অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৯
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশিরা সবাই মিলে আজ পা রাখলো খান ভিলায়। জাঈদ প্রথমবার প্রবেশ করলো নিজের বাড়িতে। চারিদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আরুশি ও আরহামকে জিজ্ঞেস করল,”মাম্মা, পাপা এটাই কি আমাদের বাড়ি?”
আরহাম মাথা নাড়িয়ে বলে,”হ্যাঁ, সোনা। এটাই আমাদের বাড়ি।”
আরুশি ও আরহামের হাত ধরে জাঈদ এগিয়ে চলে। আফিফা খান বাড়িতে প্রবেশ করে বলেন,”বাড়িটা এত নিস্তব্ধ লাগছে কেন?”
সায়রা বলে ওঠে,”আমি দেখে আসছি মামা, নানি ওরা কোথায়।”
আমান বলে,”চলো, আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।”
জাঈদ বলে ওঠে,”মাম্মা, গ্র্যান্ডমার সাথে তো দেখা করলাম কিন্তু আমার গ্র্যান্ডপা কোথায়? সে কি আমার সাথে দেখা করবে না?”
আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”করবে অবশ্যই দেখা করবে।”
এমন সময় হঠাৎ করে সায়রা ছুটে এসে বলে,”মামা..মামা তার রুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কোন সাড়াশব্দ করছে না।”
কথাটা শুনে সবাই ভীষণ ভয় পেয়ে যায় বিশেষ করে আফিফা খান। হাজার হোক, নির্ঝর তার স্বামী। সবাই ছুটে যায় নির্ঝর খানের রুমের দিকে।
দ্রুতই এম্বুল্যান্স করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বলেন, নির্ঝর খানের ভীষণ মেজর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সবাই হতবাক হয়ে যায়! আফিফা খান থ মেরে বসে থাকেন। আরুশি আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলে,”হে আল্লাহ, এতদিন অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে আমাদের পরিবারকে৷ এবার অন্তত সবকিছু ঠিক করে দাও।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছুদিন পর,
নির্ঝর খান সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যদিও তার বাঁচার আশা ছিল না খুব বেশি। তবে এজন্য তাকে কড়া মূল্য চুকাতে হয়েছে। তার দুই পা একদম প্যারালাইজড হয়ে গেছে। আর কোনদিন হয়তো তিনি স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না। এসব ভেবেই তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। আজ আরুশি জাঈদকে নিয়ে প্রথমবারের মতো নির্ঝর খানের সাথে দেখা করতে এসেছে। সে মনে অনেক সংশয় নিয়ে কেবিনের সামনে এসে সরু অথচ বিনয়ী স্বরে বলে,”আঙ্কেল, আসব..”
নির্ঝর খান অনেক কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে আরুশির দিকে তাকিয়ে বলেন,”হ্যাঁ, মা৷ এসো।”
তার কণ্ঠে আর পূর্বের রাগ, জেদ কিছুই নেই। বরং স্নেহের আভাস পেল আরুশি৷ কিছুটা স্বস্তি বোধ করে জাঈদকে সাথে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে বলল,”আপনি এখন ঠিক আছেন তো?”
নির্ঝর খান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”তোমার সাথে, নিজের ছেলের সাথে আর সর্বোপরি তোমাদের মাসুম ছেলেটার সাথে এতদিন আমি যে অন্যায় করেছি তারপর ঠিক থাকি কিভাবে বলো? তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও মুখ নেই আমার। শুধুমাত্র আমার অবিবেচকের মতো কাজের জন্য তোমার জীবনের এতগুলো বছর কষ্টে কেটেছ। জানি তুমি আমায় কখনো মাফ করবে না তবুও এই ক্ষমাটা গ্রহণ করো।”
বলেই তিনি হাতজোড় করেন। আরুশি বলে ওঠে,”ছি ছি আঙ্কেল! এসব কি করছেন আপনি। যা হয়েছে তা ভাগ্যের লিখন ছিল। এসব ভেবে কষ্ট পাবেন না।”
“আজ আমি আমার কর্মফল পেয়েছি, শারীরিক ভাবে যতটা না দূর্বল মানসিকভাবে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি ভেঙে পড়েছি আমি আজ। হয়তো এটাই আল্লাহর বিচার।”
“চিন্তা করবেন না, আপনি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার নাতিকে নিয়ে অনেক মজা করবেন।”
“আমার নাতি?! কোথায় ও?”
