অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৬ (৪)
ইসরাত জাহান ফারিয়া
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল সৃজা। ঠিক কি শুনল ও?
এলিজকে লাগবে? ইনজান শেখের এলিজকে লাগবে? ওর হাতদুটো ইহসানের কলার চেপে ধরল শক্ত করে, “তোমার বাপ-ভাই পেয়েছেটা কী? আমার পরিবারটাকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে কেন ওরা? কী ক্ষতি করেছি আমরা?”
ইহসান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করে হাসলো, “কোনো ক্ষতি করিসনি, কিন্তু ওদের নজরে পড়ে গেছিস। যেমনভাবে পড়েছিল আমার মা! যাকে রক্ষা করার মতো এবিলিটি আমার ছিল না, যার কোনোকিছুই আমার হাতে ছিল না। আজও ছেলে হিসেবে অক্ষম মনে হয় নিজেকে। তাই আমি ওদের এই নোংরামোতে এলিজকে বলি হতে দেব না।”
আজিজ পুত্রের নজরে পড়েছে এলিজ! এ পর্যন্ত
যার দিকে তার নজর গেছে, তার জীবন কি এলোমেলো হয়ে যায়নি? কিন্তু এলিজের জীবন তো বহু আগেই সে এলোমেলো করে দিয়েছে, আর কি বাকি রয়ে গেছে? মেয়েটার সম্মান? সৃজার ভাবতে খুব কষ্ট হয়, আরসালান শেখ ইহসানের ভাই! ওর দু’চোখ ফেটে রক্ত বেরুনোর উপক্রম। ইহসান ওর গালে হাত রাখে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “বোন হয় আমার, ভাইয়া বলে ডাকে আমাকে; এই সম্বোধনের, এই সম্পর্কের যথাযথ মূল্য দেবে ওর ভাইয়া।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“না দিতে পারলে?”
“তোদের সবাইকে মুক্তি দিয়ে দেব। আর কখনো এই মুখ দেখাব না৷”
সৃজার উদ্বিগ্নতা বাড়ল, চোখ বুজে পড়ে রইল। ওর ভাবনায় এক পৃথিবী অস্থিরতা। শেষমেশ তার এলিজকে নিয়ে এতো এতো যুদ্ধ? অথচ মেয়েটা খুব সুন্দর একটা জীবন ডিজার্ভ করে। কীভাবে পরিত্রাণ পাবে শকুনিদের হাত থেকে তার বোনটি? পরদিন থেকে অন্য এক সৃজাকে দেখা গেল। যে সারাক্ষণ এলিজের সঙ্গে থাকে, ওর আশেপাশে থাকে। একটুখানি চোখের আড়াল হলেই ওর মনে হয়, এই বুঝি টুপ করে চুরি করে নিয়ে গেল কোনো এক দস্যু!
বোনের অদ্ভুত আচরণের মানে বুঝে না এলিজ। তবে ও অনুভব করতে পারে সৃজার উদ্বিগ্নতা আর ভালোবাসা। যেটা কপটতা বিহীন, নিঃস্বার্থ!
হাসপাতালে কাটানো কয়েকটা দিন আজিজ শেখের কেটেছে অপ্রসন্ন পীড়নে, অসহনীয় ক্রোধে। তবে তিনি নিজেকে ঠান্ডা মাথার মানুষ বলে মনে করেন, তাই অযথা হুল্লোড় করলেন না। এখান থেকে বেরিয়ে কী কী করবেন তা মনে মনে গুছিয়ে ফেললেন। ইমরানকে ডেকে কঠিন গলায় জানালেন, ‘কাল দিন পরশু বাদে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে তিনি নিজের একটা কাজে যাবেন। সে সময় তাকে যাতে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে সেঁটে দেওয়া না হয়।’ বাবার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া ইমরান লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমাকে সঙ্গে নেবে না?”
