আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৩

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৩
প্রীতি আক্তার পিহু

আনায়া দৃষ্টিতে তাকায় ইউভানের পানে।ইউভানের কথার অর্থ তার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না।তৎক্ষণ সে প্রশ্ন করে ওঠে,
“আপনি কি বলতে চাইছেন ইউভান ভাই?”
ইউভান নিঃশব্দে হাসে।ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বাথটাবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।আনায়া সেটা দেখে কিছুটা পেছনে সরে কিন্তু তাতে বেশি একটা লাভ হয় না। ইউভান আনায়ার ঘাড় বরাবর হাত রেখে আরেকটু নিজের দিকে ঝুকিয়ে হুইস্কির কণ্ঠে শুধালো,

“একটা ভিডিও দেখেই বিশ্বাস করে নিলি আনু।একবারও মনে হয়নি এটা মিথ্যে হতে পারে?”
এই লাইনটা যেন আঘাত করে না, বরং আনায়ার মনে জ্বালায় আগুন।আনায়ার গা দিয়ে ঠান্ডা ঘাম ছুটে যায়। মাথায় বাজ পড়ার মতো অনুভব করে সে। বিশ্বাস? অবিশ্বাস? কোনটা সত্যি? কী করবে এখন সে?মনের মধ্যে জ্বলজ্বলে হাজার প্রশ্ন ছুটে আসে তার।ইউভানকে বিশ্বাস করা কি আদৌও তার উচিত হবে? আনায়ার মন সাড়া দেয় ঠিকই, কিন্তু মাথা মানতে চায় না।ভেতরে যেন একশোটা ঢেউ একসাথে আছড়ে পড়ে।সে কাঁপা কাঁপা হাতে ইউভানকে দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। বুকের ভেতরটা চিৎকার করতে চায়।হঠাৎ সে এক মুহূর্তে চিৎকার করে ওঠে,
“না! আপনি মিথ্যে বলছেন। আমি সব দেখেছি, নিজের চোখে দেখেছি।আপনি আর তানহাপু… ছি। স্পর্শ করবেন না আমাকে।দূরে সরে যান।
আপনি নোংরা, এই নোংরা হাতে আমাকে স্পর্শ করবেন না।ঘৃণা করি আমি আপনাকে। ছাড়ুন বলছি আমায়।”
সেই মুহূর্তে ইউভানের চোখে যেন আগুন জ্বলে ওঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রাখে সে।চোখে জমে থাকা সব আবেগ রাগে রূপ নেয়।আনায়া সর্বশক্তিতে ইউভানকে ধাক্কা মেরে বাথটাব থেকে উঠে দাঁড়ায়।কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে,ইউভান এক ঝটকা টানে আনায়াকে আবার নিজের কোলে বসিয়ে নেয়।আনায়ার কোমর শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ইউভান। আনায়ার শরীরটা পড়ে ইউভানের উন্মুক্ত বুক বরাবর।আচমকা ঘটা কারণে আনায়ার মুখ গিয়ে বাড়ি খায় ইউভানের কলারবোনের কাছ বরাবর।
এক মুহূর্তের জন্য দুজনের নিশ্বাস এক হয়ে যায়।

মুহূর্তেই ঝর্ণার সুইচে হাত রাখে ইউভান।পানির ছোঁয়ায় আনায়া এক ঝটকায় কেঁপে ওঠে।তার দম বন্ধ হয়ে আসে কিছুক্ষণের জন্য।তবু আনায়া চেষ্টা করে সরে যাওয়ার, কিন্তু শরীরটা শীতল হয়ে যায় পানির ছোঁয়ায়।আনায়া দুই হাত দিয়ে কিল ঘুসি মারতে থাকে ইউভানের বুকে। ইউভান নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করে কিন্তু কিছু বলে না।আচমকা ইউভান নিজের ফোনটা বের করে আনায়ার চোখের সামনে তোলে।আনায়া হতভম্ব হয়ে তাকায় ফোনের স্ক্রিনের দিকে।ইউভানের দৃষ্টি আনায়ার উপর। আনায়া থমকে যায়। চোখ ভিজে গেছে পানিতে, তবু সে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে।স্ক্রিনে ওই রাতের সেই মুহূর্তের ভিডিও চলছে। তানহার মুখ, সেই ছেলেটির কণ্ঠ, গলার ছায়া সবই মিলছে, কিন্তু চেহারা?
চোখ কুঁচকে আসে আনায়ার। ধীরে ধীরে ভিডিও জুম করে ইউভান।আনায়ার কাছে এবার পরিষ্কার হয়ে ওঠে ছেলেটি ইউভান না এমনকি মেয়েটাও তানহা না।ভিডিও অন্তরঙ্গ মুহূর্ত গাঢ় হতে থাকে আনায়া চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। ইউভান সেটা দেখে বাঁকা হাসে ফোনটা সরিয়ে নাই। এরপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“এরা আমি আর তানহা না।এই ভিডিও বানিয়ে তোকে ঠকানো হয়েছে। আর তুই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিস।এত বোকা তুই?”
আনায়া স্তব্ধ। তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চাপ তৈরি হয়। কীভাবে ভুল বুঝলাম তাকে?এখন তার নিজের উপরই ঘৃণা হচ্ছে।আনায়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।এই একমাস ধরে ইউভানকে সে ঘৃণা করেছে ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে তার। তৎক্ষণ মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়।সে তার ঠোঁট কাঁপছে, বুক ভারী হয়ে এসেছে।সে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকায় ইউভানের পানে।ইউভান চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছে একফোঁটা অভিযোগ নেই চোখে।আনায়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে,

“তাহলে আপনি এতদিন আমাকে সত্য বলেননি কেন?”
ইউভান আনায়ার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,
“কারণ আমি চেয়েছিলাম তুই আমাকে ঘৃণা করিস।”
আনায়া বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল । ইউভানের প্রতিটি শব্দ তার কানে ঢুকছে, কিন্তু তার মানে কিছুই যেন সে ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। সমস্ত কিছু অস্পষ্ট তার চোখে কেবল বিভ্রান্তি আর অবিশ্বাস ঝুলে রইল।আনায়া পুনরায় কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে, আচমকা ইউভান নরমভাবে আনায়ার ঠোঁটে আঙুল রেখে থামায়।এরপর নরম স্বরে হুইস্কির কণ্ঠে বলে,
“হুশশশ কোনো কথা না।তুই যেহেতু আমাকে চরিত্রহীন বলেছিস। তাই এবার চরিত্রহীন এর মত আচরণ তোকে সহ্য করতে হবে সুইটি।”

