আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৪
প্রীতি আক্তার পিহু
—”আনায়া তোমার সাথে কি করছে কোথায় পেলে তুমি ওকে? আমরা বাসার সবাই কথা চিন্তা করছিলাম তার কোন ধারনা আছে তোমার?এতদিন কোথায় ছিলে বাসায় আসোনি কেন? সবকিছু ছেলেখেলা পেয়েছ যখন মন যা চাইবে তাই করবে?আমাদের কথার কী কোনো দাম নেই তোমার কাছে?চুপ করে কেন আছো উত্তর দাও ইউভান।” গম্ভীর কন্ঠে কথাগুলো বলে আহসান চৌধুরী।
ইব্রাহিম চৌধুরী গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে আছে। যেখানে বড় ভাই কথা বলছে সেখানে তার কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই বলে সে মনে করে।
ইউভান স্টিল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার হাভবাভ দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন কথায় তার কোন কিছু যায় আসে না।আনায়া ইউভানের পেছনে গুটি ছুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভাবতেও পারিনি সে। এরই মধ্যে সায়মা বেগম আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
” তোর এই অবস্থা কেন আনায়া জামা কাপড় কোথায়?”
এবার সবার নজর যায় ইউভানের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আনায়ার উপর। আনায়া হাফসাফ করতে থাকে কি বলবে বুঝতে পারছে না। পরিবারের সামনে এরকম বাজে পরিস্থিতি আগে কখনো হয়নি। সে এবার আড় চোখে ইউভান পানে তাকায়।ইউভান আনায়ার দিকে না তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
” আনু উপরে যা।”
সবাই থ মেরে যায় ইউভানের কথায়। আহাসান এবার রাগ আটকে রাখতে পারে না সে এবার চিৎকার করে বলে,
“ও কেন উপরে যাবে? ও তোমার সঙ্গে কি করছিল সব প্রশ্নের উত্তর দাও আগে।”
ইউভান এবার চোখ বন্ধ করে ঘাড় কাত করে আনায়ার পানে তাকিয়ে পুনরায় বলে,
“তুই উপরে যাবি নাকি আমার হাতে থাপ্পড় খাবি কোনটা?”
আনায়া ভয়ে চুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,
“ভা ভাইয়া ওই।”
ইউভান এবার উচ্চস্বরে ধমক দিয়েয়ে বলে ওঠে,
“থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেবো বেয়াদব। উপরে যা আর এক সেকেন্ড তোকে নিচে দেখলে তোর পা ভেঙে দিব আমি।”
সবার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। আনায়াকে আর পাই কে? সে এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। দুনিয়া গোল্লায় যাক আগে তার নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে। ইউভান আর তার ধমককে জমের মতো ভয় পাই সে।সবাই আনায়ার যাওয়ার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। যে মেয়ে কারোর কথা শুনে না সেই মেয়ে ইউভানের এক ধমকে কথা শুনলো।
ইউভান এবার তার বাবা চাচাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। সবাই রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইব্রাহিম চৌধুরী এতক্ষন চুপ থাকলেও সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে ইউভানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি কি আমাদের সারারাত এখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাও? আমাদের প্রশ্নের উত্তরগুলা দিয়ে দিলেই তো হয়ে যাচ্ছে? কোথায় ছিলে ৩০ দিন তুমি কেন বাসায় আসোনি একবারও? আনায়া এত রাতে তোমার সাথে কি করছে কোথায় পেলে তুমি ওকে?”
ইউভান এবার আয়েশ করে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে।আহসান ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়। হাতে থাকা ফোন উঠিয়ে কাউকে কল দেয়। আহসান থান এবার এসব দেখে আরও বেশি রেগে গিয়ে বলে,
“তোমার মধ্যে বিন্দু পরিমাণ কমনসেন্স নাই। এখানে বড়রা তোমাকে একের পর এক প্রশ্ন করছে আর তুমি আরামে বসে কাউকে কল দিচ্ছ, এখন কি তোমার নিজের পার্সোনাল কাজ করার সময়? আদব কায়দা কি সবকিছু ভুলে গিয়েছো তুমি?”
ইউভান তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“আদব কায়দা ছিলই বা কবে আমার মধ্যে? ছোটবেলা থেকে কেউ কখনো শেখায় নি তাই এই শব্দ আমার কাছে অপরিচিত। ”
আহসান চৌধুরী চুপ হয়ে যায় পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইব্রাহিম চৌধুরী ইশারা দিয়ে থামিয়ে দেয়।তৎক্ষণ বাড়ির সদর দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ড্রাইভার প্রবেশ করে। সবার চোখ সেদিকে যায়।আহসান খান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
“একে এখানে ডেকে কি প্রমাণ করতে চাইছো তুমি ইউভান?”
ইউভান ফোন স্কল করতে করতে উত্তর দিলো,
“আপনাদের বাড়ির ড্রাইভার আপনাদের বাড়ীর গাড়ি কোথায় সেগুলোর কোনো খোঁজখবর রাখেন আপনারা?বাসার গাড়ি যে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে এই খবর কি আপনারা জানেন? মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আনুকে একা রেখে ড্রাইভার কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে এসব খবর রাখার দায়িত্ব কি আপনাদের না?
সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় গাড়ি এক্সিডেন্ট কারণ মাথায় কিছু ঢুকছে না। তখনই ড্রাইভার মাথা নিচু করে বলে,
_”ক্ষমা করবেন স্যার পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল যে কিছু চিন্তা-ভাবনা করার সময় পায়নি। আসলে গুন্ডারা গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল তখন আনায়া ম্যম গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যায় আর আমিও পালিয়ে যাই। কিন্তু পরক্ষণে এসে আমি গাড়িও পাই না আর না পাই আনায়া ম্যমকে।আমি ভেবেছিলাম হয়তো আনায়া ম্যাম বাসায় চলে এসেছে আমি বুঝতে পারিনি গাড়িটার ব্রেক ফেল হয়ে খাদে পড়ে যাবে। ”
সবার মাথায় বড়সড় একটা বাচ পড়ে। ইউভান হাতের ইশারায় ড্রাইভারকে চলে যেতে বলে, পরক্ষনেই ড্রাইভার সেখান থেকে চলে যায়। ইব্রাহিম এবার চিন্তিত কন্ঠে বলে,
—”তুমি আনায়াকে কোথায় পেলে?গাড়ি খাদে পড়ে গিয়েছে মামনির কিছু হয়নি তো? ”
ইউভান সরু দৃষ্টিতে তার চাচার দিকে তাকিয়ে আওড়ায়,
—”আমি ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ চোখে পড়ে আনুর গাড়ি উল্টাপাল্টা ভাবে রাস্তাতে যাচ্ছে। তখনই আমি গাড়ির পেছনে আর সঠিক সময়ে ওকে গাড়ি থেকে আমার গাড়িতে নিয়ে আসি। পরেরবার থেকে একটু খেয়াল রাখবেন সব সময় আমি থাকবো না আপনাদের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য।”
সবাই অনুতপ্ত আহসান চৌধুরী কি বলবে বুঝতে পারছে না তারই ভুল। বিষয়টা খেয়াল রাখা উচিত ছিল তার। তারপরও সে গম্ভীর মুখে ইউভানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
—”সব বুঝলাম কিন্তু এই ৩০ দিন তুমি কোথায় ছিলে?”
