আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১০

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১০
অরাত্রিকা রহমান

সকালটা যেন অন্যসব দিনের থেকে একটু আলাদা লাগছিল। মিরায়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে নামিয়ে দেওয়ার পরও রায়ানের মনটা অদ্ভুত অস্থির হয়ে ছিল। হয়তো এত বছর পর দেশে ফেরা, কিংবা হয়তো সেই অচেনা অথচ আপন মুখটা—যাকে বিয়ের কাগজে ‘স্ত্রী’ বলা হয়েছে অথচ বাস্তবে আজই প্রথম সামনে দেখা হলো। সব মিলিয়ে তার ভেতরে হাজারটা প্রশ্ন, হাজারটা টানাপোড়েন চলছিল।

গাড়ি ঘুরিয়ে সে সোজা নিজের কোম্পানির সাইটে এসে থামল। ঢাকার প্রখর সকালের রোদে সাইটটা সরগরম—শ্রমিকদের হাঁকডাক, লোহার রডের ঝনঝনানি, আর মেশিনের শব্দে চারপাশ মুখর। কিন্তু ঠিক সেই কোলাহলের মাঝেই একটা দৃশ্য দেখে রায়ান থমকে গেল।
গেটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক—হালকা নীল শার্ট, কালো জিন্স, চোখে স্বচ্ছ একটা কৌতূহল আর অস্থিরতা। হাতে ফাইল, মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে, আবার চোখ তুলে চারপাশ খুঁজছে।
রায়ানের ঠোঁটে অজান্তেই হাসি ফুটে উঠল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এ তো রুদ্র…!”
দশ বছরের মধ্যে এই মুখটা কতটা বদলেছে! ছোট্ট ছেলেটা থেকে কেমন একেবারে পূর্ণ যুবক হয়ে গেছে। অথচ চোখদুটো ঠিক একই রকম—চঞ্চল, স্পষ্ট আর প্রাণবন্ত।
রায়ান গাড়ি থেকে নেমে পকেট থেকে সানগ্লাস খুলে নিল। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার ছোট ভাইয়ের দিকে। রুদ্র তখনও খেয়াল করেনি।
—“এই যে ভদ্রলোক, এতক্ষণ ধরে কাকে খুঁজছো?”
পেছন থেকে শোনা অচেনা গলায় রুদ্র হকচকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। প্রথমে অবাক, তারপর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখের কোণে থমকে থাকা বিস্ময় ধীরে ধীরে আনন্দে পরিণত হলো।
—“ভাইয়া…?!”

কণ্ঠে অবিশ্বাসের সাথে সাথে দম আটকে যাওয়া উত্তেজনা। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না, এতদিন পরে সামনাসামনি তার ভাইকে দেখছে।
রায়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হাত বাড়াল,
—“কেমন আছিস, ছোটভাই?”
রুদ্র এক মুহূর্ত দেরি না করেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। বুকের ভেতর জমে থাকা শূন্যতা যেন এক নিমিষেই পূর্ণ হয়ে গেল। দশ বছরের অপেক্ষা, অভিমান, ভালোবাসা সব একসাথে এসে ভর করল সেই আলিঙ্গনে।
—“তুমগ সত্যি ফিরে এসেছ… আমি ভাবতেও পারিনি আজ হঠাৎ এভাবে দেখে ফেলব। সকালে মা শুধু বলল তুমি এসেছ, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।”
রায়ান হালকা করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো রুদ্রর।
—“এই জন্যই তো সারপ্রাইজ রাখা হয়। তুই এখানে কেন, আব্বু বিজনেস স্ট্রিপে বাহিরে গেছে তোর তো আমাদের কোম্পানিতে যাওয়ার কথা?”
রুদ্র একটু হেসে বলল,

