আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৪ (২)
অরাত্রিকা রহমান
রাত ১.৩০মিনিট~ (একই সময়ে)
জ্যাক কে হসপিটাল থেকে দেখে এসে কিবরিয়া সরকার নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রাতের খাবার এখনো পেটে পড়েনি তার। নিজের বেডে শুয়ে আছেন চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমের উপস্থিতি ও চোখে ধরা পড়ছে না। এমপি হয়ে এমন বাজে একটা পরিস্থিতিতে ফেঁসে যাওয়াতে তার চিন্তার যেন শেষ হচ্ছে না। সকলের সামনে একটা সাধু চেহারা দেখানো ছাড়া রাজনীতিতে টিকে থাকা এখন বড় কঠিন, সেই জায়গায় মাদক সাপ্লাইয়ের মতো বাজে কান্ডতে ফেসে যাওয়ায় তিনি নিজের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে টেনশন করছিলেন।
আবার একমাত্র ছেলে এমন বাজে অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি, সবকিছুই যেন কেমন তার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ তার সাইড টেবিলের উপর থাকা লেন লাইনের ফোনটা বেজে উঠলো। তিনি অবাক হয়ে চোখ দুটো খুলে বিছানায় গা এলিয়ে বসে ফোনটা তুললেন। ফোনটা কানে যাওয়ার সাথে সাথে জোরে কান্না কান্না কন্ঠে বাংলোর দারোয়ান বলতে লাগল-
“স্যার গো স্যার, আমারে মাফ কইরা দেন স্যার। আমি কোনো দোষ করি নাই। স্যার আমারে দয়া কইরা মাফ কইরা দেন। ওহ্ আল্লাহ!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দারোয়ান রীতিমতো আল্লাহর নাম নিয়ে বিলাপ করে ক্ষমা চাইছে কিবরিয়া সরকারের কাছে।
কিবরিয়া সরকারের মন মেজাজ এমনিতেও ভালো ছিলো না যার কারণে তিনি খুব একটা পাত্তা দিতে চাইলেন না দারোয়ানের অদ্ভুত কথাবার্তায়। উল্টো স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করলেন-
“এমন ভাবে বিলাপ না করে হয়েছে টা কি তাই বলো। এমনিতেই সময় খারাপ যাচ্ছে।”
দারোয়ান আবারো কান্নার মাঝে একটু সুরে সুরে বলল –
“ওও স্যার গো বাংলোয় তো আগুন ধরাইয়া দিসে গো স্যার। আমি তো পুলিশের ভয়ে গেছিলামগা। এহন আইয়া দেহি দাউ লাউ কইরা আগুন জলতাছে স্যাররর..আমি কি করি নাই স্যার!”
কিবরিয়া সরকার বাংলোতে আগুন লাগার কথা শুনার সাথে সাথে বিছানায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। তিনি এক মুহূর্ত কিছু বুঝতে না পেরে রাগে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
“আগুন লেগেছে মানে কি? আগুনের কি হাত পা আছে যে বাংলোর কাছে নিজে চলে যাবে? কিভাবে, কখন, কে আগুন লাগালো?”
