অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৭
ইসরাত জাহান ফারিয়া
সেদিনের পর এলিজের সঙ্গে সহজভাবে কোনো কথা হয়নি সৃজার। কোথাও না কোথাও নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল। ওর কারণেই ওসব বিশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে এলিজকে। নয়তো আজিজ শেখের সাহসই হতো না এমনতর প্রস্তাব আনার, আর না ইনজান শেখ তার বিশ্রী নজরে বন্দী করতে পারত এলিজকে। ওসব ভেবেই বারবার কুণ্ঠায় ভুগছিল সৃজা। ওর হাবভাব দেখে ইহসানই উপলব্ধি করল ব্যাপারটা। অহেতুক নিজেকে দোষী ভাবার কারণে খানিকটা চটেও গেল সে। বলল, “দিনদিন বোধবুদ্ধি হারাচ্ছিস নাকি? ওসবে তোর কোনো দোষ নেই। থাকলেও সেটা আমার। তুই তো আর জানতিস না কে, কী নজরে কাকে দেখছে, মাথায় কী কুবুদ্ধি নিয়ে ঘুরছে! যাহোক, কুনজরের কুবুদ্ধিদাতাকে যখন আটকানো গেছে, তারও কোনো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
ধরা পড়ে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়েছিল ইহসানের দিকে। এলোমেলো স্বরে বলল, “তোমার বাবা হাজতে থাকলেই বা কী, তোমার ভাইয়ের তো হদিস নেই।”
ইহসানের ভ্রু কুঁচকে গেল। মুখাবয়ব শক্ত। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে ওর দিকে ফের তাকাল। বলল, “আজ হদিস নেই, কাল তো পেতেও পারি। ভরসা নেই তোর আমার উপর?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভরসা আছে, কিন্তু সেটা স্বীকার করবে না সৃজা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার বাবার কী যাবজ্জীবন হবে?”
ইহসান স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “জানি না। সব প্রমাণিত হলে ফাঁসিও হতে পারে। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানিস, ব্যাপারটা এতো সহজ হবে না। এতদিনেও একটা অপরাধের কথাও তার মুখ দিয়ে কেউ স্বীকার করাতে পারেনি।”
কোনো সন্তান তার বাবাকে নিয়ে অকপটে এমন ভয়ংকর কথা বলতে পারে সৃজা কখনো ভাবেনি। আজিজ শেখের জন্য ওর খুব আফসোস হলো। যে লোকটা ভাবে তার জীবন পরিপূর্ণ, সে সবকিছু পেয়ে গেছে। অথচ তার নিজের সন্তানেরা এই বিষয়ে একটুও চিন্তিত নয়। জীবনকালে কী নিদারুণ তার ব্যর্থতা আর অপচয়। সবটাই বৃথা! ও ইহসানের পাশ ঘেঁষে বসলো, কাঁধে মাথা রেখে বলল, “এইযে, তোমার বাবার সব প্রতিদ্বন্দ্বীরা একসাথে তোমার বাবার পেছনে পড়েছে, তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে, তার অফিসের কাছের লোকগুলো তোমার বাবার বিরুদ্ধে চলে গেছে; এসবকিছুর
পেছনে কলকাঠি তুমিই নাড়াচ্ছা, তাই না?”
ইহসান চুপ করে রইল। এসব স্বীকারোক্তি দিয়ে নিজেকে মহান কিছু প্রমাণ করতে চায় না সে। কেননা, সে মহান নয়। মহান হলে এসবকিছু করতো না, নিজ হাতে খুন করতো সে আজিজ শেখকে। পারেনি বলেই এসবের দারস্থ হওয়া৷ যদি আইনিভাবে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া যায়; একপ্রকার ডুবে যাওয়া নাবিকের খড়কুটো আঁকড়ে ধরে তীরে উঠার প্রচেষ্টামাত্র!
ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসটা বুকে চেপে দূরদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল রাস্তায় ওপাশে, কী দেখে কে জানে!
সৃজা নিচু স্বরে জানতে চাইল, “তুমি এমন কেন, ইহসান শেখ?”
“কেমন আমি?”
“অদ্ভুত, আমি তোমায় বুঝতে পারি না।”
“কেমন হলে পারতি?”