—“আমি তুমি এসেছ শুনে আর থাকতে পারিনি…তাই সরাসরি এখানে চলে আসলাম।”
রায়ান একটু প্রশ্ন সূচক চোখ করে বলল-
-“তুই কিভাবে জানলি কোম্পানির সাইট লোকেশন। আমি তো তোকে বলিনি।”
রুদ্র- “মাহির ভাই কে কল করেছিলাম। মাহির ভাই লোকেশন দিয়েছে। তার কাছে তোমার সব খবর থাকে, সেটা আমার আগের থেকেই জানা।”
রায়ান হালকা হেঁসে বলল –
-“ওই পেট পাতলার কাছে কোন কথাই থাকে না। কেমন আছিস তাই বল এখন।”
রুদ্র- “আমাকে যেমন দেখে গেছো তেমনি আছি ‘বিন্দাস আর সুদর্শন’।’
রুদ্রর দুষ্টামি করে বলা কথায় দুইজনই হাসে উঠে। হঠাৎ রুদ্র তার হাসি থামিয়ে হালকা ভয়াত্মক গলায়-

” ভাইয়া একটা কথা ছিল বলব? রাগ করবে নাতো?”
রায়ান নির্বিকার চিত্তে –
“বোলে ফেল, কি বলবি।”
রুদ্র আমতা আমতা করে রায়ান কে বলল-
“সকালে নাস্তা শেষে আম্মু বলল তুমি নাকি মিরাকে ডিভোর্স দিতে চাও। সেই কারণেই নাকি দেশে ফিরেছো আর সাথে নাকি ডিভোর্স পেপারস রেডি করে আম্মুকে মিরার থেকে সাইন নিতে বলেছ সকালে। কথা কি সত্য?”
রায়ান রুদ্রর মিরাকে ভাবি না বলে নাম ধরে সম্মোধন করাটা রায়ানের পছন্দ হয়নি। রায়ান রাগি গলায় বলে –
“ওই গর্ধব, মিরা কি হে? ভাইয়ের বউ ভাবি হয়- আমার বউকে ভাবি ডাকবি। আর কখনো যেন ওর নাম তোর মুখে না শুনি। মাথায় ঢুকেছে?”

রুদ্র রায়ানের মুখে এমন কিছু শুনবে আশা করেননি। সে হঠাৎ ভারী চিন্তায় পড়ে গেল- “যে মানুষটা তার বউকে ভাবি ডাকলে আমাকে ভাই হিসেবে মানতে চাইতো না, আজকে ভাবিকে ভাবি ডাকতে বলছে।”
রুদ্র রায়ানের কথার প্রতিউত্তরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ বলল-
“ভাইয়া তুমি নিজেই না আগে আমাকে বলেছিলে মিরাকে … মানে ভাবিকে ভাবি না ডাকতে?”
রায়ান স্বাভাবিক ভাবেই উওর করে-
“আগের দিন বাঘে খাইছে,
এখন তোর ভাই প্রেমে পড়ছে। এইটাই।”
রুদ্র যেন রায়ানের কথায় আকাশ থেকে পড়লো। মনে হাজারো প্রশ্ন, তার ভাই প্রেমে পড়েছে? মানে?-
“তুমি প্রেমে পড়েছ মানে? কার প্রেমে? কবে? কখন? কোথায়? কিভাবে?”
রায়ান বিরক্তি নিয়ে বলে-

“হায় রে বোকা*চোদা, তোর ভাবির, আমার বউয়ের প্রেমে পড়েছি রে। যেই একটা ভাবি পেয়েছিস, প্রেমে না পড়ে উপায় ছিল না।”
রুদ্র – “মিরা ভাবির প্রেমে কিভাবে পরলে তুমি হঠাৎ?”
রায়ান- “জানি না, পড়ে গেছি কোনো ভাবে। বৃষ্টির সময় ছিল তো রাস্তা একটু পিচ্ছিল, তাই স্লিপ করে পড়ে গেছি । কেন? তুই খুশি হোসনি?”
রুদ্র মুখে স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে-
“আরে বাবা কি বল! খুশি হবো না কেন? ফাইনালি ভাবিকে ভাবি বলে ডাকতে পারবো। এর থেকে বড়ো শান্তি আছে নাকি।”
রায়ান হালকা হেঁসে গম্ভীর গলায় বলল-
“তবে এখন আমার তোর সাথে বোঝাপড়া আছে।”
রুদ্র আশ্চর্য হয়ে-
“আমার সাথে তোমার কিসের বোঝাপড়া ভাইয়া…?”