দারোয়ান কান্নারত অবস্থায় ভয়ে ভয়েই বলল-
“স্যার আমি চিনি না, আমি জানি না কেডা ওই পোলা। সিসি টিভিতে দেহা যায় এক পোলায় সব বাইকের তেল বাংলোতে ছড়াইয়া আগুন ধরাইতাছে। স্যার গো, আমি নির্দোষ স্যার। আমি কিছু করি নাই স্যার। আমি আপনারে ফুট্যাজ পাঠাইছি, ফোনে কল রিসিভ আপনে তো ধরেন নাই স্যার। এহন আপনে দেহেন।”
দারোয়ান কথা গুলো বলার পর তার কান্নার গতি আরো তীব্রতর হয়ে উঠলো। কিবরিয়া সরকার তখনি কলটা কেটে দিলেন বিরক্তিতে এবং সাথে সাথে নিজের ফোন হাতে নিলেন ফুট্যাজ টা চেক করার জন্য। ফোন খুলে তিনি সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখলেন যখন রায়ান বাংলোতে দ্বিধা ছাড়া আগুন লাগাচ্ছিল। হসপিটালে আদনানের কাছে ছেলের এমন হাল করা মেয়ে আর ছেলে টা কেমন, দেখতে চাওয়ায় আদনান রেসের ভিডিও বের করে রায়ান আর মিরায়াকে দেখিয়ে ছিল কিবরিয়া সরকার কে। যেহেতু মিরায়ার মুখ দেখা যায়নি রায়ানের চেহারাটা তার চোখে গেঁথে আছে তখন থেকেই। সিসি টিভি ফুট্যাজে রায়ানকে দেখে চিনতে তার এক সেকেন্ড লাগেনি।
রায়ানের বেপোরোয়া ভাব দেখে কিবরিয়া সরকার অবাক প্রায় তিনি ফুট্যাজটা দেখতে দেখতে আওড়ালেন-
“দুই দিনের ছোকরা অথচ এতো তেজ। চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে বলে কথা। শিরায় শিরায় গরম রক্ত বইছে দেখেই আন্দাজ করা যায়। কিন্তু সব ছেড়ে কিবরিয়া সরকারকে তেজ দেখাতে মেতেছিস কেন রে?” (তুচ্ছ স্বরে)
কিবরিয়া সরকার রায়ানকে বাংলোয় আগুন জ্বালাতে দেখে নিজের রাগ আর ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তিনি ধপ করে খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কুটিল হাঁসি দিয়ে বললেন –
“সরকার পরিবারের সাথে খেলায় নামলে এর মাশুল তো গুনতে হবে হে ছোকরা! আমিও দেখবো কতটা বেপোরোয়া হওয়ার ক্ষমতা আছে চৌধুরী বাড়ির রক্তে। আমার ছেলে যেই অবস্থায় এখন হসপিটালে ভর্তি তার চেয়ে হাজার গুণ খারাপ পরিস্থিতিতে হসপিটালে পড়ে থাকতে হবে তোকে। তার জন্য যা করার, আমি, কিবরিয়া সরকার, নিজে করবো।”
কিবরিয়া সরকার নিজের ফোনে এবার একটা নাম্বার ডায়েল করলেন। কয়েকবার বাজতেই কলটা রিসিভ হলো-
“ওই শালার ঘরে শালা , কেডায় রে? এই মাইজ রাইতে তোর কোন বাপেরে লাগবো?”
কিবরিয়া সরকার খানিকটা ধৈর্য ধরে শান্ত গলায় বললেন-
“আমি বস বলছি। নাম্বার দেখে কথা বলো ইকবাল।”
ইকবাল (কিবরিয়া সরকারের রাজনৈতিক জীবনের সকল কালো অধ্যায়ের লেখক, যত অরাজকতা কিবরিয়া সরকার করেছেন সবই ইকবালের হাত দিয়ে করানো, একজন বিশ্বস্ত কর্মী)
কিবরিয়া সরকারের কন্ঠ কানে পৌঁছাতেই ইকবাল খাটে ধপ করে উঠে বসে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চোখের সামনে নিয়ে এসে নাম্বার টা দেখে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ফোনটা আবার কানে দিয়ে ভয় ভয় কন্ঠে বলল-
“সরি বস সরি। আসলে ঘুমের ঘরে খেয়াল করি নি আপনার নাম্বার টা। সরি বস।”
কিবরিয়া সরকার কথা না বাড়িয়ে স্বাভাবিক ভাব নিলেন-
“হয়েছে বুঝতে পেরেছি। এখন এসব বাদ দিয়ে যেই কাজে ফোন করা তা শুনো।”
ইকবাল কাজের কথা আসতেই গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল-
“কি কাজ বস? খালি হুকুম করুন আপনি, কাজ হয়ে যাবে মুহূর্তে।”
কিবরিয়া সরকার আশ্বস্ত হয়ে বললেন-
“একটা ছেলের ছবি যাবে তোমার ফোনে। ওই ছেলেকে এখনি আজ রাতের মধ্যে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পারবে?”
ইকবাল হালকা বাঁকা হেঁসে বলল-
“বস হাসপাতালে না পাঠিয়ে ডিরেক্ট উপরে পাঠিয়ে দেই?”
