আত্মার আগলে পর্ব ২৭

আত্মার আগলে পর্ব ২৭
সানজিদা আক্তার মুন্নী

গুদামের ভেতরে থমথমে নীরবতা। বাতাসে ভেসে আসছে পোড়া বারুদের গন্ধ, মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা লাশের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একদল পুরুষ—নিঃশব্দ, তবে তাদের চোখে আগুন জ্বলছে। যারা কিনা এহসানেরি লোক”! এহসান দাঁড়িয়ে আছে, রাগে ওর হাত পা একপ্রকার কামড়াচ্ছে! পায়ের তালু অবধি জ্বলছে রাগে,! রাগে কপালের রগ মনে হচ্ছে ছিঁড়ে যাবে এতটা রাগ হচ্ছে তার “!
রাসেল একমাত্র জীবিত, তবে সে এখনো বোকার মতো চারপাশে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ভয়, শরীর কাঁপছে। তার সব লোক মরে গেছে—একটাও বেঁচে নেই।
এহসান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছে — আর ওকে কিভাবে মারবে তা ভাবছে।
তারপর এক ইশারায় হাসিব ও জয়নালকে নির্দেশ দিল—রাসেলকে চেয়ারে বেঁধে ফেলতে।
রাসেল ছটফট করতে লাগল, চিৎকার করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,

— “এহসান! দয়া করে… আমাকে সহজে মেরে ফেল! আমি ভয়ংকর ভাবে মরতে চাই না…! দয়া করে, এহসান!”
মেহনূর এতক্ষণ ধরে চুপচাপ ছিল। সে বুঝতে পেরেছে কী হচ্ছে, তবুও নিজের অস্তিত্বকে এহসানের বুকে লুকিয়ে রেখেছে। যেন এই ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চায় না।
এহসান এবার ধীরে ধীরে মেহনূরকে নিজের থেকে সরিয়ে নেয়। দু’হাত তুলে আপন নারীর কাঁধে রাখে এবং চোখে আশ্বাসের ঝিলিক এনে বলে
— “চিন্তা করিস না… হায়াত আছে বলেই বেঁচে আছি। আর যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন তোকে নিয়েই থাকব!”
তারপর এক পলক মেহনূরের চোখে তাকিয়ে নিয়ে সামনে ইশারা করল জয়নালকে। জয়নাল কিছু একটা বুঝে গাড়ির দিকে গেল “!
মেহনূর জানে এখন কি হবে, হয়তো ভয়ংকর ভাবে রাসেল কে মারবে! মেহনূর এহসানের বাহুই কাঁপা কাঁপা হাতে হাত রাখে আর কাঁপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—– মারবন না আর কাউকে বাড়ি চলুন
এহসান মৃদু হেসে মেহনূরের মাথায় হাত রেখে বলে
—- মারব না শুধু ওর প্রপ্য শাস্তি টা দিব
জয়নাল গাড়ি ভেতর থেকে একখানা তীক্ষ্ণ ছুরি নিয়ে আসে।এবং তা এহসানের দিকে এগিয়ে দেয়
এহসান ছুরিটা হাতে নিল। তার ঠোঁটের কোণে উদাস হাসি, চোখে তাচ্ছিল্য। একবার ছুরির দিকে তাকাল, একবার রাসেলের দিকে।অতঃপর মেহনূরের কপালে গভীর ভাবে কয়েক বার নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে নেয়”!
এ সময় সবাই চোখ নিচু করে নেয় ‘! এহসান নিজের নারী কে আরও একবার ঝাপটে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে “!
কিছু মুহুর্ত পর এহসান মেহনূর কে ছেড়ে”! এগিয়ে যায় রাসেলের দিকে “!
রাসেল এবার কুঁকড়ে উঠে, কারণ সে তো জানে তার মৃত্যু আসন্ন।
এহসান সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে। রাসেলের কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,

— ” একজন আমার নারীকে একজন হারাম পুরুষ ইচ্ছে করে দেখেছিল বলে আমি এহসান তার চোখ কলিজা ছিঁড়ে নিয়েছি। আর তোকে কিভাবে সহজ মৃত্যু,….. যেখানে তুমি আমার প্রাণ, আমার আত্মা, আমার দুনিয়াকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছিস! তোকে সহজে মেরে ফেললে বেচারা ঐ হারাম পুরুষ টার সাথে অবিচার হবে “!
এ বলেই হাসিব কে ইশারা করতেই হাসিব রাসেলের চুল মুঠো করে ধরে টান দিল, যাতে তার গলা উন্মুক্ত হয় এহসানের সামনে।
রাসেল চিৎকার করে উঠে “!
এহসান ছুরিটা ভালো করে একবার দেখে নেয় এপাশ ওপাশ । তারপর দাঁত চেপে এক ঝটকায় ছুরিটা তুলে বসিয়ে দেয় রাসেলের পুরুষাঙ্গে!
এতে রাসেলের মুখ দিয়ে প্রচণ্ড আর্তনাদ বেরিয়ে আসে, জিভ বেরিয়ে এলো তীব্র যন্ত্রণায়! মনে হচ্ছে এই প্রাণ টা গেল “!

