আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৯
প্রীতি আক্তার পিহু
সুইজারল্যান্ড,
আইস প্যালেসের চারপাশে ঘন তুষারপাত হচ্ছে।পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল এই প্যালেসের চারপাশে জমে আছে হিমশীতল বরফের স্তর।প্যালেসের আশেপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সহস্র গার্ডরা পরনে তাদের কালো ইউনিফর্ম।সকলের হাতে ধারালো অস্ত্র।ঠিক তখনই প্যালেসের ভারী দরজা শব্দ করে খুলে যায়। সাদা ধোঁয়া আর বরফের কুয়াশা ঠেলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ড্যারেন।মুখজুড়ে কালো মাস্কে আবৃত তার।তার পেছন পেছন আরও কয়েকজন এলিট গার্ড সামনে এগিয়ে আসে।
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ভারী গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন থামে প্যালেসের সামনে।গাড়িটি কালো বুলেটপ্রুফ এবং পেছনে বানানো বিশাল লোহার খাঁচা।দেখতে ঠিক পশুবাহী গাড়ির মতো।তৎক্ষণ ড্যারেন গার্ড গুলোকে চোখের ইশারা দেয়।মুহূর্তের মধ্যে গার্ডগুলো গাড়ির পেছনে খাঁচার সামনে এগিয়ে আসে।ভেতর থেকে একে একে বের করতে থাকে শিশুদের।সকলের বয়স প্রায় ৮ থেকে ৯ বছরের মতো।তারা প্রায় ২০০ জনের মতো।প্রত্যেকের চোখ, মুখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া। প্রত্যেকের হাতে লোহার শিকল বাঁধা।এই শিকলগুলো তাদের দুই হাতের মাঝখানে শক্ত করে আটকানো।গার্ডরা সেই শিকল ধরে টেনে টেনে এক এক করে শিশুদের নামিয়ে আনে।গার্ডরা নিঃশব্দে শিকল টেনে হিচরে প্যালেসের অভ্যন্তরীণে নিয়ে যায়।তখনই গাড়ির অভ্যন্তরীণ থেকে আরেকটি ব্যক্তি বেরিয়ে আসে।ড্যারেন দুই কদম এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমার তরফ থেকে K.K কে থ্যাংকস বলে দিবে ম্যাক।”
ম্যাক নিচু গলায় বলে ওঠে,
“কিন্তু স্যার ফর্মুলা টা….
ম্যাকের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে
“হেই ম্যান স্টপ?”
চারপাশে নীরবতা।ম্যাক চোখ তুলে সামনে থাকা রহস্যময় ব্যক্তিটির দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর জুড়ে ঘাম ধরতে শুরু করে এই শীতলতার মাঝে। ড্রেভেন শান্ত ভঙ্গিতে সামনে আসে মুখে তার চিরচেনা মুখে ড্রাগনের মুখোশ।সে পুনরায় শীতল কণ্ঠে বলল,
“এত তাড়া কীসে তোমাদের k.k এর?”
ম্যাকের ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।তবুও সে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল,
“স্যার,K.K বলেছে ফর্মুলা না দিলে পরবর্তীতে বাচ্চা গুলো কে আর আপনাদের হাতে তুলে দিবে না।”
এহেন কথায় ড্রেভেন উচ্চ স্বরে হাসল।হাসির আওয়াজ এতটা ভয়ঙ্কর ছিল যে আশেপাশের পাখিগুলো ডানা ঝাঁপ খেয়ে উড়ে চলে যায়।ম্যাকের পা থরথর করে কাঁপছে।তৎক্ষণ ড্রেভেন রক্ত শীতল কন্ঠে বলল,
“আমাকে দেখে কি বোকা মনে হয়?আচ্ছা ধরো আমি ফর্মুলা দিয়ে দিলাম। তারপর?তখন তোমাদের K.K কোন দায়বদ্ধতায় বাচ্চাগুলো আমাদের হাতে তুলে দিবে?”
লোকটি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে। ড্রেভেনের কথার প্রতি উত্তরে কি বলবে সেটা তো আর জানা নেই।কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা তারপর ড্রেভেন সতর্কতা জুড়ে পুনরায় শুধালো,
“আমার তরফ থেকে K.K একটি বার্তা।তাকে জানিও দিও ড্রেভেন এত সহজে তার অতীত ভুলে যাবে না।প্রতিটা হিসাব কড়াই-গন্ডায় নিবে।রক্তের খেলা সে খুব শুরু করেছিল আর শেষটা আমি করব।”
এই কথা তো বলেই ড্রেভেনে মুখায়ব সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়।তার নীল চোখের মনি জ্বল জ্বল করছে।ম্যাক এবার শুকনো ঢুক গিলে বলে,
“ঠ ঠি আছে স্যার!”
ড্রেভেন আরও ক্রোধিত হলো।সে ক্ষিপ্র আগুনে জ্বলন্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“আরও বলে দিও আমার গোল্ডমেরি আনায়ার পিছনে বারবার লোক পাঠিয়ে ক্ষতি করে লাভ নেই।এমন কাজ পুনরাই করলে তার,পরিণতি মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর হবে।”
ম্যাক আতঙ্কে দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে।ড্রেভেনে জলন্ত নীল চোখ ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করে।তবে আচমকা পেছন থেকে মিস লিয়া ছুটে আসে।ড্যারেন অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাই।মিস লিসা হাপাতে হাপাতে তীব্র কণ্ঠে বললে,
“স্যার! স্যার অনেক বড় প্রবলেম হয়ে গিয়েছে।”
ড্রেভেন কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কি হয়েছে?”
মিস লিসা আতঙ্কে ঠোঁট ভিজিয়ে প্রবল কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“স্যার থমাস অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
এই কথা শোনা মাত্রই ড্রেভেন থমকে যায়।চোখে বিস্ময়ের ছায়া তার।ড্যারেন উচ্চ কন্ঠে উচ্চারণ করে,
” ওয়াট দ্যা ফা**ক।”
ড্রেভেন আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না জোড় পায়ে হেঁটে আইস প্যালেসের ভেতরে প্রবেশ করে।পেছন পেছন ড্যারেন এবং মিস লিয়া ও যায়।ড্রেভেনে হাঁটার গতি আরো তীব্র হয়ে ওঠে। প্যালেসে গোপন দরজা পেরিয়ে
জেনেসিস পিট-এর ভেতরে প্রবেশ করল তারা।ড্রেভেন আশেপাশে না তাকিয়ে একদমে থমাসের চেম্বারে এসে দাঁড়ায়।কাচের অপর পাশে থমাস নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে।থমাসে চোখ দুটো বন্ধ করা এবং মাঝেমধ্যে শুধু লেজে নাড়াচ্ছে।খানিকক্ষ পরপর সাপের মতো জিহবাটা বের করে শিসশিস শব্দ করছে।এই দৃশ্য প্রতক্ষ করে ড্রেভেনের মাথায় আগুন উঠে যায়।ড্যারেন মিস লুয়ারে দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“হোয়াট ননসেন্স?এসব কখন, কিভাবে হলো?
মিস লিয়া গলা শুকিয়ে গেলে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“স্যার, জানি না ঠিক । তাকে তো নিয়মিত খাবার দেওয়া হয়েছিল। তারপরও এমন হলো কেন বুঝতে পারছি না।”
ড্রেভেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থামাসের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। সে লক্ষ্য করল থামাসের নাক থেকে কুচকুচে কালো রঙের কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে।তার শরীরের চামড়া জ্বলে ওঠা শুরু করেছে কিছু কিছু জায়গায়।ড্রেভেনের মুখোশের আড়ালে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।সে এ দৃশ্য প্রতক্ষ করে চিৎকার দিয়ে উঠে বলে,
“কল টু ড: আভীর কায়ানাত ইমিডিয়েটলি।”
মিস লিয়া কিছুটা অবাক হয় কারণ আভীর কায়ানাত তো নামকরা হার্ট সার্জন।আগপরে ড্রেভেনের সাথে কখনো দেখেনি।হঠাৎ তাহলে ড্রেভেন আভীরের নাম কেন নিল?আভীর কীভাবে থমাসের চিকিৎসা করবে? এসব প্রশ্ন মিস লিয়ার মাথায় ঘুরপাক খায়।ড্রেভেন তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুনরায় গর্জে ওঠে,
“কল হিম রাইট নাও।”
অপরদিকে বাংলাদেশে,
ঠিক সেইক্ষণেই ইউভানের মানসিক ভারসাম্য চঞ্চল হয়ে উঠে। সে কণ্ঠ ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
“সুইটি!নো!নো!সুইটি স্টপপ!প্লিজ স্টপ।”
কিন্তু আনায়া থামল না। হনহনিয়ে গাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখান থেকে প্রস্থান করল। একটিবারও পিছে ফিরে চাইল না। ইউভান এ দৃশ্য দেখে অস্থিরতায় বিধ্বস্ত হয়।সে তৎক্ষণাৎ আনায়ার গাড়ির পিছু ধাওয়া করতে শুরু করে। আনায়া গাড়ির কাচের মাধ্যমে ইউভানের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে। তার হৃদয়ের গভীরে অম্লান বেদনাবোধ সঞ্চারিত হয়।সে টলমল দৃষ্টিতে গাড়ির গতি বহুগুণ বৃদ্ধি করে।ফলশ্রুতি, গাড়িটি ইউভানের দৃশ্যসীমার বাইরে সরে গেল।ইউভান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগে।মুহূর্তেই সামনের দিকে দৃঢ় চিত্তে তাকিয়ে হিংস্র কণ্ঠে গর্জন করল,
“কত দূরে যাবি আমার থেকে তুই?আমার চোখের আড়াল হওয়া কি এত সহজ?ইউভান তোর শিরায় শিরায় মিশে আছে।তুই যেথায় যাস না কেন আমি ঠিকি খুঁজে নিব।”
বলেই বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ফোন বের করে মনোযোগের সহিত কিছু দেখতে থাকে ইউভান। অন্যদিকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আনায়ার গাড়ি থামে একাকী নির্জন স্থানে। যেখানে চট্টগ্রামের শহরের কোলাহল থেমে প্রকৃতির অমিত জলরাশির গর্জন শোনা যাচ্ছে।আনায়া গাড়ির দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো এক ঝটকায়। ঝড়ো হাওয়ায় তার চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে সাগরের পাড়ে। চারপাশে শুধু বায়ুর গর্জন। আনায়া স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বক্ষের গভীরে গুমোট যন্ত্রণার তীব্র হয়ে উঠছে তার। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলক দিচ্ছে হালকা নীলাভ দীপ্তিতে। আকাশ আর সমুদ্র যেন একাকার হয়ে গেছে। সমুদ্রের শীতল তরঙ্গ আনায়ার পা স্পর্শ করে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ইউভানের কথা স্মৃতিতে আসতেই সে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। তার মাথা, হৃদয়, শিরা-উপশিরায় শুধুমাত্র একটাই বাক্য প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যে, ইউভান তার নয়, সে অন্য কারো। ঠিক তখনই পেছন শীতল পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“সুইটি….”
