অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৪

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৪
ইসরাত জাহান ফারিয়া

মরে আসা হলুদ আলোর এক বিকেল৷ বাড়িতে মেয়েলোক আর চাকরবাকর ছাড়া তেমন কেউ নেই। ইজহান দুপুরের পর জরুরি কাজে অফিসে গেছে। আর ইহসানও হন্তদন্ত হয়ে কোথাও একটা গেছে। সৃজাকে বলে গেছে ইনজানের খোঁজে যাচ্ছে। ইদানীং কিছু লুকোয় না ইহসান, বাড়ির সামনের ষ্টোরে গেলেও বলেকয়ে যায়। তবে ছোটো ভাইকে কেন খুঁজতে গেছে সেটা সৃজার জানা নেই। ইচ্ছেও নেই। ইনজান শেখের কোনো কথা সে শুনতে চায় না। অবশ্য না চাইলেও কয়েকদিন যাবৎ তার চোখে পড়েছে, খু নীটা বাড়িতে নেই। কোথায় গিয়ে পড়ে আছে, আবার কার সর্বনাশের ধান্ধায় আছে কে জানে! সৃজা তাই মাথা ঘামায় না। ইহসানের সঙ্গে তার বোঝাপড়া চলছে। সপ্তাহখানিকের সময় চেয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে কীভাবে নিজের ভুল আর অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করে, সাফাই গায় সেটার জন্যই টিকে আছে এ বাড়িতে।

বাচ্চারা বিছানায় বসে খেলছে, এ সুযোগে রুক্ষ হয়ে উঠা চুলে চিরুনি চালানোর জন্য সবে প্রস্তুত হয়েছিল, তার মধ্যেই ঘরের দরজায় কড়া পড়ল। ওমন ঔদাসীন্যে ভরা বিকেলে হঠাৎই আজিজ শেখ এলেন ওর ঘরে, ওর সঙ্গে কথা বলতে। সবকিছুর মতো এ লোকটার উপস্থিতিটা সহ্য করার চেষ্টা করল সৃজা। বিছানায় বসা ছটফটে নাতিনাতনিদের দেখে কিছুক্ষণ হাস্যরসাত্মক বাণী ও আহ্লাদ দেখিয়ে তিনি সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলেন, “শুনলাম তোমার নাকি ডানা গজাইছে, খুব নাকি উড়তেছ, আমার নাতি-নাতনি নিয়া ভাগার মতলব কষতেছ? সেইদিন না তোমায় আমি সাবধান করলাম, যা জানছ তা নিজেদের মধ্যেই রাখো!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সংসারে এইসব ঢুকাইয়া অশান্তি সৃষ্টি করবা না। তাইলে, এইসব কি শুনতাছি? বাচ্চাকাচ্চা এ বাড়িতে রাখবা না মানে? ওরা তোমার কে, কী? ওদের নিয়া এতবড় ডিসিশন নেওয়ার তুমি কে? কী ভাবো, ভাবোটা কী কও তো? আমার ছেলের সাথে তোমার বিয়েটা মাইনা নিছি, সংসার করার সুযোগ দিছি এমনি এমনি? তোমার মতো একটা মাইয়ারে, যার মা ঢ্যাংঢ্যাং কইরা পোলাপাইনদের কলেজে পড়াইতো তার মাইয়ারে আমি এমনি এমনি এই বাড়িতে সুখে থাকতে দিছি? উহুম! মোটেও না।”
সৃজার চোখজোড়া জ্বলে উঠে, “খবরদার! আমার আম্মুকে নিয়ে একটা বাজে ইঙ্গিতও করবেন না। আমি সহ্য করব না সেটা।

