আত্মার অন্তরালে পর্ব ২২
প্রীতি আক্তার পিহু
সুইজারল্যান্ডের সন্ধ্যা নামে খুব শান্তভাবে।পশ্চিমের পাহাড়গুলো প্রথমে বেগুনি, তারপর ধূসর, শেষে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। পাহাড়ের উপরের পাইন গাছগুলো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।সেই সাদা বরফে ঢাকা পাহাড়ের কোলে গোপন এক উপত্যকার নিচে,মাটির অনেকটা গভীরে অবস্থিত একটি ভাঙা পরিত্যক্ত বিল্ডিং।বিল্ডিংটা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে কী আছে। যার সামনে বিশাল এক লোহার গেট।তখনই দূর থেকে ধেয়ে আসে দুইটি বাইক।আর মুহূর্তেই প্রচণ্ড আঘাতে লোহার গেটটিকে ভেঙে চৌচির করে দেয়।চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডগুলো সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠে।তারা দুপাশ থেকে গুলি চালাতে শুরু করে।তবে তাতে খুব একটা লাভ হয় না।কারণ, ইউভান এবং আভীর পূর্বেই প্রস্তুত হয়েই এসেছে।তৎক্ষণ তারা দুইজন পকেট থেকে ছোট বোম বের করে,দুই দিকে ছুড়ে মারে।সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের সাদা বরফের ওপর কালো ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পরল।গার্ডগুলো দিশেহারা হয়ে মুখ থুবড়ে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।
ইউভান এবং আভীর বাইক থামিয়ে ধীরে ধীরে নামল। মাথা থেকে হেলমেট খুলে দু’জনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু একটা ইঙ্গিত করে। তারপর তারা দু’জনেই একসাথে বিল্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করে।ভেতরে প্রবেশ করতেই তাদের বুটের নিচে কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ হয়।আভীর সতর্ক হয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“ইউভান বি কেয়ারফুল!ক্যাসিনো হয়ত কোনো ফাঁদ পেতে রেখেছে।”
ইউভান হুঁশিয়ার চোখে চারদিক পর্যবেক্ষণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বাস্টার্ডটাকে সামনে পেলে জানে মেরে দিব আজ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলেই ইউভান সামনের দিকে অগ্রসর হলো।মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু পুরনো ধাতব যন্ত্রাংশ,আসবাবপত্র।দেয়ালের কোণে কোণে মাকড়সার জাল বাঁধা।উপরের ছাদের বরফ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছে নিচে। ইউভান তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি চারদিকে একবার ঘুরিয়ে থেমে দাঁড়ায়। তার চোখে তখন ভয়ংকর আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে।মুহূর্তে সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে,
“ক্যাসিনো ফাকিং বিচ! কোথায় আছিস? সামনে আয়।”
তার কণ্ঠস্বর ক্যাসিনো অব্দি পৌঁছায় না।তবে ক্যাসিনো কন্ট্রোল রুমে বসে সিসিটিভি ফুটেসে সবকিছু দেখছে।তার ঠোঁটজুড়ে বিস্তৃত আছে রহস্যময় হাসি।অপরদিকে, ইউভান কোনও সাড়া-শব্দ না পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠে।রাগ তার এক নিমিষেই কয়েকগুণ বেড়ে যায়।তীব্র রাগে পেশিগুলো ফুলে ওঠে তার।ইউভান সামনে এগোনোর তার পূর্বেই সামনের অন্ধকার থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে।মুহূর্তেই দুজন সতর্ক হয়ে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে।তারা বুঝে যায় যে, ক্যাসিনো গার্ড পাঠিয়েছে তাদেরকে আহত করার উদ্দেশ্যে।তবে তা কী এতটা সহজ?আভীর দেয়ালের আড়াল থেকে গার্ডগুলোর অবস্থান নজরদারি করে।ইউভানও গার্ডদের গতিবিধি লক্ষ্য করে, দেয়ালের ওপর দিয়ে একটার পর একটা টার্গেট করে গুলি ছোঁড়ে।সঙ্গে সঙ্গে একেকজন গার্ড গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।আভীরও নিশানা অনুযায়ী গুলি ছুঁড়ে ফলে গার্ডরা রক্তাক্ত হয়ে দেয়ালের পেছনে ঢলে পড়ে।এক সময় গার্ডগুলোর গুলির তীব্রতা কমে আসে।ইউভান আর আভীর দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।সতর্ক পদক্ষেপে তারা সামনের দিকে এগোই। আভীর চারদিক চোখ বুলিয়ে হুংকার ছেড়ে বলে,
“ক্যাসিনো ব্লাডি বিচ সামনে আয়।”
ঠিক তখনই ঘটে অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা।পেছনের একটি দেওয়ালের আড়ালে একজন ব্যক্তি একহাতে বন্দুকটি ইউভানের দিকে স্থির করে ধরে রেখেছে।যা আভীরের দৃষ্টিগোচর হয়।আভীর সজোড়ে চিৎকার করে ওঠে,
“ইউভান নিচে ঝোঁক।”
কিন্তু ইউভান কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকট আওয়াজে গুলি ছুটে আসে।আর সেই মুহূর্তে আভীর নিজের শরীরটা ঢাল বানিয়ে ইউভানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। আর গুলিটা এসে বিদ্ধ হয় আভীরের বাহুতে।আভীর হাঁটু ভেঙ্গে নিচে বসে পরে।ইউভান একপলক আভীরের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে,হাতে বন্দুক থাকা ব্যক্তিটি কাঁপছে।ইউভানের রাগে চোয়াল শক্ত হয়।সে তড়িৎ বেগে আভীরের কাছে ছুটে আসে।আভীর একহাতে ক্ষতস্থান চেপে ধরেছে,সেখান থেকে গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে।ইউভান তার সামনে বসে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
“আভীর ঠিক আছিস?”
আভীর দাঁতের দাঁত চেপে নিজের ব্যথাকে উপেক্ষা করে বলে ওঠে,
“আই’ম ওকে ব্রো!তুই সময় নষ্ট করিস না ক্যাসিনো কে খোঁজ।”
কিন্তু ইউভান না উঠে পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে আভীরের বাহুর ক্ষতটা শক্ত করে বেঁধে দেয়।তবে তখন চারদিক থেকে আরেকঝাঁক গার্ড এসে ঘিরে ফেলে তাদের।একজন গার্ড গর্জে উঠে বলে,
“সারেন্ডার করো আমাদের কাছে।”
ইউভানের হাত থেকে বন্দুক কিছুক্ষণ আগে পড়ে গিয়েছিল।সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে গার্ডগুলো।ইউভান চারপাশে একবার তাকিয়ে বাঁকা হেসে ব্যঙ্গ করে বলল,
“ইউভান তোদের মত বাস্টার্ডদের কাছে সারেন্ডার করে নাহ।”
গার্ডরা কিছু বুঝে ওঠার পূর্ব মুহূর্তেই ঘটে আরেক বিস্ফোরণ।পেছন থেকে এক আকস্মিক বিস্ফোরণের বিকট শব্দ হয়।বিস্ফোরণের তীব্রতায় আশপাশের সমস্ত গার্ড ছিটকে পড়ে যায় দূরে।চারদিক কালো ধোঁয়া অন্ধকারে ভরে ওঠে।ইউভান উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে দেখে একটি কালো ছায়া এগিয়ে আসছে।আভীর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
“ওয়াট দ্যা ফা**ক!”
একই সময়, ক্যাসিনোর কন্ট্রোল রুমে হঠাৎ করে সিসিটিভি স্ক্রিনগুলো এক এক করে ঝিরঝির করতে শুরু করে। প্রথমে মনে হয় টেকনিক্যাল সমস্যা, কিন্তু মুহূর্তেই একটি বিকট শব্দে স্ক্রিনগুলো কেঁপে উঠে, সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও ফিড সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্ক্রিনে আর কিছুই দেখা যায় না। ক্যাসিনো তৎক্ষণাৎ বুঝে যায়, এটা কোনো সাধারণ টেকনিক্যাল সমস্যা না। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যামেরাগুলো নষ্ট করেছে। তৎক্ষণ ক্যাসিনো কমিউনিকেশন বোতামে চাপ দিয়ে সিকিউরিটি গার্ডদের অ্যালার্ট করে বলে,
“সিকিউরিটি গার্ডগুলোকে এলার্ট করো, এক সেকেন্ডের মধ্যেই।”
কিন্তু ঠিক তখনই এক বিকট শব্দে কাঁচের দরজাটা ধাম করে ভেঙে পড়ে। টুকরো টুকরো কাচ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে।ক্যাসিনো ধীরে ধীরে পেছনে ঘুরে তাকায়। মুহূর্তেই তার গলার পানি একদম শুকিয়ে আসে।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং ড্রেভেন হান্টার।ড্রেভেন ধীর পায়ে তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঠান্ডা কন্ঠ বলে ওঠে,
“হ্যালো ম্যান।”
ক্যাসিনো চায় না তার দুর্বলতা প্রকাশ পাক।সে বুক ভরে দম নিয়ে বলে,
“যতই চেষ্টা করিস না কেন, ফর্মুলা আমি তোর হাতে কিছুতেই দিব না।”
ড্রেভেন মুখোশের আড়াল থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।সে আরেক ধাপ এগিয়ে এসে ঘাড় কাত করে ভারী কণ্ঠে বলল,
“ড্রেভেন খালি হাতে ফিরতে শিখিনি।”
ক্যাসিনো চোখের ইশারায় গার্ডদের নির্দেশ দেয়।তৎক্ষণাৎ চারদিক থেকে গার্ডরা ঘিরে ধরে ড্রেভেনকে।কিন্তু ড্রেভেন একটুও বিচলিত না হয়ে কোটের ভেতর থেকে ছোট আকারের স্নেক বোম বের করে সেকেন্ডের মধ্যে ছুঁরে দিল গার্ডের দিকে।মুহূর্তেই সামান্য বিস্ফোরণে গার্ডগুলো শরীর হাওয়াই ছিটকে নিথর হয়ে পড়ে যায়।ক্যাসিনো স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।তার কপাল দিয়ে ঘাম অঝোর ঝরছে।ড্রেভেন এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে।চোখে শিকারির মতো তৃষ্ণা নিয়ে বলে ওঠে,
“এবার কী হবে তোর ক্যাসিনো?ভাবতে শুরু কর। সময় কিন্তু কম তোর হাতে।”
ক্যাসিনো পিছু সরে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে টেবিলের পাশে পড়ে যায়।বয়স বেড়েছে যার ফলে তার শরীর কাঁপছে। তবুও সে ঠোঁট চেপে গম্ভীর গলায় বলল,
“যাই হোক আমি নিজে যা-ই হয়ে যাই না কেন, ফর্মুলা আমি তোর হাতে দিব না।”
এই কথায় ড্রেভেন থামে না, বরং তার চোখে রাগের আগুন আরও জ্বলে ওঠে।সামনের কাচের শেলফে রাখা ফর্মুলা আর ব্ল্যাক ডায়মন্ড তখনো জ্বলজ্বল করছে।সেই দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে ফিসফিস করে ড্রেভেন বলে,
“ফর্মুলা তো আমি সঙ্গে করেই নিয়ে যাব।আর তোর প্রাণটাও আমার সঙ্গে চলে যাবে।”
এ কথা শুনে কিছুক্ষণ ক্যাসিনো চুপ হয়ে কিছু একটা চিন্তা করে।তাকে ড্রেভেন আর ইউভানের আসল সত্য জানতেই হবে।তাই সে পরিকল্পনা অনু্যায়ী ঠান্ডা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
“ঠিক আছে ফর্মুলা আমি তোকে দিব। কিন্তু তার আগে বল তুই কে?”
ড্রেভেন হঠাৎ থেমে যায়। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে ক্যাসিনোর সামনে বসে চাপা কন্ঠে আওড়ায়,
“এখনো বুঝতে পারিস না আমি কে?”
ক্যাসিনোর মুখ শুকিয়ে আসে।নিজেকে সামলে সে গলা ঝেড়ে বলল,
“বুঝতে পারিনি বলেই তো জিজ্ঞাসা করেছি।তুই কে? আর এই ফর্মুলা তোর কাছে কিভাবে গেল?”
ড্রেভেন এবার নিচু স্বরে হেসে ওঠে। সেই হাসির মধ্যে অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে।হাসতে হাসতে সে তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলল,
“এতগুলো প্রশ্ন একসাথে? কিন্তু আমি কেন তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিব?”
ক্যাসিনো রেগে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলে,
“দিবি তুই! কারণ ফর্মুলা আমার হাতে। আর ওটা দিয়ে আমি কী করব তা তো তুই ভালো করেই জানিস।”
ড্রেভেন এবার গম্ভীর গলায় বলে,
“তার আগে তুই একটা প্রশ্নের উত্তর দে।”
“কী প্রশ্ন?”
ড্রেভেন তার হাতে থাকা বন্দুকটা ঘোরাতে ঘোরাতে তাক করে ধরে ক্যাসিনোর দিকে।তারপর ধারালো কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
“আমার রোজ মা কোথায়?”
এই প্রশ্নটা শুনে ক্যাসিনোর মাথার ভেতরে বজ্রপাত হয়। বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। নিজের স্ত্রীর কথা, এত বছর পর শত্রুর মুখে শুনে তার হৃদয় তালগোল পাকিয়ে ফেলে।তবে তার চেয়েও বড় ধাক্কা খায় সে ড্রেভেনের ‘রোজ মা’ সম্বন্ধান কারায়। ক্যাসিনো হাঁ করে ড্রেভেনের মুখের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“ম ম মানে?”
ড্রেভেন এবার হঠাৎ করেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।হাসি থামিয়ে ভয়ংকর কণ্ঠে সে প্রতিউত্তরে বলে,
“কেন কী ভেবেছিলি? তোর লাগানো আগুন আমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে পারবে? এত সহজ বুঝি?”
ক্যাসিনো স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখের পলক না ফেলেই তাকিয়ে আছে ড্রেভেনের দিকে।তবুও সে নিজের ভিতরের দ্বিধা কাটিয়ে উঠে আবার ফিসফিস করে বলল,
“কথা ঘুরাস না। সত্যি করে বল তুই কে?”
ড্রেভেন বন্দুকটা আরও ঠেসে ধরল ক্যাসিনোর গলা বরাবর।ক্যাসিনোর দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে মুহূর্তেই। তখনই ড্রেভেন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি সে,যাকে তুই তোর নোংরা এক্সপেরিমেন্টে ব্যবহার করেছিলি।যাকে তুই তার রোজ মায়ের থেকে আলাদা করেছিলি।আমি সেই,যার শৈশবকে তুই নরক বানিয়ে দিয়েছিলি।মনে পড়ে কিছু?”
এই কথা শুনে ক্যাসিনো কেমন জমে গেল। তার মাথার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।ক্যাসিনো হিসেব মেলাতে পারছে না।কীভাবে সম্ভব? কোনো হিসাব মিলছে না। ইউভান আর ড্রেভেন,তাদের অস্তিত্ব নিয়ে সে যা ভেবেছিল তা সব ভুল।সে ঠোঁট ফাঁক করে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
” আ্যশ আ্যশার….।”
ড্রেভেন মুখোশের আড়ালে ঠোঁটের কোণে ঠান্ডা হাসি ফুটিয়ে ধরা গলায় উচ্চারণ করে,
“নোপ!আই’ম অনলি ড্রেভেন হান্টার।তোর মৃত্যু!”
ক্যাসিনো কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে কন্ঠে দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইল,
“তারমানে তুই সেই আ্যশার?”
ড্রেভেন প্রতিউত্তরে হিশহিশিয়ে বলে,
“কেন?কোনো সন্দেহ আছে?”
এই প্রশ্নে ক্যাসিনোর মুখের ভাব মুহূর্তেই পাল্টে যায়।ড্রেভেনের মুখ থেকে ‘রোজ মা’ শুনে ক্যাসিনো শতভাগ নিশ্চিত হয় ড্রেভেনই আ্যশার।এত বড় সত্য ক্যাসিনো কিছুতেই মানতে পারছে না। তার চোখের কোণে কেমন একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে।সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,
“সব বুঝলাম তুই বাঁচলি কীভাবে?”
ড্রেভেন বন্দুক নামিয়ে দাঁড়াল।তারপর ধীরকদমে এগিয়ে কাঁচের সেলফে রাখা ফর্মুলাটি হাতে নিয়ে বলল,
“তোর শত্রু বাঁচিয়েছে আমায়।”
ক্যাসিনোর কপাল সামান্য সংকুচিত হয়।সে বিস্মিত কন্ঠে জানতে চাইলো,
“ম মানে?”
ক্যাসিনো কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই পেছন থেকে এক বিকট শব্দে গুলি এসে বিঁধে ক্যাসিনোর কাঁধে।মুহূর্তে আর্তনাদ করে ক্যাসিনো হেলে পরে নিচে।রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে তার হাত বেয়ে মেঝেতে। ড্রেভেন চমকে পেছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখে বন্দুক হাতে ইউভান দাড়িয়ে আছে।ইউভান ধীরে ধীরে ক্যাসিনোর সামনে এগিয়ে আসল।ক্যসিনো যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে সেই দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
“ই ইউভান ত তুই কে?”
ইউভান এবার ঠোঁট বাঁকা করে এক চিলতে ঠাণ্ডা হাসি দিয়ে বলে,
“আমি কে জানাটা এতটাও সহজ না। আমার পরিচয় জানতে হলে তোকে আরও গভীরে যেতে হবে, ব্লাডি ফাকিং বিচ।”
ক্যাসিনো আর কিছু বলতে পারে না সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে যায়।ইউভান সেটা দেখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ড্রেভেনের পানে তাকায়।ড্রেভেন ইউভানকে দেখে মুখোশের আড়ালে এক রহস্যময়ী হাসি দিল।
রাতের হাওয়া আরও বেশি শীতল হয়ে উঠেছে। বাইরে টুপটাপ বরফ পড়ছে নিঃশব্দে।ঘরের ভেতর এক কোণে কাঠের আগুন জ্বলছে। আগুনের পাশে বসে আছে ইউভান।সে খুব মনোযোগ সহকারে আভীরের হাত ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে।ব্যান্ডেজ শেষ করে ইউভান আভীরের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“কেমন ফিল করছিস এখন?”
আভীর বিরক্তি নিয়ে ইউভানের দিকে তাকায়। তার মুখে ব্যথার ছাপ নেই, বরং ঠোঁটের কোণে একরকম ব্যঙ্গ এনে বলল,
“শ্বশুরের কাছে জামাই আদর হিসেবে গুলি খেয়ে প্রাউড ফিল করছি।”
এই কথাটা শুনে ইউভানের ঠোঁটে একটু মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ডোন্ট ওয়ারি তার বদলে ক্যাসিনো গুলি খেয়েছে।”
হঠাৎই আভীরের ইউভানের ফোনের কথা মনে পড়ে।ফোনটা তার কাছেই রয়ে গিয়েছে।সে দ্রুত ফোনটা বের করে ইউভানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আরভির নাম্বার আছে তোর কাছে?”
আভীরের হুট করে এমন প্রশ্ন করার কারণ ইউভানের বোধগম্য হলো না।সে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে জবাবে বলল,
“নাহ পিহুর নাম্বার আমার কাছে নেই।বাই দ্যা ওয়ে তুই রেস্ট নে!”
বলেই ইউভান পেছনদিকে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।তবে একথা শুনে আভীরের ধূসর চোখ পরিবর্তিত হয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করে।কারণ সে এই ফোনে পিহুর কন্ঠের আওয়াজ শুনেছে।তা কী করে ভুল হয়?সে ঠোঁট বাঁকিয়ে পেছন থেকে হুমকি স্বরুপ বলে,
“লিসেন ইউভান চৌধুরী!প্রসঙ্গ যখন আমার ভালোবাসার তখন বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যেতেও শাহরিয়ার আভীর কায়নাথ দ্বিতীয়বার ভাববে না।”
কথাটা ইউভানের কানে পৌঁছানো মুহূর্তেই থেমে দাঁড়ায়।তেমন প্রতিক্রিয়া না করে সামনের দিকে তাকিয়ে নিলিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
“শত্রুতা আবার ইউভান চৌধুরীও ভালোভাবেই নেভাতে পারে মিস্টার শাহারিয়ার।মাইন্ড ইট!”
আভীর প্রতি উত্তর করল না বরং হাসল।ইউভান সঙ্গে সঙ্গে ভারী পায়ের শব্দ ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।ইউভান সোজা নিজের রুমে এসে সোফায় আরাম করে বসলো।ফোনটা দিকে তাকিয়ে তার হঠাৎই আনায়ার কথা মনে পড়ে।অনেকক্ষণ হলো আনায়ার সাথে কোনো কথা হয়নি।ফোনটা ওপেন করতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় ইউভানের।অনেকগুলো মিসড কল।সবগুলো কল দিয়েছে আনায়া।ইউভানের বুকটা ধাপ করে উঠল। সে সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে।তবে ওপাশ থেকে কেউ কল তুলছে না।ইউভান কল দিতে দিতে অধৈর্য হয়ে বলে,
“পিক আপ দ্যা ফোন সুইটি।”
পুনরায় কল দেয় সে কিন্তু অপর পাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করেনা।ইউভান অধৈর্য হয়ে পকেট থেকে হেডফোন বের করে কানে দেয়।সময় নিয়ে মনোযোগ সহকারে কিছু একটা শুনতে থাকে। মুহূর্তেই তার চোখ লালচে হয়ে উঠে।ক্রোধে সে সামনে থাকা কাচের গ্লাসটা এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়।এরপর তড়িৎ বেগে কাউকে কল দিয়ে হুংকার ছেড়ে বলে,
“ফ্ল্যাইট রেডি করো। এখনই বাংলাদেশে ফিরছি।”
অপরদিকে বাংলাদেশে,
আনায়া এলোমেলোভাবে নিজের ঘরের মেঝেতে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ঘরটা যেন একটা যুদ্ধের ময়দান।ঘরের চারপাশে জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আনায়া চুপচাপ তাকিয়ে আছে নিজের হাতে ধরা মোবাইল স্ক্রিনের দিকে। স্ক্রিনে ইউভানের নাম বারবার ভেসে উঠছে।একসময় রাগে গা জ্বলে ওঠে তার। হঠাৎ সে এক আঘাতে ফোনটা আছাড় মারে মেঝেতে।পরমুহুর্তে আনায়া তীব্র রাগে চিৎকার করে উঠে বলে,
“ধরব না আমি আপনার ফোন।আই হেইট ইউ!”
ক্রোধে তার নিঃশ্বাস ঘন হতে থাকে।কেন ধরবে সে ফোন?যখন ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিল, আংটির কথা হচ্ছিল, কতবার ফোন করেছিল ইউভানকে সে।কিন্তু একবারও কল ধরেনি ইউভান।আনায়া নিজের মুঠোয় থাকা ছোট্ট একটি আংটির দিকে তাকায় ছেলে পক্ষ থেকে সে আংটি গ্রহণ করেনি।কিন্তু তবুও ছেলেপক্ষ আংটি দিয়ে গেছে, তার মায়ের হাতে। আর সেই নিয়েই বাসায় তুমুল ঝগড়া। তাতে কোনোও লাভ হয়নি।আনায়া এখনও আংটি আঙুলে পরে নি।সে উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁট শক্ত করে চেপে বলে,
“আপনাকে এর মাশুল দিতে হবে ইউভান ভাই।আপনি জানেন, আমার কত অসহ্য লাগছিল। ওই ছেলেটা আমার চোখের দিকে কেমন বাজে ভাবে তাকাচ্ছিল।কেন ফোন ধরেনি আমার হ্যাঁ?”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় আনায়া। তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আয়নার দিকে।সেই আয়নায় আনায়া একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে নিজের চোখের দিকে। কি আছে এই চোখে যা সবাইকে টানে? ইউভান তো এই চোখের জন্যই কত পাগলামি করেছে।কিন্তু কেন?সে আয়নার সামনে এগিয়ে এসে নিজেকে আরও গভীরভাবে দেখে। হ্যাঁ, তার চোখ সত্যিই অস্বাভাবিক সুন্দর, উজ্জ্বল সোনালী বর্ণের। কিন্তু এটুকুই কি?অনেকক্ষণ যাবৎ আনায়া একইভাবে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।আচমকা আনায়া উপলব্ধি করে, সে চাইলেও চোখ সরাতে পারছে না। তার নিজের চোখ যেন তারই দিকে তাকিয়ে হ্যালুসিনেশন তৈরি করছে।আনায়ার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে প্রায়।সে নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে দৃষ্টি সারায় আয়না থেকে। হুঁশ ফিরে পেয়ে হাপাতে হাপাতে জোরে জোরে শ্বাস নেয়।ধপ করে বিছানায় বসে নিজেকেই প্রশ্ন করে বলে,
“আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?কি হচ্ছে এগুলো আমার সাথে?”
কিছু বুঝতে পারে না আনায়া।তখনই তার মাথার পেছনটাই পুরনো ব্যথাটা অনুভব হয়।ব্যথাটা আজকাল বেশি বেড়েছে।আনায়া দ্রুত ড্রয়ার থেকে মেডিসিন বের করে খেয়ে নিল।সে আর কিছু না ভেবে চিন্তার জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুয়ে পড়ে।
অতীত,
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের ঠিক উপকণ্ঠে অবস্থিত ‘St. Clara Medica’ হাসপাতালটি বেশ বিখ্যাত।হাসপাতালের করিডোরজুড়ে সাদা অ্যাপ্রন পরা নার্স আর ডাক্তাররা ছুটে চলেছে ব্যস্ততাই। হাসপাতালের A-2 ওয়ার্ড একটু নিরিবিলি। এখানেই একটা কেবিনে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আলিসা। মাথায় ব্যান্ডেজ করা,তার। পাশের চেয়ারে বসা ক্যাসিনোর হাতে পায়েও ব্যান্ডেজ।হঠাৎই আলিসা বিছানা থেকে উঠে চিৎকার করে উঠল,
“আ্যশাররররর!”
নিঃশ্বাস গুলো বড় বড় হয়ে আসছে আলিসার।ক্যাসিনো চমকে উঠল।সে দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে আলিসাকে দুহাতে আগলে ধরে বলল,
“রোজ, শান্ত হও। শান্ত হও প্লিজ।”
কিন্তু আলিসা যেন কিছুই শুনছে না। সে চারদিক তাকিয়ে বুক চাপড়ে বলল,
“ক্যাসিনো, আমার আ্যশার কোথায়? কোথায় ও? বলো।”
ক্যাসিনো কোন উত্তর না।সে একটানা তাকিয়ে আছে আলিসার মুখের দিকে।ক্যাসিনোকে চুপ থাকতে দেখে আলিসা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
“তুমি চুপ কেন? আমি জিজ্ঞেস করছি,আমার আ্যশার কোথায়? ঠিক আছে তো ও?”
আলিসা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে।চোখ দিয়ে অবিরাম জল পড়ছে তার।ক্যাসিনো এবার কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আই’ম সরি রোজ। আ্যশারের বডি খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়ত আগুনে….”
আর কিছু বলতে পারল না।তার আগেই আলিসা জোরে ঠেলা দিয়ে ক্যাসিনোকে সরিয়ে দেয়।তার হৃদয় যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেছে।সে পাগলের মতো উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বলে,
“চুপ!কি সব আজগুবি কথা বলছো তুমি? আমার আ্যশারের কিছু হতে পারে না।কোথায় লুকিয়ে রেখেছো ওকে তুমি?”
বলেই আলিসা উম্মাদের ন্যায় চারপাশে থাকা হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ছুড়ে ফেলে দেয়।তার এহেন আচরণ দেখে ক্যাসিনো ঘাবড়ে যায়।আলিসা উন্মাদ কন্ঠে পুনরায় বলল,
“ও খুব ছোট। ও আমায় ছাড়া একা থাকতে পারবে না ক্যাসিনো। দয়া করে আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলো। এখনই!”
বলেই দু’হাতে চুল চেপে ধরে জোরে কাঁদতে থাকে আলিসা। কান্নার শব্দে পুরো কেবিন কেঁপে ওঠে।ক্যাসিনো এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। এগিয়ে এসে আলিসাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে,
“আমি সত্যি নিরুপায় রোজ।আ্যশারের বডি আগুনে পুড়ে গেছে খুঁজে পাইনি।”
এই কথাটা শুনে আলিসা ক্যাসিনোর বাহুর মধ্যে ছটফট করতে থাকে। আলিসার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সবকিছু দুঃস্বপ্নের মত লাগছে তার কাছে।আলিসা নিজের হাতে আ্যশারকে বড় করেছে।নিজের সুখ দুঃখের সঙ্গী বানিয়েছে।তাকে ছাড়া আলিসা কিভাবে থাকবে বেঁচে?আ্যশার তাকে মা সম্বোধন করেছে আজ প্রথম আর আজই সে তার ছেলেকে হারিয়ে ফেলল?এ সত্য আলিসার হৃদয় সইছে না।তার হৃদয় ভেঙ্গে-চুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে।আলিসা ক্যাসিনোর পায়ের কাছে বসে পড়ে।সে ক্যাসিনোর কাছে দুহাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমাকে যেতে দাও, ও নিশ্চয় কোথাও বসে কাঁদছে আমার জন্য।আমি ছাড়া,ওর কেউ নেই।আমার আ্যশার, আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাও।”
ক্যাসিনো হাটু গেড়ে বসে দুবাহু দ্বারা আলিসাকে আগলে নিয়ে সান্তনা দিয়ে বলে,
“নিজেকে সামলাও রোজ।”
আ্যশার প্রতি আলিসার ভালোবাসা দেখে ক্যাসিনো সম্পূর্ণ স্তব্ধ।যে নিজের প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে কবর দিতে পিছুপা হয়নি,সেই কঠোর আলিসা অজানা বাচ্চা ছেলের জন্য এত মায়া?আলিসা কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে যায়।ক্যাসিনো ঘাবড়ে দ্রুত আলিসাকে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনে,
“ডক্টর! হোয়াট হ্যাপেন? ইজ শি ওকে?”
ডাক্তার তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে আলিসার পালস চেক করে, একটা ইনজেকশন দেয়।তারপর ক্যাসিনো কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রিল্যাক্স মিস্টার ক্যাসিনো নাথিং সিরিয়াস। শি নিড সাম রেস্ট নাউ।প্লিজ ইউ ওয়েট আউটসাইড।”
ক্যাসিনো মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে কেবিনের বাইরে চলে যায়। দরজার ফাঁক দিয়ে একবার চোখ রাখে আলিসার দিকে।ঠিক তখনই ক্যাসিনোর ফোনটা বাজে।ফোনটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাসিনোর মুখ রং পরিবর্তিত হয়।সে খুব আস্তে করে বলল,
“আমি এক্ষুনি আসছি।”
তারপর শেষবারের মতো আলিসার দিকে তাকিয়ে পিছন ফিরে হসপিটাল থেকে অন্য গন্তব্যে রওনা দেয়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ক্যাসিনো নিজের গাড়িতে উঠে বসল। অল্প কিছুক্ষণ পর, গাড়ি এসে থামে একটি বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে।গার্ড এসে মাথা নিচু করে সম্মান জানিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়।ক্যাসিনো ধীর পায়ে বেরিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে।সে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা এগোয় নিচতলার একটা গোপন রুমের দিকে।ঘরের এক প্রান্তে রাখা একটি বিশাল বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে সে বুকশেলফের ঠিক মাঝখানে একটা চাপা চাবি ঘোরায়।এক মুহূর্তেই সেই ওয়ালের নিচে লুকানো দরজাটা ফাঁক হয়ে যায়।ক্যাসিনো সেই দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে।নিচে নামতে অন্যরকম জগত দৃশ্যমান হয়। চারপাশে কাচের ঘর, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, স্পেশাল টিউব, ব্লু লাইট, দেখে মনে হবে কোনো ল্যাবরেটরি।প্রবেশের মুখে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন ভারী অস্ত্রধারী গার্ড। ক্যাসিনোর চোখের ইশারাতেই তারা একপাশে সরে দাঁড়ায়।সে সোজা আরেকটি ঘরে ঢোকে।ঘরটি একটু বেশি ঠান্ডা। ঘরের একপাশে একটা বিশাল কাচের জারে বন্দি অদ্ভুত এক প্রাণী। ঠিক পাশেই, দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আছে একটি ছোট্ট ছেলেটি।ছেলেটি তার নীলাভ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ক্যাসিনের উপর নিক্ষেপ করে।আর ক্যাসিনো ধীরে ধীরে ছেলেটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বাঁকা হেসে বলে,
“ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড। কেমন লাগছে অ্যাশার, এখানে?”
আ্যশার কিছু বলতে পারে না তার চোখমুখে আতঙ্ক।শরীরে অনেক জায়গায় রক্ত লেগে আছে তার।এই পুরো এক্সিডেন্ট ক্যাসিনোর এর পূর্ব পরিকল্পিত।সে আলিসার বুক থেকে ছিঁড়ে এনেছে অ্যাশারকে।আ্যশার ছটফট করে ওঠে যন্ত্রণায়। ক্যাসিনো আবারও বলে উঠে,
“এখন থেকে অভ্যাস করে নাও। প্রতিদিন তোমার এখানেই থাকতে হবে।”
এই কথা শুনে অ্যাশারের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
রোজ মায়ের কোলে ঘুমানো ছেলেটি কেমন করে এই বরফঠাণ্ডা কাচঘরের ভেতর থাকবে?ঠিক তখনই সেই কাচের জারে বন্দি প্রাণীটি এক বিশাল হুংকার ছাড়ে।
প্রাণীটার গর্জনে অ্যাশার কেঁপে ওঠে।এই ভয়ংকর প্রাণীটিকে সে খুব ভয় পায়। তখনই ক্যাসিনো রেগে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাথকে ডেকে বলে,
“ক্যাথ আমার থমাসকে এখনও খাবার দেওয়া হয়নি?”
ক্যাথ ভয়ে কেঁপে হেঁচকি গিলে বলে,
“জি স্যার মানে এখনই ব্যবস্থা করছি।”
ক্যাসিনো চোখ বড় করে তাকিয়ে দাঁত চিপে বলে,
“কুইকলি।”
ক্যাথ সাথে সাথে গার্ডদের ইশারা করে।তারা দ্রুত বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে ফেরে।আ্যশার নীরব দর্শক হয়ে সবকিছু দেখছে। তখনই ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা।গার্ডরা ছেলেটিকে ধরে সেই ভয়ংকর প্রাণী অর্থাৎ থমাসের মুখের কাছে ছেড়ে দেয়।মুহূর্তেই থমাস ছেলেটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।একে একে ছেলেটার মাংস টেনে ছিঁড়ে খেতে লাগল।রক্ত গড়িয়ে পড়ল কাচের ভেতরের দেয়াল বেয়ে।এমন ভয়ংকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আ্যশার হীম হয়ে যায়।ছেলেটির শরীরে হাড়ের সঙ্গে কিছু মাংসের টুকরো এখনো লেগে আছে।ক্যাসিনো দাঁড়িয়ে হাসছে।তার সৃষ্টি হাইব্রিড প্রাণীতো থমাস।ক্যাসিনোর আদেশে কয়েকজন গার্ড আ্যশারকে বাঁধন মুক্ত করে।অ্যাশার স্তব্ধ হয়ে বসে থমাসের দিকে তাকিয়ে আছে।তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।তখনই ক্যাসিনো এগিয়ে এসে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
“তুমিও যদি বেশি বাড়াবাড়ি করো, আমার কথা না শোনো, তাহলে তোমার অবস্থাও ওই ছেলেটার মতো হবে।”
এ কথা শুনে অ্যাশার কাঁপতে কাঁপতে মাথা দুই পাশে নাড়ে।সে আর কিচ্ছু বলার মতো অবস্থায় নেই।ক্যাসিনো পেছন ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে আ্যশার মৃদু গলায় বলে ওঠে,
“আমার রোজ মা কোথায়?”
এই কথা শোনা মাত্রই ক্যাসিনোর চোখ রাগে লাল হয়ে যায়।সে গর্জে উঠে বলে,
“দ্বিতীয়বার তোমার মুখ থেকে রোজের নামও শুনতে চাই না আমি।আর যদি শুনি, আমি তোমাকে ওই কাচের জারে ফেলে দেবো।”
আ্যশারের ভয়ে চোখের কোনে জল জমে ওঠে।সে ধীরে ধীরে দেয়ালের এক কোণে গুটিয়ে বসে হাঁটুর আড়ালে মুখটা লুকিয়ে ফেলে।সে কীভাবে তার রোজ মাকে ছাড়া থাকবে একা?ভাবলেই বুকটা হু হু করে ওঠে তার।ছোট্ট আ্যশার কিছুই জানেনা ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তার সাথে।তখনই ক্যাথারিন ক্যাসিনোকে জিজ্ঞাসা করে,
“স্যার এই ছেলেটার ওপর আপনার এক্সপেরিমেন্ট কবে থেকে শুরু করবেন?”
ক্যাসিনো থেমে একটু ভেবে উত্তরে বলে,
“কাল থেকেই।সবকিছু যেন রেডি থাকে!”
ক্যাথরিন দুই দিকে মাথা নাড়াই।ক্যাসিনো সেখান থেকে একেবার প্রস্থান করে।ক্যাথরিনও আ্যশারকে একা ফেলে চলে যায়।পুরো রুমে শুধু অ্যাশার, সেই মৃতদেহ আর বন্দি থমাস ব্যতীত কেউ নেই।
বর্তমান বাংলাদেশ,
চৌধুরী ম্যানসনের প্রতিটা কোণ আজ বর্ণিল আলোয় ঝলমল করছে। বিয়ের তোড়জোড় চলছে চূড়ান্ত প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে। আজ সারাহ আর সাদনানের গায়ে হলুদ।গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সাদনানের বাসায় করা হবে আজ।বিকাল নাগাদ বাসার প্রতিটা মানুষ সাজসজ্জার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। গাঁদার মালা আর পিতলের বাসনে সাজানো হলুদ-চন্দনের থালা সহ তত্ত্ব নিয়ে ছেলের বাড়ি রওনা হবে সবাই।কিন্তু এই রঙিন আয়োজনের মাঝেও আনায়া সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। বাইরে সবাই ডেকে ডেকে হয়রান, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই।রুহি শেষবারের মতো দরজায় ধাক্কা মেরে বলে উঠল,
“আলু বের হ প্লিজ। একবার দরজা খোল।”
কোনো উত্তর নেই।হতাশ হয়ে রুহি সেখান থেকে চলে যায়।তার শখ ছিল বোনের সঙ্গে একসাথে হলুদ শাড়ি পরবে, একসাথে সেলফি তুলবে কিন্তু কিছুই হলো না।
আজ সে হলুদ শাড়ি পরেছে।শরীরজুড়ে কাঁচা লাল গোলাপের গয়না আর মুখের দুধে আলতা রঙ মিশে এক অপার্থিব সৌন্দর্য তৈরি করেছে।সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শাড়ির ভাঁজে পা আটকে যায় রুহির।সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতেই পেছন থেকে কেউ শক্ত করে তার হাত ধরে ফেলে।মুহূর্তেই রুহির পিঠ গিয়ে ঠেকলো কারোর প্রশস্ত বুকে।আর ঠিক তখনই তার কানে আসে পুরুষলী কন্ঠের আওয়াজ,
“সাবধানে চলাফেরা করুন, ম্যাম।”
কন্ঠের স্বর শুনে রুহি বুঝে ফেলল এটা আয়ান।তখনই আয়ান রুহের সামনে এসে দাঁড়ায়।রুহিকে শাড়ি পড়া দেখে আয়ানের হৃদয় মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ থমকে যায়।সে মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের অজান্তে বলে ফেলল,
“মাশাআল্লাহ।”
সঙ্গে সঙ্গে রুহি মাথা নিচু করে ফেলে।আয়ান আজ বসন্ত রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে।নিঃসন্দেহে আয়ানকে কোন সুদর্শন পুরুষের থেকে কম লাগছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আয়ান নিজেই বলল,
“আমি সামনে আসলে কি তুই মুখে উলু পেতে রাখিস?”
রুহি চোখ তুলে একটু তাকিয়ে বলল,
“তো কী করব?”
আয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“কথা বলবি।”
রুহি শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে নিচু গলায় বলল,
“আপনার সঙ্গে বলার মতো কোনও কথা খুঁজে পাই না আমি।”
“কারণ জানতে পারি?”
রুহি আমতা আমতা করে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
“কারণ আপনি সামনে এলেই আমার শব্দগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়।”
আয়ান ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটিয়ে তুলে ধরা গলায় বলল,
“অথচ তোকে নিয়ে ভাবলে পুরো একটি উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে তবুও আমার সব শব্দ শেষ হবে না।”
রুহি মুখ উচিঁয়ে আয়ানের পানে তাকায়।তার চাউনিতে হাজার হাজার প্রশ্ন।এত কঠিন কথা আয়ান তাকে কেন বলল?রুহি বুঝল নাহ।আয়ান বিনা বাক্যে সেখান থেকে চলে যায়।রুহি সেই যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।তখনই নিচ থেকে সায়মা বেগমের ডাক আসে।ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে রুহি দ্রুত নিচে নামে।সকলে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদনানের বাসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য।রুহি আসায় চৌধুরী পরিবারের সকলে রওনা হয়।পুরো চৌধুরী ম্যানসনে আনায়া কেবল একা রয়েছে।
সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগেই, চারপাশে সন্ধ্যার ছায়া নেমে ঘন হয়ে উঠেছে। অথচ আনায়া ছন্নছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, মুখটা ফ্যাকাসে।ঠিক এমন এক নিঃসাড় সময়ে হঠাৎই তার ঘরের দরজায় টোকা পড়ে।আনায়ার কপাল কুঁচকে উঠে। এই সময়ে তো বাসায় কারো আসার কথা না।সে ধীরে পেছন ঘুরে বলে ওঠে,
“কে?”
কিন্তু কোনো উত্তর আসে না।নতুন করে দরজা থেকে আর কোনো শব্দ আসে না।তবুও আনায়ার মনের মধ্যে খচখচ করে।সে বুকে সাহস নিয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে কেউ নেই।কিন্তু কোনো উত্তর আসে না।ঠিক তখনই পাশের রুম থেকে পুণরায় একটা আওয়াজ হয়।মুহূর্তেই আনায়ার শরীরটা হালকা শিউরে ওঠে।। ভয় করে তার, তবুও সে সাহস করে,রুমটার সামনে এসে দেখে, ঘর প্রায় অন্ধকার।জানালার পর্দাটাও একদিক সরে গেছে।আনায়ার মনে কেমন সংকোচ জন্ম নেয়।আনায়া এগিয়ে এসে কাঁপা হাতে জানালার পর্দা সরাতে যাবে তৎক্ষণ তার ঘাড়ের কাছাকাছি কোথাও থেকে গরম নিশ্বাস পড়ে।মুহূর্তেই আনায়ার হাত থেমে যায়।হৃদয়ের গতি বেড়ে যেতে শুরু করে তার।সে স্পষ্ট পেছনে কারোর উপস্থিতি অনুভব করে।তার পরক্ষণেই এক পুরুষকণ্ঠ ছুঁয়ে যায় তার কান,
“সুইটি…”
এই ডাকটা শোনামাত্র আনায়া আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে।মনে হয়, কত বছর, না-হয় শতাব্দী পেরিয়ে গেছে এই ডাকটা শুনে তার বুকের মাঝে এক আবেশ জমে ওঠেপৃথিবী থেমে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য।কিন্তু সেই আবেশ বেশি সময় থাকে না।বাস্তবতার ঘোর টের পেয়ে সে চোখ মেলে তাকায়।সেকেন্ডের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে ইউভানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় আনায়া। এক মুহূর্তেই হৃদয়ের কোমলতা রাগে রূপান্তরিত হয়ে যায়।সে চিৎকার করে বলে ওঠে,
“কেন এসেছেন এখানে? সাহস কী করে হলো আমার কাছে আসার?”
ইউভানের মুখে স্থির অভিব্যক্তি।সে এক দৃষ্টিতে আনায়ার পানে তাকিয়ে শত বছরের পিপাসা মেটাচ্ছে।ইউভানকে চুপ থাকতে দেখে আনায়া পুনরায় গর্জে ওঠে,
“কী হলো উত্তর দিচ্ছে না কেন?”
ইউভান আগের ন্যায় স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“সুইটি আমার কথা শুন।”
আনায়া এবার আর সহ্য করতে পারে না।ক্রোধে তার চোখে তখন আগুন জ্বলছে।তীব্র বিদ্বেষে সে চিৎকার করে বলে,
“শুনবো না আমি আপনার কথা! শুনতেও চাই না। আপনি এখনই বেরিয়ে যান এখান থেকে।”
তৎক্ষণ ইউভান এক অপ্রত্যাশিত কথা বলে ফেলে,
“সুইটি প্লিজ, লেট মি হাগ ইউ জাস্ট ওয়ান্স।”
এই কথা শুনে আনায়া আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে সে কর্কষ কণ্ঠে বলে,
“গেট আউট।”
তবে ততে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ইউভানের।সে যেন নিজেকে থামাতে পারছে না।তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠেছে।মনে হচ্ছে,এখন যদি সে আনায়াকে জড়িয়ে ধরতে না পারে, তাহলে সে মরে যাবে।সে নিজেকে সামলে পুনরায় শান্ত স্বরে বলে,
“লিসেন একবার, একবার জরিয়ে ধরতে দে। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। প্লিজ সানসাইন!”
এই কথা আগুনে ঘি ঢালার মত কাজ করে।ক্রোধে আনায়ার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে,
“বলুন তো, কোন অধিকারে জড়িয়ে ধরবেন আমাকে?কাল আপনাকে কতবার কল দিয়েছি আমি?আমার কোনো গুরুত্ব নেই আপনার কাছে, তাই না?”
কিন্তু আনায়ার কোনো কথায় ইউভানের কান অব্দি পৌঁছায় না।তার ভেতরকার অশান্ত ঝড় আনায়াকে স্পর্শ করা না অব্দি থামবে না।ধীরে ধীরে তার ভেতরে আনায়েকে জড়িয়ে ধরার অস্থিরতা বাড়ছে।ইউভান শুকনো ঢুক গিলে উচ্চারণ করল,
“আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সানসাইন প্লিজ একটিবার জড়িয়ে ধরতে দে।তারপর সব বলছি!”
বলেই ইউভান সামনে এগিয়ে আসে দুই কদম।কিন্তু আনায়া পেছনে সরে যায় সাথে সাথে।তার চোখ ছলছল করছে।আনায়ার ঠোঁট কাঁপছে তবুও সে ভাঙ্গা গলায় বলল,
“সেই অধিকার আপনি হারিয়েছেন।কাল আমি হাজারবার কল দিয়েছি আপনাকে। কিন্তু আপনি ধরেননি। আমি কি এতটাই অপ্রয়োজনীয় ছিলাম আপনার জীবনে?”
ইউভান কাঁপা গলায় উত্তর দেয়,
“আমি কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ”
এ কথা শোনা মাত্রই আনায়া ক্ষীণ হাসে।সেই হাসিতে একরাশ রাগ,বেদনা,অভিমান জমে আছে।সে তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠে বলে উঠল,
“বাহ!ঠিক আছে। তাহলে আপনার কাজ নিয়েই থাকুন।আর আমি?”
বলেই আনায়া তারা হাতে থাকা আংটিটা ইউভানের চোখের সামনে স্পষ্ট করে ধরে বলল,
“আর আমি আমার হবু স্বামীকে নিয়ে না হয় থাকি।কাল বাগদান সম্পন্ন হয়েছে অন্য কারোর সঙ্গে আমার।”
বলেই আনায়া চিৎকার দিয়ে পাশে থাকা কাচের জারটি মেঝেতে আছাড় মারে। প্রচণ্ড শব্দে জারটা চুরমার হয়ে মেঝেতে কাঁচেরটুকরা ছড়িয়ে পড়ল। আনায়ার পাগলামির সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে।কিন্তু এত কিছুর মাঝে ইউভানের দৃষ্টি আনায়ার হাতের আংটির দিকে।এটা দেখে ইউভানের হৃদয়ের সমস্ত রক্ত সম্পূর্ণ চক্ষুতে ছড়িয়ে পড়ে।চোখ সরিয়ে সে আনায়ার পানে তাকায়।ইউভানের সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে আনায়া ভিতরে ভিতরে কাঁপলেও বাইরে তা প্রকাশ করে না।তখনই ইউভান এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে বসে।
সে একদমে এগিয়ে এসে আনায়াকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে অধরে অধর মিশিয়ে দেয়।মুহূর্তেই আনায়ার চোখ বিস্ফোরিত হয়।দুজনের ঠোঁটের মধ্যে দূরত্ব বলে কিছু রইল না।ইউভানের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া আনায়ার দেহে আগুন ধরিয়ে দেয়।সে দু’হাতে ইউভানেকে ঠেলে দুরে সারানোর প্রয়াস করে।কিন্তু ইউভানের শক্তির কাছে সে বরাবরই ব্যর্থ।ইউভান দুই হাতে শক্ত করে আনায়ার হাত দেয়ালে চেপে ধরে রেখেছে।আনায়া তবুও ছটফট করতে থাকে ইউভানের বাহুবন্ধনের মাঝে।সঙ্গে সঙ্গে চুম্বন ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।আনায়ার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে কারণ ইউভান তার শ্বাস আটকে রেখেছে তার অধরের মাঝে।ভয়,রাগ,লজ্জা,অভিমান সব অনুভূতির সংমিশ্রণে আনায়া কাঁপছে।
ইউভান নেশায় এখন সম্পূর্ণ মত্ত।আনায়া শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে।ইউভান ঠোঁটের স্পর্শ আরো কারো করে।একসময় আবেশে আনায়ার হাত নিজের অজান্তেই ইউভানের ঘাড়ে উঠে আসে।তখনই ইউভান আনায়ার হাতে আংটি তার অজান্তেতেই খুলে ফেলে।কিছু সময় বাদ ইউভান আনায়ার অধর ছেড়ে দিয়।আনায়া ছাড়া পেয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়।ইউভান আনায়ার আদলটি তুলে চোখে চোখ রেখে বলে,
“রাগ কমেছে?”
আনায়া চোখ সরিয়ে নিয়ে কর্কশ গলায় বলে,
“ছুবেন না আমায়।”
ইউভান খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইল,
“কেন পুড়ে যায়?”
“হ্যাঁ, আপনার অবৈধ স্পর্শে দেহ পুড়ে যায় আমার।”
আনায়ার কথায় ইউভান অধর প্রসারিত করে হাসলো।তারপর কিছুটা ঝুঁকে ধরা গলায় শুধালো,
“আমি নামক অবৈধের একমাত্র বৈধতা যে তুই।”
আনায়া ইউভানের দিকে তাকল নাহ।বরং অন্য দিকে তাকিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
“ঘৃণা করি আপনাকে।”
ইউভান ঠোঁটের কোলে হাসি নিয়ে বলল,
“ঘৃণা করলেও তুই আমার আর না করলেও তুই আমার।”
আনায়া ইউভানের পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে জবাবে বলল,
“এ কেবলি আপনার ভুল ধারণা।আমি অন্য কারো….”
মুহূর্তে ইউভান আনায়ার ঠোঁটে আঙুল রেখে থামিয়ে দেয়।কথাগুলো গিলে ফেলে সে।ইউভান তার দিকে ঝুঁকে হিশহিশিয়ে,
আত্মার অন্তরালে পর্ব ২১
“তোর এই শরীরের সীমারেখা মনে রাখিস সুইটি। আমার পৃষ্ঠদেশে শুধু তোর ছোঁয়াই থাকবে, অন্য কোনো হাতের স্পর্ধা যদি এই চামড়ায় পড়ে; তার পরিণাম নিষ্ঠুরতম অক্ষরে আমি নিজ হাতে লিখব। আর তোর শরীরও কেবল আমার স্পর্শেই সাড়া দেবে, অন্য কারো দুঃসাহস হবে না তোকে ছোঁয়ার।”