“বোধহয় স্বার্থপর হলে।”
রোষপূর্ণ কণ্ঠে বলল ইহসান, “আজিজ শেখের চরিত্রটা ধারণ করলে বুঝতিস, তেমনটাই বোঝাতে চাইছিস?”
সৃজা মাথা নাড়াল। তেমন হলেই সে ইহসানকে পুরোপুরি বুঝত কি-না জানে না। তবে রক্তের টানের চেয়ে ভালোবাসার টান বেশি, এমনটা পৃথিবীতে খুব বেশি দেখা যায় না। ও ফিসফিস করে বলল, “আমি বোধহয় কখনোই তোমায় বুঝতে পারব না।”
“আমি চাইও না তুই আমাকে বুঝিস!”
সুন্দর করে হাসলো ইহসান, সৃজার মনে হলো এত চমৎকারভাবে এর আগে কখনো হাসেনি ইহসান। আশ্চর্য! আজওয়াও তার পাপার দিকে তাকিয়ে তাঁর মতোই হাসছে! এতো আদুরে কেন এরা, বাবা-মেয়ে? সৃজা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না, তার যে খুব নজর লেগে যাওয়ার ভয়!
শীতের কাঁটা হাওয়া জানালা ঠেলে ঘরে ঢুকছে।জানান দিচ্ছে এবার জাঁকিয়ে ঠান্ডা নেমেছে। কুয়াশাজড়ানো বারান্দার টব ভর্তি টিউবারোজের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরময়। কিন্তু এলিজকে তা মুগ্ধ করতে পারছে না। সে হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে; যেখানে আরসালান শেখ তাকে আবার শায়েরি লিখে পাঠিয়েছে। সঙ্গে একটা বার্তাও। তার ভাষা এমন, ‘আমি চাই যে, তুমি ভালো থাকো, তবে সেটা আমাকে নিয়ে। আমাদের দু’জনের জীবনসূত্র এক, তাই ভদ্র ছেলের মতো, বাপের দ্বারা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। অথচ তোমরা প্রস্তাব না মেনে বুড়োটাকে হাজতে ঢুকিয়ে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছ, ব্যাপারটা আমার বিশেষ ভালো লাগেনি। আমাকে জ্বালিয়ে তুমি অন্যকে নিয়ে বাঁচতে চাইবে, সেটা আমায় খুব হেরো হেরো অনুভূতি দেবে। যেটা মোটেও ভালো হবে না, তোমার জন্য!’
প্রতুত্তরে এলিজ লিখল, ‘আপনি একটা হেরো লোকই। যা খারাপ করার করে দিয়েছেন, কী কোনো খারাপ হবে না আমার।’
‘সেল্ফ কনফিডেন্ট খুব বেশি তোমার।’
‘না তো, খুব কম। তাও আপনার মতো লোকের মাথায় কী চলছে সেটা আমি ধরতে পেরে গেছি।’
‘কী চলছে আমার মাথায়?’
‘বুদ্ধিমানেরা অত্যন্ত সেটা সরাসরি আপনাকে বলবে না।’
‘“হাহ… ইউ কন্টিনিউ টু মেজমারাইজ মি… ইন দ্য মোস্ট পিকুলিয়ার ওয়েই।”
ঘৃণায় ফোনটা ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে রাখল এলিজ। এরপর আরো অনেক নোটিফিকেশন বাজল, কিন্তু ও সিন করল না একটা ম্যাসেজও৷ একটা সময় জবাব না পেয়ে ওপাশে থাকা ব্যক্তিও থেমে গেল, এলিজও নিজের একটা কাজ সারল। কাজটা সারামাত্রই ওর মনে হলো, মাথাটা একটু হালকা হয়ে এসেছে।
ঐ জঘন্য লোকটা বিগড়ে দিতে পারেনি সম্পূর্ণভাবে ওকে। সে নিজেকে শান্ত করে পুনরায় পড়াশোনায় ডুবে গেল, যে দিনের আলো রাতের আঁধারে ডুবে গেছে তাও টের পেল না।
সৃজা ঘরে ঢুকে দেখল এলিজ পড়ার টেবিলে মাথা রেখে অন্যমনস্কভাবে পেন্সিলের দাগ কাটছে ডায়েরিতে। কী নিয়ে এত চিন্তা তা আন্দাজ করে গলা খাকারি দিয়ে এলিজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “কে, কী চায়, কী বলেছে এসব মাথায় নিস না। ভাবিসও না এসব নিয়ে। সামনে তোর পরীক্ষা, মন দিয়ে পড়। অন্য কোথাও মনোযোগ ঘুরানোর প্রয়োজন নেই।”
এলিজ বোনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ টের পেয়ে মাথা তুলে তাকাল ওর দিকে। স্পষ্ট অবসাদ ফুটে থাকা মুখে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, “কে, কী চায়, না চায় সেটা নিয়ে হয়তো ভাবা যেতো, যদি ভাবনার কোনো জায়গা বা সুযোগ থাকতো। তাদের কুকীর্তি আমার জীবনের অর্ধেক আলো নিভিয়ে দিয়েছে, বাকি অর্ধেকটা জীবনে তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা মানে তাদের কাছে নিজেকে ন্যস্ত করা, যেটা আত্মসমর্পণ করার শামিল। আমার দ্বারা এটা সম্ভব বলে মনে হয় তোমার?”
