আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৩ (২)

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৩ (২)
অরাত্রিকা রহমান

মিরায়া ধীরে ধীরে কফির মগটি সাইড টেবিলে রেখে রুমের চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিল। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি ঘরটি তার নজর কাড়ে। ধীরে ধীরে তার চোখ এক কোণে থাকা বড় বুক সেলফের দিকে যায়। সেলফটা neatly সাজানো বইগুলো একদম প্রতিটি সেলফের স্থান অনুযায়ী স্থিরভাবে রাখা।
মিরায়া ধীরে ধীরে সেলফের কাছে এগোয়। হাত দিয়ে হালকা স্পর্শ করে বইগুলো ধরে দেখে। তার চোখ আটকে যায় সেলফের একটি বিশেষ স্থানে—সেই চারটি বই পাশাপাশি সাজানো।
তার আগ্রহ আরও বাড়ে। প্রথমেই সে প্রথম বইটি তুলে দেখে। বুকের উপরের লেখা পড়ে, “Twisted Series: Love”। মিরায়ার চোখে অদ্ভুত এক উচ্ছ্বাসের ঝিলিক ফুটে ওঠে। এই প্রথমবার সে রায়ানের পড়া এই ছোট্ট অংশের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে।

এরপর সে বাকি তিনটি বইতে নজর দেয়। প্রত্যেকটি বই একই সিরিজের—Twisted Series: Game, Twisted Series:hate, আর Twisted Series: lies।
মিরায়া হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বইগুলো আবার সেলফে রাখে, এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকে, এবং মনে মনে ভাবতে থাকে—“রায়ান কত যত্নশীলভাবে নিজের জিনিসগুলো সাজায়… আর তার পছন্দগুলো, এই বইগুলো, আমাকে অদ্ভুতভাবে আকর্ষণ করছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একটু কৌতূহল আর শৌখিন চোখে সে চারটি বই আরও ঘেঁষে দেখে। “Love… Game… Mystery… lies… সবকিছু ঠিকমতো রাখা, যেন প্রতিটি বই যেন নিজেই গল্প বলতে চায়,” মনে মনে বলল।
মিরায়ার মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি ঘুরপাক খায়। বইগুলো দেখে, রায়ানের রুচি আর সাজানো পদ্ধতি তার প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে কিছুক্ষণ সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রতিটি বইয়ের নাম মনোযোগ দিয়ে পড়ে, যেন বইগুলোর মধ্য দিয়ে সে রায়ানের ভেতরের দিকটা জানার চেষ্টা করছে।
বলা চলে একপ্রকার কৌতূহলের বসেই মিরায়া সেলফ থেকে Twisted Series: Love বইটা আস্তে করে টেনে বের করল আবার।

পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ মাঝামাঝি এসে তার হাত থেমে গেল। সেখানে একটা সোনালী রঙের বুকমার্ক গুঁজে রাখা ছিল। বুকমার্কটা বের করতেই চোখে পড়ল পাতার ভেতর কিছু লাইন হাইলাইট করা।
হাইলাইট করা লাইনটা পড়তে গিয়ে মীরার বুক যেন ধক করে উঠল।
পাতায় লেখা—
“His lips were so close to mine that the line between breath and desire blurred. I knew if I touched him in that moment—I would never be able to stop.”
“তার ঠোঁট আমার ঠোঁটের এত কাছে ছিল যে নিঃশ্বাস আর আকাঙ্ক্ষার সীমারেখা মুছে যাচ্ছিল। আমি জানতাম, যদি সেই মুহূর্তে ছুঁই—তাহলে আর থামতে পারব না।”
মিরায়া লাইনটা পড়ে আচমকাই চমকে উঠল। বুকের ভেতরটা কেমন অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল তার। দু’চোখে যেন এক মুহূর্তে রায়ানের চাহনি ভেসে উঠল। ঠোঁট… নিঃশ্বাস… আকাঙ্ক্ষা—এই শব্দগুলোই তার গালকে টকটকে লাল করে দিল।
মিরায়া পাতাটা বন্ধ করে দিতে চাইল, কিন্তু হাত আবার বইয়ের ভেতরকার কয়েকটা হাইলাইটেড লাইনে আটকে গেল।
পাতায় লেখা ছিল—