রুদ্র কথা শেষ হতে না হতেই রায়ান রুদ্রকে ধাক্কা দিয়ে একটু দূরে সরিয়ে, তার হাতে থাকা কালো কোর্ট টা রুদ্রের দিকে ছুড়ে মেরে চেঁচিয়ে বলল-
“ওই আবাল! ১০ বছরে তোর সাথে আমার কতবার কলে কথা হয়েছে? যতবারই কথা বলেছিস ততবারই – ‘ভাইয়া ভাবি হেন , ভাবি তেন, ভাবির সাথে কি এটারা তোমার ঠিক হয়েছে, ভাবি জানতে পারলে কষ্ট পাবে আইনি ভাবে তুমি ছাড়া এখন তার কেউ নেই ‘ এসব বলে মাথা খেয়েছিস।
রুদ্র নিজের হাত দিয়ে কোর্ট টা ধরে সোফার পিছনে চলে যায় দৌড়ে। রায়ান আবার নিজের পায়ের জুতা খুলতে খুলতে বলে-

“তোর বাল তো গজিয়েছে অনেক আগেই, তাহলে বাল-পাকনামি করে ভাবির একটা পিক দিতে পারলি না কেন?”
রুদ্র হাত সামনে দিকে এগিয়ে নিজের আত্মরক্ষা করতে থাকা অবস্থায় উত্তর করে-
“বাল তো গজিয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু পাকেনি তো ভাইয়া। বাল-পাকনামি কেমনে করতাম। আর আমি ভাবির ছবি দিলেই বা কি এমন হতো?”
রায়ান পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়ে তারা রুদ্রর দিকে তাক করতে করতে বলে-
“হাঁদারাম, আর জিজ্ঞেস করে কি হতো! ওমন হলে এত দিনে দুই তিনবার চাচা হয়ে যাইতি। তোর এই বাল-পাকনামি না করার জন্য এখনো আমি আমার বউকে আদর দিতে পারছি না। আদর কি! কাছে এনে ছুঁয়ে দেখতেও পারছি না।”

রুদ্র এবার রায়হানের কথায় এক প্রকার বিরক্ত হয়ে তার হাত দুটো নিচে ছেড়ে দিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল-
” যা বাবা! বিয়ে, বউ কোনটাই মানবে না বলে নিজে হেডাম দেখিয়ে বিদেশ চলে গেল। আর এখন আমাকে বলছে আমার জন্য নাকি সে বউ পায় না। এখন সব দোষ রুদ্র ঘোষ। আল্লাহ তুমি এই অমানবিক নির্যাতন এর বিচার কইরো।”
রায়ান রুদ্র কথাগুলো শুনে হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। হাতে নিয়ে রাখা জুতা টা নিতে হলে শরীর ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসে পড়ল। রায়হানকে এমন হঠাৎ শান্ত হয়ে যেতে দেখে নিশ্চুপ হয়ে যায়।
রুদ্র হালকা পায়ে রায়নার কাছে এসে সোফায় তার পাশে বসে রায়ানের কাঁধে হাত রেখে বলে-
“আরে ভাইয়া মজা করেছি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো আমি, যেন তুমি তোমার বউকে দ্রুত পেয়ে যাও। আমি ওই ভাবে বলতে চাইনি।”

রায়ান নিজের মাথায় হাত দিয়ে কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলো –
“রুদ্র ভাই আমার, কিছু একটা কর প্লিজ। ওকে আমার করে নিতে একটু হেল্প কর। আমি জানলেও মিরা তো জানে না যে সে আমার স্ত্রী। ”
রায়ান একটু থেমে আবার বলল –
“আচ্ছা! মিরা কি আমার সম্পর্কে জানতে পারলে আমাকে মেনে নেবে? আমি ওকে অস্বীকার করে চলে গেছিলাম এটা জানতে পারলে কি আমাকে ঘৃণা করবে? আমাকে কি আর একটা সুযোগ দেবে না?”
রুদ্র রায়ানের কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না কেবল কাঁধে হাত দিয়ে রাখলো। কিছু কখনো পর রায়ান বলল-
” রুদ্র এখন এসব ভেবে মাথা খারাপ করা যাবে না। চল সাইটের কাজ কতদূর একবার দেখে আসি।
বাকি রইল মিরার ব্যাপার ও আমার স্ত্রী ছিল , আছে আর থাকবে নিজের ইচ্ছায় থাকুক বা জোর করে আটকে রাখাতে।”
রুদ্র রায়ানের কথা শুনে মৃদু হাসি দিয়ে রায়ানের কথায় সম্মতি জানায়। আর একটু পরে দুই ভাইয়ের মিলে নতুন কোম্পানির সাইট পরিদর্শনে যায়।