কণ্ঠস্বরটি সরাসরি গিয়ে বিধ্বস্ত করে আনায়ার হৃদয়ের অন্তস্থল। মুহূর্তের মধ্যেই সে চোখ মেলে তাকায়। বুঝতে আর বাকী রইল না কার উপস্থিতি। কিন্তু আনায়া এখন কী করব? কী বলব? সে তো দুর্বল হয়ে পড়বে ইউভানের সামনে। কিন্তু সে অঙ্গাঙ্গীণ ভাবে অনুধাবন করে তার দুর্বলতা প্রকাশে নিজেকে অক্ষম রাখতে চাইছে। আনায়া পেছনে ফিরলো না। শুকনো ঢুক গিলে নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
“কেন এসেছেন এখানে?”
ইউভান নিঃশব্দে হাসলো। দু’কদম এগিয়ে এসে পুনরায় বলল,
“পালিয়ে লাভ হলো কী?সেই তো ধরে ফেললাম?”
আনায়ার ভ্রুঁ সামান্য সংকুচিত হয়। সে দৃঢ় স্বরে বলল,
“আপনাকে কে বলেছে আমি পালিয়ে এসেছি? আমি কেন পালাবো আপনার থেকে?”
ইউভান বিস্ময়ে ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠে,
“তাহলে কেন এমনভাবে আসলি?”
আনায়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ধীরে ধীরে ঝাঁপসা হয়ে ওঠা ব্যথা দমন করে, ক্ষতবিক্ষত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“আমি পালাইনি! আমি মুক্তি চেয়েছি আপনার ছায়া থেকে।”
ইউভান হঠাৎ আনায়ার নিকটে এসে দাঁড়ায়। আনায়ার কেশপুঞ্জ তীব্র বাতাসে উড়ছে। সেই ঝড়ানো চুলের ঘ্রাণ ইউভানের মুখে ছড়ায়। চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাসে সেই ঘ্রাণ গ্রহণ করে ইউভান। ঘ্রাণে তার হৃদয় উত্তেজনায় মত্ত হয়ে উঠে। পরমুহুর্তে সে ঠাণ্ডা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“এত সহজে মুক্তি পাওয়া যায়? আমার ছায়া থেকে মুক্তি তুই এ জন্মে কেন, পরের জন্মেও পাবি না সানসাইন।”
আনায়া তখনও পেছনে ফিরে তাকায় না। তার চোখ স্থির হয়ে আছে গভীর সমুদ্রের মতো। সে কণ্ঠে এক রাশ হতাশা নিয়ে বলল,
“পরের জন্ম বলতে কিছু নেই ইউভান ভাই।”
ইউভান ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে কণ্ঠ ভারাক্রান্ত করে বলল,
“এজন্যই তো এ জন্মেই তোকে বন্দিনী বানানোর চেষ্টা করছি আমি।”
ইউভানের এহেন কথায় আনায়া ঘুরে দাঁড়ায়।সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইউভানের দৃষ্টিতে।ইউভানের বক্ষ মোচড় দিয়ে উঠল আনায়ার দৃষ্টিতে। আনায়ার দৃষ্টি অদ্ভুত ঠেকছে তার কাছে। এবার আনায়া তাচ্ছিল্যময় কণ্ঠে বলল,
“এই দৈত্যসুলভ আচরণের কারণ কী ইউভান ভাই? এক জন্মে কতজনকে বন্দিনী বানাতে চান আপনি? হ্যাঁ?”
ইউভান চোখ কুঁচকে তাকায়। বিস্ময়ে প্রশ্ন করে ওঠে,
“কী সব আজেবাজে কথা বলছিস? কতজন মানে? তুই আমার সঙ্গে আর কতজনকে দেখেছিস?”
সমুদ্রের অশান্ত ঢেউয়ের সঙ্গে আনায়ার হৃদয়ের স্পন্দনও অস্থির হয়ে উঠছে। সাগরের বুক চিরে বাতাস তীব্র গতিতে এসে সবকিছু বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। আনায়া ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাটার মতো খচখচে কণ্ঠে বলল,
“কেন আপনার সেই আকাঙ্ক্ষার প্রথম স্পর্শপ্রাপ্ত নারী, যাকে রক্ষা করার জন্য রকস্টার হওয়ার সত্বেও প্রফেসর হয়ে ভার্সিটিতে এসেছেন।সে তো আপনার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাই না?”
ইউভান স্থবির। কী বলছে আনায়া,তা অনুধাবনের ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত সে। হঠাৎ বয়ে আসা ঝড়ো হাওয়ার গুঞ্জন তার কর্ণকুহরে বেজে উঠছে অবিরাম। ইউভান মুহূর্তেই এক হাতে চুগুলো পশ্চাৎ দিকে সরিয়ে বলল,
“ওহ গোড।”
তারপর আনায়ার মুখাবয়বের দিকে একনিষ্ঠ দৃষ্টিতে তাকায়। এতক্ষণে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে আনায়ার ক্রুদ্ধ অভিমানময় অবস্থানের উৎস।ইউভানের হৃদয়ের অন্তর্গত সুর অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠছে। সে অধরসীমায় জলের আভাস এনে অস্থির সুরে উচ্চারণ করে,
“সুইটি!তুই যেটা ভাবছিস বা বলছিস সেরকম কিছুই না। অর্ধসত্যে খুব ভয়ঙ্কর হয় জানিস তো তুই?”
আনায়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। কৃষ্ণবর্ণ আকাশ ধীরে ধীরে আরও গাঢ় ও বিষণ্ণ রূপ ধারণ করছে। সমান্তরালে আনায়ার অন্তর্দাহ ও বিক্ষোভও তীব্রতর হয়ে উঠছে। সে এক ঝটকায় ইউভানের হাত প্রত্যাখ্যান করে বলল,
“কোন অর্ধসত্যের ইঙ্গিত দিচ্ছেন আপনি? আপনি তো বলেছিলেন আমি আপনার জীবনের দ্বিতীয় নারী। তবে প্রথম জন কে? সে তো আপনার হৃদয়সিংহাসনের প্রকৃত অধিকারিণী। আমি তা কীভাবে মেনে নেব? বলুন তো কী উপায়ে মেনে নেব?”
ইউভান ব্যাকুল হয়ে আনায়ার হাত আঁকড়ে নিয়ে তাকে অদূরে টেনে আনে। কিন্তু সেই স্পর্শে আনায়ার ধমনিতে বেগ তীব্রতর হয়। সে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে উঠে,
“স্পর্শ করবেন না আমাকে! আপনি তো অন্য কারোর! আমার নয়, নয়! আপনি তো সম্পূর্ণরূপে অপর কারোর।”
এই বলে আনায়া ইউভানের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বিদীর্ণ করে মেঘের গর্জন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সাগরের উত্তাল তরঙ্গ ক্রমে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আনায়া উভয় হাত দিয়ে নিজ চুলগুলি চেপে ধরে পুনরুচ্চারণ করে,
“আমাকে ধ্বংস করে দেবার এত আয়োজন আপনার ইউভান ভাই? কেন এভাবে ভেঙে দিচ্ছেন আমাকে? বলুন তো কেন? কেন? কেন?”
আনায়ার এই উন্মাদনার ছায়া দেখে ইউভান নিস্পন্দ হয়ে পড়ে। আনায়া তার কোনো কথা শ্রবণে আগ্রহী নয়। ইউভান আর নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। সে আনায়াকে জোরপূর্বক নিজের বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ করে। আনায়া তৎক্ষণ ক্ষুব্ধ দু’হাতে ইউভানের বুকে আঘাত হানতে হানতে চিৎকার করে বলে,
“ছাড়ুন আমাকে! বহুরূপী আপনি! স্পর্শ করবেন না আমাকে। ছাড়ুন বলছি।”
আনায়ার দেওয়া আঘাতেও ইউভান তাকে ছাড়ে না; বরং আরও দৃঢ়ভাবে বেষ্টন করে রাখে নিজ বক্ষের অভ্যন্তরে। আনায়ার চুলে করুণ আদরে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ইউভান শুষ্ক কণ্ঠে বলে,
“সুইটি!প্রাণপাখি আমার।প্লিজ পাগলামি করিস না,শান্ত হ।
আনায়া থেমে যায়। ইউভানের প্রতিটি হৃদস্পন্দন সে যেন স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারছে। তার দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসে। তবু ইউভান অন্য নারীর স্পর্শধন্য হয়েছে এই কল্পনাতেই তার বুক জ্বলন্ত হয়ে ওঠে। সে মাথা উঁচু করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে,
“আপনি কেন আমার নন? কেন? কেন?”
ইউভান ধীরে ধীরে আনায়ার কপালের সাথে কপাল সংযুক্ত করে। তাদের নিঃশ্বাস একই সুরে মিশে একেকার হয়ে যায়। ইউভান কোমল স্বরে শুধায়,
“আমি তো কেবল তোরই সুইটি। কেবলমাত্রই তোর।”
আনায়া চোখ মেলে ইউভানের দিকে চাইল। ইউভানের সুপরিচিত মুখাবয়বটি আজ অচেনা লাগছে। সে কণ্ঠে বিস্ময় ও ক্লান্তি মিশিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তবু সেই নারী কে? কেন তাকে স্পর্শ করলেন আপনি? বলুন কেন?”
ইউভান আনায়াকে ছেড়ে দুই কদম পিছু হটে। তার চোখের সম্মুখে ঘুরপাক খায় অতীতের কিছু অপূর্ণ অধ্যায়। কয়েক বছর পূর্বে, ইউভানের কনিষ্ঠ আঙুল এক জোড়া ছোট্ট হাত আঁকড়ে ধরে ছিল দৃঢ়ভাবে। ইউভান ব্যর্থ হয়েছিল সেই আঙুল মুক্ত করতে। তাই তো সে নিজের হাতের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিল সেই নরম হাতের বন্ধন। সেই স্পর্শ কীভাবে কলুষিত হতে পারে? প্রাণরক্ষা করা সেই স্পর্শ কি পাপরূপে রূপান্তরিত হলো ইউভানের জীবনে? আনায়া একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইউভান মুখ ফিরিয়ে নিচু স্বরে উচ্চারণ করে,
“সে আমার জীবনের এক অনভিপ্রেত অতীত। তার প্রাণ রক্ষার্থেই আমি তাকে স্পর্শ করেছিলাম। সেই ছোঁয়ায় কোনো অবমাননা ছিল না সুইটি। তুই যা ভাবছিস তার কিছুই সত্য নয়।”
ইউভানের কণ্ঠ এক পর্যায়ে থামে। কিছু বলতে গিয়েও গলায় আটকে যায়। আনায়া বিস্ময়ে বিস্মিত হয়। সবকিছু যেন তার কাছে অস্বচ্ছ ও ধোঁয়াটে লাগছে। ইউভান আসলে কাকে বাঁচিয়েছিল?কেন সেই স্পর্শ? তার মনে হাজারো প্রশ্ন জমাট বাঁধে। সে বিস্ময় নিয়ে বলে,
“প্রাণরক্ষা মানে কী? আপনি কি কিছু আড়াল করছেন আমার কাছ থেকে ইউভান ভাই?”