শিউরে ওঠে আনায়া।ইউভান আনায়াকে পুনরায় কোল থেকে বাথটাবে বসায়। ঝর্ণার পানির ধীরে ধীরে আনায়ার গায়ের ত্বকে ছুঁয়ে পড়ছে। পানির প্রতিটি ফোঁটা তার মনে অজানা আরাম এনে দেয়।হঠাৎ আনায়ার মনে অজানা ভয় বাসা বাঁধতে থাকে। ইউভান এখন কি করবে তার সঙ্গে? এটা ভেবেই আত্মা কেঁপে ওঠে তার। ইউভান স্পষ্টভাবে দেখতে পায় আনায়ার চোখের ভয়। এটা দেখে সে ভীষণ মজা পায় মনে মনে।সে এবার আনায়ার কপালে আছড়ে পড়া ভেজা চুলগুলো এক হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে বলে,
” আমাকে ভয় পাচ্ছিস সানসাইন ? আমি তো চাই তুই আমাকে ঠিক সেভাবেই ভয় পা যেভাবে হরিণ ভয় পাই বাঘকে।তুই হচ্ছিস একলা পথভোলা হরিণ যে হয়ত এখনো ভাবছে পালিয়ে যেতে পারবে। আর আমি হচ্ছি সেই বাঘ যে জানে কখন থাবা বসাতে হবে তার নিরীহ হরিণের উপর।”

আনায়ার নিশ্বাস যেন থমকে যায় । ইউভানের প্রতিটা শব্দ তার শরীর দিয়ে শিহরন বইয়ে দিচ্ছে। ঠান্ডা পানিতে পুরো ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সে অথচ শরীরের রক্ত ধেয়ে যাচ্ছে বিপরীত দিকে।তখনই ইউভান শক্ত হাতে কোমর ধরে কিছুটা উপরে তুলে ধরে আনায়াকে। আনায়া ব্যালান্স রাখতে না পেরে ইউভানের ঘাড় আঁকড়ে ধরে। তার আঙুলগুলো কাঁপছে কারণ ইউভান সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন।ইউভানের চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আনায়া চোখ তুলে দেখে ইউভানের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ফাঁক হয়ে আসে সামান্য লজ্জায়।
“কী হলো?চরিত্রহীনের মত আচরণ করলে সামলাতে পারবি তো?ক্যারেক্টারলেস ছেলেরা যা যা করে এখন সেগুলো করে দেখাই তোকে প্র্যাকটিক্যালি?”

“ছেড়ে দিন আমাকে।”
“নাহ ছাড়বো না।”
আনায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
“আমি কিন্তু চিৎকার করবো।”
ইউভান ঠোঁট কামড়ে হাসে আনায়ার বোকা বোকা কথা শুনে।
“আচ্ছা তাই? কর যত জোরে পারবি চিৎকার কর।এখানে কেউ তোকে বাঁচাতে আসবে না। আমি আর তুই ছাড়া এ বাসায় আর কেউ নাই।”
আনায়া এহেন কথা শুনে ভীষণ কান্না পায়।এতক্ষণ মনের মধ্যে অপরাধ বোধ হলেও এখন মনে একরাশ ভয় ভার করেছে। কিভাবে বের হবে সে এই বাঘের গুহা থেকে।ঠান্ডা পানির ছোঁয়া যতটা না শীতল তার চেয়েও বেশি ঠান্ডা লাগছে ইউভানের দৃষ্টি।ইউভান ধীর গতিতে মুখ এগিয়ে আনে আনায়ার ঠোঁটের ওপর তার গরম নিঃশ্বাসের স্পর্শ লাগে।

“আর ইউ মিস মি সুইটি? একবারও মনে পড়েনি আমার কথা এই এক মাসে দিনে?”
আনায়ার দম আটকে আসে। এত কাছ থেকে ইউভানের দৃষ্টি সহ্য করা অসম্ভব। সে চোখ সরাতে চাই কিন্তু পারে না।কি বলবে সে ইউভানকে? কিভাবে বলবে এত কিছুর পরে এমন কোন রাত নাই যে সে বেলকনিতে ছুটে যায়নি গিটারের আওয়াজ শোনার টানে। এত অবজ্ঞার পরেও নির্লজ্জের মত বেলকনির দিকে চেয়ে থেকেছে।আনায়া কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“আমি… আমি…”
ইউভানের ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হাসে কণ্ঠে একরকম ব্যঙ্গের ছোঁয়া এনে বলে,
“বুঝতে পারছি খুব বেশি মনে পড়েনি।তুই হয়তো একটু বেশি ব্যস্ত ছিলি তাই না? নাহলে তো রোদ এত তীব্র ছিল না যে, আমার অস্তিত্বকেই পুড়িয়ে দিবে!”
আনায়া চমকে তাকায়। পানির জন্য ঠিকমত তাকাতে পারছে না।
“আপনি কী বলছেন? আমি তো… ”
ইউভান এবার আনায়ার চিবুকটা ধরে মাথাটা সামান্য উঁচু করে বলে,
“এই ৩০ দিনে একবারও আমার কথা মনে পড়েনি সানসাইন ? একবারও মনে হয়নি আমি কোথায় আছি, কেমন আছি?”

আনায়া ঠোঁট নাড়ায়, কিছু বলতে চাই কিন্তু ইউভান তাকে থামিয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“এসবই আমার কিছু যায় আসে না কে আমার চিন্তা করল বা না করল। ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি আমি। তুই হয়তো ব্যস্ত ছিলি নতুন ভোরের আলোয় কিন্তু সেই ভোরের আকাশে আমি ছিলাম না। আমি রয়ে গেছি অন্ধকারের কোণায়, যেখানে তোর একবারও ফিরে তাকানোর সময় হয়নি। তাইনা সানসাইন হুমমম?
আনায়া হতভম্ব হয়ে তাকায় ইউভানের দিকে। ইউভানের গলার আওয়াজ এমন কেন শোনা যাচ্ছে কন্ঠটা কেমন যেন অভিমানী অভিমানী। ইউভান কি তার উপর অভিযোগ করছে অভিমান করেছে তার উপর। আনায়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
“আপনি… আপনি কেন এমন বলছেন?আমি কেন আপনাকে ভুলে যাব?এই ৩০ দিনে আপনার কথা কেনই বা মনে পড়বে না? ”
ইউভান এবার আনায়ার কানের কাছে ফিসফিসে বলে,