মিরায়া ভর্তির সব কাজ শেষ হওয়ার পর প্রথমেই রায়ান কে কল করে রায়ানের কথা মতো।
রায়ান আর রুদ্র তখন দুইজনই সাইট দেখে বের হয়ে গেছে দুই গাড়িতে করে। রায়ান মিরায়ার কল না পেয়ে নিজেই ঢাবি ক্যাম্পাসের রাস্তায় রোওনা দেয় আর রুদ্র ও পিছন পিছন আসছে ।
রায়ান ক্যাম্পাসে বেশ কাছেই কোথাও ছিল সেই সময় হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। রায়ান সামনে পড়ে থাকা তার ফোনের দিকে তাকায় কে কল করেছে দেখার জন্য। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে “হৃদপাখি” লিখা টা যা দিয়ে আজ সকালেই মিরায়ার নাম্বার সেভ করেছে।

মিরায়ার কল এসেছে দেখে রায়ান মনে মনে বেশ খুশি হয় আর মুখে এমনিতেই হাঁসি ফুটে ওঠে। সে কল টা কেটে দিয়েই আবার ব্যাক করলো। আর মিরায়ার সাথে সাথে কল টা রিসিভ করে-
মিরায়া- “হ্যালো! আসসালামুয়ালাইকুম। রায়ান ভাইয়া বলছেন? আমি মিরায়া।”
রায়ানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল ভাইয়া ডাক শুনে। সে মনে মনে আওড়ালো- “হে আল্লাহ! এই ছেমরি কি আমাকে একটু খুশি থাকতে দিবো না। কখনো মায়াবী চোখ, কখনো হাসি, কখনো নাচ আর এই ভাইয়া ডাক দিয়েই আমাকে মেরে ফেলবে। আল্লাহ আমার বউরে হেদায়েত দেউ।”
রায়ান নিজের রাগ সামলে বলল-

” হ্যাঁ, আমি চিনেছি, মিস ঢাবি! ওহ্ , এখন তো তুমি মিস ঢাবিয়ান হয়ে গেছ। আচ্ছা কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
মিরায়া- “জ্বি সব ভালোভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে আমি আমার এক ফ্রেন্ড এর সাথে এখন ক্যাম্পাসে আছি। বাড়িতে যাবো । নিতে আসবেন আপনি?”
রায়ান প্রশস্ত হাসি নিয়ে বলল-
” অবশ্যই হৃদপাখি, ওয়েট ফর মি । আই এম কামিং।”
কলটা কেটে রায়ান ক্যাম্পাসের দিকে গাড়ি চালাতে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসের ভেতর বিকেলের হাওয়া তখন কেমন যেন নরম হয়ে বইছিল। দুপুর গড়িয়ে এসে পড়েছে, চারদিকে একটা হালকা ক্লান্তির ছাপ। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার সমস্ত ঝক্কি ঝামেলা শেষে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে মিরায়া আর তার বন্ধু রিমি। হাতে ভর্তি রশিদ, ফাইল—ক্লান্তি থাকলেও চোখে উচ্ছ্বাস, হাসি।
রিমি একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
—“উফফ… অবশেষে কাজটা শেষ হলো! মনে হচ্ছিল এই লাইনের আর শেষ নেই।”
মিরায়া হেসে উত্তর দিল,
—“হাহা, আমি তো ভেবেছিলাম তুই হাল ছেড়ে দিবি মাঝপথেই। দেখিস, দুজন একসাথে ভর্তি হলাম—এটাই আসল জেতা।”

