আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৯

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৯
অরাত্রিকা রহমান

রায়ান মাহির কে উদ্দেশ্য করে বলল-
“হ্যাঁ, সোরায়া। আমার শালির নাম। পেয়েছিস নাম্বার? কল কর তাড়াতাড়ি।”
মাহির স্তব্ধ হয়ে গেলো যেন তাকে এইমাত্র সাপে কেটেছে। রায়ান গাড়ির জানালার দিকে মুখ এগিয়ে চেঁচিয়ে মাহির কে ডাকলো-
“ওই… মাহির.. পেলি নাম্বার টা? কল কর না দ্রুত।”
মাহির হুশে ফিরল হঠাৎ। সে রায়ানের দিকে তাকিয়ে অসম্ভব শান্ত ভঙ্গিতে যে জিজ্ঞেস করল নিশ্চিত হতে-
“তোর শা..শালির নাম সো..সোরায়া..?!”
রায়ান বিরক্ত হয়ে বলল-

“সো..সো..সোরায়া না। আমার শালির নাম সোরায়া। বয়রা হয়ে গেলি নাকি। এক নাম কতবার বলতে হয়?”
মাহিরের বুক হঠাৎ খুব জোরে ধুকধুক করতে শুরু করলো, চারপাশে বাংলা সিরিয়ালের ধুমতানা নানা নানা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে মনে হচ্ছে। মনের মাঝে নাম নিয়ে দ্বন্দ্বে মেতেছে সে- “এই সোরায়া কি সেই সোরায়া? আমার সোরায়া? ধুর কি বলছি আমার কবে হলো! আর বললেই কি হয়েছে, হয়নি তো কি হবে ভবিষ্যতে। কিন্তু এই সোরায়া সেই সোরায়া কিনা কিভাবে বুঝবো?”
মাহির মনকে মানাতে না পেরে রায়ান কে অবশেষে জিজ্ঞেস করেই বসলো-
“দোস্ত.. তোর এই সোরায়ার পুরো নাম কি রে?”
রায়ান মিরায়াকে নিয়ে এমনিতেই চিন্তায় আছে এখন। এর উপর মাহিরের এমন উদ্ভট প্রশ্নে সে বেজায় বিরক্ত-
“যেখানে আমার বউয়ের পুরো নামই জানি না, সেখানে শালির নাম জানা বিলাসীতা। বউকেই পাখি, জান, বেইবি এসব ডাকি, নামও মুখস্থ নেই ওর। আর আমার প্রয়োজন ও নেই আমার ওকে আদর করে ডাকতেই ভালো লাগে। তুই কি কলটা করবি এবার?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাহিরের কানে যেন কিছুই ঢুকছে না এখন সোরায়ার বিষয়ক কথা ছাড়া। সে পাল্টা প্রশ্ন করলো-
“আচ্ছা নাম না জানিস, কিসে বা কোথায় পড়ে তা তো জানিস!!”
রায়ানের এবার মাহিরের প্রশ্ন গুলোতে খটকা লাগলো। ভ্রু কুঁচকে নিয়ে মাহির কে জিজ্ঞেস করলো-
“তুই আমার শালির বায়োডাটা জানতে চাইছিস কেন রে? মতলব কি?”
মাহিরের মন অশান্ত হয়ে উঠেছে সোরায়ার পরিচয় মিলানোর জন্য রায়ানের শালির সাথে। সে রায়ানের জন্য বিষয় টা আর না ঘেঁটে ছোট ছোট প্রশ্ন করলো-
“আচ্ছা, বাদ দে এটা বল- ও কি কলেজে ফাস্ট ইয়ার স্টুডেন্ট?”
রায়ান চোখ তীক্ষ্ণ রেখেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-“হ্যাঁ।”

মাহিরের উৎসাহ বের গেল। পরবর্তী প্রশ্ন ছুড়ে দিল-“বয়স কি ১৬-১৭ বছরের কাছাকাছি ?”
রায়ান এবারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল- “হ্যাঁ। কলেজ ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট দের বয়স এমনি হয় গাধা।”
মাহিরের ও মোতি ফিরলো-“ওহ তাই তো!” কিন্তু সাথে সাথেই পরের প্রশ্ন করলো-
“ওর পুরো নাম কি বাই চান্স জান্নাতুল রহমান সোরায়া?”
রায়ানের সত্যিই মিরায়া বা সোরায়ার আসল নাম সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। প্রয়োজন পরেনি কখনো জানার তাই স্বাভাবিক ভাবে আবারো মাথা নাড়িয়ে বলল- “আমি জানি না। তবে রহমান বাড়ির মেয়ে যেহেতু নামে রহমান থাকতে পারে, কেন?”
মাহির হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গাড়ির স্টেয়ারিং এ জোরে আঘাত করে রায়ানের উপর চেঁচিয়ে বলল-
“জানিস টা কি তুই হ্যাঁ? ভাই হয়ে বোনের নোট অনলি বোন, বোনের সাথে শালিও তার নাম জানিস না। এটা কোনো কথা হলো।”

রায়ানের মন এমনি আনচান করছে নিজের হৃদপাখির জন্য আর এইদিকে মাহিরের আচরণে তার কপালে কুটিল ভাবনার এক ভাজ পড়লো। রায়ান সন্দেহ ভরা কন্ঠে মাহির কে জিজ্ঞাসা করলো-
“একটু আগেই কে যেন বলছিল, আমার শালির প্রতি তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। এখন কি হলো তার? এতো মড়িয়া কেন?”
মাহির রায়ানের কথায় আগে নিজের বলা সব কথার অনুশোচনা করে সোজাসুজি বলল-
“তখন ছিলো না, এখন আমার আছে ইন্টারেস্ট। তাই মড়িয়া হচ্ছি।”
রায়ান মাহিরের স্পষ্ট কথার পাত্তা না দিয়ে সোজা তাকিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে মাহির কে বলল-
“চড়ুই এর নাম্বার নিবি না। কল করার প্রয়োজন নেই। চলেই এসেছি আরো ১০ মিনিটের মতো লাগবে।”
রায়ান কথাটা বলে, মাহিরের দিকে তাকাতেই দেখলো মাহির ফোনে নাম্বার উঠাচ্ছে। রায়ান জোরে চেঁচিয়ে মাহির কে বলল-

“ওই,.. কি করিস? বললাম না রাখ। দিতে হবে না কল। মাহির সাবধান করছি আমার বোনের থেকে দূরে থাক। নাম্বার নিবি না একদম।”
কে শোনে কার কথা। মাহির রায়ানের কথার বিন্দু মাত্র তোয়াক্কা না করে সোরায়ার নাম্বারটা নিজের ফোনে উড়িয়েই সাথে সাথে ডায়েল করে কানে ধরলো আর একই সাথে রায়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে ইশারা করে বলল-
“It’s too late, hopefully my future brother in law.”
রায়ান মাহিরের এমন উদ্ভট ডাকে আরো খেপে গিয়ে বলল-
“Brother in low my foot. তুই আমার বন্ধু হয়ে আছিস এটাই সহ্য করতে হয় আমাকে। বোন জামাই কে করবে তোকে!”
সোরায়ার ফোন রিং হচ্ছে এখন। রায়ানের কথায় মাহির উল্টো জবাব দিলো-

