আত্মার আগলে পর্ব ১৮+১৯
সানজিদা আক্তার মুন্নী
— “জান, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও! তোমার জন্য একটা সুন্দর চমক আছে!”
এহসান খুশিতে গদগদ হয়ে ঘরে ঢুকেই কথাগুলো ছুড়ে দিলো একপ্রকার মেহনূরের দিকে।
বেচারী মেহনূর! কাল রাতের পর থেকে লজ্জায় নিজের কাছেই মুখ দেখাতে পারছে না। মনে হচ্ছে, এই লজ্জাই তার মরনাস্ত্র! ছিঃ, কী লজ্জা!
সকালের নাস্তা সেরে বিছানা গুছাচ্ছিল সে। তখনই এহসানের এই ঘোষণা! এক পলক তাকিয়ে এহসানের পানে ফের চোখ নামিয়ে, দ্রুত বালিশ ঠিক করতে করতে বলল,
— “আপনার চমক আপনি দেখুন। আমি কোথাও যাব না।”
এহসান ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মেহনূরের সামনে দাঁড়ালো। ব্যস, বেচারী মেয়েটার লজ্জা সাত গুণ বেড়ে গেল! এহসানের দিকে তাকানোর সাহসটুকুও পেল না সে। কী করে তাকাবে? যে কাণ্ড কাল রাতে এহসান ঘটিয়েছে, তারপর আর চোখ তুলে দেখা সম্ভব?
এহসান ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি টেনে বলে,
— “আমার লজ্জাবতী লতাপাতা, লজ্জা ঝেড়ে ফেলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।”
মেহনূর ধীরগতিতে চোখ তুলে তাকাল। সন্দিগ্ধ স্বরে বলল,
— “কোথায় যাব?”
এহসান মৃদু হেসে বলল,
— “গেলেই দেখতে পাবে!”
মেহনূর আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। কোনো দিকে না তাকিয়ে ধীর পায়ে কাপড় রাখার কক্ষে চলে গেল। একটু খুঁজে বের করল কালো বোরখাটা, তারপর ধীরে ধীরে গায়ে জড়াল। কালো পর্দার নীচে সে যেন নিজেকেই লুকিয়ে ফেলল, ঠিক যেন রাতের আকাশে মিলিয়ে যাওয়া এক নীরব চাঁদ।
নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকেই অচেনা লাগল। কালো আবরণে মোড়া মেয়েটা কি সে-ই? বুকের ভেতর কেমন একটা অজানা শিহরণ খেলল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এহসান? কী অপেক্ষা করছে তার জন্য?
মেহনূর তালুকদার বাড়ির গেটে আসতেই”! একজন মহিলা এসে গাড়ির দরজা খুলে দেন ‘! গাড়ির দরজা খুলে দিতেই ধীর পায়ে উঠে বসল মেহনূর। বসতে না বসতেই এহসান নরম হাতে তার চোখের উপর কালো একটা কাপড় বেঁধে দেয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “এটা আবার কী?” মেহনূর চমকে উঠে ফিসফিস করে বলল।
এহসান একগাল হাসল, কিন্তু কিছু বলল না। শুধু আলতো করে তার হাতটা নিজের শক্ত মুঠোয় ধরে নিল। মেহনূর আরও সংকুচিত হয়ে গেল। এই মানুষটার আচরণ মাঝে মাঝে এমন রহস্যময় হয়ে ওঠে যে, নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো অনুভূতি হয়।
গাড়ির ভেতর নরম আলো আর হালকা সুবাস ছড়িয়ে আছে। এহসানের কাছ থেকে ভেসে আসা তার শরীরে ঘ্রাণ মেহনূরের মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সে চুপচাপ বসে আছে, কিন্তু তার শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি যেন একটু বেড়ে গেছে।
— “আর কতক্ষণ?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল মেহনূর।
এহসান মৃদু হেসে বলল,
— “অল্পক্ষণের অপেক্ষা, জান। তারপর এমন কিছু দেখবে, যা তোমার স্বপ্নেও আসেনি!”
গাড়ি এগিয়ে চলছে রহস্যের গন্তব্যের দিকে। মেহনূরের মনে একদিকে ভয়, আরেকদিকে কৌতূহল। সে জানে, এহসান যখন কিছু বলে, তখন সেটার পেছনে কিছু একটা লুকিয়ে থাকে। আজও কি তেমন কিছু ঘটতে চলেছে?
কালো কাপড়ের আড়ালে মেহনূর চোখ বন্ধ করে অনুভব করার চেষ্টা করছে, সামনে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য…
গাড়ি থমকে থেমে যায়, এতে মেহনূরের ভিতর ধুকপুকানি আরও এক ধাপ বেড়ে যায়। আল্লাহ মাবুদ ভালো জানেন, সামনে কী হতে চলেছে!