কিবরিয়া সরকারের এই কথায় যেন কোনো কিছু গেলো এলো না তিনি শান্ত গলায় বললেন –
“যা ইচ্ছা করো। ছেলেটা যেন সুস্থ অবস্থায় না থাকে। সে হক আঘাত প্রাপ্ত বা মৃত।”
ইকবাল ঠিক বিশ্বস্ত গলায় বলল-
“হয়ে যাবে বস। আপনি ডিটেইলস দিয়ে দিন। ৩০ মিনিট এর মধ্যে আপনার কাছে সুখবর চলে যাবে।”
কিবরিয়া সরকার কুটিল হেঁসে বললেন –
“ঠিক আছে। অপেক্ষা থাকবে তোমার খবরের।”
কিবরিয়া সরকার রায়ানের একটা ছবি তুলেন সেই সিসি টিভি ফুট্যাজ থেকে। আর তার পর চৌধুরী বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সব ডিটেইলস সহ ইকবালকে দেন। ইকবাল ও সব তথ্য পাওয়ার পর মেসেজে কিবরিয়া সরকারকে আশ্বস্ত করে যে, কাজ হয়ে যাবে আজ রাতেই।
চৌধুরী বাড়ি~
রুদ্র রিমির কথা মতো তার সাথে দেখা করতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে। চৌধুরী বাড়ি থেকে কামরাঙ্গীরচর বেশ দূরে তাই কম করে প্রায় ২৫ মিনিট এর মতো লাগতে পারে এখন যেহেতু মাঝ রাতে রাস্তায় তেমন যানবাহন নেই। রুদ্র গাড়িতে উঠার আগেও অনেক বার চেষ্টা করে রিমি কে কল করে কথা বলার কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছিল। হঠাৎ এমন কি হয়েছে রিমির সাথে সেই সম্পর্কে রুদ্রর কোনো ধারণা নেই কিন্তু চিন্তার চেয়ে বেশি তার মনে এখন খুব উৎসাহ কাজ করছে রিমির সাথে দেখা করা নিয়ে। তাই রুদ্র আর রিমির ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে সেই দিকে ফোকাস না করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে রায়ান নিজের ঘরে না গিয়ে সোজা মিরায়ার ঘরের দিকেই যাবে বলে মনস্থির করেছে। চোখে মুখে উৎফুল্লতা উপচে পড়ছে তার। মিরায়া ই আজকের রাতের রাইডার কুইন রায়া, জানার পর যেন স্বামী হিসেবে সে নিজেকে মহা ভাগ্যবান মনে করছে, গর্ব আর খুশি তার চেহারায় স্পষ্ট পরিলক্ষিত। সিঁড়ি দিয়ে বাচ্চা দের মতো হালকা হেলে-দুলে ছোট ছোট লাফ দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে সে বিড়বিড় করছিল-
“your king is coming my personal rider queen..”
রায়ান মিরায়ার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং হাত উঠালো নোক করতে, কিন্তু দরজায় শব্দ করার আগে হঠাৎ তার মাথায় সব কিছু কেমন আবার ফিরে এলো। এতো দ্রুত সব কিছু হচ্ছে যে মাথা এক মুহূর্তে গোলমাল পাকিয়ে গেলো রায়ানের। তার চোখের সামনে আবারো আজকের রাতের এক ঝলক ভেসে উঠলো, সে একটু শান্ত হওয়ার চেষ্টায় দুইবার দীর্ঘশ্বাস নিল আর ছাড়লো। নিজেকে একবার মোটিভেট করতে বলল-
“রায়ান ! Be strong. You can do this. জাস্ট ভেতরে যাবি বউকে ধরবি আর সব সত্যি বলে দিবি, শেষ। হ্যাঁ শেষ। এরপর..থাক এরপর আর ভাবতে হবে না। যা হবার হবে।”
এই বলে দরজাতে নোক করতে যাবে, কিন্তু এবারো একই কারণে পরলো না। মিরায়ার সত্যি জানার পর ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেবে, তা মাথায় এলেই রায়ানের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল। রায়ান বুকের বাম দিকে হাত রেখে হালকা জোরে চাপ দিয়ে নিজেকে বুঝালো-
“All is well, all is well, all is well.. Calm down Rayan. মিরা তোর বউ, মানুক বা না মানুক তোর বউ হয়েই থাকতে হবে তাকে- শুধু এতো টুকু মনে রেখে, বাকি সব সত্যি বলে দে। কি আর করবে? না হয় বড় জোর এক বালতি পানিতে সত্যি সত্যি গোসল কারতে হবে, তারপর তো অন্তত কোনো এক সকালে বউকে নিয়ে ফরজ গোসল করার সুযোগ পাবি নাহলে ওই সুযোগটুকুও আসবে না তোর জীবনে।”
মিরায়াকে পরিপূর্ণ করে পাওয়ার আশা রায়ানের মন অনেক টা স্থির করে আনলো। রায়ান সব সত্যিটা একবারে বলে দেবে মিরায়াকে এমনটা ভেবেই দরজাতে নোক করলো। একটা টোকা পড়তেই দেখলো দরজাটা হালকা ফাঁকা হয়ে গেলো-মানে দরজা খোলাই ছিল। রায়ান একটু সংকচে করলো নিজে থেকে ঢুকতে। পরক্ষণেই ভাবলো- “দরজাটা যেহেতু খোলা মিরা হয়তো কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে এসেছে। আমি কি ভিতরে ঢুকেই নিজের মতো সব বলে দেব?”