“His gaze burned into me, as if the whole world had stopped. Only a breath away… and I knew, if he leaned in, everything would shatter.”
“তার চোখে আটকে গিয়েছিলাম, যেন পুরো পৃথিবীটা থেমে গেছে। আমাদের মাঝে শুধু নিঃশ্বাসের ফাঁকিটুকু বাকি ছিল, আর আমি জানতাম—একটু এগোলেই সব ভেঙে পড়বে।”
মিরায়া নিঃশব্দে গিলে ফেলল লাইনটা। বুকের ভেতরটা অদ্ভুতভাবে ধড়ফড় করতে লাগল। রান্নাঘরে রায়ান যখন মৃদু গলায় বলেছিল “Heartbird, look at me”, সেই মুহূর্তটা যেন আবার ফিরে এলো।
পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল আরেকটা হাইলাইটেড অংশ—
“His fingers brushed against mine, and it felt like fire. I couldn’t pull away even if I tried.”

“তার আঙুল ছুঁয়ে গিয়েছিল আমার হাতে, আর সেই ছোঁয়া ছিল আগুনের মতো। আমি চাইলেও আর সরে আসতে পারিনি।”
লাইনটা পড়েই তার মনে হলো, ঠিক যেমন রান্নাঘরে রায়ানের হাত তার হাতের পাশ ঘেঁষে গিয়েছিল। সে ইচ্ছে করলেও সরে আসতে পারেনি।
মিরায়ার হাত হঠাৎ শিউরে উঠল। বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত এক গরম ঢেউ বয়ে গেল। তার মনে পড়ে গেল রায়ানের ঠান্ডা অথচ গভীর কণ্ঠের টান—
“থেমে যা… আমার দিকে ঘুরে তাকাও।”
শেষে চোখ আটকালো তৃতীয় লাইনে—

“We both wanted it. I could feel it. But maybe the time wasn’t ours… still, the desire to claim him was unbearable.”
“আমি জানতাম, আমরা দুজনেই চাই। কিন্তু সময় হয়তো আমাদের জন্য নয়। তবুও ইচ্ছে হচ্ছিল সবকিছু ভেঙে তাকে শুধু নিজের করে নিতে।”
মিরার নিঃশ্বাস আটকে গেল, ঠোঁট হালকা কাঁপতে লাগল। মনে পড়ে গেল রায়ানের চোখের গভীর চাহনি, তার কাছে এগিয়ে আসার ভঙ্গি।
গাল লাল হয়ে উঠল, নিঃশ্বাস ভারী হলো। বুক ধড়ফড় করতে লাগল অকারণে।
সে ফিসফিস করে বলল—

“হায় আল্লাহ…! এসব ভাবার কি দরকার ছিল এখন…”
মিরায়া যেন নিজের লজ্জা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার ভেতরটা গলে যাচ্ছিল সেই লাইনগুলোর সাথে নিজের ও রায়ানের কিছু সময় আগের মুহূর্তগুলো মিশিয়ে ফেলে।
মিরায়া হঠাৎ বইটা বন্ধ করে নিজের অজান্তে ফিসফিস করে উঠল,
—“আল্লাহ মাফ করো! আমি এসব কি পড়ছি … এই লোক কত পরিমাণ নির্লজ্জ! এই ধরনের ডার্ক রোমান্স বই পড়ে! ছিঃ…”

সে মাথা নাড়তে লাগল, কিন্তু গাল আর কান পর্যন্ত আগুনের মতো লাল। বুকের ভেতর এখনও কাঁপন থামছে না।
বইটা তখনো মিরায়ার হাতেই ছিল হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ এলো। মিরায়া তখনো লজ্জায় আচ্ছাদিত তাই সে রায়ানের সম্মুখিন হতে চায়নি।
সে তাড়াতাড়ি বইটা আবার বুকশেলফে গুঁজে দিল, কিন্তু মনের ভেতর সেই লাইনটা যেন বাজতেই থাকল। ঠোঁটের কোণে হালকা কাঁপন আর বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি থামছিল না।
মিরায়া রুম থেকে বের হওয়ার সেই পরিমাণ সময় না থাকায় দ্রুত কিছু একটা ভেবে ধপ করে রায়ানের খাটের নিচে ঢুকে লুকিয়ে গেল। সাবধানতার সাথে নিজের ওড়না ও গুটিয়ে নেয় নিজের সাথে। মিরায়া ভেতর থেকে মনে মনে প্রার্থনা করছিল, “শুধু এখন আমায় রায়ান ভাইয়া যেন দেখে না।”
ওয়াশ রুমের দরজা খুলে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো রায়ান।

