অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৫
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি শান্ত হয়ে বসে ছিল। তার সামনেই সমানে পায়চারি করে চলেছেন আরিশা খন্দকার। আরুশি নিজের মায়ের এমন অবস্থা দেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে বলে,”তুমি এতো চিন্তা কেন করছ আম্মু? পাপা ঠিক ফিরে আসবে।”
আরিশা খন্দকার বলে ওঠেন,”আমি কেন জানি নিশ্চিত হতে পারছি না৷ তুই তোর পাপাকে একটা কল লাগা না।”
আরুশি মাকে শান্ত করার উদ্দ্যেশ্যেই ফোন লাগাল তার বাবার ফোনে। কিন্তু জাঈদ শেখ ফোনটা রিসিভই করল না। আরিশা খন্দকার ভয়ে বলে উঠলেন,”নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে ওর। নাহলে ফোন কেন রিসিভ করবে না।”
“উফ, আম্মু। পাপা তো কোন কাজে ব্যস্তও থাকতে পারে। তুমি এত দুশ্চিন্তা করো না নাহলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে।”
এমন সময় আরহাম সেখানে চলে আসে। আরহাম এসেই বলে ওঠে,”তুমি চিন্তা করছ কেন খালামনি? কিছু কি হয়েছে?”
আরিশা খন্দকার আরহামকে বলেন,”দেখো না, তোমার খালু হঠাৎ করে একটা জরুরি ফোন পেয়ে সেই কোন সকালে বেরিয়ে গেলেন পার্টি অফিসে কিন্তু এখনো তার আসার কোন খোঁজ নেই।”
“আচ্ছা, তুমি এত চিন্তা করো না। আমাকে পার্টি অফিসের ঠিকানাটা বলো আমি গিয়ে দেখে আসছি।”
আরিশা খন্দকার ঠিকানাটা বলে দেন। আরহাম বলে,”তুমি এখন নিশ্চিন্তে থাকো। আমি গিয়ে খালুকে নিয়ে আসবো৷ আরুশি তুমি খালামনিকে সামলাও।”
আরুশি মাথা নাড়ায়৷ আরহাম বেরিয়ে যায়। আরুশি এবার আরিশা খন্দকারকে টেনে খেতে বসায়। যদিও তিনি কিছু খেতে চাইছিলেন না তবুও আরুশি জোর করে খাইয়ে দেয়। আরিশা খন্দকার একসময় বলেন,”আরু..আমি আর পারবো না। জোর করিস না।”
“না, আম্মু। তোমাকে পুরো খাবারটা খেতে হবে।”
“শোন, এমন জেদ তোর বাচ্চার সাথে করিস। আমি আর কতদিন আছি বল?”
“আম্মু, তোমায় বলেছি না, এমন কথা না বলতে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রেগে বলে আরুশি। এরইমধ্যে আরিশা খন্দকার উঠে গিয়ে আরুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”আমি থাকি বা না থাকি, তুই সবসময় আমার দেয়া শিক্ষাগুলোকে জীবনে কাজে লাগাবি। কখনো না কোন অন্যায় করবি আর না অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবি। সবসময় ন্যায়ের পথে থাকবি। বুঝলি?”
আরুশি মাথা নাড়ায়। আর বলে,”কিনে তোমাকেও আমার সাথে থাকতে হবে। কথা দাও আমার সাথে থাকবে।”
“শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকব।”
বলেই আরিশা খন্দকার এবার ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসে টিভি অন করেন। আরুশিও এসে তার পাশে বসে। টিভি অন করে নিউজ চ্যানেলে যেতেই ব্রেকিং নিউজে ভেসে ওঠে,”সিলেটে বাংলাদেশ *** রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসে বিরাট গণ্ডগোল! এখনো অব্দি ৫ জন হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ মাঠে নেমেছে কিন্তু এখনো অব্দি রণক্ষেত্র সিলেট!”
নিউজটা দেখামাত্রই আরিশা খন্দকারের অন্তরাত্মা কেপে ওঠে। আরুশিও ভয়ার্ত কন্ঠে বলে ওঠে,”পাপা!”
আরিশা খন্দকার আর শান্ত থাকতে পারেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,”জাঈদ তো ওখানেই গেল ওর কিছু হয়নি তো…নাহ,জাঈদের কিছু হতে পারে না..কিছু না..আমি ওর কিছু হতে দেবো।”
বলেই তিনি দৌড়াতে শুরু করেন। আরুশি,”আম্মু, দাঁড়াও,যেওনা এভাবে..”