রায়ানের মনের এতো ভয় কেবল তার হৃদপাখিকে হাড়িয়ে ফেলার ভয়ে। রায়ান নিজের জন্য একটু করুণা করেই বলল-
“যেই মানুষ টা ছোট থেকে বেপোরোয়া, আজ সে বউয়ের রাগের পোরোয়া করছে। হাহ্!”
অচিরেই রায়ানের মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। রায়ান সাহস নিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। তবে চোখটা বন্ধ, আগু পিছু কিচ্ছু না ভেবে চোখ বন্ধ করে মিরায়াকে উদ্দেশ্যে করে শান্ত গলায় একটানে বলল-
“হৃদপাখি? Don’t panic, please. Just hear me out. সত্যি টা চোখে চোখ রেখে বলার সাহসে কুলাচ্ছে না তাই এভাবে বলছি পরে না হয় তোমার চোখে চোখ রাখবো।”
কথাটা বলে রায়ান হালকা চুপ থাকলো। এর আগে রায়ান কখনো এভাবে কারো সাথে কথা বলে নি সবটাই নতুন নতুন তার কাছে। মিরায়ার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে এবার ছোট বাচ্চারা যেমন বাড়ির পড়া শেষ না করলে ক্ষমার জন্য অনুরোধ করে সেই অনুযায়ী কথা বলতে শুরু করলো-
“হৃদপাখি..আমি প্রথমেই সরি বলে দিচ্ছি ওকে। আমার ভুল হয়ে গেছে। রাগ না করে প্লিজ আমার কথা গুলো শুনে আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।
আসলে এত বছর যেই রিভান কে খুজছো সেই রিভান আমিই- রিভান চৌধুরী রায়ান। আজ থেকে দশ বছর আগে পারিবারিক ভাবে আমার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছিল। আর হ্যাঁ আমিই সেই ব্যক্তি যে তোমাকে রেখে চলে গেছিলাম, যেটা আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ভুল ডিসিশন ছিল। প্লিজ প্লিজ রাগ করে আগেই রিয়েক্ট না করে আমাকে একটু বোঝো সোনা, আমার বয়সই বা কত ছিল বলো? সতের বছর বয়সে এমন ভাবে বিয়ে হওয়াটা আমি মানতে পারি নি। দেখো আমি জাস্টিফাই করছি না আমি ঠিক ছিলাম। আমি অবশ্যই ভুল ছিলাম, আমার নিজের দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল তোমার একমাত্র গার্ডিয়ান হিসেবে যেটার অধিকার এতো গুলো বছর আমি নিজে দোষে নষ্ট করেছি। বিশ্বাস করো আমি খুব পস্তাচ্ছি। কিন্তু তোমার ক্ষমা না পেয়ে এই পস্তানোর ও কোনো লাভ নেই। মিরা.. আমার হৃদপাখি.. তুমি কি তোমার বরটাকে আর একটা সুযোগ দিতে পারো না? I promise you, I will be the best husband. Seriously, I just can’t anymore baby…Be mine , please…এভাবে কখনো বলবো এসব তোমাকে ভাবি নি কিন্তু আমার সম্ভব হচ্ছে না তোমাকে ছাড়া থাকা। মিরা প্লিজ একটু বোঝো। মিরা.. মিরা..কথা বলছো না কেন?”