এমন সময় আরুশির পেছন থেকে জাঈদ বেরিয়ে এসে বলে,”সারপ্রাইজ গ্র্যান্ডপা। আমি জাঈদ, তোমার ওয়ান এন অনলি গ্র্যান্ডসন।”
নির্ঝর খান খুশি হয়ে বলেন,”বাহ, আমার গ্র্যান্ডসনকে তো খুব খুশি লাগছে।”
“খুশি হবোই তো। এই প্রথম আমার গ্র্যান্ডপার সাথে দেখা করলাম যে!”
এরপর দুজনেই খুনশুটিতে মেতে ওঠে। একসময় নির্ঝর খান আরুশিকে বলেন,”তুমি নিজের পাপাকে খুব ভালোবাসতে তাই না আরুশি? এজন্য নিজের ছেলের নামের মাঝে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছ?”
আরুশি হালকা হেসে বলে,”ঠিক বলেছেন আপনি। যখনই আমি জাঈদকে দেখি আমার নিজের পাপার কথা মনে পড়ে। ও আমার পাশে থাকলে আমার মনে হয়, আমার পাপা আমার পাশেই আছে।”
৩ মাস পর,
খান বাড়িতে চারিদিকে এখন শান্তি, সুখ ও সুন্দর মুহুর্তের বন্যা চলছে। সবার মুখে হাসি আর আনন্দ। সায়রার এখন প্রেগ্যান্সির সময় চলছে। এই বিষয়টা আমিনার কাছে ভীষণ আনন্দের। তার ছোট্ট ভাই বা বোন আসতে চলেছে। যদিও আমিনার ইচ্ছা তার একটা ছোট বোন হোক যাতে সে ইচ্ছামতো নিজের বোনকে সাজাতে পারে।
এদিকে আরুশি ও আরহামের জীবনও সুন্দর ছন্দে এগিয়ে চলছে। এত আনন্দের মাঝে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো ফ্যামিলির সবাই মিলে পিকনিক উদযাপন করতে সিলেটে যাবে। সিলেট–যেই শহরের সাথে তাদের পূর্বপুরুষের চিহ্ন মিশে আছে, সেই শহরকেই তারা বেছে নিলো।
আরহাম, আরুশি, জাঈদ, সায়রা, আমান, আমিনা, আফিফা খান ও নির্ঝর খান যাবেন এই পিকনিকে। যদিও নির্ঝর খান এখন হুইল চেয়ারেই চলাফেরা করেন তাই তিনি যেতে চাইছিলেন না। বাকিদের জোরাজুরিতে যেতে হলো। নিঝুম খান আজকাল শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন তাই তাকে বাড়িতেই থাকতে হবে। তার দেখাশোনার জন্য অবশ্য আয়া রাখা হয়েছে।
রাজীবকেও তাদের এই ফ্যামিলি পিকনিকে যোগ দিতে বলা হয়েছে এবং সেও সানন্দে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। সবাই মিলে বাড়ির বাইরে বাস নিয়ে অপেক্ষা করছে।
এরমধ্যে আমিনা ও জাঈদের মধ্যে খুনশুটিও চলছে। দুজনের মধ্যে এই ক’য়দিনে বেশ ভাব হয়ে গেছে। এমন সময় সেখানে চলে এলো রাজীব। রাজীবকে দেখেই আরুশি বলে উঠল,”এসেছ রাজীব ভাই!”
“হুম, এসেছি৷ তবে একা আসিনি। আমার সাথে কে এসেছে দেখবে না?”
বলেই সে পেছনে তাকিয়ে বলল,”এসো।”
মারিয়া মাশরাফিকে কোলে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো। মারিয়াকে দেখেই আরুশি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ দীর্ঘ ৬ বছর পর আজ সে একসময়কার প্রিয় বান্ধবীর মুখোমুখি হলো। সেদিনের মারিয়ার সাথে আজকের মারিয়ার কতই না পার্থক্য। সুন্দর চেহারা মলিন হয়ে গেছে যেন!
