আত্মার আগলে পর্ব ২৩

আত্মার আগলে পর্ব ২৩
সানজিদা আক্তার মুন্নী

মেহনূর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মহিলার হাত ধরে আটকে দিল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
— আপনি কাদঁবেন না আমি পানি নিয়ে আসছি ‘!
— না, মা! পানি লাগবে না। আপনি কষ্ট করবেন না।
মহিলার ফ্যাকাশে মুখ দেখে এহসান একটু এগিয়ে এল। শান্ত গলায় বলল,
— আপনি এত হতাশ হবেন না, এভাবে ভেঙে না পড়ে বলুন— আপনি কে? আর কী কারণে আমার দরবারে এভাবে হাজির হলেন?
মহিলা একবার এহসানের দিকে তাকালেন, যেন অনেক কথা বলতে চেয়েও আটকে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে, তবু কষ্ট করে বললেন,

— ক… কাল গ্রামের পশ্চিম পাড়ায়, পিছনের পাড়ার যে মেয়ে আত্মহত্যা করেছে… আমি তার মা!
এটুকু বলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো তার, দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
এহসান গভীর দৃষ্টি নিয়ে মহিলার দিকে তাকাল। শান্ত গলায় বলল,
— আপনি নিজেকে সামলান, দয়া করে! একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হতো।
মহিলা কাঁপা কাঁপা হাতে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলেন। তারপর ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললেন,
— আমার মেয়ে এমনি এমনি আত্মহত্যা করেনি… ছোট তালুকদার সাহেব… ওর ইজ্জত হরণ করা হয়েছে !
শেষ কথাটা বলে যেন সব শক্তি হারিয়ে ফেললেন। আর কিছু বলতে পারলেন না। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
এই কথা শোনার পর এহসানের চোখমুখ কঠিন হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, কপালের রগ ফুলে উঠল রাগে। কী! তার গ্রামে এইসব হচ্ছে, আর সে কিছুই জানে না!
কঠিন গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— আপনি সব খুলে বলুন!
মহিলা কিছু বলতে পারলেন না, শুধু কাঁদতে লাগলেন। মেহনূর ধীরে ধীরে উনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, সান্ত্বনার সুরে বলল,
— দেখুন মা, আপনি খুলে বলুন। আপনার কথা পুরো না শুনলে তো বোঝা যাবে না। আপনি বলুন, ধীরস্থির হয়ে বলুন।
মেহনূরের কণ্ঠে অদ্ভুত মায়া ছিল। মহিলা তার চোখের দিকে তাকালেন, চোখে জমে থাকা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
— জানো মা… আমার মেয়েটাও এভাবে আমায় ‘মা’ বলে ডাকত… কিন্তু এখন আর ডাকে না…
এ কথা বলেই আবারও বুক ফেটে কান্না শুরু করে দিলেন।
মেহনূর ধীরে ধীরে উনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল, নরম হাতে উনার হাত ধরে নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
— আপনি সব খুলে বলুন, মা…!
এ বলেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “এহসানের মগজ টগবগ করতে তাকে, কিন্তু তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললেন,

—-‘আপনি কি পুলিশের কাছে যাননি?'”
মহিলা নিজের আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
— “বাবা, আমার মেয়েটা আধমরা হয়ে বাড়ি এসেছিল। বাড়ি এসেই আমার বোকা মেয়েটা গোসল করে নিয়েছিল। আমাদের কাউকে কিছু বলেনি, বাবা। আমার মেয়ে! হয়তো এ জন্যই বলেনি, ভেবেছে, আমি কি নিজেকে সামলাতে পারব কি না। কিন্তু একদিন পর, অনেক কষ্টে আমরা ওর মুখ থেকে সব কথা জানতে পেরেছিলাম। যখন আমরা সব জানলাম, তখনই সাথে সাথে পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ বলল, এসব কেসের কোনো তদন্ত নেই, আর তাড়াতাড়ি আমাদের ফেরত দিয়ে দিল।
তারপর আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন

—তাই আমার মেয়েটা লজ্জায়, দুঃখে, ঘৃণায় নিজেকে সামলাতে না পেরে নিজের প্রাণটা শেষ করে দিল। এখন আপনি কিছু করুন, কারণ আমি জানি, আপনি এহসান তালুকদারের সমাধান দিতে পারেন। আমার অনেক কষ্টে মেয়েটা ছিল, বাবা। ওর বাপ মরার পর আমি ওদের দুই বোনকে অনেক কষ্টে বড় করেছি। বাবা, আর আজ আমার মেয়েটা চলে গেল। আমি চাই, আমার মেয়ে যেন তার প্রাপ্য বিচার পায়। তাই তোমায় এক মা ভিক্ষা চাচ্ছি, বাবা। তুমি ওই ধর্ষককে শাস্তি দাও।”
এহসান শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
— আপনি কি ওই কুত্তার বাচ্চাটাকে চিনেন? নিয়ে যেতে পারবেন আমায় ওর কাছে?
মহিলা যেন নিজের সমস্ত জ্বালা, ঘৃণা, কষ্ট একসাথে উগরে দিলেন, দ্রুত মাথা নেড়ে বললেন,
— হ্যাঁ! হ্যাঁ! আমি চিনতে পারব!
এহসান তখনই নিজের পাঞ্জাবির দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু পেল না। মনে পড়ল, তাড়াহুড়োয় মোবাইলটা ঘরেই রেখে এসেছে।
সে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— মেহনূর, আমার মোবাইলটা নিয়ে আসো।
অন্য সময় হলে হয়তো মেহনূর গম্ভীর মুখে কিছু একটা বলত, বা এহসানের কথার তোয়াক্কা না করত। কিন্তু আজ? আজ সে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না!
দ্রুত ঘরে থেকে মোবাইলটা এনে এহসানের হাতে দিল।
এহসান মোবাইল হাতে নিয়েই দ্রুত কাউকে কল দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওপাশ থেকে ফোন ধরার শব্দ এলো।
— জয়নাল, তাড়াতাড়ি গাড়ি বের কর, আমি বের হব।
এ কথা বলেই সে মোবাইল আবার নিজের পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিল। এরপর মহিলা’র দিকে তাকিয়ে বলল,
— এখন ঐ শ****রের বাচ্চাটাকে কোথায় পাবো, সেটা আপনি জানেন?
মহিলা চোখ মুছে কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
— পাবা বাবা, এ সময় ঐ শয়তানটা গ্রামের শেষ মাথার বাজারে বটগাছের নিচে বসে থাকে… স্কুল-কলেজে যাওয়া আসা মেয়েদের দেখতে!
এহসানের চোখেমুখে যেন আগুন জ্বলতে লাগল। নিজের গায়ের চাদরটা ঠিক করতে করতে বলল,

— চলুন! আজই ওর শেষ দিন হবে, ইনশাআল্লাহ!
তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, এক ভয়ংকর প্রতিশোধের ঝলক ছিল।
এ বলেই সে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল, আর মহিলা তার ঠিক পেছনেই ছুটলেন।
মেহনূর চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। এহসানের চোখে সে এক ভয়ংকর প্রতিশোধের আগুন দেখতে পাচ্ছিল। আজ যদি সে ওই ছেলেটাকে হাতে পায়… তাহলে ওর যে নিকৃষ্ট মৃত্যু হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ট্রেতে রাখা চায়ের কাপ তুলে নিল। নিজের ভাবনার মধ্যে থেকেই “!
এহসানের এটু চায়ের কাপে এক চুমুক নিয়েই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল, কিন্তু মন পড়ে রইল এহসানের দিকে। কি করবে আল্লাহই জানেন”!
এহসান গাড়ির সামনের সিটে বসে আছে, চোখেমুখে কঠিন রাগ ফুটে উঠেছে, তবু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। জয়নাল নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। পেছনে বসা মহিলা চুপচাপ চোখ মুছছেন, মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছেন।
একসময় গ্রামের শেষ মাথার বাজারের কাছাকাছি এসে পৌঁছাল তারা। বটগাছের কয়েক হাত দূরেই জয়নাল গাড়ি থামিয়ে দিল।

কারণ _শিকার সামনে!
এহসান ধীর পায়ে নেমে পড়ে। চারপাশ একবার দেখে নিয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
— নেমে আসুন, আর দেখিয়ে দিন কোথায় আছে ওই কুত্তার বাচ্চা!
মহিলা গাড়ি থেকে নামলেন। কিছু মুহূর্ত এদিক-ওদিক তাকালেন, তারপর আঙুল উঁচিয়ে কাঁপা গলায় বললেন,
— ঐ দেখ, বাবা! ঐ যে ওই কুকুরটা!
এহসান তার দৃষ্টি অনুসরণ করল। বটগাছের নিচে একটা বাইকে বসে থাকা এক যুবক, সিগারেট হাতে নিয়ে আয়েশ করে টান দিচ্ছে। চোখেমুখে খারাপ হাসির ঝিলিক।
এহসান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখের সামনে শুধু একটাই দৃশ্য ভেসে উঠছে— লজ্জায়, দুঃখে, অপমানে আত্মহত্যা করা এক নিষ্পাপ মেয়ে… আর তার মায়ের কান্না!
সে ধীরে ধীরে নিজের চাদরটা টেনে অর্ধেক মুখ ঢেকে নিল।
তারপর শান্ত গলায় মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,

