অশ্রুবন্দি পর্ব ১০

অশ্রুবন্দি পর্ব ১০
ইসরাত জাহান ফারিয়া

ইহসানের গাঢ় নিঃশ্বাস পুড়িয়ে দিতে লাগল
সৃজার ঠোঁটমুখ। জানালা গলে আসা হিম স্পর্শী হাওয়া দোলা দিয়ে যেতে লাগল বুকের ভেতর স্পন্দিত হতে থাকা ছোট্ট হৃদপিন্ডটা। অতিরিক্ত জ্বরে ইহসান তখন জ্ঞানশূন্য, সৃজা যখন এটা টের পেল ততক্ষণে পূর্ব আকাশ কমলা রোদে ভরে উঠেছে।

সারা রাত কাহিল অবস্থায় জ্বরগ্রস্ত ইজহানের সেবা
করতে গিয়ে ইহসানের অবস্থা ওর চেয়ে বেশি খারাপ
হলো। জ্বর ১০৪°। সারা শরীরে ব্যথা, অবসাদ। বমি করে অবস্থা কাহিল। জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ একদম। সৃজা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। একা একা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। তাই সময় নষ্ট না করে দরজা খুলে ছুটে গেল নিচে। রান্নাঘরে ইস্মিকে না পেয়ে সালেহা বেগমকে
জানাল ইহসানের অসুস্থতার কথাটা। তিনি আহাজারি করতে করতে স্বামীকে গিয়ে সবটা জানালেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কোনোকালেই ইহসানের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না আজিজ শেখের। পারতপক্ষে বাবার সাথে কথাও বলতে চায় না ইহসান। খুব দরকারি, না বললেই নয় সেরকম দু-একটা কথা কালেভদ্রে হয় তাদের। তবে সেগুলোও স্বাভাবিক কথাবার্তা নয়। অত্যন্ত বিরক্তিকর আর ঝামেলা বাঁধানোর মতো। কেননা, আজিজ শেখ চিরকালই অন্য ধাঁচের মানুষ। তার বড্ড টাকা কামানোর নেশা। এরজন্য তিনি সবকিছু করতে পারেন। ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারেন না। সন্তানদের চোখে ছোট হয়ে যাওয়ার ভয়টাও তার মধ্যে কাজ করে না। এসব ছাড়াও আরো বহু কারণ আছে
তাকে ঘৃণা করার জন্য! ইহসান তাই জন্মদাতাকে ঘৃণা
করে। তবে ন্যায়নীতির ধার না ধারলেও আজিজ শেখ
কম চিন্তা করেন না তাদের নিয়ে। যে ছেলেকে দু’দিন
আগে গালে থাপ্পড় দিয়েছেন, গায়ে হাত উঠিয়েছেন,
বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছেন লিথুকে বিয়ে না
করার জন্য, এমনকি যে ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখলে বাড়ির অন্যদেরকে উচিৎ শাস্তি দিবেন বলে হুমকি-ধমকি দিয়েছিলেন সেই ছেলের অসুস্থতার খবর শুনে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন এবং পুত্রের অবস্থা দেখে চিন্তিত, বিচলিত হয়ে পড়লেন।

সৃজা আর সালেহা বেগম ইহসানের শিয়রে বসা। একজন মাথায় পানি দিচ্ছে, অন্যজন হাত-পায়ের তালু ম্যাসাজ করছে। আজিজ শেখ মেজো ছেলে ইমরানের সাথে পরামর্শ করছে ইহসানের ব্যাপারে। ঔষধ দিয়ে, জলপটি দিয়েও জ্বর যেহেতু কমছে না তার মানে ব্যাপার সিরিয়াস। হাসপাতালেই নিতে হবে। মিতু-লিথু ঘরে উপস্থিত, দু-একটা কাজের লোক বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! ইহসানকে হাসপাতালে নেওয়া হবে শুনে লিথু এক কাণ্ড করল। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ছুটে গিয়ে ইহসানের উপর পড়ল। আহাজারি শুরু করল ওর মুখ-চোখ ছুঁয়ে! সৃজার মাথা ভনভন করে উঠল দৃশ্যটা দেখে। এসব কী অনাচার হচ্ছে? সে সবার দিকে তাকাল, তারা নির্লিপ্ত! শুধু সালেহা বেগম কাঁচুমাচু করছেন, কিন্তু স্বামী উপস্থিত থাকায় মুখফুটে শব্দ বেরুচ্ছে না। সৃজা অনেকটা ঘোরগ্রস্ত অবস্থায়ই ঠেলে সরিয়ে দিলো লিথুকে। কঠিন স্বরে বলল,

