আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৮ (২)
প্রীতি আক্তার পিহু
আনায়া বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে ঠোঁটদ্বার উন্মুক্ত করে উচ্চারণ করল, “নাউযুবিল্লাহ!”
এক ঝটকায় সে ইউভানের কাছ থেকে সরে গিয়ে হতচকিত হয়ে বসে পড়ল। নিজেকে নিজেই কিছু বোঝাতে না পেরে ধীরে ধীরে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“অশ্লীল, অসভ্য ব্যক্তি…”
কিন্তু ইউভান? আনায়ার প্রতিক্রিয়ায় সে অপার্থিব তৃপ্তি খুঁজে পেল। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ মিশ্রিত হাসি টেনে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“টু বি কন্টিনিউ, সুইটি?”
এই বাক্যের সাথে সাথেই আনায়ার মুখখানা লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। ইউভানের চোখের দিকেও সে তাকাতে পারছে না। ইউভান চোরাভাবে আনায়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,
“এ কী, তুই এতটা লজ্জায় পিঙ্ক হয়ে যাচ্ছিস কেন?”
আনায়া মুখ ঘুরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর স্বরে বলল,
“থামবেন আপনি?”
ইউভান অনবদ্য নীরবতায় ড্রাইভিং চালিয়ে যেতে যেতে নির্লিপ্ত কণ্ঠে শুধালো,
“কিছু তো আর আরম্ভই করিনি। তার আগেই থেমে যাব কীভাবে, সানশাইন?”
আনায়া এবার নিশ্চুপ। সে অনুধাবন করেছে, ইউভানের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়ালে আজ লজ্জায় ভূমির গভীরে তলিয়ে যেতে হবে তাকে। সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঠোঁট ফাঁক করে উচ্চারণ করল, “উফফফ!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইউভান দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখে ঠোঁট চেপে হেসে উঠল। পুনরায় মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোনিবেশ করল। তবে হঠাৎ করেই সামনে থেকে ধূসর রঙের একটি গাড়ি প্রবল বেগে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। ইউভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে লক্ষ করল, একজোড়া হাত গাড়ির জানালা দিয়ে বেরিয়ে তাদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। মুহূর্তেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে সে হিশহিশিয়ে বলে উঠল, “ওহ শিটটটট!”
আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ইউভান ডান পা দিয়ে তীব্রভাবে অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরল। একই সঙ্গে স্টিয়ারিং হুইলটিকে এক ঝটকায় ডানদিকে ঘুরিয়ে দিল। পুরো গাড়িটি হেলে গিয়ে জোরে বাঁপাশে মোড় নিল। ইউভান গাড়ির গতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। এর ফলস্বরূপ আনায়া ভারসাম্য হারিয়ে কাচের দিকে হেলে পড়ে গেল। আতঙ্ক আর ভীতিতে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেল। কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে সে কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠল,
“আহহ, ইউভান ভাই ধীরে চালান!”
আনায়ার কাতর স্বর শুনে ইউভানের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে উঠল। চোখের পলকে সে বাম হাত দিয়ে আনায়ার মাথাটি ধরে নিজের বুকে চেপে ধরল। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি গুলি ছুটে এলো তাদের গাড়ির দিকে। তবে তার আগেই ইউভান সতর্ক হয়ে ডান হাতে স্টিয়ারিং হুইলটিকে নিখুঁতভাবে ঘুরিয়ে দিল, ফলে গাড়িটি সরে গেল গুলির সরলরেখা থেকে। কিন্তু অপর দিকের দুর্বৃত্ত থামল না আরও কয়েকটি গুলি ছুড়তে লাগল। তবুও একটি গুলিও গাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারল না। গুলির শব্দে আনায়ার হৃদস্পন্দন থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সে আতঙ্কিত হয়ে ইউভানের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরল। আনায়া বেপরোয়া শ্বাসে কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল,
“ইউভান ভাই… গুলি… কী হচ্ছে এসব? আমি খুব ভয় পাচ্ছি…”
ইউভান তার হাতের বন্ধন কয়েকগুণ শক্ত করে আনায়াকে আরও নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরল। আনায়ার মনে হচ্ছে ইউভানের বুক চিরে তার অন্তঃস্থলে ঢুকে নিরাপদে আশ্রয় নিতে। সে নিঃশব্দে লেপ্টে রইল ইউভানের বুকের প্রাচীরে। তখনই ইউভান নরম কণ্ঠে বলল,
“হুশশশ! ভয় পাস না সুইটি, আমি তো আছি। প্রাণপাখি আমার! তোকে কিছুই হতে দেব না।”
আনায়া মাথা দুদিকে নেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ধূসর রঙের গাড়িটি গতিবেগ বাড়িয়ে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও রেসিং প্রতিযোগিতা চলছে। ইউভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেই গাড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গহাসি হাসল। পরক্ষণেই বজ্রসম কণ্ঠে বলে উঠল,
“ওহ ফাকিং ম্যান! একজন সাধারণ চালক হয়ে রেসিং চ্যাম্পিয়নের সামনে গাড়ি নিয়ে নামা? দিস ইজ ফাকিং ননসেন্স, ম্যান!”
বলেই ইউভান ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপ হাসি নিয়ে গতি বাড়িয়ে গাড়িটিকে বাঁদিকে হুইল-স্কিড করিয়ে ঘুরিয়ে দিল। চাকার নিচে রাবারের ঘর্ষণে ধোঁয়া উঠতে লাগল। আনায়া এবার ইউভানের বাহু থেকে ছিটকে পড়তে যাচ্ছিল। তার আগেই ইউভান এক হাতে স্টিয়ারিং সামলিয়ে অন্য হাতে আকঁড়ে ধরল তার ধরণীকে অর্থাৎ আনায়াকে। আনায়ার শরীর কাঁপছে থরথর করে। তার শ্বাস মিশে যাচ্ছে ইউভানের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে। ইউভান গাড়িটি ছোট একটি নির্জন রাস্তায় প্রবেশ করাল। সামনে বিশাল এক গাছ। কিছু না ভেবে ইউভান হঠাৎ গাড়িটিকে গিয়ে ঠুকিয়ে দিল সেই গাছে। ধূসর রঙের গাড়িটি আর দেখা গেল না। এতক্ষণে আনায়া হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলল। গাড়ি থেমে গেলেও আনায়া ইউভানের শার্টের গলা থেকে নিজের হাত দুটি সরাতে পারছে না। সে এক বিন্দুও নড়ছে না। ইউভান ফিসফিস করে বলল, “সুইটি, তুই ঠিক আছিস তো?”
ইউভানের কণ্ঠ শুনে আনায়া চোখ তুলে তাকাল।তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। সে কম্পিত ঠোঁটে বলল,
“আমি ঠিক আছি, কিন্তু ওরা কারা ছিল? কেন আমাদের দিকে গুলি চালাল?”
ইউভান দুই হাত দিয়ে আনায়ার মুখখানা আলতো করে ধরে বলল,
“কারা ছিল, তা গুরুত্বপূর্ণ নয় বুঝলি? তুই ঠিক আছিস, সেটাই সবচেয়ে জরুরি।”
আনায়া শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“কিন্তু যদি তারা আবার আসে? আমাকে যদি কিছু—”
হঠাৎ ইউভান আনায়ার ঠোঁটে নিজের আঙুল চেপে ধরল। আনায়ার বাক্য অপূর্ণ রয়ে গেল। ইউভান ফের ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“হুশশশ! এই পৃথিবীতে যদি কেউ তোকে ক্ষতবিক্ষত করতে চায়, তবে তাকে প্রথমে ইউভান নামক আগুন পার হতে হবে, আর সেটা অসম্ভব। তোর দিকে কেউ তাকালেও তার চোখ উপড়ে ফেলব, কেউ ছুঁতে এলে হাত গুঁড়িয়ে দেব, তোকে ব্যথা দিতে এলে তার জীবনটাই কেড়ে নেব আমি।”
আনায়া নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার দিকে। তার অন্তরে অজানা আবেশের এক তরঙ্গ বয়ে যেতে লাগল। ইউভান আনায়ার চোখে চোখ রেখে পুনরায় বলল,
“বিশ্বাস আছে তো আমার উপর, সুইটি?”