ইউভান উঠে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্য কন্ঠে উত্তর দিল,
“আমার জন্য এতটা চিন্তা করে আপনাদের সময় নষ্ট করবেন না অনুগ্রহ করে। আসলে অভ্যস্ত না আমি কারণ ছোটবেলা থেকে কেউ এভাবে চিন্তা করেনি তো যে আমি কোথায় আছি কি করছি বা না করছি তাই বললাম।”
সেই মুহূর্তে আয়ান অফিস থেকে বাসায় প্রবেশ করে। ইউভানকে বাসায় দেখে কিছুটা অবাক হয় আয়ান।
সাইমা বেগম এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে সবকিছু শুনছিলেন কিন্তু এমন কথায় তার চোখের পানি আটকে রাখতে পারলেন না। ইব্রাহিম চৌধুরী থ মেরে যাই। আহসান চৌধুরী চুপ তার মুখ থেকে আর কোন কথা বের হয় না ছেলের মুখ থেকে এমন কথা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ইউভান কোন কিছুকে পাত্তা না দিয়ে উপরে চলে যায়।
আয়ান খুব ভালো মতোই বুঝতে পেরেছে বাসায় আবার নতুন করে কোন ঝামেলা হয়েছে।সে বাসার কারো সাথে কোন কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ইউভানের রুমের উদ্দেশ্যে। ইউভানের রুমের দরজার কাছাকাছি পৌঁছানোর ঠিক আগমুহূর্তে আয়ানের পা থমকে যায়।
হঠাৎই তার চোখ পড়ে পাশের রুহির ঘরের দরজার দিকে। দরজাটা পুরোপুরি বন্ধ ছিলো না, একটু ফাঁক ছিলো। কী মনে করে আয়ান ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে আসে।
রুহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে চোখ গভীর বনধুর চাঁদের দিকে।মনের মধ্যে তার প্রেমের হাওয়া বইছে তার।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়াতে ফোন বের করে পিহুর নাম্বার খুঁজে বের করে কল দেয়।
পিহু বিষন্ন মনে বিছানায় শুয়ে ছিল।হঠাৎ ফোনটা কাঁপে তার।সে তড়িৎ বেগে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে স্ক্রিনে রুহির নাম।হতচকিত হয়ে ফোনটা ধরে একটু কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“কিরে রুটি? এতদিন পর মনে পড়ল আমাকে?”
ওপাশ থেকে রুহির নিঃশ্বাসের আওয়াজ।সে নিঃশব্দে হেসে আস্তে করে ফিসফিস করে বলে,
“পরটা তুই জানিস? আমি প্রেমে পড়েছি।”
পিহুর চোখে এক মুহূর্তে ঝিলিক মারে।কপালের চুল সরিয়ে একটু সোজা হয়ে বসে গলাটা নিচু করে বলে,
“কবে? কখন ? কীভাবে?কার প্রেমে পড়েছিস রে তুই?”
রুহির হাসির শব্দ ভেসে আসে ভেজা পাতার মতো মৃদু,
“পায়েসের প্রেমে…”
পিহু এক ঝটকায় শুয়া থেকে উঠে পড়ে চিৎকার করে বলে,
“কি বললি! পায়েস? কাকে তুই পায়েস বলছিস?”
রুহি চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওর হাসিটা দেখলে মনে হয় জোছনার ভিতরে ঝিকিমিকি কিছু মেশানো আছে। আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি, কখন যেন ছেলেটার মুখ চোখের ভিতর গেঁথে গেছে।”
পিহু হেসে গড়িয়ে পড়ে বিছানায়,
“ওহ গড! তোকে কে বলছে এত সিনেমা দেখতে? নাম বল নাম, আমি দেখে নেই পায়েসটা দেখতে কেমন।”
রুহি একটু লাজুক ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,
“নামটা এখনই বললে পায়েস গলে যাবে বুঝলি।”
পিহুর গলায় অভিমান মিশানো কন্ঠে শুধালো,
“তুই তো আগেই বলছিলি, প্রেম-ট্রেম লুকানোর জিনিস না আমি পড়লে জানিয়ে দিবো।এখন নিজেই লুকাচ্ছিস আমাদের কাছ থেকে?”
রুহি ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
“বলব সময় হলে। আগে পায়েসকে আমার মনের কথা জানাই যে আমি তাকে ভালোবাসি তারপর।”
হঠাৎই পিহুর চোখে এক ঝলক জল এসে থামে।সে ফোনটা শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বলে,
“ভালোবাসা জিনিসটা কি জানিস রে রুহি? কারো নাম মুখে আনতেই বুকের মাঝে ব্যথা জেগে ওঠে, আর কারো নাম শুনলেই ব্যথা হয়।”
রুহি থেমে যায়। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ।তারপর আবার আস্তে করে বলে,
“তোর ব্যথার নাম কি পিহু?”
পিহু তখন চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে সে নিঃশব্দে কলটা কেটে দেয়।বুকের বাঁ পাশটায় অজানা ব্যথা উঁকি মারে।চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দুই জোড়া নীলমণি ওয়ালা চোখ।
অপরদিকে,
রুহি ফোনটা কানে রেখে পেছনে ঘোরে।আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখে চমকে যায়।তার চোখ একদম বড় বড় হয়ে যায়, গলার স্বর আটকে যায়, মুখ শুকিয়ে ওঠে।
“আ… আয়ান ভাই ?”
তার গলা কাঁপে চোখে ভয়। রুহি বেশি ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে আয়ান সব কথা শুনে ফেলল নাকি?শুনে ফেললে কি হবে? আয়ানের শিরা গুলো ফুঁলে উঠেছে কপালে। সে একটাও শব্দ করছে না, শুধু তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে রুহির চোখের গভীরে।
রুহির বুকটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে।রুহি নিজেকে শান্ত করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়ান সজোরে থাপ্পর মারে রুহির গালে।রুহি ছিটকে যায় একপাশে।
সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। হাতটা গালে উঠে যায় স্বাভাবিকভাবেই। সে বলার চেষ্টা করে কিন্তু শব্দ আটকে যায় গলায়। বুকের মধ্যে ধক ধক করছে যেন ভেতরে কেউ কাঠি ঘুরাচ্ছে।তৎক্ষণ আয়ান গর্জে ওঠে,
“তুই অন্য কাউকে?লজ্জা করল না এসব বলতে?”
রুহি চমকে ওঠে। কি উত্তর দিবে সে বুঝতে পারে না। এই প্রথম আয়ান তার গায়ে হাত তুলল।আয়ান অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল রুহির পানে।আয়ানের মাথায় একটাই শব্দ ঘুরছে পায়েস… পায়েস… আর ওর হাসি।
সেই শব্দটা যেন রুহির মুখ থেকেই ছুরি হয়ে গেঁথেছে আয়ানের বুকে।আয়ানের চোখে জল নেই।কিন্তু তার দৃষ্টি এমন যে, যেন সে কাঁদতেও ভুলে গেছে।রুহি কোন প্রতি উত্তর করতে পারে না তার দম বেরিয়ে আসে।
আয়ান হয়তো আরো কিছু কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারলো না। বাক্য শেষ করতে পারে না। হাতদুটো মুঠো পাকিয়ে ফেলে, যেন নিজের অনুভূতিগুলো পিষে ফেলতে চাইছে। বুকের মধ্যে অসহ্য ব্যথা জমে উঠেছে, যেন একটা ভারী পাথর কেউ চেপে ধরেছে তার হৃদয়ে।আয়ান দাঁড়ায় না আর।এক মুহূর্তেই ঘুরে যায়। দরজাটা এত জোরে খোলে যে, সেটা দেয়ালের সাথে ঠোক্কর খেয়ে ধাক্কা খায়।দরজার শব্দে রুহি ভয়ের চোখ খিচে বন্ধ করে নাই। সে কাঁপা কাঁপা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে আয়ান নাই।সে ওইভাবে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।রুহি মনে মনে বলতে থাকলো,
“আমি কি খুব বেশি ভুল করে ফেলেছি? ভালোবাসাটা কি আমার জন্য অন্যায় আয়ান ভাই?”