ওরা দুজনেই গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালো। রাস্তাটা তখন ভিড়ে ঠাসা। এদিক-সেদিক থেকে রিকশার বেল বাজছে, ভ্যানে করে ফল বিক্রি করছে কেউ, আবার একপাশে কিছু শিক্ষার্থী আড্ডা দিচ্ছে।
রিমি আবার বলল,
—“চল একটা ঠাণ্ডা কিছু খাই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।”
মিরায়া মাথা নেড়ে বলল,
—“তুই একটু বসে থাক, আমি গিয়ে দুইটা আইসক্রিম নিয়ে আসছি।”
রিমি পাশের গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেল। মিরায়া ব্যাগটা হাতে নিয়ে পাশের দোকানের দিকে এগিয়ে গেল।
মিরায়া দোকানের দিকে হেঁটে যেতেই রিমির সামনে এসে দাঁড়ালো তিনজন চেনা চেহারা। ওরা সেই একই তিনজন, যারা ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন রিমিকে হয়রান করেছিল, আর তখন মিরায়া ঝাঁপিয়ে পড়ে রিমিকে বাঁচিয়েছিল।
তিনজনের একজন কুটিল হাসি দিয়ে বলল,

—“ওই যে… আবারও দেখা হয়ে গেলো বোনজান।”
অন্যজন ঠোঁট কামড়ে ব্যঙ্গ করে বলল,
—“কি খবর? আজ আর সেই দাদাগিরি করা বান্ধবীটা পাশে নেই, তাই না?”
তৃতীয়জন এক পা এগিয়ে রিমির হাতটা হঠাৎ ধরে ফেলল।
—“সেদিন তো বেঁচে গেলি, আজ দেখি কতদূর পালাতে পারিস।”
রিমি আঁতকে উঠল, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল।
—“ছাড়ো! কি করছেন কি আপনারা? প্লিজ, ছাড়েন!”
কিন্তু ছেলেরা শোনে না। চারপাশের লোকজন কেউ টের পায়নি এখন।
ঠিক তখনই মিরায়া হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে ফিরছিল। সে দৃশ্য দেখে চোখ দুটো রাগে জ্বলে উঠল। এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত দৌড়ে এল সে।
মিরায়া গর্জে উঠল,

—“এই! হাতটা ছাড়েন এখনই!”
ছেলেরা প্রথমে ভড়কে গেলেও তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল।
—“আরে এই তো সেই দাদাগিরি করা নায়িকা!”
মিরায়া আর কিছু না বলে সরাসরি রিমির হাত টেনে ছেলেটির হাত থেকে মুক্ত করল, তারপর ঠাস করে একটা চড় বসাল তার গালে। আওয়াজে আশেপাশের কয়েকজন শিক্ষার্থী ঘুরে তাকাল।
অন্য ছেলেটা এগিয়ে আসতেই মিরা তার হাত থেকে আইসক্রিমটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ব্যাগ দিয়ে আঘাত করল।

—“তোরা মানুষ না জানোয়ার! মেয়েদের সঙ্গে এরকম আচরণ করিস?”
রিমি পিছনে সরে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে সবকিছু দেখছিল। তার চোখে ভয়ের সঙ্গে মিশে ছিল বিস্ময়—মিরার সাহসী রূপটা যেন অন্যরকম লাগছিল।
ঠিক তখনই রাস্তার অপর প্রান্ত থেকে দুটো গাড়ি দাঁড়ালো। রায়ান আর রুদ্র কোম্পানির সাইট ভিজিট শেষে ফিরছিল। মিরার ফোন পেয়েই রায়ান এসেছিল তাকে নিতে। গাড়ি থেকে নেমে দুজনেই দৃশ্যটা একসাথে দেখতে পেল।
রুদ্র অবাক হয়ে বলল,