আনায়া দু’দিকে মৃদু মাথা নাড়ল এরপর ক্ষীণ নিঃশ্বাসে ছিন্নভিন্ন স্বরে উচ্চারণ করল,
“হুহু… নিজের থেকেও অধিক।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই পেছনের গার্ডরা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছাল। ইউভান সেদিকে নির্লিপ্ততায় চোখ তুলে চেয়ে দেখল, পরক্ষণেই মাথা ফিরিয়ে আনায়ার দিকে ঠান্ডা, ভারী স্বরে বলল,
“তুই বস, আমি আসছি।”
আনায়া নীরবে সম্মতির শীর্ষে মাথা নাড়ল। ইউভান ধীরে গাড়ি থেকে নামল। তখনই একজন গার্ড দৌড়ে এসে বিনয়ভরে মাথা নিচু করে জানাল,
“স্যার গাড়িতে ধরতে পারিনি, তবে নাম্বারটির ছবি তুলে এনেছি।”
ইউভান সামান্য পাশ ফিরে চোয়াল দৃঢ় করে ফেলল। ঘাড়টা হালকা কাত করে ভয়প্রদ গম্ভীরতায় উচ্চারণ করল,
“গিভ মি।”
গার্ডটি কাঁপা হাতে মোবাইল এগিয়ে দিল। ইউভান স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই চোখ দু’টোতে আগুন জ্বলে উঠল। ক্রোধে তার মুখাবয়ব পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ সে ফোনটি আছার মারল জোড়ে।মুহূর্তেই ইউভান অগ্নিঝরা কণ্ঠে বজ্রনিনাদের মতো গর্জে উঠল,
“ওহ শিটটট! ইউ ব্লাডি বিচচ! তোকে জানে মেরে ফেলব আমি K.K। আই ফাক ইউ ম্যান!”
তার কণ্ঠস্বর এতটাই বর্ণচ্যুত যে পার্শ্ববর্তী গার্ডরা শিউরে উঠল। তারা মাথা নত করে নীরবতায় সরে গেল একপাশে।গাড়িটি সাউন্ডপ্রুফ থাকায় আনায়া কিছুই শ্রবণ করতে পারল না, কেবল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ইউভান ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে পেছন থেকে বন্দুক বের করার উদ্যোগ নিল, কিন্তু হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে গেল আনায়ার উপর।তখনই সে মাথা নিচু করে চোখ বুঁজে ফেলল, নিজের ক্রোধকে দমন করতে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে গাড়ির ভেতর উঠে বসল।
ইউভানকে দেখে আনায়া তৎক্ষণাৎ তার হাতটি পেছনে লুকিয়ে ফেলল। বিষয়টি ইউভানের দৃষ্টি এড়াল না। সে কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞাসা করল,
“কি হয়েছে? কি লুকাচ্ছিস দেখি।”
আনায়া মাথা নিচু করে কম্পিত কন্ঠে বলল
“ক.. কই কিছু না। সত্যি কিছু হয়নি।”
ইউভান ভ্রু কোঁচকাল। এবার আর কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে দৃঢ়ভাবে আনায়ার হাতটি টেনে নিয়ে এল সামনে। আনায়া চোখ বন্ধ করে ফেলল মুহূর্তেই।আনায়ার ডান হাতে একপাশে লাল রক্তাক্ত ক্ষত দৃশ্যমান।তা দেখে ইউভানের নীরস দৃষ্টি মুহূর্তে বিচলিত হয়ে উঠল। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“ওয়াট দ্যা হেল! ওহ গোড সুইটি। এটা কীভাবে হলো? বেশি লেগেছে? ওহ ড্যমন!”
আনায়া পূর্বানুমান করেছে ইউভান এমন পথিকরাই দেখাবে। সে স্থির কণ্ঠে উত্তর দিল,
“তেমন কিছু না গাড়ির কাচে সামান্য আঘাত পেয়েছি। আপনি প্লিজ উতলা হবেন না।”
ইউভান তার কাঁপা আঙুলে আনায়ার ক্ষত স্থান স্পর্শ করে বলল,
“বেশি ব্যথা করছে সানসাইন? উফফ! সরি! এগেইন মাই ফল্ট… হ হসপিটাল…”
ইউভানের বাক্যপংক্তি শেষ হবার পূর্বেই আনায়া হঠাৎ তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল,
“এই চুপপপ! জানে মেরে দিব আপনাকে এবার।”
ইউভান বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আনায়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। সে অনুভব করল যে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে।ইউভানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“ন… না মানে… আ আসলে আপনি বরং মলম লাগিয়ে দিন তাতেই হবে।”
ইউভান নিঃশব্দে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আনায়ার দিকে তাকাল। এরপর হঠাৎ এক টানে গ্লাভবক্স খুলে বের করল ফার্স্ট এইড বক্স। একদিনে তার প্রাণ পাখিকে কত দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, সেই চিন্তায় ইউভানের অন্তর্গত রাগে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল।
সে নিঃশব্দে আনায়ার হাত নিজের হাতের উপর রেখে পরম মমতায় মলম প্রয়োগ করতে লাগল।ক্ষত স্পর্শে আনায়া সামান্য যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে কেঁপে উঠে উচ্চারণ করল,
“আহহহ…!”
ইউভান থামল। আনায়ার কুঁচকে যাওয়া মুখাবয়বের দিকে অবলোকন করে অধর কামড়ে সে উচ্চারণ করল,
“এসব শব্দ করার মত কোন কাজ করেছি আমি?”
আনায়া বিমূঢ় দৃষ্টিতে চক্ষু বিস্ফারিত করে তাকালো। ইউভানের বাক্যের তাৎপর্য অনুধাবন করতে না পেরে বলল,
“মানে?কি কাজের কথা বলছেন আপনি?”
ইউভান অধর কামড়ে মৃদু হাসল। সেই হাসি সরাসরি তীরের ন্যায় আঘাত হানলো আনায়ার হৃদপিণ্ডে।ইউভান স্বর কয়েক গুণ গম্ভীর করে বলল,
“সামথিং ব্যাড…”
আনায়ার শ্বাসপ্রশ্বাস আচম্বিতে তীব্র হয়ে উঠল। ইউভান যে আজ তাকে নিঃশেষ করার পরিকল্পনায় লিপ্ত, সে তা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। তথাপি না বোঝার অভিনয় করে আনায়া ফিসফিসিয়ে বলল,
“ওয়াট?”
আনায়ার চাহনির দিকে দৃষ্টিপাত করে ইউভান চাপা নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। ইউভানের হৃদয়ে আনায়ার প্রতি সেই নিষিদ্ধ অনুরাগ মুহূর্তে বহুগুণে বৃদ্ধি পেল। সে চেপে রাখা স্বরে বলল,
“ওভাবে তাকাস না প্লিজ।ইউ নো আই ক্যন’ট কনট্রোল মাই সেল্ফ।আই উইল ডু সামথিং রং ….
আনায়া এতটা নিরীহ নয় যে ইউভানের কথার অর্থ বুঝতে না পারে। ইউভানের যে তার প্রতি অনুভূতি আছে সেটা বহুপূর্বে উপলব্ধি করেছে আনায়া।পুনরায় সে কম্পমান কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
” আপনার কণ্ঠস্বর এমন শোনা যাচ্ছে কেন?”
ইউভান মত্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর স্থির কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“এই মুহূর্তে খারাপ কিছু করে ফেলি?খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে সুইটি?”
আনায়ার দেহ কেঁপে উঠল। ইউভানের গভীর কণ্ঠ তার অন্তরকেও স্পন্দিত করছে। তবুও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উত্তরে বলল,
“বড্ড ক্ষতি হয়ে যাবে ইউভান। ভার্সিটি যেতে লেট হয়ে যাবে আমার বুঝলেন?”
মুহূর্তের মধ্যে ইউভান দৃষ্টি সরিয়ে ঠোঁট দিয়ে ‘চ’ ধ্বনি করল। ফিসফিসিয়ে বলল,
“শুধু শুধু তো আর বাচ্চা বলি নাহ।”
আনায়া ইউভানের অনুভূতিতে বাগড়া দিয়ে বড্ড আনন্দিত হল। ঠোঁট চেপে হাসি দিয়ে বলল,
“কি হলো? ইউভান ভাইয়ায়ায়ায়ায়া!”
ভাইয়ার স্বরে ইউভান বিরক্ত দৃষ্টিপাত করল। নিরবেই গাড়ি চালু করে ভার্সিটি পথে রওনা দিল। আনায়া দূরত্ব বজায় রেখে বসল। সে ইচ্ছাকৃতভাবে ইউভানের মজা নিচ্ছে। আনায়া মনে মনে ভাবল,
“এতো সহজে আনায়া তার ভালোবাসা প্রকাশ করবে না ইউভান ভাই। যতদিন আপনি নিজেই আগে প্রকাশ করবেন না, ততদিন এই লুকোচুরি চলতেই থাকবে।”
ইউভানের সঙ্গে কাটানো কয়েক মুহূর্তেই আনায়া কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া এক্সিডেন্টের কথা ভুলে গেল।ইউভানের সাথে থাকলে কোনো কষ্টই যেন অনুভূত হয় না তার। আনায়া নিঃশব্দে হাসি দিয়ে জানালার বাইরে তাকাল।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি ভার্সিটির গেটে থেমে গেল। এত বাঁধা পার হয়ে আনায়া ভার্সিটিতে এসে খুব খুশি। হাসিমুখে গাড়ি থেকে নেমে ইউভানকে প্রশ্ন করল,
“আপনি যাবেন না ইউভান ভাই, উপস সরি স্যার?”