গমগমে স্বরে আজিজ শেখ হুঙ্কার ছাড়েন, “তেজ দেখাইয়ো না। মেয়েমানুষ হয় নম্র ভদ্র, শান্তশিষ্ট। তাদের গলার স্বর থাকব নিচুতে, চোখ থাকব মাটিতে। মাথা রাখবা নুয়াইয়া। কে সাহস দিছে তোমারে আমার চোখে চোখ রাইখা খবরদার বলতে? গলা উঁচাইয়া কথা বলতে? উফফো…তোমারে আমি যে কথা বলার সুযোগ দিতেছি এটাই তো অনেক বেশি। অন্য কেউ হইলে গলার আওয়াজটা আরো আগেই বন্ধ কইরা দিতাম! দিই নাই কেন বলি এবার! শুধু আমার অবাধ্য পোলাটার মতিগতি ঠিক রাখতে, আমার নাতি-নাতনিদের দেখভাল করতে। আর কিছু না, আর কিচ্ছুর জন্য না। মা হইছ, সব মাইয়ারাই মা হয়। মানি ওরা পেটে ধরে, জন্ম দেয়। কিন্তু রক্ত-বীর্য, বংশ-পরিচয় সব থাকে বাবাদের। মা ছাড়া সন্তান বড়ো হইতে পারলেও বাবা ছাড়া পারে না। তাদের সমাজ টিকতে দেয় না। লাত্থাইয়া রাস্তায় ফালায়। পথে-পথে কাঙালের ন্যায় বড়ো হইতে বাধ্য করে। কিন্তু বাবার ছায়া থাকলে কেউ সেই দুঃসাহস দেখাইতে পারে না। মা ছাড়া সন্তান এতিম হইতে পারে কিন্তু বাবা ছাড়া জা র জ পরিচয়ে বড়ো হয়।

তাই ওমন দুঃসাহস কখনোই দেখাইবা না, যে দুঃসাহসের কারণে আমার নাতি-নাতনিদের সেই পরিচয়ে বড়ো হইতে হয়। এমনিতেই তোমার নামে তোমার এলাকায় নানা কুৎসা শুনছি, চরিত্র কেমন তা নিয়া বিচার করব না। কারণ বাড়ির বউ তুমি, এই হিসেবে একটু সম্মান তোমারে দেওয়াই যায়। কিন্তু যা বাড়াবাড়ি শুরু করছ, বড়ো গলা কইরা কথা বলতাছ আমার ধৈর্য্য বেশিক্ষণ কুলাইব বইলা মনে হইতেছে না!”
সৃজার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল, “ধৈর্যে না কুলালে কী করবেন আপনি? মেরে গুম করে ফেলবেন? অবশ্য এসব তো আপনার বা হাতের খেল!”
“আসলেই বা হাতের খেল! আমার কাছে তুমি তো একটা মশা, এক টিপ দিয়া ধরলেই শেষ।”
“আপনার এতো ক্ষমতা? এতো ক্ষমতা কে দিয়েছে আপনাকে? আমার রব! আর কাউকে না করুন, তাঁকে তো একটু ভয় করুন।”

“ভয় করি। ভয় করি বলেই তো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজটা মিস দিই না। কাজা হইলেও পড়ি।”
“আপনার মুখে ধর্মের বাণী! বিশ্বাস করুন, শুনতে
একটুও ভালো লাগছে না। বিদঘুটে লাগছে। আমার কি মনে হচ্ছে জানেন? বয়সের ভারে নেতিয়ে পড়া নোংরা কোনো প্রাণী আমাকে হাস্যকর কোনো ঘটনা বলছে। অথচ আপনি একজন বাবার বয়েসী লোক।” বলেই মুখ বিকৃত করল সৃজা, “আমি কী নির্বোধ দেখেছেন? বাবাদের সাথে আপনাকে তুলনা দিলাম। আপনি তো কারো বাবা হতেই পারেননি, সেই যোগ্যতাই আপনার নেই। যা কিছু আপনি দেখান, ছেলেদের নিয়ে সুখী জীবন! বাস্তবে তো সেসব এগজিস্ট করে না। সবটাই ছলনা আপনার! অথচ লোকের কাছে আপনি মহান পিতা!”
শিরায় শিরায় আগুন জ্বলে উঠে। অথচ আজিজ শেখ পারেন না এক থাপ্পড়ে অনিতা রেহমানের মেয়েটার মুখ বিকৃত করে দিতে। দাঁত কিড়মিড় করে তিনি বাঁকা হাসেন, “লোকের কাছে মহান না হই, আমি নিজের কাছে মহান হইতে পারলেই খুশি। আর আমি মহানই।”