তার গায়ে তখন শুধু কোমর জড়ানো সাদা তোয়ালে। ভেজা শরীর থেকে এক ফোঁটা ফোঁটা পানি বুক বেয়ে নেমে আসছে। প্রশস্ত কাঁধ, শক্ত বাহু আর সিক্স-প্যাকের স্পষ্ট রেখা বুক থেকে কোমর অবধি দাগ টেনে নামছে। ভেজা চুলগুলো থেকে টুপটাপ পানি পড়ছিল কপালে, সে আরেকটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছিল ধীর ভঙ্গিতে।
রায়ানের দেহের কাঠামোতে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল—যেন প্রতিটা মাংসপেশীর নিচে লুকিয়ে আছে শক্তি আর আত্মবিশ্বাসের ছাপ। তার চলাফেরার ভঙ্গিমা এমন, যে দেখে মনে হচ্ছিল একদিকে প্রচণ্ড পুরুষালি, অন্যদিকে নির্লিপ্ত এক সহজ স্বাভাবিকতা।

মিরায়া খাটের নিচ থেকে রুমে কি হচ্ছে বুঝতে পারছিল না তাই রায়ানের অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য বিছানার নিচ থেকে হালকা উঁকি দিয়ে তাকিয়ে দেখতে চাইল।
মিরায়া ভীত ভাব নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে বিছানার চাদর উঠিয়ে রায়ানের উদ্দেশ্যে তার পাশে চোখ বুলাতে থাকলে হঠাৎ তার নজর আঁটকে যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে রায়ানের তার নিজের ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে থাকা দৃশ্যে।

মিরায়া আচমকা রায়ানকে এভাবে দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলে। সে লজ্জায় চোখ সড়িয়ে ফেলতে চায়, কিন্তু চোখ ফেরাতেও পারলো না।
নিজের অজান্তেই সে রায়ানের পা থেকে মাথা অবদি পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো যেন স্কেন করছে রায়ানকে।
তার বুকের ধকধক বেড়ে যাচ্ছিল। ঠোঁট শুকিয়ে এলো।
মিরায়া চোখ রায়ানের দিকে রেখেই মনে মনে- “এমন করে একটা উলঙ্গ ছেলেকে দেখছি কেন আমি?”—মনের ভেতরে ঝড় বইতে লাগলো।

আর রায়ান? সে একেবারেই স্বাভাবিক ছিল। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে থাকলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে । তারপর হাতের আঙুল দিয়ে ভেজা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দিল। তার শরীরের প্রতিটা ভাঁজে জলের ফোঁটা চিকচিক করছিল, যেন সেগুলোও নিজের জায়গা ছেড়ে দিতে চাইছে না।
এ দৃশ্য দেখে মীরার বুক কেঁপে উঠলো। মনে হলো—আর একটু হলে সে হয়তো নিজেকে সামলাতে পারবে না।
রায়ানের কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হলো হঠাৎ। সে যেন অনুভব করতে পারলো তাকে কেউ দেখছে। রায়ান নিজের মনের সন্দেহ বজায় রেখে চারপাশটা দেখলো।
রায়ানের নজর বারের সেলফ এ যেতেই সে বুঝতে পারলো এই ঘরে কেউ এসেছে- কারণ তার সব জিনিস ই জায়গায় গুছানো থাকে তবে এখন বইয়ের সেলফের একটা জায়গা একটু এলোমেলো, বুঝাই যাচ্ছে কেউ হাত দিয়েছে।