— আপনি ওর সামনে যান… আমি আছি!
মহিলা এহসানের চোখে ভয়ংকর প্রতিশোধের ছায়া দেখলেন, কিন্তু আজ আর ভয় পেলেন না। বরং ভরসা পেলেন।
সে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন, আর এহসান… ঠিক তার পিছনেই!
মহিলা থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলেন ছেলেটার সামনে। এক মুহূর্ত সে কিছু বুঝে উঠতে পারল না, তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি ছড়িয়ে বলল,
— কী রে বুড়ি? তোর মেয়েকে যেমন মজা করে খেয়ে উপরে পাঠিয়েছি, তোকে কি এবার পাঠাব?
তারপর সে এহসানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে বলল,
— এই মুখঢাকা, তুই কার সঙ্গে এসেছিস রে? তোর কোন বাপকে নিয়ে এসেছিস? আমি তোদের—
ব্যাস! এরপর আর কিছু বলতে পারল না সে!
বিদ্যুৎগতিতে এহসানের ডান হাত উঠে এলো, আর সমস্ত শক্তি দিয়ে সে ছেলেটার বাঁ গালে এমন এক থাপ্পড় কষাল যে দাঁতগুলো রক্তের সঙ্গে ছিটকে পড়ল!
আকাশে বাতাসে যেন মুহূর্তেই গর্জন ছড়িয়ে পড়ল!
ছেলেটা ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। একপাশে টলমল করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, মুখ থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে।
এহসান তখন ধীরে ধীরে তার চাদর সরিয়ে নিল, মুখের তীব্র রাগ ফুটে উঠল।
ছেলেটার চোখ ছানাবড়া!

— এ…এহসান তালুকদার!
তার কণ্ঠে ভয়, আতঙ্ক, আর মৃত্যুর ছায়া নেমে এলো। সে জানত, তার কুকর্মের কথা এহসান শুনে ফেলেছে, আর তার মানে একটাই— মৃত্যু!
সে ছটফট করে উঠে বসে, কোনোভাবে পালানোর চেষ্টা করে! কিন্তু, না! তা আর হয়ে ওঠে না!
এহসান আগ্নেয়দৃষ্টিতে তেড়ে এসে তার বুক বরাবর একটা প্রচণ্ড লাথি বসাল!
ছেলেটা আবার মাটিতে পড়ে গেল, এবার দম ফেলারও ক্ষমতা নেই!
— উগগ…আর…আর পারছি না…!
সে অসহায়ের মতো ছটফট করছে।
এহসানের চোখে একটুও দয়া নেই। বরং আগুনের শিখার মতো জ্বলছে সেগুলো।
— তুই একটা জানোয়ার! নারীর সম্মান নষ্ট করেছিস! একটা নিষ্পাপ মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিস!
এ কথা বলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেটার চুল মুঠো করে ধরে টেনে তুলল!
ছেলেটার চিৎকারে বাজারের বাতাস কাঁপিয়ে উঠল!

