অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৫
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি চেয়ে আছে আরহাম ও জাঈদের পানে। বাবা-ছেলেকে একসাথে দেখে তার ভীষণ ভালো লাগছে। একইসাথে তার কিছু টা খারাপ লাগাও কাজ করছে এত দিন বাবা ছেলেকে আলাদা রাখার জন্য। আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আরহাম আরুশির দিকে তাকাতেই সে চোখ নামিয়ে নেয়। রাজীব ও আমান তাদের নিজেদের মতো কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য চলে যায়। তারা যেতেই আরহাম আরুশির কাছে আসে। আরুশি আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি জানি না..কিভাবে কি বলব..শুধুমাত্র আমার ভুলের জন্য তুমি এত গুলো বছর নিজের সন্তানের থেকে আলাদা ছিলে। আমি সত্যি..”
“দোষ তোমার একার নয় আরুশি। দোষ আমারও আছে। আমি তোমার ভরসা জিততে পারি নি আর তাই তুমি আমায় ভরসা করে উঠতে পারো নি। নিজের জীবনের এত বড় একটা কথা আমার থেকে লুকিয়েছ। আমিও সেই সময় তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম তাই হয়তোবা। কিন্তু এসব কিছুর মাঝে সবথেকে বেশি দোষ ড্যাডের। ড্যাড যে এভাবে আমাদের আলাদা করবেন তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। ওনার সামনেই তো আমি তোমার জন্য কতটা তড়পেছি৷ তবুও কি ওনার মায়া হয় নি? উনি কিভাবে তোমাকে মিথ্যা বলে আমার থেকে দূরে সরাতে পারলেন? এর জবাব ওনাকে দিতেই হবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরুশি বলে,”আরহাম, এবার আমার মনে হয় সব সত্যটা সামনে আনা উচিৎ। আমি নিজের মা বাবাকে আর দোষী দেখতে পারব না অন্যদের সামনে। অনেক আগে থেকেই আমি ফেরার কথা ভাবছিলাম। এবার আমি ফিরবোই।”
বলেই আরুশি রক্তিম চোখে তাকায়। তার চোখে নিজের মা বাবাকে নিরপরাধ প্রমাণ করার সেই আগের জেদ যেন আবার নতুন করে জেগে ওঠে। আরহাম আরুশির কাধে হাত দিয়ে ভরসা দিয়ে বলে,”আমিও আসি তোমার পাশে। আগের বার তোমার সঙ্গ দিতে পারি নি তবে এবার আর সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। এবার আমি সব সত্য টা সামনে আনবোই। আমারও মনে হয়, খালু এমন কিছু করতে পারে না। আর খালামনি সবটা জেনে লুকাবে এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাছাড়া ঐ আদৃতা নামক মহিলার অতীতের ব্যাপারেও আমি আগে কিছু জানতাম না। কিন্তু মমের কাছে আমি এখন সবটা শুনেছি। সব শোনার পর তো ওনার কথায় কোন বিশ্বাসই করা যায় না। উনি যে মিথ্যা বলছেন তা দিনের আলোর মতো পরিস্কার এবার শুধু তা সামনে আনার পালা। তার জন্য যদি আবার নতুন করে তদন্ত শুরু করতে হয় হোক। তবুও সব সত্য সামনে আসুক।”
আফিফা খানও ঢাকা থেকে খুলনায় ছুটে এসেছেন। আরুশি ও জাঈদকে দেখেই তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। প্রথমেই নিজের নাতি জাঈদকে বুকে জড়িয়ে নেন তিনি। জাঈদকে আদরে ভড়িয়ে দিতে থাকেন আর বলেন,”আমার নাতি…এত গুলো দিন আমাদের সবার থেকে দূরে ছিল ও। তবে ভাগ্য এতদিনে আমাদের দিকে আবার মুখ তুলে তাকিয়েছে। আবার সব ফিরে পেলাম। অথচ আমরা কখনো ওর কথা জানতেও পারিনি। আমার আরহামের যে একটা ছেলে আছে এটা আমরা কেউই জানতে পারি নি..”