ইউভান মুখে মাস্ক পরে গাড়ি থেকে নেমে আঁড়চোখে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, ভিতরে যা। আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।”
আনায়া আর কিছু না বলে পেছনে ফিরে ভার্সিটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। ইউভান সেদিক তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল,
“ওহ গোড!তুই মেয়ে সাংঘাতিক!প্রফেশনাল বিজনেসম্যান অর সিঙ্গার থেকে সাধারণ প্রফেসর বানিয়ে দিলি আমাকে?আরও কত কি সাজতে হয় তোর জন্য তা কেবল উপরওয়ালাই জানে।”
আনায়া ক্লাসরুমের করিডোর পেরিয়ে শেষ বেঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ায়। তার চোখ সরাসরি জানালার পাশে পাশাপাশি বসা পিহু ও রুহির দিকে যায়। রুহি আনায়াকে কথা বলবে তার পূর্বে আনায়া ইশারা দিয়ে থামিয়ে দেয়।রুহি চুপসে গেল, আর আনায়া ধীরে ধীরে পিহুর পাশে এসে চোখ আঁকড়ে ধরে।পিহু প্রথমত বিস্ময়ে শিহরিত হলেও পরে অনুধাবন করে এটি কে। সে ধীরে স্বরে বলল,
“আনায়া..। ”
আনায়া চোখ টিপে সম্মুখে এসে স্থির হলো।এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল,,
“চিনে ফেললি কীভাবে?”
পিহু চোখ সঙ্কুচিত করে পর্যবেক্ষণ করে হেসে ওঠে,
“আলুর বাচ্চা! ঢং বাদ দে! বল আগে এত লেট কেন?”
আনায়া সামান্য গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“আসার সময় একটু ছোটখাটো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো।”
রুহি বিস্ময়ে চোখ বিস্তার করে বলল,
“এক্সিডেন্ট! কী বলিস! কিছুক্ষণ আগেও তো তোর চোখের উপর ঝড় বয়ে গেছে।”
পিহু কিছুই উপলব্ধি করতে না পেরে আনায়াকে প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে? কিসের এক্সিডেন্ট? আর তোর চোখেই বা কি হয়েছিল?”
আনায়া কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“তেমন কিছু নয়, সামান্য মাত্র। উদ্বিগ্ন হবি না।”
এ সময় একজন শিক্ষক এগিয়ে এসে ফর্ম পূরণের প্রসঙ্গ তোলেন। সকলেই নিজ নিজ ফর্ম পূরণে মগ্ন হয়ে পড়ে। সেই ব্যস্ততার অন্তরালেই আনায়া দৃষ্টি তোলে বাইরে। মুহূর্তেই তার চাহনি স্থির হয়ে যায় সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির উপর। ইউভান বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে পড়তে আনায়ার গাল লজ্জায় পিংক হচ্ছে ইউভানের ভাষ্যমতে।আনায়া হাসছে কারণহীনভাবেই। প্রেম যখন নারীর অন্তরে রঙ ছড়ায়,তখন এমন হাসি তো স্বাভাবিকই।
ঠিক বিপরীত দিক থেকে আরেক জোড়া দৃষ্টি সেই একই ব্যক্তি’র প্রতি নিবদ্ধ হয়ে আছে।ইউভানকে দেখে পিহুর হৃদয়ে এক প্রকার ঝড়ের উদ্ভব ঘটল। তার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল অতীতের স্মৃতি।অগ্নিকাণ্ড ওই রাতে এক জোড়া নীল চোখ তাকে উদ্ধার করেছে। ইউভানের নীল চোখের দিকে দৃষ্টি দিলে পিহুর হৃদস্পন্দনের ছন্দ ব্যতিক্রম ঘটে।আনায়াকে মৃদু হেসে থাকতে দেখে পিহু খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কি রে আলু? এভাবে মুচকি হাসছিস কেন?”
আনায়া পিহুর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“হৃদয়ে বসন্তের বইছে তাই হাসছি। তবে সাধারণ বসন্ত নয়, প্রেমের বসন্ত।”
হঠাৎ করে রুহি চোখ তুলে স্থির দৃষ্টিতে আনায়ার দিকে চাইল। আনায়ার চাহনির অনুসরণে ইউভানের দিকে তাকিয়ে রুহি উপলব্ধি করল, আনায়ার বসন্তটি কাহার জন্য উৎসর্গিত। পিহু আনমনে হেসে ইউভানের দিকে তাকাল। তারপর আনায়ার মাথায় নিজের মাথা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,
“তোর হৃদয়ে বসন্তের আবাহন, এদিকে আমার হৃদয়ে বয়ে চলছে কালবৈশাখীর ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড় তার ব্যতীত থামাবার উপায় নায়।”
এক ইউভানকে লক্ষ্য করে দুই জোড়া চোখ এবং দুইটি হৃদয় একত্রে নিবদ্ধ রয়েছে। আনায়া এবং পিহু কেউই অবগত নয় যে তারা অজ্ঞাতসারে একই হৃদয়স্পন্দনে প্রতিযোগী হয়ে উঠছে। অথচ প্রেম তো বিভক্ত করা যায় না। অন্যদিকে রুহির অন্তরে উঁকি দেয় পিয়াসের মুখচ্ছবি। সেই বহুদিন আগে পিয়াসকে দেখেছিল রুহি, তারপর তার আর আবির্ভাব ঘটেনি। রুহি এবার দুই হাত বাড়িয়ে আনায়া ও পিহুকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলল,
“একজনের হৃদয়ে বসন্ত, অন্যজনের হৃদয়ে কালবৈশাখী। আর আমার হৃদয়টি হেমন্তে মোড়া পড়ে আছে।অপেক্ষার পাতা ঝরে পড়ছে।কাশফুলের আড়ালে মুখ লুকিয়ে খেলা করছে সে আমার সঙ্গে।”
আনায়া এবার ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
“এই যে এক মুহূর্ত! সকলের হৃদয়ে এমন ঋতুর পরিবর্তন? তো বল কাকে কেন্দ্র করে এই ঋতুর আবর্তন?”
পিহু জিভ কাটল,”আগে তুই বল।”
আনায়া মাথা নাড়ল,
“না, প্রথমে তোরা বলবি, তারপর আমি উদঘাটন করব।”
তাদের এই বিতর্ক, রসিকতা ও হাস্যরসের মাঝেই হঠাৎ চেনা পুরুষকণ্ঠের শীতল উচ্চারণ শ্রুতিগোচর হলো। মুহূর্তের মধ্যে সকলে একে একে দাঁড়িয়ে গেল। আনায়া, রুহি, পিহুও স্থির হয়ে উঠল এবং আশঙ্কাভরা চোখে ইউভানের দিকে তাকাল। ইউভান কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে হুংকার দিল,
“এটা কি প্রেমআলাপ করার জায়গা?”
আনায়া, রুহি, পিহু একে অপরের দিকে দৃষ্টিবিনিময় করল। ইউভান কীভাবে অনুমান করল যে তারা প্রেম আলোচনা করছিল? এরই মধ্যে ইউভান পুনরায় সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এভরিওয়ান পেই এটেনশন টু দ্যা ফ্রম ফিলিং।”
বক্তব্য শেষ করেই ইউভান গোপনে আনায়ার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সঙ্গে সঙ্গে আনায়া দৃষ্টি সরিয়ে নিল অন্য দিকে। প্রেমের বসন্ত, হেমন্ত, কালবৈশাখী সব অনুভূতি ত্যাগ করে আনায়া, রুহি, পিহু ফর্ম পূরণে নিবিষ্ট হলো।
অতীত~
আমেরিকা, নিউইয়র্ক সিটি,
আলিসা নিজ দৃষ্টির কোণে অবশিষ্ট অশ্রুকণাটুকু মুছে নিল।তার তীক্ষ্ণ ও ধারালো কণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
“আপনার জন্য দুইজন শিকারি আমি ইতোমধ্যেই বাছাই করেছি আমি।কাল আমার বাসায় আসবেন।আমার সঙ্গে চালাকি করার কথা চিন্তা করবেন না ক্যসিনো।এর ফলাফল ভালো হবে না আপনার জন্য।”
এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিলো আলিসা। ক্যাসিনোর প্রতিউত্তর শোনার প্রয়োজন সে অনুভব করল না। অপরদিকে, ক্যাসিনো ফোনের অপর প্রান্তে এক মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেল। কুটিল হাসি ছুঁড়ে দিয়ে সে হাতে ধরা ওয়াইনের গ্লাসটি নামিয়ে রাখে।
রাত্রি তখন অন্ধকারের অতল গভীরে নিমজ্জিত। প্রাচীরঘড়িতে রাত্রি প্রায় ত্রয়ীর কণ্ঠ ছুঁইছুঁই। সমগ্র শহর অন্ধকারের আবরণে ঢাকা পড়েছে। কক্ষটিও নিবিড় কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত। জানালার ধারে নিশ্চলভাবে বসে আছে আলিসা। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ বাইরের ঘোর অন্ধকারে। হঠাৎ সেই মুহূর্তে বারান্দা থেকে একটি ক্ষীণ শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। আলিসা আঁতকে উঠল। এত গভীর রাতে কার উপস্থিতি সম্ভব? চোর তো নয়? এমন ভাবনায় আলিসা নিঃশব্দে পায়ে পায়ে বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়। দরজাটি উন্মুক্ত করতেই সে প্রত্যক্ষ করে এক মানবছায়া। সাহস সঞ্চয় করে টেবিলের পাশ থেকে একটি ফুলদানী তুলে নেয়। ধীরে ধীরে সেই ছায়ামূর্তির দিকে অগ্রসর হলো। আলিসা আঘাত হানার পূর্বমুহূর্তেই একজোড়া দৃঢ় হাত তার কোমর আবদ্ধ করে।
আলিসা চিৎকার করতে উদ্যত হলেও, হঠাৎ সেই ব্যক্তি তার মুখ আচ্ছাদিত করে। হৃদয়স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল আলিসার। ঠিক সেই সময় শীতল গম্ভীর পুরুষকণ্ঠে উচ্চারিত হলো,
“শশশশ হেই গার্ল স্টপ! আই’ম ক্যাসিনো।”
অবিলম্বে আলিসার চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠে। ক্যাসিনো তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। আলিসা মুক্ত হয়ে দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে লাগে। বিস্মিত চাহনিতে সে ক্যাসিনোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“এত রাত্রে আপনি এখানে? কেন?”