“যে কাজে যাব, সেইটা পারিবারিক। খানিকটা জটিল। একাই সামলাইতে হইব আমার। তোমারে সঙ্গে নিলেও তেমন কিছু লাভ হইব না। সুতরাং, আমারে নিয়া ব্যস্ত হইতে হইব না আব্বা।”
ইমরান অতিষ্ঠ চিত্তে বলল, “তো যাকে সঙ্গে নিলে লাভ হবে, তাকেই নিয়ে যাও!”
আজিজ শেখ ওর দিকে তাকিয়ে কটুক্তিভরা চোখে হাসলেন, “সে-ই কেউ কি আছে? কোনো জীবনে ছিল?”
ইমরান ভাবনায় পড়ে গেল। মিনিটখানিক আঁতিপাঁতি করে ভাবনার দুয়ার ঘুরে আসার পর মনে হলো, তার বাবার পাশে বিশ্বস্ত লোকের বড়োই অভাব। এইযে, ব্যবসায় নিয়ে এতো বড়ো ঝামেলায় পড়েছে, মামলা চলছে, এতে করে অফিসের ম্যানেজার থেকে কর্মচারী; সবক’টাই নিজেদের রুপ দেখিয়ে দিচ্ছে। আজিজ শেখের সব অবৈধ কাজে তাকে সঙ্গ দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়ে তারা এখন আইনি ঝামেলায় আটকে পড়ার ভয়ে সটকে পড়ছে। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, এই দুর্দশায় লোক চেনা হয়েছে। মুখ দিয়ে মধু ঝরতে থাকা পল্টিবাজদের চিহ্নিত করা গেছে। তাকিয়ে দেখল ইমরান, জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে দৃষ্টিতাক করে আছে আজিজ শেখ। বাবার এই দৃষ্টিকে সে শিকারি দৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে। তার মানে আজিজ শেখের কাছে কিছুই অজানা নেই, কোন ফ্যাসাদে নিজের নাম লিখিয়েছেন, তা আন্দাজ করে ফেলেছেন। ইমরান খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। আজিজ শেখ ওকে বললেন,
“যেসব মামলা করা হইছে তাতে জামিন
তো অসম্ভব! কিন্তু আমি তো জেলহাজতে থাকার মতো মানুষ না, জামিনের ব্যবস্থা তো কইরা রাইতে হইব বাপ। যাও উকিলরে খবর দাও। আমি কথা বলব তার সাথে।”
ইমরান বিষণ্ণ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল,
কিছু বলার মতো শব্দ তার ভান্ডারে খুঁজে পেল না।
হসপিটাল থেকে রিলিজ নেওয়ার পর আজিজ শেখ সরাসরি শেখ বাড়িতে ফেরার প্রয়োজনবোধ করলেন না। ইমরানের বারণ স্বত্তেও তিনি রওনা দিলেন শ্যাওড়াপাড়ায়। অগত্যা ইমরানও এলো তার সঙ্গে।দুপুর নাগাদ একনাগাড়ে বাজতে থাকা কলিংবেলের শব্দটাকে ক্ষান্ত দিতে এলিজ যখন দরজা খুলল, মেয়েটার চমকে উঠার কথা থাকলেও কেন যেন একটুও চমকাল না। যেন এটা খুব স্বাভাবিক। জানতোই যেন আজিজ শেখ এখানে আসবে।
তা আজ হোক, তো কাল!
ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা দূর, সালামটুকু দেওয়ার প্রয়োজনবোধও করেনি। দরজা খুলে কেমন অভদ্র চিত্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নূন্যতম সহবৎ শিক্ষা নেই। আজিজ শেখ সন্তপর্ণে নিজের রাগটা গিলে নিলেন। মেয়েটা যেমনই হোক না কেন, তাকে সংযত আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। কেননা, এই মেয়েটা জানের। ক্রোধের বশে পড়ে তাকে কিছু বলা যাবে না। মধুর ভাষায় কথা বলতে হবে। সতর্ক করে দিয়েছে তার ছেলেটা তাকে। আর জানের আবার মাথাটা বেশ গরম থাকে সবসময়। অবশ্য থাকবেই বা না কেন? এমির পেট থেকে বেরিয়েছে না, হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রা নিয়ে ঘুরতো মেয়েটা। স্পর্শ করলেই কাঁচা মাছ গরম তেলে ফেলানোর মতো ছ্যাঁত করে উঠতো। হুট করে এমিলির কথা মনে পড়ায় আজিজ শেখ একটু থমকালেন। হাসলেন। তার মনে হলো সামনে এলিজা নয়, এমিলি দাঁড়িয়ে আছেন। আর এমির সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলাটা মানায় না। তাই তিনি আলতো গলায় বললেন, “কী খবর, কেমন আছো?”
