অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৬
ইসরাত জাহান ফারিয়া
ইহসানের অনুপস্থিতি সৃজাকে কষ্ট আর পীড়া তো দিচ্ছিলই, তার সাথে আজিজ শেখের চেঁচামেচি আর অকথ্য ব্যবহার নতুন করে যোগ হয়েছে। এতদিন ইহসানের কারণে কটুক্তি মাত্রা ছাড়াতে পারেনি, কিন্তু এখন ছেলের অনুপস্থিতি আজিজ শেখকে দারুণ একটা সুযোগ করে দিয়েছে। লিথুরাণীকে ইহসানের গলায় না ঝুলাতে পারার ব্যর্থতা আর সৃজার প্রতি ক্ষোভ—এসবের ঝাঁঝ মেটাচ্ছেন বাড়ি মাথায় তুলে। সৃজা এসব কটুক্তি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে! তবুও মাঝেমধ্যে তিক্ত অনুভূতিতে ওর মন ক্লিষ্ট হয়, চোখ ছাপিয়ে অশ্রু নামতে চায়। কিন্তু মনকে বুঝিয়ে শান্ত করে। জানার চেষ্টা করছে ওর উপর রাগ করে লোকটা কোথায় গা-ঢাকা দিলো!
এদিকে অবশ্য আজিজ শেখ দু’দিন ধরে খোঁজখবর চালিয়ে অবশেষে জানতে পারলেন ইহসান কোথায় আছে! জেনে নিশ্চিন্ত হলেন ঠিকই, কিন্তু কাউকে কিছু বললেন না। যেহেতু সংবাদটা তিনি আগে জেনেছেন, তাই জানাবেন কি না, সেটা তার মর্জির ব্যাপার! এক সন্ধ্যায়, ইহসানের সেই ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলেন তিনি। দরজা খুলে নিজের তাকে দেখে ইহসানের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। রশিদ আগেই ফোন করে জানিয়েছিল, আজিজ শেখ জেরার মুখে ফেলে জেনে নিয়েছেন ওর ঠিকানা। তিনি যে এভাবে কথা ঘুরিয়ে, খোঁচা দিয়ে, মুখ থেকে সব বের করে নিতে ওস্তাদ—এটা ইহসান ভালোই জানে। এবং সে এতে চরম বিরক্ত। সে বিরক্তি প্রকাশ করল স্পষ্টভাবে। কিন্তু আজিজ শেখ এসবের ধার ধারলেন না। ভেতরে গিয়ে নিজের মতো করে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে বসলেন। এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “এই ফ্ল্যাট কখন নিছো তুমি? আর হাভাইত্তা মেয়েরে বিয়া করার মজা বুঝছ?”
ইহসান কপাল কুঁচকালো, “হাভাইত্তা মানে?”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আজিজ শেখ বাঁকা হাসলেন। পানির গ্লাস টেনে নিয়ে ঘড়ঘড় করে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন, “যার বাপ পঙ্গু, মা নাই। সম্পত্তি নাই, রেফারেন্স নাই, লাইফে কোনো স্ট্যান্ডার্ড নাই—তোমার মতো ছেলের বউ হইতে গেলে যে নিজেরও যুতসই যোগ্যতা লাগে তা জানা নাই, তারে হাভাইত্তা ছাড়া আর কি বলব?”
ইহসানের চোখ ধীরে ধীরে রক্তিম হয়ে উঠল, “আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলার অনুমতি কে দিলো?
আর স্ট্যান্ডার্ড, যোগ্যতার মানে কী? একে-ওকে বিয়ে করে ঠকানো? হোটেলে যাওয়া? শরীর প্রদর্শন? অবশ্য কাকে কী বলছি? কাকের কাছে কাকের গান!”