ক্যাসিনো মৃদু হাসিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“বাঘকে তো শিকারির খোঁজ দেওয়া হয়েছে। আর বাঘ এসে না দেখে পারে?”
এই সংলাপে আলিসার অধরকোণে বিদ্রূপ মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠে,
“সামান্য দেরি সহ্য হলো না বুঝি আপনার?”
ক্যাসিনো তখন গম্ভীর স্বরে প্রতিউত্তর করে,
“সহ্য হলো না বলেই এত রাত্রে ছুটে এলাম। এখন বলো, মিস রোজ, আমার শিকারিরা কারা? প্রবল ক্ষুধায় আমি পীড়িত।”
আলিসা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল,
“আমার মা ও বোনই আপনার শিকারি, ক্রিস্টান ক্যাসিনো।”
এই বাক্য শুনে ক্যাসিনোর দৃষ্টিতে বিস্ময় ছায়াপাত করল। ঠোঁট ভিজিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“মানে? কী বলছো তুমি?”
“আমার সৎ মা এবং সৎ বোন। কেউই রক্তসম্পর্কীয় নয়।”
ক্যাসিনোর কিছুই অনুধাবন করতে পারছে না। নিরেট স্বরে পুনরায় উচ্চারণ করল,
“তোমার বাবা কোথায়?”
এই শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই আলিসার সত্তায় জ্বলে উঠে উত্তাপের জলোচ্ছ্বাস।দেহেজুড়ে বয়লো তীব্র ক্রোধের বিস্ফোরণ। চোয়াল দৃঢ় করে কণ্ঠ উঁচু করে সে বলে,
“আমি তাকে হত্যা করেছি।”
চারদিকে নেমে এলো স্তব্ধতার ছায়া। ক্যাসিনো ভাষা হারিয়ে ফেলে। তবে এটুকু স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছেআলিসা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। নতুবা কে-ই বা নিজের বাবাকে হত্যা করতে পারে? কম্পিত কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করল,
“তুমি কী বলছো এসব? নিজ বাবাকে?কেন?”
আলিসা হঠাৎ ক্যাসিনোর হাত খপ করে ধরে টান দিল। ক্যাসিনো বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কোথায় যাচ্ছো রোজ?”
আলিসা থেমে গিয়ে দৃষ্টিপাত করল ক্যাসিনোর দিকে এবং বলে,
“আ্যশার এখানে ঘুমাচ্ছে। ছাদে চলুন।”
এই বলে তারা দু’জন বারান্দা পেরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। তখনই ক্যাসিনোর দৃষ্টি বিছানার উপর নিদ্রারত আ্যশার এর উপর নিবদ্ধ হয়। সে নিঃশব্দে হাসে এবং ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমার শিকার!”
তবে তার কণ্ঠ এতই মৃদু ছিল যে, তা আলিসার শ্রবণে আসেনি।ছাদে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই এক দমকা হাওয়া তাদের উপর দিয়ে বয়ে যায়। আলিসা ক্যাসিনোর হাত ছেড়ে ছাদের এক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্যাসিনো দীর্ঘ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে আলিসার অঙ্গভঙ্গি। ঠিক তখনই আলিসা ক্যাসিনোকে লক্ষ্য করে আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
“ওই দেখুন, চাঁদের নিকটে একটি তারা জ্বলছে। জানেন ওটা কে? আমার মা! আমাকে একা রেখে তিনি চলে গিয়েছেন অনন্তলোকে। তবে ইচ্ছায় যায়নি বরং কেউ তাকে পাঠিয়েছে। অনুমান করতে পারেন কে করেছেন?”
ক্যাসিনো কপালে ভাঁজ ফেলে নিঃশব্দে তাকায়। কয়েক কদম অগ্রসর হয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,
“কে?”
“আমার পিতা।”
ক্যাসিনো মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। আলিসাকে অনুধাবনের জন্য সে মনোযোগ দেয়। আলিসা পেছনে ঘুরে ক্যাসিনোর চক্ষুর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলতে লাগল তার অতীত…
❝সবার মতো হ্যাপি ফ্যামিলি আলিসা মেহেরিন এরও ছিল।সে পিতা-মাতার একমাত্র স্নেহভাজন কন্যাসন্তান। শৈশবকাল থেকেই আলিসা অনুভব করত তার পরিবারই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পরিবার। কিন্তু বাস্তবত বলতে গেলে সেই আনন্দময় চিত্রপটের অন্তরালে ছিল এক বিভীষিকাময় অন্ধকার। নিত্যদিন সকালের মতো নয় বছর বয়সী ছোট্ট আলিসা তার মা মোনালিসা পিছু পিছু ঘুরছে।ঠিক সেই মুহূর্তে আলিসার পিতা সায়মন উপস্থিত হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আজকে আলিসার স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই। আমরা আজ বাইরে যাব বুঝলে মোনালিসা? ফ্যামিলি ট্যুরে।”
মোনালিসা সামান্য বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল,,
“বাইরে মানে? আজ হঠাৎ?”
সায়মন আলিসাকে কোলেপিঠে তুলে স্নিগ্ধ চুম্বন দিয়ে বলল,
“আজকে ছুটি নিয়েছি আমি। অনেক দিন তো কোথাও যাওয়া হয় না। আলিসা তো কখনো ঘুরতেও যায় না। আজ একটু সময় দিই মামনিকে।”
মোনালিসার চোখে একটুখানি অবিশ্বাসের ছায়া ভেসে উঠে।ক্ষুদ্র আলিসা গগনের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। সেও তো অপর শিশুসন্তানদের মতো পিতা-মাতার সাথে ঘুরতে চায়। আজ সেই কল্পনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে ভেবে সে বিস্ময়াভিভূত নেত্রে বলল,
“থ্যাঙ্ক ইউ পাপা।ইউ আর দা বেস্ট পাপা ইন দ্যা ওয়াল্ড।”
উচ্চারণ শেষ করে আলিসা কয়েকটি চুম্বন দেয় তার পিতার গালে। মোনালিসা কিছু বলতে উদ্যত হলেও, কথাগুলো গলাধঃকরণ করে ফেলে। কারণ, আলিসার আড়ালে সায়মন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।মোনালিসা আলিসাকে রেডি করে বাইরে গাড়িতে এসে বসে।সায়মন সবার প্রতি দৃষ্টিপাত করে মৃদু হাসি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। শুরু হল সেই অভিশপ্ত যাত্রাপথ। প্রভাত ধীরে ধীরে পরিণত হল মধ্যাহ্নে, মধ্যাহ্ন গড়িয়ে বিকেল, বিকেলান্তে সন্ধ্যা। গাড়িতে বসে আলিসা মৃদু হাস্যভঙ্গিতে বলল,
“মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমি আজ খুব হেপি।”
“আমি ঠিক জানি না মামনি। তোর বাবার প্ল্যান…”
তৎক্ষণ গাড়ি এসে থামে জঙ্গলের সামনে। চারদিকে গা ছমছমে নিস্তব্ধতা।মোনালিসা উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন,
“সায়মন জঙ্গলে কেন? আমরা কি কোনো রিসোর্টে যাচ্ছি নাকি?”
সায়মন মুচকি হেসে উত্তর দিল,
“চলো, গেলেই জানতে পারবা।
এই বলেই সে আলিসার দিকে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“তুমি গাড়ির ভিতর বসে থাকো মামনি। নিচে নামবা না, আমরা একটু যাচ্ছি।তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো বুঝলে?”
আলিসা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।গাড়ি থেকে নামল তারা দুজন।মোনালিসার অন্তরে আতঙ্কের প্রলেপ জমে উঠল। সায়মন তাকে সঙ্গে নিয়ে অরণ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে তার পূর্বে মোনালিসা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“আপনি কী করতে চাইছেন?”