“খবর যদিও ভালো না, তবে আমি ভালো আছি।”
কাষ্ঠ হেসে বললেন আজিজ শেখ, “ভদ্রতা বইলাও একটা কথা আছে, একজনে কুশল জিজ্ঞাসা করলে পাল্টা তারেও ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে হয়। অবশ্য পারিবারিক শিক্ষার বড়ো অভাব, বুঝলা! তোমার মা-বাপ বা আমি, কেউই সন্তানদের এইসব সহবৎ শিক্ষা দিতে পারি নাই। কেউ সুযোগ পায় নাই, আবার কেউ তার সদ্ব্যবহার করে নাই। যেমন, আমি।”
অমায়িক হাসলেন আজিজ শেখ, এলিজ নিজেও হাসলো। ভন্ডদের মুখে মধুর রস একটু বেশিই থাকে কি-না, স্বাভাবিক গলায় বলল ও, “ভালো থাকার কথা না আপনার, শুনলাম হাসপাতালে কাটিয়ে এসেছেন বেশ অনেকগুলো দিন। বোধহয় সুস্থ হয়ে গেছেন।”
“হ্যাঁ, ওইখান থেইকাই সোজাসুজি এইখানে আসলাম। শরীর যখন সুস্থ, মন যখন চাঙ্গা তখন আর রোগী সাইজা পইড়া থাকবার দরকার কী? অবশ্য আমার ইমিউনিটি সিস্টেম বেশ ভালো কাজ করে।”
বিড়বিড় করে কী যেন বলে এলিজ, আজিজ শেখ স্পষ্ট বুঝতে পারেন না ওর কথা। তবে আন্দাজ করেন, ভালো কিছু বলেনি মেয়েটি। তবে তিনি খারাপই, ভালো কী বলবে লোকে? আশাও করেন না তিনি। সহাস্যে বলেন, “দরজার বাইরেই দাঁড় করায়া রাখবা নাকি? ভেতরে যাই? বইসা কথাটথা বলি? চা-নাস্তা কিছু বানাইতে পারো তো? কড়া করে এক কাপ লিকার দেওয়া চা নিয়া আসো তো, মা!”
এলিজ মুখে স্বাভাবিক হাসি ধরে রেখে বলল, “আমাকে এসব সম্বোধনে ডাকবেন না, নাম ধরে ডাকুন।”
মুখে স্বাভাবিক হাসি রাখলেও ওর চোখে অন্যরকম রেষ। আজিজ শেখের চক্ষু এড়াতে পারল না। তিনি কয়েকটা মুহূর্ত রুক্ষ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে এরপর হেসে ফেললেন। মাথা দুলিয়ে বললেন, “বেশ, বেশ তা-ই সই! তা বাড়িতে মানুষজন আছে তো, আছে না? ডাকো তোমার ফুফু আর বোনরে! কিছু কথা বলার আছে, আমার হাতে বেশি সময় নাই। ঝামেলাটামেলা পিছনে নিয়া ঘুরতাছি। যাও, ডাকো তাদের।”
এলিজ আজিজ শেখের দিকে এবার সরাসরি তাকাল, ওর চোখে সন্দেহ, অল্প বিরক্তি। সেইসঙ্গে অবশ্য কৌতূহলও ভেসে উঠল। নিচু স্বরে বলল,
“কিন্তু ওরা কেউ-ই যে আপনার কথা শুনতে আগ্রহী না, ইনফেক্ট আপনার মুখদর্শনও করতে চায় না!”