ইউভান আবার আনায়ার কাছে এগিয়ে আসে। দুই হাত দিয়ে আনায়ার মুখমণ্ডল আলতো করে ধরে নিচু কণ্ঠে বলে,
“তুই কি আমাকে বিশ্বাস করিস না সুইটি।কোথায়,কেন,কিভাবে এসব জানতে চাস না। কেবল এটুকু জেনে রাখ আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন কেবল তোর জন্যই প্রকম্পিত হয়।”
আনায়া শান্ত ও শীতল চাহনিতে অপলক চেয়ে রইল। ইউভানের প্রতিটি উচ্চারণের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। আংশিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলেও সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারছে না আনায়া। হৃদয়ের গহীনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটি মাত্র বাক্য ‘আমি কেবল তোরই সুইটি’। ইউভানের এই একটি উক্তিতেই আনায়ার মনে তীব্র একাধিকারের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে।কিন্তু তবুও সে নিজের ক্রোধ সংবরণে ব্যর্থ।যেভাবেই হোক না কেন, আনায়ার কাছে সেই নারী শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর সমতুল্য। সে কঠোর কণ্ঠস্বরে পুনরায় উচ্চারণ করল,
“যেকোনো কিছুর প্রতি অংশীদারিত্ব আমার চিরকালীন অপছন্দের বিষয় ইউভান ভাই। যা ঘটেছে তা শুনতে আমি আগ্রহী না। কেবল এটুকুই স্পষ্ট করে বলব আপনার স্পর্শের অংশীদারিত্ব আমি অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করতে রাজি নই। আর যদি ভাগ করতেই হয়, তবে সেই আপনিটাই আমার প্রয়োজন নেয়।”
এই বাক্য শুনে ইউভান মৃদু হাসে। আনায়ার ক্রোধের প্রকৃত কারণ জেনে ইউভানের মনে অপার্থিব তৃপ্তি খেলে যায়।আনায়া কেবল তাকেই নিয়ে মগ্ন থাকুক এটাই ইউভান চেয়ে এসেছে আজীবন। নারীদের স্বভাবই তো অভিমান, রাগ, হিংসা দেখানো।আনায়া তাতে কোনো ব্যতিক্রম নয়। ইউভান কৌতুক মিশ্রিত ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“এতখানি অধিকারবোধ দেখানোর পেছনে কারণটা কি জানতে পারি ম্যাডাম?”
আনায়া অন্যদিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। তার অন্তর্গত রাগ এখনো প্রশমিত হয়নি। কণ্ঠস্বরকে কঠোরতার আবরণে মুড়ে সে আবার বলল,
“কারণটি না হয় রহস্যই থাকুক। তবে এটুকু জানিয়ে রাখছি যে, সেই নারী কে আমি জানতে চাইব না। কখনো তাকে আমার দৃষ্টিসীমায় আনবেন না। যদি সামনে আসে,তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটটে পারে।”
ইউভান তৎক্ষণাৎ বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে যায়। সে কীভাবে বলবে সেই নারী আর কেউ নয় বরং পিহু। আনায়ার প্রতিক্রিয়া তখন কেমন হবে?ইউভান পিহু,আনায়া,রুহির সম্পর্কে অবগত।তার কারণে কী আনায়া আর পিহু সম্পর্কে ফাটল ধরবে?এই চিন্তার ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হচ্ছিল ইউভান, এরইমাঝে আনায়া রুদ্ধস্বরে বলল,
“কারণ আমার বরাবরই নিজের জিনিসের উপর অন্যের দাবীদার অপছন্দের।যা আমার, তা সম্পূর্ণরূপে আমারই।”
ইউভান নিজের ঠোঁট চেপে ধরে। নিমেষে হুইস্কিতে ভেজা স্বরে প্রশ্ন করল,
” এই নিয়ম কিন্তু আমাদের একে অপরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ম্যাডাম।
“মানে?”
ইউভান হেসে উঠল। সেই হাসি যেন আনায়ার হৃদয়ের গহীনে শিহরণ তুলে। আনায়া অনুধাবন করতে পারে, নিজের অজ্ঞাতে হৃদয়ের সব অব্যক্ত অভিব্যক্তি উন্মোচিত হয়ে পড়ছে ইউভানের কাছে। ইউভান ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। আনায়ার নিকটবর্তী হয়ে সে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমার পৃষ্ঠদেশ জুড়ে শুধুই তোর আঙুলের বিচরণ হবে সুইটি। আর তোর ঠোঁটের উষ্ণতা পাওয়ার অধিকার কেবলমাত্র আমার জন্যই সংরক্ষিত থাকুক,এই অঙ্গীকার রইল।”
এক নিমেষে আনায়ার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়। ইউভানের মাত্র দুটি বাক্যে তার সমগ্র শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আনায়ার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বারংবার। আনায়ার কণ্ঠ শুকিয়ে গিয়ে গলার স্বর ভারী হয়ে আসে,
“শ…শুনুন! তাই বলে এই নয় যে আমার রাগ কমেনি বুঝলেন?”
ইউভান মুখ তুলে তাকায়।অগোছালো চুলে আনায়াকে আরও বেশি অপার্থিব লাগছে।সে হুইস্কির গড়নের কন্ঠে বলল,
“হুমম!বুঝছি ম্যাডাম।”
আনায়ার হৃদয়প্রতিটি স্পন্দনে ভারীতা এসে জমেছে। ইউভানের সামনে সে আর স্থির থাকতে পারছে না। পিছন ফিরে প্রস্থান করতে উদ্যত হয়। এক পা এগিয়ে যেতে না যেতেই ইউভান তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। আনায়ার হৃদয় যেন মুহূর্তেই কেঁপে ওঠে। সে রুদ্ধস্বরে বলে ওঠে,
“কি করছেন? ছেড়ে দিন আমাকে।”
ইউভান তার হাত আরও দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। আনায়া কপাল কুঁচকে তাকায়। ইউভান নিম্নস্বরে বলে,
“আমাকে ছেড়ে কোথায় যাচ্ছিস, সুইটি?”
আনায়ার হৃদয়ে ইউভানের প্রতি জমে থাকা অভিমান এখনও কমেনি। সে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল,
“শেষবারের মতো বলছি, ছেড়ে দিন আমাকে।”
আচমকা ইউভান তার হাত ধরে সমুদ্রতটের বালুকায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। একের পর এক সমুদ্রের তরঙ্গ এসে আছড়ে পড়ছে বালুচরে।ইউভানকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় সেই ঢেউগুলি। সেই ক্ষণেই ইউভান আনায়ার হাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে সুরে সুর মেলায়,
ও…ও ও ও…
পারব না আমি ছাড়তে তোকে,
কোনো মতেই আর হারতে তোকে;
সরে যেতে আর আমি পারব না,
ও…ও ও ও…
তৎক্ষণাৎ আনায়ার শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সে ধীরে পেছন ফিরে ইউভানের দৃষ্টির গভীরতায় নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। সমুদ্রের উচ্ছ্বাসী তরঙ্গগুলো আরও উত্তাল হয়ে দুইজনকে সম্পূর্ণভাবে ভিজিয়ে দেয়। ইউভান উঠে দাঁড়িয়ে, হঠাৎই আনায়ার কোমড় জড়িয়ে আকস্মিক টানে তাকে নিজ বক্ষে মিশিয়ে নেয়। আনায়ার শরীর শিহরিত হয়ে উঠে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার নিঃশ্বাস গলা অবধি আটকে আসে। তখনই ইউভান পুনরায় সুরে সুর মেলায়,
“পারব না আমি ছারতে তোকে,
কোন মতে আর হারতে তোকে,
সরে যেতে আর আমি পারব না….”
আনায়ার চোখর কোণ বেয়ে একফোঁটা লবণাক্ত জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ে। ইউভান স্নিগ্ধ হাতে সেই অশ্রুবিন্দু মুছে দিল। সে আনায়ার কালো চুলগুলো কানের পেছনে সরিয়ে, হিমশীতল স্বরে গেয়ে ওঠে,
“তোর বায়না সব রেখে দিব সাজিয়ে;
তুই চাইলে বল হয়ে আছি রাজিরে,
পালাতে আমি পারব না…….!”
সমুদ্রের ঢেউ বহুগুণ উত্তেজনায় আছড়ে পড়ছে বালুচরে। ইউভান আনায়ার ডান হাত উপরে তোলে ধীরে তাকে একপাশে আবর্তিত করে। সেই আবর্তনের তালে আনায়া উন্মুক্ত চুলগুলি হাওয়ায় উড়ছে।সমুদ্রজল ছিটকে দু’জনের দেহে এসে পড়ে।ফলস্বরূপ, তাঁদের শরীর জুড়ে শীতল জলের ধারা টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে। এত ঠান্ডার মধ্যেও ইউভানের সংস্পর্শে আনায়ার শরীর ধীরে উষ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে।আনায়া দৃঢ় হতে ইউভানকে নিজের থেকে আলাদা করে দিয়ে,পেছন ফিরে পদক্ষেপ বাড়ায়। ঠিক তখনই ইউভানের করুণ কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়,
“ছায়া তোর হয়ে আছি দেখ,
পথে তোর চেয়ে আছি দেখ….”
ইউভান তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে পেছন দিক থেকে আনায়াকে আলিঙ্গন করে। তার থুতনি এসে থেমে যায় আনায়ার ঘাড়ের ওপরে।আনায়া গলা বরাবর ইউভানের নিঃশ্বাস পড়ে।সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলায়। ঠিক তখনই ইউভান বিষাদভরা কণ্ঠে গান তোলে,
“তোকে বল কি করে বুঝাই…?
দুজনেই হয়ে আছি এক….
উম…পারব না আমি রাখতে তোকে,
পারব না আমি ঢাকতে তোকে..
ছেরে যেতে আর আমি পারব না….!”
ইউভান ধীরে আনায়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, তার চোখের গভীরতায় ডুব দেয়।আনায়ার দৃষ্টিতে পালানোর অস্থিরতা, আর ইউভানের দৃষ্টিতে ধরে রাখার দৃঢ়তা।ইউভান তার কপাল আনায়ার কপালে স্থাপন করে। আনায়া আবিষ্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।ইউভান বেদনাবিধুর কণ্ঠে আবার উচ্চারণ করে,
“তোর বায়না সব রেখে দিব সাজিয়ে,
তুই চাইলে বল হয়ে আছি রাজিরে,
পালাতে আমি পারব না…….
ওও..ওও..ও…..!”
আনায়ার হৃদয়ভূমি তীব্র আলোড়নে উদ্বেল হয়ে ওঠে। সে জানে এই আবেগ এত সহজে ধুয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।তবুও আবেগ চাপা দিয়ে, সে জেদের গলিটাই বেছে নেয়।এক ঝাঁটকায় ইউভানকে নিজ থেকে দূরে সরিয়ে দিল আনায়া। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই উল্টো পথ ধরে দৌড় দিল আনায়া।ইউভান আর তাঁকে থামায় না। কেবল অপার দৃষ্টিতে বিদায়ের পথে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ধীরে উচ্চারণ করে,
“তোর অভিমান না ভাঙ্গা পর্যন্ত।আমি প্রয়াস থামাব না, সুইটি।”
আধঘন্টা ধরে নির্জন পথে আনায়া হাঁটছে। না হাঁটছে না বরং দ্রুতগতিতে দৌড়াচ্ছে।সমগ্র দেহাতল সিক্ত হয়ে টুপটাপ করে জলাধার প্রবাহিত হচ্ছে তার। চতুর্দিকে বায়ুর গর্জন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে বর্ষণ নামবে আকাশ থেকে। পথের কিনারায় কোথাও একপ্রান্তে কুকুর কর্কশ স্বরে ঘেউঘেউ করছে।এমন সময় পার্শ্ববর্তী হতে গাড়ির হর্ন শোনা যায়। আনায়া বিরক্তিবোধে পাশ ফিরিয়ে দৃষ্টিপাত করে। ইউভান গাড়ির ভেতরে বসে আছে। অতঃপর গাড়ি ত্যাগ করে ইউভান এগিয়ে আসে।আনায়ার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রগাঢ় ও দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“অনেক রাত হয়ে গেছে সানসাইন। আমাদের এখন বাড়ি ফেরা উচিত।”
কোনো অনুমতী ব্যতীতই ইউভান আনায়ার হাত ধরে তাকে গাড়ির দিকে উদ্যত হয়। তৎক্ষণাৎ আনায়া তীব্র আপত্তি প্রকাশ করে।সে ইউভানকে বাঁধা দিয়ে কঠিন ও অনমনীয় স্বরে বলল,
“আমি যাব না! বুঝলেন? এসব দরদ-ভালোবাসা রেখে দিন অন্য কারও জন্য।”
ইউভান গভীরভাবে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।সে তার কণ্ঠস্বর আরও সংযত করে শুধালো,
“দেখ আমাকে রাগাস না সানসাইন।”
আনায়া এবার দৃষ্টি রাঙিয়ে তাকায়।ঠোঁটে তাচ্ছিল্যমিশ্রিত হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আপনার রাগকে আমার প্রতিচ্ছবিও পাত্তা দেয় না বুঝলেন?আমার রাগের রূপ দেখতে চান আপনি?”