আজিজ শেখ সব কথা হজম করে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পানির গ্লাসে একটা চুমুক দিলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন, “বাপের টাকা থাকলে এসব কিছু মাফ করাই যায়। দুনিয়ায় টাকাপয়সা, সহায়-সম্পত্তি আসল। অন্যকিছু বাদ দিলেও চলে।”
ইহসান বাঁকা হাসলো, “বিকৃত মানসিকতার মানুষের কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি আর কীই আশা করা যায়! বুঝি বুঝি, জুটেনি তো কপালে, তাই এই হাল—আফসোস!”
পুত্রের কটুক্তিতে মেজাজ চড়তে গিয়েও চড়ল না বরংচ তুচ্ছতাচ্ছিল্য ফুটে উঠল আজিজ শেখের গলায়, “যারে কবুল বইলা নিয়া আসছ হেই তো আক্কল জ্ঞানহীন মাইয়া মানুষ! তুমি নিঁখোজ অথচ সে দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াইতেছে। কোনো চিন্তা নাই। লিথুরে বউ করো নাই সেইটা মানছি কিন্তু তোমার বউয়ের আচরণ বুঝায় দিয়েছে আমি ওরে না মাইনা ঠিক পথেই আছি!”
“আপনার মানার ধার ধারছেটা কে? নিজেকে অতো দামী ভাবার কিছু নেই। আপনি কী ভাবছেন সৃজা আনন্দে আছে শুনে আমি দুঃখব পাব, নারাজ হব? উহু! আমি শুনে খুশি হয়েছি! আমার অনুপস্থিতিতে ও নিজেকে আনন্দে রাখছে শুনে আমি প্রাউড ফিল করছি, দ্যাটস মাই ওয়াইফ…”
ইহসান একপেশে হেসে বলল কথাগুলো। আজিজ শেখ এসব কটুক্তি গায়ে মাখলেন না। ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন, “সে তুমি যাই কও, তোমার ঐ হাভাইত্তা বউ ঘর হাতানি শুরু করছে! মিনিমাম কার্টেসীও জানা নাই ঐ মেয়ের। অনুমতিবিহীন ধরার সাহস পায় ক্যামনে তোমার মায়ের ছবি-ছিনারিতে? এইখানে আইসা বইসা আছ, ঠিক কাজ করছ!”
আজিজ শেখের বাঁকা কণ্ঠের কথাগুলো ভালো লাগল না ইহসানের। থমথমে গলায় আওড়াল, “আপনার মুখ থেকে সৃজার ব্যাপারে কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি কিন্তু কিছু ভুলে যাইনি! আপনি ওর কী কী ক্ষতি করার ধান্ধা করেছিলেন সবই আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। নিজের আর সাগরেদদের অবস্থা আশা করি ভুলে যাননি!”
লিথুর হুট করে উবে যাওয়া, তারপর আবার তপন নামক একটা ছেলেকে বিয়ে করে ফিরে আসা! ছেলের হুমকিতে মনে পড়ে আজিজ শেখের। লিথুর হাতের এ’সি’ডে পুড়ে যাওয়া অংশটা চোখে ভাসতেই তিনি নিজের পাঞ্জাবি চেপে ধরেন। এ’সি’ড পরিকল্পনায় তিনি জড়িত এটা জানার পর ইহসান তার শরীরের কিছু অংশেও এ’সি’ডে ঝলসে দিয়েছে! কাপড়ের উপর দিয়ে ঝলসানো জায়গাটায় কয়েক সেকেন্ড নীরব চেয়ে থাকেন। কী এক ছেলে হয়েছে তার, বাপকেও ছাড়েনি! আজিজ শেখ স্বাভাবিক গলায় বলেন, “এরজন্য তুমি আমার চালের মিল লাটে উঠাইসো, হোটেলের কাজটা হাতছাড়া করাইয়া ফতুর করার চেষ্টা করছ! তা করছো যেহেতু, করছো! তুমি আমার সন্তান হও, তোমার অতটুকু রাগ মাইনা নিসি।”