ইমরান বাবার পেছনে দাঁড়িয়েছিল, সে হাসফাস করছে। ভাবেনি তার বাবা এখানে চলে আসবে। আবার কোন ঝামেলা কর্তে এসেছে, কে জানে! একবার যখন চলে এসেছেই, একরোখা স্বভাবের বাবাকে আটকানোর সাধ্যি নেই ওর। নিজেকে অসহায় লাগছিল কেন জানি। এদিকে মুখের উপর এলিজের বলে দেওয়া তিক্ত সত্য কথাগুলো শুনে শরীরের হাড়-মাংস কিলবিল করতে লাগল, চোয়াল কাঁপতে লাগল আজিজ শেখের। তবুও যে কাজে এসেছেন, সেটা সম্পন্ন করতে হবে ভেবেই নিজেকে সংযত করলেন, যা তার স্বভাবের বিপরীত বৈশিষ্ট্য। কপট বিরক্তি দেখিয়ে বললেন, “বাড়ি বয়ে আলাপ পাড়তে আসছি, আগ্রহী না হইলেও শুনতে হইব আমার কথাগুলা। অবশ্য না শুনলেও আমার কিছু যায়-আসবে না। এইটা একটা ফর্মালিটি মাত্র! তবে পরবর্তীতে এই ফর্মালিটি পালন করি নাই বইলা কেউ যদি আমার দিকে আঙ্গুল তুলে, সেটা কিন্তু মেনে নিব না। দোষ না কইরা দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হইলে আমার আবার মাথা ঠিক থাকে না।”
গলা নামিয়ে শেষোক্ত কথাটা বললেন তিনি। এলিজ সূক্ষ্ম চোখে এই লোকটার উদ্দেশ্যে বোঝার চেষ্টা করল। এই অহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক, উন্মাদ লোকটা কেন এসেছে এখানে? কী এমন আলাপ থাকতে পারে এর পেছনে? অযাচিত লোকটাকে মূল্যবান সময় দেওয়া কী উচিৎ হবে, যেটা সে ডিজার্ভ করে না? সেকেন্ড খানিক সময় নিলো এলিজ, এরপর দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে নাছোড়বান্দা আজিজ শেখ আর ইমরানকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। আজিজ শেখকে দেখে মনে হলো, তিনি বেশ খুশি হয়েছেন ওর আচরণে। তর্কে জিতে গেলে অবশ্য মানুষ খুশিই হয়।
নীলু ফুপি যোহরের নামাজ শেষ করে মাত্র বালিশে মাথা লাগিয়েছেন, একটু শুয়ে নেবেন বলে। কিন্তু তা আর হলো না। এলিজের ডাক পড়ায় ধরফড়িয়ে উঠলেন তিনি। ফুপিকে এমন অস্থির হতে দেখে এলিজা বলল, “প্যানিক করো না। ধীরেসুস্থে উঠো। বসার ঘরে একজন অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। তুমি এসো, আপুকে ডাকছি আমি।”
এই ভরদুপুরে, খাওয়ার সময়ে কে এলো আবার?
নীলু ফুপি ঠিক বুঝলেন না। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে এসেছে রে?”
এলিজ রহস্যময় হেসে বলল, “তোমাদের এক অনাকাঙ্খিত মেহমান।”
বলে পর্দা উড়িয়ে চলে গেল মেয়েটা। নীলু ফুপি থমকে বসে রইলেন। মেয়েটার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি নিজেকে গুছাতে লাগলেন। কে এসেছে দেখতে হবে, তেমন কেউ হলে আবার রান্নাবান্নার ব্যপারও আছে। না খাইয়ে তো আর মেহমান বিদায় করা যায় না এই অসময়ে। চট করে চায়ের ব্যবস্থা করে ফেললে কেমন হয়?