সৃজা গভীর আবেগে বোনকে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলাল। ছোট্ট এলিজকে আদর দেওয়ার মতো আগলে রাখল নিজের বাহুডোরে। বুকের ভেতর বয়ে চলা শব্দগুলো জানান দিচ্ছিল উদ্বিগ্নতার মাত্রা কতখানি। এলিজ মৃদু গলায় বলল, “যে অন্ধকারে বাস করে, সে কখনো আমাকে নিজের অন্ধকারে টেনে নিতে পারবে না। আমি একটুখানি বাঁচব, সেটাও নিজের মতো করে, নিজের নিয়মে। বিগড়ে যাওয়া কোনো কাপুরুষের বিকৃত চাওয়া, পাওয়ার দাসী হিসেবে নয়। খুব বেশি না, শুধু একটুখানি সাহসী হতে শিখতে হবে।”
“তুই আমার বোন কম, মেয়ে হোস বেশি। মা না হলেও মা হিসেবেই ভাবি, তোর সঙ্গে অন্যায় কিছু হলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না আমি।”
ওসব এলিজ ভালোভাবে জানে। আর জানে বলেই কখনো প্রকাশ করতে চায় না, বোঝাতে চায় না আপুকে সে, কতটা দুর্বল! তবে বাস্তবের অন্ধকার বা দুর্বলতা পুরোপুরি দূর হয় না বলে, সেটাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে হবে সেটারও তো কোনো যৌক্তিকতা নেই। এলিজ শুকনো গলায় সৃজাকে বলল,“ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা ভেবে এখনি কুঁকড়ে থাকলে হবে? এইযে তুমি আর ভাইয়া আমাকে সীমাবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত করতে চাইছ, একা ইউনিভার্সিটিতে যেতে দাও না, টিউশনেও না; কতদিন এমন চলবে? সবসময় তো তোমরা আমার পাশে থাকতে পারবে না। একদিন না একদিন তো আমাকে একা পথে চলতেই হবে। তাহলে কেন এতো ভয়?”
“পরেরটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু ইনজান শেখ যে এখনি তোর কোনো ক্ষতি করবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? বাপের মতো আস্ত একটা বদমাইশ সে। উহু! একটুখানি পার্থক্য আছে, গর্তে লুকিয়ে থাকার স্বভাবেই!”
এলিজের প্রতিক্রিয়া হলো অত্যন্ত অদ্ভুত, “বদমাইশ বলছ? অমানুষ না হলে নিশ্চিত তুমি তোমার শ্বশুরের প্রস্তাবটা নিদ্বির্ধায় গ্রহণ করে আমাকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে। ভাগ্যিস, লোকটা অমানুষ!”
এমন খোলাখুলি কথা আগে কখনো বলেনি এলিজ। সৃজা একটু হকচকিয়ে গেল। পরক্ষণে বিষয়টি ধরতে পেয়ে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে পুনরায় বলল,
অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৬ (৪)
“ভাগ্যিস অমানুষ!”
“এই যে, আমি তোমার পাশে আছি, তুমি আমার পাশে আছো। এরচেয়ে বড়ো সত্যি আর কী আছে এই মুহূর্তে?”
সৃজা রেহমানের ছোট্ট বোনটি খুব বড়ো হয়ে গেছে!
যে তার চোখ পড়তে পারে, মন বুঝতে পারে, তার ভেতরে চলমান দাপুটে ঝড় এক নিমিষেই থামিয়ে দিতে পারে।