রাসেলের জিভ বেরিয়ে আসতে দেখে —এহসান এবার নিজের বা হাত দিয়ে সেই জিভ চেপে ধরল, তারপর দাঁত চেপে নিজের শরীরে যত শক্তি আছে তা দিয়ে টেনে ছিঁড়ে আনল সেই জিভ খানা — যে জিভ দিয়ে তার নারীকে কলঙ্কিত করার কথা উচ্চারণ করা হয়েছিল!
এর ওর জিভ হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলে
— “এই জিভ দিয়ে তুই আমার নারীর সম্মান নষ্ট কররার কথা বলেছিলি! তাই তোর এই জিভই ছিঁড়ে নিলাম!” কুকুরের বাচ্চা
ওর মুখ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রাসেল কাঁপছে, আর্তনাদ করছে, কিন্তু এহসান নির্লিপ্ত। রাসেলের গলা দিয়ে ফেঁটে রক্ত গড়াচ্ছে “! এখন শুধু মৃত্যুর পালা “! চিৎকার অব্দি করতে পারছে না আর না পারছে নড়তে ‘!
রাসেল তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছিল, তবে তার প্রাণ এখন উঠবে-উঠবে করছে।
এহসান এবার হাতের ছুরি টা দিয়ে রাসেলের গলার চামড়ায় বসিয়ে দিল আর ধীরগতি তে গলার চামড়া কেটে ফেলতে লাগল!

রাসেল ছটফট করছে, গলা দিয়ে অদ্ভুত গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না!
যখন তার গলার চামড়া পুরোপুরি ছিলে খসে পড়ে, তখন এহসান হাতের আঙুল ঢুকিয়ে দিল তার গলার গভীরে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর হঠাৎ দাঁত চেপে কন্ঠনালীটা এক টানে ছিঁড়ে বের করে আনলো!
এতক্ষণে রাসেল মারা গেছে তার প্রাণ বিদায় নিছে “!
সবাই এই দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
মেহনূর পেছনে হেলে পড়ল, বুক ধক ধক করছে! এতটা ভয়ংকর কিছু সে জীবনে দেখেনি! তার পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল, সে বমি করে দিবে এমন অবস্থা! এতক্ষণ এই বিবৎসাতা পাথরের ন্যায় দেখছিল দাড়িয়ে !
এহসান রাসেলের ছিঁড়ে আনা গলার রগ আর কন্ঠনালী হাতে তুলে নিয়ে বিকট হাসি দিয়ে বলে

— “এই গলা দিয়ে তুই আমার নারীকে বাজে কথা বলেছিলি! তাই এই গলাই আমি রাখলাম না তোর!”
কিন্তু এতেও এহসানের রাগ কমেনি। তাই দাঁত চেপে বলে
— “হাসিব! কুড়াল দে!”
হাসিব সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে গাড়ি থেকে কুড়াল নিয়ে এলো।
এহসান রাসেলের রক্তাক্ত দেহের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ক্ষিপ্ত পশুর মতো কুড়াল চালাতে শুরু করল!
এক, দুই, তিন…
প্রতিটি কোপে রাসেলের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে!
ওর মগজ ছিটকে পড়ল মাটিতে, কলিজা পড়ে রইল আলাদা এক পাশে। শরীরে রগ ছিঁড়ে ফিঁড়ে গেছে
এহসান কুড়াল চালিয়ে যাচ্ছে, বারবার, যতক্ষণ না শরীরটা একদম ক্ষুদ্র মাংসের টুকরো হয়ে যায় ততক্ষণ
যখন আর কিছু কাটার নেই, তখন সে নিঃশ্বাস ফেলল, কুড়ালটা মাটিতে ফেলে দিল মাটিতে “!
তারপর নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে বলে