“দূরে সরো।”
লিথু কান্নাভেজা চোখে কটমট করে চাইল। যেন গিলে
খেয়ে ফেলবে সৃজাকে। সে অবাধ্য হলো। কেউ কিছু
বলছে না দেখে সাহস পেয়ে ইহসানের হাতদুটো নিজের আয়ত্ত্বে নিতে চাইলে সৃজা এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে
গর্জে উঠে বলল,
“নির্লজ্জতা অন্য কোথাও দেখাও! আমার সামনে, আমার স্বামীকে ছুঁয়ে না। তাহলে খুব খারাপ হবে। শেষবার বলছি, দূর হও!”

ঘরে থাকা সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল সৃজার কথা শুনে।
মিতু অগ্নিচোখে চাইল। লিথু ফুঁসতে ফুঁসতে আজিজ শেখকে বলল,
“চাচাজান দেখেন, ও আমার সাথে কি বিহেভ করে… ”
আজিজ শেখ প্রচন্ড রাগান্বিত হলেন। তবুও ছেলের অসুস্থতার কথা ভেবে তিনি কথা বাড়াতে চাইলেন না।
বিরস গলায় জবাব দিলেন,
“তুমি কিছু মনে করো না, পরে দেখব ব্যাপারটা।”
লিথু বেচারি ন্যায় বিচার না পেয়ে রাগে-দুঃখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিতুও মুখ ঝামটা মেরে বেরিয়ে গেল। সৃজা ভেতরে ভেতরে আগ্নেয়গিরির ন্যায় জ্বলে যাচ্ছিল এ বাড়ির মানুষদের আচরণে।

সৃজাকে কিছু বলা হলো না। সে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হসপিটালে যেতে চাইছিল। ইতস্তত করে ভদ্র গলায়
দু’বার কথাটা বলতেই আজিজ সাহেব আগুন চোখে চাইলেন। বেশ ক্ষেপে ‘বেয়াদব’ আখ্যা দিলেন ওকে৷ ইমরানও বিরক্তি প্রকাশ করল। কেউই সৃজার কথার
তেমন একটা পাত্তা দিলো না। কারণ ওকে সাথে করে নিয়ে আসার মতো মনোভাব নেই কারোর। সবশেষে লিথু-মিতুর ইন্ধনে বাপ-ছেলে কেউই সৃজাকে সাথে নেয়নি। জ্ঞানশূন্য ইহসানকে নিয়ে তারা বাড়ির গাড়ি করেই রওয়ানা দেয়। সৃজার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর প্রত্যাখ্যান তাকে বেশ কষ্ট দিলো। কিন্ত মনে হলো যা কিছুই হোক না কেন এখন রাগ করা বা কষ্ট পাওয়ার সময় নয়। তার এখন ইহসানের পাশে থাকা উচিৎ। অগত্যা একাই সে বেরিয়ে পড়বে বলে ঠিক করে। কিন্তু সালেহা বেগম দেননি। নিজের স্বামীকে তিনি চেনেন! তার কথা অমান্য করে সৃজা যদি হাসপাতালে যায়, তাহলে আজিজ শেখ নিশ্চিত ক্ষেপে গিয়ে কিছু একটা করে বসবেন। সেই ভয় থেকেই ভীতু সালেহা বেগমও ওর সঙ্গী হলেন।