রুহি নিঃশব্দে হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল।শূন্য চোখে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।মনের মধ্যে অজানা ভয় বাসা বাঁধছে তার। পিয়াসকে কী আদৌও পাবে সে এটা কল্পনা করে।আয়ানের এহেন হিংস্র ব্যবহারের অর্থ রুহির মাথায় ঢুকছে না।রুহির চোখেও জল জমে উঠেছে।সে আর সহ্য করতে না পেরে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে।
অতীত,,
আমেরিকা,নিউইয়র্ক সিটি।
আলিসা টু শব্দ করলো না বরং এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই ধর্ষকের পানে।হঠাৎ তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ভিডিও করতে লাগলো। তার চোখে আজকের এই দৃশ্যটা কোনো অপরাধ নয় বরং ভালোলাগা।সবাই যেখানে বীভৎসতা দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আলিসা সেখানে দৃশ্যটা উপভোগ করছে। তার ভালোলাগার ভাষা ভিন্ন। সে সবসময়ই এমন কিছুতে আকৃষ্ট হয়েছে যা নিষিদ্ধ, যা সমাজ অস্বীকার করে, যা মানুষ ভয় পায়।আলিসা ফোনের ক্যামেরাটা আরেকটু জুম করে দেখতে পাই,
মেয়েটির নিথর দেহটা মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ঠোঁটের কোণায় শুকিয়ে গিয়েছে রক্ত, হাতের নখগুলো মাটি খুঁড়ে গেছে।ধর্ষকটি দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, হাড়ভাঙা শান্তিতে। চোখে কোনো অপরাধবোধ নেই, বরং একধরনের আত্মতৃপ্তি। তার হাতে একটা জ্বালানি বোতল। সে নিচু হয়ে মেয়েটির শরীরের ওপর ছিটিয়ে দেয় তরলটা চুল, চামড়া সব কিছুতেই মিশে যায় কেরোসিনের গন্ধ।
তারপর সে পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে। এক ক্লিক, দুটি ক্লিক। হঠাৎই শিখাটা জ্বলে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন লেগে যায় মেয়েটির পোশাকে, তারপর শরীরে।মেয়েটি জোড়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে।আলিসা এমন চিৎকারে কিছুটা কেঁপে ওঠে।তবুও মনে সাহস নিয়ে ভিডিও করতে থাকলো সে।
মেয়েটির উন্মুক্ত শরীরের উপর শিখায় জ্বলে ওঠা কাপড়টি তীব্র শোঁ শোঁ শব্দ করে মিশে যায় চামড়ার সাথে।মুহূর্তেই মেয়েটির নিথর দেহটা কেঁপে ওঠে আগুনের ছোঁয়ায়। চামড়া ধীরে ধীরে ফেটে যায় ফুসকুড়ির মতো ফুলে ওঠে কিছু অংশ। তারপর সেই বুদবুদের ভেতরকার রক্তচাপ এক মুহূর্তে ফেটে ছড়িয়ে পড়ে কালচে তরল।মাটি ভিজে ওঠে তরল কালচে রক্তে। শরীরের মাংস গলে গলে চুঁইয়ে পড়ে মাটিতে।মেয়েটার চোখের পাতা গলে চোখের ভেতরকার অংশ সাদা অংশ বেরিয়ে আসে।আগুনের দাপটে বুকের পাঁজর এক এক করে ডেবে যেতে থাকে। হৃদপিণ্ডে আগুন পৌঁছানোর মুহূর্তেই মেয়েটির ছটফটানি থেমে যায়।হয়তো মেয়েটি হাঁপিয়ে গিয়েছে ছটফট করতে করতে। অবশেষে তাহলে মুক্তি পেল এই নরক যন্ত্রণা থেকে। গলাটা গলে পড়ে গেল একদিকে। চামড়া আর হাড়ের মাঝে আর কোনো সীমা নেই সব গলে গিয়ে একাকার।
আলিসা দাঁড়িয়ে আছে দূরে।ফোনে সে সব রেকর্ড করছে। কিন্তু তার চোখ স্ক্রিনে নয় চোখ সরাসরি সেই পোড়া দেহে। চারদিক ধোয়াই ভরে ওঠে। পোড়া চামড়ার গন্ধটা এত তীব্র যে সেটা আলিসার গলা পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়।সে এক হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে। এসব দৃশ্য পৈচাশিক হাসি দিয়ে উপভোগ করছে ধর্ষক ব্যক্তিটি। আলিসার বুকে কোনো গ্লানি নেই।তার ভেতরে এক পচন ধরেছে এক বিষাক্ত প্রেম।
এক অদ্ভুত মোহ তৈরি হলো আলিসার ভেতর। তার বুকের গভীর থেকে একটা ঠান্ডা ভালোলাগা বের হয়।সে ক্যামেরাটা জুম করে ধর্ষকের পানে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণ আলিসা ব্যক্তির মুখ স্পষ্ট দেখতে না পেলেও, এই মুহূর্তে ধোঁয়ার মাঝে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।আলিসা অদ্ভুত হাসি দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ব্যক্তিটির পানে।
ব্যক্তিটির চওড়া কপাল, ভ্রু-দুটো ঘন এবং একটু ভিতরের দিকে বাঁকানো। চোখ গাঢ় কালো তার ভেতর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। গালের হাড় দুটো উঁচু, ঠোঁট সামান্য বাঁকা, এবং সেই বাঁকানো ঠোঁটে এক মুহূর্তের জন্য পৈচাশিক হাসি খেলছে।আলিসা সম্পূর্ণ দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে নিল।এই মুখটাই আলিসার ভালো লেগে গেছে। এই চেহারাতেই সে খুঁজে পেয়েছে নিজের হারিয়ে যাওয়া অন্ধকারকে। এই ভালোলাগা প্রেম নয়,এটা হলো পয়জনাস অ্যাট্রাকশন নিষিদ্ধের প্রতি একধরনের অবচেতনে জন্ম নেওয়া ভালোলাগা। ব্যক্তিটির দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে।আলিসা সেটা দেখে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। ব্যক্তিটি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। আলিসা নিরবে সেদিকে শুধু চেয়ে রইল দীর্ঘ দৃষ্টিতে।
রাত তখন সাড়ে দশটা,
একটা পুরনো, জংধরা লোহার দরজা আলিসা ধীরে ধীরে ঠেলে খোলে। এরপর ধীর পায়ে বাসায় প্রবেশ করে। হঠাৎই আট বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে আলিসাকে জড়িয়ে ধরে।তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“পিপি মা আমাকে আজ মেরছে। শুধু একটু নুডুলস বেশি চেয়েছিলাম তাই আমাকে ঠেলে ফেলছে। আমার হাত কেটে গেছে।”
সে বলেই আলিসার হাত চেপে ধরে কাঁদতে থাকে।আলিসার বুক হাহাকার করে উঠে। ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রাখে সে।
“এইডন আমার বাচ্চা ভাই কাঁদে না। আমি চলে এসেছি না?সব ব্যথা সেরে যাবে তোমার হুমমম?”
