অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৯

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৯
ইয়াসমিন খন্দকার

নির্ঝর ও আফিফা একসাথে নিজেদের ঘরের দিকে যেতে ধরেছিল। ঠিক সেই সময়েই সেখানে এসে উপস্থিত হলো জাঈদ ও আরিশা৷ জাঈদ আরিশার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। তাদের দুই জনকে একসাথে দেখে উপস্থিত সবাই চরম অবাক হয়। আফিফা অবাক স্বরে বলে,”আরিশা! বোনু তুই এই ছেলেটার সাথে কি করছিস?”
আনিকা খান বলেন,”ইনি কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর শেখের ছেলে না? কিন্তু এখানে কি করছেন আর আরিশাই বা ওনার সাথে কি করছে?”

নির্ঝরও অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। জাঈদ আরিশাকে সাথে নিয়ে সবার সামনে এসে বলে,”শুধু নিজেদের বড় মেয়েকে দোয়া করলেই তো চলবে না, আপনারা নিজেদের ছোট মেয়েকেও দোয়া করুন।”
ছবি বেগম জিজ্ঞেস করেন,”তুমি কে? আর কিসব বলছ? আরিশাকে দোয়া করব কেন?”
জাঈদ শেখ বাকা হেসে বলে,”কারণ আমি আরিশাকে বিয়ে করেছি৷ তাই আপনাদের তো উচিৎ নবদম্পতির জন্য দোয়া করা তাইনা? শুধু তাই নয়, আপনাদের ছোট মেয়েকে বিদায়ও তো দিতে হবে!”
জাঈদের কথা শুনে উপস্থিত সবাই ভীষণ পর্যায়ের অবাক হয়। কারো মুখে কোন কথা নেই। আবির খান বলে ওঠেন,”এসব কি বলছ কি তুমি ছেলে? আমার মেয়ে, আমার আরিশা ওকে তুমি বিয়ে করেছ?”
জাঈদ বলে,”হ্যাঁ করেছি।”
আনিকা বলে,”এটা কিভাবে সম্ভব? আরিশা তুমি এভাবে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিলে! আমাদের কে কি নিজের পরিবার মনে করো না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আফিফা এগিয়ে এসে আনিকার হাত ধরে বলে,”এসবের মানে কি বোনু? তুই এই বখাটে ছেলেটাকে কিভাবে বিয়ে করলি? নিশ্চয়ই এর পেছনে কোন রহস্য আছে। এই ছেলেটা নিশ্চয়ই কোন চক্রান্ত করে তোকে বিয়ে করেছে, তাই না? সত্যি করে বল আমায় সব৷ আমি বিশ্বাস করি, আমার বোনু এরকম বখাটে একটা ছেলেকে বিয়ে করবে না।”
জাঈদ শেখ বলে,”এই বখাটে কাকে বলছেন? আমার স্ত্রীর বড় বোন জন্য আপনাকে সহ্য করছি অন্য কেউ হলে..যাইহোক আমরা একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছি। তাই না আরিশা?”

বলেই আরিশার দিকে অন্যরকম একটা দৃষ্টিতে তাকায় আরিশা। তার চাহনিতে স্পষ্ট সতর্কবার্তা ছিল৷ আরিশা শুকনো একটা ঢোক গিলে। তার মনে পড়ে যায় কিছু সময় আগে জাঈদ তাকে কি হুমকি দিয়েছিল। এই বাড়িতে আসার সময়ই জাঈদ কার্যত তাকে হুমকি দিয়ে বলে, যদি সে সবাইকে সত্যটা বলে দেয় তাহলে আফিফা ও নির্ঝরের ক্ষতি করবে৷ এই ভয়েই আরিশা থমকে যায়। সে চায় না তার বোন কিংবা নির্ঝর এর কোন ক্ষতি হোক৷ তাই সে কান্নারত স্বরে বলে,”উনি যা বলছেন তাই সত্য। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি আপ্পি! আর সেজন্যই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি। আমি ভয়ে ছিলাম যে আমাদের সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে কিনা। আর এই ভয় থেকেই আমরা লুকিয়ে বিয়েটা করে নেই।”
“বোনু!”
নিঝুম ও আবরাজ খানও অবাক হয়ে সব দেখছিলেন। আদৃতা তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”মম, ড্যাড তোমরা দেখ। কেমন মেয়ের সাথে ব্রোয়ের বিয়ে দিলে। যার বোন এভাবে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে তার চরিত্র আর কত সুন্দর হবে বোঝাই যায়।”