ইউভান হতচকিতভাবে চেয়ে আছে।তার বহুদিনের পরিচিত আনায়া এমন আচরণ কখনো করেনি।সে ঘাড় কাত করে বিদ্রূপস্বরূপে বলে,
“দেখা..।”
বাক্য শুনেই আনায়া নিচু হয়ে পথ থেকে একটি পাথর তুলে নেয়।এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে গাড়ির কাঁচ লক্ষ করে নিক্ষেপ করে।সহসা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে কাচগুলোর ভেঙে গুড়িয়ে পড়ে।ইউভান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু। বৃহৎ দৃষ্টিতে সে পর্যবেক্ষণ করে এ কি সত্যিই আনায়া?আনায়া এবার তর্জনী উঁচিয়ে গাড়িড় বিধ্বস্ত কাচের দিকে নির্দেশ করে বলে,
“দেখুন।”
এটুকু উচ্চারণ করে সে পেছন ফিরেই অগ্রসর হলো।
ইউভানের মানসিক প্রক্রিয়া কিছুকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়ে।সে একবার গাড়ির দিকে, একবার আনায়ার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে।পরমুহূর্তে বিস্মিত স্বরে বিড়বিড় করে বলে,
“সি ইজ এ সো ক্রেজি গার্ল।বাটট আই লাইক দিস!”
চারপাশের আকাশঘন অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়েছে। প্রতিটি বৃক্ষছায়া যেন অচেনা ভুতের ন্যয় লাগছে।আনায়া হৃদপিণ্ডে হাত দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
ভীত ও কাঁপা দৃষ্টিতে সে চতুর্দিকে পর্যবেক্ষণ করে।
ঝিঁঝি পতঙ্গের একটানা সুরে তার শ্রবণেন্দ্রিয় প্রায় অবশ হয়ে গেছে।সে থেমে দাঁড়িয়ে বিহ্বল দৃষ্টিতে
সুদীর্ঘ গাছগুলির দিকে তাকায়।ঠিক তখনই পার্শ্ববর্তী গাছের অন্তরাল থেকে শ্রুত হয় একটি কণ্ঠস্বর,
“কার অনুসন্ধান করছেন ম্যাডাম? ভূতের নাকি?”
আনায়া আঁতকে পার্শ্বদিকে মুখ ফেরায়।আর একটুকুও দেরি হলে হৃদযন্ত্র থেমে যেত।
ইউভান দুই বাহু বুকে আড়াআড়ি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।আনায়ার বিস্ময়ের সীমা থাকে না, এত কিছু পরেও ইউভান তার পিছু নিচ্ছে। তবু তা উপেক্ষা করে নির্বাকভাবে আবার পদচারণা শুরু করে আনায়া।
তাতে কিছুটা সাহস সঞ্চারিত হয় তার অন্তরে, কারণ ইউভান নিকটেই আছে। তবে আচমকা হাঁটতে হাঁটতেই তার পা একটি পাথরে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।সে আর্তনাদ করে ওঠে,
“আআআহ!”
ইউভান সেই আর্তধ্বনি শুনে দূর থেকেই উৎকণ্ঠাভরে আর্তনাদ করে ওঠে,
“এই যে ম্যাডামমমম শুনুন!”
আনায়া পিছন ফিরে তাকায়।ইউভান দূর থেকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“সাবধানে হাঁটুন ম্যাডাম।”
পরক্ষণেই সে হাত বুকের বাঁ দিকের উপরে স্থাপন করে ইঙ্গিতে বলে,
“নাহলে এইখানটাই লাগে বুঝলেন?”
আনায়া বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে একনিষ্ঠভাবে চেয়ে আছে।ইউভানের এই উক্তি তার হৃদয়কে স্পর্শ করে।
তবুও সে নিজস্ব আত্মসংবরণ বজায় রেখে জবাব দেয়,
“জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হোক আপনার ওইখানটা।”
ইউভান আঙুলের দ্বারা চুলগুলি পেছনে সরিয়ে ঠোঁটের কোণে এক প্রকার কৌতুকমিশ্রিত হাসি টেনে বলে,
“আগুনটা কিন্তু আপনিই লাগিয়েছেন, ম্যাডাম।”
আনায়া এবার নীরবে পেছন ফিরে পুনরায় হাঁটা শুরু করে।ঠোঁটের কোণে তখন সুস্পষ্ট হাস্যরেখা ফুটে ওঠে।ইউভান পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। না অধিক দূরে, না অতি নিকটে, ঠিক মধ্যবর্তী দূরত্বে।আনায়া বামে গেলেই ইউভান বামে, ডানে গেলে ডানেই সঞ্চরণ করে।প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী চলতে থাকে তাদের এই পিছু নেওয়া-হাঁটা খেলা।শেষে ক্লান্ত হয়ে আনায়া পথপাশের একমাত্র বেঞ্চে বসে।ইউভান ও নিঃশব্দে পাশে বসলো। আনায়া পাশ ফিরেই কপালে ভাঁজ ফেলে ক্ষুব্ধস্বরে বলে,
‘আমার পিছু নেওয়া কবে থামাবেন আপনি?”
ইউভান ঘাড় কাত করে এক নির্মম শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,
“মৃত্যু থেকে পরপার অব্দি অব্যাহত থাকবে।”
আনায়া কোনো প্রতিউত্তর না করে নীরবে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে।পুনরায় উঠপ ধীরগতিতে পদচারণা শুরু করে।তার পরিকল্পনা আজকে হেঁটেই বাসায় যাবে।প্রশস্ত জনমানবহীন পথপ্রান্তে দুই মানব-মানবী নিঃশব্দে নিঃশব্দে হাঁটছে।কোনো কথার আওয়াজ নেয়, শুধুমাত্র নিঃশ্বাসের শব্দ ও পদধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারিপাশে।আরও প্রায় এক ঘণ্টার পথচলার পর তারা বাসায় এসে পৌঁছায়।দুজনেই নিঃশব্দে ভিতরে প্রবেশ করে।বাড়ির সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে।রাত প্রায় দুইটা বাজে।আনায়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে রুমের সামনে দাড়াই।সে রুমে প্রবেশ করে দরজ বন্ধ করতে উদ্যত হয় ঠিক সেই মুহূর্তে,ইউভান হঠাৎ সম্মুখে এসে দুই হাতে দরজা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে।আনায়া বিরক্ত গলায় উচ্চারণ করে
“আবার কী ব্যাপার?”
ইউভান মাথা সামান্য হেলিয়ে ঠোঁটে এক প্রকার মৃদু হাস্যরেখা এঁকে বলল,
“গুড নাইট সুইটি।”
আনায়া সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারে যে, ইউভান তার মনরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সুচারু কৌশল প্রয়োগ করছে।তবুও স্বরচিত ব্যক্তিত্ব রক্ষার্থে জবাব দেয়,
“গুড নাইট টু!”
ইউভান এক মুহূর্ত থেমে মাথা কিছুটা নিচু করে আনায়ার দিকে ঝুঁকে আসে।তৎক্ষণাৎ আনায়া স্ফীত হয়ে পিছু হটে।ইউভান তখন মৃদুস্বরে ফিসফিস করে বলে,
“একা যেতে পারবি তো?নাকি আমি বিছানা অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসবো?”
আনায়ার কর্ণদ্বার থেকে যেন তপ্ত বাষ্প নির্গত হয়।
সে কঠিন চোখে দৃষ্টিপাত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“বের হন আপনি।”
ইউভান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হুইস্কির কন্ঠে শুধালো,
“কিন্তু তোর চোখ তো বলছে আমি যেন ভেতরে আসি আর কিছু একটা…. ”
ইউভান বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে পারেনি।তার পূর্বেই
ধামমমম করে আনায়া দরজা বন্ধ করে সেই বাক্যকে চিরতরে রুদ্ধ করে দেয়।ইউভান বাঁকা হেসে মুখে চেপে বাক্যটি গলাধঃকরণ করে।অপর প্রান্তে, আনায়া দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বিমূঢ়স্বরে বিড়বিড় করে বলে,
“অসভ্য, ঠোঁটকাঁটা, নির্লজ্জ ব্যক্তি!”
অতীত,
আমেরিকা, নিউইয়র্ক সিটি,
আলিসা কয়েকবার গলার স্বর গিলে নিয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“মা-মা-মা-মা… মা মা মাআআ মাম্মা মাআআআ…”
বাস্তব সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে আলিসা হঠাৎ হাউমাউ করে অঝোরে কেঁদে ফেলে। ক্যাসিনো তা দেখে মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। কী বলবে এখন? কোন অভিব্যক্তি দেবে বুঝে উঠতে পারে না। কাঁপা কাঁপা হাতে সে আলিসার কাঁধে আলতো করে রাখে। মুহূর্তেই আলিসা বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকায় তার দিকে। ক্যাসিনো এক রহস্যময় প্রশান্ত ভঙ্গিতে বলে,
“শান্ত হও, রোজ। তারপর বলো এরপর কী ঘটেছে? কীভাবে হত্যা করেছিলে তোমার বাবাকে?”
আলিসা শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর নিঃসৃত হুইস্কির মতো গাঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“সব বলব, তবে এখন নয়।আপনি যে কাজ করতে এসেছেন সেটা সম্পূর্ণ করুন আগে।”
এই কথা বলেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। ক্যাসিনো উঠে দাঁড়ায়। তার চোয়ালে দৃঢ়তা ফুটে ওঠে। সমস্ত মানবিক আবেগ মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলে সে পরিণত হয় এক নির্মম শিকারিতে। সে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে,
“তারা কোথায়?”