সায়মন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দেয়,
“গেলেই দেখতে পাবে তোমার জন্য বড় সারপ্রাইজ রেডি করে রেখেছি আমি।”
মোনালিসার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামে। তখনই তার হৃদয়ে আলিসার জন্য হাহাকার করে। মুহূর্তেই সে সায়মনের কবল থেকে নিজের হাত মুক্ত করে দৌড়ে গাড়ির জানালার নিকটে আসল। কাঁচের অপর প্রান্তে আলিসা তার মায়ের পানে চাইল।কাঁচে শিশির জমে রয়েছে অল্পস্বল্প। মোনালিসা সেই কাঁচে আঙুল দিয়ে লিপিবদ্ধ করল,
“মাম্মা তোমাকে খুব ভালোবাসে মামনি।”
ক্ষুদ্র আলিসা মৃদু হাস্যচূর্ণ করে অপরপ্রান্ত থেকে কাঁচের উপর আরেকটি বাক্য লিখল,
“আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি মাম্মা।”
লেখা শেষ করেই আলিসা জানালার কাঁচে ঠোঁট স্পর্শ করে। মোনালিসার চোখ জলে আর্দ্র হয়ে উঠে। কাঁচের অপরদিক থেকে তিনি আলিসার ললাটে চুম্বন দানের ভঙ্গিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় কাঁচে। একটি অশ্রুবিন্দু ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে তার গণ্ডদেশ বেয়ে। মোনালিসা আরও কিছু উচ্চারণ করার পূর্বেই সায়মন তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগে জঙ্গলের গভীরে। মোনালিসা পিছন ফিরে একবার তার মেয়ে আলিসার দিকে দৃষ্টিপাত করে। মাতৃহৃদয় তখন বেদনায় অবরুদ্ধ হয়ে উঠে। অবুঝ আলিসা তাদের গমনপথের দিকে অপলক চেয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে দু’জনেই অরণ্যের অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল।
এক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়েছে। আলিসা বারবার জানালার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে, কিন্তু কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অবশেষে সে আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ির দরজা খুলে।ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপে সে জঙ্গলের অভিমুখে অগ্রসর হয়। চারিপাশ পর্যবেক্ষণ করে কোমল কণ্ঠে ডাকল,
“মাম্মা… পাপা।”
কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায় না। হঠাৎই কুকুরের কর্কশ ঘেউ ঘেউ শব্দ আসে। আলিসার দেহ ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠে।অতঃপর ধীরে ধীরে সে একটি বৃহৎ বৃক্ষের অন্তরালে গমন করে।আর ঠিক তখনই আলিসা যা প্রত্যক্ষ করে, তার জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।তার সম্মুখে উদ্ভাসিত হয় নিষ্ঠুর বিভীষিকাময় দৃশ্যপট।
মোনালিসা র*ক্ত*রঞ্জিত অবস্থায় মাটিতে নি*থ*র পড়ে আছে। তার শরীরের উপর লাফিয়ে বেড়াচ্ছে চার-পাঁচটা বিশালাকার হিং*স্র কুকুর।মোনালিসার মুখমণ্ডল এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে চেনা যাচ্ছে না। দুটি কুকুর তার মুখমণ্ডলের উপর উপবিষ্ট হয়ে মুখমণ্ডলের চ*র্মস্তর উপড়ে ফেলছে।একটি কুকুর তার অধর কামড়ে ছি*ন্ন*ভিন্ন করছে। অন্যটি গালদেশ থেকে চামড়া আলাদা করছে।চামড়া সরে অন্তর্নিহিত র*ক্ত*রঞ্জিত মাংস উন্মুক্ত হয়।
কুকুরটি সেই মাংসল তন্তু চিবাতে চিবাতে হাড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়।মোনালিসা এবার সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে যায়।অন্য একটি কুকুর তার উদর বিদীর্ণ করছে। ধারালো দাঁতের মাধ্যমে উদর ছিন্ন করে অভ্যন্তরীণ অ*ঙ্গ*প্র*ত্য*ঙ্গ টেনে হিঁচড়ে বের করছে।য*কৃ*ৎ, বৃ*ক্ক, না*ড়ি-ভুঁ*ড়ি প্রতিটি অঙ্গ পৃথক করে রক্তসহ গিলে নিচ্ছে হিংস্র জন্তুরা।মোনালিসার যৌ**না*ঙ্গ বরাবর কুকুরগুলো কা*মড়াতে কা*মড়াতে গভীর গহ্বর সৃষ্টি করে।
সেখান থেকে নিরবচ্ছিন্ন র*ক্ত*স্রোত প্রবাহিত হয়ে চারপাশকে লা*ল করে দিচ্ছে।তার ডান পা তখন অর্ধেকটা বিলুপ্ত। তার ব*ক্ষদেশ ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে হিং*স্র দলটি। বক্ষের চামড়া খুলে অন্তর থেকে উন্মোচিত হয়েছে ফুসফুসের র*ক্তে ভেজা থলি আর ছোট ছোট শ্বাসনালী।কুকুরগুলো তাদের দাঁতের প্রখরতা দিয়ে হৃদপিণ্ডে গভীর কামড় বসায়।র*ক্তপ্লাবিত হৃদপিণ্ড থেঁতলে চিবোতে চিবোতে তারা র*ক্তা*ক্ত কর্দমে মিশিয়ে দেয়।মোনালিসার ঘাড় উল্টিয়ে কুকুরগুলো সেখানে আঘাত হানে ছিন্ন করে।
ফলস্বরূপ চুলগুচ্ছের ফাঁক দিয়ে উথলে পড়ে উষ্ণ লোহিত র*ক্ত।বেরিয়ে আসা মগজটুকু কুকুরগুলো চেটে চেটে খেলো।
আলিসা গাছের আড়ালে এই নৃ*শং*স দৃশ্য দেখে শীতার্তের ন্যায় কাঁপতে রইল।তার দৃষ্টি তখন সঞ্চারিত হয় তার বাবার দিকে।তার বাবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছে,কিন্তু বাধা দিচ্ছে না। আলিসা কয়েকবার গলার স্বর গিলে নিয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“মা-মা-মা-মা… মা মা মাআআ মাম্মা মাআআআ…”
ভার্সিটির ক্লাসগুলো শেষ হতেই বিকেলের সূর্য কোমল সোনালি রশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছে সমগ্র প্রাঙ্গণে। রুহি, পিহু এবং আনায়া মূল ভবনের বৃহৎ প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। হঠাৎ করেই আনায়া থমকে দাঁড়ায়। রুহি কপালের ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“থেমে পড়লি কেন? বাসায় ফিরবি না তুই?”
আনায়া, রুহি ও পিহুর দিকে দৃষ্টিপাত করে তড়িঘড়ি করে বলল,
“তোরা যা আমি আসছি।হুট করে একটা কাজ করে গিয়েছে আমার।বেশি সময় নেবো না প্রমিস!অনলি ফর পাঁচ মিনিট প্লিজ।”
বাক্যটি সমাপ্ত করেই আনায়া পিছন ফিরে সোজা পুনরায় প্রাঙ্গণের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করে। রুহি এবং পিহু বিস্ময়ে তাকিয়ে রইছে। পিহু রুহিকে উদ্দেশ্য করে বিদায় জানিয়ে রওনা দেয় বাসার উদ্দেশ্যে।রুহি কেবলমাত্র অপেক্ষা করতে থাকলো।
এইদিকে প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি নিঃসঙ্গ কক্ষে বসে আছে ইউভান। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ মোবাইল স্ক্রিনে। চুলগুলো অগোছালোভাবে কপালে ঝুলে পড়েছে। শার্টের হাতা গুটানো এবং সামনের দুটি বোতাম খোলা ফলে লোমহীন উন্মুক্ত বক্ষ প্রবল আকর্ষিত লাগছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মোবাইলটি বেজে ওঠে। স্ক্রিনে সুপরিচিত নাম্বার ভেসে ওঠায় ইউভান কলটি তোলে। ঠিক তখনই অপর প্রান্ত থেকে শ্রুত হয় পুরুষকণ্ঠ,
“ইউভান আমি দেশে ব্যাক করছি।”
এক নিমেষে ইউভানের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে। তার শরীর কঠোর হয়ে উঠল। ক্রোধে দাঁত চেপে উচ্চারণ করল,
“আর ইউ ম্যাড আভীর?”
ফোনের অপর প্রান্তে অন্ধকারে বসে আছে আভীর। তার সম্মুখে টেবিলের উপর রাখা রেড ওয়াইনের বোতল এবং একখানা কাঁচের গ্লাস। আভীর এক হাতে ফোন ধারণ করে, অন্য হাতে গ্লাস তুলে নেয়। ঠোঁটে গ্লাস স্পর্শ করিয়ে এক নিঃশ্বাসে কয়েক ঢোক পান করে ফেলে। তারপর আভীর শীতল স্বরে পুনরায় উচ্চারণ করল,
“আই নিড হার।ব্যাডলি নিড হার!আমি আর ওয়েট করতে পারছি না ইউভান।আমার লাভবাডকে দ্রুত আমার কাছে পেতে চাই আমি।”
ইউভান চোখ বন্ধ করল। কপালের শিরাগুলো স্ফীত হয়ে উঠেছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে ক্রোধ দমন করে গলার নিচু সুরে বলে,
“লিসেন আভীর ও ঠিক আছে। আমি তাকে দেখে রাখছি। আর তুই এখন দেশে এলে কত বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তার কোন ধারনা আছে তোর?”