বলে আরিশা খন্দকারের পিছু নেয়। আরিশা খন্দকার দ্রুত বাইরে এসে গাড়ি নিয়ে নেয়৷ অতঃপর ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলে৷ আরুশি বের হতে হতেই তিনি গাড়ি নিয়ে রওনা হন। এদিকে আরুশি বাইরে এসে দেখে আর কোন গাড়ি নেই৷ তাই সে আর কোন উপায়ন্তর না দেখে বাইরে এসে একটা অটোরিকশা নেয় পার্টি অফিসে পৌঁছানোর জন্য।
আরিশা খন্দকার পার্টি অফিসের সামনে পৌঁছেই দেখেন সেখানে পুলিশের ব্যারিকেড দেয়া। চারপাশে হাজারো মানুষের ভীড়। এত ভীড়ের মাঝে তিনি ভিতরে প্রবেশ করতে চান। কিন্তু একজন পুলিশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”ম্যাম, ভেতরকার অবস্থা এখন ভালো না। এখানেই থেমে যান।”
আরিশা খন্দকার বলে ওঠেন,”আমাকে যেতে দিন অফিসার৷ আমার স্বামী ভেতরে আছে। আমায় ওকে বাঁচাতে হবে।”
“এভাবে যাওয়া সম্ভব না। আমরা তো দেখছি ব্যাপারটা শান্ত হন।”
আরিশা খন্দকার তবুও শান্ত হন না৷ একসময় পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি ভিতরে ঢুকে যান। একজন পুলিশ তাকে দেখে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু ততক্ষণে তিনি অফিসের ভেতরে ঢুকে যান।
আরিশা খন্দকার ভেতরে প্রবেশ করেই চারিদিকে রক্ত, নানান পড়ে থাকা অস্ত্র ও ভাঙাচোরা আসবাপত্র দেখে ভয় পান কিছুটা। শুকনো ঢোক গিলে সামনে আগাতে থাকেন। কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান অনেক দেহ পড়ে আছে। তিনি এবার ভীষণ ভয় পেয়ে যান। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলেন,”জাঈদ..কোথায় তুমি?”
কিন্তু কোন সাড়া আসে না। আরিশা খন্দকার ভীত হয়ে পড়েন৷ আর পা আর চলছিল না। কিছুটা এগিয়ে পা ফসকে পড়ে যান এবং সামনে তাকাতেই যা দেখতে পান তাতে তার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। সামনেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন জাঈদ শেখ। সেটা দেখেই আরিশা খন্দকার চিৎকার করে ওঠেন। জাঈদ শেখের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেন,”জাঈদ..চোখ খোলো..দেখো আমি এসে গেছি। তোমার কিছু হবে না। আমি তোমায় রক্ষা করব। তাকাও আমার দিকে..”
কিন্তু জাঈদ শেখ কোন সাড়া দেন না। আরিশা খন্দকার পাগলের মতো কাঁদতে থাকেন। পাশে পড়ে থাকা একটা পাতির বোতল তুলে নিয়ে জাঈদ শেখের মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বলে,”চোখ খুলে তাকাও লক্ষীটি..তুমি না বলেছিলে ফিরে গিয়ে আমাদের সাথে একসাথে ডিনার করবে। আরু তোমার অপেক্ষায় বসে আছ। প্লিজ চোখ খোলো..”
কিছু সময় পর জাঈদ শেখ চোখ খুলে তাকান৷ আরিশা খন্দকারের চোখে খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে। তিনি বলে ওঠেন,”তাকাও আমার দিকে..”
“আরিশা..তুমি চলে যাও। এখানে থাকলে তোমার বিপদ হতে পারে৷ ওরা আমাদের সবাইকে শেষ করে দিতে চায়।”
“কার কথা বলছ তুমি? কেউ আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”
“তুমি যাও আরিশা। জেদ করো না।”
“না, আমি কোথাও যাব না। যদি বাঁচতে হয় আমরা একসাথে বাঁচব আর মরতে হলে একসাথে মরব।”
“আরিশা! জেদ করো না। আমাদের মধ্যে একজনকে থাকতে হবে। নাহলে আমাদের প্রিন্সেসকে কে সামলাবে? তুমি যাও এখান থেকে।”
এমন সময় হঠাৎ করে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ আসে আরিশার নাকে। তিনি বলেন,”কিসের গন্ধ এটা..”
আচমকা জাঈদ শেখ সজাগ হয়ে আরিশা খন্দকারকে জড়িয়ে ধরেন শক্ত করে। আরিশা খন্দকার জাঈদ শেখের এই আলিঙ্গনে হারিয়ে যান তাদের অতীতে। জোরপূর্বক বিয়ে থেকে শুরু করে, হাজার লড়াই, কষ্টের পর তারা এক হন। অবশেষে আরুশির আগমনে তাদের জীবন পরিপূর্ণ হয়। সব সুখের স্মৃতিই যেন আজ বেশি করে মনে পড়ছিল। জাঈদ শেখ আরিশাকে জড়িয়ে ধরে শেষবারের মতো বলেন,”ভালোবাসি…”
আরিশা খন্দকারও বলে ওঠেন,”আমিও তোমাকে ভালোবাসি..”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৪
এমন সময় গোটা পার্টি অফিস একটা বিস্ফোরণে কেপে ওঠে। চারিদিকে আগুনির ফুলকি বের হতে থাকে। আশেপাশে থাকা সবাই হতবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখতে থাকে। নিমেষের মধ্যেই যেন পুরো পার্টি অফিসটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। আর তার সাথে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় দুটি প্রাণ। আরুশি বিস্ফোরণের কিছু সময় পরই ছুটে আসে৷ আরহাম তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকেই ছুটে আসে। পুলিশি ব্যারিকেড অতিক্রম করে সে ভেতরে যেতে পারেনি তাই এতক্ষণ বাইরেই ছিল৷ আরুশি এসেই এভাবে পার্টি অফিসে আগুন জ্বলতে দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে,”পাপা!”
আর কিছু বলতে পারে না সে। সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে যায়। আরহাম তাকে আগলে নেয়