“তুই আমাকে চাইলেও এই ৩০ দিনে ভুলে থাকতে পারতি না আনু। কারণ তুই আমাকে ঘৃণা করেছিস এক মাস ধরে। এজন্য আমি তোর থেকে প্রতিবার দূরে যাওয়ার আগে নিজের জন্য ঘৃণা জন্মিয়ে যাব তোর মনে। যেন তুই আমাকে প্রতিটা ক্ষণে,প্রতি সেকেন্ডে মনে করিস। ভালোবাসা হারিয়ে যায় তবে ঘৃণা ক্ষত আজীবন রয়ে যায়।”
আনায়া আমাকে চরম পর্যায় যায়।তার মাথা ভনভন করে ঘুরছে। একটাই প্রশ্ন একটা মানুষ এতটা সাইকো কিভাবে হতে পারে?সে এবার প্রশ্ন করে ওঠে,
“তারমানে আপনি সবকিছু ইচ্ছে করে করেছেন?আমি যেন আপনাকে ঘৃণা করি তাই আপনি ভিডিও তৈরি করেছেন?”
ইউভান মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে উত্তর দেয়,
“নাহ।আমি নিজেকে বাস্তব হোক বা কল্পনা অন্য মেয়ের সঙ্গে ইমাজিন ও করতে পারি না।আই জাস্ট হেইট গার্ল’স।”
আনায়ার মাথায় কিছু ঢুকে না,
“আপনি এক মাস কোথায় ছিলেন ইউভান ভাই?”
ইউভান নির্বিকায় উত্তর দেয়,
“সেটা তোর না জানলেও চলবে।”

আনায়া একবার চুপ হয়ে যায়, কথা বাড়িয়ে লাভ নাই কারণ সে জানে ইউভান কত বড় ঘাড় ত্যড়া তাকে কিছুই বলবে না।আপাতত সেখান থেকে বের হতে চাই। ইউভান তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। প্রতিমুহূর্তে স্পর্শ কেঁপে উঠছে আনায়া। ইউভান এবার একদৃষ্টিতে আনায়ার ভেজা শরীরের দিকে তাকায়। গভীর শ্বাস নিয়ে আনায়ার গালে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
” ইউ লুক লাইক এ ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট পান্ডা সানসাইন ।ডোন্ট সিডিউস মি লাইক দিস। ইউ ক্যান নট হ্যান্ডেল ইট লেটার।”
আনায়া অবাক হয়ে চোখ তুলে। সে কিভাবে সিডিউস করছে ইউভানকে বুঝতে পারে না। ইউভান ঠোট কামড়ে হাসে।ইশশশ এই হাসিটা সোজা গিয়ে অষ্টাদশীর হৃদয়ে গিয়ে লাগে। ইউভান এবার উঠে দাঁড়ায় শাওয়ার অফ করে দেয়। ঠান্ডায় একেবারে জমে গিয়েছে আনায়া।ইউভান গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ড্রেস চেঞ্জ করে নে, বাইরে অপেক্ষা করছি আমি।”
আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকায় সে কীভাবে চেঞ্জ করবে? সে তো কোনো জামা কাপড় আনেনি। তবে ইউভান তার হাবভাব দেখে বুঝতে পারে হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলে,

“ওখানে আমার সাদা ট্রাউজার আছে ওটা পড়। আর মেয়েদের জামা নাই আমার কাছে। যা আছে তাই পড়।”
আনায়া হতবম্ভ হয়ে তাকিয়ে বলে,
“এগুলা কিভাবে পড়বো আমি? ”
ইউভান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে উত্তর দেয় ,
“পড়লে পড় না হলে এই অবস্থায় বাসায় চল তোর ইচ্ছা।” বলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আনায়া অবাক হয়ে বসে থাকে। একটা লোকের এতটা বেপরোয়া আচরণ কীভাবে হতে পারে সেটা সে বোঝেনা। কোন মতে উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় তাৎক্ষণিক চোখ বড় বড় হয়ে যায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। তার ভেজা সাদা জামার নিচে কালো ইনার স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। আনায়ার লজ্জায় মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে। তার মন চাচ্ছিল যেন মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এতক্ষণে বুঝতে পারে ইউভান তাকে পান্ডা কেন বলেছে। আনায়া বিড়বিড় করে নিজের ঠোঁট চেপে বলে,

“ছি নির্লজ্জ, অসভ্য ফকস্টার।মুখে কিছু আটকায় না আপনার।”
অপরদিকে ইউভান অন্য রুমে আসে ড্রেস চেঞ্জ করতে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের বাম পাশে ক্ষতস্থানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে।মনে পড়ে যায় একমাস আগের ওই এক্সিডেন্টের কথা।ঐদিন ইউভান হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সোজা তানাহার কাছে গিয়েছিল।তানহা চেয়েও কিছু লুকাতে পারিনি ধরা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু সব থেকে অবাক করার বিষয় হল ইউভান তানহার সাথে টু শব্দ করিনি। হসপিটালে আনায়ার অবস্থা নরমাল হওয়ার পর। পরের দিন ইউভান সোজা আহসান চৌধুরীর কাছে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।যে সে তানহাকে বিয়ে করতে চায় না। আহসান চৌধুরী ছেলের এমন কথা সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করেছে।এক কথায় দু’কথায় কথা কাটাকাটি হয়,আহসানের সঙ্গে ঝামেলা বিশাল পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়।

রাগে ইউভান ওই রাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।
ড্রিঙ্কস করে গাড়ি চালাতে থাকে অসংলগ্নভাবে।তানহার মিথ্যা অন্তরঙ্গ ভিডিও দেখে,নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হয়।তানহার সত্য সে পরিবারকে বলেনি কারণ তার মনে অন্য কিছু চলছিল। তবে আচমকা অনিয়ন্ত্রণ ভাবে গাড়ি চালানোর ফলে এক্সিডেন্ট হয় ইউভানের।পরবর্তীতে পিয়াস তাকে হসপিটালে নিয়ে আসে।এই একমাস সে হসপিটালেই ছিল।বাসার কারো সঙ্গে সে যোগাযোগ করেনি ইচ্ছে করেই।আনায়াকেও ইচ্ছা করেই সত্যটা বলেনি যে ভিডিওটা মিথ্যা ছিল। কারণ, ইউভান চায় যেন আনায়া তাকে বেশি করে মনে করুক তার অনুপস্থিতে।ভালোবাসা থেকে ঘৃণার জোর অনেক।যত বেশি ঘৃণা করবে, ততো বেশি মনে পড়বে। মুলত এই কারণেই ইউভান চুপছিল। এখন যেহেতু ইউভান সুস্থ আনায়ার আশেপাশে থাকতে পারবে তাই এই ঘৃণার কোন প্রয়োজন নাই।
চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে ইউভান ফোন বের করে পিয়াসে নাম্বারে কল দেয়। কয়েকবার রিং হওয়ার পর পিয়াস কল তুলে। ইউভান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
” ওকে সুস্থ না হওয়া অব্দি বাসা থেকে বের হতে দিবে না।”
অপর পাশ থেকে পিয়াস ভয়ে জড়িত কন্ঠে উত্তর দিল,
“ঠিক আছে স্যার।”
ইউভান প্রতি উত্তর করল না ফোনটা রেখে দিল।