সৃজার শীতল কণ্ঠস্বর, “খু ন করা, অন্যায় প্রশ্রয় দেওয়াটা আপনার কাছে মহান কাজ হতেই পারে। কিন্তু একজন সন্তান হিসেবে আমার কাছে আমার মা কোনো খেলনা নয়, যাকে আপনাদের মতো হায়েনারা ছিনিয়ে নিয়েছেন বলে কেঁদেকেটে, সব ভুলে আবার খেলায় মন দেব!”
আজিজ শেখ গায়েই লাগান না সৃজার কোনো কথা।যেন একটা বাচ্চা তার অবাধ্যতা করছে, আর তিনি হেসেখেলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন এমন একটা ভাব নিয়েই তিনি চওড়া হাসেন। তীক্ষ্ণ স্বরে বলেন, “সংসার নামক খেলায় ঢুকছ। মা-বাপের চেয়েও বেশি আপন এখন তোমার স্বামী। তাই না চাইলেও মন বসাইতে হইব রে মা। মুখে মুখে তর্ক কইরো না। যা বলছি শুনো।”

“মা ডাকবেন না, আমার এতো কাল দিন আসেনি যে আপনাকে বাবা অথবা পুত্রের স্থান দিতে হবে। আর বলছেন সংসারে মন দেওয়ার কথা? যেটা সংসার নামক মরীচিকা, সেখানে মন বসিয়ে মনকে কষ্ট দেওয়ার বোকামি এমিলি ইয়াসমিন করতে পারে, সৃজা রেহমান না।”
এমিলির নাম নেয় মুখে? কতো বড়ো স্পর্ধা এই মেয়ের! ক্রোধে কটমট করে উঠেন আজিজ শেখ। মস্তিষ্ক তার নিয়ন্ত্রণ হারায়। সৃজার অবাধ্যতায় বেরিয়ে আসে তার পৈশাচিক স্বরূপ। হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জে উঠে তিনি আকস্মিক সৃজার কণ্ঠনালি চেপে ধরে অগ্নি স্বরে বলেন, “এমিলির নাম করে কী বোঝাইতে চাও? যা-ই বোঝাইতে চাও না কেন, ওর মতো হইতে পারবা? যতোই ঘৃণা করুক, শেষ নিঃশ্বাসটা এই বাড়িতেই নিছে৷ এই বাড়ির মাটিতেই শায়িত আছে। ওর মতো হইতে একশো জন্মেও পারবা না তোমরা নিমকহারাম মেয়েজাত। এতক্ষণ ভালোভাবে কথা বইলাও তোমার মতো চুনোপুঁটির তেজ সহ করতে হইতেছে আমারে? বলি, এত তেজ কোত্থেকে পাইছো? মায়ের থিকা? মইরা ভূত হইছে, তার বেটি তুমি! তোমার উপর নিশ্চয় ভর করছে! চলো, আজ সেই ভূতের কাছেই পাঠামু তোমারে!”

অতর্কিত আক্রমণের জন্য সৃজা প্রস্তুত ছিল না। ও হতভম্ব হয়ে গেল। গলায় শক্ত, রুক্ষ হাতের চাপে ওর দম আটকে এলো। চোখ উলটে আসতে চাইল। মনে হলো স্বয়ং মৃত্যুদূত সামনে দাঁড়িয়ে! কিন্তু মরলে কীভাবে হবে? এই পিশাচটা তার বাচ্চাদেরকে শেষ করে দেবে! তাকে বাঁচতে হবে। সৃজা হাপড়ের ন্যায় শ্বাস টানতে চাইল, দু’হাতে ঠেলে আজিজ শেখকে সরাতে চাইল মেয়েটা। কিন্তু পারল না। বরং ধস্তাধস্তিতে ওর মাথাটা দেয়ালে ঠোক্কর খেল। বাচ্চারা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠল তক্ষুণি! তা স্বত্তেও আজিজ শেখের হেলদোল হলো না, বরং সৃজার যেন বোধ হলো হিংস্র এক শ্বাপদের হাতেই আজ প্রাণ হারাবে সে। কিন্তু ঠিক সেই সময় ওকে আজিজ শেখ ছেড়ে দিলো, ছুঁড়ে মারল একটু দূরে। এরপর গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে ওর দিকে চাইল। হিসহিসিয়ে বলে উঠল,