এইডন মাথা দুই দিকে দুলাই।ঠিক তখনই ভিতর থেকে ভেসে আসে এক গলা
“এই মেয়ে।এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবি? ভিতরে ঢুকে রান্না কর। ফ্লোরার জন্য কোন রান্না আজ তুই করে যাস নাই।”
আলিসা তার সৎ মা জোভিয়ার দিকে তাকালো।তার সৎ মায়ের চুল সবসময় শক্ত করে বাঁধা, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, আর চোখে জ্বালা ছাড়া কিছুই নেই। মুখে সবসময় অভিযোগ আচরণে রাক্ষসীর মতো আচরণ।আলিসা এইডনের হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করল।আলিসাকে দেখে তার সৎ বোন ফ্লোরা তেড়ে এসে বলে,
“এই মেয়ে নাকি শয়তানের বাচ্চা! সারাদিন কোথায় ঘুরে বেড়াস? আজও যদি রান্না ঠিকঠাক না হয়, তবে তোর মাথার চুল আমি নিজে তুলে ফেলবো।”
আলিসা শক্ত চোখে তার বোনের দিকে তাকায়।
তার বড্ড ইচ্ছে হয় কয়টা কথা শুনিয়ে দিতে—তাও নিশ্চুপ থাকে।চোখের কোণে জমে থাকা কথাগুলো গিলে ফেলে।কারণ তার বাবা বহুত বছর আগেই মারা গিয়েছে।মায়ের মৃত্যুর পরে, আলিসা আর তার ভাই একটুখানি করে বাবার ভালোবাসা পেলেও, সেই ভালোবাসাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
সবকিছু বদলে যায় সেদিন, যেদিন সেই বিষাক্ত নারী তাদের জীবনে পা রাখে।সে একজন সৎ মা নয়, সে এক নিঃশ্বাসে সুখ চুষে নেওয়া বিষ।আলিসার জীবন আরো বিষাক্ত হয়ে ওঠে, সেদিন—যেদিন তার বাবা তাদের একা রেখে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে যায়।আলিসা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করার একমাত্র কারণ ভাই এইডন।
সব চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে সে মাথা নিচু করে, ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।এইডনের ছোট ছোট আঙুল আঁকড়ে ধরে আলিসা।রান্না করা শেষে একে একে সবাইকে খাবার সার্ভ করে দেয় আলিসা।
তারা খেতে খেতে হাসে, টিভিতে নজর রাখে, নিজেদের গল্প করে।আলিসা সবার খাওয়া না অব্দি ওখানে রোবটের মত দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন।যেন সেই বাড়ির মেয়ে না বরং কাজের লোক। কিন্তু কেউ একবারও আলিসাকে ডাকে না খাবারের জন্য। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন সবকিছু সয়ে গিয়েছে তার।
খাওয়া শেষে বাসন পরিষ্কার করে, পানি ঢালে।
এইডনেকে খাবার খাইয়ে দিয়ে নিজেও কিছুটা খেয়ে নাই।এরপর এইডনকে রুমে নিয়ে এসে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।আর গভীর চিন্তা করতে থাকে, হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় সে ধরফরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
ফোন বের করে ভিডিওটা আবার চালু করে আলিসা।তারপর সেই ব্যক্তিটির একটি স্ক্রিনশট নিয়ে একে একে AI-সহায়িত ছবির সার্চ ইঞ্জিনে আপলোড করে।
মিনিট দশেকের মাথায় একের পর এক ডেটা খুলে যায় তার চোখের সামনে।ধর্ষকের নাম পরিচয় ঠিকানা সব বায়োডাটা চোখের সামনে চলে আসে।সাইন্টিস্ট ক্রিসটান ক্যাসিনো সেই নির্দয় ধর্ষকের নাম।আলিসার ঠোঁটে এক প্রকার শীতলতা ভরা কাঁপা হাসি ফুটে ওঠে।সে একবার চোখ বুজে আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে আওড়ালো,
” আপনি আমার নিষিদ্ধ আসক্তি।নাহহহহ আমার নিষিদ্ধ চাহিদা আর ভালোবাসা।আমার চাহিদা আপনাকে পূরণ করতেই হবে ক্যাসিনো।”
বলেই উচ্চস্বরে হাসতে থাকে আলিসা।তার হাসির শব্দ চারপাশের দেয়ালটাও কেঁপে ওঠে।তবুও সে হাসে ছবিটির দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো হাসে।
রাত গভীর থেকে আরও গভীর হচ্ছে কিন্তু অষ্টাদশীর চোখে বিন্দুমাত্র নিদ্রা নেই। চারদিক নিস্তব্ধ অথচ তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এই যে, ইউভান ভাই কেন এমন করছে? কেন সে এতটা অধিকার দেখায়? কেন তার প্রতিটি কথায় প্রতিটি কাজে এতটা শাসন ঝরে?আনায়ার এরকম হাজারটা চিন্তাভাবনা নিয়ে রুমের মধ্যে পায়চারি করে। কিন্তু হঠাৎ তার চোখ পড়ে আয়নার দিকে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। এখনো সেই ইউভানের সাদা শার্টটিই পরে আছে। ঘাড়ের কাছে একটু টেনে শার্টের কাপড় নাকে নিয়ে শ্বাস টানে আনায়া।
এক মুহূর্তের স্পন্দন জোরে জোরে চলে। শার্টের ভাঁজ থেকে ভেসে আসা হালকা ম্যান্ডারিন ফলের ঘ্রাণে আনায়ার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ কাঁপিয়ে দিচ্ছে এক ধরনের অপরিচিত আকর্ষণে।আনায়া আয়নার দিক তাকিয়ে লাজুক হেসে বলে,
“উফফফ এই ঘ্রানটা বারবার আপনার কথা মনে করিয়ে দেয় ইউভান ভাই মনে হয় যেন আপনি আমার খুব কাছে।”
কিন্তু পরক্ষণেই মুখ গোমড়া করে বিরবির করে বলে,
“কিন্তু ব্যাটা খাট্টাস। একটা রস-কষহীন বুইড়া ফকস্টার। কখনো আমার সঙ্গে দু একটা ভালো কথা বলে না, যখনই কথা বলে মুখ দিয়ে যেন বিষ ঝরে হুহুহু।”
তৎক্ষণ মাথার মধ্যে কিছু একটা খট করে বাজে। আনায়া এক মুহূর্তও দেরি না করে পা টিপে টিপে দরজা খুলে বের হয়ে চারদিকে চোখ বুলাই কেউ আছে নাকি। গন্তব্য একটাই রস-কষহীন ইউভানের রুম। চুপচাপ ইউভানের রুমের সামনে এসে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই দরজার সামনে।
বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ হচ্ছে এই মুহূর্তে কেউ ধরে ফেললে সব শেষ।আনায়া এক হাত বুকে দিয়ে জোরে শ্বাস নেয় যখনই দরজা ফাঁক করতে যাবে তার আগেই রুমের ভেতর থেকে কিছু শব্দ তার কানে আসে।আনায়া থমকে দাঁড়ায় চেনা পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে হ্যাঁ এটা তো তার মামুনের গলার আওয়াজ। তাৎখান ইউভানের গলার কন্ঠ শোনা যায়।
—”আমি বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম তাই বলে এই না যে আমি বিয়েটা করব এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো ছোট মামনি। এই এনগেজমেন্টটা শুধু লোক দেখানো ছিল যেন তোমরা আমার কানের কাছে বিয়ে নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে না পারো।কিন্তু এখন অনেক হয়েছে এসব নাটক আমার সাথে বিয়ে নিয়ে কোন কথা বলতে আসবে না দয়া করে।” গম্ভীর কন্ঠে কথাগুলো বলে ইউভান।
সায়মা বেগম চিন্তিত কন্ঠে ইউভানের পানে তাকিয়ে বলে ওঠে,
” কিন্তু সবই বুঝতে পারছি একটিবার তোর বাবার কথা চিন্তা কর। তোর বাবা চায় তুই তানহা কে বিয়ে কর। শুধুমাত্র তুই তানহা কে বিয়ে করবি না বলে ঝগড়া করে একমাস বাইরে থাকলি?একবার আমাদের কথা চিন্তা করলি না?”
ইউভান কিছুটা বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
—”তাতে আমার কিছু যায় আসে না ছোট মামনি।”
“কিন্তু তুই যেটা চাচ্ছিস সেটা সম্ভব না একদিন না একদিন তোকে তো বিয়ে…….
