আত্মার আগলে পর্ব ১৫

আত্মার আগলে পর্ব ১৫
সানজিদা আক্তার মুন্নী

মেহনূর এহসানের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কান্নার শব্দ থামানোর কোনো চেষ্টা নেই, গলা কাঁপছে, কেবল একটাই কথা উচ্চারণ করছে—
—”দয়া করে, একটা বার আমায় দাদাজানকে দেখতে দিন! একটা বার আমায় দাদাজানকে দেখতে দিন! প্রয়োজনে আপনি নিয়ে যাবেন, আবার ফিরিয়ে আনবেন, তাও দয়া করে নিয়ে যান!”
কিন্তু এহসান যেন আগুন হয়ে আছে। তার চোখে প্রচণ্ড ক্রোধ, চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। ঠান্ডা অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে
—”চুপ! আর একটা শব্দও মুখ থেকে বের করবি না, বেয়াদব নারী! চুপচাপ বসে থাক!”
মেহনূর নিঃশ্বাস আটকে আসে, চোখ দুটো পানিতে ভরে যায় আরও বেশি। কী এমন ঘটল যে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল? একটু পিছনে ফিরলেই পাওয়া যাবে সেই উত্তর…

সকালের ঘটনা
বাড়ির সবাই ফজরের নামাজ আদায় করে একসঙ্গে নাস্তার টেবিলে বসেছে। মেহনূর এহসানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, নিঃশব্দে পরিবেশন করছিল নাস্তা।
ঠিক তখনই তাজিম সাহেব পাগলের মতো ছুটে বাড়িতে প্রবেশ করেন। শ্বাস ঘন, চোখে আতঙ্ক। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠেন—
—”দয়া করে, মেহনূরকে নিয়ে আয়, এহসান! আব্বা কাল রাত থেকে খুব বেশি অসুস্থ। ওকেই শুধু দেখতে চাইছে! একবার, মাত্র একবার নিয়ে আয়!”
এহসানের মুখ কালো হয়ে ওঠে, চোখের কোণে তীব্র বিদ্বেষ। ঠান্ডা অথচ বিষাক্ত কণ্ঠে বলে—
—”তোদের মতো কুকুরদের এই বাড়িতে ঢোকার সাহস দিল কে? তোরা যখন ইচ্ছে, তখন চলে আসিস?”
মনিরুল সাহেব কঠিন গলায় বলেন, ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—এহসান, এসব বলার সময় নয়। তুমি মেহনূরকে নিয়ে যাও।”
তাজিম সাহেব আকুল স্বরে আবার অনুনয় করেন,
—- “হ্যাঁ, হ্যাঁ! তুই দয়া করে একবার নিয়ে আয়!”
এহসান ধীর পদক্ষেপে তাজিম সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ায়, চোখের দৃষ্টি হিমশীতল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে উচ্চারণ করে—
—”আমি, এহসান, কাউকে দয়া করি না। চুপচাপ বেরিয়ে যা, নয়তো কুকুরের মতো মেরে বের করে দেব!”
তাজিম সাহেব হতবিহ্বল হয়ে মেহনূরের দিকে তাকান। তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার ভাতিজি কাঁদছে, ঠোঁট চেপে রেখেছে চোখের জল সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
এহসান আবার গর্জে ওঠে—
—”তাজিম তালুকদার! বেরিয়ে যা এখান থেকে!”
তাজিম সাহেব কিছু না বলে ফিরে যান, পদক্ষেপগুলো ভারী হয়ে আসে।
এহসান পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে, মেহনূর ফুপিয়ে কাঁদছে। কোনো দিক না দেখে, না কিছু শুনে সে তার হাত ধরে টেনে নিজে কক্ষে নিয়ে আসে তাও সবার সামনে ।