অন্যদিকে ইজহানকে সামলাতে গিয়ে ইস্মিরও বেহাল দশা। লোকটা দু’দণ্ড শান্তি দিচ্ছে না। বহুকষ্টে তাকে বারান্দা থেকে বিছানায় আনা গেলেও তার পাগলামো কমেনি। জ্বর উঠানামা করছে, মুখে রুচি নেই। কোমড়ের ব্যথায় একটু পরপর আর্তনাদ করছে আর বরাবরের মতোনই গালি ছুঁড়ছে! ইস্মির জান যায় যায় অবস্থা। অনেকটা কাকুতিমিনতি আর জবরদস্তি করে ইজহানকে জোর করে ঔষধ খাইয়ে, কোমড়ে মালিশ করতে করতে আজিজ শেখকে ফোন করে সব জানাতেই তিনি ছেলের জন্য বাড়িতে ডাক্তার পাঠিয়ে দিলেন। এরপর থেকেই আজিজ শেখ বিরক্ত ও চিন্তিত। বহু সেক্টরে তার ব্যবসা-বাণিজ্য। জমি কেনা-বেচা থেকে শুরু করে চালের মিল, কার্গো সার্ভিস, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, জুয়েলারি ব্যবসা, ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস নিয়ে তার কারবার। নতুন করে একটি লাক্সারি হোটেল চেইন এবং শপিং মল করবেন। যেখানে নামীদামী ব্র‍্যান্ডের আউলেট থাকবে। সেজন্য শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জমি কিনেছেন। অতিশ্রীঘ্রই নির্মাণ কাজ শুরু হবে সেখানে। সেসব নিয়েই আজ মিটিং ছিল বিদেশি ডিলারের সাথে, কোটি টাকা বিনিয়োগের ব্যাপার। ইহসান তার এসব কাজে নাক গলায় না, তার পছন্দ বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। ইজহানই তার সাথে তাল মিলিয়ে হিসাবপত্র থেকে শুরু করে ব্যবসাটা সামলাতো। ইমরান ব্যবসায় থাকলেও সে বেশিরভাগ সময়ই গড়বড় করে ফেলে। কিন্তু এখন সব কেমন ঘেঁটে গেছে। দুই ছেলে জ্বরে পড়ে তাকে এখন নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। সব ফেলে তিনি ছেলে নিয়ে হাসপাতালে ঘুরঘুর করছেন।

ইহসান তার যতই কাছে না ঘেঁষুক, তাকে অপছন্দ করুক। তিনি
তো বাবা, তাকে এ অবস্থায় রেখে তিনি কিছুতেই মিটিং-ফিটিং করতে পারবেন না। ইস্মি বাড়িতে ইজহানকে সামলাচ্ছে, তিনিও ডাক্তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই ওদিকে চিন্তা কম। কিন্তু ইহসানের পাশে কেউ নেই, সে একা। সৃজাকে তার পছন্দ নয়। এই মেয়েকে ছেলের পাশে এক সেকেন্ডের জন্যও সহ্য করা মুশকিল তার পক্ষে।
তাই ছেলের দায়িত্ব নিয়ে নিজেই থাকবেন বলে ঠিক করলেন তিনি। ম্যানেজার আর ইমরানকে সব বুঝিয়ে মিটিং সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন অফিসে। অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়ে গেল তার পাশে। তবে ইমরানকে অফিসে পাঠিয়ে আজিজ শেখের মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল৷ তার মেজো ছেলেটা গর্দভ প্রকৃতির। সবটা ঠিকঠাক সামলাতে পারবে কি-না কে জানে! এসমস্ত বিষয় নিয়ে ফ্যাসাদে
পড়ায় আজিজ সাহেবের তাই মেজাজ ঠিক নেই।