মিরায়ার কোনো আওয়াজ নেই ঘরে। থাকবে কিভাবে ঘরে তো সে নেই। রায়ান মিরায়াকে ডাকলো কিন্তু তাও কোনো সাড়া নেই। হঠাৎ রায়ানের ডাকে খাটে বসে থাকা জুলিয়েট সাড়া দিল-“মিয়াও!”
রায়ান আচমকাই জুলিয়েটের আওয়াজ শুনে চোখ খুললো। একবার খাটে বসে থাকা জুলিয়েটের দিকে তাকিয়ে ঘরটায় চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখলো, কেউ নেই ঘরে। রায়ান এতোক্ষণ একা একাই কথা বলে যাচ্ছিল এটা বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে খাটে জুলিয়েটের কাছে দিয়ে বসে পরলো আর বলল-
“যা ব্বাবা এতোক্ষণ একা একা বকবক করলাম? ধুর বাল, এতো কিছু বলে ফেললাম বউটা কিচ্ছু শুনলো না। এখন তো মনেও পড়ছে না কিভাবে শুরু করেছিলাম রিপিট কিভাবে করবো! আবার সব নতুন করে ভেবে বলতে হবে।”
রায়ান ঠাস করে মিরায়ার বিছানায় শুয়ে পরলো। জুলিয়েট টুক টুক করে হেঁটে রায়ানের কাছে গিয়ে বসলো। রায়ান জুলিয়েট কে শুয়া অবস্থা হাত দিয়ে তুলে বুকের উপর বসিয়ে বলল-
“তোর মাম্মা ও আমার বুকে আসে নি এখনো তার আগে তোকে বুকে নিলাম। Feel lucky, ok?”
জুলিয়েট পাত্তা দিলো না রায়ানের কথার চুপচাপ বসে রইল রায়ানের প্রসস্থ বুকের উপরে। রায়ান জুলিয়েটের লোম ভরা শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করলো-
“জুলি…এই জুলি.. বলনা তোর মাম্মা কি তোর পাপা কে বুঝবে না?”
জুলিয়েট আওয়াজ করলো-“মিয়াও!” যেন বলতে চাইছে-“বুঝবে।”
রায়ান হঠাৎ জুলিয়েট কে হাতে তুলে বিছানা থেকে উঠে বসে বলল-“কিন্তু আমার বউটা গেলো কোথায়? আমার কতো আগেই তো রওনা দিয়েছিল। বাড়িতে ফেরেনি কেন এখনো? রাস্তায় কি কিছু.. না না কিছু হয় নি। কি ভাবছি এসব।”
রায়ান তখনি জুলিয়েটকে প্রশ্ন করলো-“পাপা.. তুই কিছু জানিস? মাম্মা কোথায় গেছে? বাড়ি ফেরেনি কেন?”
জুলিয়েট এতক্ষণ যেন রায়ানের মুখে এই প্রশ্নটা লুনার অপেক্ষায় ছিল। জুলিয়েট দ্রুত রায়ানের কোল থেকে নেমে দৌড়ে বারান্দায় গেলো। রায়ান ও সাথে সাথে গেলো। জুলিয়েট রেলিং এ বাঁধা ওড়না কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রায়ান অবাক হলো রেলিং এর ওড়না দিয়ে বানানো দড়ি দেখে। সে বারান্দা থেকে ঝুলতে থাকা ওড়না গুলো টেনে উপরে তুলে নিলো আর বলল-
“ওহ্! তাহলে এইভাবে বাড়ির বাইরে গেছেন মেডাম। কি সাহস! যদি পড়ে যেত? আজকে বাড়ি ফিরুক, সত্যি জানানোর গুষ্টিরতুষ্টি। আগে ওর সত্যি লুকানোর আর এসব দুঃসাহস দেখানোর শাস্তি পাবে সারা রাত, পরে বেশি কান্না কাটি করলে বলে দিবো বরই ছুঁয়েছে কান্না করার কিছু নেই, তাহলেই হয়ে যাবে। কিন্তু এখনো আসছে না কেন?”