বেলকনির ধারে বসে আছে পিহু। চারদিক নিস্তব্ধ, রাতের মৃদু বাতাস তার মাজা পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুলগুলো দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এক একটা বাতাস যেন তার ভেতরের ক্ষতগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। চোখের ভারি পাপড়িগুলো বারবার ঝাপটাচ্ছে পিহু।আকাশের দিকে তাকিয়ে কত চিন্তা ভাবনা করছে সে। মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন হাজারো কৌতুহল ঘুরপাক খাচ্ছে। তখনই পেছন থেকে পরিচিত ঠান্ডা পুরুষলী কণ্ঠ ভেসে আসে
“আপনার জন্য সুপ নিয়ে এসেছিলাম। যদি খেতেন তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম আমি।”
পিহু চমকে উঠে ধীরে ধীরে পেছনে ঘোরে। কাঙ্খিত পুরুষকে দেখে মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়াস ধোঁয়া ওঠা সুপের বাটিতা টেবিলে রাখে। পিহু পিয়াসের দিকে তাকিয়ে
বলে ওঠে,

“এর কোন দরকারই ছিল না। এমনি তো আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন। ঐদিন হসপিটাল থেকে… তার জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ। এখন মনে করি আমার বাসায় যাওয়া প্রয়োজন।এতদিন আপনার বাসায় রেখে আমার খেয়াল রেখেছেন তার জন্য সত্যি ধন্যবাদ।”
পিয়াসের চোখ-মুখের রং মুহূর্তেই পাল্টে যায়। সে তীব্র অথচ শান্ত গলায় বলে ওঠে,
“না… আপনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি। আমি আপনাকে এভাবে যেতে দিতে পারি না। আপনি থাকুন, একটু বিশ্রাম নিন। এইটুকু কেবল অনুরোধ।সুস্থ খাওয়ার পর না হয় চলে যাবেন।”
পিহু নীরব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পিয়াসের দিকে।এই একমাস ধরে সে এই অপরিচিত বাসায় অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আছে।অবশ্যই তার আশ্রমের পরিচিত মনি অর্থাৎ যে পিহুকে ছোট থেকে বড় করেছে সেও আছে এই বাসায় তার সঙ্গে। মনির খুবই পরিচিত আত্মীয় পিয়াস।প্রথমে থাকতে পিহুর একটু অস্বস্তি অনুভব হলেও ধীরে ধীরে সেটি ঠিক হয়।পিহু এবার নিচু গলায় বলে,

“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?”
পিয়াস মাথা নাড়ে।পিহু ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে, চোখটা জানালার দিকেই রেখে বলে,
“ওইদিন আগুন থেকে আমাকে কে বের করেছিল? আপনি? নাকি অন্য কেউ ছিল?”
পিয়াস মুহূর্তেই ঘাবড়ে যায়। ঠোঁট কেঁপে ওঠে, হাতের আঙুল দুটো একসাথে জড়িয়ে ফেলে। কণ্ঠ যেন হঠাৎ শুকিয়ে আসে।
“হ্যাঁ আমিই ছিলাম। আমি সেদিন বাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি চারপাশে আগুন, ধোঁয়া আপনাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।”

কথাগুলো বলে সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় পিয়াস।কিন্তু পিহুর বুকের ভিতরটায় একরকম খটকা লাগে। তার চোখ স্থির হয়ে আসে পিয়াসের চোখের দিকে।তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে ঐদিন সে দুই জোড়া নীল মনিওয়ালা চোখ দেখেছিল। সে অনুভব করেছিল ওটা ইউভান। পিহু শিওর ছিল কিন্তু জ্ঞান ফেরার পিহুকে মনি সবটা বলল যে ওটা পিয়াস ছিল।তবুও যেন পিহুর মন মানতে চায় না।কিছুক্ষণ নিরবতা। রাতের হাওয়া যেন আরো ঠান্ডা হয়ে আসে।পিহু হঠাৎ প্রশ্ন করে,
“আপনি চোখে কখনো কি লেন্স পড়েন?”
পিয়াস হেসে ফেলে,
“না চোখ তো আমার এভাবেই আছে সবসময়।”

পিহু চোখ বন্ধ করে নেয়। কিন্তু তবু যেন তার চোখের সামনে ঘুরে ফিরে আসে সেই একজোড়া চোখ নীল।বড্ড চেনা, বড্ড কাছের কেউ।পিয়াস হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়,
“আপনার বিশ্রামের দরকার। আমি যাই,মনি এসে আপনাকে ওষুধ দিয়ে যাবে।”
সে পেছন ঘুরে দরজার দিকে যেতে শুরু করে।তখনই পেছন থেকে পিহু ডেকে ওঠে,
“শুনছেন?”
পিয়াস থেমে যায়।বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে যেন তার। ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকায়।পিহু এবার একটু হাসে।
“আপনি আমাকে ‘তুমি’ করে বলতে পারেন।”

পিয়াস মুচকি হাসে। সে একটু অবাক হয়েও বটে।তবে মুখে সেটা প্রকাশ না করে উত্তর দেয়,
“ঠিক আছে তুমি বিশ্রাম নাও এখন হুমমম।”
পিহু মাথা নাড়ায়। পিয়াস নিঃশব্দে পেছনদিকে ফিরে পা বাড়ায় যাওয়ার জন্য।হঠাৎ তার বুকের ভেতরটা যেন কেমন ঝড় বয়ছে।হৃদয় স্পন্দনটা না চাইত ও একটু জোরে জোরে চলছে তবে কারণটা তার অজানা।পিয়াস রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পিহু স্যুপে এক চুমুক দেয়।অতটাও খারাপ রান্নাটা পিয়াসের।

সে এবার আকাশের দিকে তাকায় কতদিন ভার্সিটিতে যায় না। কতদিন চেনা মুখ দেখতে পায় না।ইউভানকে দেখার জন্য সে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই ফোনটা বের করে গ্যালারিতে যায়। গ্যালারি পুরনো ছবিগুলো এক এক করে দেখতে থাকে। প্রত্যেকটা ছবিতে রুহি,আনায়া আর সে।পিহু আলতো হাসে বড্ড মিস করছে রুহি আর আনায়াকে সে।এই এক মাসে একবারও কথা হয়নি তাদের সাথে। হবে কিভাবে? পিহু এতটাই অসুস্থ ছিল যে ফোন ধরার সময় পাইনি।এই শহরে যদি আপন কেউ থাকে সেটা হলো তার মনি আর আনায়া,রুহি।এই তিনজন ব্যক্তিকে পিহু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে।

