আত্মার আগলে পর্ব ১৬

আত্মার আগলে পর্ব ১৬
সানজিদা আক্তার মুন্নী

— “আপনি খুব বাজে লোক! আপনি কথায় কথায় মানুষ খুন করেন, তাও নিকৃষ্ট ভাবে! আপনি আমাকেও নিকৃষ্টভাবে নিজের করে রেখেছেন! খুব খারাপ, আপনি খুব!”
মেহনূর এহসানের বুকে মাথা গুঁজে অশ্রু চেপে ধরে বলে,
কথাগুলো বলার পরও সে এহসানের বুকেই মাথা গুঁজে থাকে। যেন ওখানেই আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, অথচ অভিযোগও সেখানেই।
এহসান নিঃশব্দে শোনে। একটাও কথা বলে না। এখন বলার কিছু নেই। তার নারী ভেতর থেকে তচনচ হয়ে গেছে। এই ভেঙে পড়া অন্তরকে তো তাকেই আগলে রাখতে হবে।
সে জানে, নারীদের অন্তর কাচের মতো—একটু চাপ দিলেই চূর্ণ হয়ে যায়। নারীদের মন মোমের মতো—একটু উত্তাপে গলে যায়। কারণ তারা মায়ের জাত। তাদের হৃদয়ে থাকে মাতৃসুলভ মমতা।
এহসান ধীরে ধীরে মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আর মেহনূর নিজের অশ্রুতে তার চাদর, পাঞ্জাবি—সব ভিজিয়ে দেয়।

একসময় কান্না ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়। মেহনূর ধীরে মাথা তোলে এহসানের বুক থেকে।
এহসানের বুকের বাঁ পাশে খচ করে ওঠে! তার নারীর কান্নার পর চেহারাটা কেমন মোহময় হয়ে উঠেছে! ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে, নাকের আগা টুকটুকে লাল হয়ে গেছে , চোখের জল শুকিয়ে লাল হয়ে আছে আঁখি জোড়া, গোলাপি অধর কাঁপছে। মনে হচ্ছে, নিজের অধর দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে! কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। তার নারী রেগে গেলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে।
এহসান মেহনূরের চোখের জল মুছে দিয়ে কপালে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দেয়। তারপর গলায় গভীর স্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “একটা কথা জেনে রাখিস, যত যাই হোক, তুই শুধু আমার। আমি, এহসান, তোর অধিকারী। তুই আছিস আমার #আত্মার_আগলে, তুই আছিস আমার অন্তরে। তুই গেঁথে গেছিস এই পাপিষ্ঠ বুকের বাঁ পাশে!”
এহসানের চোখের গভীরতা দেখে মেহনূর স্থির হয়ে যায়। কেমন যেন শূন্য লাগতে থাকে।তারপরে মলিন গলায় বলে
— “আপনি আমায় আপনার ভাবলেও আমি কখনোই আপনার হব না!”
এহসান মুচকি হাসে।
— বোকা নারী! তুই আমার হয়ে গেছিস, হালালভাবেই হয়ে গেছিস! তুই আমার! আমি তোকে আমার করে নিয়েছি তাও হালাল করে “! তুই শুধু আমার
মেহনূরের বুক ধকধক করে ওঠে। কেন হচ্ছে এমন? কেন মনে হচ্ছে, এই অনুভূতিগুলো নতুন?
কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে
— “আপনি আমায় হালাল করে পাননি! কারণ আপনি আমায় জোর করে নিজের করে নিয়েছেন! আর এটা কখনোই হালাল হবে না!”
এহসান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,

— “কি করতাম বল? নয়টা বছর! নয়টা বছর তোকে চেয়েছি, তোকে হালালভাবে চেয়েছি! বারবার তোকে চেয়েছি!তোর ঐ স্বার্থপর বাপ চাচার গেছে “!জমি পর্যন্ত দিয়েছি! কিন্তু তোর ঐ মীরজাফররা তোকে আমার হতে দিল না! তারা বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! তাই তোকে এমনভাবে নিজের করে নেওয়া ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না!”
মেহনূর কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই দরজার ওপাশ থেকে কেউ ডাক দিল।
এহসান ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, এক ঝটকায় কপাট খুলে দিল। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা, এনিসা বেগম।
এনিসা বেগম এহসান কে এড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন
মেহনূর দ্রুত চোখ-মুখ মুছে নিয়ে ঘরে আসে “!কিন্তু তার চোখের লালচে আভা, নাকের ডগায় জমে থাকা অশ্রুর ছাপ—সবই এনিসা বেগমের চোখ এড়াল না।
তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন, মেহনূরের সামনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন,