আবরাজ খান রেগে বলেন,”আহ, আদৃতা। তুমি চুপ করো। অবস্থাটা বুঝতে দাও।”
নিঝুম বলে,”হ্যাঁ, আদৃতা তোমার এই ব্যাপারে কিছু না বলাই ভালো। এমনিতেই পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না।”
এরইমধ্যে ছবি বেগম বলে ওঠেন,”এটা তো হওয়ারই ছিল। এজন্যই বলে পর কোনদিন আপন হয়না!”
আবির খান হতবাক স্বরে বলে ওঠেন,”আম্মু!”
আফিফা ও আরিশাও অবাক চোখে ছবি বেগমের দিকে তাকায়। আফিফা বলে,”এসব তুমি কি বলছ দাদি? বোনু আমাদের পর হতে যাবে কেন? ও আমার বোন, আম্মু-আব্বুর মেয়ে,তোমার নাতনী..”
আনিকা খান মাথা নিচু করে নেন। তার এতদিনের লুকিয়ে রাখা সত্যটা কি তবে এবার সামনে আসতে চলেছে। এই ভাবনায় তার বুক কেপে ওঠে। আবির খানও বলে ওঠেন,”আরিশা আমাদের পর নয়। ও আমার মেয়ে…হ্যাঁ হয়তো আজ ও একটা অন্যায় করে ফেলেছে কিন্তু তাই বলে ও আমাদের পর হয়ে যায় নি। আমি আর আনিকা মিলে ওকে মানুষ করেছি। আমি এই হুইল চেয়ারে করে ওকে প্রথম খাইয়ে দিয়েছি, ও ভাসা ভাসা স্বরে আমায় বাবা বলে ডেকেছে, আমার হাত ধরে হাটা শিখেছে, আমি আর আনিকা ওকে স্কুলে নিয়ে গেছি৷ ও কিভাবে আমাদের পর হয়? আনিকা তুমি চুপ করে আছ কেন কিছু বলো?”

আনিকা খান আজ আর কিছু বলতে পারেন না। ছবি বেগম বলে ওঠেন,”তুই অনেক বোকা আবির! এক গাছের ছাল কখনো এক গাছে লাগে না। কোকিল হয়তোবা কাকের বাসায় ডিম পাড়ে এবং কাকও সেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চার জন্ম দেয় কিন্তু সেই বাচ্চাটা কোকিলের বাচ্চাই হয়, কাকের বাচ্চা নয়।”
আরিশা আজ যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছিল৷ এই একদিনের তার উপর দিয়ে আর কত ঝড় যাবে? আফিফা ছবি বেগমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”দাদি! এসব কি আজেবাজে কথা বলছ তুমি?”
আবির খানও চেচিয়ে উঠে বলেন,”আম্মু! আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করো তুমি।”