কিছুক্ষণ বাদে আনায়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়। পরনে ঢিলা ঢালা সাদা শার্ট ও আর কালো ট্রাউজার। চুল বেয়ে বেয়ে এখনও পানি পড়ছে। এরই মধ্যে ইউভান রুমে প্রবেশ করে সঙ্গে সঙ্গে চোখ আটকায় আনায়ার উপর । কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। এক পা এক পা করে এগোই আনায়া ও এক পা এক পা করে পেছতে পেছতে দেয়ালের সঙ্গে মিশে যায়। ইউভান দুই হাত দেয়াল ধরে আনায়াকে সম্পূর্ণ আটকে নেয়।আনায়া কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়লে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।
“আ আপনি ক কি করছেন ইউভান ভাই। বাসায় সবাই চিন্তা করছে। ”
ইউভান বাঁকা হেসে বলে,

“আপনাকে কতটা আবেদনময়ী লাগছে জানেন ম্যাডাম?”
আনায়া ডাগর ডাগর চোখে ইউভানের পানে তাকায়।ইউভান সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এভাবে তাকাবেন না ম্যাডাম। আপনার ডাগর ডাগর চোখের চাহনি যে কারোর বুকে ঝড় তুলে দেয় সেটা আপনার অজানা। ”
আনায়া কিছুটা অবাক হয়, চোখ আরও বেশি বড় বড় হয়ে যায়।
“কার?”
ইউভান এক দৃষ্টিতে তাকায় আনায়ার চোখের দিকে।সেই চোখের গভীরতা একমাত্র ইউভান ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। ইউভান হুইস্কির কন্ঠে শুধালো,

“আপনি নিতান্তই অবুঝ ম্যাডাম। এত কিছু আপনার ছোট্ট মাথায় ঢুকবে না।”
আনায়া আঁখি পল্লব কয়েকবার ঝাঁপটালো।এটা আর নতুন কি? সে তো প্রথম থেকে ইউভানের কথা আগাগোড়া মাথা কিছু বুঝতে পারেনা।ইউভান হঠাৎই স্থির হয়ে গেল। নজর আটকে গেল আনায়ার মুখের দিকে। না, শুধু মুখেই নয়, চোয়ালের হাড়টা আরেকটু বেশি স্পষ্ট, গালদুটো যেন ভিতরে ঢুকে গেছে, গলার হাড় বেরিয়ে এসেছে স্পষ্টভাবে। ইউভান কপালে ভাজ ফেলে বলল,
“তুই কি না খেয়ে খেয়ে মরার প্লান করছিস?
আনায়া চমকে উঠল চোখ বড় হয়ে গেল মুহূর্তে।
“কি বলছেন আপনি?”
ইউভান রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এত শুকিয়ে কেন গিয়েছিস বেয়াদপ? তোকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস না তুই।”
“না আমি ঠিকমতো খাই।”

আনায়ার কথায় যেন ইউভানের রাগ সপ্তম আকাশ ছুঁলো।সে পুনরায় হিসহিসিয়ে বলে উঠল,
” তুই এতটাই রোগা হয়ে গিয়েছিস যে তোর শরীরের এক একটা হাড় আমি গুনতে পারছি।আর আমি হাড় না বরং মাংস পছন্দ করি।বিকজ দ্য মিট ইজ ভেরি টেস্টি অ্যান্ড ইফ ইটস ইউর্স…….
আর কিছু বলে না ইউভান ঠোঁট কামড়ে হাসে। আনায়ার যেটা বোঝার সে বুঝে গিয়েছে। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে ওঠে, হাতদুটো অজান্তে গুটিয়ে যায় পেটের কাছে। সে চোখ তুলে তাকাতে পারে না, গলার নিচে ঘাম জমে।মুখটা লাল হয়ে ওঠে, যেন কেউ আগুন ছুঁইয়ে দিয়েছে।সেই কাপা কাপা কন্ঠে শুধালো,
“বাসায় যাব আমি।”
ইউভান মাথা দুদিকে নাড়ায়,

“হুশশশশ প্রথমে তোকে খাবার খাইয়ে অন্যের খাবারের উপযোগী করতে হবে। দ্যান বাসায় যাব আমরা।”
আনায়া মুখ ঘুরিয়ে নেয় এক ঝটকায়।ঠোঁট কামড়ে ধরে, আর মনে মনে ভাবে এই লোকটা এত নির্লজ্জ কিভাবে হয়, আর আমি কেন পালিয়ে যেতে পারি না?সেই মুহূর্তে ইউভান কাউকে কল দেয়। মিনিট পাঁচেক পর দুজন গার্ড থালা ভর্তি খাবার নিয়ে আসে।সাদা ধবধবে দুধে ভেসে থাকা বাদাম, গরম গরম সেদ্ধ ডিমে হালকা মসলা ছড়ানো, একপাশে হালকা বাটার গন্ধে ভাজা চাইনিজ রাইস, পাশে চিকেন সুপে ভেসে থাকা ঝোললাগা মুরগির হাড়, আর ছোট ছোট ফল কেটে রাখা—ড্রাগন ফ্রুট, আপেল, পেঁপে। থালাটা যেন রাজকুমারীর জন্য সাজানো হয়েছে।
আনায়া বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল খাবারের দিকে।তখন তার মনে পড়ে যায় ওই দিনের কথা যেদিন ইউভান তাকে দুই প্লেট ভাত জোড় করে খাইয়ে ছিল। ভয়ে শুকনো ঢুক গিলে সে।এখন কি তাকে এসব কিছু খেতে হবে?
“আমি… খাব না।”

ইউভান চোখ রাঙিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,
“খাবি। খেতে হবে। বেয়াদবি করলেই থাপ্পড় মারবো।এত জোরে যে গালটা লাল হয়ে যাবে।”
আনায়ার চোখে জল চিকচিক করে উঠলো
“আমি বললাম না আমি খাব না।আপনি জোর করতে পারেন না।”
“আমি আরো অনেক কিছু করতে পারি দেখতে চাস?” বলেই ইউভান আনায়া বাহুদ্বয় আঁকে ধরে কোলের উপর বসিয়ে নেয়।আনায়া মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ইউভানের চোখে আগুন সে দুধের গ্লাসটা আনায়ার মুখের কাছে ধরে।আনায়া নাক সিটকে মাথা দূরে সরিয়ে নেয়। ইউভান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“চুপচাপ না খেলে আমি তোকে জঙ্গলে রেখে আসবো। আই সুয়্যার আনু আমাকে রাগাস না।”