কক্ষে আসার সঙ্গে সঙ্গে মেহনূর ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। বুকের ভেতর একটা চেপে রাখা যন্ত্রণা যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল।
—”দয়া করে একটা বার আমায় দাদাজানকে দেখতে দিন! একটা বার! প্রয়োজনে আপনি সঙ্গে থাকবেন, নিয়ে যাবেন, ফিরিয়ে আনবেন… তাও দয়া করে যেতে দিন!”
শ্বাস কাঁপছে, গলা বুজে আসছে, চোখের জল থামার কোনো নাম নেই।
কিন্তু এহসানের মুখে একটুও করুণা নেই। চোখের দৃষ্টি কঠিন, ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ এক বিদ্রুপের রেখা। সে রূঢ় কণ্ঠে বলে—

—”চুপ! একদম চুপ! আর একটা শব্দও মুখ থেকে বের করবি না, বেয়াদব নারী! চুপচাপ বসে থাক!” ঐ নোংরা দের নামও নিবি না আমার সামনে
কথাগুলো যেন বজ্রাঘাত হয়ে নেমে আসে মেহনূরের ওপর।
কিন্তু আজ মেহনূর আর আগের মতো নিশ্চুপ থাকল না।
তার রক্তে যেন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়, দু’চোখে বিস্ফোরণ, হৃদয়ে দাবানল।
বাঘীনির ন্যায় এক তীব্র বিক্রমে এহসানের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে ফেলে!
চোখের লালসিটে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ফুঁসে ওঠে—
—”আপনি নিজেই একটা নোংরা! আর আমার বাবা, আমার চাচাকে নোংরা বলছেন? লজ্জা থাকা উচিত আপনার! লজ্জা! নিজের আপন চাচাতো ভাইয়ের আপন মেয়েকে বিয়ে করতে লজ্জা লাগেনি?”
এহসানের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
কিন্তু সে একটুও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল না।
বরং তার গাঢ়, শীতল দৃষ্টি মেহনূরের মুখের দিকে স্থির হয়ে থাকল।এক দীর্ঘ মুহূর্ত পার হয়ে গেল।
তারপর ঠান্ডা অথচ তীব্র কণ্ঠে বলে উঠে বলে

—তুই আমার বউ, ভাতিজি নস। আর তোর দাদা? সে আমার আব্বার আপন ভাই নয়।”
মেহনূর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
—”কি…কি বলছেন আপনি?”
—”তোর দাদা আমার আব্বার চাচাতো ভাই মাত্র। তার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আমার দাদা তাকে বড় করেছেন। তাই তোকে এতদিন এই পরিবারের অংশ মনে করা হয়েছে। কিন্তু রক্তের সম্পর্কে তুই আমাদের কেউ নস!”
মেহনূর আরও এক ধাপ পেছনে সরে যায়।
—”না… না! এটা সত্যি না! এটা মিথ্যে!”
এহসান ঠোঁটের কোণে এক তাচ্ছিল্যের হাসি এঁকে বলে—
—”তুই তো একবার আয়নায় গিয়ে নিজেকে দেখিসনি, তাই না? একবার আয়নায় গিয়ে দেখ। তোর কি মনে হয়, তুই আমাদের মতো? পাগলের বাচ্চা, তুই শুধু এই বংশেরই নয়, এই দেশেরই নস তুই!”
মেহনূর যেন গলায় কিছু আটকে গেছে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর হাসতে হাসতে বলে
—”পাগল হয়ে গেছেন আপনি! এসব বলছেন? পাপে পাগল হয়ে গেছেন! এসব সব মিথ্যে! মিথ্যে!”
এহসানের ধৈর্য যেন ভেঙে পড়ে।