জুলিয়েট আবার কি যেন মনে করে বারান্দা থেকে আবার ভেতরে গেল। সে দৌড়ে গিয়ে মিরায়ার পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে লাফিয়ে টেবিলের উপরে উঠে গেলো। রায়ান জুলিয়েটের আচরণে অবাক হলো কিন্তু জুলিয়েট আসলে কি বোঝাতে চাইছে তা বুঝলো না। সেও বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে গিয়ে জুলিয়েটের কাছে টেবিলের সামনে গেলো। জুলিয়েট তার সামনের এক পা একটা কাগজের উপর রাখলো, রায়ান ও খেয়াল করলো সেটা-
“কিসের কাগজ এটা জুলি? পাপাকে পড়তে বলছিস?”
জুলিয়েট বাকহীন প্রাণী বলার মতো করে বুঝাতে পারছে না। সে রায়ানের দিকে মুখ উঁচু করে ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইল শুধু। রায়ান বুঝতে পারলো হয়তো জুলিয়েট কাগজটা দেখার জন্য বলছে। অতঃপর রায়ান টেবিলের উপর থেকে কাগজটা তুলে নেয়। কাগজটা হাতে নিতেই উপর থেকে সে বুঝতে পারলো এইটা কোনো লিগাল পেপার। বুঝতে পারাটা স্বাভাবিকও যেহেতু রায়ানের লিগাল পেপারস নিয়ে কাজ করতে হয় ডিলস এর জন্য। রায়ান এবার একটু গম্ভীর ভাব নিয়ে কাগজটার ভাজ তাড়াতাড়ি খুললো।
এই কাগজটাই যে তার ডিভোর্স পেপার সেটা বুঝতে পেরেই রায়ানের চোখ ছানা বড়া-“এইটা এখানে এলো কিভাবে?য এটা তো আমার রুমে ছিলো। তাও আবার পুরোনো টেবিলের ড্রয়ারে।”
রায়ান এক মুহূর্ত ফ্রিজ হয়ে রইল তার হাতের কাগজটা মিরায়ার ঘরে কিভাবে এলো এটাই তার মাথায় ঘুরছে। হঠাৎ তার নজর পরলো কাগজটার নিচে ঠিক যেখানে মিরায়ার সিগনেচার করার কথা সেখানে। মিরায়া যাওয়ার আগে কাগজটাতে কিছু লিখে রেখে গেছিল আর সেটা ওই সিগনেচার এর জায়গায়ই লিখেছিল-
“চলে যাচ্ছি। দেখা যাক নিজের কথার মূল্য দিতে পারেন কি না। অপেক্ষায় থাকবো।”
রেসের আগে মিরায়া যখন রায়ানকে বলেছিল যদি কখনো সে চলে যায় তাহলে কি হবে, রায়ান বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলেছিল সে মিরায়ার কাছে ঠিক পৌঁছাবে গন্তব্য যেখানেই হোক না কেন। মিরায়া চায় রায়ান নিজেকে প্রমাণ করে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে চৌধুরী বাড়িতে বড় বউয়ের মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলবে, তাদের সংসার হবে। ম্যাচরিটির সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে দশ বছর আগের ভুল সে ভুলতে রাজি কারণ তখন পরিস্থিতি সবার জন্য অন্য রকম ছিল। কিন্তু এখন দুইজনেই বড় হয়েছে বয়সের তফাত রয়েছে, কিন্তু রায়ান যেহেতু প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পরও সম্পর্ক রাখতে চাইছে তাহলে এত বছর অপেক্ষা করে সইচ্ছায় সংসার করতে মিরায়ার আপত্তি ছিল না। এখন রায়ানের ভালোবাসা তাকে বাধ্য করেছে সব ভুলতে। তবে আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনি মিরায়ার কাছে তাই চলে গেছে নিজের জন্য তবে তার বিশ্বাস রায়ান ঠিক নিজের কথা রাখবে।
রায়ান মিরায়ার লেখাগুলো পড়ল। সে নিজেকে বোঝাতে পারছে না ঠিক কি হলো এটা। সত্যি টা সে নিজে মিরায়াকে বলার আগেই মিরায়া এভাবে জেনেছে এইটা তার মেনে নিতে বুকে লাগছে। রায়ান নিজের মাথায় হাত দিয়ে চুল খামচে ধরে বলতে লাগলো-
“না না না। এটা কেন হলো? কিভাবে হলো? সত্যি টা তো আমি আজ এমনিতেও বলতাম বউ। তুমি এইভাবে কেন সত্যর মুখোমুখি হলে?”