“আমার নাতি-নাতনি নিয়া আমার ছেলেরে বিরহ যন্ত্রণা দিবা, কী ভাবছ? আমি আজিজ শেখ, হইতে দিব তা? এখন তো একটু নমুনা দেখাইলাম। এক পা বাড়ির বাহিরে যাউক! তারপর দেখো তোমার কী হাল করি আমি! এখন যাও, মাথায় যেসব নেড়ীবাদী পোকা কিলবিল করতেছে সেই পোকাগুলো মাথাচাড়া দিয়া ঝাইরা ফেল, পিষে মাইরা ফেলো। এরপর পানি ঢাইলা মাথাটা ঠান্ডা করে দুই রাকাত শোকরানার নামাজ পইড়া সংসারে মন দাও।”
বলতে বলতে ভয়ে, আতংকে ভীতু হয়ে কাঁদতে থাকা বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে, গালে আদর দিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। চোখভরা জল আর অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে সৃজা তাকিয়ে রইল তার গমনপথে।

এ কেমন লোক? এতোটা পৈশাচিক আর নিকৃষ্ট তার সত্তা? পুত্রবধূর গায়ে হাত তুলতেও কার্পণ্যতা নেই? সৃজার সবকিছু গুলিয়ে যায়। ক্রোধে কাঁপতে থাকে অনবরত। কোথায় ইহসান শেখ? সেও কী তার বাপের মতো এভাবে সৃজার কণ্ঠনালি চেপে ধরে মৃত্যু দেবে? না না, অতটুকু চেনা হয়েছে তার মানুষটাকে। এতটুকু ভালোবাসা সে পেয়েছে। কিন্তু আজ তার অনুপস্থিতিতে এ বাড়িতে তার নিরাপত্তা কোথায়? তার বাচ্চাদের নিরাপত্তা কোথায়? এরকম খু নে লোকেদের সাথে এক ছাদের তলায় থাকলে তার মৃত্যু নিশ্চিত! হয়তো দেখা যাবে, কাল সকালেই সে মরে পরে আছে বিদীর্ণ ঘাসের উপর, এমিলি ইয়াসমিনের মতোন! দেয়াল ধরে সৃজা কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। এই পিশাচের বাড়িতে আর এক মুহূর্তও না!

চাঁদটাকে খানিক পরপর গিলে নিচ্ছে বৃহাদাকার শত শত কালো মেঘকুঞ্জ। মাঝেমধ্যে বিজলিও চমকাচ্ছে! ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামবে কি-না কে জানে! নভেম্বর মাস বলে প্রকৃতিতে জমেছে কুয়াশা। চারিদিকে হালকা শীত শীত ভাব। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো তার মধ্যেও তপ্ত গ্রীষ্মের খরতাপে পোড়া দিনশেষে যেমন গহীন রাতে এক ধরনের নির্মল বাতাস মাঝেমধ্যে বয়ে যায়; এই রাত্রিতেও সেরকম বাতাস বইছে। তা স্বত্তেও সেই নির্মলতা ছুঁতে পারছে না সৃজাকে। বরং জ্বলুনি তৈরি করছে বুকের ভেতরটাতে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট দিচ্ছে। অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে কষ্টের ফোয়ারা। কিন্তু অন্তরিন্দ্রিয়কে দেওয়া প্রবোধের মূল্যটুকু অক্ষুণ্ণ রাখতে নিজেকে ধাতস্থ করে চুলায় চায়ের পানি বসায় সে।

মাথা ধরেছে। কড়া লিকারের চা খেলে যদি যন্ত্রণা শ্রান্ত হয়; তার নামকাওয়াস্তে চেষ্টা! এই চেষ্টা অবশ্য গত চারদিন ধরেই করে যাচ্ছে সে, কিন্তু ফল শূন্য। তবুও হাল ছাড়ার পাত্র নয় যেনো সে। সৃজা তপ্ত শ্বাস ফেলল! রান্নাঘরের জানালাটা দিয়ে বাইরের আকাশে তার দৃষ্টি আটকে গেল, বজ্রভরা মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে আড়ালে চলে যাওয়া চাঁদটা। একটুকুতেই কী দ্যুতি ছড়াচ্ছে! অথচ তার জীবনের দ্যুতি কই? সবটাই যে আঁধারের চাদরে ঢাকা পড়ে গেল! কোনোদিন কী সরবে সেই চাদর? নোংরা, কদর্য আজিজ শেখের শকুনি ছায়া থেকে পরিত্রাণ পাবে সবকিছু? সৃজার হঠাৎই গা গুলিয়ে উঠে। কী করে আজিজ শেখের মতো বিকৃতমস্তিষ্কের লোকটার সাথে দেড় বছরের মতো এক বাড়িতে কাটিয়ে এলো সে?