আনায়াকে আর পাই কে?নাক বন্ধ করে ঢক ঢক করে দুধটুকু খেয়ে নিল।আর যাই হোক সে জঙ্গলে যেতে চায় না। মনে মনে ইউভানকে গালি দিতে মোটেও ভুলেনা সে।ইউভান সেদ্ধ ডিম তুলে গালে দেয় আনায়ার।আনায়া এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। সে মুখ সরাতে চাইলে ইউভান জোর করে ঠেলে ডিমটা মুখে ঢুকিয়ে দেয়।আনায়ার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এ কোন ধরনের মানবিক অত্যাচার? বুকে কষ্ট জমা রেখে সে দিনটা গিলে ফেলে। ইউভান তাতে থামে না একটা খাবার শেষ হওয়ার পরে আরেকটা খাবার আনায়ার মুখে পুরে দিচ্ছে। যেন সে একদিনেই আনায়াকে খাইয়ে মোটা বানিয়ে ফেলবে। দীর্ঘ এক ঘন্টা পর আনায়া এই খাওয়ার অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়।এক ঘন্টা ধরে ইউভান আনায়াকে কোলের উপর বসিয়ে সযত্নে খাইয়ে দিয়েছে।

তবে এই যত্নে আনায়ার ভালো লাগা উচিত? কিন্তু তার মোটেও ভালো লাগছে না বরং ভীষণ রাগ হচ্ছে। কারণ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে এভাবে জোর করে খাওয়ানোর জন্য। তবে রাগটা বুকে চাপা দিয়ে রাখল আনায়া।ইউভান এবার উঠে দাড়ায়।তারও বড্ড পরিশ্রম হয়েছে আনায়ার মতো বন্য জংলি প্রাণীকে সামলাতে।আনায়ার মন হঠাৎ অন্যদিকে ঘুরে যায়।তার মাথায় তানহার কথা ঘুরতে থাকে। আনায়া শিওর হওয়ার জন্য প্রশ্ন করে ইউভানকে,
“তানহা আপু কে আপনি বিয়ে…………
ইউভান আনায়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গর্জে ওঠে,
“ওই মেয়ের নাম তোর মুখে যেন আনতে আর দেখি আমি আনু।জানে মেরে ফেলব আমার সামনে ওই মেয়ের নাম নিলে।আই জাস্ট হেইট গার্লস মাইন্ড ইট। ”

আনায়ার হৃদয়ে বসন্ত বয়ে গেল। এমনি সময় ইউভনের ধমকে খারাপ লাগলেও আজকের বিষয়টা অন্য। তার যেটা বোঝার সে বুঝে নিয়েছে। হঠাৎ ইউভানের ফোনে একটি মেসেজ আসে। ইউভান সেটি দেখে ভ্রু কুচকায়। তারপর আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“আমাদের হাতে সময় নাই অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তাড়াতাড়ি চল বাসায় যেতে হবে।”
আনায়া কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগে ইউভান তার হাত টেনে নিয়ে যেতে থাকে। হতভম্ব হয়ে ইউভানের দিকে তাকায় সে।এতদিনে সব ঘৃণা অভিমান এক নিমিষে কিভাবে শেষ হয়ে গেল? ইউভানের প্রতি কেন সে এতটা দুর্বল? ইউভানের একটু ছোঁয়া আর যত্নে সমস্ত অভিমান বরফের নেয় গলে যায়। ওটা আনায়ার ঘৃণা না বরং অভিমান ছিল যা ইউভানের সংস্পর্শে এসে বিলীন হয়ে গিয়েছে।

অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া কারাগারের ভেতরে এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ভেতরে তীব্র শীত এবং শূন্যতা ছড়িয়ে রয়েছে। তখনই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে স্পেক্টর কৃষাণ। তাঁর সঙ্গী আর কয়েকজন পুলিশ, কিন্তু তিনি এগিয়ে যান একাই।কারাগারের ভেতরে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মহিলাটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাই সে।মহিলাটি শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলছে আর কি যেন বিড়বিড় করছে। কৃষান এবার ধীরে ধীরে মহিলাটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।হ্যাঁ এই সেই মধ্যবয়স্ক মহিলাটি যে ঐদিন পিহুকে ওদের থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে মহিলাটি চোখ তুলে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবার নিজে কাজে মনোযোগ হয়। কৃষান সেটা দেখে প্রশ্ন করে মহিলাটিকে,

“আপনি এক মাস আগে ওই বাড়িতে কী করছিলেন? ওই শিশু পাচারকারীদের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক ছিল?আপনি কিভাবে জানলেন পাচারকারীরা ওই বাড়িতেই আশ্রয় নিবে।আর কেনই বা আপনি ওই বাড়িতে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্যাস ব্লাস্ট করালেন?”
মহিলাটি ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকান। তার চোখের নিচে অন্ধকার। সে মাথা নেড়ে বলে,
“হুহু আগুন না ধড়ালে ওরা মেয়েটিকে ছিড়ে খেতো জানোয়ারদের মত।ওই মেয়েটিকে বাঁচানোর জন্যই আগুন ধরিয়েছি।আমি আর কিছু জানি না। আমি শুধু আমার মেয়েকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।”
কৃষানের চোখ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। তিনি সোজা তার দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করেন,
“তাহলে, আপনার মেয়ে কোথায়?কেই বা আপনার মেয়ে? ”
মহিলা একটুখানি মাথা নেড়ে, খুব ধীরে বলে,