“আচ্ছা, ঠিক আছে তোকে বোন জামাই করতে হবে না। আমিই হয়ে যাবো। তোকে নিজের সম্বন্ধী বানাতে। Done deal.”
এই সময়েই হঠাৎ সোরায়া কলটা রিসিভ করে বলল-
“হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম। কে বলছেন?”
রায়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহির রায়ান কে ইশারায় থামিয়ে দিল। দুইজনেই গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিলো।
সোরায়া দ্বিতীয় বার কথা বলল-
“হ্যালো, হ্যালো! কে বলছেন? কাকে চাই?+
মাহিরের বুকের ভেতর একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া বয়ে গেল তবে তা স্বস্তির ছিল না অস্বস্তির বোঝা দায়। অপর পাশের গলার স্বর মাহির কাছে অস্বাভাবিক ভাবে চেনা মনে হলো। সোরায়া তৃতীয় বার কথা বলল এবার গলার স্বর মোটেও কমল ও ভদ্রতায় মোড়ানো ছিল না-
“এই যে কে কল করেছেন? তখন থেকে হ্যালো হ্যালো করছি কানে যাচ্ছে না? কত ব্যস্ত আছি! কোথা থেকে সময় নষ্ট করতে আসেন হ্যাঁ?”

মাহির থতমত খেয়ে রায়ানের দিকে তাকাতেই রায়ান ইশারা করে বলল-
“কথা বলিস না কেন গাধা? কথা বল।”
মাহির রায়ানের ইশারা দেখেই আমতা করে বলল-
“হ্যাঁ, হ্যালো., হ্যালো। সোরায়া বলছেন?”
সোরায়া মাহিরের আওয়াজ আন্দাজ করতে পারেনি এক মাস পড়ে। সে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো –
“জ্বি হ্যাঁ, আমি সোরায়া বলছি। কি চাই?”
মাহির এখন কি বলবে তা তো জানে না। রায়ান তো একবারও বলেনি কি নিয়ে কথা বলতে হবে। তবে এটা তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ ছিল সোরায়ার পরিচিতি জানার। মাহির একটু চালাকির সাথেই জিজ্ঞেস করলো-
“সোরায়া বলতে জান্নাতুল রহমান সোরায়া বলছেন? আইডিয়াল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট, মানবিক থেকে?”
মাহির ইচ্ছে করে সোরায়ার রিলেটেড সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করলো যেন সে ক্লিয়ার হয়ে পারে নিজের ভাবনা সম্পর্কে। এইদিকে তার মন এক নাগাড়ে আওড়াচ্ছে-“Say yes, say yes. Please please please.”
সোরায়া সত্যি ভাবলো হয়তো কলেজ থেকে কল এসেছে যেহেতু সে কলেজে যায় নি গত একমাস। সোরায়া একটু ভয় নিয়েই বলল-

“জ্বি, আমি জান্নাতুল রহমান সোরায়া বলছি। আইডিয়াল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট, মানবিক থেকে। আপনি কে বলছেন? কলেজের কেউ?”
সোরায়ার মুখে এই ছোটো স্বীকারোক্তি শুনে মাহির সাথে সাথে গাড়ি ব্রেক করলো। রায়ান মাহির কে গাড়ি থামাতে দেখে নিজেও গাড়ি থামিয়ে দিলো। তার মাথায় এখন মিরায়ার চিন্তা ছাড়া কিছুই নেই। আর এই দিকে একমাস পর কাঙ্খিত ষোড়শীর খোঁজ পেয়ে মাহিরের আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মাহির নিজের চোখ জোড়া আবেশে বন্ধ করে নিয়ে গা ছেঁড়ে দিল গাড়ির সিটে আর ফোনটা অজান্তেই কান থেকে নেমে এলো বুকের বাঁ দিকে। চির মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠেছে-“ohh yes, yes, yes..পেয়ে গেছি।”

অপর পাশ থেকে সোরায়া বারবার ডেকে যাচ্ছে। রায়ান মাহিকে এভাবে দেখে অবাক হয়ে গেল-
“এর আবার কি হলো? আল্লাহ আসলেই আমার জীবনে খুঁজে খুঁজে এক একটা মাস্টার পিস দিয়েছে। উফ্!”
রায়ান নিজের গাড়ি থেকে নেমে মাহিরের কাছে যেতে যেতে বিড়বিড় করলো- “কয়দিন আগে আমি হসপিটালে শুয়ে ছিলাম এখন ওরও শখ জেগেছে। রায়ান মাহিরের কাছে গিয়ে ওর মাথায় টোকা দেয়। মাহির ও সাথে সাথে চমকে উঠে । রায়ান মাহির কে ফোন কানে নিতে বলল আর মাহির ও তাড়াতাড়ি কানে ফোন নিয়ে বলল-
“হ্যাঁ হ্যাঁ, হ্যালো। সোরায়া? তুমি কি ব্যস্ত?”
রায়ান মাহিরের মুখে তুমি সম্বোধন শুনে ভ্রু কুঁচকে নিলো-
“সোরায়া? আবার তুমি? শালা লুচ্চা।”
মাহিরের সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই। সোরায়াকে যে তুমি ডাকাতে অবাক হয়নি তা নয়। সে ভাবছিল হয়তো কলেজের কেউই হবে। সোরায়া প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর দিলো-
“জ্বি একটু ব্যস্ত।”
এই পর্যায়ে রায়ান মাহিরের ফোন নিয়ে ফোনটা স্পিকারে দেয়। সোরায়া অপর দিক থেকে নিজের ব্যস্ততার ব্যাখ্যা দিল-

“আসলে বাড়িতে অনুষ্ঠান চলছে তো। তাই সব মিলিয়ে ব্যস্ত আছি একটু।”
রায়ান অবাক হলো বাড়িতে যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে তাহলে এখন তাদের গিয়ে সিন ক্রিয়েট করাটা লোক হাসানো হবে। তাই রায়ান মাহির কে ইশারায় বলল-“জিজ্ঞেস কর কিসের অনুষ্ঠান।”
মাহির রায়ানের কথা মতো জিজ্ঞেস করলো-
“ওহ আচ্ছা, পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান বুঝি? ফ্রি হবে কখন?”
রায়ান নিজের চোখ ছোট করে নিলো-“জিজ্ঞেস করতে বলেছি কিসের অনুষ্ঠান জিজ্ঞেস করছে ফ্রি কখন হবে। কার হাতে দায়িত্ব দিয়ে কল করতে বলেছি আমি। আল্লাহ!”
মাহিরের কথায় সোরায়া বাড়ির বর্তমান পরিস্থিতিই বর্ণণা করলো-
“ফ্রি কখন হব তা তো বলতে পারছি না। আসলে খুব শীঘ্রই আমার আপুর বিয়ে। আজ এ্যানগেজমেন্ট। একটু পরই আংটি বদল হবে। তাই ব্যস্ত। আপনি কে বললেন না যে!”