সে দ্রুত বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের ফোনটা তুলে নেয়।
—”আমি তোর জন্য প্রমাণ এনেছি, মেহনূর!”
সে ফোনের স্ক্রিনে কিছু খুঁজতে থাকে, কয়েক মুহূর্ত পর এক ছবি বের করে মেহনূরের সামনে তুলে ধরে।
মেহনূর প্রথমে তাকাতে চায় না।
কিন্তু চোখ গিয়ে পড়ে ফোনের স্ক্রিনে, আর তাতেই সে হতভম্ব হয়ে যায়।
তার শরীর যেন শূন্য হয়ে যায়, পা কাঁপতে থাকে।
সে তাকিয়ে আছে ছবির দিকে, তারপর তাকাচ্ছে এহসানের দিকে।
—”এ…এ কে?”
ফোনের স্ক্রিনে হাসপাতালের একটি ছবি।
শুয়ে আছেন এক মহিলা।
একদম… মেহনূরের মতো”! নাহ, শুধু ‘মতো’ না। একদম সে-ই! শুধু বয়স বেশি!
মেহনূর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনের দিকে ইঙ্গিত করে ফিসফিস করে বলে—
—”এ কে? এ আমি? আমি কি?”
মেহনূর অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে এহসানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কণ্ঠ যেন জমে গেছে, শব্দগুলো বের হচ্ছে না।
এহসান গভীর শ্বাস নিয়ে বলল,

— “উনি তোর আম্মু। তোর আপন জন্মদাত্রী জননী। শুধু তোর নয়, তোর বড় ভাই মেহরাজেরও। তোরা দুজন আমাদের থেকে আলাদা। তুই লক্ষ্য করিসনি? তুই আর মেহরাজ একরকম! তোদের চলন একরকম! আর মেহরুব… ও একেবারেই আলাদা! তুই বুঝতে পারিসনি? তোরা এই বংশের কেউ নস! তোরা তো মূলত বাঙালিও নস!”
মেহনূর যেন পাথর হয়ে গেছে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এহসানের প্রতিটা কথাই মিলে যাচ্ছে… কিন্তু কেন? তাহলে কে সে? কীভাবে এসেছে? কেন এসেছে?
ও চমকে উঠে এহসানের চোখে চোখ রাখল। গলা কাঁপছিল, তবু ফিসফিস করে বলল,
— “তাহলে আমরা এখানে কীভাবে এলাম? নিশ্চয়ই সব মিথ্যে, তাই না?”
এহসান ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গভীর স্বরে বলল,
— “এক খোদার কসম! আমি একটা অক্ষরও মিথ্যে বলিনি। তোর মা একজন পাকিস্তানি। আর তোর মা আর মেহরুবের মা দূর সম্পর্কের খালাতো বোন ছিলেন। মেহরুবের মায়ের এক খালার বিয়ে হয় পাকিস্তানে। সেই খালাই ছিল তোর নানী, আর তার মেয়ে— সে-ই তোর আর মেহরাজের মা।”
মেহনূরের শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
এহসান বলতে লাগল,

— “২০০৭ সালে, যখন তোর বয়স মাত্র দুই বছর, তখন তোর মা-বাবা তোদের তিনজনকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তোদের আরও এক বড় ভাই ছিল…! একদিন বেড়াতে এসেছিলেন তোর মা আমাদের বাড়িতে । যেহেতু তোর মায়ের আপনজন বলতে এই দেশে কেবল মেহরুবের মাই ছিলেন, তাই উনি এসে দেখা করেছিলেন। তখন থেকেই তোদের চিনি আমরা ‘! আর সেসময় তো আমরা এক পরিবারি ছিলাম “!
মেহনূরের চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে এসব শুনে “!
মেহনূর স্থির হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত ভুলে গেছে। মনে হচ্ছে, ওর চারপাশের সবকিছু থমকে গেছে—শুধু এহসানের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওর মনের গভীরে।
এহসান বলে যাচ্ছিল,