পরক্ষণে আভীর হঠাৎ গর্জে উঠল,
“তুই আমাকে ওর থেকে আলাদা করার প্রচেষ্টা করছিস ইউভান?”
ইউভানের কণ্ঠ দৃঢ় হয়ে উঠল,
“স্টপ ম্যান!ওর প্রাণের মালিকানা কিন্তু আমার হাতে আভীর।”
আভীর তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
” আমার লাভবাডের কষ্টের মূল কারণ কিন্তু শুধুমাত্র তুই ইউভান।”
ইউভান ঠোঁট দিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে। অতঃপর শীতল স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
“ওহ রিয়েলি?তাকে কষ্ট দেওয়ার হলে সেই ছোটবেলায় না বাঁচিয়ে মেরে ফেলতাম।সে তো আমার প্রথম স্পর্শ পাওয়া সেই সৌভাগিনী নারী, যার সেফটির জন্য আমি এই ভার্সিটিতে এডমিশন করিয়েছি তাকে।”
অপর প্রান্ত থেকে আভীর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তোর স্পর্শ ছিল কেবলমাত্র জীবন রক্ষার জন্য, আর আমার স্পর্শ অর্পিত থাকবে তার অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত।”
ইউভান কিছু বলবে তার পূর্বেই বাহির থেকে খট করে একপ্রকার শব্দ শুনতে পায়। সতর্ক হয়ে দ্রুত ফোনটি রেখে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। কোথাও কেউ নেই তো? তবুও ইউভানের মনে হলো, এইমাত্র এখানে কেউ অবস্থান করেছে। হঠাৎ করেই ইউভানের বক্ষদেশে তীব্র যন্ত্রণার অনুভব হয়।সে চারদিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে ভেতরে প্রবেশ করে পুনরায়।
অন্যদিকে, ফোন কেটে দেবার পর আভীরের দেহে আগুন জ্বলে উঠে। তার দৃষ্টিতে উন্মত্ততা সুস্পষ্ট। সে হাতে ধারণকৃত ওয়াইনের গ্লাসটিকে সম্পূর্ণ শক্তিতে ছুঁড়ে মারল প্রাচীরের দিকে। গ্লাসটি মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। আভীর ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ঠিক তখনই তার দৃষ্টি স্থির হয় ক্যানভাসে অঙ্কিত এক নারী প্রতিচ্ছবির উপর। আভীরের দৃষ্টি নেশাগ্রস্ত হয়ে ঠেকে নারীটির রক্তিম অঁধরের উপর। সে কাঁপা হাতে সেই রমণীর রাঙা ঠোঁট স্পর্শ করে। তার দৃষ্টিতে তখন অদ্ভুত উন্মাদনা। বিক্ষিপ্ত স্বরে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
“আহ! আমার লাভবাড! সুইটহার্ট! তুমি শুধুমাত্র আমার লাভবাড, কেবল আমার।”
ধীরে ধীরে সে এগিয়ে এসে ছবির ঠোঁটের সন্নিকটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে। উন্মাদনায় দিশেহারা হয়ে আবার উচ্চারণ করে,
“আই লাভ ইউ। আই নিড ইউ! আই নিড ইউ সুইটহার্ট…।”
আভীরের উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যায় ক্যানভাসের পৃষ্ঠে। তীব্র উন্মাদনায় সে নিজের ঠোঁট আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেই প্রতিচ্ছবির ঠোঁটে। কিন্তু তাতেও সে শান্তি খুঁজে পেল না। কিভাবে পাবে? এ তো শুধুমাত্র একটি প্রাণহীন চিত্রকর্ম। আভীরের কপালের শিরাগুলো স্ফীত হয়ে উঠেছে। তার বক্ষ উত্থান-পতন করছে স্তব্ধতা আর হাহাকারের মধ্যে। হঠাৎ সে মাথা উঁচু করে প্রবল বিক্রমে ছবিটির উপর চাপিয়ে দেয় প্রচণ্ড আঘাত। ফলে ছবিটি পড়ে গেল মাটিতে। মুহূর্তেই আভীর উন্মত্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
“পিহুহুহু হুহুহুহুহুহুহু।”
গোধূলি লগ্নে অপরাহ্নের আলো টুপটাপ করে সন্ধ্যার আঁধারে গড়িয়ে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বারের সম্মুখে ব্যস্ততার কলরব। ধূলিধূসরিত রাস্তায় যানবাহনের চাকার ঘূর্ণনে ধোঁয়ার মতো কুয়াশার আভা ছড়িয়ে পড়ছে। এই সমস্ত কোলাহলের কেন্দ্রে নিঃসঙ্গ পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছে আনায়া। তার দৃষ্টিতে বিষাদের ছায়া সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত। আনায়া অবিরাম চলেছে অথচ গন্তব্যহীন। বারংবার তার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটিই স্বর,
“সে আমার স্পর্শ করা প্রথম নারী, যার সুরক্ষার জন্য আমি তাকে ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন করিয়েছি।”
একটি বাক্য অনস্তিত্বের তীর হয়ে বিদ্ধ হলো আনায়ার হৃদপিণ্ডে। হ্যাঁ, কিছুক্ষণ পূর্বে সে ইউভানের কাছে গিয়েছিল দেখা করতে। তবে, সাক্ষাতের পূর্বেই ইউভানের উচ্চারিত শেষ কয়েকটি বাক্য তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে ধাক্কা দেয়; আর সেখানেই থমকে যায় সে। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে। হৃৎস্পন্দনের গতি ক্রমেই চাঞ্চল্য লাভ করে আনায়ার। সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার অবকাশ ছিল না তার। তাই তো সে নীরবে ইউভানের অগোচরে স্থান ত্যাগ করেছে।
বর্তমানে সে পুনরায় ফিরে আসে আনায়া।বারবার মনে পড়ে ইউভানের সেই উচ্চারিত শব্দ যা তার হৃদয়ের বসন্তকে পরিণত করেছে কালবৈশাখীর তাণ্ডবে। তবুও, আশ্চর্যের বিষয়, তার নয়নে একফোঁটা জলও নেই।আনায়া হঠাৎ থেমে দাঁড়াল। ঠোঁটে কটাক্ষের হাসি ফুটিয়ে, ভাঙা কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“এজন্যই আপনার ভার্সিটিতে প্রফেসর হয়ে আসা ইউভান ভাই। শুধুমাত্র সেই নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাহ্! যাকে আমি চাইলাম, সে চাইলে অন্য কাউকে।”
অচিরেই কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠে আনায়ার। চোখের কোনায় জমা কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে এসে থমকে দাঁড়ায় গলার উপকণ্ঠে। কিন্তু সে কাঁদেনি। সমস্ত আবেগকে বুকের গভীরে চেপে রেখে, পুনরায় দহনময় কণ্ঠে বলল,
“আপনার বসন্তের পূর্ণফুল না-হয় সেই সৌভাগ্যনি নারী হোক ইউভান ভাই ।আমি না হয় বসন্তের অন্তিম পাতার মতো ঝড়ে পড়ব।আপনি সেই ফুলবিলাসে নিমগ্ন হয়ে হেঁটে যাবেন সেই ঝরা পাতার উপর দিয়ে।আর আমি মর্মর ধ্বনিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবো নিঃশেষে এবং উপেক্ষায়।”
এরপর দীর্ঘ এক নিঃশ্বাসে বুক হালকা করে আনায়া পুনরায় হাঁটা শুরু করে। চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমে আসছে। রাস্তাঘাটের বাতিগুলো একে একে জ্বলতে শুরু করে। ঠিক তখনই পেছনে চায়ের স্টল থেকে ভেসে এলো এক মনকাড়া সুর,
“আমার ভিতরটাই জানে,
মায়া কারে বলে;
এই মায়া তো কাটবে না রে,
এ জীবন ও গেলে;
আমার অশ্রুখানা জানে,
কত ভালোবাসি তোরে,
তোর মায়া তো কাটবেনা রে,
এ জীবনেও গেলে…!”