সোরায়ার কাছ থেকে মিরায়ার এ্যানগেজমেন্টের কথা শুনে রায়ানের মাথা তৎক্ষণাৎ বাজ পরলো। আকাশ যেন জমিতে আছড়ে পড়েছে সাথে সাথে। মাহির আচমকাই ফোন কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো –
“কিহ? কার এ্যানগেজমেন্ট?”
সোরায়া আবারো একই উত্তর দিল -“আমার বড় বোনের।”
মাহির আরো কিছু সোরায়াকে বলার বা জিজ্ঞেস করার আগেই রায়ান মাহির কে উদ্দেশ্য করে বলল-
“মাহির ফোন কাট। গাড়ি স্টার্ট দে।”

মাহির রায়ানের দিকে তাকালো চোখের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত স্পষ্ট। জ্বলন্ত লাভা বেরিয়ে আসবে এমন ভাবে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। সোরায়া রায়ানের গলা চিনলো না কিন্তু মাহির নামটা স্পষ্ট কানে বাজলো তার। রায়ান সাথে সাথে নিজের গাড়িতে ফিরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।
এই দিকে সোরায়া আশ্চর্য হয়ে প্রশ্নাত্মক গলায় বলল-
“মা.. মাহির., মাহির স্যার?”
মাহির সোরায়ার ডাকে সারা দিয়ে পারলো না। তার আগেই ফোনটা কেঁটে গেলো সাথে মাহিরের ফোনটা ও বন্ধ হয়ে গেল‌। রাতে চার্জ দেওয়া হয়নি ফোন আর সকালেও সুযোগ হয়নি। তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে বলে সাথে পাওয়ার ব্যাংক ও আনে নি। মাহির অকেজো ফোনটা পাশের সিটে ছুঁড়ে ফেলল-
“শিট। এখনি বন্ধ হতে হলো ফোনটা।”
মাহির খেয়াল করল রায়ানের গাড়ি নেই। আগেই সামনে চলে গেছে। মাহির ও দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রায়ানের গাড়ি ফোলো করতে লাগলো-

“ইসস্ আজকে অনেক বড় ঝামেলা হয়ে যাবে। সব ছেড়ে শেষ মেষ বিয়ে? আজকে রায়ানকে আমার দ্বারা সামলানো সম্ভব না। কি করবে কে জানে। আল্লাহ তুমি সহায় হও।”
রায়ান ডান বাম কোনো কিছু না দেখে স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে যেন একটা সেকেন্ডের মূল্য অনেক বেশি। রায়ানের চোখে মুখে কালো মেঘেরা জোরো হয়েছে। রায়ান মিরায়ার এ্যানগেজমেন্টের খবরটা শুনে আর কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। মিরায়াকে শেষ বার নিজের দুইবাহুর মাঝে আবিষ্কার করার দৃশ্যটা মনে করে বলল-
“হৃদপাখি তুমি বলেছিলে তুমি অপেক্ষা করবে। তুমি বলেছিলে তুমি বিবাহিত এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। তাহলে আমার পরিচয় পাওয়ার পরও কেন এমন কিছু হচ্ছে? Why?”
রায়ানের মুখে হঠাৎ এক বিকট বাঁকা হাসে দেখা গেলো যেন বিদ্রুপ করছে কোনো কিছুর-
“লাইক সিরিয়াসলি। বিবাহিত মেয়ের আবার বিয়ে দিচ্ছে। সাহসও কিভাবে হলো আমার বউয়ের বিয়ে ঠিক করার! হৃদপাখি, এখন যাই হচ্ছে এটা তোমার মত নিয়ে করা হক বা মতের বিরুদ্ধে। তুমি আমার আর আমারই থাকবে। নিজের ইচ্ছায় হলে ভালো নয় তো জোর করেই।”

রায়ান গাড়ির স্পিড যতটা সম্ভব বাড়ায়। প্রায় পৌঁছে গেছে আর দুই মিনিটের রাস্তা। মাহির ও রায়ানের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চালাচ্ছে এখন। মাহির রায়ানের মুখশ্রী দেখে ভালো আন্দাজ করতে পারছে খুব আনপ্রিডিক্টেবল কিছু হবে। মাহির রায়ানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো-
“রায়ান এবার কি করবি?”
মাহিরের দিকে না তাকিয়ে রায়ান আরো একবার গাড়ির আয়নার দিকে তাকিয়ে কন্ঠে অন্যরকম এক দৃঢ়তায় জোরে বলল-

“খোদার কসম যদি সবার সামনে ঘর থেকে না উঠিয়ে না এনেছি ওকে- চির কুমার থাকবে রায়ান চৌধুরী। ও আমার প্রেম না, আমার ভালোবাসা, আমার জেদ, আমার অহংকার। দুনিয়ার জন্য বউ ছাড়ার মতো মহৎ মন আমার নেই। আমার বউ আমার হবে, প্রয়োজনে দুনিয়া ধ্বংস হক।
I can burn the world just to have my wife in my arms. And now…It’s show time.”
রায়ান গাড়ি চালিয়ে রহমান বাড়ির সামনে পৌঁছালে গাড়ি ব্রেক করার কোনো প্রয়োজন অনুভব না করে, ফুল, আলো দ্বারা সুসজ্জিত মূল দরজায় গাড়ি চালিয়ে দরজা ভেঙে গাড়ি বাড়ির আঙিনায় থামালো। মাহিরের গাড়িও রায়ানের ঠিক পিছনেই।
মেহমানরা সবাই বাড়ির বাইরেই ছিলেন। এখানে মেহমান বলতে এলাকার লোকজনেরা এবং আসিফ ও আসিফের সাথে ক্লাবের ছেলে পেলে ও বন্ধু বান্ধব ছিলো যারা মিরায়ার ও ভীষণ কাছের। হঠাৎ এমনভাবে বাড়ির দরজা ভেঙে একটা গাড়িকে ঢুকতে দেখে সকলেই ভয়ে কুঁকড়ে যান। বিকট আওয়াজে সবাই আঙিনায় তাকায়। সকলেই বিড়বিড় করছেন নিজেদের মাঝে-

“কি হলো এটা? এমনভাবে গাড়িটা ঢুকলো কেন এখানে?”
রায়ান গাড়ি থেকেই চারপাশটা লক্ষ্য করছে। শফিক রহমান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন শব্দের দরুন আসিফের কাছে-
“আসিফ বাবা, সবাই ঠিক আছে তো? হঠাৎ কি হলো? কিসের আওয়াজ?”
আসিফ রায়ানের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে বলল-
“সবাই ঠিক আছে চাচা। হঠাৎ এই গাড়িটা মেইন গেট ভেঙে ঢুকলো। অদ্ভুত কারবার, কা্য গাড়ি এটা?”
শফিক রহমান অবাক হয়ে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন-“দাঁড়াও আমি দেখছি।”
এবার রায়ানের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন-
“কার গাড়ি এটা? বেড়িয়ে আসুন। কি ধরনের অসভ্যতামি এগুলো? এটা একটা ভদ্রলোকের বাড়ি।”
শফিক রহমানের কথাগুলো কানে যেতেই রায়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তখনি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রায়ান আর রায়ানের দেখা দেখি মাহির ও গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো রায়ানের কাছে। রায়ান কে শফিক রহমান অনেক ছোটো বয়সে দেখেছেন তাই ঠিক রায়ানকে চিনতে পারেন নি। কিন্তু রায়ানের স্পষ্ট মনে আছে তার খালু কে। রায়ান ধীরে পায়ে শফিক রহমানের দিকে এগিয়ে গিয়ে এসে তার মুখ বরাবর সোজাসুজি দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল-