—“ওইটা কি… মিরা? এভাবে মারছে?”
রায়ানের ঠোঁটে ধীরে ধীরে গর্বের হাসি ফুটে উঠল। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত টান—সে যেন বুঝতে পারল, এই মেয়েটি কেবল তার স্ত্রীই নয়, বরং তার গর্ব।
রায়ান অচিরেই নিজের ঠোঁট প্রসারিত করে বলল-
“that’s my girl.”
রায়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছিল মিরার লড়াই। প্রতিটি চড়, প্রতিটি রাগী দৃষ্টি তার কাছে যেন অমূল্য হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু মার খেয়েও ছেলেরা থামল না। একসময় তাদের একজন হঠাৎ পিছন থেকে মিরার কাঁধে হাত রাখতে গেল।
মিরায়া হকচকিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই রায়ানের ধৈর্য শেষ হয়ে গেল।
বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল রায়ান। মুহূর্তেই ছেলেটার হাত মুচড়ে দিল, আরেকজনকে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিল।
রায়ান গর্জে উঠল,

—“তুই আমার হৃদপাখির গায়ে হাত দিস কোন সাহসে? হারামজাদা!”
চারপাশে ভিড় জমে গেল। রুদ্রও এগিয়ে এসে সাহায্য করল মিরায়া আর রিমিকে দূরে নিয়ে গেল, কিন্তু রায়ান তখন সম্পূর্ণ উন্মত্ত।
একজনকে লাথি মেরে সোজা রাস্তায় ফেলে দিল সে।
—“তোদের মতো নোংরা কুকুরেরা ভাবে মেয়েরা দুর্বল? আজকে তোদের দেখাই আমি, একজন স্বামী তার বউকে রক্ষা করতে কতদূর যেতে পারে!”
অন্য ছেলেটা পালাতে চাইলে রায়ান ধরে ফেলল তার কলার চেপে।
—“কুত্তার*বাচ্চা।… যে হাত দিয়ে আমার বউকে ছুঁতে গিয়েছিলি ওই হাত আজ আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবো, আর যে চোখ দিয়ে তাকিয়েছিস ওর দিকে ওই চোখ উপড়ে ফেলব!”
রায়ানের চোখে তখন খাঁটি আগুন। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, কিন্তু সেই কাঁপন ছিল ক্রোধ আর ভালোবাসার মিশ্রণ। চারপাশের মানুষ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল। দূর থেকে রায়ানের এমন রূপ দেখে মিরায়া ভয় পেল। যদিও সে দূরে থাকায় কিছুই শুনতে পারছে না।

মিরায়া রায়ানের ক্রোধের ভয়ে রুদ্রকে উদ্দেশ্যে করে বলে-
“রুদ্র ভাইয়া তুমি যাও প্লিজ উনাকে আটকাও গিয়ে। লেগে যাবে উনার। থামাও প্লিজ।”
মিরায়ার মাথায় হঠাৎ রায়ানের ক্ষতির চিন্তা বাসা বাঁধে যেন ভীষণ আপন কেউ তার। রায়ানের ক্ষতি হলে যেন তার খুব ক্ষতি হবে এমন অনুভূতি হলো যার কোনো মানে ছিল না মিরায়ার কাছে।
মিরায়ার কথায় রুদ্র দৌড়ে গিয়ে রায়হানকে ধরে আটকায় আর ছেলে গুলো কে মারা থেকে।
মারামারি শেষে তিন ছেলেই ছুটে পালাল। ভিড় থেকে করতালিও উঠল—কেউ বলল “ভাই, বাহ!” কেউ বলল “এই রকমই হওয়া দরকার!”
মিরায়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে রিমিকে বুকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

—“তুই ঠিক আছিস তো? ভয় পেয়েছিস?”
রিমি মাথা নেড়ে চোখে জল নিয়ে বলল,
—“তুই না থাকলে আজ আমার যে হয়ে যেত…”
ঠিক তখনই রায়ান মিরার দিকে তাকাল। তার চোখে তখনও আগুন, কিন্তু সেই আগুনের ভেতর ছিল এক অদ্ভুত মমতা, অধিকার আর আসক্তি।
মিরায়ার বুক কেঁপে উঠল। সে চুপ করে শুধু রায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল… সেই দৃষ্টিতে ছিল ভয়, বিস্ময় আর অজানা এক অনুভূতির ঝড়।
ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন তখনও গুঞ্জন করছে। একটু আগে যে ঝড়টা বয়ে গেল, তার রেশ কারো মুখে, কারো চোখে। রিমিকে আগলে রেখে মিরায়া দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু রায়ানের মুখ কালো মেঘে ঢাকা। সে একটাও কথা বলল না—শুধু গিয়ে দৃঢ় হাতে মিরায়ার কব্জি চেপে ধরল।

