আত্মার অন্তরালে পর্ব ২৪
প্রীতি আক্তার পিহু
হঠাৎ মেঘের প্রচণ্ড গর্জনে আনায়া ঘুম থেকে আঁতকে উঠে বসে পড়ে। তার সমগ্র দেহজুড়ে ঘাম ঝরছে আর বুক অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। আনায়া উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে টের পায় সে তো তার রুমেই আছে। অর্থাৎ সেই বৃষ্টিভেজা ছাদ, ইউভানের স্পর্শ, সেই ক্ষণিক মুহূর্ত সবই কেবল তার স্বপ্নমাত্র!ইউভান তো সেই কখন মোমবাতি রুমে রেখে গিয়েছিল আর তার বৃষ্টিতে ভেজার অনুরোধ উপেক্ষা করেই চলে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আনায়ার আর একাকী ছাদে গিয়ে ভিজবার সাহস হয়নি। সুতরাং ইউভানকে নিয়ে চিন্তাধারার ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়ে এমন দুর্বিসহ স্বপ্ন দেখে সে। এসব ভাবতেই বিস্ময়ে স্তব্ধ আনায়া দুই হাত কপালে চেপে ধরে উচ্চারণ করল,
“আনু ছিঃ, তুই স্বপ্নে এসব কী দেখলি?”
ক্ষণমুহূর্তেই লজ্জার লাল আভায় সে দুহাতে মুখ ঢেকে ফিসফিস করে বলল,
“ইশশ! কী রোমান্টিক সপ্ন।”
কিন্তু ইউভানের উচ্চারিত ‘ভালোবাসি’ শব্দটিও নিছক স্বপ্ন ছিল, এই বোধ হতেই আনায়ার অন্তরটা হাহাকারে ভরে ওঠে। প্রবল হতাশা নিয়ে ধীরে বলে,
“এই স্বপ্ন কবে বাস্তব হবে মিস্টার ক্রিমিনাল? কবে আপনি আমায় স্পষ্ট মুখে বলবেন, ভালোবাসি?”
সে খুব করে চায় যে ইউভান তাকে ভালোবাসি স্বীকার করুক, কিন্তু এ আকাঙ্ক্ষা আদৌ কি পূরণ হবে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আনায়া খোলা জানালার দিকে চেয়ে দেখে, অবিরাম বর্ষা ঝরছে। ধীরে সে বিছানা ছেড়ে জানালার ধারে এসে স্থির হয়। হঠাৎই কামে অদ্ভুত শব্দ পৌঁছাতেই আনায়া আঁতকে উঠে। অজ্ঞাত ভয়ে তার দেহ কাঁপতে থাকে। সাহস সঞ্চয় করে বাইরে বের হয়ে দেখে, চারদিকে অগণিত রুম কিন্তু কোনটিতে ইউভান আছেন তা অজানা। ঠিক তখনই পুনরায় ভাঙচুরের শব্দ আসে। সঙ্গে সঙ্গেই আনায়া পেছন ফিরে লক্ষ্য করে আওয়াজটা সিঁড়ির পাশের রুম থেকে আসছে। ভয়ে শুষ্ক কণ্ঠে সে ডেকে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কে? ইউভান ভাই, আপনি ওখানে?”
কোনো প্রতিধ্বনি না আসায় আনায়া সেই রুমের কাছে এসে দাঁড়ায়। সঙ্কোচের সাথে দরজাটা ঠেলে খুলে দেখে চারপাশে ভাঙাচোরা ধুলো, ভাঙ্গা আসবাবপত্র পড়ে আছে, কিন্তু কারোর উপস্থিতি নেই। আনায়া ভেতরে প্রবেশ করে সতর্ক চোখে চারদিক পর্যবেক্ষণ করে। হঠাৎই তার দৃষ্টি স্থির হয় বুকশেলফের আড়ালে আধখোলা গুপ্তদ্বারের দিকে। কৌতূহলী হয়ে সে গুপ্তদ্বারের নিকটে এগোয়, আর তখনই তার পায়ের নিচে একটি আংটি বাঁধে। আনায়া ভ্রূ কুঁচকে আংটিটি তুলে নিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,
“এ তো সেই আংটি, যেটি সেদিন ছেলেপক্ষ আমায় দিয়েছিল। কিন্তু এটি এখানে কেন?”
তৎক্ষণাৎ আনায়ার মনে পড়ে আংটিটি তো ইউভানই তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। এ বার সে নিশ্চিত হয় যে ভেতরে ইউভান আছে। তাই বিন্দুমাত্র সংশয় ছাড়াই গুপ্তদ্বারের ভেতরের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এক অন্ধকার রুমে পৌঁছায় আনায়া। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সে আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে ডাক দেয়,
“মিস্টার ক্রিমিনাল…”
কোনো সাড়া না মেলায় ভীত-সন্ত্রস্ত আনায়া কয়েক পদক্ষেপ অগ্রসর হতেই ক্ষীণ আলোর সন্ধান পেল। কিন্তু আলোর নিকটে পৌঁছাতেই তার চক্ষু বিস্ফোরিত হয়ে যায়। সম্মুখের নৃশংস দৃশ্য দেখে আনায়া প্রবল আর্তনাদে চিৎকার করে ওঠে,
“আআআআআআআআআ!”