— “দেখ তো, কোনো পানির লাইন আছে কি না গোসলের জন্য!”
একজন দৌড়ে গিয়ে দেখে এলো।
— “জ্বি ভাইজান, আছে!”
— “তাহলে চালা পানির মোটর। শরীরে হারাম রক্ত লেগেছে!”
একজন পানির লাইন এনে এহসানের সামনে ধরল অতঃপর, পানি সশব্দ গড়িয়ে পড়তে লাগল
এহসান নিজের শরীর থেকে চাদর খুলে ফেলল। ঠান্ডা পানির ধারা তার রক্তমাখা শরীরের ওপর পড়ে ধুয়ে দিচ্ছে সব। সে শান্ত হয়ে গেছে। যেন এই রক্তস্নানই তার পরিত্রাণ।
মেহনূর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
তার মন বুঝতে পারছে না… সে ভয় পাচ্ছে নাকি বিস্মিত হচ্ছে!
সে এতক্ষণ ধরে দেখছে কীভাবে এই পুরুষ শুধু তার সম্মানের জন্য কতটি জীবনকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিল!
এতটা ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব?

এতটা ভয়ংকর হয়ে ওঠার কারণ কী?
কী এমন আছে তার নিজের মধ্যে , যা একজন পুরুষকে জানোয়ার বানিয়ে দিল?
সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু দেখছে…
দেখছে, কীভাবে তার পাপিষ্ঠ পুরুষ রক্তস্নানের পর এখন প্রশান্তিতে গোসল করছে…মেহনূর শুধু দেখছে শুধু মন ভরে দেখছে এহসান কিভাবে শান্তি সহিত গোসল দিচ্ছে!
চারপাশে যেন নরকের বিভীষিকা! রক্তের গন্ধ বাতাসকে ভারী করে তুলেছে। জমিনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিথর দেহগুলো প্রমাণ দিচ্ছে যে এখানে কিছুক্ষণ আগেও এক ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ চলেছে।
মেহরাজের জ্ঞান ফিরতেই সে গোঙানি দিয়ে চোখ খুলল। কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে চারপাশ দেখল, যেন বুঝতে পারছে না সে কোথায়! ধীরে ধীরে তার স্মৃতিতে ফিরে এলো সবকিছু—কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে!
ঠিক তখনই, মেহরাজের গলার আওয়াজ শুনে মেহনূরের ধ্যান ভাঙল। এক পলক সে তাকাল নিজের ভাইয়ের দিকে, তারপর চোখ গেল এহসানের দিকে। এহসান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, তার দৃষ্টি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে!
মেহনূর শিউরে উঠো,! মুহূর্তের মধ্যে এক দৌড়ে গিয়ে এহসানের সামনে দাঁড়িয়ে মেহরাজকে আড়াল করে বলে

— “দয়া করে! দয়া করে আমার ভাইজানকে কিছু করবেন না! আমার দোষ, আমি চলে যেতে চেয়েছি, আমিই সব করেছি!”
মেহরাজ চারদিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই সব বুঝে গেল। এহসান কী ভয়ংকর কাণ্ড ঘটিয়েছে! চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তরতাজা যুবকদের লাশ, রক্তাক্ত জমিন, আর রাসেলের শরীরের যা অবশিষ্ট আছে—এ সবকিছু দেখে গা শিউরে উঠল।
রাসেলের শরীর লাশ বললেও ভুল হবে, কারণ সেটাকে যেন দক্ষ রাঁধুনির মতো টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে! কলিজা, ফুসফুস, জিহ্বা—সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্তমাখা মাটিতে!
মেহরাজ চোখ বন্ধ করে নিল! ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠছে। সে জানে, এহসান এক ভয়ংকর নরখাদক। কিন্তু এতটা নিষ্ঠুরতা? এটা তার কল্পনারও বাইরে ছিল!
মেহনূরকে ভাইয়ের হয়ে অনুনয় করতে দেখে এহসানের কপালের রগ ফুলে উঠে এমনতেই কি ঘটিয়েছে এর মধ্যে এমন করছে এই নারী কি শুধু নিজের টাই বুঝে। দাঁত চেপে বলল,

— “মীরজাফরি করেছিস, আবার সেটাই স্বীকার করছিস?!”তো….
এহসান আর কিছু বলতে যাবে, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। এতগুলো মানুষের সামনে মেহনূরের ওপর রাগ প্রকাশ করা মানে তার নারীকে অপমান করা। আর সে মরে গেলেও তার নারীর অপমান সহ্য করবে না!
চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নেয় নিজেকে “! তারপর হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় মেহনূরের বাহু ধরে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে !
মেহনূর কেঁপে উঠে, কিন্তু কিছু বলে না। ভয়ে এহসানের এক হাতে বুকের অন্য হাতে পিঠের ভেজা পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরে, যেন এটাই তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন।
এহসান মেহরাজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গর্জে উঠে বলে