অতঃপর তিনি আরুশির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”এতো অভিমান তোর আরু? আরহামের উপর নাহয় অভিমান করে ছিলি কিন্তু নিজের বড় খালার উপর কি একটুও ভরসা রাখতে পারিস নি? আমি তো তোকে বলেছিলাম সব কিছু থেকে তোকে আগলে রাখব..তুই যে আমার বোনুটার রেখে যাওয়া দায়িত্ব। তোর প্রতি কি আমি অবহেলা করতাম বল? করতাম না তো। তবুও তুই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলি। আরহামকে না জানা আমাকে তো বাচ্চাটার ব্যাপারে জানাতে পারতি..আমার নাতিটাকে এত দিন নিজের পরিবার থেকে কেন দূরে রাখলি তুই? তাও আবার ঐ লোকটার কথায়। আর উনিও নিজের ইগো বজায় রাখার জন্য সংসারটা পুরো তছনছ করে দিলেন। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই সবকিছুর পেছনে ঐ আদৃতা যতটা না দায়ী, আমার স্বামী নির্ঝর খান তার থেকেও বেশি দায়ী। আরহাম, আরু তোদেরও দায় আছে। আমরা চাইলেই সবাই মিলে এক সাথে হয়ে সব সত্যটা সামনে আনতে পারতাম। কিন্তু তোরা নিজেদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি বাড়িয়ে নিজেদের সম্পর্কটাকেই এমন পর্যায়ে নিয়ে গেলি যে..”
আরহাম বলে,”মম, এখন তো আর অতীত নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই৷ যা হয়েছে তা নিয়ে ভেবে তো কোন কিছু হবে না। এখন আমাদের সব এলোমেলো সম্পর্ক ঠিক করতে হবে।”
আরুশিও বলে,”হ্যাঁ, বড় খালাম্মা। অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি এবার আর আমি করবো না। এবার সব সত্য সামনে আনতে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমার বাবা যে খু*নি নয় তা আমি প্রমাণ করবোই।”
আফিফা খান এবার জাঈদকে কোলে নিয়ে বলেন,”তা আমার নাতির নাম কি রেখেছে?”
“জাঈদ।”
নামটা শুনে আফিফা খান হেসে বলেন,”হুম, তোমার পাপার সাথে অনেক মিলও আছে আমার নাতির।”
বলেই তিনি চুমু খান ছোট্ট জাঈদের কপালে। আমান ও রাজীবও সেখানে চলে আসে। সায়রাও আমিনাকে কোলে নিয়ে উপস্থিত হয়। সায়রা এসেই আরুশির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। আরুশি ধীর পায়ে সায়রার দিকে এগিয়ে এসে বলে,”আমি জানি, তুমি আমার পাপাকেই নিজের মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী ভাবো। তোমার এই ভাবনাকে আমি দোষ দেব না। কারণ সব প্রমাণও তাই বলছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত আমার পাপা এমন কিছু করে নি। আর এই সত্যটা আমি প্রমাণ করে দেব। আমি নিজের পাপা আর আম্মুকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেবো। কারণ আমি এটাও জানি, তাদের মৃত্যুটা কোন সাধারণ মৃত্যু নয়। আজ আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, তোমার মা এবং আমার আম্মু পাপাকে যারা খু**ন করেছে তাদের কে শাস্তি পেতেই হবে।”
আমানও বলে ওঠে,”আরু আপাই, আমি বর্তমানে একজন নাম করা উকিল। আমিও আসি তোমার পাশে। ন্যায়বিচারের পক্ষে যা যা করতে হয় করব।”
রাজীবও বলে ওঠে,”আর আমিও আসি। আমিও সব সত্য সামনে আনার জন্য যা করা লাগে করব।”
সবার কথা শুনে সায়রা বলে ওঠে,”আমি জানি না, সত্যটা কি। তবে যদি সত্যিই আমার মায়ের খু*নি অন্য কেউ হয় যে এখনো শাস্তি পায় নি তাহলে আমিও চাইবো তার অপরাধের শাস্তি যেন সে পায় আর সব সত্যটা সামনে আসুক।”
আরহাম বলে,”আমরা সবাই যদি একসাথে হাত মিলাই তাহলে সত্যটা সামনে আসবেই। কেউ তা আটকাতে পারবে না।”
কথাটা বলেই সবাই একসাথে হাত মেলায়।
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৪
নিজের স্বামী ঈশান কবীরের রাজনৈতিক দপ্তরে বসে আছেন ঈশিতা। তার চোখে মুখে যেন আগুন জ্বলছে। নিজের করা নানা অপরাধের স্মৃতি আজ তার চোখে ভাসছে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে, কিভাবে তিনি সেদিন রাস্তায় বৃষ্টিকে দেখে তাকে পিষে মেরে ফেলেছিলেন, কারণ বৃষ্টির প্রতি তার চাপা রাগ ছিল৷ বৃষ্টির জন্যই তিনি নিজের সব হারিয়েছেন তাই বৃষ্টিকে মেরেই সেসব কিছুর প্রতিশোধ নেন। আর এরপর রাজনৈতিক কারণে ঝামেলা তৈরি করে অতঃপর বোমা ব্লাস্ট করিয়ে জাঈদ শেখ ও আরিশার মৃত্যুর পেছনেও তারই কলকাঠি আছে। তিনি অগ্নিদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলেন,”এভাবেই আমার পথে যারা যারা আসবে তাদের সবাইকে আমি শেষ করে দেবো।”