ইহসানের মাথা রাগে দপদপ করছে। বাপ নামক ট্যাগ লাগিয়ে রাখা এই ধুরন্ধর লোককে সে কী করবে, কোন শাস্তি দেবে? দু-একটা ব্যবসা লাটে তুলেছে, তাতে কী? এই লোকের তো বিন্দুমাত্র অনুশোচনাও নেই। কিছু হারানোর ভয় পায় না লোকটা। ইহসান চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। এক পৃথিবী বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে সতর্ক করে আজিজ শেখকে, “হু, ওটাই! মনে-মগজে গেঁথে রাখেন। দরকার হলে সাইনবোর্ড বানিয়ে গলায় ঝুলান! পরেরবার কোনো কলকাঠি নাড়ালে এইবার শেষবার, আমি ভুলে যাব সম্পর্ক কী, সামনে কে আছে।”
আজিজ শেখ পুত্রের হুমকি গিলে নেন, পরক্ষণেই সাবলীল কণ্ঠে বলেন, “সে তুমি কবেই ভুইলা গেসো আমি তোমার কে! ছোট থেকে বড় করলাম, ভরণপোষণ দিলাম, পরিচয় দিলাম, আগলায় রাখলাম, যা চাইছো জীবনে তা-ই দিলাম…”
কথাটুকু শেষ হয় না৷ তার আগেই ইহসান তীব্র স্বর তাকে থামিয়ে দেয়, “না দেননি। মাকে চেয়েছিলাম, দিতে পারেননি। আর যেসব দেওয়ার কথা বলছেন, সেগুলো আপনার পাপের প্রতিফল, আমরা পেতামই, ম্যান্ডেটরি ছিল! তাছাড়া আপনিই নাকি চেয়েছিলেন, যে-কোনোভাবে মা’কে বাগে আনতে! শেষ পর্যন্ত কী হলো? পেরেছিলেন আমার মা’কে বাগে আনতে? পারেননি। কেন পারেননি? কারণ আপনি একটা ব্যর্থ আর কাপুরুষ প্রজাতির অমানুষ! আপনার নষ্ট আর কলুষিত চরিত্রের জন্য আমরা মায়ের স্নেহ থেকে চিরজীবনের জন্য বিসর্জিত!”
ক্ষোভের কথাগুলো শুনে গা জ্বলে উঠলেও আগুন বাইরে বের করলেন না আজিজ শেখ। নিজের এই ব্যর্থতা বারবার মনে করতে চান না। কিন্তু এটাও তো ঠিক—ঐ নারীই একমাত্র ব্যক্তি, আজিজ শেখ যার মনে জায়গা করতে চেয়েছে! কিন্তু ঐ মেয়েমানুষ বারবার ভেঙেছে, তবুও মচকায়নি! তার হয়েও তার হয়নি! এই দুঃখ কোথায় রাখবেন তিনি? বুকটা ভারী হয়, জ্বলে! আজিজ শেখ গোপনে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে নিজে স্বাভাবিক হোন। কথা না শোনার ভান করলেন। ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে কথা কাটালেন, “যাইহোক, বাপ হয়ে তো আমি ফেলে দিই নাই তোমাদের চারজনকে—আব্বা হই! কিঞ্চিৎ সম্মান তো দিবা নাকি?”
“আমি ইজহান নই।”
আজিজ শেখ হাল ছেড়ে দিয়ে ফুঁস করে শ্বাস ছাড়েন, “ইহসান, তুমি যে আমার কলিজার টুকরা কোনোদিনই সেইটা বোঝো নাই।”
“ভাগ্যিস! নয়তো লুফারটার মতো গদগদ করতাম একটা রে’পিস্টকে!”
আজিজ শেখ ছেলের মুখে সরাসরি একথা শুনে মেজাজ হারান। তবে বরাবরের মতোই প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন, “তা যা খুশি বলো, আমি রাগ করি না।”
“লজ্জা থাকলে তো!”
“মেয়েমানুষ ভাবো কেন নিজের আব্বাকে?”