রায়ানের মনে ভয় হচ্ছিল যদি মিরায়া ডিভোর্স পেপারের জন্য তাকে ভুল বুঝে থাকে, তাহলে কিভাবে বুঝাবে সে। রায়ান কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না বলে আবার মেঝে থেকে পেপার টা তুলে নিয়ে মিরায়ার লিখাটা পড়লো-
“চলে যাচ্ছি, মানে কি হ্যাঁ? বললেই হলো নাকি। কোথায় যাবে? মাটির নিচে গেলেও ওইখান থেকে তুলে নিয়ে আসবো। আর আমার কোন কথা রাখার কথা বলছে?”
রায়ান যখন কিছু বুঝতে পারছিল না তখনি শেষের লাইনটা পড়ে একটু মাথা শান্ত করলো-“অপেক্ষায় থাকবো?”
রায়ান -“অপেক্ষায় থাকবে ও, এটার মানে কি? ও আমার অপেক্ষা করবে? না আমার কোন কথা রাখার অপেক্ষা করবে? উফ্ আল্লাহ আমাকে বোঝার ক্ষমতা দেও।”
রায়ানের ঠিক খেয়াল ছিল না রেসের আগের এই কথা গুলো। সে ভাবে ছিল মিরায়া এমনি তাকে দূরে যাওয়ার কথা বলছে রায়ানের উত্তর কি হয় শুনতে। হঠাৎ অনেক কিছু মাথার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রায়ানের ছাদে মিরায়ার অঝরে কান্না করতে থাকা, তাকে আচমকা জড়িয়ে ধরতে বলা, অন্তরঙ্গ মুহূর্তে একবারও বাঁধা না দেওয়া সব স্বাভাবিক রাখতে শুরু করলো যেহেতু মিরায়া সত্যি টা জানে। রায়ান আনমনে বলল-
“তার মানে মিরায়া আমার বাড়ি ফেরার আগেই সব জেনে গেছিল? এই জন্যই ছাদে কান্না করছিল? আমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে বলেছিল?”
দুইয়ে দুইয়ে চার করতে গিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টাই রায়ানের কাছে পরিষ্কার হয়ে ধরা দিলো। রায়ান হালকা মুচকি হেঁসে বলল-
“মানে আমি ওর বর জানার পর আমার উপর মিরা রাগ করে নি! উল্টো আমার কাছে আসতে চেয়েছে? আমার হৃদপাখি আমাকে বুঝেছে! ও কি তবে আমার সাথে সংসার করতে রাজি হবে যদি ওকে আমি নিজর ভুল স্বীকার করে নিজের করতে চাই? এই বাড়িতে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসি?”
রায়ানও বুঝতে পারলো মিরায়া ঠিক কি চাইছে। রায়ান যেখানে একটু আগে টেনশন করছিলো এখন সে কি করবে! এখন সে আবেগে ভাসছে, খুশিতে আত্মহারা হয়ে জুলিয়েট কে কোলে তুলে বলল-
“জুলি রে, তোর মাম্মা তোর পাপাকে ভুল বোঝে নি। একদম ঠিক বুঝেছে।”
জুলিয়েট হালকা আওয়াজ করলো-“মিয়াও।”
রায়ান জুলিয়েট কে আদর করে বলল-
“তুই চিন্তা করিস না, তোর মাম্মা যা চাইছে তাই হবে। তোর মাম্মাকে সকালের মধ্যে আবার এই বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে তোর পাপা।”
রায়ান জুলিয়েট কে রেখে দিয়ে নিচে চলে গেল। সে এখনি চট্টগ্রামের জন্য রওনা দেবে। মিরায়া যাওয়ার মতো জায়গা একমাত্র চট্টগ্রামই আছে। সুতরাং মিরায়া সেখানেই যাবে এটা রায়ান জানে। রায়ান ড্রয়িং রুমে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে চিন্তা করলো বাবা মাকে কিছু জানাবে কিনা। কিন্ত পরে কি যেন ভেবে বলল-
