অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৩

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৩
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি সবার দিকে তাকায়। প্রায় সবার চোখেই যেন তার প্রতি অবিশ্বাস। তবুও সে বলে ওঠে,”আমার পাপা, আম্মু এত বড় অন্যায়ের সাথে জড়িত হতে পারে না। এই মহিলা মিথ্যা বলছে।”
আদৃতা বলে ওঠেন,”সবাইকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ? আর আমি নাহয় মিথ্যা বলছি তাহলে কি এখানে এত সব লোক সবাই মিথ্যা বলছে?”

আরুশি আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় নির্ঝর খান বলে ওঠেন,”এই মেয়ে চুপ করো তুমি। তোমার কোন কথা আমার আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। তুমি একটা খু*নির মেয়ে।”
আফিফা খান বলে ওঠেন,”নির্ঝর! কি বলছ তুমি এসব! দোহাই লাগে, চুপ করো। ও তোমার পুত্রবধূ হয়। ওর সাথে তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না।”
নিঝুম খানও বলেন,”হ্যাঁ, নির্ঝর। তুই এভাবে বলতে পারিস না। আমি আদৃতাকে একদম বিশ্বাস করি না আর নাতো ওর আনা এসব প্রমাণকে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নির্ঝর খান বলেন,”তোমরা বিশ্বাস না করলেও আমি করি। তোমরা ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি জাঈদ শেখের অতীত কেমন ছিল। একজন স্পয়েল ব্রাট ছিল ও, রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করত, আফিফাকেও তো বিরক্ত করত, আরিশাকেও তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল, আমাকে এক্সিডেন্ট করে মেরে ফেলারও চেষ্টা করেছিল যখন আমি আফিফাকে উত্তক্ত করার জন্য ওকে গায়ে হাত তুলেছিলাম৷ এসব কিছু আমি ভুলে যাইনি।”
আরুশি কানে হাত দিয়ে বলে,”চুপ করুন প্লিজ। আমি আমার পাপার বিরুদ্ধে আর একটা কথাও শুনতে চাই না।”
“শুনতে না চাইলে বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে। তোমার মতো একটা খুনির মেয়েকে আমার আর একটুও সহ্য হচ্ছে না।”

আরুশি আরো একবার আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম তখনো অব্দি চুপ ছিল। আমান এগিয়ে এসে নির্ঝর খানকে বলেন,”ড্যাড, তুমি এত রাগারাগি করো না। আমি জানি, সব কিছু শুনে তোমার ভীষণ রাগ হচ্ছে আমাদের সবারই হচ্ছে কিন্তু তাই বলে আরু আপাইকে এসব বলা ঠিক হচ্ছে না। যদি এসব কিছু সত্যও হয় তাহলেও তোর আপাইয়ের কোন দোষ নেই এখানে।”
“দোষ আছে। ও যদি আমার চোখের সামনে থেকে তাহলে আমার মনে হবে, আমার বোনের খু*নির মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সেটা মেনে নিতে পারবো না।”
এরমধ্যে সায়রাও আমানের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমি একটা খু*নির মেয়ের হয়ে কথা বলছ কেন আমান? তোমার থেকে এটা আশা করি নি।”
সায়ন চৌধুরী সায়রাকে বলেন,”সায়রা এভাবে বলো না কিছু। আমার মনে হচ্ছে, এই ব্যাপারে আরো তদন্ত প্রয়োজন।”

নির্ঝর খান বলেন,”কোন তদন্তের প্রয়োজন নেই আর। সব সত্য দিনের আলোর মতো পরিস্কার। জাঈদ শেখ একজন খুনি সেই খুন করেছে আমার বোনকে।”
আরুশি চিৎকার করে বলে,”খবরদার আমার বাবাকে আর একবার খুনি বলবেন না নাহলে আমি…”
এরমধ্যে নির্ঝর খান বুকে হাত দিয়ে অনেক কষ্টে বলে ওঠেন,”একশোবার বলব..হাজারবার বলব..কি করবে তুমি? তোমার বাবা খুনি..”
বলেই নির্ঝর খান পড়ে যেতে নেন। আরহাম তাকে সামলে নেয়। আমানও ছুটে যায় নিজের বাবার কাছে। আফিফা খান, সায়ন চৌধুরীও। নির্ঝর খান ধীর স্বরে বলেন,”ও একটা খু*নির মেয়ে..”
আরহাম আমানকে বলে,”ভাই তাড়াতাড়ি গাড়ি বের কর। ড্যাডের অবস্থা ভালো ঠেকছে না। ওনাকে হাসপাতালে নিতে হবে দ্রুত।”

আমান মাথা নাড়ায়। আরুশি এগিয়ে আসতেই আরহাম তার উদ্দেশ্যে বলে,”তুমি কেন এসেছ এখানে? দূরে থাকো আমার ড্যাডের থেকে।”
আরুশি হতবাক স্বরে বলে ওঠে,”আরহাম!”
“তোমার জন্যই আমার ড্যাডের আজ এই অবস্থা। তুমি কেন শুধু শুধু আমার ড্যাডের সাথে নিজের খু*নি বাবাকে নিয়ে তর্ক করতে গেলে? আজ যদি আমার ড্যাডের কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি তোমায় কখনো ক্ষমা করব না”
আরুশি কান্নারত স্বরে বলে,”আমার ড্যাড খু-নি নয়..”
আরহাম আরুশির কোন কথাই শোনে না। আরহাম গাড়ি বের করলে নির্ঝর খানকে সবাই মিলে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যান। আরুশি সেখানে একাই দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ সে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। তখন সেখানে উপস্থিত আনিকা খান ও নিঝুম খান তাকে আগলে নেয়।