— “সেদিন, যেদিন তোদের পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, সেদিন এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথেই তোদের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়। তোদের বাবা আর বড় ভাই সামনের সিটে বসা ছিল, তাই ধাক্কাটা সবচেয়ে বেশি লাগে ওদের ওপর। ঘটনাস্থলেই ওরা দুজন মারা যায়। কিন্তু তোরা—তুই, মেহরাজ আর তোদের মা—পিছনের সিটে ছিলি, তাই তোরা বেঁচে যাস। তবে তোদের মা… উনি তখনই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। উনি বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেন, উন্মাদ হয়ে যান। এতদিন পাবনার হাসপাতালে ছিলেন। কিন্তু এক বছর আগে উনি পালানোর চেষ্টা করেন, আর তখনই আরেকটা এক্সিডেন্ট ঘটে। সেই এক্সিডেন্টের পর থেকে উনি কোমায় আছেন… সিলেটের এক হাসপাতালে।”
মেহনূরের গলা শুকিয়ে গেছে। একটা শব্দও বের হচ্ছে না।
এহসান আবার বলতে থাকে,

— “গাড়ি দুর্ঘটনার পর মাজহারুল ভাই আর উনার স্ত্রী তোদের আপন করে নেন। মা-বাবার মতো আগলে রাখেন। তোদের তালুকদার বংশের পরিচয়ও ধরে রাখা হয়, তালুকদার নামেই তোদের বড় করা হয়। কিন্তু তোর আসল নাম নূর… আমরা তা বদলে দিয়েছি মাহজাবিন মেহনূর করে।”
মেহনূরের দেহটা যেন অবশ হয়ে গেল। ওর চারপাশ কেমন ঝাপসা লাগছে। বুকের ভেতর একটা ফাঁকা শূন্যতা… যেন কেউ একটা ধাক্কা দিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।
তাহলে এতদিন যা বিশ্বাস করে এসেছে, তা সব মিথ্যা? তাহলে কি সব সম্পর্কও মিথ্যা?
মেহনূর অসহায় চোখে এহসানের দিকে তাকাল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— “তাহলে কি সব মিথ্যা? সব সম্পর্কই মিথ্যা?”
এ বলেই ডুকরে কেঁদে উঠল মেহনূর।
ওর কান্না এহসানের বুকের ভেতর একটা অদৃশ্য শেলের মতো বিদ্ধ করল। গভীর চোখে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে এহসান শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “সব মিথ্যা। সব সম্পর্কই মিথ্যা। তবে এই এত মিথ্যের মধ্যে একটা সত্যি আছে—একটাই সত্য! আর তা হলো, তোর প্রতি আমার ভালোবাসা!”
মেহনূর আরও জোরে কেঁদে উঠল। আর সহ্য করতে পারল না এহসান। এগিয়ে গিয়ে ওকে শক্ত করে নিজের বুকে টেনে নিল। একহাতে মেহনূরের মাথাটা আগলে রাখল, আরেক হাতে ওর পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— “ভালোবাসি, আমি ভীষণ ভালোবাসি! সব মিথ্যার মাঝে এটাই একমাত্র সত্য, যে আমি তোমায় ভালোবাসি!”
মেহনূর কাঁদতে কাঁদতে ওকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কেঁপে কেঁপে বলল,
— “ছুঁবেন না আমায়! মিথ্যে বলেছেন আপনি! ঘৃণা করি আমি আপনাকে! ঘৃণা করি! মিথ্যে বলেছেন!”
এহসান একটুও ছাড়ল না, বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— “আমি জানি, তোর অন্তর আঁতকে উঠছে। কিন্তু এটাই চিরসত্য—তুই আমার ভাতিজি নস না। না রক্তের, না বংশের!”
কিছু মুহুর্ত পর