ভয়ে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ শক্তভাবে চেপে ধরে সে। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য! আনায়ার দেহ স্তব্ধ হয়ে পাথরের মতো কঠিন হয়ে আসে। তার সামনে লোহার স্ট্রাকচারের উপর এক মানুষের বিচ্ছিন্ন হাত, পায়ের খন্ডাংশ, নড়ি-ভুঁড়ি, কিডনি, হৃদপিণ্ড ছড়িয়ে আছে। শরীরের উপরে ফেলা চামড়ার চাদরের মতো গুটানো আর দেহের অভ্যন্তরীণ হাড়গুলো যত্নসহকারে সাজিয়ে রাখা।মৃতদেহের রক্তিম মাংস টুকরো করে এক পাশে রাখা, সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে আনায়ার পা অব্দি আসছে। তখনই আনায়ার কম্পিত দৃষ্টি কাটা মাথাটির দিকে আটকে গেল, যা আর কারো নয় বরং সেই ব্যক্তির; যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা চলছে।
তার হাতের মুঠোর আংটিটি নিচে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার করে উঠল,
“ইউভাননননননননননন!”
চিৎকারের ধ্বনি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার মাথায় ভীষণ আঘাত পড়ে। সামান্য আর্তনাদ করে পেছনে ফিরে সে ঝাপসা চোখে একবার মানুষটিকে দেখেই অচেতন হয়ে পড়ে। অবচেতন আনায়ার দেহ ঢলে পড়ার আগেই ইউভান তাকে দুই বাহুর মধ্যে আগলে নিল।অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলল,
“আই’ম সরি, সুইটি।”
বলেই সে আনায়াকে কোলে তুলে সেই কাটা মাথার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে অদ্ভুত বাঁকা হাসি নিয়ে আওড়ায়,
“ফাকিং ম্যান! তোকে কুকুরের খাবার বানানোর আগে আমার সুইটি চলে এল। ইউ আর সো লাকি, ব্লাডি বিচ! বাট ডোন্ট ওয়ারি, আই’ল বি ব্যাক।”
এরপর নিঃশব্দে সে সেই স্থান ত্যাগ করে সোজা রুমে প্রবেশ করে। সযত্নে আনায়াকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে বসল। কিছুক্ষণ তার নিস্তেজ মুখটি পর্যবেক্ষণ করে নিচু কন্ঠে বলল,
“তোর ওখানে যাওয়া উচিত হয়নি সুইটি। আই’ম এগেইন সরি।”
তৎক্ষণাৎ ইউভান উঠে তার কালো ব্যাগ থেকে একটি ইনজেকশন বের করে তা আনায়ার বাহুতে পুশ করল।কিন্তু তাতেও ইউভানের দুশ্চিন্তা কমছে না বরং আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামান্য ঝুঁকে সে আনায়ার কপালে আলতো চুমু দিয়ে শান্ত স্বরে শুধাল,
“ডোন্ট ওয়ারি! সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে সুইটি।”
এরপর কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সে ফোন বের করে কাউকে কল দেয়। বহুবার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হতেই ইউভান গর্জে উঠল,
“ফাকিং বিচ, ফোন তুলতে এত দেরি কেন?”
ওপাশ থেকে আভীর ঘুমভরা চোখে বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“হোয়াট হ্যাপেন ভাই? এত রাতে ফোন দিয়ে চিল্লাচ্ছিস কেন?”
“অনেক বড় প্রবলেম হয়েছে। আনায়া মাথায় আঘাত পেয়েছে।”
“ওয়াট? কিন্তু কীভাবে আঘাত পেল?”
“আমি আঘাত করেছি কারণ সে আমাকে খুন করতে দেখে ফেলেছে।”
এমন কথায় আভীর হেসে সামান্য ব্যঙ্গ করে ইউভানের উদ্দেশ্যে বুলি ছুঁড়ল,
“ইউ আর দ্যা গ্রেট ব্রো! তোকে এই কাজে নোবেল দেওয়া উচিত।”
ইউভান ক্রোধে দাঁতে দাঁত চেপে সামান্য চিৎকার দিয়ে আওড়ালো,
“বাজে কথা বন্ধ কর। এখন বল কী হবে?”
প্রতিউত্তরে আভীর ঠোঁটের কোণে রহস্যময়ভাবে হাসি ফেলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
“বেশি কিছু হবে না। শুধু আনায়ার পুরোনো স্মৃতিশক্তি ফিরবে, আর বর্তমান তোকে চিরতরে ভুলে যাবে। দ্যাটস ইট।”
এ কথায় ইউভানের মুখরঙ বদলে অন্ধকারে ডুবে যায়। অস্থির দৃষ্টিতে সে আনায়ার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকায়। মুহূর্তেই, হারানোর ভয় তার বুকের ভেতর জাগ্রত হয়। ইউভানকে চুপ থাকতে দেখে আভীর আচমকা উচ্চস্বরে হেসে উচ্চারণ করে,
“রিলাক্স ভাই! জাস্ট ফান করছিলাম। সামান্য আঘাতে আনায়ার কিছু হবে না।”
আভীরের জঘন্য মজা শুনে ইউভান ক্রোধে ফেটে পড়ে হিশহিশিয়ে বলে,
“হোয়াট রাবিশ! আই’ল কিল ইউ।”
আভীর হাসি থামিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে কণ্ঠে হিংস্রতা মিশেয়ে বলল,
“কিছুক্ষণের জন্য তোকে বুঝালাম, ভালোবাসার মানুষ থেকে দূরত্ব আর বিচ্ছেদ কতটা ভয়ঙ্কর। তো কেমন লাগল?”
ইউভান এবার চোখ বন্ধ করে বুঝতে পারে যে, আভীর আসলে তাকে কী বোঝাতে চাইছে। কয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সংযত করে শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
“তুই ভালো করেই জানিস কেন তোর আর পিহুর এই দূরত্ব! ক্যাসিনোর মেয়ে বেঁচে আছে জানলে তোর বাবা ওকে আবারও মারার চেষ্টা করবে। যেমনটা ছোটবেলায় করেছিল।”
এমন কথায় হঠাৎ আভীরের চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েক বছর আগের দৃশ্য। বাংলাদেশে এসে তার বাবা সদ্যজাত মেয়েটিকে ইউভানের কোলে তুলে দিয়েছিল, সাগরে ভাসানোর জন্য। কিন্তু এগারো বছর বয়সি ছোট্ট ইউভান নিরপরাধ প্রাণটিকে হত্যা করতে পারেনি। মেয়েটিকে বাঁচিয়ে সে অনাথ আশ্রমের সামনে রেখে গিয়েছিল। সেই মেয়েটি হলো আরভিয়া জাহান পিহু।যার প্রাণ বাঁচাতে ছোট্ট ইউভান তাকে স্বইচ্ছায় প্রথম স্পর্শ করেছিল আর সেই তাগিদেই পিহু ইউভানের প্রথম স্পর্শ পাওয়া নারী।
ভাগ্যক্রমে আভীরও তার বাবার চিরশত্রু ক্যাসিনোর মেয়েকে ভালোবাসে। বন্ধুর ভালোবাসার জীবন রক্ষার দায়িত্ব আজও ইউভান পালন করছে। শুধুই দায়িত্ব!কেবল এটুকু সম্পর্ক ইউভান আর পিহুর মাঝে।এরপর বাস্তবে ফিরে এসে আভীর বলল,
“জানি আমি সবকিছু। তুই আনায়ার খেয়াল রাখিস। আর আরভিকেও দেখিস! সব দায়িত্ব তোরই।”
বলেই ফোন কেটে দেয় সে। ইউভান তপ্ত শ্বাস ফেলে কারণ বন্ধুর এরুপ আচরণে সে অভ্যস্ত। ইউভান এবার দ্রুত আনায়ার নিকট এসে বসে। আলতো হাতে তার মাথা সামান্য উঁচু করে দেখল বহুবছর পুরোনো ক্ষতের দাগ এখনো স্পষ্ট। সেই স্থানে কয়েক চুমু খেয়ে মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“তুই কী আমায় ভুলে যাবি সানশাইন?”
এই মুহূর্তে ইউভানের বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। সে দুহাত দিয়ে আনায়ার মুখ আঁকড়ে ধরে অস্থির কণ্ঠে বলল,
“নো, নো! কখনোই না। তোর চোখের ভালোবাসা যদি কোনোদিন মুছে যায়, আমি বাঁচব না সুইটি। মরে যাব!”
বলেই সে আনায়াকে বলিষ্ঠ হাতে নিজের প্রশস্ত বুকে টেনে নেয়। আলিঙ্গন এত দৃঢ় যে দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন এক হয়ে গেল। তখনই ইউভানের মুখ থেকে তীব্র কণ্ঠে বের হলো,
“তুই আমায় ভুলে কখনো চলে যেতে চাইলে, আমি তোকে জোর করেও আটকে রাখব। প্রমিস!”
ইউভান থামল। ঠোঁটের কোণে পৈচাশিক হাসি ফুটিয়ে পুনরায় বলল,
“দরকার হলে আমি আমার দ্বিতীয়রূপে তোর সামনে আসব।”
অতীত,
সুইজারল্যান্ড,
গত তিন দিন ধরে আ্যশার মুখে পানি ব্যতীত কিছুই ওঠেনি। ক্যাথরিন তাকে খাবার হিসেবে থমাসের খাওয়া অবশিষ্ট দুর্গন্ধময় খাবার মানুষের হাড়, ছেঁড়া মাংস, নাড়িভুঁড়ি, কিডনি, যকৃত ইত্যাদি দিয়েছে। কিন্তু এসব খাবার আ্যশারের রুচিতে আসেনি বিধাই সে তিন দিন যাবত অনাহারে ভুগছে।এই তিন দিনে ক্যাসিনো তার শরীরে ভাইরাসের দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ করেছে। ফলে আ্যশারের মস্তিষ্কে গভীর প্রভাব দেখা দিচ্ছে; কখনো হাসছে, কখনো কাঁদছে, আবার কখনো রাগে চিৎকারে ফেটে পড়ছে।
ল্যাবরেটরির এক কোণে মেঝেতে ক্ষুধার যন্ত্রণায় আ্যশার শুয়ে আছে। তার শরীরে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট। ঠিক সেই মুহূর্তে রাগী অবিভ্যক্ত ক্যাসিনো প্রবেশ করে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে আ্যশার আতঙ্কে দমবন্ধভাবে উঠে বসে। ক্যাসিনো সরাসরি আ্যশারের নিকট গিয়ে তার গাল চেপে ধরে হিশহিশ করে বলেন,
“কতদিন তুই না খেয়ে থাকতে পারিস আমিও দেখব।”
হাতের চাপে আ্যশারের গালে রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে যায়। গাল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আ্যশার যন্ত্রণায় কেঁদে ওঠে,
“আমায় রোজ মাকে এনে দাও।”
‘রোজ মা’ শব্দটি ক্যাসিনোর কানে পৌঁছাতেই সে উদ্ভ্রান্ত হয়ে আ্যশারের চুলের মুঠি চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গর্জে ওঠে,
“কি বললে? আবার বল!”
ক্যাসিনোর ভয়ঙ্কর আচরণে আ্যশার আতঙ্কে ঠোঁট কাঁপাতে কাঁপাতে পুনরায় বলল,
“রোজ… মা…”
কথা শেষ হবার আগেই ক্যাসিনো আ্যশারের গালে জোরে থাপ্পড় মারে। আঘাতের ফলে আ্যশার ছিটকে দূরে পড়ে এবং তার গালের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে। সঙ্গে সঙ্গে ক্যাসিনো ক্যাথরিনকে ডেকে আদেশ দেয়,
“ক্যাথরিন, আমার চাবুক আনো। আজ থেকে রোজের নাম নিতে ও ভুলে যাবে।”
চাবুকের কথা শুনে আ্যশারের মনে পড়ে এই তিনদিন ক্যাসিনো কিভাবে তাকে মেরেছে কারণ, সে রোজ মায়ের নাম নিয়েছে। ক্যাথরিন চাবুক এনে তার হাতে তুলে দেয়। ক্যাসিনোকে চাবুক হাতে এগিয়ে আসতে দেখে আ্যশার আকুতি করে বলল,
“আ, আমাকে ওটা দিয়ে মেরো না। আমার খুব কষ্ট হয়।”
কিন্তু ক্যাসিনো আ্যশারের আকুতি উপেক্ষা করে চাবুকের তীব্র আঘাত হানে তার শরীরে । মুহূর্তের মধ্যে আ্যশারের চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে, লাল মাংস উন্মুক্ত হয়। আ্যশার আর্তনাদে গলাকাটা মুরগির মতো ছটফটিয়ে চিৎকার করে,
“আর মেরো না! আমি ব্যথা পাচ্ছি। মেরো না!”
তবুও নির্দয় ক্যাসিনো থামার বদলে একের পর এক চাবুকের আঘাত চালিয়ে যায়। আ্যশারের পিঠ, কাঁধ, হাতে, বুকের উপরে চামড়া থেঁতলে রক্ত মেঝেতে পড়ে। ক্যাসিনো এবার লাথি মারে আ্যশারের রক্তাক্ত শরীরে এবং কঠোর কণ্ঠে বলেন,
“এরপর থেকে আমার ‘রোজ’ নাম তোর মুখে শুনলেই এভাবে তিলে তিলে শেষ করব।”
বলেই সে ভারী পদক্ষেপে প্রস্থান করে।ক্যাথরিনও আ্যশারের রক্তাক্ত দেহের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আ্যশার আধো-আধো চোখ মেলে শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। তার প্রতিটি শিরা-উপশিরা বিদীর্ণ হয়ে পড়ছে।তৎক্ষণাৎ ছোট্ট আর্তনাদ তার গলায় ফেটে বেরিয়ে আসে ,
“রোজ মা…আআআ…”
দেহের ক্ষতের সঙ্গে ক্ষুধার তীব্রতায় আ্যশারের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মাত্র আট বছর বয়সেই তাকে এত অতর্কিত যন্ত্রণায় সহ্য করতে হচ্ছে। তখনই সে রুমের এক কোণে মৃত শিশুদের লাশ দেখতে পায়। এই কয়েকদিনে সে নিজের চোখে দেখেছে কিভাবে তার বয়সী শিশুদের থমাসের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভয়ংকর দৃশ্য! আ্যশার টলতে টলতে মৃতদেহের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ে। ক্ষুধার তাড়নায় সে বাধ্য হয়ে দুর্গন্ধময় মাংস গিলে খায়। বমি আসতে চাইলেও আ্যশার তা গিলে ফেলে। অবশেষে পচা দুর্গন্ধযুক্ত মৃতদেহের মাংস খেয়েই আ্যশার তার ক্ষুধা নিবারণ করে।
অপরদিকে,একই সময় আলিসা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এই তিন দিনে সে আ্যশারের কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়েছে, কিন্তু কষ্ট ভোলাতে পারেনি। তখনই ক্যাসিনো উপস্থিত হয়। আলিসাকে মনমরা অবস্থায় দেখে সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে,
“কি ভাবছ রোজ?”
আলিসা চোখের পানি আড়াল করে ঠোঁটের কোণে সামান্য তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলেন,
“তেমন কিছু না। নিজের ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কথা ভাবছি। মানুষ যাহা চায় তাহায় হারিয়ে যায়।”
আলিসার খাঁটি বাংলায় কথা শুনে ক্যাসিনো ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করেন,
“তুমি এত খাঁটি বাংলা কার কাছ থেকে শিখেছো?”
“আমার মায়ের কাছ থেকে। আর মা শিখেছে আমার আসল বাবার কাছ থেকে।”
“তোমার আসল বাবা সম্পর্কে তুমি কিভাবে জানো? তার আগেই তো তোমার মাকে তোমার সৎ বাবা হত্যা করেছিল।”
আলিসা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে জবাব দিল,
“আমার মায়ের ডায়রি থেকে সব জানতে পেরেছি। আমার বাবা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ছিলেন।”
বাংলাদেশের নাম শুনে ক্যাসিনো চোখে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“তার নাম কী ছিল?”
“প্রফেসর জাভেদ হায়দার।”
নামটি ক্যাসিনোর কাছে পরিচিত লাগে না।কিছুক্ষণ নীরবতা ভেঙে আলিসা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কিন্তু বললেন না, আপনার পরিবার কোথায় থাকে?”
ক্যাসিনো নির্মমভাবে হেসে তার লাল চুল ব্ল্যাক ব্রাশ দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দেয় এবং বলে,
“আমার জন্ম রাশিয়ায়। বাবা-মাও রাশিয়ান। বাবা অবশ্য ছোটবেলায় মারা গেছে।”
আলিসা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে,
“তাহলে আপনি আপনার মায়ের সঙ্গে কেন থাকেন না? আর আপনি এত নিখুঁতভাবে বাংলায় কিভাবে কথা বলেন?”
আলিসার প্রশ্নে ক্যাসিনো রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে, ইচ্ছাকৃতভাবে প্রসঙ্গ এড়িয়ে উত্তর দেয়,
“অন্যদিন সব বলব। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি ঠিক আছো তো, রোজ?”
আলিসা বুঝতে পারে ক্যাসিনো কিছু লুকাচ্ছে। প্রসঙ্গ না বাড়িয়ে সে অন্যদিকে ঘুরে উদাস স্বরে বলে,
“না! আ্যশারের কথা খুব মনে পড়ছে। আমি একা থাকতে চাই।”
পুনরায় আ্যশারের নাম শুনে ক্যাসিনো রাগে ফেটে পড়ে।সে কোনো কথা না বলে আলিসার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। রাগের আগুন জ্বলছে ক্যাসিনো চোখে।ঠোঁটে কুৎসিত হাসি নিয়ে সে উচ্চারণ করল,
“আ্যশারের প্রতি তোমার এই ভালোবাসার জন্যই আমি তাকে তিলে তিলে মেরে ফেলব রোজ। আর তুমি জানতেও পারবে না।”
সূর্যের অতি তীব্র রশ্মি জানালা ভেদ করে আনায়ার চোখের পাতায় আছড়ে পড়তেই তার চোখটা সামান্য কেঁপে ওঠে। আধো আধো চোখ খুলে সে অনুভব করে মাথার পেছনে হালকা ব্যথা টনটন করছে।সে চারদিক চোখ বুলিয়ে মুহূর্তেই হকচকিয়ে উঠে বসে পড়ে।এটাতো তারই রুম কিন্তু সে কীভাবে বাসায় এলো?তখনই আনায়ার দৃষ্টি আটকায় সামনে কাউচে বসা ব্যক্তিটির উপর যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার উপরেই নিবদ্ধ।আনায়া ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস স্বরে ডেকে ওঠে,
“ইউভান ভাই…!”
মুহূর্তেই ইউভানের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলে যায়। ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে আনায়ার সামনে বসে সে জিজ্ঞাসা করল,
“আর ইউ ওকে সুইটি?”
“আই’ম ওকে। কিন্তু আমরা বাসায় ফিরলাম কখন?”
“কেন? আমরা কি কোথাও গিয়েছিলাম?”
এমন উত্তর শুনে আনায়ার মাথায় বাজ পড়ে।অতঃপর সে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“কী? আপনি না আমাকে গতরাতে সেই প্রাসাদে নিয়ে গেলেন।”
“আচ্ছা তারপর?”
“তারপর আমাকে অনেক উপহার দিলেন,ডান্স করলেন আর বৃষ্টি পড়ার কারণে আমরা বাসায় ফিরতে পারিনি।”
“তারপর?”
ইউভানের এমন আজব প্রশ্নে আনায়া তেঁতে উঠে বিরক্ত মুখে বলল,
“কী সব তারপর তারপর লাগিয়েছেন?তারপর ঘুমিয়ে পড়িছিলাম।”
ইউভান পুণরায় বাঁকা হাসে কারণ ইনজেকশনটা কাজ দিয়েছে। কিন্তু তাও সে চিন্তিত কারণ আনায়া সব স্মৃতিতে আছে শুধু খুনের ঘটনা ব্যতীত।বিষয়টা খুবই অবিশ্বাসযোগ্য!সেইসময় আনায়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করে,
“বললেন না তো বাসায় কীভাবে এলাম?”
ইউভান চোখ সঙ্কীর্ণ করে কাঁধ নাড়িয়ে নিলিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
“ভোরবেলায় তুই ঘুমিয়ে ছিলি তখন বাসায় এসেছি আমরা।”
আনায়া চোখ-মুখে চিন্তার প্রলেপ নিয়ে ইউভানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“কিন্তু বাসায় কেউ কিছু বলল না? মানে কীভাবে ম্যানেজ করলেন?”
ইউভান একপ্রকার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য উত্তর দেয়,
“এসব জেনে তোর লাভ নাই।এখন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় রাত থেকে এক শার্ট পড়ে আছিস।”
আনায়া এবার পরনের টি-শার্টের দিকে এক পলক তাকায়ে চোখ ঘুরিয়ে ইউভানে চোখে রাখে।তারপর বলল,
“যাক আপনার তাহলে সবকিছু মনে আছে।আমি তো ভেবেছিলাম আপনি সব ভুলে গিয়েছেন।”
ইউভান ধীরস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত পকেটে গুঁজে আলগোছে কাঁধ নাড়িয়ে শুধায়,
“ইউভান কিছু ভোলে না।”
“যদি আমায় কখনো ভুলে যান তখন?”
আনায়ার প্রশ্নে ইউভান তার মুখপানে চেয়ে থেকে অদ্ভুতভাবে হেসে বলল,
“মানুষ কেবল স্মৃতিতে থাকা জিনিসই ভুলে যায়।কিন্তু তুই আমার স্মৃতিতে না বরং হৃদয় আর আত্মা জুড়ে আছিস।তাই তোকে ভুলে থাকা অসম্ভব!”
ইউভানের বাণিতে আনায়া মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেও তার হৃদয়ে উত্তাল ঝড় বইছে।তৎক্ষণ ইউভানের ফোনে কারোর কল আসায় সে বলল,
“বাই দ্যা ওয়ে আই হেভ টু গো।”
আনায়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। মুহূর্তে ইউভান তড়িঘড়ি করে রুম থেকে প্রস্থান করে।অনেক বেলা হাওয়ায় আনায়াও চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলে ওয়াশরুমে শাওয়ার নিতে যায়। কিছুক্ষণপর সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে তার রুমে তানহা এসেছে।তানহার অপ্রত্যাশিত উপস্থিতিতে আনায়া খানিকটা অবাক হয়।তখনই তানহা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কন্ঠে বিদ্বেষ মিশিয়ে বলল,
“বাহ! সারা রাত ফুর্তি করে এসে এখন আবার শাওয়ার নিলি?”
এমন অপ্রাসঙ্গিক ইঙ্গিতে আনায়া ভেতরটা রাগ ও ঘৃণায় ভরে ওঠে।অতঃপর দম আটকানো ক্রোধে সে গলা উঁচু করে বলল,
“মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ! কাকে কী বলছো তুমি?”
তানহা তার ঘৃণিত দৃষ্টি সোজা আনায়ার চোখে গেঁথে দিয়ে গর্জে উঠল,
“সারা রাত ইউভানের সাথে তুই কোথায় ছিলি?”
কিন্তু আনায়ার তানহার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে ঠোঁটের কোণে কড়া বাঁক এনে বলল,
“আমি কৈফিয়াত তোমাকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না।”
মুখের ওপর এমন জবাব শুনে তানহার মুখ রাগে আরও বিকৃত হয়ে যায়। মুহূর্তই সে সজোরে হাত উঠিয়ে আনায়ার গালে সপাটে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘনটায় আনায়ার হাত আপনা-আপনি গালে চলে আসে।রাগে তার শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। তানহা আরও তীব্র গলায় ঠাস করে বলে উঠল,
“বয়সে তোর বড় হয় তাই মুখ সামলে চলবি।এখন থেকে ইউভানের পাশাপাশি তোকে দেখলে খুব খারাপ হবে। মাইন্ড ইট!”
শব্দগুলো ছুড়ে দিয়ে তানহা হনহনিয়ে ভারী পায়ের শব্দ তুলে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে ক্রোধে আনায়ার রক্তচোক্ষে তানহা যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।তারপর ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে সে।
বিকেলের রোদ গড়িয়ে অন্ধকার নেমেছে তবে চৌধুরী ম্যানশনের চারদিকে আলোকসজ্জার সজ্জিত। ভেতরের ড্রইং রুমে আলোর চাকচিক্য চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।একটু পর সারাহর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। অন্যদিকে রুহিও আজ বেশ ব্যস্ত হাতে সবকিছু সামলাচ্ছে কারণ একটু পরেই সাদনানের পরিবারসহ বাকী মেহমানরা চলে আসবে।তবে এতো আয়োজনের ভীরে আনায়া অনুপস্থিত।সকাল থেকে সে নিজের রুমে বসে আছে, একবারও বাইরে আসেনি। রুহি একাধিকবার গিয়েছে আনায়ার কাছে, অনেক ডেকেছে, কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি। এবার আবার রুহি আনায়ার ঘরের সামনে এসে বিরক্তির স্বরে চিৎকার করে উঠল,
“আলু, এবার বেশি হয়ে যাচ্ছে! প্লিজ রেডি হয়ে নিচে আয়। নাহলে সারাহ রাগ করবে।”
কিন্তু ভেতর থেকে কোনো উত্তর না আসায় রুহির বিরক্তি এবার আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সে আবার দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলল,
“আমি লাস্ট বলছি আনায়া। তুই কি বের হবি, না হবি না? সেটাই বল।”
কোনো সাড়া নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে করিডর দিয়ে হেঁটে আসে ইউভান। রুহিকে অস্থিরভাবে দরজা ধাক্কাতে দেখে সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল,
“কী সমস্যা? এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছ কেন?”
রুহি চোখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“দেখুন না ভাইয়া, আনায়া সকাল থেকে ভেতরে বসে আছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে না, আর কিছু খেয়েছে তাও না।”
ইউভান ভ্রু কুঁচকে ভাবে হঠাৎ কী হলো মেয়েটার।সে রুহিকে শান্ত করে বলল,
“তুই যা দেখছ, আমি ওটাই দেখছি।”
রুহি মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। এরপর ইউভান দরজার কাছে গিয়ে শক্তভাবে নাড়িয়ে, নরম স্বরে ডেকে বলল,
“সুইটি, দরজা খুল।”
আবারও কোনো সাড়া নেই। ইউভান তবুও ধৈর্য ধারণ করে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“কি হয়েছে তোর? দরজা খুল।”
প্রতিউত্তর না আসায় ইউভান অন্তিমবারের মতো হুমকিস্বরুপ উচ্চারণ করে,
“লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি। দরজা খুল নাহলে আমি ভেঙে ফেলব।”
ইউভান উপলব্ধি করে যে, আনায়া তার কথা শুনবে না তার। তাই অবশেষে অধৈর্য হয়ে সে সত্যিই দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করল।চারপাশ অন্ধকার তার মাঝেই ইউভান ডাকলো,
“আনু, তুই কোথায়?”
সারা শব্দ না আসায়, ইউভান দ্রুত সুইচ টিপে রুমের আলো জ্বালিয়ে দেখে আনায়া হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে মেঝেতে বসে আছে। সঙ্গে সঙ্গে তার বুক কেমন ধকধক করতে শুরু করে। সে তড়িঘড়ি আনায়ার কাছে গিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করে,
“সুইটি, কী হয়েছে তোর? অন্ধকারে এভাবে কেন বসে আছিস?”
আনায়া প্রতিউত্তর তো দূর মাথা পর্যন্ত তুলে তাকায় না। তার নিস্তব্ধতায় ইউভান আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উচ্চারণ করে,
“আনসার মি, আনু। আমাকে রাগাস না।”
অবশেষে, আনায়া ধীরে ধীরে মুখ তুলে ইউভানের দিকে রক্তাভ চোখে তাকায়।তখনই ইউভানের দৃষ্টি আটকায় আনায়ার গালের পাশে লালচে আঙুলের ছাপের উপর। মুহূর্তেই তার চোখ বিস্ফোরিত হয়, যেন কেউ তার বুকের ভেতর ছুরি গেঁথে দিয়েছে ।আলতো হাত দিয়ে সে আনায়ার গাল স্পর্শ করে বলল,
“কে তোকে মারেছে?”
আনায়া ছলছল নয়নে তাকিয়ে আচমকা ইউভানকে জড়িয়ে ধরে গুমরে ওঠে। ইউভান চোখ বুঁজে নিজেকে সংযত করে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে বলল,
“হুশশ, কাঁদবি না।আমার বুকে লাগে।”
অবশেষে আনায়া মুখ খুলল,
“জানতে চাইবেন না কে সে?”
ইউভান আলতোভাবে তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আমি খুঁজে বের করে নিব।”
আনায়া নিঃশব্দে পুনরায় ইউভানের বুকে মুখ লুকায়। কিছুক্ষণ নীরবতা। তখন সেখানে আয়ান, হাতে ভরা শাড়ি-গয়না নিয়ে প্রবেশ করে। আনায়া লজ্জায় দ্রুত ইউভানকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আয়ান বাঁকা চোখে ইউভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সরি ভাই, রং টাইমে এসেছি।”
ইউভান রাগান্বিত হয়ে তাকাতেই আয়ান তখন একপ্রকার দৌড়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। এরপর সে আনায়ার দিকে ঘুরে বলল,
“তাড়াতাড়ি এগুলো পড়ে রেডি হয়ে নিচে আয়। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।”
“মন ভালো নেই আমার। আর আমি শাড়ি পড়তে পারি না। তাই আপনি চলে যান।”
আনায়ার এমন উত্তরে ইউভান কপালে ভাঁজ ফেলে ঠোঁট সামান্য বাঁকা করে বলল,
“তুই কি ইনডিরেক্টলি বলতে চাইছিস,যে আমি যেন তোকে শাড়ি পরাই?”
আনায়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আজব! আমি সেটা কখন বললাম?”
তখন ইউভান নিঃশব্দে বসন্ত রঙের শাড়ি এনে তার হাতে ধরিয়ে, ধীর কন্ঠে বলল,
“ওয়াশরুম থেকে কোনোমতে শাড়িটা পেঁচিয়ে আয়।”
আনায়া একবার শাড়ির দিকে আরেকবার ইউভানের চোখের দিকে তাকায়। সামান্য বিভ্রান্ত হয়ে সে বলতে চাইল,
“কিন্তু…”
এর পূর্বেই ইউভান তার ঠোঁটে হাত রেখে দৃঢ় গলায় বলল,
“হুশ! কোনো কিন্তু নেই। যা বলছি তাই কর।”
বেচারা আনায়ার নিরুপায় হয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। ইউভান বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণ পরে আনায়া ব্লাউজ ও পেটিকোটে শাড়ি পেচিয়ে বেরিয়ে আসে। তার অদ্ভুত অবস্থায় ইউভানের মুখে চাপা হাসি ফুটে উঠে। আনায়া খানিকটা বিরক্ত ভঙ্গিতে সামনে এসে বলল,
“এবার কী করবেন শুনি?”
ইউভান মাথা ঝুঁকিয়ে ধরা গলায় বলল,
“তোকে নিজের হাতে নিজের মতো করে সাজিয়ে দিব।”
এই অপ্রত্যাশিত কথায় আনায়ার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়।এবার ইউভান তার শাড়ির আঁচল ধরে কাঁধে নিখুঁতভাবে উঠিয়ে দেয়।এরপর শাড়ির কুঁচিটা গুছিয়ে দিয়ে আনায়ার হাতে দিয়ে বলল,
“নে ধর।”
আনায়া হা হয়ে তাকিয়ে আছে।ইউভান তার এহেন প্রতিক্রিয়া দেখে কৌতুকভরে বলল,
“এটাও কি আমি করে দেব?”
আনায়া হকচকিয়ে উঠে ইউভানের হাত থেকে কুঁচির ভাঁজ নিয়ে বলল,
“না, না! আমিই করছি।”
সে তাড়াহুড়ো করে কুঁচিটা সুন্দরভাবে গুঁজে নেয়। ইউভান এবার তার শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নিচে মেলে ধরে পিন মেরে দিল। ইউভানের এমন নিখুঁতভাবে শাড়ি পড়ানো দেখে আনায়া বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“আপনি শাড়ি পরানো শিখলেন কোথায়?”
ইউভান নিঃসংকচে বলল,
“তুই যতক্ষণ ওয়াশরুমে ছিলি, ততক্ষণ আমি ফোনে ইউটিউবে দেখে নিয়েছি।”
কথা শেষে সে আনায়াকে আয়নার সামনে বসায়।তারপর, নিজেও হাঁটু গেড়ে বসে আলতা নিয়ে আনায়ার উন্মুক্ত ফর্সা পায়ে রাঙিয়ে দেয়। আনায়া কেবল মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে আছে। আলতা দেওয়া শেষে ইউভান তার চোখে সামান্য কাজল এবং ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দিল। আনায়া আলতো হাসি দিয়ে বলল,
“আপনি সাজিয়েও দিতে পারেন?বাহ অলরাউন্ডার!”
ইউভান বেলি ও গোলাপ ফুলের কানের দুল পড়িয়ে দিতে দিতে শুধালো,
“জাস্ট ফর ইউ, সুইটি।”
আনায়া লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। সবশেষে ইউভান তার চুলগুলি পরিপাটিভাবে সাজিয়ে দুইটি গোলাপ গেঁথে দেয়। দীর্ঘ সময় নিয়ে সাজানো শেষে ইউভান আয়নার দিকে ঘুরিয়ে আনায়াকে দাড় করিয়ে বলল,
“দেখ কেমন হয়েছে?”
আনায়া আয়নায় নিজেকে দেখে বিস্মিত হয়। বসন্তি রঙের শাড়ি তার সাথে অপূর্ব মানিয়েছে। কালো চুলে গুঁজে রাখা গোলাপ এবং কানে দুলের ছোঁয়া কী মোহনীয় লাগছে। সে ইউভানের দিকে ফিরে বলল,
“আপনি বরং বলুন, কেমন লাগছে আমাকে?”
ইউভান মৃদু হাসি দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
“সদ্য ফোটা ফুলের মতো লাগছে।”
আনায়া লজ্জায় আধখানা হয়ে হাসে। ইউভান তার রক্তিম মুখশ্রীর দিকে চেয়ে বলল,
“যাই হোক, আমি নিচে যাচ্ছি। তুই দ্রুত আয়।”
আনায়া মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। ইউভান ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে রুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে, তারপর নিচে নেমে আসে। সাদনানের পরিবারসহ বাকি অতিথিরা উপস্থিত। স্টেজের মাঝ বরাবর সারাহ বসে আছে, পরনে ভারী হলুদ লেহেঙ্গা, শরীরজুড়ে অসংখ্য কাঁচা ফুলের গহনা মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে । ইউভানের দৃষ্টি পড়ল সারাহর পাশে হুইলচেয়ারে বসা তার মা নুরজাহান বেগমের দিকে।
ঠিক তখন তনহা আচমকা কোথা থেকে এসে ইউভানের সামনে উপস্থিত হয় একগাল হাসি নিয়ে। তনহাকে দেখে মুহূর্তেই ইউভানের চোখে বিরক্তি ফুটে উঠে। তখনই তনহা লাজুক হাসি দিয়ে বলল,
আত্মার অন্তরালে পর্ব ২৩ (২)
“ইউভান, দেখুন তো আজ আমাকে কেমন লাগছে?”
ইউভান বাঁকা হেসে, উপরে থেকে নিচ পর্যন্ত একবার পরখ করে। তারপর কণ্ঠে হালকা বিদ্রূপ ছুঁয়ে বলল,
“বিষাক্ত কালনাগিনির মতো লাগছে।”
মুহূর্তেই তনহার মুখ কালচে হয়ে অন্ধকারে আবৃত হয়ে যায়। তার কিছু বলার পূর্বেই ইউভান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সেখান থেকে চলে যায়। ইউভানের করা অপমানে তানহার রাগে ফোঁস ছাড়ে।