আজিজ শেখ হেসে উঠেন। ইহসানের বিরক্ত লাগে, চরম বিরক্ত। সে চোখমুখ শক্ত করে বাপের হাসিমুখের দিকে চেয়ে থাকে। আজিজ শেখ কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ান। এরপর ঘুরেফিরে ফ্ল্যাটটা দেখতে থাকেন। ঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা। ইহসান ভেবেছিল এই লোক বিদায় নেবে, কিন্তু যাওয়ার কোনো লক্ষ্মণ নেই। ওর আরো বিরক্তি লাগে, রাগে হাত-পা নিশপিশ করে উঠে! ঐ ঘরে বিকেল থেকে ম-দ খেয়ে টাল হয়ে ঘুমাচ্ছে ইনজান। আজিজ শেখ ওকে দেখে এখন আবার আহ্লাদের নাটক বসাবে। পুত্রদের নিয়ে তার আহ্লাদের শেষ নেই! ইহসান দাঁতে দাঁত চেপে বাপ নামক লোকটার কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল!
আধ ভিড়ানো দরজাটা ঠেলতেই নাক ডেকে ভোঁসভোঁস করে ঘুমানো পেলব মুখটিতে নজর পড়তেই আজিজ শেখ বিস্মিত চোখদুটোকে বিশ্বাস করতে পারেন না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তিনি উত্তেজিত ভঙ্গিতেই চিৎকার করে উঠেন, ছুটে যান চাদর গায়ে জড়িয়ে বেহুঁশের মতোন ঘুমিয়ে থাকা যুবকের দিকে, গিয়ে দু’হাতে আগলে নেন তাকে, কোনোদিক খেয়াল না করেই বলে উঠেন, “আমার ইনজান দেখি! কবে আসলা তুমি? ইশশিরে…পোলাডা ঘুমে! ও ইহসান! কলিজা বাপ আমার, তুমি এতক্ষণ ধরে চুপ
ক্যান? বলো নাই ক্যান আমার হীরামানিক এইখানে…দেশে…কাজটা কি ঠিক করলা?”
ইহসানের রাগে পিত্তি জ্বলে। উচ্চরবে বিরক্তি ঝাড়ে, “হীরা মানিক কোলে নিয়ে বসে থাকেন, আমি কারোর খবর এনে দেওয়ার পিওন নই।”
চেঁচামেচিতে আর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে যায় ইনজানের।
সে চোখ খুলে পিটপিট করে। মুখের উপর কাচা পাকা দাঁড়িওয়ালা মুখটিকে দেখে সে কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তি প্রকাশ করে, “ ষাঁড়ের মতোন চেঁচাচ্ছ কেন? দেখোনি, আমি ঘুমে অর্ধমৃত?”
আজিজ শেখ খুশিতে, আনন্দে ডগমগ করছেন। এতদিন…এতবছর পর তার ছোটছেলে তার বুকে,
এই আনন্দেই তিনি গলে যাচ্ছেন। ছেলের চোখমুখে চুমু খেয়ে তিনি বললেন, “ঘুমাইও, আগে একটু আদর কইরা নিই!”
“আমি এখন ছোটবাচ্চা না।”
“তুমি আমার কাছে সেই ছোট্ট ইনজানই আছো বাপ, বড় হইবা না। তো কখন ফিরলা? আমায় জানাও নাই কেন? আর বাড়িতে ক্যান উঠো নাই? এইসব কী দেখতেছি আমি?”
ইনজান তখনো কপাল কুঁচকে চেয়ে। বাবার এত প্রশ্নের কোনটার জবাব সে আগে দেবে ভেবে নিয়ে বলল, “ফিরলাম মাসখানিক আগে, ফিরে বাড়িতেই যাব ভাবছিলাম। কিন্তু তোমার কলিজার টুকরা
পথেই আমাকে মেরে পঙ্গু করে প্রথমে হসপিটালে এরপর এই ফ্ল্যাটে এনে আটকে রেখে দিলো, ভাঙা
পা নিয়ে যেতে পারিনি কোথাও।”
আজিজ শেখ আঁৎকে উঠেন। চাদর সরান ছেলের উপর থেকে। দু’পা ব্যান্ডেজে মুড়ানো। দরজার কোণে হুইলচেয়ার দেখে হতভম্ব হন তিনি। আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করেন, “কিন্তু কেন?”