আলিসা নিরুত্তরভাবে মাথা নাড়ে। কোনো বাক্য না বলে পিছন ফিরে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হয়, ক্যাসিনোকে সঙ্গে করে নিয়ে। তারা প্রবেশ করে সেই কক্ষে, যেখানে আলিসার সৎ মা ও সৎ বোন ফ্লোরা গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। ক্যাসিনো বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাদের উভয়কে পর্যবেক্ষণ করে। কোনো শব্দ কোনো দয়া-ভিক্ষা ছাড়াই পকেট থেকে বন্দুক বের করে সৎ মায়ের বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
আলিসা বিস্ময়ে স্থবির! সে দুই হাতে মুখ চেপে বসে পড়ে। ভেবেছিল ক্যাসিনো হয়তো নির্মম হবে তবে এভাবে সোজাসাপ্টা খুন? না এটি তো এমন হালকাভাবে শেষ হওয়ার কথা ছিল না। অথচ ফ্লোরা তখনো অচেতন।আলিসার সৎমা কেঁপে ওঠে। গলা দিয়ে তার আর্তনাদায় বের হয় না তার আগেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ক্যাসিনো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে ফ্লোরার দিকে। একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করে। তার চোখে একফোঁটাও অনুভূতি নেই। আলিসা বুঝতে পারে পরবর্তী মুহূর্তে কী ঘটতে যাচ্ছে। তাই নিঃশব্দে সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ঠিক তখনই ক্যাসিনো পিছন থেকে বলে ওঠে,
“কোথায় যাচ্ছো, রোজ?”
আলিসা বিদ্রুপে ভরা কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়,
“আপনার শিকারের সময় তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে আগ্রহী নই।”
ক্যাসিনো ঠান্ডা স্বরে জানায়,
“এই ক্রিস্টান ক্যাসিনোর রুচি এতটাও নিচু হয়নি।”
আলিসা হতচকিত। বুঝে ওঠে না ক্যাসিনো কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তখন ক্যাসিনো চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করে,
“পেট্রোল নিয়ে এসো, রোজ।”
আলিসা ভ্রূ কুঁচকে তাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করে,
“কেন? সেটা দিয়ে আপনি কী করবেন?”
ক্যাসিনো চোখ বন্ধ করে একের পর এক গভীর নিশ্বাস নেয়। পরক্ষণেই চোখ খুলে কঠোর দৃষ্টিতে বলে ওঠে,
“যা বলছি তাই করো, রোজ। প্রশ্ন কোরো না।”
আলিসার হৃৎস্পন্দন যেন মুহূর্তে দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। মুখাবয়বে ফুটে ওঠে এক অপার্থিব ঘোরের আভাস। কিছু বোঝার আগেই যেন নিঃশব্দে পা বাড়ায়। সে সোজা চলে যায় পাশের কক্ষে, যেখানে একটি কাঁচের বোতলে রাখা ছিল তরল পেট্রোল। বোতলটি হাতে নিয়ে ক্যাসিনোর দিকে বাড়িয়ে দেয়। ক্যাসিনো কোনো সময় অপচয় না করে ছিপি খুলে একপ্রকার সতর্ক আচরণে বিছানার চারপাশ, জানালার কিনারা এবং দরজার চৌকাঠ বরাবর ছড়িয়ে দেয় সেই দাহ্য তরল। পেট্রোলের তীব্র ঘ্রাণে ফ্লোরার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। সে একটু নড়ে ওঠে, চোখ আধমেলা। ক্যাসিনো পকেট থেকে দেশলাইয়ের একটি বাক্স বের করে, একটি কাঠি তুলে ঘষে। মুহূর্তে ঝলসে ওঠে আগুনের ক্ষুদ্র শিখা।
এক মুহূর্তে আগুন লেলিহান শিখার মতো বিস্তার লাভ করে চারদিকে। বিছানা, পর্দা, দেওয়ালের কিনারা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। আগুনের গর্জনে ঘর ভরে ওঠে আতঙ্কে। এই দৃশ্যেই চমকে ফ্লোরা জেগে ওঠে এবং চিত্কার করে ওঠে,
“আআআবববব! আগুন!”
ফ্লোরা সামনের দিকে তাকিয়ে ক্যাসিনোকে দেখে। সে এই অচেনা পুরুষটিকে চিনতে না পারলেও আলিসাকে দেখে শিউরে ওঠে। দ্রুত বলে ওঠে,
“আলিসা! পানি নিয়ে আয় বাঁচা আমাদের!”
কিন্তু আলিসা শুনেও যেন কিছুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ঠোঁটে কুটিল হাসি ফুটিয়ে পুরো দৃশ্য নিরবধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ফ্লোরা দিশেহারা হয়ে তার মায়ের নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। তখনই তার হাত রক্তে ভিজে যায়। চমকে উঠে মায়ের দেহ ঘুরিয়ে দেখে সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে রক্তস্রোত। ফ্লোরা কেঁদে ওঠে। দুই হাতে মাকে আঁকড়ে ধরে আর্তনাদ করে ওঠে,
“মাআআআ! উঠো!”
আলিসা সেই আর্তনাদ দেখে হেসে ওঠে। কারণ সেও তো একদিন ঠিক এমনভাবেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু কেউ শোনেনি। ইতোমধ্যে ছাদের কাঠ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ঘরে ছেয়ে গেছে দগ্ধ ধোঁয়ায়। ফ্লোরার শরীর জুড়ে আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়ে। সে চিৎকার করে আকুলভাবে আর্তনাদ করে ওঠে। কিন্তু তার সেই চিৎকার কোনো ক্যাসিনো কিংবা আলিসার কানে পৌঁছায় না। তার দেহ পুড়ে গিয়ে চামড়া-মাংস একাকার হয়ে যায়। হঠাৎ ক্যাসিনো আলিসার হাত ধরে টেনে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। দরজা বন্ধ করে দেয়। ভিতর থেকে শোনা যায় মর্মান্তিক চিৎকার।ঠিক তখন ক্যাসিনো দ্রুত বলে ওঠে,
“আমাদের এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে।”
আলিসা মাথা দুইদিকে দুলিয়ে দ্বিধায় থাকে। এমন সময় পিছন থেকে একটি মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
“রোজ…”
আ্যাশারের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে যায় সে। পেছন ফিরে তাকায়। আ্যাশার জেগে রয়েছে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। আলিসা ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে, দুই হাতে আ্যাশারকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলে,
“আ্যাশার! কী হয়েছে? উঠে এলে কেন?”
ঠিক তখনই ঘরের এক কোণে ধোঁয়া উগরে উঠতে থাকে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে অগ্নিশিখার মতো চারদিকে। আ্যাশার সেদিকে আঙুল তুলে ইশারা করে বলে,
“ওখানে কী হচ্ছে, রোজ?”
আলিসা হালকা হেসে উত্তর দেয়,
“তোমাকে আর কেউ আঘাত করতে পারবে না, আ্যাশার। আমরা দূরে চলে যাব, অনেক দূরে। ঠিক আছে?”
আ্যাশার নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। ক্যাসিনো এবার ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে। চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে আ্যাশারকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত লক্ষ্য করে। অপরিচিত এই ব্যক্তি দেখে আ্যাশার আলিসাকে জড়িয়ে ধরে।ক্যাসিনোর দৃষ্টি আটকে যায় আ্যাশারের সেই রহস্যময় নীল চোখের জোড়ায়। কালো ধোঁয়ার মাঝে ও নীল রংএর চোখদুটি জল জল করছে।আ্যাশারের চোখ সমুদ্রের চেয়েও গারো নীল বর্ণের।যার দিকে একবার কেউ তাকালে চোখ ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
সকালবেলা, চৌধুরী বাড়িতে বিয়ের তোরজোর লেগেছে।গেট থেকে শুরু করে বারান্দা, প্রতিটা কোণ যেন আলোর মালায় ঝলমল করছে। আজ সারাহর এনগেজমেন্ট।অনুষ্ঠানটা কনভেনশন সেন্টারে হলেও, সকাল থেকে পুরো বাড়ি যেন অতিথি-আত্মীয়দের পদচারণায় জমজমাট।বাড়ির বড় করতে নুরজাহান বেগম তো প্যারালাইজড। তাই সবটা সায়মা বেগমের একা হাতে সামলাতে হচ্ছে।এই কলহল আওয়াজে আনায়ার সদ্য ঘুমটা ভেঙে যায়। আনায়া ধীরে ধীরে উঠে বসে। চোখ কচলাতে কচলাতে হাত মেলে শরীরটা একটু সোজা করে। ক্লান্তিতে শরীর ভার লাগছে তবুও উঠতে হবে।আনায়া বিছানা থেকে নামতে গিয়েই পায়ে কিছু একটা বাধলো। থমকে গেল আনায়া। চোখ নামিয়ে নিচে তাকাতেই চমকে উঠলো।নিচে একটা বাদামি রঙের বক্স রাখা। আনায়া বক্সটির দিকে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।পরক্ষণেই সে নিচু হয়ে বক্সটি হাতে তুলে নেয়।
কৌতূহল দমাতে না পেরে সে আস্তে করে ঢাকনাটা খুলে ফেলে।সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায় আনায়ার।কারণ বাক্সের ভেতরে অনেকগুলো La Madeline au Truffe নামক চকলেট রাখা।চকলেট গুলো সিলভার কালারের বক্সে রাখা এবং উপরে সোনালী রিবন দিয়ে বাঁধা।আনায়া হতবাক এত দামী চকলেট?সে স্বপ্ন দেখছে না তো?এটা ভেবেই আনায়া একটি চকলেটের বক্স হাতে তুলে নেয়।সে বিড়বিড়িয়ে বলে,
“নাহ স্বপ্ন না, সত্যিই তো চকলেট এগুলো।কিন্তু কোথা থেকে আসলো?”
আনায়া কিছু বুঝে উঠতে পারে না।তার জানামতে এই চকলেট বাংলাদেশের পাওয়া যায় না বাইরের দেশ থেকে ইনপুট করতে হয়। ঠিক তখনই আনায়ার চোখে পড়লো চকলেটগুলোর নিচে রাখা একটা ছোট্ট চিরকুট।ধীরে ধীরে সেটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ লেখাটা পড়ে,
“চকলেট গুলো খেয়ে নিস, তাহলে রাগ কমে যাবে সানসাইন।”
‘সানসাইন’ শব্দটা পড়তেই আনায়া বুঝে যায় এটা আর কেউ না বরং ইউভানই পাঠিয়েছে।আনায়া হাঁসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারেনা।ইউভান এই প্রথম এভাবে চেষ্টা করছে রাগ ভাঙানোর, কিন্তু এত সহজে কি সে রাগ কমবে?আনায়া চকলেট গুলো আগের স্থানে রেখে মুখয়াব শক্ত করে।সে কিছুতেই তার রাগ কমাবে না এত তাড়াতাড়ি।সে এবার হৃদয়কে কঠোর করে উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বের হয়।সিঁড়ি বেয়ে নামতেই চারপাশে চোখ আটকে গেল সাজসজ্জায়।বাড়ির বড় ছোট সকলে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে।তখন তার দৃষ্টি তানহার উপর আটকায়।সে কিছুটা অবাক হয় কারণ বিয়ে ভাঙার পর থেকে তানহা খুবই কমই আসে তাদের বাসায়।আনায়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুহি বলল,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন?বসে পড়।”
আনায়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বসে পড়ল।তানহা একবার আঁড়চোখে আনায়ার দিকে তাকাতে ভুললনা। আহসান চৌধুরী সকলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
” ইউভান কোথায়?”
বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে দেখা গেল ইউভানকে।আনায়ার চোখ যেন আটকায় সেখানে।ধীর পায়ে নিচে নামছে ইউভান। গায়ে হালকা মেটালিক সাদা রঙের শার্ট হাত গুটানো। হাতে চকচকে একটি দামি ঘড়ি। চুলগুলো অগোছোলো হয়ে ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। আনায়া হা হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ ফেরাতে পারছে না। কী এক মায়া যেন আটকে রাখলো তাকে।ইউভানকে আজকে থেকে আহসান চৌধুরী পুনরায় খাবারে মনোযোগ দিল।ইউভান সোজা হেঁটে এল ঠিক আনায়ার পাশের চেয়ারে।বসতে বসতেই আনায়ার দিকে এক ঝলক তাকায়।তারপর হালকা ঝুঁকে ব্রেড প্লেটে জ্যাম লাগাতে লাগাতে বললো
“এভাবে হা হয়ে তকিয়ে আমার লজ্জা হরণ করার মানে কি সুইটি।”
আনায়া চমকে উঠলে। মুখটা লাল হয়ে গেল। কথার জবাব দিতে গিয়ে গলা শুকিয়ে আসে।আনায় দাঁতে দাঁত চেপে মাথা নিচু করে ধীর কণ্ঠে বললো,
“আপনার আবার লজ্জা আছে নাকি?”
ইউভান বাঁকা হেসে ঠান্ডা কন্ঠে উত্তর দেয়,
“আমাকে দেখে কি তোর ক্যারেক্টারলেস মনে হয়?শুন আনু আর যাইহোক মেয়েদের ব্যাপারে আমি খুবই সচেতন।”
আনায়া তাচ্ছিল্য হাসে ব্যঙ্গাতক কন্ঠে উচ্চারণ করে,
“আপনি বড্ড চরিত্রবান ইউভান ভাই।সেজন্যই তো প্রথমে অন্য নারীকে স্পর্শ করেছেন।”
ইউভান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে।আনায়া এখনো সেই একটা কথা নিয়ে পড়ে আছে। ইউভানকে প্রতিটা কথায় কথায় সে ইচ্ছাকৃতভাবে খোঁচা মারছে।ইউভান মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় নিচের সরে উচ্চারণ করে,
“চকলেটগুলো রেগুলার খাবি বুঝলি?”
আনায়া ভ্রুঁজোড়া উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
“কেন?”
ইউভান সোজা হয়ে বসে পাউরুটিতে জ্যাম লাগাতে লাগাতে জবাব দেয়,
“মুখ থেকে বিষের বদলে মিষ্টি ভাষা বের হবে তাহলে।”
মুহূর্তেই আনায়া রক্তচক্ষু দৃষ্টি তাকায়।তারপর ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
“আপনি আমাকে ইমররেক্টলি নাগিন বললেন?”
ইউভান কোন প্রতি উত্তর করে না। নিঃশব্দে একটি ব্রেড আনায়ার প্লেটে তুলে দেয়।আনায়া মনে মনে ইউভানকে গালি দিতে মোটেও ভুলল না। এই দৃশ্য তানহা প্রত্যক্ষ করে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।কারণ তনহা এখনও ইউভানকে ভালোবাসে।সে তীব্র রাগে মনে মনে বলে উঠলো,
“যত হাসার হেসে নে আনায়া।আজকেই তোর শেষ দিন এই পৃথিবীতে।তুই না থাকলে ইউভান সম্পূর্ণরূপে আমার হবে।”
তানহা মনে মনে আনায়ার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করতে থাকে।এদিকে আনায়া তো রেগে আগুন হয়ে আছে।তাকে ইউভান ইন্ডিরেক্টলি নাগিন বলেছে।আনায়া প্লেটে পড়া থাকা ব্রেডটি ছুয়েও দেখল নাহ।শুধু পানি খেয়ে উঠে দাড়ায়।আনায়াকে এভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাড়ির সকলে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে।আয়ান প্রশ্ন করে ওঠে,
“কী হয়েছে বোন?খাবার না খেয়ে উঠলি কেন?”
আনায়া ইউভানের দিকে কঠিন দৃষ্টি ফেলে বলল,
“খেতে ভালো লাগছে না আমার ভাইয়া তাই।”
বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে আনায়া।সেদিকে চেয়ে ইউভান দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।সে চাইলে আনায়ার অভিমানটা এড়িয়ে যেতে পারে।কিন্তু না, সে এই অভিমানটার মধ্যেই সুখ খুঁজে পায়।তাই তো নিজের কঠোর ও গম্ভীর ব্যক্তিত্ব একপাশে রেখে সাধারণ প্রেমিকের মতো আনায়াকে মানানোর প্রচেষ্টায় ইউভান।সকলে ব্রেকফাস্ট শেষ করে আবার যার যার কাজে লেগে পড়ে।ইউভান আজ ভার্সিটি যাবে না।আয়ানও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছে।সারাহ তো সকলের সঙ্গে গল্প গুজব করতে ব্যস্ত।আনায়া সেই সকালে রুমে ঘাপটি মেরে বসেছি আর বের হয়নি।ইউভানও অবশ্যই ডাকতে যায়নি।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার প্রাক্কালে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আনায়া নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে। রক্তিম রঙের দীপ্তিময় লং গাউনটি তার দুধভাত ত্বকে অভিজাত আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাউনের হাতা পূর্ণদৈর্ঘ্যের, কোমরের অংশটুকু স্নিগ্ধভাবে আঁটসাঁট, আর নিচের দিকে ঢেউখেলানো ঢলানে। চুল দু’পাশে সূক্ষ্ম কার্ল করে সাজানো। ঠোঁটে টানা গাঢ় রক্তবর্ণের লিপস্টিক। ঠিক সেই মুহূর্তে দরজা খুলে রুহি প্রবেশ করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল,
“তোর কি শেষ হয়েছে?”
আনায়া ধীর পদক্ষেপে পেছনে ফিরে তাকায়। রুহি বিস্ময়ে থমকে বলে,
“আল্লাহ!তোকে কী কিউট লাগছে আলু।কারোর নজড় না লাগুক।”
আনায়ার ঠোঁটে স্নিগ্ধ এক লাজুক হাসি ফুটে ওঠে,
“থাক এতটা প্রশংসা করলে আমি মেঘের উপর ভেসে উড়ে যাব।”
রুহি হেসে ওঠে। তার গায়ে একখানা সাদা বর্ণের বাহারী স্লিভলেস গাউন। মুখে মেকআপের গাঢ় রেখাপাত নেই তেমন। কিন্তু তার স্বাভাবিক রূপই সে সুন্দর। আনায়া ও রুহি একত্রে বাড়ির বাইরে পা রাখে, গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বাড়ির বাকি সদস্যরা পূর্বেই কনভেনশন সেন্টারে পৌঁছে গেছে। ইউভানও তাদের সঙ্গেই গিয়েছে। আয়ান নিজের গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সেই মুহূর্তেই রুহি ও আনায়া গাড়িতে উঠে বসে। রুহি সামনের আসনে, আনায়া পেছনের আসনে।আয়াত তৎক্ষণ গাড়ি স্টার্ট দিল কনভেনশন হল এর উদ্দেশ্যে।রুহির খোলা চুল জানালার হাওয়ায় উড়ে গিয়ে আয়ানের মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। আয়ান সেগুলো সরায় না বরং সেই স্পর্শ উপভোগ করে। রুহির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
“তোকে অপূর্ব লাগছে রুহ।”
সঙ্গে সঙ্গে রুহি তার দৃষ্টি সরিয়ে আয়ানের চোখে চোখ রাখে। আয়ান তাকিয়ে আছে এক গভীর দৃষ্টিতে। রুহি ধীর কণ্ঠে বলে,
“ধন্যবাদ! আপনাকেও সুন্দর লাগছে।”
আয়ান চোখ রাস্তার দিকে রেখেই জবাব দেয়,
“কারণ চোখ দুটো সুন্দর। ও চোখ যখনই আমার দিকে উঠে আসে,তখনই মনে হয় আমি দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ।”
রুহি বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। আয়ানের এ হঠাৎ আবেগঘন উক্তির অর্থ খুঁজে পায় না সে। আয়ান আর কোনো কথা বাড়ায় না।কিছুক্ষণ পর, গাড়ি এসে থামে কনভেনশন সেন্টারের লাল গালিচার সূচনালগ্নে। সুবিশাল আলোকসজ্জিত প্রবেশদ্বারের পাশ দিয়ে তারা অন্দরমহলে প্রবেশ করে। ভিতরের দৃশ্যাবলি ছিল রাজমুকুটের আভিজাত্যে ভরপুর। সোনালী কারুকার্যমণ্ডিত আলোর সারি দেয়ালে ঝুলছে, ওপরে ঝুলছে বিশালাকার ঝকঝকে ঝাড়বাতি।আনায়া বিস্মিত নয়নে চারপাশ অবলোকন করে।
সাদনানের পরিবারসহ অন্যান্য অতিথিগণ পর্যায়ক্রমে আগমন করছে। সাদনান এগিয়ে এসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে,
“কি খবর শালীসাহেবারা? কোনো অসুবিধা হয়নি তো আসতে?”
রুহি স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে জবাব দেয়,
“না ভাইয়া, একটুও না।”
সাদনান এগিয়ে যায় অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে। রুহির দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় এক কোণে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা রোহানের উপর। অন্যদিকে, আনায়া সমগ্র হলঘর ঘুরছে আর দুটি চোখ দিয়ে কাউকে খুঁজছে। প্রত্যাশিত ব্যক্তির সান্নিধ্য না পেয়ে সে ক্রমাগত অধৈর্য্য অনুভব করে। এমন সময়েই তার পেছন থেকে ভেসে আসে এক স্নিগ্ধ পুরুষকণ্ঠ,
“কাকে খুঁজছেন, ম্যাডাম?”
আনায়া চমকে উঠে ধীর ভঙ্গিতে পিছনে ফিরে তাকায়। ইউভানের নীলাভ চোখের দৃষ্টি তার সঙ্গে মিলে যেতেই বুকের গভীরে শিহরণ জাগে। ইউভান ধীরপায়ে এগিয়ে আসে।নিমিষে চোখ বুলিয়ে নেয় আনায়ার মাথা থেকে পা পর্যন্ত। তার হৃদকম্পন বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। কারণ আনায়ার রূপের অপার দীপ্তি সামাল দেওয়া তার পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। ইউভান আনায়ার একেবারে সান্নিধ্যে এসে মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে,
“সুইটি, ইউ লুকিং লাইক এ রেড অ্যাঞ্জেল।”
এই বাক্য শুনে আনায়ার মুখমণ্ডলে লাজে রক্তিমতা ছড়িয়ে পড়ে। সে হালকা নিচু করে ফেলে মাথাটি, ঠোঁট কামড়ে রঙিন ঠোঁটদুটি আড়াল করার অপচেষ্টা করে। ইউভান গলা খাঁকড়িয়ে কৌতুক ভঙ্গিতে বলে,
“থাক, লজ্জায় আর পিংক হওয়ার প্রয়োজন নেই।”
আনায়া চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়, মুখের রেখায় হালকা অভিমানের ছাপ ফুটে ওঠে। ইউভান তা অনুধাবন করে পুনরায় প্রশ্ন তোলে,
“শুনছেন, ম্যাডাম?”
আনায়া ভিন্নদিকে দৃষ্টি রেখে মৃদু কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“হুম, শুনছি বলুন।”
ইউভান এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তার স্বরকে হুইস্কির মতো ঘন করে তোলে,
“আপনার রাগ কি কমেছে?”