আসলে রায়ানের ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার কথা ভেবে মিরায়া তাড়াহুড়োতে বই সেলফে ঠিকমতো হাতের বইটা রাখতে পারেনি একটু এলোমেলো হয়েছিল।
রায়ান আরো সূত্র খুঁজতে চোখ সড়াতেই তার চোখ গেল সাইড টেবিলের উপর রাখা কফি মগের উপরে। রায়ানের তখন আর বুঝতে বাকি রইল না যে কে তার রুমে প্রবেশ করেছে।
রায়ানের মুখে আশ্চর্যতা ছিল না বরং ছিল একটা মিষ্টি হাসি।
এরপর রায়ান ব্যস্ত চোখে তার রুমে খুঁজতে লাগলো তার হৃদপাখিকে।

তখনি হঠাৎ মিরায়া বিছানার নিচে অল্প জায়গায় থাকতে না পেরে একটু নড়ে উঠলো তার কারণে তার পায়ে পড়ে থাকা নূপুর মৃদু শব্দ করে উঠতেই রায়ানের নজর গেল বিছানার দিকে।
সে বুঝতে পারলো কোনো একটা কারণে বিছানার নিচে লুকিয়েছে তার বউ কিন্তু কেন- সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।
সে আবার বই সেলফে নজর দেয়। টুইস্টেড সিরিজের বইগুলো একটু এলোমেলো ঢাকায় সে বুঝল তার বউ ঠিক কি কারনে খাটের নিচে লুকিয়ে আছে।
রায়ানের মিরায়ার ডার্ক রোমেন্স বই দেখে লজ্জা পেয়ে লুকানোর ব্যাপারটা বেশ মজার মনে হল। সে মিরায়াকে আরো লজ্জায় ফেলার জন্য মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি আটে।
রায়ানের মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। সে হঠাৎ বিছানার দিকে এগোতে থাকে। বিছানার কাছে আসার একপর্যায়ে সে হঠাৎ তার পরিহিত সাদা তোয়ালে টা খুলে মাটিতে ফেলে দেয়।

অন্যদিকে মিরায়া হাতের নিচের থেকে ফ্লোরে রায়ানের দেহে পরিহিত শুধু মাত্র তোয়ালেটা দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলে। মিরায়া মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো- “রায়ান কি এই মুহূর্তে কিছুই পড়ে নেই?” মিরায়া নিজের মনে রায়ানকে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন কল্পনা করার মুহূর্তের মধ্যে নিজে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নেয় লজ্জা।
কয়েক মিনিট এভাবে পার হওয়ার পর, ঘরের মধ্যে কারো কোনরকম উপস্থিতি বুঝতে না পেরে মিরায়া ভাবে রায়ান হয়তো এখন আর ঘরে নেই বাহিরে চলে গেছে।
এরপর মিরায়া ভয়ে ভয়ে বিছানার নিচ থেকে তার মাথা অল্প একটু বের করে ঘরে চারপাশের পরিবেশ বোঝার জন্য। অন্যদিকে রায়ান ও তার দুষ্টু বুদ্ধি খাটিয়ে বিছানার উপরে উঠে বিছানার নিচে মিরায়ার দিকে মুখ করে থাকে।
মিরায়া বিছানা নিচে থেকে মাথা বের করতেই তার সামনে ভেসে ওঠে রায়ানের কুটিল হাসতে থাকা মুখ। মিরায়াকে এমন ভাবে দেখে রায়ান মুখ ভরে হেসে বলে ওঠে-
“টুকি…! মাই হার্ট-বার্ড।”

সোরায়ার ঘর তখন একেবারে শান্ত। জানলার পর্দা আধখোলা, ভেতরে হালকা বাতাস ঢুকছে, আর পড়ার টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো তার অস্থির মনের সাক্ষী দিচ্ছে। সে অনেক চেষ্টা করছিল পড়ার দিকে মন বসাতে, কিন্তু শব্দের লাইনগুলো চোখের সামনে এলেও মাথায় যাচ্ছিল না। বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, রাস্তায় প্রথম বারের মতো একজন অচেনা ছেলেকে ভালো লাগা—সব মিলিয়ে তার মাথার ভেতর যেন ছোটখাটো ঝড় বইছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার কপাটে হালকা ঠেলা দেওয়ার মতো শব্দ হলো। সোরায়া ভ্রু কুঁচকালো, তারপর ঘাড় ঘুরিয়েই দেখলো— ছোট্ট জুলিয়েট একা একাই তার রুমে ঢুকে পড়েছে। তার নরম লোমশ পা দুটো মেঝেতে হালকা শব্দ তুলছিল, লেজটা ধীরে ধীরে দুলছিল। চোখ দুটো চঞ্চল এদিক ওদিক ঘুরছে যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে।

