অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪২
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহাম সরাসরি এসে দাঁড়ায় আরুশির মুখোমুখি। তার কোলে ছিল আমিনা। আর আরুশি আগলে ধরে ছিল জাঈদকে। আরহাম আরুশির কাছে এসে বলে,”আরুশি তুমি..”
আরুশি রাজীবকে লক্ষ্য করে বলে,”গাড়ি বের করো। আমরা এখনই এখান থেকে চলে যাব।”
আরহাম আরুশির কাছে আকুতির স্বরে বলে,”দাঁড়াও, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

“আমার মনে হয় না যে, আমাদের মধ্যে আরো কোন কথা থাকতে পারে। ৫ বছর আগেই সব কথা বলার স্পেস শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা দুজনেই নিজের জীবনে এগিয়ে গেছি আর তাই এখন আর কথা না বলাই বেটার হবে।”
বলেই আরুশি আরহামকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে স্থান ত্যাগ করে গাডিতে উঠে বসে। রাজীবও আর অপেক্ষা না করে গাড়িতে উঠবে বসে। অতঃপর গাড়ি চালানো শুরু করে। আরহাম হতাশ চোখে চেয়ে থেকে বলে,”তুমি তাহলে নিজের জীবনে এগিয়ে গেছ আরুশি। রাজীব ভাইয়ের সাথে নতুন জীবন শুরু করেছ। তোমাদের একটা সন্তানও আছে আর এদিকে আমি এই পাঁচটা বছর তোমার অপেক্ষায় কাটালাম। কিভাবে আমার সাথে এমনটা করতে পারলে তুমি আরুশি? এমন ভাবে তুমি আমায় ঠকাবে সেটা আমি নিজের স্বপ্নের মাঝেও ভাবি নি কখনো? কি দোষ ছিল আমার? কেন এভাবে শাস্তি পেতে হলো আমায়? কেন আরুশি কেন?।”
ছটফট করতে লাগল আরহাম। আমিনা নিজের বড় আব্বুর এরকম অবস্থা দেখে বলে,”কি হয়েচে তোমার বড় আব্বু? তুমি এমন কেন করচ?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরহাম কিছু বলে উঠতে পারে না। এমন সময় আমান সেখানে চলে আসে। আমান এসে নিজের ভাই এর এমন অবস্থা দেখে বলে,”কি হয়েছে ভাইয়া? তোমায় এমন কেন লাগছে?”
আরহাম বলে,”ও আমায় ঠকিয়েছে আমান। আমার জীবন..আমার সব কিছু ও শেষ করে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস রাখে নি। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো অভিমান করে আমার থেকে দূরে সরে গেছে ও তো..ও নতুন ভাবে নিজের জীবন শুরু করেছে। আর এদিকে আমি শুধু শুধু নিজের জীবনের পাঁচটা বছর নষ্ট করলাম।”
“মানে? এসব কি বলছিস তুই ভাইয়া? আমি কিছুই তো বুঝতে পারছি না৷ তুই সবটা একটু খুলে বল।”
“আজ আমি আরুশিকে দেখেছি।”
“আরু আপাই! কোথায় সে?”

“সে একা ছিল না। তার সাথে..তার সাথে তার নতুন স্বামী এবং সন্তান ছিল।”
“কিসব আবোল তাবোল বলছ তুমি ভাইয়া? তোমার আর আরু আপাই এর তো এখনো ডিভোর্স ই হয় নি। তাহলে আরু আপাই কিভাবে আরেকটা বিয়ে করবে। তোমার বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“কিন্তু তাহলে ঐ বাচ্চাটা..”
হঠাৎ করেই আরহামের মাথায় একটা কথা আসে। বাচ্চাটা কার সে নিয়ে তো আরুশি তাকে কিছু বলে নি। তাহলে কি এমন হতে পারে যে বাচ্চাটা তার? আরহাম কিছু বুঝে উঠতে পারে না। আরহাম মনে মনে ভাবে,”আমাকে সবটা জানতেই হবে। হয়তোবা আরুশি আমার থেকে কিছু লুকাতে চাইছে। এজন্য হয়তোবা এভাবে পালিয়ে গেল। আমি তো ঝোক এর বশে কিছু খেয়ালই করি নি। নাহ, এবার ব্যাপারটা আমায় দেখতেই হবে।”
বলেই আরহাম আমিনাকে আমানের কোলে তুলে দিয়ে বলে,”এই নে, আমিনা বুড়িকে একটু সামলা। আমি গিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে দেখি ওরা কোথায় গেল।”

আরহাম সহসা গাড়ি নিয়ে আরুশি রাজীবরা যেদিকে গেছে সেদিকে যেতে থাকে তাদের ফলো করার উদ্দ্যেশ্যে।
এদিকে গাড়ির মধ্যে আরুশি কান্নারত স্বরে রাজীবকে বলে,”ভাইয়া একটু দ্রুত গাড়ি টা চালান। আমার খুব ভয় হচ্ছে যে, আরহাম না আবার এসে আমার থেকে আমার বাচ্চাকে কেড়ে নিতে চায়।”
“তুমি ভয় পেয়ো না আরু। আমি তো আছি তোমার পাশে৷ তোমার ছেলেকে কিছুতেই তোমার থেকে দূরে যেতে দেব না।”
জাঈদও বলে ওঠে,”আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাব না, মাম্মা।”
আরুশি জাঈদের কপালে চুমু খেয়ে বলে ওঠে,”তুমি ছাড়া যে এখন আমার কাছে আর কেউ নেই সোনা। তুমিই যে এখন আমার বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।”