এখন ভাবলে তার নিজেরই মাথা খারাপ হয়ে আসে। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা শীতল হাওয়া তার আধখোঁপা করা চুলগুলো এদিকসেদিক দুলিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে যায়। আকস্মিক সৃজা উদাস হয়। পুরুষালি পরিচিত ঘ্রাণ তার নাকে ঠেকে। যেনো তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে! পুরুষটার অস্তিত্ব টের পেয়ে বিহ্বল হয় সৃজা, গলা ঠেলে বেরুতে চায় কান্না। পেছনে দৃষ্টিপাত করতে চায়, কিন্তু বিষিয়ে উঠা মনটা তা হতে দেয় না বলে তাকিয়ে দেখেও না মেয়েটা। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে উঠার চেষ্টা করতেই কাঁধে গরম নিঃশ্বাসের তাপ আর শীতল হাতের স্পর্শ সে টের পায়। তৎক্ষনাৎ সৃজার দম আটকে আসে, নড়তে ভুলে যায় সে। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। শব্দ খুঁজে পায় না, কিছু পায়ই না সে। শুধু অনুভব করে, উপলব্ধি করতে পারে মানুষটা তাকে স্পর্শ করছে। যত্ন নিয়ে, আবেগের সহিত। বহুদিনের আকাঙ্খা মিশিয়ে। সৃজা টের পায় তার অগোছালো চুলগুলো তার কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দিয়ে সযতনে উত্তপ্ত ঠোঁটজোড়া ছোঁয়াল তার কাঁধে। ওটুকু আদরে মেয়েটা নেতিয়েই পড়তো বোধহয়, কিন্তু বিস্ময় খেলে গেল মস্তিষ্কে। এটা কীভাবে সম্ভব? ইহ…ইহসান এখানে এলো কোত্থেকে?

এলিজ কি দরজা খুলে ওকে ফ্ল্যাটে আসতে দিয়েছে? বসার ঘরে বসতে দিয়েছে? স্তম্ভিত হয় সৃজা! অবচেতনে দু’পা পিছিয়ে যেতেই ধাক্কা খায় রান্নাঘরের রংচটা দেয়ালটাতে। সম্বিৎ ফেরার পরেও মেয়েটার বুঝতে সময় লাগে এতক্ষণ সে ভ্রমে ডুবেছিল! আজ চারদিন যাবৎ সে শ্যাওড়াপাড়ার বাড়িতে আছে। নীলু ফুপি আর এলিজার কাছে বাচ্চাদের রেখে সে এখন রান্নাঘরে চুলায় চায়ের পানি বসিয়েছে! এ চারদিনে ইহসান শেখ যতোবার এ বাড়ির দরজায় উপস্থিত হয়েছে ততবারই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে সে, এমনকি বাচ্চাদের মুখ অবধি দেখতে দেয়নি। ইজহানকেও না। আতঙ্ক ঢুকে গেছে সৃজার মনে, আজিজ শেখ যদি ওদের নিতে চলে আসে?

যদি জোর করে নিয়ে যায়? দরজা খুললেই যদি হামলে পড়ে? কী করবে সৃজা? আগুনের তাপে ততক্ষণে চায়ের পানিটা লিকার গলানোর জন্য উপযুক্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এদিকে তার খেয়াল নেই। সৃজার নিজেকে এলোমেলো লাগে। তার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? নয়তো এক পৃথিবী রাগ, অভিমান জমিয়ে রাখা লোকটাকে নিয়ে সে এমনতর অলীক ঘটনা কেন ঘটতে দেখল নিজের সাথে? অবান্তর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইল সে। কিন্তু পেল না, তার আগেই টগবগ করে ফুটতে থাকা পানির কয়েকটা ছিঁটেফোঁটা এসে পড়ল সৃজার ফর্সা হাতের তালুতেও। ঝলসে যেতে চাইল উপরিভাগের চামড়াটা। মৃদু আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে। দাঁতে দাঁতে চেপে ট্যাপের পানিটা ছেড়ে তার নিচে হাতটা দিয়ে রাখল সে। শীতল পানির স্পর্শ পেতেই যন্ত্রণা প্রশমিত হলো কিছুটা।