সোরায়ার মুখে সঙ্গে সঙ্গেই একটা উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো। সে টেবিল থেকে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালো আর তাড়াতাড়ি জুলিয়েটের দিকে এগিয়ে গিয়ে কোলের ভেতরে তুলে নিলো।
—“আরে আমার ছোট্ট রাজকুমারী! কে এল রে?”—সোরায়া মিষ্টি গলায় বলে উঠলো।
জুলিয়েট হালকা মিঁউ করে সাড়া দিলো, তার নরম থাবা দিয়ে সোরায়ার গলা স্পর্শ করলো।
সোরায়া আবার হেসে বললো,
—“আহা! আমার সোনার পাখি… আমার ছোট্ট ডল। হঠাৎ আমাকে দেখতে এলি যে? মাকে খুঁজে পাচ্ছিস না বুঝি?”
সে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো জুলিয়েটের মোলায়েম লোমে। আঙুল বুলাতে বুলাতে বারবার আলতো করে ডাকছিল

—“শোন জুলু, … জানিস তুই কত আদরের?”
জুলিয়েট যেন সত্যিই তার কথাগুলো বুঝছিল। একবার গলা ফেলে সোরায়ার কোলের ভেতর গুটিসুটি মেরে বসল, তারপর চোখ আধবোজা করে শান্তভাবে গরগর শব্দ করলো।
সোরায়ার বুক ভরে গেল এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে। মাহিরের কথা ভেবে তার যে অস্থিরতা হচ্ছিল, মুহূর্তের জন্য যেন সব উধাও হয়ে গেল। জুলিয়েটকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
—“তুই না এলে আমি কেমন একা একা চিন্তাতে মরে যেতাম… এই মুহূর্তে আমি আমার মনের অবস্থা কাউকে বলতে পারছি না অথচ এখন আমাকে সঙ্গ দিতে তুই এলি… জানিস, তুই একেবারে আমার হার্ট হিলার।”
সে মজা করে জুলিয়েটের লেজ টেনে আবার আলতো করে ছেড়ে দিলো।
—“বল তো, কিরে ছোট্ট জাদুকরী, তুই কি সত্যি আমায় শান্ত করতে এসেছিস? নাকি মাকে খুঁজে না পেয়ে ভাবছিস, খালার কাছে গেলেই ভালোবাসা পাবি এই ভাবে, হুঁ?”

জুলিয়েট মাথা ঘষে দিলো সোরায়ার গালে, আর সে হাসতে হাসতে চোখ বন্ধ করে ফেললো—মনে হলো এই নরম উপস্থিতিটুকুই এখন তার কাছে সবচেয়ে বড় স্বস্তি।
জুলিয়েট তখন সোরায়ার কোলের ভেতর শান্তভাবে বসেছিল। চোখ আধবোজা, গরগর শব্দ করছে, যেন পুরো পৃথিবীর প্রশান্তি এখন তারই কোলের ভেতরে লুকিয়ে আছে। সোরায়াও একরকম ভুলে গিয়েছিল চারপাশ—মনে হচ্ছিল, শুধু সে আর তার ছোট্ট জুলিয়েট।
কিন্তু হঠাৎ করেই, যেন ভিতরে কোথাও মিরায়ার অভাব টের পেয়ে গেল ছোট্ট প্রাণীটা। এক মুহূর্তে ঝটকা দিয়ে সোরায়ার কোলে থেকে লাফ দিলো।

—“আরে জুলু, কোথায় যাচ্ছিস!”—সোরায়া অবাক হয়ে ডাক দিলো।
জুলিয়েট লেজ উঁচু করে, কান খাড়া করে, তাড়াহুড়োয় ছুটতে শুরু করলো দরজার দিকে। তার ছোট্ট পায়ের শব্দ টাপটাপটাপ করে করিডোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
সোরায়া তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালো।
—“আরে দাঁড়া! কোথায় যাচ্ছিস?”
সে বুঝতে পারলো না হঠাৎ কেন এমন করলো জুলিয়েট, কিন্তু তার চোখে মনে হচ্ছিল—ছোট্টটা যেন মিরায়ার গন্ধ পেয়েছে কোথাও, সেই টানেই ছুটছে।

