অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৪

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৪
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি হতাশ মনে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসে। তার কানে বাজতে থাকে আরহামের বলা শেষ কথাগুলো। অসুস্থ অবস্থায় সে নিজের বাবাকে যেই কথা দিয়েছে সেই কথা তো অবশ্যই রাখবে। আরুশি নিজের পেটে হাত দিয়ে বলে,”তাহলে তোর কি হবে সোনা? ওরা সবাই কি তোকেও আমার থেকে আলাদা করে দেবে? কিন্তু তুই ছাড়া যে এখন এই দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। নাহ, আমি তোকে নিজের থেকে আলাদা হতে দেব না। প্রয়োজনে তোকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাব।”

বলেই আরুশি উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় হাটতে থাকে। তার মাথা ভীষণ ঘুরছিল। সে নিজের ভাবনায় এতোটাই বিভোর ছিল যে হাঁটতে হাঁটতে কখন মেইন হাইওয়েতে চলে এসেছিল সেটা খেয়ালও করে নি। এমন সময় বিপরীত দিক থেকে দ্রুত বেগে একটা গাড়ি তার দিকেই ছুটে আসছিল। সরে যাওয়ার জন্য হর্নও বাজাচ্ছিল কিন্তু আরুশি সেটা শুনতেই পারছিল না৷ গাড়িটা আরুশিকে ধাক্কা দিতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ কেউ একজন এসে আরুশিকে টেনে সরিয়ে আনে। আরুশি যেন এক পলকে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে।
রাজীব রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,”আরু..তুমি..এভাবে কেয়ারলেসের মতো রাস্তায় হাঁটছিলে কেন? আমি যদি সঠিক সময় না আসতাম তাহলে কি হয়ে যেত?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুশি নিশ্চুপ ভাবে রাজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাজীব কি বলছিল কিছুই তার কানে যাচ্ছিল না। তার কানে তখনো আরহামের বলা কথাটা বাজছিল,”আমি আরশিকে ডিভোর্স দিয়ে দেব ড্যাড..”
আরুশির চোখ দিয়ে না চাইতেও জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজীব সেটা খেয়াল করে বলে,”কি হয়েছে আরু? তুমি এভাবে কাঁদছ কেন?”
“আমাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাবেন রাজীব ভাই? এতোটা দূরে যেখানে গেলে আর কেউ আমার খোঁজ পাবে না..”
“মানে? এসব কি বলছ তুমি? কি হয়েছে তোমার? তোমায় কি আমি তোমার বাড়িতে দিয়ে আসব?”
আরুশি ভয়ে তটস্থ হয়ে বলে,”নাহ, আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরবো না। দয়া করে আমায় অন্য কোথাও নিয়ে চলুন।”
রাজীব বুঝতে পারল আরুশির নিশ্চয়ই বড় কোন সমস্যা হয়েছে৷ তাই সে বলে,”বেশ, তাহলে তুমি আমার সাথে চলো। আমি আপাতত ঢাকায় নিজের বাসায় আছি৷ তবে আজকেই আমায় আবার খুলনায় ফিরতে হবে। আমি দেখছি কি করা যায়।”

রাজীবের সাথে তার বাসায় চলে আসে আরুশি। সে রাজীবদের বাসার সোফায় বসে ছিল৷ রাজীব এখানে একাই থাকে। এটা মূলত তার ঢাকার বাসা। ঢাকায় এলে সে এখানেই থাকে। রাজীব আরুশির দিকে একটা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,”এই নাও আরু। পানিটা খেয়ে নাও। তারপর আমায় সবকিছু খুলে বলো তো।”
আরুশি পানিটা খেয়ে নেয়। অতঃপর কান্নারত গলায় রাজীবকে শুরু থেকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে৷ সব শুনে রাগে রাজীব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে বলে,”এসবের মানে কি? এভাবে হঠাৎ কেউ একজন এসে কিছু বলল আর সবাই তাকে বিশ্বাস করে নিল?”
“সবাই বিশ্বাস করে নি। শুধুমাত্র নির্ঝর আঙ্কেল, আরহাম, সায়রা এরা তিনজনই বিশ্বাস করে নিয়েছে। বাকি সবার মনে সন্দেহ আছে।”
“তোমার কোন ভয় নেই আরু। আর কেউ তোমার পাশে না থাকলেও আমি তোমার পাশে থাকব। সত্যটা আমি যে করেই হোক বের করে আনব।”

“কিন্তু আরহাম যে ওর বাবাকে কথা দিয়েছে যে আমায় ডিভোর্স দেবে..সেই কথা ও নিশ্চয়ই রাখবে। কিন্তু আমি তো প্রেগন্যান্ট..এই অবস্থায় তো ডিভোর্স হবে না। তাহলে…তাহলে নিশ্চয়ই আমার বাচ্চা জন্ম হওয়ার পরই ও আমায় ডিভোর্স দেবে। তারপর আমাকে আমার বাচ্চার কাছ থেকে চিরতরে আলাদা করে দেবে।”
“আরু..কাম ডাউন..আমি আছি তো। আমি এমন কিছু হতে দেব না। তোমার বাচ্চা তোমার কাছেই থাকবে।”
“নাহ, আপনি জানেন না রাজীব ভাই। নির্ঝর আঙ্কেলের চোখে আমি নিজের জন্য চরম ঘৃণা দেখেছি। উনি কিছুতেই আরহাম আর আমাকে একসাথে থাকতে দেবেন না। আমি এমনিই নিজের সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। আমার আম্মু-পাপা আমায় ছেড়ে চলে গেছেন, এখন আমি শুধু আরহামকেই আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু…”
আরুশি নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”এখন এই বাচ্চাটা ছাড়া যে আমার আপন বলে কেউ নেই। যদি ওকেও ওরা আমার থেকে আলাদা করে দেয় তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচব? তখন যে আমার মরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।”