সৃজা স্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। এমনভাবে কী তার ভেতরে চলা ঝড়টাকে সারিয়ে তুলতে পারে না কেউ? এবারেও জবাব পেল না, মেয়ের চিৎকার তার কানে বাজলো। ঘুম পাড়িয়ে এসেছে আধঘন্টাও পেরুয়নি, এরমধ্যেই উঠে গেছে। চা আর বানানো হলো না চুলাটা কোনোমতে বন্ধ করে ছুটে বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। হুড়মুড় করে এলিজের কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তার কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগল সৃজা! আজওয়া বাচ্চাটা ওর সংস্পর্শে এসে যদিও চিৎকার থামিয়েছে, কিন্তু মায়ের কাঁধে মাথা ফেলে ঠোঁট ভেঙে কান্না করছে। এমন করুণভাবে কাঁদছে যে সৃজার দিশেহারা লাগে।

বাবাকে ছাড়া আজ চারদিন কেটে গেছে তাঁর দুটো বাচ্চার। বাবার কোলঘেঁষা, বড়ো আব্বার আদুরে জান তারা! জন্মানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত খুব কমই তাদের ছাড়া এক রাত্রি দূরে কাটিয়েছে তারা। অথচ কী এক অভিশাপ যে ছুঁয়েছে তাদের; আজ চারদিন কতো দূরে তারা! কান্না থামানোর, জেদ ভুলানোর জন্যও পাশে নেই। আযরানকে আজকে সারাদিন যদিও একটু ভুলিয়ে রাখা গেছে কিন্তু আজওয়াকে কিছুতেই ভুলানো যাচ্ছে না।খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে প্রায়। সারাক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে লাগাতার কান্না করে যাচ্ছে মেয়েটা। তাদেরকেই খুঁজে ফিরছে চেতনে-অবচেতনে। মুখফুটে পরিষ্কার শব্দে বলতে পারছে না, কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গিমা দেখে যে কেউ এই সত্যিটা বলে দিতে পারবে। এলিজ স্থির
চিত্তে দেখে যায় সবটা। দ্বিধাহীন কণ্ঠে সে প্রশ্ন করে বোনকে, “একটা ফোন দেই ভাইয়াকে?”

সৃজা ত্বরিত পেছনে ফেরে। এলিজের পেলব সুন্দর অথচ সংশয়হীন মুখখানির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয় সে। সবকিছু জানা স্বত্তেও মেয়েটা কীভাবে এতো সহজে প্রশ্নটা করে বসল তাকে? সবকিছু কি আর আগের মতো আছে? আজিজ শেখ তো ওত পেতে আছে! সৃজার কণ্ঠ স্তব্ধতার মতো ভারী শোনায় এ পর্যায়ে, “ফোন কেন দিতে হবে তাকে?”
“আজওয়ার জন্য, ওর জন্য দিতে চাইছি। সামনাসামনি না হোক, ফোনকলে একবার ভাইয়াকে দেখলে অন্তত কিছু খাওয়ানো যাবে ওকে। সেজন্যই বলছিলাম।”
সৃজা আগের মতো একই নিরাসক্ত স্বরে বলল,

“দীর্ঘ স্থায়ী দুর্ভোগ থেকে সাময়িক কষ্ট পাওয়া ভালো। সহজে ভোলা যায়। আর সবকিছু সহজে ভুলতে পারলেই ভালো থাকা যায়। ভালো থাকাটা সবচেয়ে জরুরি। আমি চাই না ওদের অভ্যস্ততা বাড়ুক, ও বাড়ির কাল শ্বাস ওদের উপর পড়ুক…” গলা ভেঙে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে সৃজার, “এমন কয়েকদিন কান্নাকাটি করবে, এরপর সয়ে যাবে।”
ওদিক থেকে যে ইহসানও অস্থির হয়ে আছে, একটাবার কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য সেটা আর বলল না এলিজ সৃজাকে। বরংচ বলল, “ওদের এভাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। ওদের কী দোষ বলো? ওরা তো কোনো অন্যায় করেনি।”