জুলিয়েট সোজা দৌড়ে গেল লম্বা করিডোর পেরিয়ে, আর তার পেছনে দৌড়তে লাগলো সোরায়া। চুল খুলে গিয়েছিল, পায়ে স্যান্ডেলও ঠিক ছিল না, তবু থামলো না সে।
করিডোরের বাতাসে গলার আওয়াজ কেঁপে উঠলো—
—“জুলিয়েট! থাম না! কোথায় যাচ্ছিস?”
কিন্তু জুলিয়েট থামলো না। সে যেন নিশ্চিত কোথায় যেতে হবে। করিডোর পেরিয়ে একেবারে সোজা রায়ানের রুমের দিকে এগোলো।
সোরায়া দম নিতে নিতে প্রায় তার পেছনে পৌঁছে গেল, আর অবাক চোখে দেখলো—ছোট্টটা সত্যিই রায়ানের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। দরজাটা আধখোলা, ভেতর থেকে হালকা আলো বেরোচ্ছে, আর ভেতরের অদ্ভুত উত্তেজনাপূর্ণ নীরবতা যেন বাইরের বাতাসকেও ছুঁয়েছে।

মিরায়া ওমন অবস্থায় হঠাৎ রায়ানের মুখ নিজের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে জোরে চিৎকার করে ওঠে।
“আআআআ…”
রায়ানও মিরায়ার চিৎকারে হক চাকিয়ে উঠে বলল-
“ওই ছেমরি চিৎকার করিস কেন? চুপ কর মানসম্মান আমার সব খেয়ে ফেলবি নাকি!”
রায়ান নিজে তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে মিরায়াকে
বিছানার নিচে থেকে বের হতে সাহায্য করে। আর বের করার সাথে সাথেই নিজের সামনে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে বলল-
“ওই! আমি কি তোকে কিছু করেছি চিৎকার করার মতো? কেউ শুনতে পেলে আমাকে চরিত্রহীন মনে করবে। আমার কেরেক্টারে দাগ লাগানোর ধান্দা থাকলে এখনি বল। তোকে নিয়ে কট খেয়ে বিয়ে করে নেই।”
মিরায়া এমনিতেই ভয় পেয়েছিল তার জন্য তার শ্বাস প্রশ্বাস বেরে গিয়েছিল । সে রায়ানের এমন সোজা ভাবে এত বড়ো কথা ফেলার পর কেমন উত্তর দিবে তা ভেবে না পেয়ে শুধু বলল-
“সরি ভাইয়া, আসলে আমি…!”

মিরায়ার কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই রায়ান রেগে মিরায়াকে টেনে দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে বলল-
“বালের এই ভাইয়া ডাকা কি করলে বন্ধ হবে তোর হে?
এখন কি সেসব কাজ গুলো তোর সাথে করবো যা একজন ভাই তার বোনের সাথে দুঃস্বপ্নেও করে না? তাহলে ভাইয়া ডাকা বন্ধ করবি?”
মিরায়ার চোখে একগুচ্ছ জল বাসা বাঁধে রায়ানের এমন কথায় কিন্তু সে কথার সূত্র, বা অর্থ কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। রায়ানের তার প্রতি এমন অধিকার বোধ তার বোধগম্যের বাইরে।
রায়ান মিরায়ার চোখে পানির আভাস দেখে তাকে ছেড়ে দিয়ে। তার নিজেকে অপরাধী মনে হয় কারণ সে চায়নি কখোনো তার জন্য তার হৃদপাখি একটুও কষ্ট পাক। রায়ান মনে মনে চিন্তা করতে লাগল- “আমি কি বেশি বেশি করছি ওর সাথে প্রথম দিনেই?”