“ল্যাভেন্ডারের দিকে নজর দিয়েছি বলে।”
আজিজ শেখ মুখ বাঁকান, “ল্যাভেন্ডার আবার কে?”
ইনজান দুষ্টু হেসে বলে, “তোমার পুত্রবধূ রুপে যাকে বিয়ে করে নিয়েছে ব্রো, সে-ই।”
আজিজ শেখের মাথা ঘুরে উঠল। কোনোরকমে বললেন, “তোমার ওরে পছন্দ?”
“হু। প্রথম প্রেম৷ সিরিয়াস অনুভূতি। টিস্যু টাইপ না।”
আজিজ শেখ সমীকরণ মেলাতে না পেরে পাথর মুখে বসে রইলেন। তার কিছু বলার নেই। ছোটছেলে উন্মাদ, হেয়ালি ধরনের। এর গুরুদোষ, ইহসান যা পছন্দ করবে, তা ওর চাই। পুরোটা না পেলেও ভাগ চাই। তিনি ইনজানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ব্যথিত নজরে ওর ভাঙা পায়ের দিকে দেখেন। বুকটা হু হু করছে তার। কখনো ফুলের টোকা পর্যন্ত দেননি ওদের। অথচ তার ছেলে ইহসান নিজের ভাইদেরই মেরেধরে শেষ করে দিচ্ছে। জানেন তিনি ইহসানের আচরণ সম্বন্ধে। তাই ঝামেলা এড়াতেই বিরক্তি লুকিয়ে ইনজানকে বলেন, “ঐটা একটা মাইয়া হইসে? বেক্কল আর বেয়াদবের চূড়ান্ত! আমি আরো সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখাব তোমায়। পছন্দ হইলে বিয়াশাদি কইরো একটারে।”
“উহু! অনেক বছরের ফিলিংস জমে শক্ত হয়ে গেছে। ভাঙা সম্ভব না।”
ভাবলেশহীন কণ্ঠে কথাটা বলে আজিজ শেখের উরুতে মাথা রেখে আবারও ঘুমানোর উদ্দেশ্যে চোখ বুজে ইনজান। ছেলের ঝকঝকে গাল নরম চুলে হাত ডুবিয়ে মনে মনে প্রমাদ গুনেন আজিজ শেখ। সৃজা একটা সাধারণ মেয়ে। আহামরি কিছুই নেই এর মধ্যে। কী এমন দেখল তার ছেলে দুটো এই মেয়ের মধ্যে? কী বিশ্রি অবস্থা! লোকে শুনলে কী বলবে? আজিজ শেখের মনে একটু ধাক্কা দেয়, তরুণ বয়সে তিনি নিজেও যেমন চরিত্রের অধিকারী ছিলেন— অন্যের দোষ আর কী?
সৃজার বেশ সন্দেহ হচ্ছে রশিদের উপর। ও নিশ্চিত জানে ইহসানের কোনো না কোনো খোঁজ ওর কাছে আছে। কিন্তু বলছে না। সৃজা মন শক্ত করে রশিদকে আবারও ফোন দেয়, “আমি কতটা চিন্তায় আছি, বুঝতে পারছেন রশিদ ভাই? ওর খোঁজ আপনি নিশ্চয় জানেন, কিন্তু আমাকে বলছেন না। কেন এরকম করছেন বলুন তো?”
ফোনের ওপাশে রশিদের খুব খারাপ লাগে সৃজার জন্য। স্যারটা কী পাষাণ, অহেতুক কেন এই মিষ্টি মেয়েটাকে অস্থির করছে? ওর ইচ্ছে করছে জানিয়ে দিতে। কিন্তু তার কিছু করার নেই। স্যারের আদেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। সে ম্লান স্বরে বলে, “আমি কিছু জানি না, বোন। জানলে কী আর বলতাম না?”