— “আজ তুই বেঁচে গেলি! কারণ তুই আমার নারীর আপনজন। নইলে তোর কলিজাও আমি হাতিয়ে নিতাম!”
তারপর মেহনূরকে আরও শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে মেহরাজ কে বলে
— “মনে রাখিস, এই নারী শুধুই আমার! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে আমারই থাকবে! এ নারী শুধু আমার, একান্তই আমার!”
একটু থেমে আবার বলল,
— “আর আল্লাহ ছাড়া যে তাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে আসবে, তার কলিজাও আমি ছিনিয়ে নিব ইনশাআল্লাহ !”
তারপর হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “এই কাপুরুষটাকে নিরাপদে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিস!”
আর জয়নালের দিকে ফিরে বলল,
— “ভাই জয়নাল, এখানে যা যা হয়েছে, সব পিনপিনে পরিষ্কার করে ফেল!”
দুজনই সম্মতি জানাল,

— “আইচ্ছা ভাইজান!”
এহসান তৃপ্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে একবার মাথা ঝাঁকায়। তারপর মেহনূরের দিকে ফিরে তাকাল।
কোনো কথা না বলে ওর কোমর আঁকড়ে ধরে ওকে কোলে তুলে নিল!
মেহনূর আতঙ্কে ফিসফিস করে বলল,
— “কি…কি করবেন?”
কিন্তু এহসান কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো “! মেহনূর এহসানের বুকে থেকেও বারবারই তার ভাইজানের পানে তাকাচ্ছে “! খুব ইচ্ছে হচ্ছে ভাইজান কে একটা বার দেখার কিন্তু আফসোস এহসান সে সুযোগ টা তাকে দেয়ই না ‘!
এহসান ওকে গাড়ির সামনে বসিয়ে দেয়, তারপর নিজেও নিজ আসনে গিয়ে বসে পড়ে।
গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে দাঁত চেপে বলে
— “বিশ্বাস ভাঙার শাস্তি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সেটা এখন থেকে প্রতি মুহূর্তে বুঝবি!”
মেহনূর আতঙ্কে নিঃশব্দ হয়ে গেল।
সে জানে না, এই পুরুষ তার সাথে কী করবে!
কিছু না বলে চুপচাপ বসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে লাগল। এত ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে বেঁচে গেছে, এটাই বড় কথা!

আর সবচেয়ে বড় কথা—এহসানকে আরও একবার দেখতে পেয়েছে!
ভয়ে ভয়ে সে এহসানের দিকে তাকায়। তার শীতল, রাগান্বিত মুখ যেন আগুনের মতো জ্বলছে। আকাশি রঙের পাঞ্জাবি ভিজে গিয়ে শরীরের সাথে লেগে আছে, যার ফলে তার শক্তপোক্ত শরীরটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মেহনূর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিজের পাপিষ্ঠ পুরুষের পানে “!। মনে হচ্ছে, যেন কত বছর পর সে এহসানকে দেখছে!
ঠিক তখনই এহসানের গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— “হিজাব আর নিকাব খুল!”
মেহনূর হতভম্ব হয়ে গেল!
সে ভেবেছিল, হয়তো এহসান বুঝতে পারেনি যে সে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল! আর এটা করতেই বা কেন বলছে
তখনই এহসান আবার বলল,
— “আমায় মন ভরে দেখে নিলি, এখন আমাকেও তোর মুখটা দেখার সুযোগ দে!”
মেহনূর হতাশ হয়ে নিজের নিকাব খুলতে লাগল। এই পুরুষ সবকিছু এত নিখুঁতভাবে বুঝতে পারে, কেমন করে?
নিকাব খুলেই বলল,
— “নিন, দেখুন!আমায় দেখার চক্করে আবার গাড়ি উল্টে দিয়েন না !”
এহসান মুচকি হেসে তাকাল। মেহনূরের পানে “! কি উক্ত শুনালে তার নারী তাকে হাসারি কথা “! এহসান লক্ষ্য করে