মহিলা:
“হ্যাঁ, আমার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে সে তাকেই খুজছিলাম আমি।কিন্তু খুঁজে পেলাম না কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটি? আপনি পারবেন আমার মেয়েটিকে খুঁজে দিতে।আমার বড্ড ইচ্ছে হয় আমার মেয়েটিকে দেখতে। ”
কৃষান কিছু সময় স্থির থাকে। মহিলাটির বয়স অনেক হলেও কথার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। কথার মাঝে অন্যরকম একটি টান যেটা সচারচর বাংলাদেশের মানুষ বললে পাওয়া যাবে না।তারপর আরো একটি প্রশ্ন তোলে কৃষান,
“আপনার মেয়েকে খুঁজতে আমরা আপনাকে সাহায্য করবো। তবে এর জন্য আপনাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে।আপনি শিশু পাচারকারীদের সম্পর্কে কিছু বলুন।ওদেরকে আপনি চেনেন?”
এবার, মহিলার চোখে একটু হাসি খেলে যায়, কিন্তু তা যেন কৌতুকের নয়, বরং এক ধরনের বিষণ্নতা আর নির্যাতনের আচ্ছন্ন হাসি। তার চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সে তার মেয়েকে ফিরে পাবে এটা ভেবে। হাসি থামতেই, সে চোখে চোখ রেখে বলে,
“না, আমি জানি না শিশু পাচারকারীরা কারা। তবে এটা জানি, বাচ্চাগুলোকে পাচার করে কোথায় নিয়ে যায়।”
কৃষান স্তম্ভিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কোথায়?”
মহিলা এবার তীক্ষ্ণ হাসি ফেলে, মাথা কিছুটা নুয়ে গিয়ে চোখে এক ধরনের শূন্যতা নিয়ে শুধায়,
“আমেরিকায়।আমার স্বামীর কাছে।”
কৃষান কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহীন হয়ে যান। এরপর কোনমতে নিজেকে সামলে প্রশ্ন করে,
“আপনার স্বামীর কাছে?বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আপনার স্বামী কি করে?”
মহিলাটি এবার উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। কৃষান এই হাসির কারণ বুঝতে পারেনা।হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে হাউমাউ করে কান্না করে মহিলাটি। কৃষান হতভম্ব হয়ে তাকায়।তখন মহিলাটি কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,
“ধর্ষণ করে।”
স্তব্ধ হয়ে যায় কৃষান। মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। কৃষান হয়তো সঠিক হাতিয়ারই ধরতে পেরেছে।বাচ্চাগুলোকে ধর্ষণ করে? ১০ বছর নিচু বয়সী বাচ্চাদেরকে কিভাবে ধর্ষণ করে?সব প্রশ্নের উত্তর অজানা কৃষানের। এবার সে সবকিছু জানতে পারবে এসব কিছু মূলে কে রয়েছে।সে মহিলাটির দিকে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে মারে,
“কে আপনার স্বামী? নাম কি তার?”
মহিলাটি বিষন্ন চোখে তাকিয়ে উত্তর দিল,

” সাইন্টিস্ট ক্রিসটান ক্যাসিনো।”
কৃষান চমকে ওঠে। নামটা তার খুব পরিচিত, যেন কোনো এক দূর অতীত থেকে ফিরে এসেছে। তার মনের ভেতরে কোনো অজানা উদ্বেগ জেগে ওঠে। সে জানে এই মুহূর্তের মধ্যে কিছু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে।সে অবাক কণ্ঠে সে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“আপনি একজন ধর্ষকের স্ত্রী? সে এখন কোথায় আছে? আপনি জানেন? তার কোন খোঁজ দিতে পারবেন? অথবা তার সম্পর্কে আরও কিছু বলতে পারবেন?”
মহিলাটির গলা শুকিয়ে আসে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়ার পর, সে মৃদু ভাবে বলল,
“সে কোথায় আছে, সেটা জানি না তবে তার সম্পর্কে সবকিছু বলতে পারব। তার আগে আমাকে একটু পানি খাওয়াবেন। বড্ড তেষ্টা পেয়ে গেছে।”
মুহূর্তেই কৃষান নিজ হাতে পানি নিয়ে এসে মহিলাটির দিকে এগিয়ে দেয়। মহিলাটি এক পলক না তাকিয়ে গ্লাসটি গ্রহণ করে, ধীরে ধীরে পানির শীতল ঢোঁক গলায় নামাতে থাকে। পানি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার তৃষ্ণা মিটে যায়।কৃষান কপাল ভাঁজ করে বলে ওঠে,

“আপনার নাম তো জানতে পারলাম না?কোথায় থাকেন আপনি?”
এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে একটি অদ্ভুত শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ে। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে যেন ভারী কিছু বুক থেকে বের করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তারপর, শান্ত কণ্ঠে, সে বলে,
“আলিসা রোজ। আমেরিকা আমার জন্মস্থান।”
কৃষান চুপচাপ তার দিকে তাকায়, সে গভীর রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। তার মন এক মুহূর্তে বিভ্রান্ত হয়ে যায়, তবে একই সঙ্গে কিছুটা আগ্রহও তৈরি হয়। সে ধীরে ধীরে আবার প্রশ্ন করে,
“আপনার এবং আপনার স্বামীর অতীত সম্পর্কে জানতে চাই।বাচ্চাগুলোকে কেনই বা ধর্ষণ করে সব কিছু বলুন? সবকিছু বলুন।”
আলিসা চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তার চোখে গভীর এক শূন্যতা, যেন কোন স্মৃতির বোঝা তাকে অনেক বছর ধরে কষ্ট দিয়ে আসছে।মুহূর্তে গভীর শ্বাস টানতে টানতে সে ঠোঁট ফাক করল।

~~অতীত~~
আমেরিকার নিউওয়ার্ক শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে আলিসা। বয়স তখন মাত্র ২০ বছর তার।তার পরিবার সাদামাটা, কোন বিলাসিতা নায়। তবে ছোটবেলা থেকেই আলিসার মধ্যে কিছুটা আলাদা ভাবনা যা তাকে অন্যদের থেকে সবসময় ভিন্ন করে তোলে। আলিসা সর্বদা নিরব থাকতে পছন্দ করে। নিত্যদিনের মতোই সে ভার্সিটির মাঠ দিয়ে হেঁটে ক্লাসরুমের দিকে এগোচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে পেছন থেকে কেউ একজন এসে চোখ বন্ধ করে ফেলে। আলিসা মুচকি হেসে বলে,
“জেনি আমি জানি এটা তুই, তাই লুকোচুরি বন্ধ কর।”
জেনি মন খারাপ করে আলিসার সামনে এসে দাঁড়ালো। এরপর গাল ফুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কিভাবে আমাকে প্রতিবার চিনে ফেলিস বলতো?”
আলিসা মুচকি হাসে কোন উত্তর দেয় না। জেনি পুনরায় আনন্দে উচ্ছ্বাসে জিজ্ঞাসা করে,
“আলিসা, তুই কি কখনও প্রেমে পড়েছিস?”
আলিসা একটু হেসে বলল,

“প্রেমে তো পড়া হয়নি, কিন্তু এমন কাউকে ভালোবাসতে চাই যে পৃথিবীর সবার থেকে আলাদা হবে।”
জেনি হাসতে হাসতে বলল, “পৃথিবীর সবাই মানুষ আলাদা কেউ কিভাবে হবে?”
আলিসা দীর্ঘ দৃষ্টিতে জেনির দিকে তাকিয়ে শুধালো, “আমি চাই, যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসব, সে যেন অন্যদের থেকে ভিন্ন হয়, যেন তার মধ্যে এমন কিছু থাকে যা সাধারণ মানুষদের মধ্যে নেই।”
এতটুকু বলার পর আলিসা সেখান থেকে প্রস্থান করে। জেনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে যে আলিসা রাগ করেছে। এটা আলিসার জন্মগত স্বভাব তার কথার বিরুদ্ধে দ্বিমতকে পোষণ করলে মুহূর্তে রেগে যায় সে।জেনির এই রাগ সহ্য করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ভার্সিটি শেষের নিত্যদিনের মতো আলিসা হোস্টেলের পথে ফিরছিল।