সোফাসেটে ইমরানের পাশে আজিজ শেখকে বসে থাকতে দেখে সৃজা অবিশ্বাস্য রকমের চমকে গেল। মানে কী?এই লোকটা এখানে কেন এসেছে? ওকে মারতে, বাচ্চাদের নিয়ে যেতে? নাকি অন্য কোনো মতলবে? ও বিক্ষুব্ধ রাগ নিয়ে এলিজের দিকে তাকাল। চোখে প্রশ্ন, এই লোকটাকে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দিয়েছে কেন সে? এলিজা ওর দিকে চেয়ে,
ওর প্রশ্ন বুঝে অপ্রসন্ন হাসলো। হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, “কতদিন পালিয়ে থাকবে লোকটার থেকে, একবার মুখোমুখি হয়েই দেখো; কাপুরুষ লোকেদের কোনো ক্ষমতা নেই তোমার ক্ষতি করার, তোমার থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার!”
সৃজা আহত চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা কী জানে, আজিজ শেখ ঠিক কতটা ভয়ংকর হতে পারে স্বার্থসিদ্ধির জন্য? না, জানে না। ও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে শুধু বলল, “তোর ভাইয়াকে একটা ফোন দে।”
আজিজ শেখ কোনো ভনিতা করলেন না। গলা ঝেড়ে প্রথমেই সৃজাকে বললেন, “সোনামণিরা কই? ওদের আনো তো, দেখি! বইলো ওদের দাদু আসছে।”
সৃজা শক্ত গলায় বলল, “আপনার কাছে ওরা যাবে না। ওরা আপনাকে ভয় পায়। আর আপনি ওদের
দাদু নন।”
আজিজ শেখের কপালে ভাঁজ পড়ল সৃজার ধৃষ্টতা দেখে। তিনি দাদু নন, বাচ্চাদুটো তার নাতি-নাতনি নয়, তারা তার কাছেই যাবে না, এসব মূলত এই মেয়েটার বানোয়াট কথা। যা তিনি আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাই এ ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে ইতিওতি না করে প্রসঙ্গে চলে এলেন, “সেইদিন যেটা হইছিল, যেসব ঘটনার জন্য বাড়ি ছাইড়া চইলা আসছ, ওইটা আমার রাগের মাথায় করা একটা কাজ। যেইটা করতে চাই নাই, কিন্তু হইয়া গেছে। মূলত আমি সেদিন গেছিলাম, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি আলাপ করতে, কিন্তু কথার পিঠে জবাব দেওয়ার বাহানায় তুমি যা আচরণ করছ, নিজের রাগ কন্ট্রোলে আনতে পারি নাই। যাইহোক,
যা হইসে হইসে। তুমিও ঔদ্ধত্য দেখাইছ, আমিও রাগ কইরা হাত তুলছি। সমানে সমান।”
ভুল করেছেন, অপরাধ করেছেন এরপরেও অনুশোচনার লেশমাত্র নেই লোকটার মধ্যে। জানেই না বোধহয় ওসব কী! ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সৃজা কঠিন গলায় বলল, “আপনি এসব বলতে এসেছেন?”
“না। এসব বলতে আসি নাই। অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে আসছি! তোমার ফুফু কই? তারেও ডাক দাও। ওসব আলোচনা বাচ্চাদের সাথে করা ঠিক না, মুরুব্বিদের লাগে।”
কাউকে বলে দিতে হলো না, এক লহমায় সৃজা বুঝে গেল কোন বিষয়ে আলোচনা করার কথা বলছেন তিনি। ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ ছড়িয়ে পড়ল। একবার এলিজের দিকে তাকাল, নিজেকে দুর্দশাগ্রস্ত মনে হতেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল ও, “আলোচনাটা কি আপনার ছোটো ছেলে বিষয়ক?”
আজিজ শেখ সুন্দর করে হাসলেন। মেয়েটার বোধশক্তি ভালো। অল্পতেই বুঝে গেছে। তিনি ঘাড় দুলিয়ে হাসলেন, “ছোটো ছেলে আবদার করল, তোমার পাশে দাঁড়ানো তোমার এই বোনটিকে ওর লাগবে। লাগবে মানে বুঝছ তো? নাকি খুইলা বলতে হইব?”