আর কিছু বলতে পারে না সায়মা বেগম তার আগে ইউভান কর্কশ গলায় বলে,
—”অনেক হয়েছে এসব বিয়ে আমার সময় হলে আমি বিয়ে করবো। আর আমি কারোর কাছে কিছু চাই না,আমি আমারটা ছিনিয়ে নিতে জানি।আমি কারো ধার ধারি না মামনি। ন্যায়-অন্যায়যায়-অন্যায় আমার কাছে একটা তামাশা এর বেশি কিছুই না। ”
সায়মা বেগম কেঁপে উঠে ছেলের এরকম আচরণে। চোখ মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে ইউভানের। নুরজাহান আশ্চর্য বনে যায় ইউভানের এহেন পাগলামু দেখে। সে অবাক কন্ঠে বলে,
“এত সহজে পেয়ে যাবি? আর যদি কোন বাধা আসে তাহলে কি করবি তুই?যদি ওরা তোর প্রাণকে আঘাত করার চেষ্টা করে তখন কি করবি তুই একটিবার চিন্তা করে দেখেছিস?”
ইউভান বাঁকা হেসে এক হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে বলে উঠে,
“কেউ যদি আমার আর আামর প্রাণপাখির মাঝে দাঁড়ায় আমি তার আত্মাটাকেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেব। আমার প্রাণপাখির দিকে হাত বাড়ালে, আমি সেই হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেব। চোখ তুলে তাকালে, আমি সেই চোখ গর্ত থেকে বের করে ছুঁড়ে ফেলব। এই সায়ন চৌধুরী ইউভান তার প্রাণকে সবার থেকে রক্ষা করতে জানে।”
সায়মা বেগম থ মেরে যায়। তার মনে অজানা ভয় ডানা ঝাপটায়। আনায়া এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু শুনছিল দরজার আড়ালে। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন। আনায়া মনে মনে আওড়াতে থাকে,
“এর মানে ইউভান ভাইয়া ইচ্ছে করে বিয়েটা করতে চাইনি? সে তানহা আপুকে বিয়ে করতে চায় না বলে এক মাস বাসার বাইরে ছিল? আর প্রাণ পাখি কাকে বলল? আমাকে?”
পরক্ষণে আনায়া লজ্জায় দুই হাত মুখে দিয়ে বলে,
“ইশশশশ এর জন্য তিনি আমার ওপর এতটা অধিকার ফলান? আমার থেকে কোন ছেলে তাকালে, এজন্য তার এতটা খারাপ লাগে?”
অষ্টাদশীর হৃদয়ের রং লাগানোর জন্য ইউভানের এটুকু কথায় যথেষ্ট। আনায়া এদিক সেদিক তাকিয়ে হাফসাফ করছে আরেকটু ব্লাশ করছে লজ্জায় মুখশ্রী রক্তিম লাল হয়ে আছে তার। এরই মধ্যে সায়মা বেগম দরজা খুলে বেরিয়ে যায় আনায়া কিছুটা ঘাবড়ে দেয়ালের সঙ্গে আরেকটু চেপে দাঁড়ায়। এবার একটু উঁকি মেরে দেখে তার মামনি চলে গিয়েছে কিনা। হাফ ছেরে বাচে আনায়ার হঠাৎ মনে পড়ে যায় ইউভানের কথা।
তাও একটু সাহস সঞ্চয় করে পাশ ফিরে যখনই রুমের ভেতর উঁকি দিতে যাবে তার আগেই চোখ আটকে যায় দরজার ঠিক সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইউভানের উপর। গাঢ় কালো ট্রাউজার ঢিলেঢালা কাল শার্ট, হাতার বোতাম খোলা। চুল কিছুটা ভেজা কয়েকটা গোছা কপালে নেমে এসেছে। এক হাত পকেটে অন্য হাত বুকের সামনে ভাঁজ করা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনায়ার দিকে।
আনায়া চোখ বড় বড় করে তাকায় ইউভানের দিকে। অজানা ভয়ে কেমন হাত-পা আবাস হতে শুরু করে। সম্পূর্ণ ধরা পড়ে গেল ইউভানের হাতে।বোকা বোকা চোখের ইউভানের পানে চেয়ে রইল। তৎখান ইউভান নীরবতা ভেঙে ঠান্ডা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এত রাতে আমার রুমের সামনে উঁকিঝুকি কেন দিচ্ছিলেন ম্যাডাম?”
আনায়ার পুরো শরীর কেমন যেন থেমে যায় সে এখন কি বলবে কিছুই বুঝতে পারে না। সে কী করবে? পেছনে ফিরে পালিয়ে যাবে? নাকি কথা বলবে? কিন্তু মুখে যেন শব্দ আটকে গেছে। ইউভানের সেই চোখের দৃষ্টি যেন তাকে স্থির করে ফেলছে। সব বাধা পেরিয়ে আনায়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
“আ আমি আপনার শার্ট ফেরত দিতে এসেছি এখানে ইউভান ভাই। ”
ইউভান এবার মাথা একটু কাত করে চোখ নামিয়ে শার্টের দিকে তাকায় সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।
“শার্ট ফেরত দিতে এসেছিস তাহলে?”
আনায়া মাথা নাড়ে।ইউভান এবার দরজা থেকে সরে এসে আনায়ার দিকে কয়েক ধাপ এগোয়।
“তাহলে দিয়ে দে।”
আনায়া এবার সত্যিই থতমত খায়। এতক্ষণ সজ্ঞানে আসে সে ভয়ে উল্টোপাল্টা কি বকেছে বুঝতে পেরে নিজের উপর নিজেরই রাগ ওঠে। সে কিভাবে শার্ট দিবে সেটা পড়ে আছে সে। আনায়া চোখ নিচে নামিয়ে শার্টেটা হাত দিয়ে মুঠো করে চেপে ধরে বলে,
“মা মানে শার্ট তো আমার… মানে আমি পরেই এসেছি।”
ইউভান এবার ঠোঁটের কোণে আরও গভীর একটা হাসি নিয়ে বলে,
“হুু তাহলে খুলে দে।”
আনায়ার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যাই সঙ্গে সঙ্গে ।
“কি?”
ইউভান এক পা এক পা করে সামনে এগোই, আনায়া একটা এক পা করে পেছনে হটতে হটতে দেয়ালের সঙ্গে মিশে যায়। ইউভান দুই হাত দিয়ে দেয়াল ধরে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“শার্ট ফেরত দিতে এসেছিস না? তাহলে খুলে দে আমি নিজেই রেখে দেব।”
আনায়ার শরীর আরও জমে জমে যাচ্ছে হৃদয় স্পন্দন কেমন যেন উল্টাপাল্টা ভাবে চলছে।
“আ এখানে না মানে কীভাবে?”
“কেন কিভাবে শার্ট খুলতে হয় জানিস না তুই?”
“না মানে হ্যাঁ না মানে জানি কিন্তু ”
“কি না হ্যাঁ লাগিয়েছিস তুই? আই ক্যান হেল্প ইউ সানসাইন?”
আনায়া চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিশ্বাস যেন আটকে যাচ্ছে ।কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
“কি কিসের হেল্প?”
ইউভান ভীষণ মজা পাচ্ছে মৃদুস্বরে বলে ওঠে,
” কেন তোকে শার্ট খুলতে হেল্প করব এজন্যই তো এত রাতে এখানে এসেছিস তাই না?একা একা শার্ট খুলতে পারছিলি না বলেই তো আমার রুমে এসেছিস আমার সাহায্য নেওয়ার জন্য। যেন আমি তোকে খুলতে সাহায্য করি আই এম রাইট সুইটি?
আনায়ার লজ্জায় কান গরম হয়ে যায়।সে ঠোঁটে ঠোঁট চিপে বলে উঠে,
“ছি ছি অসভ্য বদমাশ লোক মুখে কিছু
আটকায় না। আমি কেন এসবের জন্য আপনার কাছ থেকে সাহায্য নিতে যাব হুমম?”