“অসভ্যতা? হাহ! তা খালু জান প্লাস চাচাশশুর মশাই, আমার বউকে আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় অন্য কারো সাথে তার বিয়ে ঠিক করার মহান কাজটা কি অসভ্যতার মধ্যে পড়ে না এর বাইরে? বিবাহিত মেয়ের স্বামী আছে জেনেও আবার বিয়ে দিচ্ছেন এটা লোকে শুনলে এই বাড়ি কি আদতেও ভদ্রলোকের বাড়ি থাকবে?”
শফিক রহমান অবাক হলেন। অচেনা একজন কিভাবে এসব বলবে! তিনি চোখ রাঙিয়ে রায়ান কে উল্টো প্রশ্ন করলেন-

“কে তুমি? কি সব আবোল তাবোল বলছো। বেরিয়ে যাও এখনি।”
রায়ান এবার একটু বাঁকা হাসলো। শফিক রহমান কে উদ্দেশ্য করেই বলল-
“Nice question. Who am I ?! I am you your beautiful daughter’s legal husband. খাস বাংলায়, আইনি ভাবে আপনার সুন্দরী মেয়ের একমাত্র স্বামী। আপাতত নিজের এতো টুকু পরিচয় বহন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। বাকি রইল বেরিয়ে যাওয়ার কথা- থাকতে আসি নি আমি। আপনাদের কাছে আমার আমানত আছে। আমাকে আমার বউ দিয়ে দিন সসম্মানে ভদ্রতা সহিত চলে যাচ্ছি।”
শফিক রহমানের বুঝতে আর বাকি রইল না সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা রায়ান। তিনি রায়ানের উপর এমনিতেই ক্ষুব্ধ তার উপর মিরায়াকে নিয়ে যাওয়ার কথায় তিনি আরো খেপে যান। হঠাৎ রায়ানের শার্টের কলার চেপে ধরে বললেন-

“কিসের আমানত? কিসের বউ? আমার মেয়ে কারো সাথে যাবে না। যার সাথে ওর বিয়ে হবে তার সাথেই যাবে।”
মাহির রায়ান কে ছাড়াতে এগোতে নিলে রায়ান হাত দেখিয়ে মাহির কে থামিয়ে দেয়। আশেপাশের সবাই অবাক চোখে বিস্ময়ে দেখে যাচ্ছে কি হচ্ছে তাদের সামনে। আসিফও কিছু বুঝতে পারছে না। বিবাহিত মেয়ের আবার বিয়ে এমন কথার মানে কি, সেটাই সে মাথায় নিতে পারছে না।
সম্পর্কে খালু আর শশুর সমতুল্য মানুষটির সাথে বেয়াদবি করতে চাইছিল না। তাই রায়ান কেবল শক্ত ও দৃঢ় হাতে শফিক রহমানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-
“মিরা আমার হালাল সম্পদ খালু। আমাকে আমার বউ দিয়ে দিন। শুধু শুধু জেদ ধরে থাকার ফলে ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

শফিক রহমানের দুই চোখে রায়ানের জন্য ঘৃণা স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ স্তম্ভিত রায়ানের মিরায়াকে তার স্ত্রী হিসেবে দাবি করতে দেখে। আসিফ এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। মিরায়াকে তার সামনে কেউ নিজের বউ বলে দাবি করবে এটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ও ছিল না। হঠকারিতায় আসিফ শফিক রহমান কে সরিয়ে দিয়ে রায়ানের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল-
“এই যে মিস্টার। আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। আজ আমার আর মিরার এ্যানগেজমেন্ট‌। আপনি ভুল করছেন‌। এখানে কোনো বিবাহিত মেয়ের বিয়ে ঠিক করা হয়নি।”

রায়ান হঠাৎ আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে একটু পিছিয়ে যায়। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে সামনে দেখে নিজেকে শান্ত করা এমনিতেই ভীষণ দুঃস্কর ছিল রায়ানের জন্য আর এখন আবার আসিফ গায়ে হাত দেওয়ায় ভুল পাও করে বসেছে। রায়ান আসিফকে পা থেকে মাথা অব্দি একবার দেখে শান্ত গলায় বলল-
“রায়ান চৌধুরীর ব্যক্তিগত সম্পদে অন্য কারো নজর দেওয়া সে একদম পছন্দ করে না। আমার বউয়ের সাথে বিয়ের স্বপ্ন দেখার আগে ভালো করে খবর নিয়ে দেখা উচিত ছিলো তোর, ইউ ফা**কিং বাস্টার্ড।”
রায়ান কথাটা বলেই আসিফ কে সজোরে একটা ঘুষি মারলো। আসিফ এবার আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব। রায়ান সাথে সাথেই আবার আসিফকে মারতে উদ্যত হলো-

“আমার বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার সাহস হলো কোত্থেকে তোর? How dare you! Mother fu**.”
আসিফ আগা গোঁড়া না বুঝলেও এভাবে মার খাওয়ার মানুষ নয়। আসিফ ও রায়ানকে পাল্টা আক্রমণ করলো। আসিফের পাল্টা আঘাতের চেষ্টা রায়ান দ্রুতই বুঝে ফেলল। সে একটু পাশ ঘুরে দাঁড়াল, আসিফের ঘুষিটা তার কাঁধের দিকে ঘেষলো,পুরো লাগল না। রায়ান হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল নিচু গলায়—
“ঝামেলা করার ইচ্ছা ছিল না আমার। কিন্তু তোকে দেখে মন ইচ্ছার দরকার বুঝছে না।”
আসিফ দাঁত কামড়ে আবার এগিয়ে এল। এইবার সে রায়ানের কলারের দিকে হাত বাড়ালো, কিন্তু রায়ান হাত সরিয়ে তাকে ঠেলে পিছনে সরিয়ে দিল। ঠেলা খেয়ে আসিফ দু’পা পেছনে গেলেও আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ান তার হাত ধরে ঘুরিয়ে মোচড় দিল—ততটা জোরে নয়, কিন্তু যথেষ্ট যাতে ব্যথা লাগে। আসিফ এবার মেঝেতে পড়ে কাশতে লাগল।

ক্লাবের কিছু ছেলে পেলেও এবার একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো রায়ানের উপর। এক একজন একেক দিক থেকে রায়ানের দিকে আঘাত করতে আসল। রায়ান তাড়াহুড়ো করেনি। প্রথমজন সামনে এসে হাত তুলতেই সে পাশ ঘুরে তার কব্জি ধরে থামিয়ে দিল। আরেকজন পিছন থেকে লাথি মারতে চাইলে রায়ান ঝুঁকে পড়ায় লাথিটা বাতাসে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা সুরে বলল—

“So called gang members.”
এ কথাটা শুনেই হয়তো একটু অপমানিত বোধ করে তারা আবার একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাহির পরিস্থিতি দেখে বুঝে গেলো ভালোভাবে চাইলেও এখন আর কিছুই ভালো মতো মিটবে না। ঠিক তখনই পেছন থেকে মাহির দৌড়ে এলো রায়ানের সাথে লড়তে।
একজন মাহিরকে ধমকি দিয়ে বলল—
“এটা কোথা থেকে এলো, আমাদের ব্যাপার?”
মাহির তাকিয়ে রইল দু’সেকেন্ড, তারপর বলল—
“রায়ান আমার বন্ধু। তার ব্যাপার, আমার ব্যাপার- মানে আমাদের ব্যাপার।”
রায়ান কে ইশারায় করতেই রায়ান মাহিরের কথায় ঠোঁট কামড়ে হাসলো। এরপর সে সামনে থাকা লোকটার কলার ধরে পিছনে টেনে ফেলে দিল মেঝেতে। রায়ান একই সময়ে আরেকজনের হাত সরিয়ে তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল।

দু’জন মিলে খুব বেশি মারামারি করল না—শুধু নিজেদের বাঁচাতে, আর সামনে যারা ছিল তাদের থামাতে। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা এতটাই পরিষ্কার যে আসিফের দল বারবার উঠে দাঁড়ালেও সামলে উঠতে পারল না।
দু’মিনিটের মধ্যে বাড়ির আঙিনা বিশৃঙ্খল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে এখানে। চেয়ার সরছে, পানির গ্লাস পড়ে ভেঙে যাচ্ছে, কয়েকজন অতিথি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাচ্ছে।
শেষে দেখা গেল, আসিফ মেঝেতে বসে হেলান দিয়ে আছে, নাকে রক্ত, নিঃশ্বাস ভারী। তার দু’জন বন্ধু পাশে বসে কুঁকড়ে আছে ব্যথায়। মাহির একটু দূরে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছে।
রায়ান সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে ঘৃণা আর রাগ। ক্লান্তির রেশ মাত্র নেই যেন কিছুই করেনি।
রায়ান আহত আসিফের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। চোখের চাহনিতে বিন্দুমাত্র মায়া দয়া কিছু নেই। প্রাণ ভেঙে পড়ে থাকা একটা কাঁচের গ্লাসের টুকরো হাতে উঠিয়ে নিল। মাহির এটা খেয়াল করতেই তার গলা শুকিয়ে এলো।

মাহির ধীরে বলল—”রায়ান অনেক হয়েছে আর কি?”
রায়ান তীক্ষ্ণ চোখে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল-
“আমার বউয়ের দিকে নজর দেওয়ার শাস্তি যদি ওই নোংরা চোখগুলো কে না দিই তাহলে আন-ফেয়ার হয়ে যাবে। His eyes has committed suicide just now. Watch them getting damaged.”
শফিক রহমান রায়ানের পাগলামি দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। আসিফের কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না। উনি সত্যি টা আসিফ কে বলেননি এতে আসিফের দোষ নেই। রায়ান আসিফের দিকে আগাতেই শফিক রহমান রায়ানের পথ আটকে দাঁড়ালেন। রায়ান বড় বড় চোখ করে শফিক রহমানের দিকে তাকাতেই বলল-
“সরে যান খালু। এখন আমি বয়সের সম্মান করার মুডে নেই।”
শফিক রহমান রায়ানের গালে সজোরে থাপ্পর মেরে বললেন-

“বেয়াদব, কুলাঙ্গার। আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েকে কখনো তোর মতো ছেলের হাতে তুলে দেব না। তোর জন্য আমার মেয়েটা আজ একমাস যাবত অসুস্থ, অসুখি, বিধ্বস্ত যেন জীবন্ত লাস হয়ে পড়ে আছে ঘরে। তোকে না আমার মেয়ে কখনো ক্ষমা করবে না আমি। যা করার করে নে।”
রায়ান নিজের গালে হাত দিয়ে রেখেছে। মিরায়ার অসুস্থতার কথা শুনে রায়ানে হাত থেকে কাঁচের টুকরো টা সাথে সাথে পড়ে গেল নিচে। চারদিক নিস্তব্ধ, পেছনে শুধু গোঙানি, এলোমেলো চেয়ার, আর একটা নীরব, থমথমে পরিবেশ।
মাহির ও শফিক রহমানের কথা থ মেরে গেলো। রায়ানের মুখে অস্পষ্ট বেরিয়ে এলো-
“মি..মিরা..মিরা কোথায়?”
শফিক রহমান রায়ান কে ধিক্কার দিয়ে বললেন-

“আমি আমার মেয়ে কে তোর হাতে কখনো তুলে দেব না। তোর জন্য আমার মেয়ের আজ এই অবস্থা। মিরার সাথে দেখা করার সুযোগ টুকু ও পাবি না তুই। আমি থাকতে তা হতে দেব না।”
রায়ান তাৎক্ষণিক কিছু একটা ভেবে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগোতে এগোতে মাহির কে বলল-
“মাহির, বাড়ির ভিতরে তাড়াতাড়ি এসে সদর দরজা লাগিয়ে দে। আমি হৃদপাখির কাছে যাচ্ছি।”
রায়ান কোনো কিছু না ভেবেই দৌড়ে বাড়ির ভিতরে গেল। উপস্থিত পরিবেশ বুঝতে পেরে মাহির ও তাই করলো। শফিক রহমান ঘটনার দ্রুততার মাঝে বুঝে উঠে বাড়ির ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই মাহির বাড়ির সদর দরজা লাগিয়ে দিলো তার মুখের উপর। শফিক রহমান দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিৎকার করলেন-
“দরজা খোল। আমি বলছি দরজা খোল হারামজাদা। এটা আমার বাড়ি। বেরো আমার বাড়ি থেকে। আমি পুলিশে খবর দেব নয়তো।”

মাহিরের হাত দরজার লকে রীতিমতো কাপছিল। মাহির ধীর স্বরে শফিক রহমানের উদ্দেশ্যে বলল-
“সরি খালু, না মানে শশুর মশাই। না থাক খালুই ঠিক আছে এখন। বন্ধুর জন্য যে বেয়াদবি করছি খোদা জানে আমার হাতে জীবনে মেয়ে দেবেন কিনা উনি।”
মাহিরের মুখ থেকে অচিরেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো রায়ান থুম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহির রায়ানের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল-
“কি রে ভাবির কাছে যাস না কেন?”