এরমধ্যেই কেবিনের দরজা খুলে সৃজা আর সালেহা
বেগম হন্তদন্ত ভঙ্গিতে প্রবেশ করলে আজিজ শেখের কপালে ভাঁজ পড়ল! চোখমুখ কঠিন হয়ে গেল মুহূর্তেই। মেয়েটার এত বড় সাহস তার কথা অমান্য করে হাসপাতালে চলে এসেছে? সঙ্গী করেছে আবার সালেহা বেগমকেও? আজিজ শেখ কটমট করে স্ত্রী’র দিকে চাইলেন। এরপর রাগ সামলাতে না পেরে সালেহা বেগমের গালে থাপ্পড় বসিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সৃজা আজিজ শেখের কাণ্ড দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। আজিজ শেখের আচরণে বুঝে গেল শ্বাশুড়ির জীবনটা সুখের নয়। অনেক ভয় পান তিনি স্বামীকে। সৃজা সালেহা বেগমকে ধরে বসিয়ে দিলো একটা চেয়ারে। তিনি স্বামীর হাতের থাপ্পড় খেয়ে অভ্যস্ত, তবে সৃজার সামনে থাপ্পড়
খেয়ে তিনি ভীষণ লজ্জা পেয়ে ম্লানমুখে বসে রইলেন। খানিকক্ষণ পর কেবিনের দরজা ঠেলে ডাক্তারকে নিয়ে ঢুকলেন আজিজ শেখ। ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার কাজে, বিভিন্ন টেস্ট আর নির্দেশনা দিতে লাগলেন। সৃজা ভয়ডর রেখে নিজে থেকেই সব বুঝে নিচ্ছিল ডাক্তারের থেকে। আজিজ শেখ প্রচন্ড ক্ষেপে চুপচাপ দেখে গেলেন সৃজার স্পর্ধা!

ইহসানের হাতে স্যালাইন লাগানো। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে তার রক্তাভ মুখটা৷ ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সৃজার কান্না চলে এলো। গতরাতে তো ঠিকই ছিল! হুট করে মানুষটা এত অসুস্থ হয়ে গেল? সৃজা বিচলিত চেহারা নিয়ে বসে রইল। কিছুই ভালো লাগছে না তার। মন খারাপ জেঁকে ধরছিল চারপাশ থেকে। ইহসানের ফোনটা কাছে ছিল, বাড়িতে ফোন করে এলিজা আর ফুপির সাথে কথা বলল সে! তারা চিন্তিত হলো ইহসানের কথা শুনে। এলিজা দেখতে আসবে বলল। সৃজা নিশ্চিত ছিল না কয়দিন হাসপাতালে রাখবে, তাই ওকে পরে জানাবে বলে ফোন রেখে দিলো। ডাক্তার অবশ্য জানালেন পরদিনই পেশেন্টকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে, তবে সর্বক্ষণ কেয়ারে রাখতে হবে। আজিজ শেখ সেসব অগ্রাহ্য করলেন। দু-তিনদিন হাসপাতালে রেখে
তবেই ছেলেকে বাড়ি নিবেন তিনি। রাতে থাকতে হবে হাসপাতালে। কেবিনে যেহেতু দুটো বেড আছে, তাই থাকতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সৃজা সালেহা বেগমকে নিয়ে রয়ে গেল। আজিজ শেখ কিছুই বললেন না। সারাক্ষণ তিরিক্ষি মেজাজে ঘুরে বেড়ালেন কানে ফোন নিয়ে।

সন্ধ্যার দিকে ইহসানের জ্বর অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। তবে শরীর ভীষণ দুর্বল। কড়া ডোজের ঔষধ পড়ায় বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটলো। মাঝে কয়েকবার জাগায় সৃজা ওকে খাবার খাইয়ে হাত-মুখ মুছিয়ে দিলো, ঔষধ দিলো, টেম্পারেচার চেক করল। ইহসান এসবে অভ্যস্ত নয়। সে বিরক্ত হলো। ধমকে একাকার করল সৃজাকে। সৃজা অবশ্য কিছুই মনে করল না। মুখ ফুলিয়ে সেবাযত্ন করল। সালেহা বেগম শুধু চুপচাপ দেখে গেলেন সবকিছু। কখনো এটা-ওটা এগিয়ে দিলেন।