“না থাক, এখন না। মিরাকে নিয়ে এসে তারপর সব খুলে বলবো সবাইকে। এখন বললে চিন্তা করবে শুধু।”
রায়ান বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলো। চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। রায়ান চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে তার একটা ছবি তুলে এক খবরি ইকবালকে কল করে বলল-
“স্যার কাজ হয়ে গেছে, গাড়ি মাঝ পথেই ব্রেক ফেইল করবো। ভাবছিলাম হয়তো সকালে প্লেন কাজে দিব, এহন দেহি শিকার নিজেই শিকার হইতে বাড়ি হইছে খাঁচা থেইকা।”
ইকবাল কুটিল হেঁসে বলল-
“ভালো খবর। কিন্তু কাজ শেষ হয় নি। কাজ আসলে কতটা শেষ হয়েছে তা একটু পর বোঝা যাবে।”
একই সময়ে~
মিরায়া চট্টগ্রামে ঢুকবে একটু পরেই। সামনে একটা থেকে পোস্টে পুলিশরা তার বাইক দাঁড়া করায়। মিরায়াও দাঁড়িয়ে যায় ফর্মালিটিস পূরণ করতে।
পুলিশের একজন কর্মী মিরায়ার বাইকের কাছে এসে কথা বলে লাগলেন-“এতো রাতে মেয়ে মানুষ বাইকে কোথায় যাচ্ছেন?”
মিরায়া নিজের হেলমেটের ভিসর গ্লাস টা তুলে জবাব দিলো-
“ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছি নিজের বাড়িতে। মেয়েরা রাতে বাইক চালাতে পারবে না এমন কোনো আইন আছে বলে আমার জানা নেই।”
পুলিশের লোকেরা মিরায়ার কথার তীক্ষ্ণতা বুঝে চোখাচোখি করে মিরায়াকে জেরা করলেন-“নাম কি? লাইসেন্স আছে সাথে?”
মিরায়া সাথে সাথে নিজের লাইসেন্স টা বের করে তাদের হাতে দিয়ে বলল-“এই হলো লাইসেন্স। আর এটাতে নামও দেওয়া আছে।”
যেহেতু মিরায়ার লাইসেন্স ঠিক ছিলো, মাথায় হেলমেট ছিল সব কিছু দেখে আর পুলিশ রা তাকে আটকায় নি, ছেড়ে দিলো। মিরায়া নিজের লাইসেন্স নিয়ে নিলো। এবং আবার রাইড করতে শুরু করলো। হঠাৎই সামনে থেকে অন্য একটা বাইক মিরায়ার বাইকের সামনে পথ আটকে দাঁড়ালো। মিরায়া অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এভাবে হঠাৎ পথ আটকানো যে বিরক্তি নিয়ে বলল-
“এই যে কি হচ্ছে এটা? পথ আটকালেন কেন এভাবে? এখুনি তো বাইকে লেগে যেত।”
বাইক থেকে একটা লোক নেমে এলো। ধীরে ধীরে সে মিরায়ার কাছে এগতে লাগলো। মিরায়ার এবার হালকা ভয় করতে লাগলো। চারপাশটা নীরব অন্ধকার ফাঁকা। কিন্তু সে বাড়তি কিছু ভেবে ভয় না পেয়ে স্থির থাকলো নিজের যায়গায়। লোকটা মিরায়ার আরো আছে এলে মিরায়া জোর গলায় জিজ্ঞেস করলো-
“কি চাই আপনার? এভাবে এই দিকে কেন আসছেন?”
ওই লোকের মুখে কোনো কথাই নেই। হঠাৎ লোকটা মিরায়ার একদম কাছে চলে এসে মিরায়ার বাইকের উপর হাত রাখলো। মিরায়া এবার একটু বেশি ভয় পাচ্ছে। মনে মনে আরো একবার নিজের তৈরি করলো নিজের আত্মরক্ষার জন্য।
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৪
-“এইযে ভাই, আপনার সমস্যা টা কি বলবেন? কি চাই? আমার পথ কেন আটকেছেন?”
লোকটা এখনো কোনো কথা বলল না। মিরায়াকে দেখে যাচ্ছে হেলমেটের ভিতরে থেকেই। এই দিকে মিরায়ার মন ভয়ে জড়োসড়ো অবস্থা।