আনায়ার হৃদয় আগুনে দগ্ধ হয়ে ছাইয়ে রূপ নেয়। সুরটি তার মৌন হৃদয়ের অব্যক্ত অনুভবকে উন্মোচিত করে দেয়। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে চেপে ধরল।তবে হঠাৎ করেই কারো স্পর্শে চমকে উঠে আনায়া।মুহূর্তেই পিছন ফিরে তাকাল সে।রুহি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলি তুই? এই তোর ৫ মিনিট হ্যাঁ? আয়ান ভাই এসেছে আমাদেরকে শপিংয়ে নিয়ে যেতে। সারাহ আপু, সাদনান ভাই, বড় মামা সকলে বিয়ের কেনাকাটায় ব্যস্ত। চল এখন।”
আনায়ার কর্ণে শব্দগুলো আদৌ প্রবেশ করেছে কিনা, তা অনির্ধারিত। সে নিঃশব্দে কেবল রুহির মুখপানে তাকিয়ে রইল। রুহি ধৈর্যহীন হয়ে তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও বসে। আনায়াকে দেখে মনে হবে, সে এক নির্জীব পুতুল, যাকে যেমনভাবে চালানো হয়, তেমনই সে নড়াচড়া করে।রুহি,আনায়া গাড়িতে উঠতেই আয়ান ইঞ্জিন চালু করল।আনায়ার চেতনা নিঃশেষপ্রায়। গাড়ি শহরের কোলাহল পেরিয়ে চলেছে সামনের পথে। আনায়ার শীতল দৃষ্টি জানালার কাঁচ ভেদ করে বাইরের অন্ধকারে স্থির হয়ে আছে।
সারাহর বিবাহের সংগ্রহ-বিশেষ তোড়জোড় চলছে সর্বত্র। সাদনান হাত ধরে সারাহকে টানছে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে।রুহিও টুকটা কেনাকাটা করছে। বাড়ির সকলেই ক্রয়বিক্রয়ে নিমগ্ন। শুধুমাত্র আনায়া নিঃশব্দে এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সে সমস্ত কিছু লক্ষ্য করছে কিন্তু অন্তর্দৃষ্টিতে অনুভব করতে পারছে না। তার দৃষ্টিতে উৎসাহ নেই, শুধু আছে নিবিড় বিষণ্নতা।ঠিক তখনই রুহে উচ্ছ্বাসভরে বলে উঠল,
“এমন রোবটের মত দাড়িয়ে আছিস কেন? কিছু কিনবি না তুই?”
আনায়া আলতোভাবে মাথা ফিরিয়ে অপর দিকে দৃষ্টিপাত করে শীতল কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“আমার ভালো লাগছে না।তোরা কেনাকাটা কর।”
কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রুহি আনায়াকে বাধ্যতামূলকভাবে দোকানের অভ্যন্তরে টেনে নিয়ে আসে। একের পর এক জমকালো লেহেঙ্গা তুলে আনায়ার সম্মুখে উপস্থাপন করতে লাগে। আনায়ার দৃষ্টি একটি দিকেও স্থির হয় না। ঠিক সেই মুহূর্তে রুহি গোলাপী রঙের একটি লেহেঙ্গা সামনে ধরে বলল,
“এটা সুন্দর। তোকে মানাবে খুব।যা গিয় ট্রাইল রুমে এটা পড়ে আয়।”
আনায়ার মুখাবয়বে সুস্পষ্ট বিরক্তি ফুটে উঠে। লেহেঙ্গার দীপ্তিময় রঙসমূহ তার চোখে ধুলিকণার ন্যায় ভাসছে। তার দৃষ্টিতে এখন সবই অনুজ্জ্বল। রুহির কথায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে লেহেঙ্গাটি হাতে নিয়ে ট্রায়াল রুমের অন্তরালে প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ পর সে বাইরে আসে।তার পরণে হালকা গোলাপি রঙের রাজসিক লেহেঙ্গা, কোমরে দৃঢ় ফিটিং, বুকে জাঁকজমকপূর্ণ কারুকাজ, ঝলমলে রত্নখচিত অলংকারের ছোঁয়া। আনায়া চারদিকে রুহিকে খুঁজে কিন্তু তাকে দেখতে পায় না। তাই ওড়নাটি এক পাশে ফেলে আয়নার সম্মুখে গিয়ে স্থির হলো।নিজেকে দেখে এক অদ্ভুত অনুভব ঘিরে ধরে তাকে। এক অপরিচিত সত্ত্বার মতো লাগছে নিজেকে।
ঠিক তখনই আনায়ার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আয়নার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির দিকে।ব্যক্তির দৃষ্টি স্থিরভাবে নিবদ্ধ আনায়ার উপর। মুহূর্তেই তার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়, নিঃশ্বাস আটকে আসে। চোখাচোখি হলো ইউভানের সঙ্গে। আনায়া তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি অবনত করে পেছন ফিরে দাঁড়ায়। ইউভান ধীরপায়ে এগিয়ে আসে আনায়ার নিকটে। অষ্টাদশীকে লেহেঙ্গার আবরণে দেখেই ইউভানের হৃদয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।হালকা গোলাপি রঙে আনায়াকে এক কোমল কুসুম লাগছে। অতিরিক্ত উজ্জ্বল গায়ের বরণের লেহেঙ্গাটি অপরূপ দীপ্তি ছড়াচ্ছে। কেশগুলি কোমর ছুঁয়ে ঢলে পড়েছে। সব মিলিয়ে এক স্বর্গীয় অপ্সরার অনুরণন প্রতিভাত হচ্ছে আনায়ার মধ্যে। ইউভান একবার উপর থেকে নিচ অবধি পরখ করে দেখে আনায়াকে।
ইউভানকে দেখে আনায়ার হৃদয়ে চেপে থাকা প্রাচীন ক্ষত পুনরায় রক্তক্ষরণ শুরু করে। সে ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করে। সে দৃষ্টিনিম্ন করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ ইউভান কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই ওড়নার এক প্রান্ত তুলে নিয়ে আলতো করে তার মাথায় আবৃত করে। এক মুহূর্তের জন্য আনায়া কেঁপে উঠে। সে চোখ তুলে তাকাল ইউভানের দিকে।ঠিক তখনই ইউভান শীতল কণ্ঠে বলল,
“বউ বউ লাগছে তোকে সানসাইন।”
আনায়া চোখ দুটি বন্ধ করে, তারপর ওষ্ঠ খুলে উচ্চারণ করল,
“কার বউ?”
ইউভান এবার আনায়ার দু’ বাহু ধরে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে দিল। আনায়া আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে থমকে যায় সত্যিই তো, মাথায় ওড়না দিয়ে তাকে বধূরূপে লাগছে। ইউভান তার দিকেই তাকিয়ে বলল,
“জানি না, তবে হবে একজনের।”
আনায়া কষ্টে জমাট বাঁধা কণ্ঠে বলল,
“আমি সত্যিই অন্য কারোর বউ হয়ে যাব?”
ইউভান কিছু সময় নিরবতা রক্ষা করল, তারপর গভীর কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, হতে তো হবেই কারোর বউ কোন একদিন।”
আনায়া এবার একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার বক্ষস্থল হাহাকারে কাঁপছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ফিসফিস করে বলল,
“কার?”
ইউভান এবার এত নিকটবর্তী এলো যে তার কাঁধে স্পর্শ করে না, তবুও তার উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে আনায়ার গালে।গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“যাকে দেখলে তোর নিজের নিজের লাগবে তার। যাকে দেখলেই তোর হৃদয়ের স্পন্দন তীব্র হয়ে উঠবে। যার স্পর্শে তুই কেঁপে উঠবি। যার অনুপস্থিতি তোর ভিতরে এক সুনামি তৈরি করবে, যা কেবল তার উপস্থিতিতেই প্রশমিত হবে। যার পাশে থাকার আকাঙ্ক্ষা তোর হৃদয়ে প্রবল হয়ে উঠবে।”
আনায়া চোখ বন্ধ করল না। তার অন্তরকুঞ্জে উথালপাথাল দোলা লাগছে। কেউ জানুক বা না জানুক, সে তো জানে কার স্পর্শে তার শরীর কেঁপে ওঠে? কাকে দেখলে হৃদপিণ্ডের গতি দ্বিগুণ হয়ে যায়? কার পাশে থাকার আকুতি প্রতিনিয়ত তার হৃদয়ে বাজে? সেই তো ইউভান।কিন্তু সে তো আর চাইলেও ইউভানকে পাবে না। সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে আয়নার ইউভান প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“যাকে দেখে আমার আমার লাগে সে তো আমার না ইউভান ভাই। একপাক্ষিক চাওয়াতে কী আসে যায়? সে তো অন্য গ্রহের চাঁদ। সেই চাঁদের কাছে নিজেকে বামন লাগে। বামন হয়ে চাঁদের দিকে কিভাবে হাত বাড়াই?”
ইউভান মৃদু নিঃশব্দ হাসে। সরু চোখে নিবদ্ধ করে আনায়ার প্রশ্নভরা মুখের দিকে,
“যে তোর, সে তোরই থাকবে। তুই না হয় সাগর হয়ে যা, চাঁদ না হয় নেমে আসবে সমুদ্রের বুকে। তুই যখন তরঙ্গ হয়ে ছুটে আসবি, চাঁদ তখন তোর বুকে আলো ছড়াবে। দুজনে মিলে সুখ-দুঃখের আলাপন করবি মানিয়ে নিতে পারলে মন্দ হবে না।”
আনায়ার নয়ন জলে টলমল করতে থাকে বেদনায়। সে কোনোমতে চোখের অশ্রু বাধা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু না! ইউভানের সম্মুখে সে দুর্বলতা প্রকাশ করবে না। হঠাৎ সে এক ধাক্কায় পেছনে ঘুরে ইউভানকে দূরে ঠেলে দিল। ইউভান সামান্য হেলে গেল। বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে আনায়ার দিকে। তার আচরণ ইউভানের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকল।আনায়া আর এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে দ্রুত ট্রায়াল রুমে প্রবেশ করে পোশাক পরিবর্তন করে নেয়। ইউভান কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে,
“এর আবার কী হলো?”