আনায়া মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেয় না। ইউভান নিঃশব্দে সেই ইঙ্গিত বুঝে ফেলে। আনায়া এবার সরাসরি চোখে চোখ রেখে বলে,
“এতটা সহজে কমবে না।”
ইউভান ঠোঁটের কোণে এক সূক্ষ্ম হাসি ছড়িয়ে বল,
“বুঝতেই পারছি, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।”
আনায়া স্তিমিত বিস্ময়ে তাকায়। ইউভানের এমন আগ্রহপূর্ণ মনোযোগ ও তৎপরতা তার কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকে। ইউভানের ব্যবহার তার নিকট প্রণয়প্রবণ বলে প্রতিভাত হয়। আনায়া মৃদু স্বরে ঠোঁট কামড়ে বলে ওঠে,
“সাবধান, কাঠখড় পোড়াতে গিয়ে নিজেই যেন দাউ দাউ করে জ্বলে না ওঠেন।”
ইউভান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চুলগুলি এক হাতে পিছনে সরিয়ে দেয়। সেই দৃশ্য দেখে আনায়ার অন্তরে এক অনির্বচনীয় উচ্ছ্বাস সঞ্চারিত হয়। ইউভান নিঃশব্দে হেসে কটাক্ষভরে বলে,
“সে তো আপনার সৌন্দর্যের তেজে বহু পূর্বে ছাই হয়ে গিয়েছে আমার হৃদয়।”
আনায়া মুখ সামান্য সংকুঁচিত করে জিজ্ঞাসা করল,
“হঠাৎ এমন প্রেমিকসুলভ আচরণ কেন ইউভান ভাই?”
আনায়ার উচ্চারিত বাক্য শ্রবণমাত্র ইউভানের দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়। গলাটাকে শক্ত করে, একটু চড়া স্বরে জবাব দেয়,
“হঠাৎ নয় সুইটি।এই প্রণয় তো বহু পূর্বেই হৃদয়ের অন্তস্থলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তুই এসে হৃদয়ের আঙিনায় উঁকি মারতেই তা তীব্র ঝড়ের মতো বেড়িয়ে আসে।”
আনায়ার চোখে ফুটে ওঠে বিস্ময়। তার ঠোঁটদুটি কেঁপে ওঠে, যেন কথা আটকে গেছে গলায়। ইউভানের এই আবেগমথিত উক্তি কি ভালোবাসার নিঃশব্দ স্বীকৃতি? নাকি কেবল ছায়াভাস? আনায়া নিশ্চিত হতে পারে না, তবুও তার হৃদয়ের গহীনে কোথাও এক ঝিম ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়।ঠিক সেই মুহূর্তে মঞ্চের চারপাশে কৌতূহলী ভিড় জমে ওঠে। আহসান চৌধুরী মাইক্রোফোন হাতে তুলে বলেন,
“আজ চৌধুরী পরিবারের বড় কন্যা সারাহর সঙ্গে সিকদার পরিবারের বড় ছেলে সাদনান শিকদারের আংটি পরানোর আনুষ্ঠানিকতা।”
সবাই এক দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইউভান তার বাবা-চাচাদের পাশে গিয়ে স্থিত হয়। আনায়াও সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সারাহ মঞ্চে পদার্পণ করে। তার পরণে লাল বর্ণের সোনালি জরির কাজ করা লেহেঙ্গা। এরপর সাদনান ওঠে মঞ্চে, সে পরেছে গাঢ় কালো শেরওয়ানি। উভয়েই একে অপরের সঙ্গে পরিপূর্ণরূপে মানিয়ে গেছে।রুহি এসে আনায়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। এমন সময় আনায়ার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় মঞ্চের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়ানো রোহানের দিকে। হঠাৎ করে তাকে দেখে চমকে ওঠে আনায়া।রুহিকে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে জিজ্ঞাসা করে,
“এই রুহি, ওটা আমাদের ভার্সিটির সেই ছেলে না? এখানে কী করছে?”
রুহি রোহানের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, সেই টাকলু ছেলেটাই। ও আমাদের বড় মামার ত্যাজ্য ছোট ছেলে। আর সাদনান ভাইয়ার আপন ছোট ভাই।”
আনায়া বিস্ময়ে মুখ হা করে চেয়ে আচে। রোহান যে তার মামাতো ভাই, এতকাল তা তার গণ্ডিতেও আসেনি। জানবেই বা কেমন করে? রোহান তো পরিবারের সাথে থাকে না। আনায়ার মনস্তলে ভাবনার ঢেউ খেলে যায়, এমন মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত হন সায়মা বেগম। সারাহ এবং সাদনান তাদের সম্মতির প্রতীক স্বরূপ আংটি তুলে নেয়। সারাহ মৃদু হেসে সকলের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে। অতঃপর সাদনানকে আংটি পরায়। সাদনানও পাল্টা সারাহর অনামিকায় পরিয়ে দেয় বাগদানের আংটি। সহসাই চারপাশ গুঞ্জরিত হয়ে উঠে করতালির ধ্বনিতে। প্রভাবশালী ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বেরা পর্যায়ক্রমে আগমন করতে শুরু করেন। ইউভান ও আয়ান বড়পুত্রসুলভ দায়িত্বে পারঙ্গম হয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনায় নিযুক্ত হয়ে পড়ে।
অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ওয়েটারগণ সমবেত অতিথিদের মাঝে পানীয় পরিবেশন আরম্ভ করে। আনায়া সারাহর সংলগ্ন বসে বোনের সহিত গল্পে মগ্ন। এমন সময় হঠাৎ তানহা ত্বরিতপদে এগিয়ে এসে সম্বোধন করে,
“আনায়া!”
আনায়া চমকে উঠে, দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে আপু? কিছু বলবে?”
তানহা শুষ্ক ও নিরাবেগ স্বরে প্রতিউত্তর দেয়,
“পাশের পুরাতন ভবনে ইউভান তোকে ডেকেছে।”
আনায়ার কপালে চিন্তার রেখা খচিত হয়। সে কিছুই স্পষ্ট করতে না পেরে বিস্ময়ভরে উচ্চারণ করে,
“মানে? সেখানে কেন?”
তানহার দৃষ্টিতে একপ্রকার অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিজেকে সামলে আবার উচ্চারণ করে,
“আমি কি করে জানব? সে আমাকে বলেছে তোকে জানাতে, সেই কথা অনুযায়ী জানালাম।”
বাক্য সমাপ্ত করে তানহা স্থান ত্যাগ করে। আনায়া কিছুক্ষণ স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকে, মনে দোল খেতে থাকে নানা দ্বন্দ্ব। যাবে কি যাবে না এই দোটানায় অস্থিরতায় গ্রস্ত হয় সে। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ইউভান তখন নিজের আবেগ দমন করতে ব্যর্থ হয় আনায়া।ধীরে ধীরে কনভেনশন হল ত্যাগ করে বাহিরে অগ্রসর হয়।হলের নিকটেই দাঁড়িয়ে এক জরাজীর্ণ পুরাতন ভবন। আনায়া সেইদিকে পা বাড়ায়। চতুর্দিকে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতার চাদর। বাতাসে শীতলতার মৃদু ছোঁয়া। ভবনের চারপাশে জঙ্গল ভাঙাচোরা দেয়াল, ছাদের কোল ঘেঁষে ঝুলে থাকা লতা, সব মিলিয়ে এক রহস্যময় পরিবেশ।আনায়ার হৃদস্পন্দন অস্থির হয়ে ওঠে, তবুও বুকে সাহস সঞ্চয় করে সে ভবনের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করে। চারদিকে দৃষ্টিপাত করে কম্পমান কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
“ইউভান ভাই…!”
কিন্তু প্রতিউত্তরে কোনো শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় না। আনায়া অনুধাবন করতে পারে না ইউভান তাকে এখানে রেখে নিজে কোথায় বিলীন হয়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত চিত্তে সে পিছনে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হয়। হঠাৎ করেই এক আর্তচিৎকার ভেসে আসে। আনায়া ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর্তনাদটি উপরতলার দিক থেকে আসছে। আনায়া সেই আর্তচিৎকার অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। ভয়ের সূক্ষ্ম শিরা তার শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ে। চিৎকারটি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় কান্নায়।মুহূর্তে আনায়ার বুক ধকধক করে উঠে।আওয়াজটি স্পষ্টতই সামনের একটি রুম থেকে আসছে। আনায়া অনুমান করে নেয়, সেই রুমের অভ্যন্তরে নিশ্চয়ই কেউ আছে। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে রুমটির সম্মুখে এসে স্থির হয়। হৃৎপিণ্ড তার বিক্ষুব্ধ সুরে স্পন্দিত হতে থাকে। অজান্তেই আনায়ার হাত উঠে আসে বুকে। তবু সাহসকে অবলম্বন করে, মাথাটি সামান্য নিচু করে সে জানালার পাশ ঘেঁষে অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করে।
আর সঠিক সেই মুহূর্তেই যা তার দৃষ্টিগোচর হয়, তার জন্য সে একেবারেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। চক্ষুদ্বয় বিস্ময়ে প্রশস্ত হয়ে যায়। ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে কণ্ঠনালীতে শব্দ স্থবির হয়ে যায়। তার দেহ হিমশীতলে স্তব্ধ ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরে এক ব্যক্তি অকথ্য নির্মমতায় এক মেয়েকে ধ*র্ষ*ণ করছে। ব্যক্তিটির মুখমণ্ডল আনায়ার চোখে ধরা পড়ে না, কারণ তার দৃষ্টির ঊর্ধ্বাংশ মুখোশাবৃত।মেয়েটিকে হাত-পা দড়ি দিয়ে শক্তভাবে আবদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি মুখটিও কালো বাঁধনে নিপুণভাবে মোড়ানো। তার দেহে এক বিন্দু বস্ত্র নেই সম্পূর্ণরূপে ন*গ্ন। সেই ব্যক্তি কামুক দৃষ্টিতে মেয়েটির উদ্ভিন্ন দেহপল্লবের দিকে তাকায়। এক মুহূর্ত দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটির দেহের উপর।