আনায়া রেগে ইউভানের হাত ঠেলে দূরে সরিয়ে সামনে এগোতে চাইলে, ইউভান পেছন থেকে এক হাত আনায়ার পেট বরাবর রেখে চাপ দিয়ে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নেই। আনায়া বরফের ন্যায় শীতল হয়ে যায়। ইউভান আনায়ার ঘাড়ে থুটনি রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,
“কি কি শুনেছিস সত্যি করে বলতো? আমার মনে হচ্ছে যেন একটু বেশি শুনে ফেলেছিস। যেগুলা হয়তো এখন শোনা একদম উচিত হয়নি তোর সানসাইন।”
আনায়া চোখ বন্ধ করে বুকের ভেতর ভয় ভালো লাগা খারাপ লাগা অনুভুতি উথাল-পাথাল করছে। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
“ক কই আমি কিছু শুনি নাই সত্যি। আমি তো মাত্রই আসলাম বিশ্বাস করুন আমি কিছু শুনি নাই।আমার কথা বিশ্বাস না হলে আমার কানকে জিজ্ঞাসা করুন।”
ইউভান কিছুটা ভ্রু কুচকায় তারপর আর একটু জোরদার করে আনায়ার পেটসহ কোমর এক হাতে আঁকড়ে ধরে পুনরায় বলে,
“ও আচ্ছা তাই কান কে বুঝি জিজ্ঞাসা করা যায়। কই আগে তো জানতাম না।এসব আজগুবি কথা কোথা থেকে আসে তোর মধ্যে?”
আনায়া বেচারা অসহায় হয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,
“ছেড়ে দিন না ইউভান ভাই আর আসবো না কখনো।”
ইউভানের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে আনায়াকে এক টান দিয়ে নিজের সামনাসামনি ঘুরে দাঁড় করালো। আনায়া লজ্জায় রক্তিম মুখশ্রী নত করে রাখেছে।ইউভান গভীর দৃষ্টিতে অষ্টাদশীর চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,
“ছেড়ে দেবার জন্য তো ধরিনি সানসাইন। আমার জিনিস আমার কাছে ফেরত দে তারপর যেতে পারবি। তার আগে না।”
আনায়া শার্টের কলার শক্ত করে ধরে ভয়ে ভয়ে বলে,
“কিন্তু ক-কীভাবে দেব…?”
ইউভান একপাশে মাথা কাত করে চোখ তার শার্টের দিকে নামিয়ে আনল। ধীর অস্থির করা গলায় বলে,
“তোর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে? ঠিক আছে সমস্যা নেই। আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি।শার্ট তো আমার তাই না তাই আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সেটি কেড়ে নিতে পারি। ”
আনায়া চোখ বড়করে তাকায়। দুই হাত দিয়ে ইউভানকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
“না না, আপনি না।”
ইউভান কথার পরোয়া না করে হাত বাড়িয়ে দেয় আনায়ার শার্টের বোতামের দিকে।সঙ্গে সঙ্গে আনায়া রোবটের মত শক্ত হয়ে যায়। ইউভানের চোখ অষ্টাদশীর ভীতু কাঁপা কাঁপা চোখের দিকে। এক এক করে দুটো বোতাম খুলে ফেলে। তৎক্ষণ আনায়া এক হাত দিয়ে ইউভানের হাত শক্ত করে চেপে ধরে থামিয়ে দেয়। নিচের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে,
“ক কী করছেন ইউভান ভাই?”
ইউভান এবার থেমে গিয়ে আনায়ার কানের কাছে মুখ এনে বলে,
“যেইভাবে তুই হাত ধরলি দেখে মনে হচ্ছে একটু বেশি অধিকার ফলাতে চাইছিস আমার উপর তাইনা সুইটি?”
আনায়ার মুখ লাল হয়ে গেল সে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেয়।ইউভান বাঁকা হেসে চোখ নামিয়ে দেখে আনায়া শক্ত হাতে তার পরনের শার্ট খামচে ধরে আছে।
“বুঝতে পারছি ছাড়তে মন চাচ্ছে না তোর। তোর গায়ে বেশ মানিয়েছে শার্টটা তাই না?”
— “এটা… এটা তো আপনার।”
ইউভান হালকা হেসে বলে,
— “হুঁ জানি। কিন্তু এখন তো এটা তোকে ছাড়তে বললে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবি।তাই এটা তোকে দিয়ে দিলাম যা।নিজের জিনিস তোকে দিয়ে দিলাম বলে এটা ভাবিস না এভাবে নিজের সবকিছু অন্যকে বিলিয়ে দিব হুমম।”
ইউভান আনায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে ঘোর লাগানো কণ্ঠে বলে,
—”এই সায়ন চৌধুরী ইউভান আবার কেড়ে নিতে খুব ভাল করেই জানে সেটা কোন জিনিস হোক বা বাঘের মুখে পড়ে থাকা কোন শিকারি।”
আনায়া চুপ হয়ে যায় সে বুঝে উঠতে পারে না এমন কথার অর্থ। সত্য কথা বলতে গেলে ইউভানের কোন কথার মানেই সে ঠিকমত বুঝতে পারি নাই আজ পর্যন্ত। ইউভান এবার আনায়াকে ছেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়। আনায়া হাফ ছেড়ে বাঁচে। এই বদমাশ ফকস্টার আজকে তাকে মনে মনে মারার প্লান করছে এটা সে ভালোমতো বুঝতে পেরেছে। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না এক দৌড়ে নিজের রুমের দিকে চলে আসে। ইউভানের রুম আনায়ার রুম একেবারে সামনাসামনি। ইউভান আনায়ার রুমের দরজার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায় কিছুক্ষণ, তারপর পেছন ঘুরে নিজের রুমের ভেতর যখনই ঢুকবে তার আগেই মেয়েলি কণ্ঠ শুনে থেমে যায়।
আনায়া দরজার ফাঁক থেকে মাথাটা চোরের মত বের করে বলে,
“বলছি শুনছেন?”
ইউভান পেছন ফিরে তৃক্ষ দৃষ্টিতে তাকাই অষ্টাদশীর দুষ্টু দুষ্টু চোখের দিকে।দুই হাত বুকে গুঁজে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“শুনছি ম্যাডাম।”
আনায়া দাঁত কেলিয়ে বলে,
“আমি কিন্তু সবকিছু শুনে ফেলেছি ।”
“কি শুনেছিস উমমমম?”