রায়ান মিরায়ার হাত ধরে রিমিকে নির্দেশ করে রুদ্র কে বলল-
“রুদ্র ওনাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আয়।”
রায়ান রুদ্রকে আদেশ দিয়েই মিরায়াকে টানে।
মিরায়া (চমকে উঠে, টানাটানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করে):
—“এই! ছাড়ুন না লাগছে… আমি নিজেই যাচ্ছি।”
কোনও উত্তর দিল না রায়ান। লোহার মত শক্ত হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল নিজের কালো SUV-র দিকে। চারপাশের লোকেরা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল—কারণ সেই দৃষ্টি, সেই তীব্রতা, কারও কিছু বলার সাহসই রইল না।
গাড়ির দরজা খুলে মিরায়াকে ভেতরে বসিয়ে দিল, প্রায় ঠেলে। দরজাটা প্রচণ্ড শব্দে বন্ধ হলো। মুহূর্তে পুরো পৃথিবী যেন নিস্তব্ধ।

গাড়ির ভেতরে টানটান নীরবতা~
রায়ান ইঞ্জিন চালু করল। শক্ত হাত স্টিয়ারিংয়ে, চোয়াল শক্ত করে চেপে আছে, চোখ শুধু সামনে। এক বিন্দুও নড়ল না তার দৃষ্টি।
গাড়ি ধীরে ধীরে রওনা দিল। ভেতরে যেন কেবল ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দ আর দুজন মানুষের বুকের ধকধকানি।
মিরায়া (আবছা গলায়, ভয় মিশে দ্বিধা নিয়ে):
—“আপনি… এভাবে রেগে গেলেন কেন? আমি তো শুধু রিমিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম।”
রায়ান এবার চোখ ফিরিয়ে তাকাল, দৃষ্টি যেন ধারালো ছুরির মত। কণ্ঠে থিরতা, চাপা রাগ—
—“চেষ্টা? এটাকে চেষ্টা বলে? মাঝ রাস্তায় তিনটে জানোয়ার তোকে গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল… আর তুই দাঁড়িয়ে তাদের সাথে লড়াই করছিলি! আমি যদি তখন না আসতাম, কি হতো ভেবেছিস একবারও?”
মিরায়া চুপ করে গেল। বুকটা ধড়ফড় করছে, গলার স্বর আটকে যাচ্ছে।
মিরায়া (নিচু গলায়, চোখ নামিয়ে):

—“আমি ভেবেছিলাম সামলে নিতে পারব… আমি চাইনি আপনি ঝামেলায় পড়ুন।”
রায়ান স্টিয়ারিংয়ে হাত চেপে ধরল। গাড়ির গতি বেড়ে গেল হঠাৎ। কণ্ঠে কঠোর গর্জন—
—“তুই ভেবেছিলি! তোকে দেখে ওই কুকুরগুলো আবার সাহস পায়, বোঝিস না? আমি শপথ করে বলছি, তোকে নিয়ে কেউ কথা বলবে, হাত তুলবে—আমি সহ্য করব না।”
রায়ান রাখি গলায় কঠিন স্বরে বলল-
“তোকে আমি সকালেও বলেছিলাম তার তার সাথে কথা বলবি না ঝামেলায় জড়াবি না। সব সময় কি আমি সাথে থাকবো নাকি। আজকের পর তো তোকে এটাও ছাড়তে ইচ্ছা করবে না।”
মিরায়া কোনো উত্তর দেয় না । কারণ সে রায়ানের রাগিভাব দেখে ভালোই বুঝতে পারল- যে এখন কিছু বলা আর আগুন
এ ঘি ঢঢালা সমান । তাই সে নীরব থাকলো। আর রায়ান একই ভাবে সোজা তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।