আরুশির জ্ঞান ফিরতেই সে আনিকা খানকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পায়। আনিকা খানকে দেখেই সে বলে,”নানি! তুমি বিশ্বাস করো, আমি পাপা খু*নি নয়৷ আর নাতো আমার আম্মু কোন সত্য আড়াল করেছে। তুমি তো আমার আম্মুকে চেনো বলো?”
আনিকা খান বলেন,”হ্যাঁ, চিনি৷ আরিশা জন্ম না দিলেও ওকে আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। আমি জানি, ও খারাপ কিছু করতে পারে না।”
“তাহলে সবাই কেন ওদেরকে খারাপ বলছে? আরহামও ওদের সাথে তাল মেলাচ্ছে।”
“আরহাম দাদুভাই এখনো ছেলেমানুষ তাই কিছু বুঝতে পারে নি। আজ নিজের বাবার এরকম অবস্থা দেখে কোন ছেলের পক্ষেই ঠিক থাকা সম্ভব নয়। তুমি এতটা ভেঙে পড়ো না দিদিভাই। দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তোমার শরীরও তো ভালো লাগছে না। কি হয়েছে তোমার?”
“জানি না, হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে উঠল।”
“আচ্ছা, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নাও। আমি আসছি।”

দুপুরের দিকে আরুশি একটু বিশ্রাম নিয়ে নিজের রুম থেকে বের হয়ে কিচেনের দিকে যায়। আফিফা খান রান্না করছিল। আরুশি সেখানে এসে বলে,”খালামনি! তুমিও কি সবার মতো আমায় ভুল বুঝবে?”
“ধুর পাগল! আমি কেন তোকে ভুল বুঝতে যাব? আমি নিজের বোনুকে চিনি আর তোকেও। আমি জানি, তোরা কখনো ভুল হতে পারিস না। নির্ঝর আর আরহাম শুধু শুধুই তোকে এত কথা শোনালো। যাইহোক, আমি খাবার বানিয়েছি। তুই এগুলো নিয়ে একটু হাসপাতালে যা তো।”
“আঙ্কেলের অবস্থা এখন কেমন?”

“ভালোই আছে। মাইল্ড এট্যাক হয়েছে ডাক্তার বলেছে একটু সাবধানে থাকতে। তুই এই খাবার নিয়ে হাসপাতালে যা। আমিই যেতাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোর যাওয়াই ভালো হবে। কেননা, আরহামের সাথে তোর সামনাসামনি কথা বলা দরকার। যাতে ভুল বোঝাবুঝি আর না বাড়ে।”
নিঝুম খানও এগিয়ে এসে বলেন,”বৌমা একদম ঠিক বলেছে। ঐ আদৃতাকে আমরা কেউ বিশ্বাস করি না। আরুশি তুমি যাও। আরহামকে বুঝিয়ে সবটা বলো।”
“ঠিক আছে।”

আরুশি হাসপাতালে যাওয়ার পথে হঠাৎ করে ভীষণ বমি করতে লাগল। এছাড়া কিছুদিন ধরেই তার ভীষণ মাথাব্যথাও করছে। এসব নিয়ে কিছুটা সন্দেহ হচ্ছিল তাই হাসপাতালে পৌঁছেই প্রথমে নিজের চেকআপ করিয়ে নিলো। আর তারপর এমন কিছু জানল যা তাকে অবাক করল!
“কংগ্রাচুলেশনস মিসেস আরুশি। আপনি মা হতে চলেছেন!”
আরুশি নিজের রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সে ভাবতেও পারেনি এত বড় একটা সুখবর পাবে এত সমস্যার মাঝে। আরুশি বলে ওঠে,”আমি এক্ষুনি গিয়ে আরহামকে সুখবরটা দেই..ও এসব শুনে নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হবে।”

ডাক্তার আরহামের দিকে তার বাবার রিপোর্ট বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,”আপনার বাবা এই যাত্রায় বেঁচে গেলেও সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত হন নি। আবারো বড় কোন দুশ্চিন্তায় ওনার বড় সমস্যা হয়ে যেতে পারে এমনকি মৃত্যুও। তাই আপনি দেখবেন, উনি যাতে বেশি টেনশন না পান। ওনার সব কথা মেনে চলার চেষ্টা করবেন।”
“জ্বি, ডক্টর। এখন কি আমি ড্যাডের সাথে দেখা করতে পারি?”
“হুম।”
আরহাম গিয়ে তার বাবার সাথে দেখা করে। নির্ঝর খানের জ্ঞান ছিল। তিনি আরহামকে দেখেই বলে ওঠেন,”আরহাম তুমি এসেছ।”
“হুম, ড্যাড।”
“আমাকে একটা কথা দেবে?”
“কি?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩২

“আমাকে ওয়াদা করো, ঐ খু*নির মেয়েটাকে তুমি ডিভোর্স দেবে। আমি ওকে নিজের চোখের সামনে সহ্য করতে পারব না।”
আরহাম ডাক্তারের বলা কথাগুলো মনে করে ভাবে,”ড্যাডকে বাচাতে এখন এই মিথ্যা কথা আমায় দিতেই হবে।”
তাই সে বলে,”আচ্ছা ড্যাড। আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেব।”
হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে তাদের বলা কথোপকথন শুনে নেয় আরুশি। তার সব খুশি এক পলকে মিলিয়ে যায়। হাত থেকে প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট কার্ডটাও পড়ে যায়।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৪