আনায়া লাজুক চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ওঠে,
“আপনার প্রাণপাখি হি হি হি হি”
ইউভান ভ্রু কুচকে চোখে এক গভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে বলে,
“আপনার মোটেও এখন এত কিছু শোনা উচিত হয়নি ম্যাডাম।”
আনায়া ঠোঁটের কোণে হাসি চেপে সোজা চোখে তাকিয়ে বলে,
“অবশ্যই উচিত হয়নি তাতে কি হয়েছে? আমি তো শুনে ফেলেছি।”
ইউভান এবার কিছুটা ঘাবড়ে যাই। কথা ঘুরানোর জন্য বলে,
“চুপচাপ এখন ঘুমাতে যা। আবহাওয়া ঠিক নেই বাইরে বৃষ্টি হবে।”
আনায়ার এই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ তার নাক-মুখ কুঁচকে আসে।কোথায় কি বলতে হয় এই বদমাশ ফকস্টার কিছুই জানে না।আর রোমান্টিক মুডের ১৪ টা বাজিয়ে দেয় সব সময়।
আনায়া তৎখান দরজা লাগিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“অসভ্য বদমাশ ফকস্টার কথায় কথায় শুধু থাপড়িয়ে গাল লাল করে দেব হুহু।রস-কষহীন বুইড়া ব্যাটা আমাকে পাত্তা না দিলে, তোর কপালে একটা শাকচুন্নি জুটবে দেখে নিস হুহু।”
রাত বারোটায়,
ঝড়ের ঠিক আগ মুহূর্তে জানালাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে, পর্দাগুলো বারবার বাতাসে আছড়ে পড়ছে দেয়ালে। বাতাসের দমক জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে এসে সারা ঘরে উষ্ণ একটা শিহরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে।আনায়া জানালার গা বরাবর ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে।সোনালি চোখ জোড়া জানালার বাইরে তাকিয়ে আাছে, যেন পৃথিবীর ভিতরেও আরেকটা গভীর পৃথিবী খুঁজছে আনায়া।আনায়ার চুলগুলো হাটুর নিচে নেমে এসেছে ঝোড়ো হাওয়ার ছোঁয়ায় পেছনে এলোমেলো হয়ে উড়ছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকের আগাম সুর বাজছে।আনায়া সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হঠাৎ তার মনটা নাড়া দিয়ে ওঠে।বাইরে যেতে হবে তার।
এখনই। ঝড় নামার আগে আকাশের সাথে দেখা করতেই হবে।মনের এই সুখ ইচ্ছাকে পূরণ করতেই আনায়া সব ভুলে ছাদে যাওয়ার সিঁড়িটা ধরে উপরে উঠে পড়ে।
ছাদে উঠেই থমকে যায় আনায়া।চারপাশে যেন সময় থেমে আছে। বাতাস শব্দ করে বয়ে চলেছে।আকাশটা যেন ক্ষেপে উঠেছে। আনায়া দুই হাত মেলে ধরে বাতাসকে অনুভব করতে থাকে।তার চুলগুলো দক্ষিণে ঝড়ের মত উড়ছে। তখনই আনায়া চোখ মেলে সামনে তাকায়। ছাদের রেলিংয়ের উপর বসে থাকা ছায়ামূর্তিটা হঠাৎ ধরা পড়ে তার চোখে।ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে আনায়ার।এত রাতে ছাদে কে আসতে পারে?মনের মধ্যে খানিকটা ভয় ও ডানা ঝাপটাই তার। তবুও বুকে সাহস সঞ্চয় করে আনায়া ধীরে ধীরে হাঁটে, রেলিংয়ের কাছে পৌঁছে যায়।ঠিক তখনই ছায়াটি রেলিং থেকে লাফ দিয়ে নামে।আনায়া ঘাবড়ে পিছুপা হয়। আকাশে বিদ্যুৎ চমকানির আলো ছায়া টিন মুখায়ব স্পষ্ট হয়।আনায়া অবাক হয়ে বলে,
“ইউভান ভাই।”
ইউভান এগিয়ে আসে। তার চোখে একই সাথে বিস্ময় আর কঠিন এক গভীরতা,
“এত রাতে এখানে কি করছিস তুই?”
আনায়া চমকে ওঠে। কিন্তু তার চোখ স্থির থাকে।
সে ধীরে করে বলে,
“আপনি… আপনি এখানে কেন?”
ইউভান কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়,
“আমি তোকে প্রশ্ন করেছি, আনায়া। তুই এত রাতে, এই ঝড়ের মুখে… একা এখানে কেন?”
আনায়া কোন কথার উত্তর দিতে পারে না।সে তো প্রকৃতি বিলাস করতে এসেছিল।কিন্তু এই বদমাশের খপ্পরে পড়ে সেটা পুরো পানি হয়ে গেল আনায়ার।আনায়াকে চুপ থাকতে দেখে ইউভান পুনরায় প্রশ্ন করে,
“কি হল কথা কানে যায় না তোর? এত রাতে এখানে কি করছিস?”
আনায়া ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে রইল ইউভানের দিকে।বাতাসে তার কিছু চুল চোখে এসে পড়ে, কিন্তু সে সরায় না। সে নিজের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় ইউভানের বা হাতে ধরা গিটারটার দিকে।চোখদুটি হঠাৎ যেন ঝলকে ওঠে।একটা কৌতূহল চাপা উত্তেজনা তার চোখে খেলা করে।পর মুহূর্তেই আনায়া নরম কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি আমাকে গিটার বাজানো শিখাবেন ইউভান ভাই?”
ইউভান একটু চমকে যায়। চোখ সরিয়ে তাকায় আনায়ার মুখের দিকে।
“কি বললি তুই?”
আনায়া ধীরে মাথা নিচু করে, আবার কাঁপা গলায় বলে,
“গিটার!আমি শিখতে চাই। আপনি বাজাতে পারেন আমি জানি। আপনি শেখাবেন আমাকে?”
ইউভান গভীর দৃষ্টিতে তাকালো অষ্টাদশীর মুখশ্রীর পানে।সে একটু নরম হয়ে ওঠে,
“তুই এত রাতে একা ছাদে এসে গিটার শেখার কথা বলছিস?”
আনায়ার ঠোঁটে মৃদু হাসি। কিন্তু সেই হাসির নিচে ঢেকে রাখা এক নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষা।সে ফিসফিস করে বলে,
“আপনার সুর শুনলে মন শান্ত হয়। আজ খুব দরকার ছিল সেই শান্তিটুকু শেখা। হয়তো সেই সুরে নিজেকে একটু হারিয়ে ফেলতে পারব নিজেকে।এই মুহূর্তে। ঝড় আসার আগেই শেখাবেন আমাকে?”
ইউভান স্থির তাকিয়ে রইল আনায়ার চোখে।একটুও না সরিয়ে। যেন সেই চোখের গভীরে কোনো হারানো।অষ্টাদশীর এহেন আবদার ইউভানের পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব।সে অন্য দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে এরপর পুনরায় হুইস্কির কন্ঠে বলে,
“তুই এত কঠিন কথা বলা শিখলি কীভাবে ।
আনায়া নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইল।সে নির্দ্বিধায় উত্তর দেয়,
“আপনার কাছ থেকে।”
ইউভান নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল।ইউভান একটু পেছনে সরে গিয়ে তার পিঠে থাকা গিটারটা নামায়। তারপর ছাদের রেলিং-এর পাশে থাকা ছোট একটা সিমেন্টের দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে সে।
“আয়,”
সে গিটারটা নিজের কোলে রেখে পাশে জায়গা করে দেয়।আনায়া ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসে। তাদের কাঁধ প্রায় ছুঁই ছুঁই, বাতাসে চুল উড়ছে দুজনের, কিন্তু চারপাশে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধ সুর বাজছে।ইউভান তার হাত ধরে গিটারের উপর রাখে।
“এইটা স্ট্রিং… এইভাবে ছুঁবি। আর এই ফিঙ্গারটা এখানে।”
ইউভান তার আঙুলগুলো নিজের আঙুলের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে গিটারের স্ট্রিং এর উপর রাখে।ইউভানের এমন মোলায়েম কন্ঠ শুনে আনায়ার হৃদপিন্ড যেন থেমে থেমে ধুকপুক করে। অনুভূতি গুলো চুম্বকের মতো ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছে তার।
তৎক্ষণ বাতাস আনায়ার কানের পাশে ফিসফিস করে ওঠে।তারপর হঠাৎ দূর আকাশে মেঘ গর্জে ওঠে।
আনায়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। বাতাসে চুল উড়ে ইউভানের মুখের ওপর পড়ছে। গিটারের স্ট্রিং গুলোতে হালকা টুংটাং আওয়াজ বেজে ওঠে।
একটা ছোট্ট ভুল টোকা, তারপর আরেকটা।
ইউভান মুচকি হেসে বলে,
“ভয় পাস না। সুর ভুল হতে পারে মন না।”
আনায়া মাথা ঝাঁকায়। এবার সে নিজেই হাত চালায়।
প্রথমে একটু কাঁপা কাঁপা হাত।প্রতি টোকায় আত্মবিশ্বাস জন্মায়।গিটারের টুংটাং আওয়াজ মিলিয়ে যায় চারপাশের বাতাসের সঙ্গে।তখনই আনায়ার মনের মাঝে আরেকটি ইচ্ছা উকি মারে। তার বড্ড ইচ্ছে হলো একটি গান গাইতে।আনায়ার কাঁধে ইউভানের চুলের হালকা ছোঁয়া লাগে।তার ঘাড় বরাবর ইউভানের নিঃশ্বাস পড়ে—হালকা, কিন্তু গভীর।শরীরের মধ্যে একটা শিহরণ খেলে যায়। ভালোবাসার টান আর তীব্র আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিশে যায় এই একটি মুহূর্তে।তারপর হঠাৎই, হঠাৎ করেই,আনায়ার ঠোঁট ফাঁকা হয়ে আসে।সে মনে ইউভানের প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে গান গেয়ে ওঠে,
❝ তুম যো গুচ্ছা ভি কারো তো
মুঝে পেয়ার লাগতা হে জানে কিউ?