এহসান গাড়ি থেকে নেমে এলো। তারপর দরজা খুলে মেহনূরের হাত ধরে নামিয়ে নিল। আশেপাশে কেমন যেন কোলাহল, মানুষের শব্দ… কিন্তু কোথায় এসেছে সে? কোথায় নিয়ে এলো এই পুরুষ তাকে? কিছুই বুঝতে পারছে না!
তার দৃষ্টিহীন চোখের সামনে কেবল অন্ধকার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। এহসান মেহনূরের দুই কাঁধে আলতো করে হাত রেখে কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে গেল, তারপর ধীরে ধীরে তার চোখের বাঁধন খুলে দিলো!
চোখ থেকে কাপড় সরতেই মেহনূরের দুনিয়া উল্টে গেলো!
মখ থেকে অস্পষ্ট গলায় বেরিয়ে এলো”!
— “আব্বাহ!”
মেহনূরের মুখ দিয়ে আর শব্দ বের হচ্ছে না, শুধু নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে! হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে! কলিজা মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার !
তার আব্বাহ! মাটিতে পড়ে আছেন! গায়ে রক্তের দাগ! মুখ ফুলে গেছে, চোখের কোণে জমে থাকা শুকনো রক্তের রেখা! তাঁর ছয়জন চাচাকে কিছু লোক শক্ত করে বেঁধে রেখেছে, দাদাজানের দুই হাত পেছনে বাঁধা, তিনি হাঁটু গেড়ে বসে আছেন!
আর তার ছোট ভাইজান”! “মেহরুব কে’!মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে!সে নিথর দেহে পড়ে আছে, মুখে একফোঁটা শব্দ নেই!
এক পাশে তার ছোট ছোট চাচাতো ভাই গুলো দাঁড়িয়ে কাঁদছে, তাদের মুখে ভয় আর আতঙ্ক!
মেহনূরের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে।
পায়ের নিচে মাটি কাঁপছে ! শিরা-উপশিরায় ভয় জমাট বাঁধছে!
সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো!
এহসানের ঠোঁটে হালকা হাসি…
এই হাসির অর্থ কী? সে কি আগেই জানতো—?
মেহনূর অসহায়ের মতো চারপাশ তাকিয়ে দেখলো, আর এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, এই পৃথিবীর আলো-হাওয়াও আজ ওর বিপক্ষে!
চারপাশের হট্টগোল, আর্তনাদ আর শ্বাসরুদ্ধকর আতঙ্কের মাঝে মেহনূরের শরীরটা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, তবু সমস্ত শক্তি একত্র করে মুখ খুলতে যাবে, ঠিক তখনই এহসান ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—
“—কেমন চমক দিলাম? সুন্দর না?”
সারা শরীর শিউরে উঠল মেহনূরের। আঁতকে উঠে একপলকে নিজের আপনজনদের দিকে তাকাল সে। দাদাজান মাটিতে লুটিয়ে, চাচারা বাঁচার জন্য ছটফট করছে, আর আব্বার মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বিস্ময়ে, ভয়ে আর শোকে কেঁপে কেঁপে উঠে বলল—
—“আমার আব্বাকে কেন মারছেন? কেন এমন করছেন? আমার চাচাদের কেন মারছেন? আমার দাদাজানকে…”
কথা আর শেষ হয় না, গলার কাছে কেমন যেন দলা পাকিয়ে আসে কান্নাটা।
এহসান আবারও ফিসফিসিয়ে বলে—
–“হুশ্! আস্তে কথা বল, এখানে পরপুরুষ রয়েছে!”
তারপর একটু থেমে গলায় শীতলতা মিশিয়ে বলল—
—“আর তোর বাপ-চাচাদের আমি মারছি না, অন্য কেউ মারছে। কেন মারছে জানিস?”
মেহনূর ছলছল চোখে তাকাল তার দিকে।
—“কে… কেন?”
এহসান মৃদু হেসে বলল—
—-“কারণ, ওরা পাশের গ্রামের দক্ষিণের জমিটা নিজেদের দখলে নিতে চেয়েছিল। যার পরিণাম এই!”
মেহনূরের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
—“কিন্তু সেই জমি তো আমাদের!”
এহসান এবার ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি টেনে বলল—
—“তোদের তো, কিন্তু এরা সেটা তোদের হতে দেবে না! আর এরা কারা জানিস? এরা আরাশ জমিদারের লোক।”
—“আরাশ জমিদার!”
মেহনূর আঁতকে উঠল নামটা শুনে। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে তাদের ভয়ংকর কীর্তিকাহিনি। বিশ্রী লড়াই, রক্তের হিসাব, ক্ষমতার দম্ভ— সবকিছুর সঙ্গেই ওদের নাম জড়ানো। বড় তালুকদার, ছোট তালুকদার— যে-ই হোক,সবার সাথেই এদের রক্তাক্তির সম্পর্ক”!
কিন্তু আজ?
আজ তার নিজের পরিবারের লোকজন এই নিষ্ঠুরতার শিকার!
তখনই চারপাশের মারামারি ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। জমাট রক্তের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠে।
হঠাৎ, সবাই থমকে যায়।
থমকে যাবে না কেন,? তাদের বাপেরও বাপ এসে উপস্থিত হয়েছে এখানে “!
এহসানকে দেখে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর চোখ বিস্ময়ে কুঁচকে উঠল। কেউ একজন ফিসফিসিয়ে বলল—
“—বড় তালুকদারের ছোট সিংহ এখানে কী করছে?”
সবাই চুপ।কেউ কিছু বলছে না ভয়ে “! কারণ নিজেদের দাপট এহসান তালুকদারের সামনে দেখালে’! কলিজা আর কলিজার জায়গায় থাকবে নাহ”! তাই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে সবাই “!
তখনি এহসান হেসে উঠে বলে—
—“আরে, চালিয়ে যাও! আমি তো একটু আনন্দ নিতে এসেছি!”তোমাদের কাজে বাঁধা দিত কিন্তু নয়”!
এহসানের এমন নির্মম কথায় লোকগুলো কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে, তারপর বিশ্রীভাবে হাসতে হাসতে বলল—
—“আচ্ছা ভাই!”শুকরিয়া কাজ সম্পুর্ন করতে দেওয়ার জন্য “!
মেহনূর যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না!
এই কি সেই এহসান?? যে মানুষটা… আজ ওর পরিবারের সর্বনাশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নির্মম আনন্দ নিচ্ছে?
তখনই মেহনূরের কানে ভেসে এল এক আর্তনাদ—
—“আমার আব্বারে ছেড়ে দে, কুত্তার বাচ্চা! আমায় মেরে ফেল প্রয়োজনে!”
তার ভাইজান!মেহরুব!
তারপরই ধুপ করে একটা প্রচণ্ড শব্দ হয়।
একজন লোক প্রচণ্ড জোরে লাথি মারে মেহরুবের মুখে। মুহূর্তেই থেমে গেল ওর চিৎকার। মুখের কোণে টলটলে লাল রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে থাকল।
এই দৃশ্য দেখে মেহনূরের প্রাণ যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম সে চিৎকার করে বলে !
—“ভাইজান!”
এক দৌড়ে ওর কাছে যেতে চাইল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে এহসানের লোহার মতো শক্ত হাত ওকে টেনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে।বলে
—“তোকে এখানে এনেছি এদের এই অবস্থা দেখার জন্য, ওদের কাছে দৌড়ে যাওয়ার জন্য নয়!”
এহসানের চোখে ঝলসে উঠে এক ভয়ংকর দৃষ্টি।আর বলে
—“দেখ! পুরো গ্রাম দেখছে, কেউ কিছু বলছে না। তুইও দেখ, উপভোগ কর! যেমনভাবে তোর বাপ-চাচারা আমায় রক্তে গোসল করতে দেখেছিল! যেমনভাবে আমার আব্বা তারই ছেলের রক্তে গোসল করতে দেখেছিল!”
তারপর এক নিঃশ্বাসে বলল—
—“তুইও দেখ, আনন্দ কর!”
মেহনূর পাগলের মতো মাথা নাড়াতে থাকে! এহসানকে শুধু বারবার বলতে থাকে—
—আপনি কিছু করুন! আপনি থামান! ওরা আমার আব্বাকে মেরে ফেলবে! থামান না! কিছু তো করুন
কিন্তু এহসান মেহনূরের কোনো কথায় কান দেয় না! উল্টো তাকে বাঁ হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে, আর আনন্দ সহিত সামনের দৃশ্য দেখতে থাকে!
মেহনূর বারবার ডুকরে কেঁদে উঠে, আর একটা কথাই বলতে থাকে—
—আপনি কিছু করুন! দয়া করুন! আমার আব্বাকে বাঁচান!
আবারও কেঁদে উঠে বলে—
—ও এহসান! কিছু তো করুন! ওরা মেরে ফেলছে! ওরা আমার সব শেষ করে দিচ্ছে “!কিছু তো করুন!
কান্না করতে করতে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে মেহনূর! কিন্তু এহসান কিছুই করছে না!
মেহনূরকে কে যে এভাবে এহসান এই দৃশ্য দেখাচ্ছে, এটা দেখে মেহনূরের বাপ-চাচার অন্তর আরও ডুকরে কেঁদে ওঠে! তাদের মেয়ে খুবই কোমল! যদি কোনো ধরনের শক করে বসে! জ্ঞান হারিয়ে ফেলে! নিজের কোনো ক্ষতি করে নেয়! মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে! এটা নিয়ে তারা আর-ও ভয় পড়েছেন “!
মেহরুব নিথর দেহে শুইয়ে আসহায় চোখে শুধু এটা দেখছে—এই নরপশু এহসানের বুকে কীভাবে তার ছোট্ট পরী, তার কলিজা, তার প্রাণের টুকরো বোন কত অসহায়ভাবে আহাজারি করছে! কিন্তু তাও ঐ নরপশুটা কিছু করছে না! সব শুধু উপভোগ করছে!অথচ নিজের প্রানের জন্য নিজে কিছু করতে পারছে না, শুধু দেখছে, আর তার বুকটা বিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। রক্ত দিয়ে মুখ ভরে যাচ্ছে, তার শক্তিশেষ হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই, যখন মেহনূরের বাবা, মাজহারুল সাহেব, মৃত্যুর শিকার হতে যাচ্ছিলেন, কেউ একি বারে মেরে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখনি এহসান তার ডান হাত উঁচু করে দিয়ে এক চুটকি বাজায়। মুহূর্তেই, তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দেহরক্ষীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের মতো”!
সেই লোকগুলোর ওপর, যারা এতক্ষণ ধরে মেহনূরের পরিবারের সদস্যদের ওপর আঘাত করছিল।
মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন লোক মেহনূরের বাবাকে ধরে এনে, তাকে মাটিতে শুইয়ে দিল, তার চাচাদের ছাড়িয়ে দিতে লাগল।
মেহনূর, নিজের বাবাকে সামনে পেয়েই, এহসানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ল। তবে এহসানি নিজে ওকে ছেড়ে দেয় মেহনূরের তো আর সাধ্য নেই এহসানের বুক থেকে নিজে ছুটে যাওয়ার “! এহসান মেহনূর কে ছেড়ে এক দূষ্টিতে সামনে তাকিয়ে সব কীর্তি দেখতে থাকে ‘! একবারও মেহনূরের আধমরা বাবার দিকে ফিরেও তাকায় না “!
চোখের জলে তার সারা মুখ ভিজে যাচ্ছে মেহনূরের ।
দুঃখ, বেদনা, কষ্ট— সমস্ত অনুভূতি যেন এক সাথে উদিত হয়ে তার হৃদয়ে তোলপাড় করছে।
তাড়াতাড়ি সে নিজের আব্বার হাত, যেটি ক্লান্ত, জখম হয়ে পড়ে আছে, সেই হাত নিজের হাতে চেপে ধরে, আর অশ্রুসিক্ত চোখে, নিঃশব্দে, তার পিতার হাত চুমু খেতে থাকে।
মাজহারুল সাহেবের বুকের ভিতর এক যন্ত্রণা দায়ক অনুভূতি হচ্ছে। তার মেয়েকে এমন কষ্টে দেখে, তার মন চাইছিল, সে যেন একটি বার হলেও নিজের মেয়ের মাথায় মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে পারেন”!
কিন্তু তার শরীর সাড়া দিতে চায় না, তার হাতগুলো য ভারী হয়ে গেছে, তিনি একটুও নিজের হাত তুলতে পারছেলন না।
খুব ভয় হচ্ছে মেহনূরের, খুব ভয় হচ্ছে কারণ তার বাবা মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারছেন না!
মেহনূর ভয়ে ভয়ে তার বাবার কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে যায় আর ফিসফিসিয়ে বলে
— আব্বা, পড়ুন “লা ইলাহা”
ওর বাবা অস্পষ্ট গলায় মেয়ের সাথে সাথে বলেন
— লা ইলাহা
মেহনূর ঢুক গিলে বলে
— ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ
ওর বাবা এবার গলায় স্পষ্ট করে একটু বলেন
— ইল্লাল্লাহু… মুহাম্মাদুর…
মেহনূর ডুকরে কেঁদে উঠে বলে
— মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ
ওর বাবা অনেক কষ্টে পড়েন
— … মুহাম্মাদুর… রাসুলুল্লাহ
উনার পড়ার সাথে সাথে মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, মেহনূর ফের বলে,
—আব্বা পড়ুন আস্তাগফিরুল্লাহ
— আস্তাগফিরুল্লাহ…
মেহনূর কান্না গলায় চেপে আবার বলে
— পড়ুন আব্বা, আস্তাগফিরুল্লাহ রব্বি মিন কুল্লি
ওর বাবা মুখ থেকে অনেক কষ্টে বের করেন
— আস্তাগফিরুল্লাহ রব্বি মিন কুল্লি
— ধারিম ওয়াতিন আ’লামতু — ধারিম ওয়াতিন… আ’লামতু
তখনই কয়েকজন হাসপাতালের কর্মী এসে ওদের সামনে একটা সিট রাখেন। যাতে উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন “!
তাই এহসান একটু ঝুঁকে মেহনূরের হাতের বাহু আলতো করে ধরে একটানে, তুলে নিয়ে আবারও নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।
মেহনূর আর নিজের বাবা কে দেখতে পারে না, নিজের ভাইজানকে দেখতে পায় না কারণ এহসান ওকে এতটা জোরে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরেছে যে সে কোনো দিকে তাকাতেও পারছে না!
মেহনূরের শুধু হ্যাম্বুল্যাস এর ডাক শুনছে, তবে কি হলো, কে মারা গেল, তার বাবা কি বেঁচে রইলেন সে তা বুঝতেই পারল না!
এই সব কিছুই ঘটেছে এহসানের কারণে! সব কিছুই ঘটেছে তার জন্য, যদি সে এসব উপভোগ না করত, যদি সে বাঁধা দিত, তবে এমন কিছুই হতো না!
মেহনূরের মনে প্রতি মুহূর্তেই ভীষণ ঘৃণার পাহাড় জমে উঠছে, শুধু ঘৃণা, শুধু ঘৃণা জন্মাচ্ছে এহসানের প্রতি!
যখন সবাইকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেই লোকগুলোকে মেরে হাসপাতালে পাঠানো হয়,
তখন এহসান মেহনূরকে ছেড়ে দেয়।
মেহনূর ছাড়া পেয়ে পাগলের মতো এদিকে ওদিকে তাকায়।
কী, এই মাঠে সে আর এহসান ছাড়া কেউ নেই? কয়েক মুহূর্ত আগে তো সবাই ছিল, কোথায় গেল সবাই? তার ভাই, ছোট ছোট ভাইগুলো কোথায়?
মেহনূর পাগলের মতো মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, আর দেখতে পায় যে তার বাবা যেখানে শুয়ে ছিলেন,
সেখানকার মাটিতে কিছুটা রক্ত লেগে রয়েছে। মেহনূর তা দেখে মুহূর্তেই সেই রক্তে মাখা মাটি হাতে তুলে দাঁড়িয়ে যায়।
আর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে পিছনে ঘুরে মাটি গুলো ধরে এহসানের সামনে নিয়ে এসে বলে,
“—-এ, এ, এহসান তালুকদার, দেখুন রক্ত… রক্ত, আমার আব্বার রক্ত। আপন তো খুব পছন্দ করেন রক্ত? দেখুন, রক্ত—আমার আব্বার রক্ত। কত রক্ত দেখুন, কত রক্ত! আরও লাগবে? লাগবে? আরো দিব, দিব!”নিন ঘ্রাণ শুঁকোন”!
এহসান অনুভূতিহীন হয়ে মেহনূরের অস্থির কাজগুলো দেখছে, নিজের নারীকে এতটা ভয়ংকরভাবে আঘাত দিতে সে চায়নি। তবে এটাই তার কর্তব্য, তাকে তার আপনজনদের কষ্ট পেতে দেখিয়ে যন্ত্রণা বুঝানোর চেষ্টা করছে।
কারণ, সে চায় মেহনূরও বুঝুক, তার বাপ চাচার জন্য এহসানরা ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছে কিংবা পাচ্ছে।
মেহনূর দৌড়ে গিয়ে মেহরুবের যেখানে রক্ত পড়েছে, সেই জায়গা থেকে এক এক খাবলা রক্ত মাখা মাটি তুলে এনে এহসানের সামনে ধরে বলে,
—“দেখুন রক্ত , নিজের ক্ষোভ মেটান। এটা আমার ভাইজানের রক্ত। এখনও তরতাজা রক্ত, সুন্দর না? নিশ্চয়ই আপনার খুব ভালো লাগবে!”ঘ্রাণ নিন রক্তের “!
তারপর মেহনূর পাগলের মতো এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আরো বলে,
—-“ওখানে দেখুন, আমার চাচাদেরও রক্ত লেগে আছে। যান, দেখুন না, দেখুন! আপনার খুব মজা হবে, তরতাজা রক্ত বলে কথা!”
এ কথা বলার পর মেহনূর ডুকরে কেঁদে উঠে। এহসান তার সামনে এসে, তাকে সামলানোর জন্য এগিয়ে এলে, মেহনূর চিৎকার করে পিছু হটে বলে,
—“খবরদার! আপনি কাছে আসবেন না আমার! আমার ঘেন্না লাগে! আমার বমি পায়! আমার নিজের অস্তিত্বের উপর ঘেন্না লাগছে! আসবেন না, আপনি আমার কাছে!”ঘৃনা করি আমি আপনায় ”
কিন্তু এহসান তো আর এসব শুনে থামবে না। সে ঝাঁপিয়ে গিয়ে মেহনূরকে বুকে আঁকড়ে ধরে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
—“বেয়াদবি করিস না, বেয়াদ্দব বান্দি!”
মেহনূর এহসানের বুকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে,
—-“আমায় আমার আব্বার কাছে নিয়ে যান! আমি আমার আব্বাকে দেখব! নিয়ে যান!”
এহসানের কপালের রগ ফুলে ওঠে। সে মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে, তার বাহু আলতো করে চেপে ধরে বলে,
“—খবরদার, এমন কথা আর মুখেও আনবি না! তুই আর ওদের সাক্ষাৎ কখনোই পাবি না!”
এ বলেই এহসান মেহনূর কে জোর করে কোলে তুলে নেয়!
মেহনূর জেদের বসে কিল ঘুষি মেরেই যাচ্ছে এহসানের বুকে “! কিন্তু এহসান এসবে পাত্তা না দিয়ে ওকে গাড়িতে বসায়”!
রাতের বেলা 🌙🌸
রাত হয়ে গেছে। মেহনূর জানে না, ঠিক কি করতে হবে। তার অগোছালো, অবসন্ন শরীর আর অবসন্ন মন নিয়ে সে কাপড় রাখার কক্ষের এক কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। চিৎকার করে কান্না করার জন্য গলা ভেঙে গেছে, আর এখন কেবল নিঃশব্দে চোখে জল। অন্তরে হাজারো ঘৃণা জমে, তবুও চোখের জল থামছে না, সেসব অনুভূতির ভার সে আর বহন করতে পারছে না।
এহসান যখন মেহনূরকে বাড়ি নিয়ে আসে, তখন মেহনূর পায়ের কাছে পড়ে ছিল। আহাজারি করে বলেছিল, আমায় একটা বার হাসপাতালে নিয়ে যান, কেবল একটু সাহায্য করুন! প্রয়োজনে সারাজীবন আমি আপনার দাসী,বান্দী হয়ে তাকব “!
” কিন্তু এহসান এক টা কথাও শোনেনি তার। মেহনূরের কান্না দেখে তার বাবা, মা, ভাই সকলে মিনতি করেছে, “একবার হলেও মেহনূরকে তার পরিবারকে দেখতে দাও।”
কিন্তু এহসান তা একেবারে অগ্রাহ্য করেছে। তার অনুশোচনার কোনো সুযোগ ছিল না। সে মেহনূরকে এই কক্ষে বন্দি করে, নিজের নির্বাচনী সভায় চলে গিয়েছে।
মেহনূর, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠেছে।
চোখে আর পানি নেই, তবে হৃদয়ের ভিতর প্রতিটি মুহূর্তেই নতুন করে ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
নীরব কান্নার মাঝে শুধু একটিই রকমের ব্যথা—নিজের পরিবার কে হারানোর ভয়ে ।এমনিতেই তো তার অস্তিত্ব এই দেশে নেই এখন যদি এদের কিছু হয় তবে সে কি নিয়ে বাঁচবে “!
চোখ জ্বালা করছে কান্না করতে করতে। কিন্তু তাও অন্তর ফেটে কান্না আসছে, চিৎকার করে কান্না করতে না পারলেও, মেহনূর একেবারে নিরব হয়ে চোখের জল ফেলছে।
তখনই ঘরের দরজা খট করে খুলে এহসান ঘরে প্রবেশ করে। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে।
মেহনূর এক পলক তাকায় এহসানের পানে , সাথে সাথে তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়, ঘৃণায় এবং রাগে।
মনে হচ্ছে, তার সমস্ত পৃথিবী টুকু চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে এহসান ।
নিজের নারীর দিকে এক পলক তাকিয়েই, এহসান বুঝতে পারে—তার নারী, তার মেহনূর, কাঁদতে কাঁদতে নিজের আত্মাকে একেবারে ছিঁড়ে ফেলেছে।
মেহনূরের নাক, মুখ, চোখ—সব কিছু এতটা লাল হয়ে গেছে, যেন প্রতিটি অনুভূতি সে নিজের শরীরে আঁকড়ে ধরেছিল। তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে, একত্রিত না হয়ে গড়িয়ে পড়ছে, সেই পুরো অবস্থা নিজের দুর্বলতার কাহিনী বলে দিচ্ছে।
এহসান মেহনূরের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর কাছে এগিয়ে গেল। কিছুই বলল না, শুধুই তাকিয়ে রইল।
এহসান মেহনূরের সামনে গিয়ে হাঁটু ঘিরে বসে যায়, কিন্তু তাও মেহনূর ওর দিকে তাকায় না। এহসান এবার আলতো গলায় মেহনূরকে বলে,
— খাবারটা খেয়ে নে।
মেহনূর নিশ্চুপ, কোনো কথা বলে না, চুপচাপ বসে থাকে।
এহসান এমন দৃশ্য দেখে আলতো করে মেহনূরের মাথায় হাত রাখে।তবে তার হাত রাখতে দেরি হয়, কিন্তু মেহনূরে এক ঝটকায় এহসানের হাত নিজের মাথা থেকে সরাতে দেরি হয় না।
মেহনূর এহসানের হাত সরিয়ে চিৎকার করে বলে,
— ছুঁবেন না আমায়, ঘেন্না লাগছে, আমার ঘেন্না।
কিন্তু এহসান এখন এই কথা শুনছে না, ওর দৃষ্টির অঙ্গুলি আটকে গেছে মেহনূরের হাতে! মেহনূরের হাত খালি কেন? হাতের বালাগুলো কোথায়? হাত খালি কেন? মেহনূর নিশ্চয়ই খুলে ফেলেছে কোথাও।
এহসানের ভীষণ রাগ হয়। এহসান মেহনূরের দুই হাত ওর মুখের সামনে তুলে শক্ত করে চেপে ধরে, চিৎকারি গলায় বলে,
— হাতের চুড়ি কোথায়?
মেহনূর ব্যথায় কিঞ্চিত শব্দ করে উঠে, তবে কিছু বলে না।
এহসান আবারও বাজ খাঁই গলায় বলে,
— খারাপের বাচ্চা, হাতের চুড়ি কোথায়?
এ বলে মেহনূরকে ঝাঁকি মারে। এতে মেহনূর আঁতকে উঠে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— আমি খুলে ফেলেছি।
মেহনূরের এমন কথায় এহসানের মগজ টগবগ করে উঠে, “কি করেছে এই নারী?” এহসান মেহনূরের বাহু চেপে ধরে, দাঁত চেপে বলে,
— কোথায় ফেলেছিস?
মেহনূর ভয়ে কান্না করে দেয়, এহসানের এই রূপ দেখে, কারণ এহসানকে খুব ভয়ংকর লাগছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, কপালের রগ রাগে ফুলে গেছে, ফর্সা মুখ রাগের আগুনে পুড়ে উঠেছে।
মেহনূর কান্না চেপে গলায় বলে,
— এখানে, ঐ তো। [বালা গুলো যেখানে ফেলেছে সেখানটা দেখিয়ে বলে]
এহসান মেহনূরের কথায় সেদিকে তাকায়, তারপর এক ঝটকায় উঠে গিয়ে বালাগুলো নিয়ে আসে।
এক এক করে দুই হাতে বালা গুলো পড়িয়ে দেয়। এহসান মেহনূরের হাত ধরে স্পষ্ট বুঝতে পারে যে মেহনূর খুব রেগে, জোরজবরদস্তির সাথে এই বালাগুলো খুলেছে, কারণ মেহনূরের ফর্সা হাতে স্পষ্ট লাল দাগ দেখা যাচ্ছে।
এহসান নিজেকে কিছুটা শান্ত করে, মেহনূরের পানে তাকায়। মেহনূরের ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে, তার গোলাপি অধর খানা বারবার অস্বাভাবিকভাবে কাপছে, মেহনূর বারবার ঢোক গিলছে।
এতটা ভয় সে কখনোই মেহনূরকে দেখাতে চায়নি। তার হাতে থাকা মেহনূরের হাত জোড়াও কাপছে।
এহসান মৃদু হেসে, মেহনূরের আলতো হাতে চোখের জল মুছে দেয়। তারপর এলোমেলো চুলগুলো মুখ থেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু মেহনূর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শুধু বারবার কেঁপে উঠে “! আর টিপে চোখের জল ফেলতে থাকে”!
এহসান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, উঠে যায়। তারপর ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে একটি চিরনি নিয়ে আসে। অতঃপর মেহনূরের পাশে বসে, আলতো করে বসে ।
মেহনূর শুধু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে, আর কিছু না!
এহসান আলতো হাতে মেহনূরের চুলগুলো সম্পূর্ণ খুলে নেয়! তারপর আলতো হাতে চুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়!
মেহনূরের গাড়ে থেকে চুল সরাতেই এহসানের চোখে স্পষ্ট ভেসে ওঠে, মেহনূরের গাড়ের ফর্সা শরীরের মধ্যে কালো কুচকুচে তিলটা!
এহসান থমকে যায়! এই নারীর শরীরে এত তিল কেন? আর কেন? এই তিলগুলো তাকে ভয়ংকরভাবে টানে, সে খুঁজে পায় না এর উত্তর!
এহসান ধীর হাতে মেহনূরের কাঁধে দুই হাত রাখে!
এবং কিছু মুহূর্ত নেশাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে ওই তিলটার দিকে!
বারকয়েক ঢোঁক গিলে নিজেকে সামলাতে চায়! কিন্তু সে ব্যর্থ হয়!
নিজেকে সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে যায়!
তারপর সব সংকোচ ফেলে দিয়ে, মেহনূরের গালের তিলটায় নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়। কয়েকবার গভীরভাবে ছোঁয়ায়!
এহসানের ঠোঁট আর দাঁড়ির স্পর্শ বিষাক্ত লাগতে থাকে মেহনূরের কাছে!
মেহনূর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না! নিজের দুই হাঁটু খামচে ধরে, চিৎকার করে কেঁদে ওঠে!
মেহনূরকে এভাবে কাঁদতে দেখে এহসান, মেহনূরের গাল থেকে তার মুখ তুলে নিয়ে মেহনূরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
— এভাবে কাঁদিস না, কারণ আমার তোর এই কান্না শুনলেই, মনে চায় তোর এই কান্নাকে আরও তীব্র থেকে তীব্র করে তুলতে!
মেহনূরের কান্না মুহূর্তেই থেমে যায়! এহসানের এমন কথা শুনে!
এহসান মেহনূরের কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে মেহনূরের কানের লতিতে কয়েক কামড় বসায়!
মেহনূর বারবারই চিৎকার দিয়ে ওঠে, তবে ফের নিজেকে সামলে নেয়!
এহসান নিজেকে সামলে নেয়, তারপর কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে!
হাত বাড়িয়ে অতি যত্নে নিজের নারীর চুলগুলো ধীরে ধীরে আঁচড়ে দিতে থাকে!
প্রায় আধঘণ্টা সময় নিয়ে এহসান মেহনূরের লম্বা ঘন চুল জুড়ে বেঁধে দেয়!
অনেক কষ্টে সামলে নিতে পারে এহসান মেহনূরের চুলগুলো!
মেহনূরের চুল বেঁধে দিয়ে চিরুনি তার জায়গামতো রেখে দেয়!
অতঃপর এহসান তাড়াতাড়ি কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে! এবং বাথরুমে এসে একটি ছোট্ট তোয়ালে ভিজিয়ে নেয়!
এবং আবারও কক্ষে এসে মেহনূরের সামনে বসে যায়!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহনূরের থুতনি আলতো করে ধরে!
ভেজা তোয়ালে দিয়ে মেহনূরের কান্নামাখা মুখশ্রী মুছে দেয় অতি যত্নে!
তারপর মেহনূরের হাত-পা আলতো করে মুছে দেয়!
কিন্তু মেহনূর বারবারই এহসানের স্পর্শে কেঁপে ওঠে, তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না! সে চোখ নিচু করে নিজের দুই হাঁটু খামচে ধরে নিজেকে সামলাতে থাকে!
সেই মূর্তির মতোই বসে থাকে, কোনো শব্দও করে না, আর না করে একটুও নড়াচড়া— চুপচাপ বসে থাকে!
এহসান ওর গা থেকে ওড়নাখানা সরিয়ে নেয়, তারপর গলাও মুছে দেয়।
এতে ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে মেহনূর, তবে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নেয়, কোনো কিছু বলে না!
অতঃপর এহসান পাশে রাখা ট্রে থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে এক লোকমা খাবার মেহনূরের সামনে ধরে বলে,
— খেয়ে নে।
মেহনূরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়! সে আর কোনো কিছু না ভেবে, রাগে ফুঁসে উঠে এহসানের হাতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে বসে!
যার ফলে এহসানের হাতে থাকা ভাত গিয়ে এহসানের পাঞ্জাবিতে পড়ে যায়!
এমন কাণ্ড ঘটিয়ে মেহনূর ভীষণ ভয় পেয়ে যায়! কারণ এহসান যদি এখন ওর ওপর আবার ক্ষেপে যায়! খুব ভয় করছে মেহনূরের!
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে এহসান একপলক নিজের পাঞ্জাবির পানে তাকায়, তারপর বা হাতে হালকা করে পাঞ্জাবিতে লাগা ভাতগুলো ঝেড়ে নেয়!
মেহনূর ভয়ে ঢোঁক গিলতে থাকে! কিন্তু এহসান ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
— রাগ দেখাচ্ছিস? সমস্যা নেই! কারণ রাগ-অভিমান সবই তো তুই আমার সাথেই দেখাবি! কারণ আমিই তো তোর অস্তিত্ব!
মেহনূর চমকিত চোখে তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে। এই নিকৃষ্ট পুরুষ সবার প্রতি এত নিকৃষ্ট! কিন্তু তার প্রতি কেন এত শান্ত? কেন সে এমন আচরণ করছে!
মেহনূর ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ওঠে!
এসময় মেহনূরকে কাঁদতে দেখে এহসানের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে! কারণ সে বুঝতে পারে, তার নারী এখন তার বাবা-চাচার জন্য কাঁদছে না— অন্য কিছুর জন্য কাঁদছে! তাই আদুরে গলায় বলে,
— কেন কাঁদছিস এভাবে, জান? বল আমায়।
মেহনূর ঠোঁট চেপে কান্না থামিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
— সবার প্রতি আপনি এত নির্মম! তাহলে আমার বেলায় কেন আপনি এত কোমল?
এহসান মুচকি হেসে প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার মেহনূরের সামনে ধরে। কিন্তু এবার মেহনূর এহসানের উত্তর পাওয়ার আশায় নিমেষেই তা মুখে তুলে নেয়!
এহসান মেহনূরের মুখে খাবার দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
আত্মার আগলে পর্ব ১৭
— সবাই তো আর আমার আত্মার আগলে নেই! শুধু তুই আছিস! তাই তোর প্রতি আমি এত কোমল! তোর প্রতি আমার বিশ্রী রাগও নিথর! সেখানে তুচ্ছ! আমি তো হবই কোমল!
এহসান আরেক লোকমা ভাত মেহনূরের মুখে তুলে দিতে দিতে বলে,
— জানিস, তোর বেলায় আমি এতটাই দুর্বল যে, আমার ভয়ংকর পাপও তোর প্রতি ভালোবাসার উষ্ণতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে! ভীষণ ভালোবাসি রে তোকে! ভীষণ ভালোবাসি! আমি এহসান, ভীষণ ভালোবাসি তোকে! ভীষণ!