ব্যক্তিটি মেয়েটির গলার কাছ বরাবর দাঁত বসিয়ে তীব্রভাবে মাংস ছিঁ*ড়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে র*ক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসে প্রবল তেজে। যন্ত্রণায় বিহ্বল মেয়েটি দু’চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আনায়া দেখল কীভাবে ব্যক্তিটি দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা মাংসপিণ্ডের আঁশগুলো ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাচ্ছে।ব্যক্তিটির ঠোঁটের কোণ বেয়ে র*ক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে।পরবর্তী মুহূর্তেই সেই ব্যক্তি শুরু করে মেয়েটির ন*গ্ন দেহের উপর একের পর এক নৃ*শং*স অত্যাচার।একটির পর একটি করে ব্যক্তিটি মেয়েটির কণ্ঠনালী ও গ্রীবায় দাঁতের চিহ্ন বসায়। প্রতিবারই সে তীব্র কাঁমড়ে মাংস ছিঁড়ে আনছে। গলার র*ক্ত ধীরলয়ে গড়িয়ে পড়ছে বক্ষদেশে।মেয়েটির কানে দাঁত বসিয়ে সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে নিয়ে আসল কানটি। মুহূর্তেই মেয়েটির নেত্রদ্বয় কোটর থেকে উল্টে বেরিয়ে আসে। তার হৃদপিণ্ড যন্ত্রণায় কাঁপতে থাকে, ছটফট করতে থাকে ব্যথার তীব্রতায়। কিন্তু সেই ব্যক্তি তাতেও বিরত হয় না।
সে মুখ নিচু করে মেয়েটির স্ত**নে**র উপর আসে। তারপর সেখানে অনবরত কাঁমড়ের চিহ্ন বসাতে থাকে। প্রতিটি কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির মুখ থেকে গোঙানির করুণ শব্দ নির্গত হয়।স্ত**ন**টি আশেপাশে চামড়া ফেটে পড়ে। ভিতরের মাংসপিণ্ডের গভীর অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় গহ্বর, আর সেখান থেকে র**ক্ত স্রোতের মতো গড়িয়ে পড়ছে। ব্যক্তিটি সেই গভীর ক্ষতচিহ্নের অন্তঃস্থলে জিহ্বা প্রবেশ করিয়ে চোষণ করতে থাকে। প্রজ্বলিত উষ্ণ মাংস রন্ধ্রে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে আসে।মেয়েটির দেহ মৃত্যুসম যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠে। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় স্ত**ন** দাঁত দিয়ে অঙ্কিত করে ক্ষ*ত সৃষ্টি করে।বুকের কেন্দ্র বরাবর সে দাঁতের মাধ্যমে চামড়া ছিন্ন করে আনে। সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা নীলাভ র*ক্তনালী দৃশ্যমান হয়।
বুক থেকে ছিঁড়ে নেওয়া লাল মাংসপিণ্ড প্রত্যক্ষ করে ব্যক্তিটি হাসল। সেখান থেকে গড়িয়ে পড়া র*ক্ত সে জিহ্বা দিয়ে লোহন করে নামিয়ে আনে পেট বরাবর। পেটের চামড়ায় সে দাঁত বসিয়ে প্রবলভাবে কা*ম*ড় দিতে থাকে। পেটের চামড়া ফেটে মাংস, চর্বি আর ধমনী দৃশ্যমান হয়। মেয়েটি প্রাণভয়ে ছটফট করতে থাকে। ব্যক্তিটি তার ভয়ানক দানবীয় দাঁত দিয়ে তলপেট থেকে মাংস ছিঁড়ে ফাঁক দিয়ে গরম র*ক্তে*র ঝাপটা সহ্য করেও খেতে থাকে। এখনো ধ*র্ষ*ণ চলছে না, বরং তার থেকেও ভয়ংকর, নিষ্ঠুর নির্যাতন চলছে। মেয়েটির চোখের করুণ আর্তনাদ আনায়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সে দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে আছে, যেন একটি শব্দও মুখ থেকে বের না হয়। হঠাৎ করে ব্যক্তিটি উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরনের সব কাপড় খুলে ফেলে।
তারপর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে নিজের পু**রু***ঙ্গ প্রবেশ করায়।মেয়েটি চোখ ব্যথায় র*ক্তবর্ণ ধারণ করেছে। ব্যক্তিটি পশুর নেয় নির্যাতন চালায় কিছুক্ষণ। এ দৃশ্য আনায়া প্রত্যক্ষ করে কেঁপে ওঠে।ব্যক্তিটি থেমে সে এবার দাঁত বাসায় মেয়েটির যৌ**না** বরাবর।মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটি যন্ত্রণায় ফেটে পড়ে।দানব ব্যক্তিটি সে যৌ*না*ঙ কামড়ে চামড়া সহ মাংস ছিড়ে আনে।মেয়েটি এবার সহ্য করতে না পেরে হাত-পা ছুড়তে থাকে।সেই স্থানের চামড়া ফেটে মাংস এক দিকে ধলে পড়ে।লোকটি হিংস্র কুকুরের ন্যায় সেই যৌ****ঙ্গে বরাবর কামড়ে কামড়ে গভীর ক্ষ*ত সৃষ্টি করে।সেখান থেকে নির্গত হওয়া র*ক্ত জিহ্বা দিয়ে লোহন করে নিল ব্যক্তিটি।তৃপ্তিতে তার মুখে পৈচাশিক হাসি ফুটে ওঠে।মেয়েটি এবার সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।ব্যক্তিটি পুনরায় ধ*র্ষ*ণ করতে থাকে।দেহগত ক্ষুধার নিবৃত্তি অবধি এই নিষ্ঠুর নির্যাতন অব্যাহত থাকে। আনায়া আতঙ্কের শ্বাসরোধকারী ঘূর্ণিতে ঢেকুর তুলছে। এখান থেকে নড়বার সামান্য শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই তার মাঝে। জীবনের প্রথম সামনাসামনি এমন অমানবিক ধ*র্ষ*ণে*র প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে সে সম্পূর্ণ স্তব্ধ।
ব্যক্তিটি এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এবং তার ঘন কালো ব্যাগের অভ্যন্তর থেকে একটি ভারী চাপাতি নিরাবেগ ভঙ্গিতে টেনে বের করে। আনায়া বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। সে মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে সেই চাপাতি তুলে মেয়েটির হাত ও পায়ের উপর নিঃসংকোচে কুঠারাঘাত করে। মুহূর্তেই র*ক্তনালির তীব্র ছিন্নতায় র*ক্তধারা দেয়ালের গায়ে ছিটকে পড়ে। মেয়েটির সংজ্ঞাহীন দেহে আবার চেতনা ফিরে আসে। সে চোখ দুটো বিস্ফারিত করে, মাথা দুলিয়ে প্রাণভিক্ষার জন্য আকুতি জানায়। কিন্তু সেই জানোয়ার সদৃশ মানুষের চোখে মায়ার লেশমাত্র নেই।
সে আর একটুও দেরি না করে চাপাতির ধারালো ফলায় মেয়েটির স্ত**নদ্বয় নিঃসংশয়ে কাটে। ধমনী ছিঁড়ে গিয়ে শরীরের গভীর থেকে র*ক্ত নির্গত হয়। মেয়েটি আর ব্যথায় কাতরায় না, কারণ তার দেহ এখন প্রাণহীন। তবুও সেই পিশাচ থামে না; একের পর এক বীভৎস আঘাত হানে ঘাড়, বক্ষদেশ বরাবর। প্রতিটি আঘাতে চামড়া ও মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে মেঝেতে বিছিয়ে পড়ে। ছিন্ন কাঁধ থেকে মাংস ঝুলে পড়ে মাটির দিকে। প্রচণ্ড আঘাতে মেরুদণ্ড ভেঙে শরীর বেঁকে যায় এক অস্বাভাবিক ও বিভৎস ভঙ্গিমায়।
তারপর সেই নরখাদক ব্যক্তি নতজানু হয়ে বসে ছিন্ন মাংসের টুকরোগুলো তুলে নিজের গালে পুরে নেয়। এই দৃষ্টিকটুভাবে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আনায়ার অন্তঃকরণ দুলে ওঠে, বমি বমি ভাব উপচে ওঠে। ব্যক্তিটি নিজের দুই হাত দিয়ে সেই তাজা র*ক্ত মেখে নেয় সমগ্র মুখমণ্ডল ও শরীরজুড়ে। এরপরও ক্ষান্ত নয় পেট বরাবর সে আরও কয়েকটি বিকট কোঁ*প হানে। ফলে চামড়া বিদীর্ণ হয়ে ধারালো চাপাতির ফলায় আটকে যায়। পেটের বৃত্তাকারে আবৃত মাংস ছিঁড়ে ঢুলতে থাকে। এক প্রবল র*ক্তবন্যা ছিটকে গিয়ে পড়ে তার জামার উপর।
ব্যক্তিটি এবার মেয়েটির মুখে বাঁধন খুলে ফেলে, তার ঠোঁট দুটো জোরে আঁকড়ে ধরে নিজের ওষ্ঠে দ্বারা। দাঁতের তীক্ষ্ণ জেড়ে মেয়েটির ওষ্ঠের মাংস উত্তেজনাপূর্ণভাবে ছিঁড়ে ফেলে। ঠোঁটের চামড়ার স্তর উঠে গিয়ে উদ্ভাসিত হয় লালচে ধূসর মাংস, যার ওপর জমাটবাঁধা র*ক্ত কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সেই গাঢ় লাল র*ক্ত ঘনীভূত হয়ে ধীরে ধীরে বেয়ে পড়ে। ব্যক্তিটি তৎক্ষণাৎ জিহ্বার সাহায্যে র*ক্তস্রোত লোহন করে নেয়।হঠাৎ করেই সে গলার গভীরে হাত ঢুকিয়ে ছিঁড়ে বের করলো স্বরযন্ত্র এবং শিরাসমূহ। মেয়েটির শরীর শেষ শিঙড়ে কেঁপে উঠে। গলাবন্ধন দিয়ে র*ক্ত স্রোতধারা মুখভর্তি হয়ে নিচে ঝরে পড়ে। চাপটি সাহায্যে মাথায় আঘাত করতেই মাথার খুলির হাড় চূর্ণ হয়ে যায়।র*ক্তে*র ছটায় মেয়েটির মুখের প্রান্ত লালাভ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙা খুলির দু’ভাগ ঝুলে থাকা অবস্থা মেঝেতে মগজের ছড়াছড়ি ক্ষুদ্রাংশগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তি নির্দ্বিধায় সেই উষ্ণ ধোঁয়া উঠা মগজ তুলে ধরে খেতে শুরু করল।
আনায়া এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ঘৃণাই শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে।তার ধারণা ব্যক্তিটি নরখাদক থেকেও বহুগুণ ভয়ংকর।তৎক্ষণ ব্যক্তিটি চাপটি দিয়ে মেয়েটির যৌ**না* বরাবর আঘাত হানে।একবার নয়, বারংবার তীব্র প্রহার করে। মাংস থেঁতলে গিয়ে রক্তের সঙ্গে মিশে একেকার হলো।যৌনাঙ্গর মাংস দুপাশে ফেটে গর্তের মতো সৃষ্টি য়। হঠাৎ করেই ব্যক্তি আবারও যৌ**না**ঙ্গ প্রবেশ করায়। আনায়া বিস্মিত!মৃতদেহকেও এভাবে ধ*র্ষ*ণ করা যায়।অঝোর পানি বেয়ে পড়ছে তার চোখ দিয়ে।সে দিশাহারা, কোন পথ ধরে যাবে বুঝতে পারছে না।
ব্যক্তিটি কয়েকবার মৃত ন*গ্ন দেহকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করল। এরপর চাপেটির সহায়তায় মেয়েটির শরীরের একাধিক অঙ্গাংশ ছিন্নভিন্ন করে। আনায়া তখন উপলব্ধি করে এই স্থান তার জন্য কতখানি বিপজ্জনক। তাই সে মুখ থেকে দুই হাত সরিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস গ্রহণ করে। পা দুটো পেছনে সরিয়ে সে পালানোর জন্য উদ্যত হয়।কিন্তু ঠিক তখনই ব্যক্তি আনায়ার দিকে ঘুরে না দেখে, ঠান্ডা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
“কোথায় যাচ্ছ বেবিডল?”
আত্মার অন্তরালে পর্ব ১৮ (২)
আনায়ার চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়। অর্থাৎ এতক্ষণ ব্যক্তি সত্যিই দেখেছে যে সে আড়ালে লুকানো ছিল? আনায়ার হৃদস্পন্দন ভয়ংকরভাবে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে যায়। ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে তার দিকে ফিরে তাকালো। ব্যক্তিটির মুখোশ পরায় তার চেহারা স্পষ্ট নয়, তবে চোখ দুটো আনায়ার পানে চেয়ে আছে।ব্যক্তিটি এবার চাপটি হাতে তুলে এগিয়ে এসে উচ্চারণ করল,
“আনায়া বেবি ডল!আর ইউ রেডি?”