মেহনূর ঘরের এককোণে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে, অন্তরটা জ্বলছে—একটা দগদগে আগুন পুড়িয়ে দিচ্ছে তাকে।
সারাজীবন যাদের আপন ভেবেছে, আজ প্রমাণ হলো, তারা কেউ তার আপন নয়! তাহলে কি তার অস্তিত্বই মিথ্যা? নিশ্চয়ই মিথ্যা! সে তো এই দেশেরই না! তাহলে তার অস্তিত্ব মিথ্যা হবে না কেন? নিশ্চয়ই মিথ্যা! সব মিথ্যা!
তার ভাইজান… বড় ভাইজান জানে এসব? হয়তো জানে! কারণ তখন তার বয়স ছিল দুই বছর, আর বড় ভাইয়ের পাঁচ বছর। হয়তো ও মনে রেখেছে, হয়তো মনে রাখেনি!
এদিকে এহসান মেহনূরকে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, বাগানে এক ক্লায়েন্ট এসেছে—তাদের কোম্পানির কিছু বড় বড় কন্ট্রাক্ট সই করাতে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে।
এহসান এতক্ষণ ধরে ধৈর্য ধরে ক্লায়েন্টকে সব বুঝিয়েছে। প্রথমে লোকটা আগ্রহ দেখালেও, শেষে এসে ‘না’ বলে দিল! এহসানের চোখে সন্দেহের ছায়া নেমে এলো। পাশে থাকা এনামের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে বলে উঠল,

— “এক মিনিট! আমি এর চেয়ে উত্তম প্রজেক্ট রেখেছি। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি, দাঁড়ান!”
ক্লায়েন্ট খুশি হয়ে মাথা নাড়ল,
— “ঠিক আছে, নিয়ে আসুন!”
এহসান চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের চাদরটা ঠিক করে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
ঘরে ঢুকেই সোজা কাপড় রাখার কক্ষে গিয়ে দরজা টাশ করে আটকে দিল!
মেহনূর ধ্যানমগ্ন ছিল, দরজার শব্দে চমকে তাকাল। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়েই ওর শরীরটা কেমন অবশ হয়ে গেল!
কারণ, দরজা খুলে এহসান যখন বেরিয়ে এলো, ওর এক হাতে একটা বিশাল স্নাইপার রাইফেল, আর অন্য হাতে গান রাখার স্ট্যান্ড!
মেহনূর থমকে গেল!
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।

— “এটা দিয়ে কাকে মারতে যাচ্ছে?”
এহসান সোজা বেলকনিতে চলে আসে। স্ট্যান্ডটা রেলিংয়ের সাথে চুম্বকের মতো আটকে নেয়। তারপর সাবধানে স্নাইপার রাইফেল সেট করে নেয়।
বেলকনির পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিশানা ঠিক করে।
টার্গেট সোজা ক্লায়েন্টের মাথা!
মেহনূর ধীরে ধীরে, শ্বাস আটকে এহসানের পেছনে আসে। বেলকনিতে এসে থমকে দাঁড়ায়।
রাইফেল সেট হয়ে গেছে, এহসান ট্রিগারের উপর আঙুল রাখতেই মেহনূর কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলে,
— “কা… কাকে মারবেন? মারবেন না!”
এহসান মুহূর্তের জন্য ওর দিকে একবার তাকাল। তারপর কপাল কুঁচকে কঠোর স্বরে বলল,
— “চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক! এটা তোর বেয়াদ্দবি করার সময় নয়, বেয়াদ্দব নারী!”
বলেই আবার নিশানায় চোখ রাখল।
তারপর…এক কিংবদন্তি হেড শট নিল! বসে থাকা লোকটির এক শটেই মাথার খুলি উড়ে গেল এতে!
তার রক্ত ছিটকে গিয়ে উপস্থিত সবার গায়ে পড়ল!