হঠাৎ ইউভানের মোবাইল বেজে উঠে। এক অতি গুরুত্বপূর্ণ কল। চোখেমুখে তীক্ষ্ণতা ফুটে উঠে তার। সে দ্রুতগতিতে দোকান ত্যাগ করে কল রিসিভ করল।ইউভান বেরিয়ে যেতেই আনায়া ট্রায়াল রুম থেকে বাইরে এল। তাকে দেখে রুহি এগিয়ে আসে, কিন্তু আনায়া এবার রুহিকে কোনো বাক্য উচ্চারণের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি দোকান থেকে বেরিয়ে পরে। রুহি কিছুক্ষণ বিমূঢ়ভাবে চেয়ে থেকে পেছন থেকে ডাকতে লাগল,
“আনায়া, কোথায় যাচ্ছিস তুই? থাম!”
কিন্তু আনায়া থামলো না সে সোজা শপিংমল থেকে বেরিয়ে আসলো।রুহিও শপিং মল থেকে বেরিয়ে আসতে যাবে তার পূর্বে এক কঠিন বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে নিচে লুটিয়ে পড়ল। এবার রুহির ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে। সে দৃষ্টি ফেরায় সামনের দিকে। সম্মুখে অবস্থানরত ব্যক্তিকে দেখে তার কপাল ভাঁজ পড়ল সঙ্গে সঙ্গে।সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর কেউ না তাদের ক্লাসমেট রোহান। রুহি রোহানকে দেখেই উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওই টাকলু! তোর সাহস তো দেখছি সীমাহীন! আমাকে ধাক্কা মারিস হ্যাঁ?”
রোহান রুহিকে অনায়াসে চিনে ফেলল, কিন্তু তার বোধগম্য হলো না এই মেয়ে এখানে কী করছে? ‘টাকলু’ শব্দটি রোহানের অহমে প্রচণ্ড আঘাত হানে। সে দাঁত কপাটি চেপে বলল,
“এই রাক্ষসনি ঠিক করে কথা বল।কাকে টাকলু বলিস তুই?”
রুহির দৃষ্টি গেলো রোহানের মাথার উপড়। সেখানে কচি চুলের ক্ষীণ সঞ্চার ঘটেছে। এই দৃশ্য দেখে রুহির প্রবল হাসি চেপে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। অবিরত হাসতে হাসতে সে বলে উঠল,
“হো হো সরি!হাফ টকলু না মানে কচি কচি চুল তো গজিয়েছে মাথায়।তাই হাফ টাকলু নামটাই তোর জন্য একেবারে পারফেক্ট।”
রোহান কিছু প্রতিউত্তর দিতে যাবে, তার আগেই পেছন থেকে এক শীতল কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ভেসে আসে,
“রোহান তুই এসেছিস।”
রুহি পেছন ফিরে চাইল।সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সাদনান। সাদনান কীভাবে রোহানকে চিনল, তা রুহির বুঝলো নাহ। রোহান দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়ে সাদনানকে আলিঙ্গন করে বলল,
“তুমি ডেকেছো আর আমি না এসে থাকতে পারি ভাইয়া?”
রুহি বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রলআছে। ‘ভাইয়া’ শব্দটি তার মনস্তত্ত্বে প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করে। তার মানে রোহানই হচ্ছে তার বড় মামার সেই নিয়ন্ত্রণ-উল্লঙ্ঘনকারী কনিষ্ঠ সন্তান। রুহি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রোহানকে নিয়ে সে সামান্য কিছু শুনেছে সারাহর কাছ থেকে, কিন্তু কখনো দেখেনি। রোহান তার পরিবারে অবস্থান করে না; সে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে আবাসিক হোটেলে জীবনযাপন করে। কিন্তু এর নেপথ্য কারণ অজানা।
শপিংমলের বাইরের পরিবেশটা ছিল খানিকটা ধুলিধূসর। রাস্তাঘাটে যানবাহনের সঞ্চার, ফুটপাথে মানুষের গমনাগমন। এক কোণ থেকে দুই পথকুকুর হঠাৎ কর্কশভাবে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। আনায়া হাতে গাড়ির চাবি নিয়ে দ্রুতপদে গাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে। ইউভানও সেখানে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল। কিন্তু হঠাৎ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো আনায়ার ওপর। এই রাতে আনায়া একাকী কোথায় যাচ্ছে?এ চিন্তায় ইউভান উদবিগ্ন হয়ে ফোনটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। নিঃশব্দে আনায়ার পশ্চাদ্ধাবন করে, তার দৃঢ় বাহুটি এক ধাক্কায় বাড়িয়ে আনায়ার কব্জি আঁকড়ে ধরে।এক লহমায় আনায়ার গমনপথ স্থবির হয়।
দেহজুঁড়ে একপ্রকার কাঁপুনি অনুভব করে সে পিছন ফিরে তাকায়। ইউভানকে তার হাত ধরে রাখতে দেখে, আনায়ার মুখাবয়বে তীব্র কঠোরতা ফুটে উঠে। সে এক আকস্মিক ঝাঁকুনিতে হাতটি মুক্ত করে নিয়ে দৃপ্ত স্বরে গর্জে উঠল,
“স্পর্শ করবেন না আমাকে আপনি।”
ইউভান হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিপাত বিস্ময়ে প্রশস্ত হয়ে উঠে। সে গলার স্বর নিম্ন রেখে আশ্চর্যভরে উচ্চারণ করে,
“কি হয়েছে তোর? পাগলামি কেন করছিস?”
আনায়া রক্তাভ দৃষ্টিতে অবলোকন করে। তার হৃদপিণ্ডের ক্ষত-বিক্ষত যন্ত্রণা অনুভব করবার সামর্থ্য ইউভানের নেই। সে অনুধাবন করতেও অপারগ, এই বিষাদ আনায়া একাকী বহন করছে। আনায়া দুর্দম কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“অন্যের বউকে স্পর্শ করতে লজ্জা করেনা আপনার?”
এক নিমেষে ইউভানের মস্তিষ্কে বজ্রাঘাত হানে। হঠাৎ করেই সে আনায়ার সরু কোমর আকর্ষণ করে তাকে নিজের বুকে নিবিষ্ট করল। মুহূর্তের ভেতর আনায়া তার দেহঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। তখনই ইউভান কণ্ঠনালীর সমস্ত জোরে বিস্ফোরিত স্বরে চিৎকার করে উঠে,
“হোয়াট দা ফাক? কি সব আজেবাজে কথা বলছিস? কার বউ? কিসের বউ তুই?!”
আনায়া উভয় হস্তে ইউভানের বুক ঠেলে তাকে প্রতিহত করার প্রয়াসে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে,
“এখনো হয়নি, তবে ভবিষ্যতে তো হবো তাই না? ভবিষ্যতে আমি হবো অন্য কারোর বউ।”
উচ্চারিত শব্দগুলি যেন তীক্ষ্ণ বিষাক্ত তীর হয়ে ইউভানের হৃদয়পিণ্ডে বেদনার গভীর ছাপ কাটে। তার সানশাইন অন্য কারও জীবনে আলো ছড়াবে এই কল্পনা মাত্রেই তার হৃদয় থরথর করে কাঁপে। ইউভান তখনই আতঙ্কে ছটফট করতে করতে আনায়ার উভয় গাল দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে কোমল স্বরে বলল,
“কি হয়েছে সুইটি?রাগ করেছিস আমার উপর হুম?বল কী হয়েছে?এমন আচরণ কেন করছিস তুই?”
আনায়ার নয়নজলে প্লাবিত হয়ে উঠে। বেদনাবিধুর অভিব্যক্তি তার মুখাবয়বে স্পষ্ট। সে ইউভানের চক্ষে চেয়ে আবারও বলল,
আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৮
“ঠিকি শুনছেন।আমি বউ হবো অন্য কারোর। অন্য কেউ এসে আমাকে বউ বানিয়ে নিয়ে যাবে তার বাড়ি।
আপনি শুধু চুপচাপ দেখবেন! শুধুই দেখবেন, বুঝলেন?”
ইউভানের হৃৎপিণ্ড ছিন্নভিন্ন হয়ে উঠে। উৎকণ্ঠায় তার কপালে রক্তনালীগুলি উদ্গত হয়ে উঠে। তার হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে গেল। আনায়া ধীরে ধীরে সেই আলিঙ্গন থেকে মুক্তি নিয়ে একপা পেছনে সরে দাঁড়ায়।ইউভান নির্বাক বিস্ময়াচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।আনায়া নিজের চক্ষুকোণ থেকে জল মুছে পিছন ফিরে তীব্র গতিতে হাঁটা শুরু করে। ঠিক সেই ক্ষণেই ইউভানের মানসিক ভারসাম্য চঞ্চল হয়ে উঠে। সে কণ্ঠ ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
“সুইটি!নো!নো!সুইটি স্টপপ!প্লিজ স্টপ।”