রাতে ঘুমানোর সময় সালেহা বেগম গল্প করতে লাগলেন সৃজার সাথে। ইতোমধ্যে সৃজা বুঝে গেছে শ্বাশুড়িকে।
মহিলা বেশ ভীতু আর সরল। তবে কথা বলতে ভালোবাসে। বাড়িতে হয়তো তেমন কাউকে পায় না কথা বলার মতো, তাই সৃজাকে পেয়ে তিনি বেশ বাচালের মতো আচরণ করছেন। বাড়ির সবার বিষয়ে অনেককিছু জানালেন। কথায় কথায় একসময় বললেন,
“সব পোলা যেমুন-তেমুন। মেজো পোলাডা বউয়ের আঁচলের তলায় থাইকা থাইকা বলদ হইয়া গেছে।
বউ যা কয় তা-ই ঠিক…..”
সৃজা খানিকটা বিস্মিত হলো। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আর ছোটজন?”
সালেহা বেগম সৃজার মুখপানে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওর দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন,
“ক্যামুন জানি, একগুঁয়ে হইছে পোলাডা। যা কইবে,
যা চাইবে ঠিক ঐডায় হ্যার লাগব। যতক্ষণ না পাইব ততক্ষণ কাউরে শান্তি দেয় না। সবাই ওরে ডরায়।
ও বাড়িতে আইলে সবাই ভয়ে তটস্থ হইয়া থাকে।”
এরপর আফসোসের সুরে বললেন,

“অত সুন্দর, রাজপুত্রের মতোন চেহারা ছোট পোলাডার, ক্যামনে যে এমুন হইল! একবার কি হইসে শোন, পিকনিকে গেছে বন্ধুবান্ধব নিয়া৷ ঐখানে কি নিয়া কথা কাটাকাটি করার সময় হ্যার এক বন্ধু ওরে মা তুইলা গালি দিছিল।
ওয় ঐডা শুইনা ঐ পোলারে ধাক্কা দিয়া নদীতে ফালায় দিসিল। অথচ পোলাডা সাঁতার জানতো না…”
সৃজা আঁৎকে উঠল,
“ছেলেটার কিছু হয়নি তো?”
সালেহা বেগম জবাব না দিয়ে হুট করে চুপ হয়ে গেলেন। হাসার প্রচেষ্টা করে আমতা-আমতা করে বললেন,
“নাহ. .. ইয়ে ওয় তো দেবর হয় তোমার! কথা হয় নাই তোমার লগে মনে হয়! হ্যায় আছে এহন বিদেশে, ডিগ্রি আনতে গেছে। আমি আবার মূখ্যুসুখ্যু মানুষ, তেমন কিছু বুঝি না। জানিও না পোলা আমার কি ডিগ্রি আনতো গেছে!”

সৃজা সরু চোখে শ্বাশুড়ির অপ্রস্তুত মুখপানে তাকিয়ে রইল।মনে হলো এ বাড়ির কেউই স্বাভাবিক নয়। সবাই কিছু না কিছু দোষে দুষ্ট! জিজ্ঞেস করল,
“আর ওদের বোন, মানে আপনার মেয়ে?”
“পুনম ওর নাম। স্কুল শেষ কইরা কলেজে ভর্তি হইসিলো, ইহসানের আব্বা পড়তে দেয় নাই৷ বিয়া দিয়া দিছে মেয়রের পোলার লগে। হেই রাগে মাইয়া বিয়ার পর আর এ বাড়ি আসে নাই…”
ধরে এলো সালেহা বেগমের কণ্ঠস্বর। মেয়ের কথা
মনে পড়ায় তার মন পুড়ছে। সৃজা বিস্মিত হয়ে বসে রইল কথাগুলো শুনে। বাইরে থেকে যতটা সাদামাটা লাগছিল সবকিছু, আদতে তা নয়৷ ওর মন কৌতূহলী হয়ে উঠল আরো কিছু জানার জন্য, বিশেষ করে ইজহান আর ইহসানকে নিয়ে। অস্বস্তি ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করতে যাবে তাদের মধ্যকার ঝামেলার ব্যাপারটা, তখনি আচমকা কাছে থাকা ইহসানের ফোনটা বেজে উঠল। ও হকচকিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল এলিজা ফোন করেছে। এখানে বসে কথা বললে ইহসানের সমস্যা হবে ভেবে তাই শ্বাশুড়িকে বলে সে করিডোরে এসে ফোনটা রিসিভ করল। কিছুক্ষণ কথা বলে এলিজা বলল সে কাল আসবে ইহসানকে দেখতে। সৃজা ওকে একা আসতে বারণ করল কারণ বাবাকে একা রেখে নীলু ফুপি এলিজাকে নিয়ে আসতে পারবে না। এলিজা অবশ্য জানাল সে তার বান্ধবীকে নিয়ে আসবে, একা অতদূর যাবে না।