ছবি বেগম বলেন,”আমি আজ আর চুপ থাকব না। এই অকৃতজ্ঞ মেয়ের আজ সব সত্যটা জানা দরকার! এই আরিশা তুই শোন, তুই না তো আমার নাতনী, না তো আবির ও আনিকা মেয়ে আর না তো আফিফার বোন! তুই ছিলি একটা দরিদ্র পরিবারের ৫ম সন্তান! তোর বাবা-মা ভাসমান বস্তির বাসিন্দা ছিল৷ দারিদ্র্যর মধ্যে এত সন্তান পালন করতে তারা হাসফাস খাচ্ছিল৷ তাই তোর জন্মের পরই তারা তোকে হাসপাতালের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে চলে গেছিল। সেখান থেকেই আনিকা তোকে উদ্ধার করে এনেছিল কিছুদিন ধরে তোর পরিবারের খোঁজ পেয়ে তাদের আর পায়না! কারণ তারা আবার অন্য কোন শহরে চলে গেছিল৷ তখন আনিকাই তোর দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়। আমার ছেলে-বৌমা তোকে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দেয়। আমি তো শুরুতেই ওদের মানা করে দিয়েছিলাম। আনিকাও প্রথমে তোকে অনাথ আশ্রমে রাখতে চাইছিল কিন্তু এরইমধ্যে আবির তোর মায়ায় পড়ে যায়। আর তাই ওরা তোকে দত্তক নেয় নিজেদের মেয়ে থাকা সত্ত্বেও। এই সত্য এতদিন শুধু আমি, আনিকা আর আবিরই জানতাম। কারণ তোকে যখন আনা হয়েছিল তখন আফিফা দিদিভাই মাত্র ২ বছরের শিশু ছিল, আবরাজ-নিঝুম ওরা বিদেশে ছিল৷ তাই তারা মনে করে তুই সত্যিই এই বাড়ির মেয়ে। কিন্তু আসল সত্যটা হলো তুই আমাদের কেউ না। আর আজ আবার তুই নিজে এটা প্রমাণ করে দিলি।”

ছবি বেগমের কথায় যেন পুরো খান ভিলায় একটা ছোট খাটো বিস্ফোরণ ঘটে যায়। আরিশার দুচোখ বেয়ে বাঁধাহীন ভাবে অশ্রু পড়ছিল। আফিফা বলতে থাকে,”এটা হতে পারে না, আরিশা ও আমার বোন..আমি এসব বিশ্বাস করি না…বিশ্বাস করি না আমি।”
বলতে বলতেই আফিফা আরিশাকে জডিয়ে ধরে। আরিশাও আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”দাদি এসব কি বলছে আপ্পি? আমি কি তোমার বোন না? আমাকে কি ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছে ওরা? এজন্য কি আমি তোমার মতো মেধাবী নই? এজন্যই কি আমি তোমার মতো এত সুন্দরীও নই? ছোটবেলায়ও তো সবাই আমায় বলত, তোর বোন এত ফর্সা অথচ তোর গায়ের রংটা একটু চাপা! এটাই কি তার কারণ?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৮

আফিফা আরিশাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”না, তুই আমার বোনু! এটাই সত্য। আর কোন কিছু নয়।”
আরিশা আফিফাকে ছাড়িয়ে দিয়ে আনিকা খানের সামনে গিয়ে বলে,”আম্মু! তুমি সবসময় আপ্পিকে আমার থেকে বেশি আদর করেছ। আপ্পির প্রতি যতটা খেয়াল রেখেছ আমার প্রতি তেমন রাখো নি। মনে আছে, ছোটবেলায় প্রতিরাতে তুমি নিজের হাতে আপ্পিকে খাইয়ে দিতে, তাকে পড়তে বসাতে অথচ আমায় কখনো নিজ হাতে খাইয়ে দাওনি, না তো পড়তে বসিয়েছ। আমাকে হয় আব্বু খাইতে বসিয়েছে আর নয়তো আমি নিজে খেয়েছি। আমার কোন ব্যাপারেই তুমি খেয়াল রাখতে না। আমার খাওয়া,পড়া কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে না। দাদিও সবসময় আমার সাথে কেমন অস্পৃশ্যের মতো ব্যবহার করে গেছে। এটাই কি তার পেছনে কারণ? আমি কি সত্যিই তোমাদের মেয়ে না?”
আরিশা খান বলে ওঠেন,”হ্যাঁ, এটাই সত্যি!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ১০