হঠাৎ সামনে চোখ যেতেই মাহির দেখলো রোকেয়া বেগম বুকে আড়াআড়ি ভাবে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই রায়ান দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু দুইজনেই মাঝে কোনো প্রকার বাক বিনিময় হচ্ছে না। রোকেয়া বেগমের চোখে পানি আর রাগ একসাথে ধরা দিচ্ছে রায়ানের কাছে। ছোট থেকেই নিজের খালামণি তার খুব প্রিয় এখন কিভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে বুঝতে পারছে না। রায়ান না পারতে চাচির কাছে আর্জি জানালো-
“খালামণি… প্লিজ। আমাকে আমার বউটার কাছে যেতে দাও।”
রোকেয়া বেগম কান্না মিশ্রিত গলায় বললেন-
“বেশি দেরি হয়ে গেলো না বউকে নিয়ে আসতে?!”
রায়ানের কিছু বলার নেই এ্যাক্সিডেন্টে ঘটনা বলবে সেটা তার ইচ্ছে করলো না। রায়ান সোজা নিজের দুই হাত এক করে আবারো রোকেয়া বেগম কে বলল-
“খালামণি আমাকে আমার বউ দিয়ে দাও না। ভিক্ষা চাইছি আমি। হ্যাঁ আমি রায়ান চৌধুরী ভিক্ষা চাইছি নিজের বউকে। খালামণি প্লিজ মিরাকে দিয়ে দাও।”

রোকেয়া বেগম রায়ানের কন্ঠের সরলতা ও গভীরতা দুই ই বুঝলেন। একটু আগেই রামিল না চৌধুরী তাকে কল করে সব খুলে বলেছেন এই এক মাসে কি কি হয়েছে। এমনকি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ততা ও প্রকাশ করেছেন তিনি। নিয়তি কে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না এই মুহূর্তে। রায়ানের জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে মিরায়াকে নিতে আসাতে রোকেয়া বেগম সন্তুষ্ট। বাইরে শফিক রহমান রান্না ঘরের জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন রোকেয়া বেগম কে-
“রোকেয়া ওরা যেন মিরার সাথে দেখা করতে না পারে। আমার মেয়ে এই ছেলের সাথে যাবে না।”
রোকেয়া বেগম এবং যে রায়ান মাহির তিনজনই শফিক রহমানের দিকে তাকায়। রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-

“খালামণি.. মিরা কোথায়? আমি ওকে দেখতে চাই।”
শফিক রহমান আরো জোরে বললেন-
“রোকেয়া তুমি ওকে মিরার সাথে দেখা করতে দেবে না। আমি বলছি।”
রোকেয়া বেগম শফিক রহমানের উপর রেগে ছিলেন মিরায়ার অনুমতি না নিয়ে একটা বিবাহিতা মেয়ের স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায় বিয়ে ঠিক করা নিয়ে। কঠোর চেতনাবাদী নারী চরিত্রের অনন্য রুপ দেখা গেল হঠাৎ। রোকেয়া বেগম শফিক রহমানের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ি দিকে আঙুল দেখিয়ে রায়ানের উদ্দেশ্যে বললেন –
“মিরা উপরে আছে। ওরে ঘরে হাতের ডান দিকের ঘর। নিয়ে চলে যা ওকে।”
তার চোখের দিপ্তী ছিল জ্বলন্ত আগুনের মতো। শফিক রহমান হঠাৎ নির্জীব হয়ে গেলেন। এখন আর চেঁচাচ্ছেন ও না। রায়ানের চোখে কৃতজ্ঞতা স্পষ্ট। সে দৌড়ে গিয়ে রোকেয়া বেগম কে জড়িয়ে ধরে বলল-
“Thank you, thank you খালামণি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি মিরা আর কখনো এভাবে এই বাড়িতে আসবে না। আমি খুব যত্নে রাখবো ওকে। তোমাদের রাজকন্যা আমার রাণী হয়ে আমার সাম্রাজ্যে থাকবে। Thank you so much.”

রোকেয়া বেগম অশ্রু সিক্ত চোখে সন্তুষ্ট মনে মাথা নাড়ালেন। রায়ান সাথে সাথে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। মাহির একা দাঁড়িয়ে চারপাশে খুঁজছে তার ষোড়শীকে কিন্তু সোরায়া তো নেই এখানে। মাহির ও রায়ানের মতোই গিয়ে রোকেয়া বেগম কে জিজ্ঞেস করলো-
“আসসালামুয়ালাইকুম খালামণি। আমি মাহির, রায়ানের বন্ধু। আচ্ছা সোরায়া কোথায়?”
রোকেয়া বেগম ঠিক পাত্তা দিলেন না মাহিরের প্রশ্নে। উত্তর করার ধারাবাহিকতায় চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে ফেললেন –

“সোরা ও মিরার ঘরে। উপরে।”
মাহির উৎফুল্ল মনে রোকেয়া বেগম কে-“thank you.” দিয়ে উপরে দৌড় দিতেই রোকেয়া বেগম হঠাৎ বিস্ময়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
“হ্যাঁ কি? সোরা…সোরায়া কেন?”
তবে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ থাকলে তো রায়ান মাহির দুই জনই উপরে দোতালায় চলে গেছে।

মিরায়া নিজের বিছানায় বসে ছিল চুপ চাপ আর সোরায়া এতোক্ষণ নিজে রেডি হচ্ছিল। অনুষ্ঠানের আয়োজন বাড়ির সামনের দিকে হয়েছিল আর মিরায়ার ঘর বাড়ির পিছন দিকে তাই এতো ঝামেলার কোনো আওয়াজই তাদের ঘরে পৌঁছায় নি। রায়ান হঠাৎ দরজা ঠাস করে খুলে মিরায়ার ঘরে ঢুকলো-
“হৃদপাখি..!”
সোরায়া চমকে দরজার দিকে তাকালো। রায়ান কে আঁতকা চোখের সামনে দেখে সোরায়ার মুখ কিছু সময়ের জন্য খোলা রইল। নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না কাকে দেখছে সামনে। মিরায়া বড্ড অলসতায় চোখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রায়ানকে এক নজর দেখলো। রায়ানের চোখ মিরায়ার উপরেই আবদ্ধ ঘরে সোরায়া আছে সেটা সে এখনো খেয়াল করেনি। রায়ান মিরায়ার দিকে ধীর পায়ে এগোচ্ছে মিরায়া এখন রায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে হয়তো কিছু যাচাই করছে। রায়ান মিরায়াকে দেখে খুশি হতে চেয়ে ও পারলো না। মেয়েটার শরীর এতোটা শীর্ণ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে যেন এক বেলাও ঠিক মতো খায়নি, ফার্স রং যেন আরো সাদা হয়ে গেছে রক্তের কমতিতে, চোখ গুলো কেমন টালমাটাল- ঘুম ঘুম। রায়ান নিজের মনকে ভিতর ভিতর শক্ত করছিল মিরায়ার মুখ মুখি হওয়ার জন্য। এই দিকে মিরায়ার কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই, সে শুধু রায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে।

এই দিকে সোরায়া রায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখ থেকেও কি বের হচ্ছে না। ঠিক সেই সময়েই মাহির ঘরে প্রবেশ করলো-“সোরায়া…!”
সোরায়া মাহিরের ডাকে আনমনে সাড়া দিল-“জ্বি..! ( সাড়া দিয়ে মাহিরের দিকে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চেচালো)- “আআআআ…!”
মাহির সোরায়ার কে এতো দিন পড় দেখেই সাথে সাথে দৌড়ে সোরায়ার কাছে গেল। সোরায়া বিস্মিত হয়ে দুইপা পিছনে সরে গেল। মাহির তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সোরায়া পরপর রায়ান ও মাহির এর দিকে তাকিয়ে কয়েকবার নিজের চোখ কচলে নিল-