রায়ান নিজেকে সামলে মিরায়ার মুখ সামান্য তার দিকে তুলে কিছু বলতে চাইল-
“মিরা আমি …!”
তবে বলে শেষ করে উঠতে পারলো না।
জুলিয়েটের ছোট্ট শরীরটা এক মুহূর্তে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। টাপটাপ শব্দে ছুটে গিয়ে একেবারে রায়ান আর মিরায়ার মাঝখানে থেমে দাঁড়াল যেন সে মিরায়াকে রক্ষা করতে চাইছে।
মিরায়া তখনো রায়ানের সামনে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট কামড়ে নিচ্ছে, আর রায়ানের চোখ তার দিকে একদম গভীরভাবে আটকে ছিল। মুহূর্তটার চারপাশে নীরবতা এত ঘন হয়ে ছিল যে দুজনের নিঃশ্বাসও যেন শোনা যাচ্ছিল।
হঠাৎ করেই সেই নীরবতা ভাঙলো—

—“জুলিয়েট!”
সোরায়া দম নিতে নিতে রুমে ঢুকলো। ঢুকেই তার চোখ আটকে গেল সামনে দাঁড়ানো দুটো চেহারায়। রায়ান আর মিরায়া দুজনেই একসাথে চমকে উঠলো, যেন ধরা পড়ে গেছে কোনো গোপন মুহূর্তে।
রায়ান প্রথমেই জুলিয়েটকে দেখলো, তারপর ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি গেল সোরায়ার দিকে। একেবারে মাথা থেকে পা পর্যন্ত অচেনা একটা মেয়েকে দেখে তার চোখ প্রশ্নে ভরে গেল। ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে সে তাকিয়ে রইলো—

“ওটা আর এটা… কে?”
তার দৃষ্টির ভেতরে একটা বিভ্রান্তি, আবার সামান্য সতর্কতাও ছিল।
মিরায়া হঠাৎ করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ঠোঁট শুকিয়ে গেল, চোখ নামিয়ে নিল, কিন্তু সেই মুহূর্তের টানটাও যেন সরে গেল না পুরোপুরি।
সোরায়া এক মুহূর্ত রায়ানের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর গিয়ে জুলিয়েটকে তুলে নিলো। বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বললো—
—“তুই আবার এমন করে পালিয়ে এলি কেন রে!”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেও বুঝতে পারছিল—এখানে এমন কিছু চলছে, যা সে আগে কখনো কল্পনাও করেনি।
হঠাৎ জুলিয়েট সোরায়ার কল থেকে নেমে মিরায়ার পায়ের কাছে গিয়ে নিজের শরীর ঘষতে লাগলো যেন মিরায়াকে বলতে চাইছে- “আমাকে একটু করে নিয়ে আদর দেও।”

জুলিয়েটকে দেখার পর মিরায়ার মুখেও মৃদু হাসি ফুটে উঠলো চোখের পানি উধাও হয়ে গেল। মিরায়া নিচু হয়ে জুলিয়েটকে কোলে নিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো-
“ওরে আমার সোনা বাচ্চা, আমার ময়না পাখি, তোমার কথা তো আমার মাথা থেকে বের ই হয়ে গেছিল, সরি সোনা। আর হবে না মাম্মা তোমার সাথেই থাকবো এখন থেকে।”
রায়ান অবাক হয়ে মিরায়ার জুলিয়েটকে নিঃস্বার্থ আদর করা দেখছিল। তবে মিরায়ার কথা কানে যেতে সে ভ্রু কুঁচকে বলল-

” ময়না পাখি? এইটা তো বিড়াল ছানা। চোখ কই তোমার ? আর মাম্মা মানে? এই বিড়ালের মা কেন হতে যাবে তুমি, আমাকে কি বিড়াল নাকি যে বাচ্চা বিড়াল হবে? মানলাম আস্তে একটু দেরি হয়েছে আমার তাই বলে বিড়ালের সাথে পরকীয়া মানা যায়?”
মিরায়া রায়ানের কথায় অনেক বিরক্ত হলো সে রেগে কিছু বলবে থির আগে সোরায়া তাদের মাঝে এসে মিরায়ার হয়ে উত্তর দিলো উৎসাহ নিয়ে –
“আরে না , সোনা পাখি তো আদুরে ডাক। ওর নাম জুলিয়েট। ওর কেউ ছিল না তাই এখন আমরাই ওর সব ও আমাদের বাচ্চার মতো। মিরা আপু ওকে রাস্তায় পেয়ে বাড়িতে এনেছে তাই ও আপুর বেবি।”
রায়ান সোরায়ার কথা চুপচাপ শুননে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে ও জুলিয়েট এর দিকে আদুরে চোখে তাকাল। জুলিয়েট যেন রায়ানের তাকানোরই অপেক্ষায় ছিল । সে রায়ানের দিকেই চাতোক পাখির ন্যায় তাকিয়ে ছিল যেন চাইছিল রায়ান তার দিকে তাকাক।