“করেনি, আর যেন করতেও না পারে সেজন্যই শেখ বাড়ির ছায়া থেকে ওদের দূরে নিয়ে এসেছি। পারলে আইরাহটাকেও নিয়ে আসতাম, সুযোগ পেলে নিয়েও আসব! কোন মা চায়, তার বাচ্চারা বাবার আদর ছাড়া বড়ো হোক? আমি কি চেয়েছি? চাইনি তো! অদৃষ্ট আজ আমাকে, ওদেরকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে… ঐ লোকটা, আজিজ শেখ তার ছেলেদের ভালো শিক্ষা দেয়নি। দিতে চায়ও না। এখনও! এখনও সে ইনজান শেখের সব অন্যায়-উৎপীড়ণ প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের জন্য তার ছেলেদের উপর যে ফিরতি আক্রমণটা আসছে; সেটা কিন্তু সে মেনে নিতে পারছে না। পৃথিবীর সবথেকে স্বার্থপর এ লোকটা সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে! তার এসব পাপ তার ছেলেদেরও ছুঁয়ে যাচ্ছে। তোর ভাইয়া…সেও আইনের দারস্থ না হয়ে একটা লোককে নির্মমভাবে মেরেছে। প্রাণটুকু ভিক্ষা দিয়েছে কি-না জানা নেই আমার…”

আজওয়ার ফুঁপানোর সঙ্গে এবার যোগ হলো সৃজার নিঃশব্দ কান্নার আকুতি। যে আকুতি মা-মেয়েকে ছাড়াও এলিজের বুকের ভেতরেও রক্তক্ষরণের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। এমন অসহায় আকুতি, এমন দুর্বলতা কি কখনো মানায় এলিজের আপুকে? শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা এলিজের মনে চলা অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে মেয়েটা বারবার পথ হারাচ্ছিল, খেই হারাচ্ছিল জীবনের, বিশ্বাসের। আচ্ছা, ইনজান শেখ কীভাবে পারল তাদের পরিবারটাকে এভাবে তছনছ করে দিতে? তার বাবা-ই বা কেমন লোক; নিজের কুলাঙ্গার ছেলের অপরাধ ঢাকতে তার বাবাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল? ক্রোধে ভেতরটা পুড়তে থাকে এলিজের। পৃথিবীর সবথেকে চরম মাত্রার ঘৃণাটা এলিজ এই লোকটাকেই করে, আর করে যাবে আজীবন। আর শাস্তি? ন্যায়বিরুদ্ধ কাজ করে সেটা থেকে রেহাই কেউ পেয়েছে আজ অবধি? তাহলে আজিজ পুত্র কি করে পাবে? তবে এতোকিছুর পর, নীলু ফুপির থেকে সবটা শোনার পর পরিস্থিতির গ্যাড়াকলে ইহসান শেখ ওসবে জড়িয়ে গেছে বলে মনে হয়? কেন বিশ্বাস হয় না তার ইহসান ভাইয়া দোষী? নিজেকে কি ধিক্কার জানানো উচিৎ এলিজের?

ভাবনার মহাসমুদ্রে ডুবে যাওয়া এলিজের ঘোর কাটে সৃজার অস্থির, ক্ষিপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে, “এলিজ? চল, কাল সকালে থানায় যাই।”
চকিতে ফিরে তাকাল এলিজা ওর দিকে, “কার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবে?”
“খু নের মামলা করব ইনজান শেখ আর আজিজ শেখের নামে। প্রতারণার মামলা করব তোর ভাইয়ার নামে। আমার পুরো জীবনটা মিথ্যে করে দিয়ে ওরা কী ভেবেছে? শান্তিতে থাকবে? আজিজ শেখ কী ভাবে? তার হুমকিতে আমি ভয় পাই? আমার বাচ্চাগুলোকে কাঁদাতে হচ্ছে, কষ্ট দিতে হচ্ছে! অথচ ওদের পাপাই দায়ী এই কষ্ট দেওয়ার পেছনে। বাবা হওয়া কি এতই সোজা? ওরা কেউ আমার আব্বুর মতো নয় কেন? বিশ্বাসঘাতকের দল!”

তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা তীব্র ব্যথায় বিষিয়ে উঠতে লাগল সৃজার মাথাটা। তার ঝাঁঝালো কথার বাণে অবশ্য অযৌক্তিক কিছু খুঁজে পেল না এলিজা। ইনজান শেখ আর তার বাবাকে ফাঁসিকাঠে ঝুলানো উচিৎ। কিন্তু ইহসানের বেলায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যায়। সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, এটা ঠিক। কিন্তু তার যতটুকু দোষ তাতে অতো বড়ো এবং ভয়ংকর তার শাস্তি প্রাপ্য নয়। এলিজ বোনকে নিঃশব্দে দেখে। ক্রোধ, হিংস্রতার বালাই নেই, বিশ্বাস নষ্ট করার এক তীব্র ব্যথা যা সৃজা বয়ে বেড়াতে পারছে না; সেগুলোতে প্রলেপ লাগিয়ে মনকে সামান্য প্রবোধ দিতে চাইছে। মানসিক শক্তি পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটার। নষ্ট কি এলিজেরও হয়নি? সত্যটা জানার পর ভেতরটা কি তারও পুড়ে যাচ্ছে না প্রতিটা মুহূর্তে? হাহাকারে, যন্ত্রণায় চিৎকার করে কান্না করতে কি ইচ্ছে করছে না? তবে কেন এলিজ পারছে না? অব্যক্ত সব যন্ত্রণা বুকে চেপে নিজেকে বড়ো করতে শেখা এলিজ আসলে শেখেইনি নিজেকে খোলা বইয়ের মতো না হোক, বইয়ের একটা, দুটো পৃষ্ঠার মতো নিজেকে প্রকাশ করতে! ছোটোবেলায় মা বলেছিল, নিজেকে খুব
বেশি প্রকাশ করলেই ক্ষতি। খুব বেশি জেনে গেলে মানুষ তোমাকে তোমার সহ্যশক্তির বাইরে গিয়েও কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করবে। এই জীবনে এলিজ কখনও
কষ্ট পেতে চায়নি; কিন্তু বিধাতার কী লিখন! কষ্ট, যন্ত্রণা আর এলিজ; আষ্টেপৃষ্টে একে অপরের সাথে মিশে গেছে কবেই!

রাত দুটো কী তিনটে তখন; গভীর ঘুমে মগ্ন থাকা অবস্থায় ফোন ভ্রাইবেট করে উঠে এলিজের। আধোঘুমে জাগ্রত অবস্থায় সে অচেনা নাম্বার থেকে আসা কলটা রিসিভ করে কানে তুলে সালাম জানায়। ওপাশ থেকে উত্তর আসে না। কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা শেষে পুরুষালি একটা কণ্ঠ বলে, “তুমহারি শ্বাস গিন কে রখতা হুঁ, তুম হাসতা হো তো রাত টুট জাতি হ্যায়, তুম রোতা হো তো আসমান ভি রোয়া কারতা হ্যায়। আজীব না? মেরা নাম তুমহারে ফোন মে নাহি হ্যায়!

মাগর হার এক রিং কে আন্দার সিরফ মেঁ হি হুঁ,
তুমহে পতা ভি নাহি—এক আজনবি ছায়া সিরফ তুমহারে লিয়ে খুঁন বন কর বহ রাহা হ্যায়। দর মত, মেঁ আজনবি নাহি, সিরফ তুমহারে আন্দেহরোঁ কা তানহা ইনতেজার কা গুঞ্জ হুঁ।”
“আরসালান ইনজান বনাম খু নী শেখ, আপনি কী ভেবেছেন ধোঁকা দেওয়া খুব সোজা? কণ্ঠ বদলে, মাঝরাত্রিতে ফোন করে শায়েরি শোনালে আপনাকে চিনতে পারব না? এলিজ এতো বোকা?”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৩ (২)

কণ্ঠে ক্রোধ ফুটে উঠে এলিজার, সেই সঙ্গে ঘৃণা! সেই ঘৃণায় আরসালান শেখ সুখে, মরমে মরে যেতে থাকে প্রতিটি মুহূর্ত!
সে বলে, “এভাবে বলে না, হার্টে লাগে হার্টবিট!”

অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here