বলেই সে নিজের জীবনের সব দুঃখের কথা মনে করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে হাহাকার করে বলে ওঠে,”আমার জন্মের পর বেড়ে উঠতে হলো অনাথ হয়ে, তারপর মা-বাবা হিসেবে যাদের পেলাম তাদেরও তুমি আমার থেকে কেড়ে নিলে, আমার সবথেকে প্রিয় বান্ধবী আমায় ধোকা দিল, যাকে ঘিরে আমি নতুন করে জীবনটা শুরু করতে চাইছিলাম সেও আমার হাত ছেড়ে দিল, জন্মের এত বছর পর নিজের আসল মাকে খুঁজে পেয়েও আমি তাকে ধরে রাখতে পারলাম না! আর এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন আমার সন্তানও আমার থেকে দূর হয়ে যাবে!আর কত আল্লাহ আর কত? আর কত কষ্ট লেখা আমার ভাগ্যে। হে রব, তুমি এবার আমার উপর একটু রহম করো, আমার ছেলেটাকে আমার থেকে কেড়ে নিও না। ওকে হারালে যে আমার বেঁচে থাকার আর কোন কারণ অবশিষ্ট থাকবে না৷ আমার যে তখন নিজেকে শেষ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না!”

রাজীব বলে ওঠে,”এসব তুমি কি বলছ আরু? এসব কথা একদম বলবে না৷ তোমার ছেলে তোমারই থাকবে বললাম তো। ডোন্ট ওয়ারি। মরার কথা মুখে আনবে না৷ মরবে তোমার শত্রু। জাঈদ তোমার মাম্মাকে বোঝাও তো।”
আরুশি বলে,”রাজীব ভাই তুমি দেখলে তো..ওনার কোলে একটা মেয়ে ছিল। ঐটা নিশ্চয়ই ওনার দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে। উনি নিজের একটা নতুন জীবন শুরু করেছেন। নিশ্চয়ই সেই জীবনে অনেক সুখী আছেন।”
“হ্যাঁ, আমিও একটু আগে আরহামকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখলাম। সাথে ঐ বাচ্চা মেয়েটাও ছিল। কিন্তু আরহাম তোমাকে দেখার পর যেভাবে রিয়্যাক্ট করল তাতে তো রাগ বা ঘৃণার মতো কিছু ছিল না। ওর চোখে বরং কষ্ট এবং হাহাকার লুকিয়ে ছিল।”
কথাটা মাথায় আসতে আরুশি ভাবে,”ঠিকই তো! আরহামের বাবা নির্ঝর খান তো আমায় বলেছিল ও আমার উপর রেগে আছে এবং আমায় ডিভোর্স দিতে চায়। কিন্তু ওকে দেখে তো এমন কিছু মনে হলো না। ও আমার সাথে কথা বলার সুযোগ চাইছিল..তাহলে কি ও সবকিছু আবার আগের মতো ঠিক করতে চায়। আমাকে ফিরে পেতে চায় নিজের জীবনে?”

সহসাই আরুশি নিজের ভাবনা বদলে নেয়। আরহামের করা অবিশ্বাস, হাসপাতালে নির্ঝর খানকে দেয়া কথা আর তার কোলে একটা মেয়েকে দেখার কথা মনে করে আরুশি বলে,”যতো যাই হয়ে যাক,উনি আমার অতীত। হয়তো এখন উনি কোন কারণে অনুতপ্ত। কিন্তু ওনার একটা নতুন সংসার আছে। ওনার একটা মেয়েও আছে। আমি চাই না,আমার জন্য ওনার নতুন সংসারে সমস্যা হোক তা আমি চাই না। আমি নিজের সুখের জন্য অন্য কারো সুখ বরবাদ করতে পারব না। আমি নিজের ছেলের সাথে নিজের এক নতুন জগৎ গড়তে শিখে গেছি যেই জীবনে আমি সুখী হতে পারব। তাই আমি আর ওনার সঙ্গ চাই না। অন্য কারো সুখ নষ্ট করব না আমি। আমি আর আমার ছেলে; আমরা দুজনেই একে অপরের জন্য যথেষ্ট।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪১

এদিকে আরহাম হঠাৎ করে সিগনাল ও জ্যামের কারণে মাঝ রাস্তায় আটকে যায়। সে টিয়ারিং এ জোরে একটা ঘুষি মেরে বলে,”তোমাকে এতদিন পর এত কাছে পেয়েও কি আবারো আমি হারিয়ে ফেললাম আরুশি? নাহ, এবার আর আমি তোমাকে হারাতে দেব না। তোমাকে আমার মুখোমুখি হতেই হবে। অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে। অনেক সত্যের মুখোমুখি হওয়া বাকি আছে এখনো ”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৩