এহসান ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে। নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে এনামকে কল দেয়।
এনাম নিজের মুখে থাকা রক্ত মুছে ক্ষিপ্ত স্বরে ফোন ধরে এহসান কে বলে
— মারলি কেন সমস্যা কি?
এহসান ধীর স্বরে বলল,
— “ওর শার্টের সামনের পকেটের কলম ভালো করে দেখো। শালা কুত্তার বাচ্চা আমাদের প্রজেক্টের আইডিয়া রেকর্ড করে অন্য কাউকে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিল!”**
এ বলেই ফোন কেটে দেয় এহসান !
মেহনূর ধীর পায়ে বেলকনির কিনারে এগিয়ে এল, নিচে কী হয়েছে দেখতে চাইলো!
তখনি এহসান ওর হাত চেপে ধরে দাঁত চেপে বলে
— “কিছু দেখা লাগবে না! চুপচাপ আগের মতো কক্ষে চলে যা!”
মেহনূর রাগে ওর হাত ঝাঁকিয়ে সরিয়ে নিল। তারপর চোখের আগুন নিয়ে বলল…
—— “পাপী হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন না আমায়! ঘেন্না লাগে, ঘেন্না! কীভাবে মারতে পারলেন? একটা ক্ষুদ্র কারণের জন্য একটা মানুষকে?”

মেহনূরের কথায় যেন আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু এহসান! সে স্থির। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মুখে, বরং পরম মমতায় সে মেহনূরের হাত ধরে এক ঝটকায় টেনে নেয় নিজের বুকের কাছে। দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে ওর কোমর, যেন এতটুকু দূরে সরতে না পারে।
— “তুই আমায় ঘেন্না করবি নাকি ভালোবাসবি, সেটা তোর ব্যাপার। এতে আমার কিছু যায় আসে না! আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু দুকআ একদম সহ্য করতে পারি না, তাই উড়িয়ে দিয়েছি ওরে!”
এহসান মেহনূরের কোমর একটু বেশি জোরেই চেপে ধরেছে, তাই মেহনূর দাঁত চেপে এহসানের দুই হাত খামচে ধরে বলে—

— “আমার কষ্ট হচ্ছে! ছাড়ুন!”
কিন্তু এহসান ছাড়ল না, বরং আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল—
— “কষ্ট হলে হোক! আমার ধ্বংসের আগুনে যদি তোকে একটু পোড়াতেই হয়, তবে ক্ষতি কী?”
মেহনূরের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল তার।কষ্ট হওয়ারি তো কথা “! এহসানের পুরুষালী হাত এভাবে শক্ত করে চেপে ধরেছে তার কোমর! চোখ-মুখ কুঁচকে গেল ওর, কষ্টে ফিসফিস করে বলে উঠল—
— “ছিঁড়ে নেবেন নাকি এখন শরীরের মাংস? যে এভাবে খাবলে ধরে আছেন! ছাড়ুন বলছি!”
এহসান চুপচাপ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি… তবে আজ সে যা দেখছে, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ঘৃণা! নিখাদ, নির্মম ঘৃণা! মেহনূরের চোখে আজ স্পষ্ট ঘৃণার প্রতিচ্ছবি। যেন কেউ ছুরি বসিয়ে দিয়েছে তার কলিজায়!
গতরাতে তো এমন ছিল না! কাল রাতে তো কত সুন্দর চোখে তাকিয়েছিল সে! তাহলে আজ এমন কেন?
দুর্বল গলায় বলল এহসান—

— “আর একবার… আর একবার শুধু ঘৃণাহীন দৃষ্টিতে তাকানো যায় না আমার পানে? শুধু একবার, মেহনূর?”
মেহনূর থমকে গেল। এই মানুষটা কি সত্যিই পাগল হয়ে গেল?
সে কঠিন স্বরে বলল—
— “আপনি শুধু ঘৃণারই যোগ্য! শুধু ঘৃণার!”
এহসান নিঃশ্বাস ফেলল। ব্যাকুল কণ্ঠে বলল—
— “হ্যাঁ, আমি ঘৃণার যোগ্য। সারাজীবন ঘৃণা কর আমায়… কিন্তু আজ, অন্তত আজ একবার ঘৃণাহীন চোখে তাকাও আমার পানে!”
মেহনূর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার কী করা উচিত? তার চোখের সামনে এত বড় সত্য, এত বড় ভয়াবহতা! একটা খুন! এত রক্ত! এহসান কি বুঝছে না তার অবস্থান? না, সে নিশ্চয়ই বুঝছে না! যদি বুঝত, তবে কি এমন করত?

আহত চোখে তাকিয়ে মেহনূর বলল—
— “আপনি বুঝলেন না আমায়। বুঝলেন না আমার পরিস্থিতি! বুঝবেন কী করে? আপনি তো আর আমার আত্মার কেউ নন, যে আমার অন্তরের অবস্থা বুঝবেন!”
এহসান এক ঝটকায় ওকে আরও কাছে টেনে আনল। হাত বাড়িয়ে মেহনূরের চোখের নিচে জমে থাকা জল মুছে দিতে দিতে বলল—
— “তুই আমার #আত্মার_আগলে! আর তোর অন্তরের কথা আমি জানব না, এমন কি আর হয়? আমি জানি, তুই ভেঙে পড়েছিস। কিন্তু সত্যি এটাই—তুই এই বংশের কেউ নোস, তুই এই দেশেরও কেউ নোস!”
মেহনূর ডুকরে কেঁদে উঠল, তবে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বলল—
— “তাহলে কি আমার অস্তিত্বই মিথ্যে?”
এহসান আবারও ওর চোখের জল মুছে দিয়ে মৃদু হেসে বলে।
— “তোর অস্তিত্ব মিথ্যে হয় কি রে? , কারণ তোর অস্তিত্ব যে মিশে গেছে আমার #আত্মার_আগলে!”
মেহনূর নারীভরে তাকিয়ে বলে—

— “আপনার পাপী অস্তিত্বের অংশীদার আমি হতে চাই না!”
এহসান এক ঝটকায় মেহনূরকে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল—
— “তুই আমার পাপী অস্তিত্ব নয় বরং … তুই আমার সব পাপের মধ্যে একমাত্র পবিত্র অস্তিত্ব!”
মেহনূর চুপচাপ এহসানের বুকে মাথা রাখে। কাঁপা কাঁপা হাতে, প্রথমবারের মতো, নিজ ইচ্ছায় আঁকড়ে ধরল এহসানকে। যেন এই মুহূর্তে সে কোনো শক্ত খুঁটির সন্ধান পেয়েছে, যেখানে সে ভেঙে পড়তে পারে, দিশেহারা হতে পারে।
এহসানও আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিল আপন নারী কে।
মেহনূর বারবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠছে “! আর দুই হাতে এহসানের পাঞ্জাবির পেছনের অংশ খামচে ধরছে। দমবন্ধ করা কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল ওর। নিজের কথা ভেবে, নিজের আপন মা-বাবার কথা ভেবে, এহসানের নিকৃষ্টতার কথা ভেবে, আপন-পরের ফারাক ভেবে, সেই ছোট তালুকদার বাড়ির কথা ভেবে—সব মিলিয়ে ওর ছোট্ট মাথায় যেন কিছুই আর ধরে না!

আত্মার আগলে পর্ব ১৪

এত ঘৃণা, এত অভিমান… তবুও আজ, এই পৃথিবীতে যাকে সে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে, তাকেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে! সেই বুকেই মাথা রেখে অঝোরে কাঁদছে! কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে মেহনূরের!
নিজের সেই তেজি, বেয়াদব নারীকে এভাবে নিজের বুকে ঢলে পড়ে কাঁদতে দেখে এহসানের অন্তরও বিষাদে ভরে উঠল। তবে এটাই তো বাস্তব, এটাই চিরসত্য!
সে ধীরে ধীরে মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে।
— “কাঁদো, যত ইচ্ছে কাঁদো… তবে মনে রেখ, আমি এহসানের এই বক্ষস্থল শুধু তোমার। আর এখানেই হবে তোমার সর্বোত্তম ঠাঁই!”

আত্মার আগলে পর্ব ১৬