মারিয়া এগিয়ে এসে আরুশিকে বলল,”কেমন আছিস আরু?”
আরুশি হালকা হেসে বলে,”ভালো আছি মারিয়া..তুই?”
“আমিও।”
অতঃপর নীরবতা। মারিয়া বলল,”তুই আজো আমায় ক্ষমা করতে পারিস নি তাই না? আমি জানি, আমি যা করেছি সব কত বড় অন্যায় ছিল। আমার কারণে একসময় তোকে, রাজীব ভাইকে সবাইকে কত কষ্ট পেতে হয়েছে। বিশেষ করে, তুই আমার কত কাছের বান্ধবী ছিলি অথচ আমি যা করেছি তাতে আমাদের এই সুন্দর সম্পর্কে বড় ফাটল তৈরি হয়েছে। বন্ধুত্বে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আমি। পারলে আমায় মাফ..”
আরুশি মারিয়ার কাধে হাত রেখে বলে,”রাজীব ভাইয়ের থেকে সবটা শুনেছি আমি। তোর সাথে যা হয়েছে তা অত্যন্ত অন্যায়৷ তবে আজ আমি এই সুন্দর মুহুর্তে অতীতের কথা মনে করতে চাই না। আমিই রাজীব ভাইকে বলেছিলাম তোকে এখানে নিয়ে আসতে। শুনলাম, তুই নিজের ছেলেকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছিস এজন্য অনেক পরিশ্রমও করছিস। নিজে সাবলম্বী হয়ে ছেলেকে নিয়ে আলাদা বাড়িতে উঠেছিস, শুনে ভালো লাগল।”
মারিয়া আরুশিকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ধন্যবাদ আরু, আমাকে আরেকটা সুযোগ দেয়ার জন্য। আগেরবার হয়তো আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখতে পারি নি কিন্তু তোকে কথা দিচ্ছি এবার জীবন দিয়ে হলেও রাখব।”
এরমধ্যে আরহাম সবাইকে বাসে উঠতে তাড়া দেয়। সবাই বাসে উঠে পড়ে। জাঈদ একদম জানালে পাশে একটি সিটে বসেছিল। মারিয়া রাজীবের সাথে পাশাপাশি সিটে বসে। মাশরাফি আর কোন সিট না পেয়ে জাঈদের সিটের কাছে গিয়ে বলে,”আমাকে জানালার পাশের সিটে বসতে দিবে? আমার আসলে ঐ সিটটা ভালো লাগে।”
জাঈদ কঠিন স্বরে বলে,”জানালার পাশের সিট আমার পছন্দের। আর আমি কারো জন্য নিজের পছন্দ স্যাক্রিফাইস করি না।”
আরুশি বলে ওঠে,”আহ, জাঈদ এভাবে বলছ কেন। ও যখন বসতে চাইছে বসতে দাও।”
মারিয়া বলে,”থাক, তার কোন দরকার নেই। মাশরাফি এসো তুমি আমার কোলে এসে বসো।”
এমন সময় আমিনা এগিয়ে এসে বলে,”তুমি চাইলে আমার পাশে বসতে পারো। আমি জানালার পাশের সিটেই আছি।”
মাশরাফি খুশি হয়ে আমিনার পাশে গিয়ে বসে। জাঈদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে থাকে। একটু পর বাসটা চলতে শুরু করে।
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৮
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা জার্নির পর বাসটা সিলেটের কাছাকাছি পৌঁছে যায় কিন্তু হঠাৎ ঝড়ো আবহাওয়ার কারণে চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে। এরমধ্যে হঠাৎ বাস ড্রাইভারের অসাবধানে কারণে বাসটা সিলেটের পাহাড়ি এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় ভুলবশত একটি খাদের কিনারায় এসে দাঁড়ায় এবং বাসচালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বাসটা একদম খাদের পাশে আটকে যায়। বাসে উপস্থিত সবার জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে!