আত্মার অন্তরালে পর্ব ১২
প্রীতি আক্তার পিহু
এক মাসপর,,
ভোরের বাতাসে আজ একটু অন্যরকম শীতলতা। আকাশের রঙ এখনো পুরোপুরি ফুঁটেনি। ধীরে ধীরে কমলা আর গোলাপির মিশ্রণে রঙিন হয়ে উঠছে। বেলকনির রেলিঙে গা ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে অষ্টাদশী। সূর্যের মিষ্টি লাল আভায় অষ্টাদশীর সোনালী বর্ণের চোখ আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
হঠাৎ করেই পরিচিত এক কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে তার।
_ “আনায়া তাড়াতাড়ি খেয়ে রেডি হয়ে নে। এক্সামের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
সারাহ বেলকনির দরজায় দাঁড়ায়। হাতে এক গ্লাস দুধ। টেবিলে রেখে একটু কড়া গলায় বলল,
_ “আয়ান তোদের কলেজে দিয়ে তারপর অফিসে যাবে। আর তোর ওষুধ খেতে হবে ভুলিস না।”
আনায়া ধীর চোখে তাকায় খাবারের দিকে। নাক মুখ কুঁচকে আসে তার।গত এক মাস ধরে একই রুটিন, একই ওষুধ, একই খাবার সব কিছু যেন অসহ্য লাগছে তার কাছে।বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ব্যথাটা আরো বেশি তীব্র হয়।তাও নিজেকে সামলিয়ে আলমারি থেকে একটা জামা বের করে ওয়াশরুমে যায়।ধীর গতিতে নিজের পরনের বস্ত্র খুলে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।তার ঘাড়ের পেছনটা এসে পুরনো ব্যথাটা অ্যাক্সিডেন্টের পরে অনেক বেড়েছে।হঠাৎ তার চোখের সামনে এক মাস আগে কাল রাতে ভয়ংকর দৃশ্য ভেসে ওঠে।
আনায়ার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।ইউভান আর তানহার কথা মনে পড়তেই তার নিজের উপর ঘৃণা আসে।ইউভান তার মনকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। সে ওই পাষান লোকের কথা চিন্তা করতে চায়না। তাও কেন বারবার তার চোখের সামনে শুধু ওই পাষাণ লোকটার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে।আনায়া আর বেশি কিছু চিন্তা না করে শাওয়ার নিয়ে একেবারে প্রস্তুত হয়ে নিচে নামে। আজ তার ভার্সিটিতে এক্সাম আছে।সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ কান ভেসে আসে সায়মা বেগমের কান্নার আওয়াজ। আনায়ার চোখ যার ড্রয়িং রুমের দিকে। সায়মা আহসান চৌধুরীরর সামনে অশ্রুসজল কণ্ঠে বলে উঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “আপনি কেমন বাবা বলুন তো? এই এক মাসে একবারও ছেলের খোঁজ নিলেন না! কেমন আছে, কোথায় আছে কিছুই জানি না আমরা। আপনার কি একটুও দায়িত্ববোধ নেই?এই কথাগুলো বড় আপার সুস্থ থাকলে অবশ্যই আপনাকে বলতো।তার হয়ে কথাগুলো আমারই বলা লাগছে এখন।”
আহসান গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,
— “যে ছেলের পরিবারের উপর কোন দায়িত্ববোধ নেই তার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ মনে করি না আমি। সে যেখানে আছে ভালো আছে, সময় হলে ফিরে আসবে। আমরা তো তাকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলিনি।”
সায়মা বেগম আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে পুনরায় বলে,
“ইউভান যেটা বলেছে সেটা শুনলে তো এমন হতো না। আপনার উচিত ছিল ছেলেটার মতামত কে গুরুত্ব দেওয়ার।”
তৎক্ষণ আহসান চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“এ বাড়িতে আমার সিদ্ধান্ত শেষ সিদ্ধান্ত।ইউভান আমার সিদ্ধান্তের উপর নাকচ করেছে তাই সে বাড়িতে থাকুক বা না থাকুক সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় আমার নেই।”
সায়মা বেগম চোখের পানি মুছে রান্নাঘরে দিকে যায় আনায়ার মন খারাপ হয়ে যায় মামনির কান্না দেখে। ইউভানের সাথে বড় বাবার এক মাস আগে কথা কাটাকাটি হয়েছে। যার কারণে ১ মাস ধরে ইউভানের কোনো খোঁজ নেই না ফোন, না কোনো বার্তা। এমনকি আনায়ার জ্ঞান ফেরার পর থেকে ইউভানকে সে কোথাও দেখেনি।এতে আনায়ার কী? সে ইউভানের থাকা বা না থাকাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
আনায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহসান চৌধুরী এগিয়ে এসে আনায়ার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“পরীক্ষা দিতে কোনো অসুবিধা হবে না তো, মামনি?”
আনায়া মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
“না বড় পাপা ঠিক আছি।”
আহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“বাইরে তোমার ভাই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে যাও। আর হ্যাঁ শরীর খারাপ লাগলে অবশ্যই আমাদের জানাবে।”
আনায়া মাথা নেড়ে সায় দেয় তারপর বেরিয়ে যায়। গাড়িতে বসে আছে আয়ান পাশে রুহি জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে। আয়ান বারবার রুহির দিকে আড় চোখে তাকায়।এরই মধ্যে আনায়া এসে গাড়িতে বসে। আয়ান গাড়ি স্টার্ট দেয় তখন।আয়ান এবার আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
“শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারবি তো আনায়া?
আনায়া নিশ্চিন্তে উত্তর দেয়,
“চিন্তা করা লাগবে না ভাইয়া পারবো আমি। ”
আয়ান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বাড়ির পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সেদিন হসপিটালে কিছুক্ষণের জন্য সবার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।আনায়ার অপারেশন সাকসেসফুল হয়।পরিবারের সবাই আনায়ার এক্সিডেন্টের কথা শুনে ওই রাত্রে ছুটে এসেছিল হসপিটালে। কিন্তু আনায়ার অপারেশনের ২দিন পর আহসান চৌধুরী সাথে ইউভানের কিছু একটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। যার পর থেকে ইউভানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটা নিয়ে বাড়ির সবাই চিন্তিত তারমধ্যে আনায়ার অসুস্থতা।সবকিছু মিলিয়ে কোন কিছু ঠিক নাই তার পরিবারের।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে থামে ভার্সিটির সামনে। আনায়া ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। আয়ান আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
_”পরীক্ষা শেষে ড্রাইভার নিতে আসবে তোদের অপেক্ষা করবি। আর হ্যাঁ একা একা যেন কোথাও যাওয়া না হয়।”
আনায়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। পা দুটো স্বাভাবিক গতিতে চললেও হৃদপিণ্ড যেন দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ তার বুকের মাঝে একটা ঢক করে ওঠে। যদি ইউভানের সাথে আজ হঠাৎ দেখা হয়ে যায়?সে কী করবো? কী বলবে?আনায়া তো ইউভানের থেকে দূরে চলে যেতে চায়।এই এক মাসে আনায়ার ভার্সিটির পথে পা পড়েনি একবারও। ইউভান কী এখনো ক্লাসে আসে? সে তো জানেই না। নিঃশব্দে কয়েকটি পদক্ষেপ এগোয় হঠাৎ চারপাশে কোলাহল চমকে ওঠে আনায়া।
ভার্সিটির মাঝখানের বিশাল সবুজ মাঠ। সেই মাঠ এখন গিজগিজ করছে মানুষে। ছাত্র-শিক্ষিকা, স্টাফ, সিনিয়র-জুনিয়র—সবাই গোল হয়ে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে আছে।আনায়া নিজের কৌতুয়াল দমিয়ে রাখতে পারে না।সে ভিড়ের দিকে পা বাড়ায়।
মাঠের মাঝ বরাবর একটি জায়গা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কেউ কেউ মুখে হাত দিয়ে, কেউ চোখে পানি নিয়ে, কেউ আবার ফোন বের করে ভিডিও করছে। হঠাৎই আনায়ার চোখ আটকায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটার উপর। কয়েকটা ছেলে মেয়েটিকে দেখা করছে। আনায়ার মেয়েটির মুখ দেখে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হলো।
মেয়েটির মুখ আধপোড়া, বিকৃত, চোখ-মুখ গলে গিয়ে চামড়া ঝুলে পড়েছে। ঠোঁট আর চোখের মাঝে আর কোন সীমারেখা নেই। বাম গালে একটি বিশাল দাগ, যেখানে ত্বক নামের কিছু আর অবশিষ্ট নেই। চুলগুলো জ্বলে গিয়ে পেছনের দিকে জট পাকিয়ে গেছে। চোখজোড়া এখনও কেমন যেন শূন্য, অথচ তাতে হাহাকারের সাগর।মেয়েটি আকুতি মিনতি করছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু তাকে যেতে দিচ্ছে না র্যাগিং করা ছেলেগুলো। আনায়া নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারে না। যে করে হোক ছেলেগুলোর কাছ থেকে অসহায় মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে।সে ভীর ঠেলে সামনে যখনই পা বাড়াবে তার আগে পেছন থেকে রুহি খপ করে ধরে নেই হাত।আনায়া থেমে পিছন ফিরে রুহির দিকে তাকায়।তখনই রুহি কপাল ভাঁজ করে বলে,
“পাগল হয়েছিস তুই? কোথায় যাচ্ছিস?”
আনায়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উত্তর দিলো,
“ওই মেয়েটাকে বাঁচাতে। দেখ মেয়েটাকে অসহায় পেয়ে ছেলেগুলো কিভাবে তাকে উত্তপ্ত করছে।”
বলেই আনায়া পুনরায় পা বাড়ায় কিন্তু আবার রুহি আটকে দিয়ে বলে,
“পাগলামি করিস না আনায়া।জানিস ওই মেয়েটা কে?”
আনায়ার চোখে একটা কৌতূহলভরা উচ্ছ্বাস,
“কে?”
রুহি অবাক হয়ে বলে,
“তুই চিনতে পারলি না? এটা তো আনিকা!”
আনায়ার শরীর জমে যায়। আনায়ার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। রুহি আবার বলে,
“এই সেই মেয়ে, যার সাথে তুই ক্যান্টিনে ঝগড়া করলি ইউভান ভাইয়ের জন্য। মনে আছে? আর তারপর তোকে ইউভান ভাই মারল। ওই আনিকা এই মেয়েটা।”
আনিকা নামটা মাথায় ধাক্কা খায়।আনায়ার চোখ আবার ছুটে যায় মেয়েটার দিকে ভেঙে যাওয়া রূপের ছায়ায় এখন শুধুই যন্ত্রণা আর ক্ষত।হঠাৎ আনায়ার কানে চারপাশ থেকে গুঞ্জন ভেসে আসে।কেউ কেউ বলাবলি করছে,
“জানিস আনিকা নাকি এক মাস আগে বাড়ি ফিরছিল, তখন রাস্তার কোণ থেকে একটা বাইক এসে অ্যাসিড ছুঁড়ে পালিয়ে যায়।”
তখন আরেকটি ছেলে বলে,
“হ্যাঁ রে। শুধু তাই না, বলছে যে আমাদের ব্যাচের সুমনও এক মাস থেকে নিখোঁজ। কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।”
সুমন নামটা শুনতেই আনায়ার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা সেই ভয়াবহ রাতটা মনে পড়ে যায় তার।তার চোখের সামনে কিভাবে সুমনকে ওই ড্রাগন মাস্ক পরিহিতা লোকটি নিশংস ভাবে মারে।আনায়ার শরীরের পশম খারিয়ে যায়। একনজর পুনরায় আনিকার দিকে তাকায়। আনিকা অসহায়ের মতো কাদছে আর তার মজা উরাচ্ছে সবাই। আনায়ার হাত-পা কাঁপছে। কিছু না বলেই আনায়া দ্রুত পেছন ফিরল।
শব্দহীনভাবে মাঠ ত্যাগ করে ক্লাসরুমের দিকে ছুটে চলে। তার পরীক্ষা আছে। কিন্ত মাথায় পরীক্ষার প্রশ্ন নয়, শুধু আনিকার পোড়া মুখ এবং সুমনের মৃত্যুর দৃশ্য বারবার ভেসে উঠছে।আনায়া মনে মনে চিন্তা করে তার কি ওই দিন দাঁতের কথা সবাইকে বলে দেওয়া উচিত?না না চুপ থাকাই শ্রেয় এটা ভেবেই আনায়া নিশ্চুপ রইলো।
গাড়িতে আরাম করে বসে আছে আনায়া। শরীর ভালো লাগছে না একদম পরীক্ষা দিতে গিয়ে যেন পুরো শরীরের শক্তিটাই নিঃশেষ হয়ে গেছে। চোখ দুটো ভারী লাগছে।আজকে ভার্সিটিতে ইউভান আসে নি।পুরো এক মাস ইউভানের কোন খোঁজ নাই। আনায়া এসব নিয়ে ভাবতে চায় না।এমন সময় হঠাৎ পাশে বসা রুহি বলে উঠে,
“গাড়ি থামাও!”
আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। গাড়ি থামতেই রুহি ব্যাগ হাতে দরজা খুলে নামতে গিয়েই বলে,
“আমার একটু মার্কেটে কাজ আছে, তুই বাসায় যা। আমি রিকশায় করে চলে আসব। নাকি তুই যাবি আমার সঙ্গে?”
আনায়া মাথা নাড়ায়। শরীরের যা অবস্থা এখন আর কোথাও যাওয়া সম্ভব না। ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,
“না তুই যা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।”
রুহি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,
“ঠিক আছে সাবধানে যা!”
গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। রুহি এবার চারদিকে তাকিয়ে কাউকে ফোন দিয়ে বলে,
“তুমি শিওর এখানে ওর বাসা?”
অপরপাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠ ভেসে আসে,
“হ্যাঁ সিওর। পিয়াস এখন ওই ব্লকেই থাকে। D-12 নম্বর বাড়ি নিচতলায়।”
রুহির মুখে এক চিলতা হাসি ফুটে ওঠে।সে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে এগো গলির ভেতর।
D-12। কালচে দেওয়ালের পুরনো এক বাড়ি। দরজার সামনে গিয়ে বেল বাজায় রুহি।কয়েক সেকেন্ড পর দরজা খুলে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে আসেন।
“আপনি কাউকে খুঁজছেন?”
“এই বাসায় পিয়াস থাকে, তাই তো?”
বৃদ্ধ মাথা নাড়ে।
“থাকতো। কিন্তু এখন আর নাই। এক মাস আগে হঠাৎ করে বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে, কিছু বলে যায়নি।”
রুহির মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।সে ধীরে ধীরে বলে,
“আপনি কি জানেন সে কই গেছে?”
“না মা।”
রুহির চোখে পানি এসে পড়ে।তার মনটা ভার হয়ে যায়।কত শত আশা নিয়ি এসেছিল সে এক নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেল।রুহি বিষন্ন মন নিয়ে পিছন ফিরে পা বাড়ায়।তখনই তার চোখ যায় । কিন্তু ঠিক তখনই চোখ পড়ে পাশের ছোট্ট ডাকঘরটার দিকে।হঠাৎ কী মনে করে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। ব্যাগ থেকে কলম আর একটি কাগজ বের করে দ্রুত কিছু লিখতে শুরু করে।
❝প্রিয় পায়েশ,
তোমাকে টেস্ট করার জন্য এসেছিলাম যে তুমি আসলে মিষ্টি নাকি তেতো। কিন্তু তুমি তো আমার আগেই পালিয়ে গেছো।এই যে পালিয়ে যাবে কতদূর?রুহি নামক জিনিস তোমার পিছু ছাড়বে না বুঝলে?তবে শোনো তোমাকে আমার বড্ড মনে ধরেছে তাই তুমি চাইলেও পালাতে পারবে না।তোমাকে খুঁজে বের করবোই করবো।তোমার পেছনে রুহি স্পেশাল গোয়েন্দা বাহিনী লেগে গেছে এখন।তোমাকে আমার কাছে আসতেই হবে।আর হ্যাঁ, যদি আবার পালাও, তাহলে পরের বার আমি চিঠি না, হ্যান্ডকাফ পাঠাবো!
তোমার পাগলা প্রেমিকা
রুহি।❞
চিঠিটা শেষ করে রুহি একবার চোখ মুছে নেয়। তারপর সেই ছোট্ট ডাকঘরের ভিতর চিঠিটা রেখে আসে নিঃশব্দে।তার মুখে তখন একটুকরো প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে যেন কিছুটা ভার নেমে গেছে বুকে জমে থাকা।
আনায়া জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকায়।তারপর সিটে হেলান দিয়ে কিছুটা চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ চারদিকে কোলহলের আওয়াজে চোখ মেলে তাকায় সে। গাড়ি থেমে যায়।আনায়া জানালার বাইরে তাকাতেই চমকে উঠে। চারপাশের মানুষের চিৎকারের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। দুই দল মানুষের মধ্যে তুমুল মারামারি চলছে। একদল লাঠি হাতে তেড়ে আসছে, আর অন্যদল ইট-পাটকেল ছুঁড়ছে।আর কয়েকজন রাস্তার গাড়িগুলো ভাঙচুর করছে। হঠাৎই চোখে পড়ে কয়েকজন রাস্তার মাঝে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
রাস্তার আশেপাশের গাড়ি গুলোয় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। আনায়া ঘাবড়ে যায়। বুঝতে পারে না এখন কি হবে। হঠাৎ খেয়াল করে তাদের গাড়ির সামনে কয়েকজন বড় লোহার রড নিয়ে এগিয়ে আসছে। আনায়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায় আর এক সেকেন্ড গাড়িতে না বসে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেয়।সে এক নিঃশ্বাসে সামনের দিকে দৌড়াতে থাকে। রাস্তার চারদিকে মানুষের মেরে মেরে লাশ ফেলে রেখেছে। আনায়ার এসব দেখে কলিজা কেঁপে ওঠে। হঠাৎ সে রাস্তার পাশে একটা দোকানের পেছনে ফাঁকা জায়গা দেখে।এক মুহূর্ত দেরি না করে ওখানে লুকিয়ে পড়ে। বুক ধড়ফড় করছে তার শরীর যেন জমে গেছে ভয়ে।
কিন্তু এত ভিড়ের মাঝে তার চোখ পড়ে রাস্তায় পড়ে থাকা একটি বাচ্চা ছেলের উপর। ছেলেটি চারদিকে তাকিয়ে কান্না করছিল। চারদিকের মানুষ দৌড়ানোর সময় ছেলেটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় কেউ সাহায্য করে না। আনায়া তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। ছেলেটিকে দেখে তার মায়া হয়। আর দেরি না করে সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে দোকানের আড়াল থেকে। কৌশলে এদিক-ওদিক দেখে এগিয়ে যায় বাচ্চাটার কাছে। বাচ্চা ছেলেটি ভয়ে কাঁপছে।
— “বাবু ভয় পেয়ো না।আমি তো আছি,” নরম গলায় বলে আরু ছেলেটাকে কোলে তুলে নেয়।
তখনই একটা বিস্ফোরণের শব্দ হয়।আনায়া চমকে উঠে।একটা দোকানে আগুন লেগে গিয়েছে, কয়েকজন আতঙ্কে দৌড়ে পালাচ্ছে। রাস্তা জুড়ে শুধু ধোঁয়া আর জ্বলন্ত আগুনের শিখা। আনায়া ছেলেটাকে শক্ত করে ধরে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করে।যে করেই হোক ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে।ছেলেটি ভয়ে কান্না করা শুরু করে দিয়েছে।
_ “বাবু একটু শক্ত হয়ে থাকো। ভয় পেয়ো না, ঠিক আছে?”
ছেলেটা ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছোট্ট হাত দিয়ে আনায়ার জামা চেপে ধরে আছে।হঠাৎ, একটা মহিলা ছুটে আসে সামনে থেকে। চোখমুখ ভয়ে সাদা, নিশ্বাস কাঁপছে।
— “আমার ছেলে। ও আমার ছেলে!”
আনায়া মুহূর্তেই বুঝতে পারে। এই মহিলাই বাচ্চাটার মা। সে দ্রুত ছেলেটাকে মায়ের হাতে তুলে দেয়। মহিলা ছেলেকে বুকের সাথে চেপে ধরে কেঁদে ফেলল।।
— “আপনি না থাকলে আমার ছেলেকে হয়তো পেতামই না।আমি কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ দেব!”
আনায়া একটু হাসল। যদিও চারপাশের ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে সে নিজেই আতঙ্কিত।
— “ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান!”
মহিলা কিছু না বলেই মাথা নাড়ায়। বাচ্চাকে শক্ত করে ধরে দৌড়ে পালিয়ে গেল।আনায়া এবার থামল। এখন কোথায় যাবে? আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তার আশ্রয় নেওয়া দোকানেও আগুন ধরে গেছে! বুক ধড়ফড় করছে। কিন্তু মাথার ভেতর চিন্তা করার সময় নেই।সে দৌড়ানোর জন্য পা বাড়াতেই সামনে আগুনের শিখার মধ্যে কিছু একটা দেখতে পায়।একটা ছায়া,ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সেই অবয়ব।আনায়া স্তব্ধ হয়ে যায়। তার গলা শুকিয়ে আসে। সে আপনা আপনি বলে ওঠে,
—”ইউভান ভাই।”
সেই তীক্ষ্ণ, মুখটা পাথরের মত কঠিন ইউভান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার কাছে। আনায়া এক পা পিছিয়ে গেল।এক মাস পর সেই পরিচিত মুখ দেখে তার বুকের ভেতর তুমুল ঝড় বয়ে গেল।মনের মধ্যে হঠাৎ কয়েকদিন আগের ঘটনা ঝলসে উঠে আনায়ার পর মুহুর্তে একরাশ ঘৃণা উকি মারে মনে।রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় সে।
সে সামনে যেতে চায় না, আবার পেছনেও যেতে পারছে না।ইউভান কি করবে তার সাথে এটা ভাবলে কেঁপে উঠছে আনায়া।যদি আবার সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে কুরে কুরে খায়?ইউভান ক্রমগত তার দিকে এগিয়ে আসছে।আনায়া আর এক মুহূর্ত দেরি করে না। পেছন ফিরে দৌড় দেয়।ইউভান কিছুটা অবাক হয় তারপর চিৎকার করে বলে,
“সানসাইন স্টপ। ওখানে যাস না, সামনে গুন্ডারা আছে।”
ইউভান কোন মতে আনায়ার হাত হ্যাচকা টান দেয়। আনায়া ঘাবড়ে ওঠে ইউভান শক্ত হাতে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে। শক্ত চোখে তাকায়। আনায়া শুকনো ঢোক গিলতে থাকে সে কিভাবে বাঁচবে এখন এই দৃষ্টি থেকে। ইউভান কর্কশ গলায় বলে ওঠে,
“কোথায় পালাচ্ছিস তুই? আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস এত বড় কলিজা? কি ভেবেছিস ছেড়ে দিবো তোকে? এত সহজে ছেড়ে দিব আমি, ভাবলি কি করে তুই?”
আনায়া রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“ছাড়ুন আমাকে চরিত্রহীন লোক। যেতে দিন তা না হলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে কোন অধিকার আমাকে টাচ করেছেন আপনি হ্যাঁ?”
ইউভান ভ্রু কুচকায়। আনায়া ইউভানের হাতে বন্দী হতে চায় না। কোনমতে নিজের শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে ইউভানকে ঠেলে একটু দূরে সরিয়ে আবার দৌড় দেয়। ইউভানের চোখ মুখ রাগে শক্ত হয়ে আসে। সামনে গুন্ডারা আছে যদি আনায়ার কোন ক্ষতি হয়ে যায়।ইউভান এবার জোরে চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা।আনায়া পাগলের মতো ছুটে চলেছে।ইউভান হতভম্ব হয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে। সে এই মেয়েকে বাঁচাতে এসেছে।আর এই মেয়ে তার থেকে ছুটে পালাচ্ছে এখন। ইউভানের হাত মুহূর্তে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায় এক সেকেন্ড দেরি না করে দৌড়াতে থাকে আনায়ার পেছন পেছন। চারপাশে এখন পুলিশের সাইরেন। আগুনের লেলিহান শিখা আর আতঙ্কিত মানুষের আর্তনাদ ছাপিয়ে পুলিশের গাড়ির আলো লাল-নীল রঙে ঝলসে উঠছে। গুন্ডারা ছুটোছুটি শুরু করেছে কেউ লুকাচ্ছে, কেউ পালানোর পথ খুঁজছে।আনায়া এবার থেমে দাঁড়ায় । এরই মধ্যে একজন গুন্ডা এসে আনায়ার মাথা বরাবর বন্দুক ঠেকিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
—”কেউ কাছে আসবে না তা না হলে এই মেয়েটাকে মেরে দিব। ”
আনায়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। হাতটা কাঁপতে শুরু করে। পুলিশরে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। আনায়া মাথার ঠিক ওপরে একটা ঠাণ্ডা লোহার স্পর্শ। আনায়া জমে যাচ্ছে । মুখ থেকে একটা শব্দ বের হয় না তার।
এক পুলিশ অফিসার চিৎকার করল,
“গান ফেলে দাও।মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।”
গুন্ডা হেসে উঠে। ঠোঁটের কোণে একটুখানি বিদ্রূপের হাসি।
_ “হা-হা-হা! বেশি চালাকি করবি না। সামনে এগোলেই মাথা উড়িয়ে দেব!”
আনায়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল এটাই শেষ।তৎক্ষণিক তার কানে ভেসে আসে কারোর কর্কশ আওয়াজ,
“ওকে ছেড়ে দে।ওর শরীরে একটা আঁচড় পড়লে, তোর শরীর ছিঁড়ে এত গুলি ঢুকিয়ে দেব, তোর নিজের লোকেরাও গুনতে পারবে না।”
আনায়া ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় আর সামনে ইউভানকে দেখে। আনায়ার এবার আরো বেশি রাগ হয় ইউভানকে দেখে।যে মানুষটিকে দেখে এতদিন মনে ভালো লাগার অনুভূতি আসতো এখন তাকে দেখেই মনের মধ্যে ঘৃণা জন্মায়। গুন্ডাটা বাঁকা হাসে। বন্দুকের নলটা আনায়ার মাথায় আরও জোরে চেপে ধরে বলে,
“আরে, তাই নাকি? বড় বেশি ভালোবাসো দেখছি!”
ইউভান চোখে আগুন জ্বলছে।সে এক পা সামনে বাড়াশ। কণ্ঠস্বর গর্জে উঠে,
“আমার কলিজা কে স্পর্শ করলে তোর কলিজা আমি কু** দিয়ে খাওয়াবো বাস্টার্ড। সাহস থাকলে ট্রিগার টান। ওর শরীর থেকে এক বিন্দু রক্ত ঝরলে,তোর শরীর থেকে এত রক্ত ঝরবে যে এই রাস্তাই লাল হয়ে যাবে।”
আনায়া তার চোখে এক টুকরো জল জমিয়ে, তীব্র ঘৃণা নিয়ে ইউভানের দিকে তাকায়। মনে মনে সে নিজেকে শপথ করে, আর কখনো ইউভানকে ভালোবাসবে না, তাকে ক্ষমা করবে না।আনায়া মরে যাবে তাও ইউভানের কাছে যাবে না।তখনই সে তীব্র কণ্ঠে বলে,
“আপনরা আমাকে মেরে ফেলুন। তাও আমাকে এই অসভ্য, চরিত্রহীন লোকের কাছে তুলে দিবেন না।”
গুন্ডা গুলো কিছুটা অবাক হয়। এ কথা শুনে ইউভান সজোরে রেগে গিয়ে বলে,
“কি বলছিস তুই? আমি তোকে থাপড়ায়ে গালে লাল করে ফেলবো বেয়াদব?
আনায়া তার চোখে আগুন নিয়ে বলে,
“আপনার মত চরিত্রহীন মানুষের কাছে আমি থাকতে চাই না বুঝলেন?আমি মরে যাব তাও আপনার কাছে যাব না।”
এ কথা শোনার পর ইউভান হিসহিসিয়ে শুধায়,
“তোর তো মরার খুব শখ জেগেছে তাই না? তাহলে ওই গুন্ডাদের হাতে না বরং আমি নিজেই তোকে মেরে ফেলবো। একবার আমার হাতের কাছে আয় তোকে ঠিক বুঝিয়ে দেব মৃত্যু কতটা যন্ত্রণাদায়ক হয়।”
আনায়া তার গাঢ় ঘৃণা আর ক্ষোভ নিয়ে ইউভানকে চোখে চোখ রেখে তাকালো।গুন্ডা গুলো আরো জোরে গুলিটা চেপে ধরল আনায়ার মাথায়।আনায়া চোখ বন্ধ করে নেই। ঠিক তখনই একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। গুন্ডাটির শরীর ধাক্কা খেয়ে পড়ে, হাত থেকে বন্দুকটা খসে পড়লো পিচঢালা রাস্তায়। সবকিছু যেন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।একজন পুলিশ একটি বোমা ছুড়ে মেরেছিল পেছন দিক থেকে। আনায়া ধাক্কা খেয়ে সামনের দিকে ছিটকে পড়ার আগেই একটা শক্ত হাত আঁকড়ে ধরে তাকে।ইউভান আনায়াকে বুকের সঙ্গে জোরে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,
“ঠিক আছিস সানসাইন। কোথাও লাগেনি তো তোর হুমমম।”
আরো শক্ত করে আনায়াকে জড়িয়ে ধরে। আনায়া ইউভানের বুকে মুখ গুঁজে ফুফিয়ে কান্না করে দেয়। হাত-পা কাঁপছে শরীর যেন নিজের নিয়ন্ত্রণেই নেই। চোখের সামনে এখনো বারুদ-ধোঁয়ার ছবি ঘুরছে। ইউভান অনুভব করে আনায়ার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে। ইউভানের হৃদপিণ্ড যেন সঙ্গে সঙ্গে কাঁপতে থাকে।সে অস্থির কন্ঠে পুনরায় বলে,
“কোথায় কষ্ট হচ্ছে কলিজা?আনু কথা বল, চুপ করে থাকার অনুমতি দেইনি আমি। এভাবে চুপ করে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব।কোথায় কষ্ট হচ্ছে? প্লিজ বল।”
আনায়া নিস্তব্ধ তার মুখ থেকে একটা শব্দ বের হচ্ছে না। চারপাশে তখন পুলিশের সাইরেন বাজছে গুন্ডাদের একজন একে একে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অফিসাররা। হঠাৎ আনায়ার মাথা সঞ্চালন হতে শুরু করে।সে নিজের অবস্থান বুঝতে পারে। যে মানুষটা তার মন ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে সে সেই মানুষটার বুকে আশ্রয় নিয়েছে।এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ইউভানকে শক্ত হাতে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“স্পর্শ করবেন না না আমাকে চরিত্রহীন লোক।আমার থেকে দূরে সরে যান।আপনাকে আমার কাছে দেখতে চাই না ঘৃণা করি আপনাকে বুঝেছেন?”
ইউভান ব্যথায় আহহ শব্দ করে।তার হাত চলে যায় বুকের ক্ষতস্থানে। কিন্তু সে সেই ক্ষতটা বুঝতে না দিয়ে শক্ত চোখে তাকায় আনায়ার পানে।ইউভানের মাথা গরম হয়ে যায়।আনায়ার চরিত্রহীন লোক এই কথাটার অর্থ সে বুঝতে পেরে বাঁকা হাসে।
আনায়া আর কোন কথা না বাড়িয়ে সামনে দৌড় দেয়। ইউভান রাগে কন্ঠে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
“থেমে যা আনু।আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেশি দূর যেতে পারবি না। ধরে ফেললে জানে মেরে ফেলবো তোকে।”
আনায়া এসব শুনছে না। মাথায় এখন একটাই চিন্তা।এখান থেকে বের হতে হবে।ইউভানের মতো নোংরা লোকের মুখোমুখি সে হতে চায় না।আনায়া দৌড়ে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। এদিকে ইউভান নিজের গাড়িতে উঠে আনায়ার গাড়ির পেছনে পেছন যেতে শুরু করে। ইউভানের চোখ আগুনে জ্বলছে। গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল শক্ত করে ধরে বিড়বিড় করে,
” পালিয়ে কোথায় যাবি সোলবিট?তুই যেখানেই যাস না কেন আমার ছায়া সেখানে পৌছাবে। তুই সহ তোর আত্মা আমার হাতে বন্দী। এ জন্মে আমার হাত থেকে ছুটে পালাতে পারবি না।”
এদিকে আনায়া কাঁপাকাঁপা হাতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু হঠাৎ মনে হয়, কিছু একটা ঠিক নেই।আনায়া ব্রেক চাপে।কিন্তু গাড়ি থামে না। আরেকবার চেষ্টা করে এবার আরো জোরে ব্রেক চেপে ধরে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।ব্রেক ফেল।তার নিঃশ্বাস আটকে আসে। মুহূর্তের জন্য মনে হয় পুরো পৃথিবী যেন শূন্যে ঝুলে গেছে। শরীরের ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আঙুলগুলো স্টিয়ারিংয়ে জমে যায়। আনায়া এবার হাউমাউ করে কান্না করে। পেছনের আয়নায় ইউভানের গাড়ি দেখা যাচ্ছে।
এদিকে ইউভান ও তখন খেয়াল করে গাড়ির গতি অস্বাভাবিক।চোখ কুঁচকে এলো তার।
—”এটা কী করছে? গাড়ি কেন এভাবে ছুটছে?”
আনায়া সাহস জোগানোর চেষ্টা করে গাড়ি নিয়ে যায় নির্জন রাস্তার দিকে। চট্টগ্রামের আঁকাবাঁকা পাহাড়ের উপরে গাড়ি ছুটে চলছে। এদিকে ইউভান বুঝতে পারে না আনায়ার কেন পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছে সামনেই তো বড় খাদ। সে তার গাড়ি ফুল স্পিডে চালাতে শুরু করে।আনায়ার গাড়ির সামনাসামনি এসে জানালা দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে,
—”কি হয়েছে গাড়ি এভাবে চালাচ্ছিস কেন?কোথায় যাচ্ছিস তুই সামনেই খাঁদ। ”
আনায়ার ধ্যন ভাঙ্গে। সে আতঙ্ক চোখে ইউভানের দিকে তাকায়।কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে যায় সে। আর নিজেকে সামলাতে পারে না ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলে,
— ” ইউভান ভাই গাড়ির ব্রেক ফেল হয়ে গেছে।গাড়ি থামছে না।ভয় করছে আমার।”
ইউভানের মাথায় শূন্যতা চলে আসে। তার মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইউভান আনায়াকে শান্ত করার জন্য বলে,
“সানসাইন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি তো, তোর কিছু হবে না। একটু শান্ত হ কাঁদিস না।এখনও সময় আছে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।আমি যেমন যখন বলছি তেমন তেমন করবি ঠিক আছে? ”
আনায়া মাথা নারিয়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দেয়। ইউভান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আনায়ার গাড়ি আরো সামনে চলে যায় স্পিড কমানোর কোন সুযোগ নেই।ইউভানের চোখ অস্থির হয়ে ওঠে। আরও শক্ত করে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে সামনে এগোয়।
তাদের গাড়ি দুটো এখন একে অপরের খুব কাছে চলে আসে। একে অপরকে সমানভাবে তাড়া করছে। পুনরায় আনায়ার গাড়ির পাশাপাশি এসে নিজের গাড়ির দরজা খুলে দেয়। আনায়া ভয়ে হতভম্ব হয়ে সে দিকে তাকায় বুঝতে পারে না কি করবে।
ইউভান চিৎকার করে বলে,
— “তাড়াতাড়ি ফাস্ট। সময় নেই আমাদের হাতে।দরজা খুল নিজের গাড়ির তারপর হাত ধর আমার। কিছু হবে না তোর ভরসা কর আমার উপর আনু।”
আনায়া ভয়ে ভয়ে নিজের গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে হাত বাড়ায় ভয়ে তার হাত কাঁপছে।ইউভান হাত বাড়িয়ে আনায়াকে ধরতে যাবে তার আগে আনায়ার গাড়ি আবার সামনে চলে যায়। ইউভান রাগে স্টিয়ারিংএর উপর হাত দিয়ে ঘুসি মারে।
— “ওহ শিট। আই ফা** দ্য কার স্পিড। ”
ইউভান আবার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে আনায়ার গাড়ির সামনাসামনি যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আনায়া গাড়ি আর কিছুক্ষণের মধ্যে খাদে পড়ে যাবে। ইউভানের বুক কেঁপে ওঠে। সে কোন মতে পুনরায় আনায়ার গাড়ির পাশাপাশি এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। আনায়া ভয়ে সেদিকে তাকায়। ইউভান চিৎকার দিয়ে বলে,
“সময় নষ্ট করিস না আনু হাত ধর আমার।”
আনায়া ভয়ে কাঁপতে থাকে। সে ধীরে ধীরে হাত বাড়ায়। এদিকে ইউভান ধৈর্য হারা হয়ে যায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইউভান সময় নষ্ট না করে আনায়ার হাত হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের গাড়িতে নিয়ে আসে।আনায়ার ভয়তে ইউভানের শার্ট খামছে ধরে। তখনই আনায়ার গাড়িটা খাদে পড়ে যায়। ইউভান এক হাত দিয়ে আনায়ার শক্ত করে চেপে অন্য হাত দিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে গাড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।
এরপর গাড়ির দরজা টা লাগিয়ে দেয়।আনায়া এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলতে যাবে তৎক্ষণ ইউভান হুট করে আনায়াকে কোলের ওপর তুলে নেয়। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটছে যে আনায়া ফ্যল ফ্যল করে চেয়ে আছে ইউভানের পানে। হঠাৎ নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে ভয় আর বিস্ময়ে পুরো শরীর শিরশির করে উঠে তার। ইউভানের সামনে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর গলায় বলে,
_”পালানোর শখ মিটে গেছে হ্যাঁ? কলিজা টা এখন টেনে ছিড়ে দি?অনেক বড় হয়ে গিয়েছে ওটা তোর।”
আনায়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। রুদ্ধ পুনরায় দাঁতে দাঁত চেপে বলে
“তুই কি সবসময় বিপদ সঙ্গে নিয়ে ঘুরিস নাকি তুই নিজেই একটা বিপদ, বলতো? বলেছিলাম আমার হাত থেকে ছুটে না পালাতে শুনিসনি কেন?এই এিশ দিনে অনেক বেশি সাহস বেড়ে গেছে না তোর?”
আনায়া দুই হাত দিয়ে ইউভানের বুকে কিল ঘুষি মারতে মারতে বলে,
“ছাড়ুন আমাকে চরিত্রহীন লোক।অন্যের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে আমাকে স্পর্শ করার সাহস কোথা থেকে হয় আপনার হ্যাঁ?”
ইউভান চোখ বন্ধ করে নেই সে সবকিছুই বুঝতে পারছে তবে এখন সত্যটা আনায়াকে বলতে চাই না সে। ইউভান হিসহিসিয়ে বলে,
” আমার আরো অনেক কিছু করার সাহস আছে দেখবি তুই? চল আজকে তোকে আমি আমার সমস্ত সাহস দেখাবো প্রাক্টিক্যালি।চরিত্রহীন রা কি কি করে সেটা তোকে আজ আমি বোঝাবো।”
আনায়ার গলা শুকিয়ে আসে। হাত-পা ঠান্ডায় জমে যায় যেন শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছে। সে ছটফট করতে লাগে এবার ইউভানের বুক থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। আনায়া কাঁপা গলায় বলে,
“আমার সাথে খারাপ কিছু করলে আপনাকে পুলিশে দেবো আমি।”
ইউভানের চোয়াল শক্ত হয়ে যাই। সে আরো জোরে চেপে ধরে বলে,
“ঠিক আছে তাহলে আগে খারাপ কিছু করি তারপর না হয় জেলে চলে যাব। আর একবার ব্যাঙের মতো লাফানোর চেষ্টা করলেই জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেব তোকে বেয়াদব!”
আনায়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট কাঁপছে বুক ধকধক করছে। এভাবে কখনো কেউ ওর সঙ্গে কথা বলেনি। কিন্তু ইউভান যবে থেকে তার জীবনে এসেছে তার জীবনটাই কেমন যেন বদলে গিয়েছে। তার বুক কাঁপছে এটা ভেবে যে ইউভান তার সাথে খারাপ কি করবে? কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে থামে একটি বাসার সামনে। দরজা খুলে ইউভান আনায়াকে কোলে তুলে নেয়। বিস্ময় আর আতঙ্ক মিশে গিয়ে আনায়ার শরীর কাঁপে। এই বাসাটা সম্পূর্ণ অপরিচিত।সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।সে এবার ছটফট করতে করতে বলে,
— “অসভ্য চরিত্রহীন লোক আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন? প্লিজ ছেড়ে দিন, আমি বাসায় যাব।আপনাকে মপরে ফেলবো আমি ছাড়ুন আমাকে।”
কিন্তু ইউভান একদম চুপ। তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। শক্ত চোখে সে সোজা বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। আতঙ্কে আনায়া চারদিক তাকায় জায়গাটা অচেনা।ইউভান সিঁড়ি ভেঙে একদম ওপরের দিকে এগিয়ে যায় আনায়াকে নিয়ে ঢুকে পড়ে একটি রুমে। এরপর সে এক মুহূর্তও না গিয়ে সোজা ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকে বাথটাবে শুয়ে দেয় আনায়াকে ।আনায়া হতবাক কাঁপাকাঁপি কন্ঠে বলে,
“এখানে কেন নিয়ে এসেছেন আমাকে? কি করবেন আপনি আমার সঙ্গে?”
ইউভান কোন কথার উত্তর দেয় না এক হাতে শাওয়ার ছেড়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে পানির স্রোত বয়ে যায়। ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় আরু জমে যাচ্ছে। ইউভান এবার নিজের শার্ট খুলে ফেলে।মুহূর্তেই আনায়ার চোখ পড়ে ইউভানের বুকে গভীর ক্ষতর দিকে।ইউভান এগোতে এগোতে বলে,
“অনেক চরিত্রহীন চরিত্রহীন বলেছিস আমাকে আজ। চল আজকে তোকে দেখাবো চরিত্রহীন ছেলেরা কি কি করে।”
এই কথাগুলো যেন আনায়ার কানে বেজে ওঠে, তার শরীরে এক শীতল শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। সে ভয়ে আরষ্ট হয়ে বলে,
“আপনি কি করছেন?আমার চরিত্র কেন দাগ লাগাতে চাইছেন?তানহা আপুকে দিয়ে মন ভরছে না এখন আপনার নাকি সে আপনাকে বিছানায়…….
ইউভানের মুখে তীব্র ক্ষোভ।সে দ্রুত এগিয়ে এসে আনায়ার গলা চেপে ধরে, আনায়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে শ্বাস নিতে পারছে না।
“চুপ! একদম চুপ! মেরে ফেলবো তোকে! মুখ থেকে আর একটা শব্দ বের হলে নোংরা। জানের ভয় নেই হ্যাঁ? না জেনে না শুনে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছিস? যেখানে তুই ব্যতীত অন্য কোনো মেয়ে আমি গভীরভাবে স্পর্শ করিনি, সেখানে তুই আমার উপর মিথ্যা কথা বলছিস কোন সাহসে? কী প্রমাণ আছে?”
আনায়ার চোখের কোণে অশ্রু জমে যায়। তার গলার মধ্যে কোনো শব্দই বের হতে চায় না। তার হৃদয়টা কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে। তার গলার কাছে ইউভানের চাপ এতটাই শক্ত যে, সে কিছুই বলতে পারছে না।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আনায়া কাশতে কাশতে নিজের কণ্ঠে বোধহয় সাহস খুঁজে পায়,
আত্মার অন্তরালে পর্ব ১১
“এসব নাটক আমার সঙ্গে করতে আসবেন না। ওইদিনের ভিডিওতে সব দেখেছি।আপনি কতটা নোংরা সবকিছু আমার চোখের সামনে পরিষ্কার বুঝেছেন?ঘৃণা করি আমি আপনাকে অনেক বেশি ঘৃণা করি নিজের থেকেও বেশি ঘৃণা করি।”
ইউভান কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার হাত সরিয়ে নেয়, আর তারপর একটানে হাসতে থাকে। তার হাসিতে তাচ্ছিল্য এবং ব্যঙ্গ ছিল। তার মুখে এক ধরনের তাচ্ছিল্য হাসি ফুটে ওঠে।আর কণ্ঠে একরাশ অবহেলা।
“তুই এত বোকা কেন, আনু? তুই ভিডিও দেখে আর বিশ্বাস করে নিলি? আমি এমন একটা কাজ করব? এটুকু বিশ্বাস আমার উপর নেই তোর?”
আনায়া অবাক দৃষ্টিতে তাকায় ইউভানের পানে।ইউভানের কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে সে। কি বোঝাতে চাচ্ছে ইউভান?