ওমন একটা বিস্ফোরক মন্তব্যে সৃজা, এলিজকে বিস্ময়ের পাহাড় ছুঁতে না পারলেও নীলু ফুপিকে পারল। তার হাত থেকে চায়ের ট্রে’টা মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দে ভর দুপুরের নীরবতাকে চাঞ্চল্যময় করে তুলল। তিনি আজিজ শেখকে দেখে যতটা না চমকালেন, তারচেয়ে বেশি চমক পেলেন মাত্র বলা লোকটার কথা শুনে, “ক কী বললেন এটা? আপনার খু নী ছেলের আমার এলিজকে লাগবে?”
“সঠিক বলছেন। ব্যপারটা বিয়েশাদী বিষয়ক।”
নীলু ফুপি রাগে কাঁপতে লাগলেন রীতিমতো, “এতবড়ো দুঃসাহস দেখানোর স্পর্ধা কোথায় পেলেন আপনারা বাপ-ব্যাটা? আমাদের মেয়ে কি এতই ফেলনা যে, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য যে দায়ী, তার হাতেই মেয়ের জীবনটা তুলে দেব? জঘন্য চিন্তাভাবনা আপনাদের!”
“আমি মানুষটারে যেমন জঘন্য জানেন, তেমনি আমার চিন্তাভাবনাও সেরকমই জঘন্য। ওটা তো আপনাদের বরং ভালো জানার কথা, বেয়াইন।”
ইমরানের ইচ্ছে করল একছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে। সে ভেবেছিল, আযরান-আজওয়াকে দেখতে এসেছে বোধহয় এখানে। কিন্তু ব্যপার তো দেখছে অন্য! ওর মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। এতকিছুর পরেও নতুন জটিলতা বাড়ানোর জন্য মুখিয়ে আছে তার বাবা? কীভাবে, কোন মুখে এই প্রস্তাব নিয়ে এ বাড়িতে এলেন তিনি? আরসালান তার এতই প্রিয় সন্তান হয়ে গেল যে, নূন্যতম বিবেকবোধ রেখেও কথা বলছেন না! মায়ের খুনীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে? তাও এলিজার মতো একটা মিষ্টি মেয়ের? তাকে ভীষণ ক্ষুদ্ধ দেখাল। এ পর্যায়ে গলা ঝেড়ে কঠিন কণ্ঠে সে আজিজ শেখকে বলল, “এসব কথা বন্ধ করো, আর এখান থেকে চলো। তামাশার দিকে যাচ্ছে ব্যাপারটা।”
আজিজ শেখ ওর থেকে দ্বিগুণ কঠিন স্বরে ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিলেন ওকে, “চুপ করো, তোমার মতামত কেউ জানতে চায় নাই।”
ইগোতে লাগল কী-না কে জানে, নাকি অন্য কোনো বিবেকবোধ থেকে! ইমরান আর কোনো কথা বলল না, চুপ করে গেল। ফোনটা বের করে ভাইকে ম্যাসেজ করল সে। এর কিছুক্ষণ পরেই সাদা পোশাকধারী কয়েকজন লোকের সঙ্গে অফিসার ইনচার্জকেও দেখা গেল ফ্ল্যাটে। যাদের দেখে আজিজ শেখ মিনিট খানিক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে এরপর ছেলের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার ছাড়লেন, “এইসব তোমার কাজ? একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না। একটা জামিনের ব্যবস্থা করতে বলছিলাম, করছ মীরজাফরগিরি!”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৬ (৩)
ইমরান স্তব্ধ মুখে বসে রইল। শারীরিক অসুস্থতার দোহাই শর্তসাপেক্ষে আগাম জামিনের ব্যবস্থা করে রেখছিল সে, অথচ অফিসার আজই এলেন গ্রেফতার করতে। মানে কী? তাহলে কী তার ভাই? ইহসানের কাজ এটা? ইমরান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল! জামিনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তার কালঘাম ছুটে গেছিল, এখন সবেতে গুঁড়ে বালি!