“ও সব কাজ আপনাকে জানিয়েই করে, কোথায় গেছে, কী করে, সব আপনার নোটবুকে সাজিয়ে লেখা থাকে। আমি জানি আপনি আপনার স্যারের কথায়ই আমাকে কিছু জানাচ্ছেন না, কিন্তু একবার ভেবে দেখুন এটা কী ঠিক করছেন?”
“না মানে…জানলে জানাতাম সত্যিই।”
রশিদ মন্থর কণ্ঠে বলে। সৃজা স্পষ্ট বুঝতে পারে, রশিদ জানে ইহসান কোথায় আছে। কিন্তু ইহসানের নিষেধ থাকায় বলছে না। এই রশিদ স্যারের ভক্ত—ভয়ও পায়। এজন্যই হয়তো কিছু বলছে না। ওকে আর জ্বালিয়ে কাজ নেই। সৃজা আর খোঁজ করবে না পাষাণটার! থাকুক যেখানে খুশি! অহেতুক কষ্ট পাবে না। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভার গলায় রশিদকে বলে, “আপনার বিবেককে একবার জিজ্ঞেস করে দেখবেন তো, রশিদ ভাই, সে কী বলে! এরপর যদি আমাকে ওর খবরটা জানাতে ইচ্ছে হয়, তাহলে একটা ফোন দিয়েন। আর বিরক্ত করছি না আপনাকে। ওহ হ্যাঁ, যদি আপনার সাথে ওর যোগাযোগ হয়, তাহলে জানিয়ে দিয়েন—সে কাজটা ভালো করেনি, এরজন্য খুব ভুগবে, পস্তাবে। রাখছি।”
রশিদ বেশ বিপাকে পড়ে গেছে। ওর চিন্তা হচ্ছে। ভয় হচ্ছে। তখন সৃজা যেভাবে বলল ইহসান খুব ভুগবে, পস্তাবে! এসবের মানে কী? সৃজা আবার রাগ করে কিছু করে বসবে না তো? যদি ডিভোর্স দিয়ে দেয়? বা হতাশ হয়ে সু’সা’ইড করে? রশিদ বেশিকিছু ভাবতে পারল না। স্যারের সংসারটা সে ভাঙতে দিতে পারে না। সে বুদ্ধি খাটিয়ে ইহসানকে ফোন দিয়ে মলিন গলায় বলল, “স্যার…ম্যাডাম তো মনে হয় উল্টাপাল্টা কিছু করার প্ল্যান করতেছে।”
“প্ল্যান মানে?”
রশিদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “আমায় ফোন দিয়ে আপনার খোঁজ জানতে চাইল একটু আগেও। আমি বলি নাই। এতে ম্যাডাম বলল আপনি নাকি খুব পস্তাইবেন, ভুগবেন। কেন বলল আমার জানা নাই। কিন্তু আমার ভালো ঠেকতেছে না কিছু…”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৩৫
রশিদের কথা শুনে ইহসানের ভ্রু কুঁচকে গেল। নড়েচড়ে বসল সে। তিরিক্ষি গলায় সন্দেহ নিয়ে শুধাল, “ঝেড়ে কাশো রশিদ! ভালো ঠেকছে না কেন?”
রশিদ ঢোক গিলে বলল, “গলা শুনে আমার মনে
হলো কান্নাকাটি করছে খুব! মানে স্যার…আমি বলতে চাইছিলাম ম্যাডাম যদি রাগ কইরা উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে!”
ইহসান বাকরুদ্ধ বনে গেল। আসলেই কী? সৃজা হন্যে হয়ে ওর খোঁজ করছে এটা সে জানে। কিন্তু মেয়েটা যা অভিমানী আর খেয়ালি…যদি সত্যিই ওকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু করে বসে? ইহসান তড়িঘড়ি করে নিজের জিনিসপত্র খুঁজতে লাগল!