রায়ান জুলিয়েট এর দিকে থেকে নজর সড়িয়ে এবার সোরায়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“ওর পরিচয় তো দিলে। তবে তোমার পরিচয়টা কে বলবে চড়ুই পাখি?”
সোরায়া রায়ানকে ভেঙেয়ে উত্তর করল-
” আমি মিরায়ার লিটল ভার্শন-আমার নাম সোরায়া, ইন সোরট সোরা। কোনো চড়ুই পাখি টাখি না আমি , হুঁ। ”
রায়ান সোরায়ার উত্তরে ঠোঁট কামড়ে হেঁসে উঠল। সে মনে মনে ভাবল-
“তাহলে এই হলো আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র শালি। আহা! কি জীবন আমার বউ নিজে এত সুন্দর তার উপর একটা ছোট চড়ুই পাখির মতো শালিও আছে দেখি। শুনেলে যে কেউ বলবে ‘মামা জিতছেন!’।
রায়ান সোরায়া কে নিজের পরিচয় দিতে বলল-

” হাই মাই মিসেসেস লিটল ভার্শন আই এম রায়ান চৌধুরী তোমার বিগ ভার্সন..(এতটুকু বলে মিরায়ার দিকে তাকিয়ে মিরায়ান রাগি চোখ দেখে রায়ান কথা ঘুরিয়ে কথা শেষ করল).. তোমার বিগ ভার্সন এর মামণির বড় ছেলে।
সোরায়া উৎসাহ নিয়ে বলল- “ওহ্! আপনিই তাহলে আমেরিকা ফেরত রায়ান ভাইয়া? ওয়াও দেখা তাহলে হয়েই গেল।”

সোরায়া নিজের থেকে উৎসাহ নিয়ে আরো কিছু বলতে যাবে এমন সময় সোরায়াকে থামিয়ে দিয়ে মিরায়া সোরায়ার হাত ধরে জুলিয়েট কে করে নিয়ে রায়ানের রুম থেকে বের হয়ে আসতে চায়।
সোরায়া- “আহ্ আপু কি কর লাগে তো। কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমার কথা শেষ হয়নি তো।”
রায়ান উৎসুক হয়ে সোরায়া কে বলে-
“কি বলবে বল না চড়ুই পাখি আমি শুনছি তো।”
মিরায়া রেগে সোরায়ার উদ্দেশ্যে বলে-
“আর কিছু বলতে হবে না তোকে। তোর না কোন অংকতে সমস্যা ছিল অর্থনীতির । চল আমি বুঝিয়ে দিবো।”
রায়ানের দিকে আর না তাকায়ে মিরায়া সোরায়ার হাত ধরে রায়ানের রুমটা ত্যাগ করে। আর সোরায়ার রুমে চলে যায়।
আর রায়ান নিজের বিছানায় বসে হাসতে থাকে একটু আগে হওয়া ঘটনা চিন্তা করে।

সোরায়ার ঘরে যাওয়ার পর মিরায়া তাকে অংক বুঝাতে বসবে এমন সময় তার মাথায় আসে বিকালেই রুদ্র তাকে তার রুমে দেখা করতে বলে ছিল রিমির ব্যাপারে কিছু বলবে বলে।
মিরায়া কপালে হাত দিয়ে-
“যা চলে! আমিতো ভুলেই গেছি রুদ্র ভাইয়া আমাকে ডেকে ছিল।”
সোরায়া ছলছল চোখে-
“আর আমার না বোঝা অংক?”
মিরায়া সোরায়াকে একটু মৃদু হাসি দিয়ে বলল –

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৩

“রুদ্র ভাইয়ার কথাটা শুনেই এসে তোকে সব পানির মতো সহজ করে বুঝিয়ে দিবো। ঠিক আছে বনু? তুই বাকি অন্য পড়া শেষ কর। আমি যাই ।
এই বলে মিরায়া সোরায়ার ঘর ত্যাগ করে রুদ্রর ঘরের দিকে গেল।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here