বাইরে তখন ঢাকার সন্ধ্যা। রাস্তার দুইপাশে বাতি জ্বলছে, হকাররা হাঁকডাক করছে, কোথাও ভাজা চপের গন্ধ উড়ে আসছে। অথচ গাড়ির ভেতরে নীরবতা—একটা ভারী আবহাওয়া, যা বাইরের কোন শব্দ ভেদ করতে পারছে না।
মিরায়া সিটে সোজা হয়ে বসল, বুকের ভেতর চাপা ভয় আর দ্বিধা। রায়ানের চোখের আগুন তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর মিরা আমতা আমতা করে ফিসফিস করল,
—“আমার আসলে… কষ্ট লাগছে আইসক্রিমটার জন্য। এত কষ্ট করে কিনলাম, শেষে মাটিতেই পড়ে গেল।”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল রায়ান। তারপর হঠাৎ করেই তার ভ্রু কুঁচকে থাকা মুখে এক ফোঁটা হাসির রেখা ফুটল। এটা ভেবে যে কি মেয়ে এটা এই পরিস্থিতিতে আইসক্রিমের কথা ভাবছে।
রায়ান (কণ্ঠে সামান্য ব্যঙ্গ, কিন্তু রাগ গলে যাচ্ছে):

—“এত বড় ঝামেলা হলো, আর সে বসে আছে আইসক্রিমের জন্য হা-হুতাশ করে? তুমি কি বাচ্চা নাকি?”
মিরায়া (হালকা অভিমানী ভঙ্গিতে):
—“আপনি আমাকে বাচ্চা বলেন কেন? আমি তো আসলেই সিরিয়াস ছিলাম।”
রায়ান মাথা নাড়ল, এবার স্বাভাবিক কণ্ঠে,
—“সিরিয়াস? রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাতাহাতি মারামারি করাকে তোমার সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে? আমি বলছি, তুমি একদম ঝামেলার মেয়ে।”
মিরায়ার ঠোঁটে এবার অল্প একটা হাসি ফুটল।

—“ঝামেলার হলেও… আমি তো রিমিকে বাঁচালাম।”
রায়ান সোজা তার দিকে তাকিয়ে গভীর স্বরে বলল,
—“হ্যাঁ, বাঁচিয়েছিস। এজন্যই তো আমার বুক গর্বে ভরে গেছে। কিন্তু… তুই আমার, মিরা। তোকে কেউ স্পর্শ করবে আমি ছাড়া, কারো স্পর্শ তোর উপর- আমি কল্পনায়ও সহ্য করতে পারবো না। ইউ বেটার বে কেয়ারফুল এ্যাবাউট ইয়োর সেলফ‌, মাই হার্ট-বার্ড।”
কথাটা এত দৃঢ়, এত অধিকারবোধে ভরা ছিল যে মিরায়ার বুক কেঁপে উঠল। হঠাৎ করেই গাড়ির ভেতরটা ঠাণ্ডা বাতাসের মত নরম হয়ে গেল।
মিরায়া চোখ বড় বড় করে রায়ানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল-
“আমি আপনার মানে? আর ওটা আবার কেমন নাম হলো ‘ ‘হার্ট-বার্ড’?
র য়ান দুষ্টু হাসি হাসলো –
“এসবের মানে তোমাকে এখন বুঝতে হবে না হৃদপাখি।”
মিরায়া তখনো রায়ানের দিকে তাকিয়ে ছিল ।
রায়ান এবার স্বাভাবিক হয়ে প্রশ্ন করে –
“তো মিস ঢাবিয়ান, তোমার ফিউচার প্ল্যান কি?”
মিরায়া মিষ্টি হেসে জবাব দেয়-

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৯ (২)

“L.L.B কমপ্লিট করে লইয়ার হব। আর আপনার ফিচারে কি প্লেন?”
রায়ান মিরায়ার প্রশ্নের প্রতিউত্তরে আনমনে গান ধরে-
“আমার যত ভাই ব্রাদার ডাকবে তোমায় ভাবি,
তোমার শাড়িতে আঁচলেতে থাকবে ঘরের চাবি।
কারণ (হালকা আওয়াজে)
হাবুডুবু খাচ্ছি আমি, প্রেম সাগরে নেমে।
প্রথম দেখায় পড়েছিলাম আমি তোমার প্রেমে।”
মিরায়া আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলো-
“কিহ্!”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here