মে তো জোভি কাহু
তুমেহ ইকরার লাগতাহে জানে কিউ,?
ছোড়ো ভি ইয়ে আদা,পাস আকে জারা,
বাত দিলকি কোই কেহে দোনা,
হে সোনা,হে সোনা,হে সোনা,হে সোনা❞
ইউভান নিঃশব্দে প্রতিটা সুর অনুভব করছিল।চারদিকের গুমোটো পরিবেশ। মেঘগুলো কনভিনশনের মতো জড়ো হচ্ছে একসাথে। ঝড় নামেনি ঠিক, কিন্তু সেই আগমনের মুহূর্তটা সব থেকে মুগ্ধকর দৃশ্য। আনায়ার হৃদয়ের ভিতরে তখন একরকম ঝড় বইছে।তার চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে সরতে সরতে গিয়ে থামলো গিটারের পাশে খোদাই করা একটা অক্ষরের উপর।খোদাই করা অক্ষরগুলো আনায়াকে চমকে দিল।সে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে রইলো। স্পষ্টভাবে লেখা—
“সোলবিট!”
আনায়া ধীরে ধীরে ইউভানের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,
“সোলবিট অর্থ কি ইউভান ভাই?”
ইউভান চোখ তুলে আনায়ার চোখে তাকালো। একরকম দৃষ্টির সংঘর্ষ যেখানে শব্দ নিষ্প্রয়োজন।তারপর সে উত্তর দিল,
” আত্মার স্পন্দন।”
আনায়া বুঝতে পারে না কিছু। তার মনে হাজারো প্রশ্ন। সে পুনরায় মুখ খুলে প্রশ্ন করার জন্য, কিন্তু ইউভান ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে থামিয়ে দেয় তাকে।এরপর অস্ফুটস্বরে শুধায়,
“হুশশশশশশশশ কোনো কথা নাহহ।বৃষ্টি নামবে এখনই আর এই অসময়ে তোকে আমি কাছে চাইছি না সুইটি। যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে, সামলাতে পারবি না তখন তুই।”
আনায়া শিউরে ওঠে। তার শিরায় শিরায় কাঁপুনি ধরে যায়।এটা কী হুমকি ছিল? ইউভান তাকে হুশিয়ার করলো।কিন্তু কেন? কি অঘটন ঘটার কথা বলছে ইউভান তাকে?আনায়া সরে দাড়ায়া।ইউভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন যদি তুই এখান থেকে না যাস, তাহলে
এই প্রাক-ঝড়ের লগ্নে তোর সর্বস্ব,তোর সমস্ত নিজস্বতা আমাতে হারিয়ে ফেলবি।তাই বলছি, সানসাইন চলে যা,এই মুহূর্ত থেমে যাওয়ার আগেই।না হলে এই লগ্নে আমি তোকে ছুঁয়ে দিলে,তুই আমার ভিতরেই নিঃশেষিত হয়ে যাবি
একবারেই, চিরতরে।”
আনায়ার হৃদয় ধ্বংসস্তূপের মতো কেঁপে ওঠে।
বাতাস যেন জমে আসে চারদিকে।তার বুকের মাঝে শব্দহীন বজ্রপাত হয়।মনের মধ্যে ছোট্ট ভীতু পাখি ডানা ঝাপটায়। সে এক পা পিছিয়ে আসে বুঝতে পেরেছে এক মুহূর্ত এখানে থাকলে নিজের সর্বস্ব হারাবে।কোন কথা গলা দিয়ে বের হয় না তার।আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দৌড়ে ছাদ থেকে প্রস্থান করে আনায়া। ইউভান তাকিয়ে রইল সেই চলে যাওয়া পথের দিকে নিঃশব্দে।তার ঠোঁটে একটুকরো হালকা হাসি খেলে।সে চাপা কন্ঠে হিসহিসিয়ে বলে,
“তুই এখনো আমাতে বিলীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত হোসনি, সানসাইন।তোর ভেতর এখনো আলো হারানোর ভয় আছে,কিন্তু আমি তো অন্ধকার।তাই আগে তোকে সব হারানোর ভয় দূর করতে হবে।পরক্ষণেই তোকে নিজের করে নিব আমি প্রমিস।”
ঝড় এসে পড়ার আগে, প্রাক-ঝড় লগ্নটা এখন নিঃশব্দ ভালোবাসার সাক্ষী।বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, মেঘ গর্জে ওঠে।বাতাস ও যেন হাহাকার করে ওঠে কিছুক্ষণ পরপর।
মধ্য রাতে,
বাড়ির সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা “Chowdury MANSION” দেয়াল বরাবর যেন চোখে পড়ার মতো এক বিশাল চিহ্ন। দেয়ালের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক তার কানে হেডফোন এবং হাতে বড় একটা কালো ব্যাগ,এবং ব্যাগ টার ভেতর কিছু একটা নড়াচড়া করছে। সে বারবার দেয়াল বরাবর চড়ে ওঠার চেষ্টা করছে তবে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে তার চেষ্টা কিন্তু কোনও ফল মেলছে না। ঘাম থকথক করছে আর মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সে এবার মেইন গেটের দিকে এগোতে থাকে তৎক্ষণ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় অন্য একটি ছায়া দেখা যায়। ছায়াটি ধীরে ধীরে তার পেছনে এগিয়ে আসে, লোকটি এক মুহূর্তে ঘাবড়াই। তার চোখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সে ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকায় সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালকায়, লম্বা এবং শক্তপোক্ত এক মুখোশধারী ব্যক্তির দিকে চোখ আটকে যায়। লোকটির পরনে কালো লম্বা ওভারকোট, হাতে একটি বড় কোদাল। ছায়ামানবটির মুখ পুরোপুরি দেখা যায় কারণ তার মুখে ড্রাগনের মাস্ক লাগানো ছিল।
লোকটি কাঁপতে কাঁপতে হেডফোন চেপে ধরে বলতে থাকে, “ড্রেভেন হান্টার চলে এসেছে এখন কি করবো আমরা?”
আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৩
অপর পাশ থেকে কর্কশ গলায় কেউ একজন বলে,
—”ওই ব্যাগটা বাসার ভেতর রেখে তারপর পালাও। ”
লোকটির আত্মার শুকিয়ে যায় সে মুহূর্তেই হাতে থাকা কালো ব্যাগটি গেটের অপর পাশে ছুড়ে ফেলে।আর এক মুহূর্ত দেরি না করে উল্টো পথে দৌড়াতে থাকে। ড্রভেন সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে তার পিছনে দৌড়াতে থাকে তার গতি যেন আরও তীব্র হচ্ছে।