“নাহ, আমি তো ভুল দেখছি না। রায়ান ভাইয়া আর মাহির স্যার একসাথে?! কিভাবে সম্ভব?”
মাহির সোরায়ার দুই বহু আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। সোরায়া ভয়ে নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো সাথে সাথে। মাহির সোরায়া কে অদ্ভুত নেশাত্বক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“এই মেয়ে একমাস দূরে থেকে আমাকে জ্বালিয়ে আশ মেটেনি? এখনো দূরে কেন যাচ্ছো?”
সোরায়ার মুখে কোনো শব্দ নেই। মিটি মিটি চোখ খুলে মাহির কে দেখছে আর মনে হাজারটা প্রশ্নের সূচনা হচ্ছে তার। তবে আমতা আমতা করেই জিজ্ঞেস করলো-
“আ..আমি আবার কি করে জ্বালিয়েছি আপনাকে? দূরেই তো ছিলাম।”
মাহিরের মনে অন্যরকমের খুশি ধরা দিতেই মাহির সোরায়ার কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের আরো কাছে নিয়ে এসে বলল-

“কেন ছিলে দূরে? কেন?”
সোরায়ার গলা শুকিয়ে এলো। হঠাৎ মিরায়ার হাসির আওয়াজ এলো। সাথে সাথেই সোরায়া মিরায়ার দিকে তাকালো সঙ্গে মাহিরও।
রায়ান মিরায়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে। মিরায়া সেই মুহূর্তে হঠাৎ হাসতে শুরু করতেই রায়ান অবাক হয়ে মিরায়ার দিকে তাকায়। মিরায়া হাসতে হাসতে সোরায়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“এই বনু দেখ, আমি মনে হয় পাগল হয়ে গেছি রে। আমার সামনে রায়ান চৌধুরী বসে আছে। তুই কি দেখতে পাচ্ছিস? (আরো জোরে হাসতে হাসতে) সবার আড়ালে আমার সামনে আসতেন আবার চলে যেতেন সেটা কি যথেষ্ট ছিল না? হ্যাঁ? এখন আমার ছোট বোনটার সামনে আমাকে পাগল প্রমাণিত করতে এসেছেন?” কথা গুলো মিরায়া রায়ানের উদ্দেশ্যে বলল।

মিরায়ার এই অবস্থা দেখে রায়ানের চোখ কপালে উঠার উপক্রম। এটা কি হয়ে গেছে তার হৃদপাখির সে বুঝতে পারছে না। সোরায়ার শরীর থম মেরে গেল তৎক্ষণাৎ। মাহির সোরায়ার কোমরের বাঁধন ছেড়ে দিল। মিরায়া সোরায়াকে জিজ্ঞেস করলো-
“ওই ওটা কে? এই ভাই আপনি কে? আমার বোনের সাথে জড়া জড়ি করছেন কেন? ছাড়ুন ওকে। হাত দেবেন না আমার বোনের গায়ে।”
মাহির সোরায়ার থেকে একটু সরে দাঁড়ালো। মিরায়া রায়ানের দিকে আবারো তাকালো আর একটু অবাক হয়েই বলল-

“আরে আপনি এখনো এখানে আছেন? আজ হওয়াতে মিলিয়ে যাচ্ছেন না কেন?”
রায়ান দ্রুত তার সাথে মিরায়ার হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলল-
“কি বলছো এগুলো হৃদপাখি। আমি কোথায় যাবো? তোমার বর তোমার আছে এসেছে, কখনো যাবে না আর।”
মিরায়ার চোখ আনন্দ চকচক করে উঠলো রায়ানের কথা শুনে কিন্তু পরো মুহূর্তেই তা উধাও হয়ে গেল। মিরায়া স্বাভাবিক গলায় বলল-
“উঁহু, আপনি নেই, আসেন নি আপনি। আমাকে এবার ধোঁকা দিতে পারবেন না আপনি। আপনাকে আর বিশ্বাস করবো না আমি।”

রায়ান বুঝতে পারলো না মিরায়া কে সে কিভাবে বিশ্বাস করাবে যে সে সত্যিই এসেছে তাকে নিতে। রায়ান মিরায়ার হাত দুটো আরো জোরে আঁকড়ে ধরে বলল-
“কেন এমন বলছো পাখি। আমি তোমার সামনে তোমার হাত ধরে আছি। তোমার বর সত্যি এসেছে।”
মিরায়া এবার হঠাৎ আবেগ প্রবন হয়ে কাঁদতে শুরু করলো আর কাঁদতে কাঁদতেই বলল-
“না, আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনার কি মনে ড়য় আমি বোকা? আর কাঁদবো না আপনার জন্য। আর না। আমি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। চলে যান আপনি। আপনাকে আমি আমার কল্পনাতেও চাই না আর।”
মাহির সোরায়া অবাক চোখে দেখছে দুইজন কে। মিরায়ার কান্না দেখে এবার রায়ান ব্যস্ত হয়ে পরলো মিরায়াকে বোঝাতে –

“হৃদপাখি…! আমি এসেছি। দেখো.. তোমার বর এসেছে তোমাকে নিতে। খুব দেরি হয়ে গেছে তাই না? দেখ দেরি হলেও তোমার বর নিজর কথা রেখেছে।”
মিরায়া রায়ানের মুখ বরাবর হাত বাড়ায় রায়ান ও আবেশে মিরায়ার হাত মুক্ত করলো যেন মিরায়া তাকে স্পর্শ করে। তবে মিরায়া নিজের কম্পিত হাত জোড়া রায়ানের মুখাবয়বের দিকে এগিয়েও ফিরিয়ে নিলো হাতগুলো আর বলল-

“আপনি.. আপনি সত্যি নন। আপনি আমার কল্পনা। আপনি সত্যি নন। সত্যি নন..না না।”
রায়ান অধৈর্য হয়ে উঠলো, তার এখন কিছু ভালো লাগছে না। রায়ান অকুতি করে বলল-
“সত্যি, একদম সত্যি। ছুঁয়ে দেখ একবার।”
মিরায়া নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল-“আমি ছোবো না আপনাকে আপনি হারিয়ে যাবেন। ছোবো না আপনাকে আমি।”

রায়ান নিজেকে আর ধরে রাখার চেষ্টা করলো না। হাঁটুর উপর ভর করে উঠে দাঁড়িয়ে মিরায়ার ছোট্ট মুখটা নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে পাগলের মতো সম্পূর্ণ মুখে ছোট্ট ছোট্ট চুমু খেতে লাগলো। মাহির সোরায়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছে। সোরায়ার মুখ হা হয়ে আছে আর মাহিরের হাত মাথায়-
“আজকে আর কি কি দেখতে হবে আমার। হায় খোদা।”
কয়েক মিনিট এমন সতর্ক বার্তা ছাড়া চুমুর পর্ব শেষ হলে। রায়ান মিরায়া গভীর শ্বাস নিতে লাগলো। রায়ান মিরায়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে দ্রুত গরম নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে করতে বলল-
“দেখ হৃদপাখি আমি তোমাকে ছুঁয়ে দিয়েছি। তোমার বর কোথাও হারায় নি। তোমার কাছেই আছে।”
এতো কিছুর পরেও মিরায়া নিজের কল্পনা জগৎ অস্বীকার করতে নারাজ। মিরায়া দীর্ঘ উত্তপ্ত শ্বাস ফেলতে ফেলতেই বলল-

“না না এটা সত্যি নয়। আপনি ছলনা করছেন আমার সাথে।”
রায়ান একবার মিরায়া কাঁপতে থাকা শুকনো গোলাপি ঠোঁট দেখে সাথে সাথে মিরায়ার ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে। ঘরে তারা বাদে অন্য কেউ আছে এই খেয়াল নেই বললেই চলে। মিরায়া বুঝে উঠতে পারলো না তার আগেই হঠাৎ তার শ্বাস প্রশ্বাস আঁটকে গেলো।
মাহির রায়ানের এই পদক্ষেপ ভিমড়ি খেলো- “আসতাগফিরুল্লা।”
সোরায়া এমন হঠাৎ রায়ানকে মিরায়ার ঠোঁটে চুমু খাওয়া দেখে চিৎকার করতে যাবে মাহির সাথে সাথে এক হাতে সোরায়া মুখ বন্ধ করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। মাহির দ্রুত তার সাথে সোরায়াকে জড়িয়ে ধরে ঘর থেকে টেনে বারান্দায় নিয়ে গেলো। যতোই হক সোরায়া বয়সে অনেক টা ছোট এসব সামনে থেকে দেখা তার উচিত হবে না বলে মনে হলো মাহিরের।

সোরায়া মুক্তি পেয়ে সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলো-“এটা কি হলো?”
মাহির সোজা উত্তর দিলো-“কি হবে বারান্দায় নিয়ে এলাম তোমাকে।”
সোরায়া আরো জোরে চেঁচিয়ে বলল-“বারান্দায় আনার কথা বলি নি।”
মাহির আশ্চর্য হয়ে-“তো? কিসের কথা বলছো?”
সোরায়া বিরক্তি নিয়ে বলল-“ঘরের ভেতরে কি হচ্ছে? ভাইয়া আপুকে এভাবে চুমু কেন খাচ্ছে?”
মাহির একটু থতমত খেলো, এমন প্রশ্নের উত্তরে কি বললে শোভা পাবে সে জানে না। তবুও যথাযথ উত্তর করলো-
“ওইভাবে চুমু খাবে না তো কিভাবে খাবে? বউ কে চুমু খাওয়ার অধিকার ওর আছে, তাই খাচ্ছে। আমার বউ ও নেই আর… আফসোস!”
সোরায়া বিস্মিত হয়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল- “বউ মানে? ভাইয়ার সাথে আপুর কবে বিয়ে হলো? কি যাতা বলছেন।”

মাহির স্বাভাবিক ভাবে বলল-“যা বলছি ঠিক বলছি। তোমার আপু আর আমার বন্ধু রায়ান দুইজন ম্যারেড। বাকি কাহিনী অন্য সময় শুনে নিও। আপাতত এতো টুকু জানো যে ওরা এখন যা করছে সেটা সম্পূর্ণ জায়েজ।”
সোরায়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো-“রায়ান ভাইয়া আপনার বন্ধু?”
মাহির সোরায়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবে তার তখনি বারান্দায় অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। সোরায়া নিজের কান একটু ঘরের দিকে এগিয়ে দিতেই বুঝলো গভীর চুম্বনের শব্দ এগুলো যেন মনে হচ্ছে কেউ কিছু একটা চেটে চুষে খাচ্ছে। সোরায়া লজ্জা মাথা নিচু করে ফেলল। মাহির ও বুঝতে পারছে সোরায়ার অস্বস্তি হচ্ছে, তার নিজের ও অস্থির লাগছে। মাহির সোরায়ার দুই কান নিজের হাত দিয়ে আবৃত করে তাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। হঠাৎ এমন করাতে সোরায়া একটু ভয়ে শিউরে উঠলো।
মাহির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই মাহির বলল-
“ওই দিকে কান দিও না। ওদের কাজ ওদের করতে দেও। এভাবে থাকো চুপচাপ।”
সোরায়ার আর কিছু বলার মুখ রইল না। মাহিরের বুকের কাছেই দাঁড়িয়ে রইল সে। মাহির হৃৎস্পন্দন তার মনযোগ কেড়ে নিল অনায়েসেই মাহিরো সোরায়ার দিকে মন দিলো আর আজকের দিনটার জন্য সৃষ্টি কর্তার শুকরিয়া আদায় করলো বার বার।

কিন্তু মাহির সোরায়া কে বারান্দায় নিয়ে যাওয়ার পর ঘরের ভেতর অন্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে যার মূল অস্ত্র হয়তো দুজন মানুষের ঠোঁট। রায়ান যখন প্রথম মিরায়ার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরেছিল মিরায়া নিজের ঠোঁট বন্ধ করে নেয়। রায়ান নিজেকে কোনো মতো সামলাতে পারছিল না অবশেষে মিরায়া ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে তার চোয়াল চেপে জোরে করে ঠোঁট জোড়া সামান্য ফাঁক করে আবার মিরায়ার ঠোঁটে ঠোঁট দিলো। মিরায়া সম্পূর্ণ ব্ল্যাংক ছিল তার সাথে কি হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় মিরায়া রায়ানের চুল টেনে ধরে শব্দ করতে লাগল-“উউউমম…উমমমম..”
রায়ান হারিয়ে গেল মিরায়ার ঠোঁটের মাঝে। মিরায়া এখনো ঠিক খেয়াল করেনি কে তাকে চুমু খাচ্ছে তার ঘোর কেটেছে তবে রায়ানের মুখ চিত্রায়ন করতে ব্যর্থ। মিরায়া খুব ছটফট করায় রায়ান কয়েক সেকেন্ডের জন্য মিরায়ার ঠোঁট ছাড়লে মিরায়া নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার মতো চোখ খিচিয়ে বন্ধ করে নিয়ে শ্বাস নিতে নিতে বলল-

“থা.. থামুন.. থামুন..আমি শ্বাস নিতে পারছি না।”
রায়ানের নিঃশ্বাস ও ভারী হয়ে এসেছে, একপ্রকার অধৈর্য হয়ে না সূচক মাথা নেড়ে বলল-
“Take mine, baby..আমি থামতে পারবো না আজকে।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৮ (২)

রায়ান সাথে সাথে মিরায়ার ঠোঁটে মত্ত হলো আবার। এবার আবছা চেয়ে মিরায়া রায়ানের চোখ দেখলো যেখানে তার জন্য ছিলো নেশা, আসক্তি আর কামনার অন্যরকম এক আবদার যেটা তাকে বলছে-“আজকে না করো না।”
মিরায়া নিশ্চিত হলো তার ঠোঁটে এই মুহূর্তে যার রাজত্ব সে তার স্বামী। মিরায়ার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু কণা চোখের পলক ফেলার সাথে সাথে গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৫০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here