এহসান তাকে মাটিতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল, আর পেছন ফিরে মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
— মা, আপনি গাড়িতে উঠুন! আর প্রস্তুত হন, নিজের মেয়ের খুনির ভয়ংকর মৃত্যুর সাক্ষী হওয়ার জন্য!
মহিলা কোনো কথা বললেন না। চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে, তবে এই কান্না ব্যথার নয়— এই কান্না প্রতিশোধের!
গাড়ির দরজা খুলে মহিলা উঠে বসেন। চোখের জল ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই।
এহসানও উঠে বসে, তবে ওর এক হাতে শক্ত করে চেপে আছে সেই জানোয়ারের চুল!
গাড়ি ছুটতে শুরু করল। ছেলেটার শরীর পুরো রাস্তার সঙ্গে লুটিয়ে গেল, বুক, মুখ, হাত-পা ঘষটে যেতে থাকল মাটির সাথে!
— আমায় মাফ করে দিন! আমি ভুল করেছি!
— মাফ করে দিন, প্লিজ!
— আমি আর কোনোদিন নারীর অসম্মান করব না!
— আল্লাহর দোহাই, মাফ করে দিন!
ছেলেটা একটার পর একটা চিৎকার করছে, গলায় আর্তনাদ!
কিন্তু এহসানের কানে সে শব্দ পৌঁছায় না।
তার চোখ বরফশীতল, কঠিন! হাতের মুঠি আরও শক্ত হলো চুলের গোছার উপর!
রাস্তার ছোট ছোট পাথর, কাঁকর ছেলেটার বুকের মাংসে ঢুকে যাচ্ছে, মুখ থেঁতলে যাচ্ছে!
গ্রামের মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।
তারা জানে, এহসান তালুকদার দোষ ছাড়া কাউকে শাস্তি দেয় না!

তালুকদার বাড়ির বিশাল লোহার গেট খুলে গেল, গাড়ি ঢুকতেই সঙ্গে সঙ্গে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হলো!
ছেলেটা তখন প্রায় আধমরা!
শরীরের প্রতিটা হাড় বোধহয় চূর্ণ হয়ে গেছে, মুখ, থুতনি থেঁতলে গেছে, বুকের মাংস কেটে রক্ত গলগল করে পড়ছে!
তবুও সে নিস্তব্ধ হয়ে যায়নি। এখনো ফিসফিস করে বলছে—
— মাফ… মাফ করে দিন…!
বাড়ির সদর দরজার সামনে সব মহিলারা দাঁড়িয়ে!
ওদের চোখেও আতঙ্ক!সবাই জানে, এহসান তালুকদার বিচার করবে।
তবে কেমন বিচার?এই একটাই প্রশ্ন মনে!
তবে তারা শুধু প্রার্থনা করছে—
— ইয়া আল্লাহ, যেন এহসান ওকে বেশি শাস্তি না দিয়ে সহজে মেরে ফেলে!
কিন্তু মেহনূরের মনে সে চাওয়া নেই।
সে চায়, এহসান তাকে ভয়ংকর শাস্তি দিক!
একটা সহজ মৃত্যু না!একটা ভয়ংকর মৃত্যু!
এটাই ধর্ষকের একমাত্র বিচার!
এহসান গাড়ি থেকে নেমেই সজোরে লাথি মেরে ছেলেটাকে মাটিতে ফেলে দেয়! ছেলেটি ধূপ করে পড়ে যায়, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। এহসান তখন চোখ রাঙিয়ে জয়নালকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— আমার হাতে দে!
সঙ্গে সঙ্গে জয়নাল গাড়ির পেছন থেকে একটি চকচকে নতুন বাঁধানো কুড়াল বের করে এহসানের হাতে তুলে দেয়। তাজা ধাতব ফলার তীব্র ঝলকানিতে মুহূর্তেই কুড়ালের ধার বোঝা যায়।
এহসান কুড়ালটি হাতে নিয়ে একবার তাকায় ফলার দিকে, তারপর শক্ত করে তার মুঠোয় চেপে ধরে। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মাটিতে আধমরা অবস্থায় পড়ে থাকা ছেলেটির দিকে। এহসানের হাতে কুড়াল দেখে ছেলেটির গলা দিয়ে আতঙ্কে ফেটে আসে এক করুণ আর্তনাদ,
— ছেড়ে দিন আমায়! মারবেন না! দয়া করুন!
এহসান দাঁতে দাঁত চেপে, গর্জন করে ওঠে,
— নারীরা হয় মায়ের জাত, নারীরা হয় মমতাময়ী! তাদের সম্মান দিতে হয়, তাদের ভালোবাসতে হয়! তারা আল্লাহর এক অশেষ রহমত!
একটু থেমে আরও গভীর ক্ষোভ নিয়ে বলে,

— আর তুই কী করেছিস? এক নারীর গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে অন্য এক নিষ্পাপ নারীর সম্মান হানি করেছিস! তাকে মেরে ফেলেছিস! তোর বাঁচার কোনো অধিকার নেই এই দুনিয়ায়! তুই একটা ধর্ষক! আর ধর্ষকের একটাই প্রাপ্য— সেটা হলো ভয়ংকর থেকে ভয়ংকর মরণ!
—তাই তুই মরবি , আমার হাতে মরবি “!তোদের জন্য আমার মা বোন আজও স্বাধীন নয় “! তুই মরবি আমার হাতে তুই মরবি
এ বলেই এহসান কুড়ালটি তুলে নেয়, এবং পরক্ষণেই সজোরে আঘাত করে ছেলেটির পুরুষাঙ্গ বরাবর! মুহূর্তেই ছেলেটির মুখ থেকে বিভৎস আর্তনাদ বেরিয়ে আসে! এক ভয়াবহ, রক্তাক্ত মৃত্যুতে সে ছটফট করতে করতে প্রাণ হারায়!

কিন্তু তাতেও এহসান থামে না। তার চোখে প্রতিশোধের আগুন আরও দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে!
সে ছেলেটির নিথর লাশের দুই হাত এক এক করে কেটে ফেলে, তারপর পাগলের মতো তার বুকে, পেটে একের পর এক কুপ দিতে থাকে! চারপাশে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে, মাটির রঙ লাল হয়ে যায়! কিন্তু এতে এহসানের কিছু যায় আসে না— সে তার ক্ষোভ মেটাতে ব্যস্ত! তার মাথায় একটাই কথা __ ধর্ষকের কোনো স্থান নেই দুনিয়ায় “!
একসময়, ধারাবাহিক আঘাতে ছেলেটির শরীরের মাংস ছিঁড়ে কলিজা বেরিয়ে আসে! স্পষ্ট দেখা যায় সেই ধুকপুক করতে থাকা কালচে লাল কলিজা!
এহসান গভীর দৃষ্টিতে সেই কলিজার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে হাতে থাকা কুড়ালটি ফেলে দেয়। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দাঁত ছেলেটির কলিজা খানা ছিঁড়ে টেনে বের করে আনে, নিজের হাতে তুলে নেয়!
এক মুহূর্ত সে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে— তারপর সেই কলিজাটি মুঠোর মধ্যে নিয়ে এগিয়ে যায় এক মহিলার দিকে, যিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছেন!
তিনি— সেই মা, যার নিষ্পাপ মেয়েটা এই দুশ্চরিত্র জানোয়ারের লালসার শিকার হয়েছিল!
উনি এতটা ভয়ংকর মৃত্যু দেখে, এতটা নির্মম শাস্তি দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলছেন! এমন শাস্তি দেখে যেন উনার ভেতরের দহন কিছুটা প্রশমিত হয়েছে!
এহসান মহিলার সামনে এসে সেই রক্তমাখা কলিজা উঁচিয়ে ধরে বলে,

— মা, দেখুন! তৃপ্তি নিয়ে দেখুন! আপনার মেয়ের খুনির কলিজা! দেখুন মা! আমি আমার এক বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছি! দেখুন মা, এই কলিজা ভালো করে দেখুন, নিজের মনকে শান্তি দিন!
মহিলা কথা বলতে পারেন না। কান্নায় ভেঙে পড়ে এহসানের পায়ের ওপর পড়ে যান!
এহসান বিস্মিত হয়! সে দ্রুত কলিজাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে উনার সামনে। তখনই উনি থরথর কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠেন,
— তোমায় সালাম, বাবা! তুমি যা করেছ, তা আমার আপন ছেলেও করত না! তুমি সত্যিকারের পুরুষ! তুমি এক সিংহ! তুমি ন্যায়ের সিংহ! ধন্য তোমার জননী! ধন্য যে উনার গর্ভে তোমার মতো সিংহের জন্ম হয়েছে! আমি কৃতজ্ঞ, বাবা! কৃতজ্ঞ! কিন্তু কিভাবে প্রকাশ করব, খুঁজে পাচ্ছি না!
এহসান গভীর দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীর গলায় বলে,
— পৃথিবীতে একজন নারী বাদে আমি সব নারীকে নিজের মা আর বোন মনে করি!
একটু থেমে বলে,

আত্মার আগলে পর্ব ২১+২২

— তাই সে ক্ষেত্রে আপনিও আমার মা, আর আপনার মেয়ে আমার বোন! আমি আমার বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছি, এতে আপনি আমার প্রতি কেন কৃতজ্ঞ থাকবেন? বরং আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, যে আপনি আমার বোনের খুনিকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন!
এ কথা শুনে সেই মা আবারও কেঁদে ওঠেন! ঘৃণায়, আনন্দে, বেদনায়— সব অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়!

আত্মার আগলে পর্ব ২৩ (২)