ওর সাথে কথা বলতে বলতে মনটা
হালকা হয়ে গেল সৃজার। কাল আসবে এলিজা, তার
ছোট্ট বোনটা। যেন কতদিন দেখে না সে বোনকে৷ ফোন কেটে সৃজা কেবিনে ঢুকে দেখল সালেহা বেগম ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছেন। আর ইহসানের ঘুম ভেঙে
গেছে। সে বিরস দৃষ্টি মেলে ক্যানোলা লাগানো হাতটার
দিকে তাকিয়ে আছে। সৃজা ধীরপায়ে হেঁটে কাছে গিয়ে বসতেই ইহসান শব্দ পেয়ে ওর দিকে চাইল। সৃজা ওর চুলে আলতো হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এখন কেমন আছ?”
রাশভারি স্বরে জবাব এলো,
“ভালো না।”
সৃজার হাত থমকে গেল। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“আবার অসুস্থ লাগছে?”
“তোকে দেখে লাগছে।”
সৃজার চোখ বড় বড় হয়ে এলো,
“মানে?”
“তোর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আমার
অসুস্থ লাগছে তোকে দেখে। বুঝলি?”
সৃজার মুখটা কালো হয়ে গেল,
“এখন কী করতে পারি?”
ইহসান রুষ্ট স্বরে বলল,
“বাকি রাখা কাজটা সম্পন্ন করে দে, তাহলেই হবে…”
সৃজা কিছুই বুঝল না,
“কোন কাজ?”
“তোর ঠোঁটে না দিয়ে কপালে যেটা দিলাম…”

সৃজার কান গরম হয়ে গেল সে মুহূর্তের কথা মনে করে। ইহসান কী নির্লজ্জ! জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তবুও মুখের লাগাম নেই। রাগত স্বরে বলল,
“হসপিটালের বেডে শুয়েও ফাজলামো করছ? তোমার
জন্য ঐ লিথুরানিই ঠিক ছিল।”
ইহসান চট করে চোখ লাল করে তাকাতেই সৃজা
ঢোক গিলে বলল,
“মহারানি সকালে যা কাণ্ড করল…”
ইহসানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মুখটা দেখার
মতো হলো,
“কী কাণ্ড?”
সৃজার ভীষণ রাগ হচ্ছিল লিথুর উপর। জানে,

অশ্রুবন্দি পর্ব ৯

ইহসান অপছন্দ করে ওকে এরপরও ঢলাঢলি করতে আসে। এটা সৃজার পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
তীক্ষ্ণ স্বরে বলেই ফেলল,
“তুমি যখন সকালে হুঁশ হারালে, যখন সবাই এলো দেখতে, তখন বেচারির যায় যায় অবস্থা! তোমাকে জড়িয়ে ধরে সে কী আহাজারি! আমি গিয়ে না সরালে এখনো মনে হয় তোমাকে ছাড়তো না…”
ইহসান অবাক, বিস্মিত! মেকআপওয়ালী তাকে
ছুঁয়েছে? জড়িয়ে ধরে কান্না করেছে তাও সৃজার সামনেই? ইহসানের রগে রগে তেজালো রক্ত বিস্ফোরণ ঘটালো যেন!

অশ্রুবন্দি পর্ব ১১