“আরু প্লিজ চুপ করো। এমন কথা মুখেও এনো না। আমি তোমার পাশে আছি। আমি কথা দিচ্ছি তোমার সাথে আর কোন খারাপ কিছু হতে দেব না। সব সত্য আমি সামনে আনবো। প্রয়োজনে নিজের সব শক্তি কাজে লাগাব।”
“বিশ্বাস করুন রাজীব ভাই,,,এখন আমার আর কারো সাথে লড়াই করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই। আমি চেয়েছিলাম নিজের আম্মু-পাপার নির্দোষতা প্রমাণ করতে কিন্তু নিজের বাচ্চার ব্যাপারে জানার পর..আমি সেই সাহস আর এখন পাচ্ছি না। আপাতত আমি নিজের বাচ্চাকে ভালো ভাবে,একটা সুস্থ পরিবেশে পৃথিবীতে আনতে চাই। আমি চাই না,ও এরকম একটা টক্সিক পরিবেশে জন্ম নিয়ে একটা টক্সিক জীবন পাক। আমার সাথে যা হয় হোক কিন্তু আমি নিজের বাচ্চার উপর খারাপ কিছুর ছায়া পড়তে দেব না।”

“তাহলে কি চাও তুমি আরু?”
“আমি আপাতত এখান থেকে ভীষণ দূরে কোথাও চলে যেতে চাই। যেখানে গেলে কেউ আর আমার কোন খোঁজ পাবে না।”
“তুমি যা বলছ ভেবে বলছ তো? আবেগের বশে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিও না আরু যার জন্য পরে পস্তাতে হয়।”
“আমি যা বলছি ভেবেই বলছি। আমি আরহামের চোখে আজ নিজের জন্য শুধু অবিশ্বাসই দেখেছি। ওর সব ভালোবাসা যেন মিথ্যা অভিযোগের আড়ালে হারিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ওর সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। ও পারলে আমার সন্তানকেও আমার থেকে আলাদা করে দেবে।”

“বেশ, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছ তখন আমি আর বিরোধ করব না। আমি আজ খুলনা ফিরে যাব নিজের ডিউটিতে যোগ দিতে। তুমি তো জানো, আমার মা-বাবা কেউ নেই। দুজনেই কিছু বছর আগে এক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। এখন আমার আপন বলতে আমার ফুফুই আছেন। উনিও খুলনাতেই আছেন। ওনার জীবনটাও ভীষণ কষ্টের। আমার মনে হয়, খুলনায় গেলে উনি তোমার খেয়াল রাখতে পারবেন।”
আরুশি বলে,”বেশ, তাহলে আপনি আমায় খুলনায় নিয়ে চলুন রাজীব ভাই।”
“তুমি আগে শিওর হও। তুমি কি এই বাচ্চাটার ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাবে না বা খুলনায় যাওয়ার ব্যাপারে? আরহামকে না বলো অন্তত পরিবারের অন্য কাউকে..”

“না..এই মুহুর্তে যদি আমি কাউকে কিছু বলি তারা আমায় দূরে যেতে দেবে না। কিন্তু আমার এখন দূরে যাওয়াটা ভীষণ প্রয়োজন।”
“কিন্তু..”
“কোন কিন্তু না রাজীব ভাই। আপনি যদি আমায় নিয়ে যেতে না চান তাহলে আমায় বলে দিন আমি একাই যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাব।”
“পাগল নাকি? আমার বিপদে তুমি আমার পাশে ছিলে তাই এই অবস্থায় আমি তোমাকে কিছুতেই একা ছাড়ব না। বেশ, তুমি যখন চাইছ আমি তোমায় খুলনায় নিয়ে যাব।”
আরুশি এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ফেলে।

আরহাম বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরে। আজ তার উপর দিয়ে অনেক বড় মানসিক ঝড় বয়ে গেছে। আরহাম তখন আরুশির সাথে করা খারাপ ব্যবহার গুলো মনে করে ভীষণ পস্তায়। মনে মনে বলে,”এবার আমি গিয়ে আরুশির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। তখন রাগের মাথায় কি না কি বলে দিয়েছি…”
কিন্তু নিজেদের রুমে গিয়ে সে আরুশির দেখা পায় না। এমনকি গোটা বাড়ি খুঁজেও না। ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে ছুটতে থাকে গোটা বাড়িময়। আফিফা খান এই অবস্থা দেখে বলেন,”কি হয়েছে আরহাম? তুমি এমন করছ কেন?”
“মম, আরুশি কোথায়?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৩

“আরুশি..ও তো হাসপাতালে তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে গেছিল। কেন তোমার সাথে ওর দেখা হয়নি?”
“কি বলছ তুমি? তাহলে আরুশি এখন কোথায়?”
আরহাম দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৫