পথটা কিছুটা একঘেয়ে, তার পরিচিত রাস্তা, যা সে প্রায় প্রতিদিনই হাঁটে হোস্টেলে যায় ।হাতে হাতে হঠাৎ আলিসার কানে কারোর গোংরানির আওয়াজ পৌঁছায়। মুহূর্তে এসে সতর্ক চোখে পাশে জঙ্গলে তাকায়। মূলত জঙ্গল থেকে আওয়াজটা আসছে। জঙ্গলটি একেবারে শুনশান কোন মানুষের উপস্থিতি নেই। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে সে জঙ্গলের দিকে পা বাড়ায়। বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে।কিন্তু অবাক করার বিষয় হল আলিসার একটুও ভয় করছে না। সে নির্বিকার হেঁটে চলেছে। গোমরানি এবং চিল্লানোর আওয়াজ আরো স্পষ্ট হয়।আওয়াজটা গাছের আড়াল থেকে আসছে। কিন্তু এই শব্দের ভেতরেও আলিসার কানে বারবার বাজছে গোংরানি আর ভাঙা ভাঙা চিৎকারের আওয়াজ।

আলিসা সতর্কভাবে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে আসে। গাছের পাতাগুলোর ফাঁক করার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে নির্মম দৃশ্য ফুটে উঠে। একজন তরুণীকে নির্মমভাবে মাটিতে ফেলে রেখেছে এক পুরুষ।তরুণীটির পোশাক ছেঁড়া, শরীর কাঁপছে। মুখে রক্ত, কান্নায় তার গলা ভেঙে গেছে। আর সেই নরপিশাচ নির্মমভাবে ভোগ করছে তরুনীটিকে।
আলিসা টু শব্দ করলো না বরং এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই ধর্ষকের পানে।হঠাৎ তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

গাড়ির ভিতরে পুরোটা নিস্তবতা। শুধু ইউভানের মনোযোগ কেবল গাড়ি চালানোতে আর আনায়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।তার মনটা ভীষণ উরু উরু আজ।এতদিনের মনে জমে থাকা অভিমান আজ নিঃশ্বাস হয়ে গিয়েছে। আনায়া অতটা অবুঝ না যে সে বুঝতে পারবে না ইউভানের তার প্রতি এতটা যত্নশীল হওয়ার কারণ। সে নিরবে মুচকি হাসে।
চারপাশে অন্ধকার আর নীরবতা ঘিরে রয়েছে। ইউভান হঠাৎ এই নিস্তবতাকে ভেঙে বলে ওঠে,
“মাই ব্ল্যাক ওয়াইট পান্ডা। ”
আনায়া এক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায় চোখ বড় বড় হয়ে একদৃষ্টিতে ইউভানের দিকে তাকায়। ইউভান ঠোঁট কামড়ে হাসে। আনায়া লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তার কান গরম হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। চোখ মাটিতে নেমে আসে। একটা মানুষ এতটা নির্লজ্জ কিভাবে হতে পারে? “উফফ অসভ্য ফকস্টার কোথাকার।” আনায়া মনে মনে বলে।
ইউভান আড় চোখে আনায়ার লজ্জা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে,

“তুই এত রেড হয়ে যাচ্ছিস কেনো?তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস সানসাইন?”
আনায়ার ঠোঁট কাপতে থাকে। অন্যদিকে তাকিয়ে হাফসাফ করে।
” আ আমি ক কেন লজ্জা পাবো আজব।”
ইউভান বেশ মজা নিচ্ছে সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে আবার কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলে,
“কারণ আমি লজ্জা দিচ্ছি তাই। ”
আনায়া মুহূর্তের জন্য ইউভানের দিকে তাকায়। বুকের ভেতরটা ধক ধক করছে। এতটা লজ্জা সে সারা জীবনও পাইনি। এই লোকটাকে তাকে আজকে লজ্জা দিয়ে মারার প্লান করছে। আনায়া ঠোট চেপে বলে,
” কেন করছেন এমন?”
ইউভান আনায়ার দিকে না তাকিয়ে কিছুটা নেশাক্ত কন্ঠে বলে,

“আমি আরো অনেক কিছুই করতে পারি সানসাইন ।কোন এক অমাবস্যার রাতে গোপনে তোর আত্মার ভিতরে প্রবেশ করে, তোর নিঃশ্বাস, হৃদয় সব কিছু চুরি করে আনব তুই জানতেও পারবি না।”
আনায়ার নিশ্বাস আটকে আসে এমন কথা শুনে। ইউভান ভাই কেন এমন কঠিন কথা বলে তাকে? সে যে এই কথাগুলোই সামলাতে পারে না। আনায়া মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। ঠান্ডা বাতাস জানালাতে প্রবেশ করছে বাতাসের মিষ্টি ঘ্রাণের সঙ্গে ইউভানের শরীর থেকে আসা ম্যান্ডারিন ফলের মিষ্টি ঘ্রান নাকে বাড়ি খাচ্ছে তার। সবকিছু মিলিয়ে অস্থির পরিবেশ তৈরি হয়েছে।হঠাৎ নীরবতা ভেঙে ইউভান গাড়ি চালাতে চালাতে খালি গলায় ঘোর লাগানো কন্ঠে গাইতে থাকে-

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১২

কে জানে তু মেরে ইরাডে, লে জাউঙ্গা সাসে চুরাকে🎶
কে জানে তু মেরে ইরাডে 🎶
লে জাউঙ্গা সাসে চুরাকে 🎶
দিল কেহেরায়ে গুনেগার বানজা 🎶
বারা চেয়ান হে ইন গুনাহোসে আগে🎶
আনায়ার মুখে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে, জানালার দিকে কিছুটা হেলে যায়।মাথা কাজ করে বাইরের দিকে তাকায়। তার হৃদয়ে অস্থিরতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে, প্রতিটি শ্বাসে গলগল করে অনুভূতির নেশা ছড়িয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে এক অদৃশ্য চাপ অনুভূত হচ্ছে, যার নাম সে নিজেও জানে না। কি নাম দেওয়া যায় অনুভূতিকে ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা নাকি অদৃশ্য আসক্তি?

আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৪