— “তুমি যেতে চাও বাড়ি?”
মেহনূর খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। কাল থেকে তিনি ‘তুই’ না বলে ‘তুমি’ বলছেন! কেন? তবে কি তিনি সত্যিই মেনে নিয়েছেন যে সে এই ঘরের বউ?
মনে হাজারও প্রশ্ন জমে, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ এল না।
একবার একপলক তাকাল এনিসা বেগমের দিকে, পরক্ষণেই চোখ ঘুরিয়ে এহসানের দিকে।
এহসান চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে, গভীর দৃষ্টি নিয়ে।
আচ্ছা, যদি সে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি যেতে চাই,’ তাহলে?
এহসান কি সত্যি তাকে ছেড়ে দেবে? নাকি নিশ্চিত কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবে!
সে তো স্পষ্ট বলে দিয়েছে—মেহনূর তার, কেবল তার!
মেহনূর নিঃশ্বাস চেপে মাথা নিচু করে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “না, আমি এখন যেতে চাই না।”

এনিসা বেগম চোখ সরু করলেন, এক মুহূর্ত ছেলের দিকে তাকালেন, তারপর আবার মেহনূরের দিকে।
— “সত্যি করে বলো, ভয় না পেয়ে বলো।”
মেহনূর নিঃশব্দে মাথা নেড়ে একই উত্তর দিল,
— “না, আমি সত্যি বলছি।”
এনিসা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
— “আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে তোমরা থাকো, আমি আসছি।”
এনিসা বেগম চলে যেতেই এহসান ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করে নিল।
তারপর, ধীর অথচ নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে এল মেহনূরের দিকে।
ঠোঁটের কোণে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসি, যা তার চোখেও ছড়িয়ে পড়েছে।এগোতে এগোতে বলে

— “বাহ, আমার বেয়াদ্দব নারী! দেখি কিছু হলেও আদব শিখেছে!”
মেহনূর আতঙ্কিত চোখে পিছু হটতে চাইল, কিন্তু পারল না।
এক ঝটকায় এহসান তার কোমর চেপে ধরে ঝাপটে ধরে নিজের বুকের সাথে “!
মেহনূর হকচকিয়ে উঠল, ঠোঁট কাঁপছে, নিঃশ্বাস তীব্র হয়ে এসেছে।
তখনি এহসান হাসিমাখা মুখে বলে
— “এত সুন্দর আদব দেখালির জন্য তো তোকে কিছু দিতেই হয়!”
মেহনূরের শ্বাস আটকে গেল!
— “ক-ক-কী?”
এহসান মুচকি হেসে মেহনূরের মুখের দিকে ধীরে ধীরে নিজের মুখ নামিয়ে আনল।
মেহনূরের শরীর শিউরে উঠল!
বিদ্যুতের ঝটকার মতো একটা অনুভূতি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল! কোমর এমনিতেই অবস হয়ে আছে, কারণ এহসানের শক্ত বাহু তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

আর এখন—
এহসানের শরীরের সেই চিরচেনা ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে!
এই ঘ্রাণ! এই উষ্ণতা!এই অধিকার!
মেহনূর কেমন যেন মাতাল হয়ে যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে!
ঠিক তখনই এহসান তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল—
একবার। দুইবার।তিনবার।গভীর, দীর্ঘক্ষণ ধরে।
মেহনূরের দেহ কেঁপে উঠল।
সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল, যেন কোনো নিষিদ্ধ স্পর্শ তাকে ছুঁয়ে গেছে!
— “এটা তোর পুরস্কার, আমার বোকা নারী!”

এহসানের কণ্ঠে একধরনের মোহময় গাম্ভীর্য, যা মেহনূরের বুকের ধকধকানিকে আরও বাড়িয়ে দিল।
আল্লাহ!এই অধিকার!এই অদ্ভুত অনুভূতি!সে কি সত্যিই আজ এহসানের হয়ে গেছে?
এহসান বিরক্তির সঙ্গে মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ফোনের দিকে।
— “একটু শান্তিতে বেগমকে ভালোবাসতেও পারলাম না, এই ফোনের জন্য!”
মোবাইল কানে দিতেই ওপাশ থেকে হাসিবের অস্থির কণ্ঠ ভেসে এল।
— “আসসালামু আলাইকুম ভাইজান!”
— “ওয়ালাইকুম সালাম।”
— “ভাইজান, আজকের মিছিলে রফিকের পোলাপান খুব সমস্যা করেছে। কয়েকজন গুরুতর আহত! কী করমু কন, বড় খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি!”
সাথে সাথে এহসানের কপালের রগ ফুলে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে গলা খটখটে করে বলল,

— “তোরা কই?”
— “ভাই, আখিলের কাছাকাছি আছি!”
এহসান চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিল। তারপর ভয়ানক শান্ত সুরে বলল,
— “ওরেও ওর ভাইয়ের মতো ওপরে পাঠাতে হবে। আগে তোরা ওর পোলাপানরে বেদম পিটা—ইচ্ছেমতো মার! শুধু জানে মারিস না।”
— “হ ভাই! ওরা এখন আমাদের হাতে বন্দি। পুলিশও আছে!”
এহসানের চোখ ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে এল।
— “তোরা ওদের নিয়ে ছয় নাম্বার গোডাউনে যা। এসিডের ড্রামে ডুবিয়ে দে! তবে সবাইকে না, যারা দোষী, শুধু ওদেরই। আমি আসতেছি। আর শুন, যারা আহত, তাদের হাসপাতালে নিয়ে যা!”

— “না ভাইজান, লাগবে না, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করায় দিছি। আপনি এখন আসেন!”
এহসান ফোন কেটে কাপড় রাখার কক্ষে প্রবেশ করে। দরজার পেছনে রাখা ছোট্ট শেলফ খুলে ভেতর থেকে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি বের করল, সাথে একটা পিস্তল। ঠাণ্ডা চোখে এগুলো পায়জামার পকেটে গুঁজে নিল।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেহনূর হতভম্ব!
এই পুরুষই কি কিছুক্ষণ আগেও তাকে কোমলভাবে আগলে রেখেছিল? এখন এক নিমেষে যেন রক্তপিপাসু শ্বাপদ হয়ে উঠেছে!
তার মন বলছে, এহসানকে থামাতে হবে। কিন্তু সে কি শুনবে?হয়তো না।
তবুও আমতা আমতা করে মেহনূর বলে উঠল,

— “ক-ক কাউকে মারবেন না…”
এহসান থমকে গেল।
ধীর চোখে তাকাল তার নারীর দিকে, ঠোঁটে একপাশে হালকা হাসি ফুটল।
— “মারব না তো, শুধু আবর্জনা সরিয়ে দিব দুনিয়া থেকে!”
এ বলেই এহসান গাড়ির চাবি হাতে নিল, আরেকবার মেহনূরের দিকে তাকাল, তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
মেহনূর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!
এহসান দ্রুত ছয় নাম্বার গোডাউনে পৌঁছাল। ভেতরে ঢুকেই দেখে, বিশ থেকে পনেরো জন যুবক শক্ত বাঁশের খুঁটির সাথে বাধা, নিথর হয়ে পড়ে আছে।
এহসান ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
একজন লোক সাথে সাথে একটা চেয়ার এনে ওর সামনে রাখল।
গায়ের চাদরটা ঠিক করে চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিল এহসান। পায়ের ওপর পা তুলে নিল, হাতের আঙুলগুলো তালুবন্দি করল।
তারপর এক গভীর, নির্মম দৃষ্টি দিয়ে সামনের লোকগুলোর দিকে তাকাল।
একটু সময় পার হলো।
তারপর খুব শান্ত স্বরে বলল,

— “কয়জন আহত হয়েছে?”
হাসিব একপাশ থেকে বলল,
— “সাতজন!”
— “কেমন আহত? বেশি না কম?”
— “কমও না, বেশিও না। মাথা ফেটে গেছে, হাঁটু থেঁতলে গেছে—এই রকম।”
এহসান ঠোঁট চেপে ধরল।
তারপর সামনে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে গর্জে উঠল,
— “চুপচাপ বল, কোন কোন শুয়োরের বাচ্চা মেরেছিস আমার লোকজনকে? আমার লোকজনের মায়েরা তোদের জন্য হাসপাতালে বসে কাঁদছে! বল, কে মেরেছিস?”
কিন্তু সবাই মাথা নিচু করে একই উত্তর দিল,
— “আমি না, ভাই!”
এহসানের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করল।
— “এদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিস তো?”
হাসিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
— “জ্বি ভাই। এরা সব বড় মাপের সন্ত্রাসী।”
এহসান ভ্রু কুঁচকাল,
— “কেমন সন্ত্রাসী? বলতো শুনি?”
হাসিব এবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “মারামারি থেকে শুরু করে… ধর্ষণ অব্দি!”
“ধর্ষণ!”
শব্দটা যেন বজ্রপাতের মতো এহসানের মগজে আঘাত করল!
তার চোখ ধূসর আগুনে জ্বলে উঠল!
আর কোনো প্রশ্ন নয়।
তার কণ্ঠ কাঁপল না, বরং ভয়ানক স্থিরতা নিয়ে বলল,

— “যারা যারা ধর্ষণের সাথে জড়িত, তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে দে! তারপর এসিডের ড্রামে ডুবিয়ে মার! আর যারা জড়িত না, তাদের গুলি করে উড়িয়ে দে!”
চারপাশে একটা ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে এল।
কেউ কাঁপছে, কেউ নিঃশব্দে কেঁদে ফেলেছে!
ঘরের ভেতর থমথমে নীরবতা। একপাশে পড়ে আছে নিথর শরীরগুলো, কিছুজন করুণ মুখে চেয়ে আছে এহসানের দিকে। কাঠের চেয়ারে বসে এহসান এক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে না ছিল করুণা, না ছিল সহানুভূতি— কেবলমাত্র শীতল, তীক্ষ্ণ সিদ্ধান্ত।
একজন গলাটা খাঁকারি দিয়ে বলল,
— ভাইজান, তাহলে কী করব?
এহসান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। কোটের কলারটা ঠিক করে একপলক বন্দীদের দিকে তাকায়। তারপর খুব শান্ত গলায় বলে,

— তোদের ওপর ছেড়ে দিলাম। কিন্তু যারা নারীদের অসম্মান করেছে, ওদের একটাও যেন বেঁচে না থাকে!
তারপর একধরনের ভয়ঙ্কর শীতলতা নিয়ে হাসিবের দিকে ফিরে বলে,
— আর তুই, রাতের টিকিট কেটে ফেল। আজ রাতেই তুর্কী যাবি।রফিক কে মারার জন্য ইয়ামিন খুরশিদের সাথে দেখা করবি”!
হাসিব এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর ধীর স্বরে বলে,
— ভাইজান, ওরে মারার জন্য আপনি একাই যথেষ্ট!
এহসান এবার সত্যিকারের হাসে, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে একটা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর ধাঁচ ছিল। হাসি শেষ হতে না হতেই নিচু গলায় বলে,
— এত ছোট একটা কাজ নিজ হাতে করতে হয় না রে ভাই। আমি তো বড় দানেই ছক্কা মারব।
তারপর একপাশে পায়চারি করতে করতে বলে,
— রফিক এখন দেশে নেই, তুর্কীতে গেছে। ওখানেই শেষ করতে হবে। ইয়ামিন খুরশিদের সাথে দেখা করবি। তিন দিনের মধ্যে ওর কলিজাটা আমি আমার হাতে চাই।
কথাগুলো এতটাই দৃঢ় ছিল যে হাসিব আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। শুধু মাথা ঝাঁকালো।
এহসান শেষবারের মতো বন্দীদের দিকে একবার তাকায়। তারপর পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বেরোনোর আগে একবার থেমে বলে,

— তুই রাতের টিকিট কেটে ফেল। আমি অন্য জায়গায় যাচ্ছি।
এ বলেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল, আর হাসিব তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল— এই মানুষটাকে সে কখনো পুরোপুরি বুঝতে পারবে না!
এশার পর
বাড়ির রান্নাঘর জুড়ে ব্যস্ততা। এশার আযান ধ্বনিত হওয়ার পরও কাজ থামার নাম নেই।
বেলা ৫ টা থেকেই শুরু হয়েছে মাছ কাটা, কিন্তু শেষ হওয়ার নামগন্ধ নেই। সাত-আট বালতি টাটকা মাছ নিয়ে আসা হয়েছে ফিশারি থেকে। কেবল বাড়ির গৃহিণীরাই নয়, কাজের মহিলারাও একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠেছেন। ধারালো বঁটিতে মাছ কাটতে কাটতে হাত কেঁপে যাচ্ছে, তবু থামার সুযোগ নেই।
মেহনূরও ওদের সঙ্গে আছে, এক কোণে বসে ধৈর্য ধরে মাছ কাটছে। চারদিকে মাছের আঁশ আর রক্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, কেউ কেউ বিরক্ত মুখে গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে, আবার কেউ হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে,

— আল্লাহ! এই মাছ কি আর শেষ হবে না?
তবে রান্নাঘরের পাশের বারান্দায় বসে থাকা বড়দের চোখে মুখে অন্যরকম আনন্দ। এত মাছ এসেছে, আজ দারুণ এক ভোজের আয়োজন হবে!
এহসান সেই সকালে বেরিয়ে দিনের শেষে বাড়ি ফিরে কক্ষে প্রবেশ করে। মেহনূরকে না দেখে তার মনটা উদাস হয়ে উঠল। হাতে থাকা নিজের বেগমের জন্য আনা ব্যাগগুলো পাশে রেখে, নিজেও একপাশে বসে পড়ল। মেহনূরের অনুপস্থিতি ঘরটাকে শূন্য মনে হচ্ছিল। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন— মেহনূর কোথায়?
অস্থির মন শান্ত হতে চাচ্ছিল না, কিন্তু মেহনূরের আসার সম্ভাবনায় এক ধরনের আশা জন্ম নিল। এহসান চোখ বন্ধ করে কিছু সময় অপেক্ষা করতে থাকল, যেন মেহনূরের ছায়া কোথাও কাছেই রয়েছে।
এহসান জানে আজ মাছ ধরা হয়েছে ওদের মাছের কয়েকটি জমিতে, তাই হয়তো মেহনূর মাছ কাটতেই ব্যস্ত। কিন্তু এহসানের চোখ আর মানছে না, মনের তৃষ্ণা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে যাচ্ছে আপন নারীকে দেখার জন্য। তাই তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসে—পরে গোসল করা যাবে, আগে একবার নিজ বেগমকে দেখে নেওয়া যাক!
তাই বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে, উদ্দেশ্য নিজের মনের তৃষ্ণা মেটানো—নিজের নারীকে মন ভরে দেখা!

তাড়াতাড়ি নিচে চলে আসে এহসান, তারপর রান্নাঘরে প্রবেশ করে। প্রবেশ করতেই দেখতে পায়, সবাই মাছ কাটতে ব্যস্ত। এশা আর মেহনূর পাশাপাশি বসে মাছ কাটছে আর কী একটা নিয়ে গল্প করছে। এহসান নীরবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিজের আপন নারীর হাসিমাখা মুখশ্রীপানে। মেহনূরের হাসিমাখা মুখ দেখে অন্তর অবধি ঠান্ডা হয়ে যায়, এত পাপ, এত অপবিত্রতা, এত অশান্তির মধ্যেও যেন একটুখানি শান্তি মেলে।
এহসান জানে, এই যে মেহনূর হাসছে, গল্প করছে—সবই নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা। মেহনূর যতটা শান্ত দেখাচ্ছে, ততটাই অশান্ত তার মন। নিজের সম্পর্কে এত বড় একটা চিরসত্য শুনে নিশ্চয়ই কেউ ভালো থাকতে পারবে না, আর অন্তত তার নারী তো নয়! কারণ তার নারী অল্পতেই ভেঙে পড়ে, মোমের মতো গলে যায়, তার নারীর মন যে কোমল…
এহসানকে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এনিসা বেগম কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে যান। তার ছেলে তো রান্নাঘরে সহজে আসে না, তাহলে আজ নিশ্চয়ই আপন বেগমের টানে! তাই এনিসা বেগম মেহনূরকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

— মেহনূর, তুমি ওঠো, হাত ধুয়ে এহসানকে চা দাও। সে চায়ের জন্যই রান্নাঘরে এসেছে!
এনিসা বেগমের কথায় সবাই এক পলক রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকায়। প্রথমে সবাই অবাক হলেও পরে ঠিকই সব বুঝে যায়! মেহনূর এহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেন জানি কেমন কেমন লাগছিল তার। সারাদিনে এই পাপিষ্ঠ পুরুষের মুখ সে আজ দেখেনি, তবে এখন যেন মনের কোথাও না কোথাও শান্তি অনুভব করছে!
মেহনূর আর কিছু ভাবে না, চুপচাপ উঠে রান্নাঘরের বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়।
এহসান বলে,

— চা কক্ষে পাঠিয়ে দিও, আমি যাচ্ছি।
মেহনূর একপলক এহসানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর মাথা নাড়ায়। এহসান জবাব পেয়ে নিজ কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। কক্ষে এসে একখানা লুঙ্গি আর টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করে, উদ্দেশ্য—ভালো করে গোসল করে পবিত্র হওয়া!

মেহনূর চা বানিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
— কি,করব চা কে নিয়ে যাব?
আয়েশা বেগম বলেন,
— তুমি নিয়ে যাও একটু কষ্ট করে, কারণ সবাই কাজে ব্যস্ত।
মেহনূর বলে,
— আচ্ছা।
মেহনূর যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে এনিসা বেগম পিছন থেকে বলেন,
— তোমার আর আসা লাগবে না, আমরাই সব গুছিয়ে নেব।
মেহনূর পিছনে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়ায়।
মেহনূর চলে যেতেই সবাই হেসে ওঠে, কারণ সবাই বুঝতে পেরেছে এহসানের ব্যাকুলতা! সবাই বুঝতে পারলেও বোকা মেহনূর তা জানে না, হয়তো এমন চিন্তা মাথায়ই আনেনি!

মেহনূর কক্ষে প্রবেশ করে চায়ের ট্রে হাতে ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। কক্ষে ঢুকতেই দেখতে পায়—
এহসান বাথরুম থেকে বের হচ্ছে, পড়নে শুধু একখানা লুঙ্গি, আর কাঁধে ঝুলানো একখানা সাদা টাওয়াল, যা দিয়ে সে চুল মুছছে। মেহনূরের চোখে স্পষ্ট ভেসে ওঠে এহসানের ফর্সা, নিখুঁত, ভয়ংকর সুন্দর শরীর! সাথে সাথে লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে—ছিঃ ছিঃ! কতটা নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে এই নির্লজ্জ পুরুষের সাথে থেকে! যে এভাবে তাকিয়েছিল “!
মেহনূর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এহসান মেহনূরকে এভাবে দেখে টিটকারি মেরে হেসে বলে,
— যা দেখার তো দেখে নিলি, এখন লজ্জা পাচ্ছিস কেন?
মেহনূর চোখ ছোট করে বলে,
— আমি কখন তাকালাম? আর কী দেখলাম?
এহসান হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে,
— বোকা ভাবিস না আমায়, নারী! কখন, কিভাবে তাকাস আমি সব জানি! আর রইল বাকি দেখার সবি তো দেখে নিলি শুধু আমার গু…
এহসান আর কিছু বলতে পারে না, মেহনূর ওর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে দাঁত চেপে বলে,
— চা টা গিলে নিন!
এহসান একপলক চায়ের কাপের দিকে তাকায়, ফের মেহনূরের দিকে চেয়ে বলে,

— এখন তো আর চা গিলতে ইচ্ছে করছে না!
মেহনূর বিরক্ত হয়ে বলে,
— তো কি গিলতে ইচ্ছে করছে শুনি?
এহসান ঠোঁট কেটে হেসে বলে,
— তোকেই গিলতে ইচ্ছে করছে, তাও চকলেটের মতো!
এমন উক্তি শুনে মেহনূরের লজ্জায় কান দিয়ে যেন গরম বাতাস বের হতে থাকে! মনে মনে ভাবে—কী লজ্জা! ছিঃ! এত খারাপ এই পুরুষ!
সে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয়, শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে এত নির্লজ্জ কথায়!
মেহনূর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সোজা চলে যায় কাপড় রাখার ঘরে। সারা শরীর এখনো মাছের গন্ধে ভরা। সারাদিন কেঁদে ভেতরটা অশান্ত হয়ে আছে, এখন গোসল করাটা খুব দরকার!
কক্ষে প্রবেশ করে তার চোখ যায় তার আলমারির দিকে
।সে জানে, আলমারির দরজা খুললেই তার কাপড়গুলি রাখা আছে, তবে আজ এহসান নিজে তাকে কাপড় তুলতে দেয়নি।

মেহনূর হতবাক হয়ে যায়, আলমারি খুলে দেখে—এটা আসলেই অনেক বড়। সে ভেবেছিল, হয়তো কয়েকটা শাড়ি আর কিছু সাধারণ কাপড় রাখা হবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। আলমারি সাতটি অংশে বিভক্ত। এক অংশে সুতির শাড়ি, অন্য অংশে নেট আর সিল্কের শাড়ি, একেবারে অন্য অংশে সুতির থ্রি পিস, গোল ড্রেস, নামাজের হিজাব, গর্জিয়া থ্রি পিস, আরও অনেক সুন্দর শাড়ি, ড্রেস, বোরখা, হিজাব, নিকাব রাখা।
মেহনূর একে একে ড্রায়ারগুলো খুলে দেখে। প্রতিটি ড্রায়ারে রয়েছে আতর, সুগন্ধি, আর সাজসজ্জার নানা উপকরণ। জীবনের প্রথম এত সাজসজ্জার জিনিস সে দেখে। মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কখনো নিজে ঠোঁটে লিপস্টিকও লাগায়নি, আর সাজগোজ তো অনেক দূরের ব্যাপার!
তবে এখন এসব দেখার সময় নয়, তাই তাড়াতাড়ি একটা কালো রঙের থ্রি পিস নিয়ে নেয় এবং আলমারির দরজা বন্ধ করে দেয়।

তবে যখন সে পেছনে ফিরে যায়, তখন আবারও তার চোখ পড়ে এহসানের দিকে। সে দেখে, এহসান কক্ষে পা রাখছে, সম্ভবত কাপড় পরার জন্যই এসেছে। “যাই হোক, বেহায়া পুরুষ! এখন কাপড় তো দিবি, আর সেই বেহায়া চোখগুলোও বেহায়া পুরুষের দিকে যাবে না,”—এমনটা ভেবে মেহনূর নিজেকে একটু আশ্বস্ত করে নেয়”!
এহসান ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে, যে আলমারিতে টিশার্ট রাখা থাকে, সেই দিকে এগিয়ে যায়, উদ্দেশ্য একটা টিশার্ট নেওয়া, তাই মনমতো টিশার্ট খুঁজতে থাকে।
মেহনূর এক দৃষ্টিতে এহসানের পানে তাকিয়ে রয়েছে। কেন জানি, তার শুধু এহসানের পানে তাকাতে ইচ্ছে করে। কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই, শুধুমাত্র তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু কেন তা সে জানে না। সে শুধু জানে, এহসানকে দেখতে হবে—ভালোভাবে দেখতে হবে।
এভাবে তাকাতে তাকাতে, মেহনূর কক্ষ থেকে বের হতে উদ্যত হয়। কিন্তু তার অসাবধানতার কারণে, কক্ষ থেকে বের হওয়ার পথে হঠাৎ দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে যায়।আর ঠুকবে না কেন সে যে এহসানের পানে তাকিয়ে হাঁটছিল”!

আত্মার আগলে পর্ব ১৫

এমন হঠাৎ ধাক্কায় মেহনূর মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভব করে। ব্যথার তীব্রতায় তার সব কিছু ঘুরতে শুরু করে, যেন দুনিয়া এক জায়গায় থেমে যাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, “আল্লাহ।” মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে, তবে ব্যথা এতটা তীব্র যে, তাকে আর সামলানো যাচ্ছে না।

আত্মার আগলে পর্ব ১৭