মেহনূরের চোখ-মুখ এখনও লাল। কান্নার ছাপ স্পষ্ট। এই অবস্থায় তার নারী কে ভীষণ ভীষণ আবেদনময়ী লাগছে! স্নিগ্ধ ফুল লাগছে “! একটা বার মন পড়ে এই ভয়ংকর মুখশ্রী খানা ছুঁইয়ে দিতে মন চাচ্ছে “!
এহসান মেহনূর এই রুপ দেখে মৃদু হেসে বলল,
— “এত ভালোবাসিস আমাকে? যে আমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে সাদা থেকে লাল হয়ে গেছিস?”
মেহনূর সাথে সাথে মুখে হাত দিল এটা দেখতে কি হয়েছে তার মুখে “!কিছু মুহুর্ত পর এহসানের কথার অর্থ বুঝে “! নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পেয়ে যায় কিন্তু তা তো শিকার করা যায় না তাই বলে
— “আমি কখন বললাম, আপনার জন্য কেঁদেছি?! আমি আমার নিজের জন্য কেঁদেছি!”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— “অবশ্য, সেটাও ঠিক! তুই তো আবার মীরজাফর দের সাথে বড় হয়েছিস যারা কিনা শুধু নিজের টা বুঝে
এহসানের এমন খুঁচা মারা কথা শুনে মেহনূর থমকে যায়! মুখ খানা চুপসে যায় মুহূর্তেই “!
এহসান এটা লক্ষ্য করে তবে কিছু বলে না “! কি বলবে তার নিজের মনটাও বিষাদে ছেঁয়ে গেছে যে”!
এহসান মেহনূর কে নিয়ে বাড়ি ফেরে না অন্য কোথাও নিয়ে আসে “! মেহনূর স্পষ্ট দেখতে পায় তাদের,
গাড়িটি ধীরে ধীরে বিশাল এক প্রাচীরঘেরা এলাকায় প্রবেশ করে। চারপাশে ঘন অরণ্য, সবুজ গাছপালা, অদ্ভুত এক রহস্যময় পরিবেশ। প্রাচীরের ওপাশে আরও একটি পুরনো প্রাচীর, যা দেখে মনে হয় অনেক শতাব্দী পুরনো কোনো দুর্গ বা রাজপ্রাসাদের অংশ। মেহনূর অবাক হয়ে এহসানের দিকে তাকায়, তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে।
— “এ কোথায় নিয়ে এসেছেন আপনি আমায়?”
প্রশ্নটা করতেই এহসান কোনো জবাব না দিয়ে সোজা গাড়ির ব্রেক কষে দাঁড় করায়। তারপর দরজা খুলে নেমে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

— “তোর জেলখানা।”
এ কথা শুনে মেহনূর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এহসান কি মজা করছে, নাকি সত্যিই তাকে বন্দি করতে এনেছে? তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই।
এহসান কোনো কথা না বলে মেহনূরকে কোলে তুলে নেয়। মেহনূর এবার তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না, কারণ সে নিজেই এতটা বিভ্রান্ত যে কিছু বোঝার মতো অবস্থায় নেই।
প্রাচীরের বিশাল গেট পেরিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যায়। মেহনূরের চোখ পড়ে সামনে এক পুরনো কিন্তু পরিপাটি করে রাখা ছোট্ট বাড়ির দিকে। বাড়ির চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান, বাগানে ছোট্ট এক পুকুর, আর বাতাসে ভাসছে জোনাকির আলো। পুরো জায়গাটা যেন কোনো এক পুরোনো রাজার গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ। অসম্ভব সুন্দর লাগছে এই পুরো জায়গা টা “!

এহসান কিছু সময় দাঁড়িয়ে মেহনূরকে চারপাশটা ভালোভাবে দেখতে দেয়, যেন সে বুঝতে পারে—এই জায়গাটা তার জন্যই নির্ধারিত। এরপর সে ধীরে ধীরে ঘরের দরজার দিকে পা বাড়ায়।
ঘরে প্রবেশ করে এহসান মেহনূর কে নামিয়ে দেয় “!
মেহনূর বিস্মিত হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে, ঘরটা আসলেই খুব ছোট তবে সাজানো-গোছানো। ছোট্ট একখানা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো পড়ছে বিছানার ওপর। ছোট্ট বেলকোনির পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে।
দেয়ালে ঝোলানো পুরোনো ডিজাইনের একটি ঘড়ি টিকটিক শব্দ করছে। ঘরের প্রতিটি কোণেই যেন এক অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে।

ঘরের মাঝখানে মেহগনি কাঠের তৈরি রাজকীয় বিছানা, গাঢ় নীল মখমলের চাদরে ঢাকা। পাশে একপাশে রাখা আছে কয়েকটি তাক, যেখানে কিছু বই এলোমেলোভাবে রাখা। দেয়ালে ঝুলছে ধাতব ফ্রেমের মধ্যে বাঁধানো এক শিল্পকর্ম, যেন কোনো এক পুরনো স্মৃতির চিহ্ন বহন করে।
কোণার দিকে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের ওয়ার্ড্রোব থেকে এক ঝলক চকচকে রেশমি কাপড়ের আভাস পাওয়া যায়, মেঝেতে পারস্যের নকশাদার কার্পেট বিছানো, যার ওপর এহসান নির্ভার হয়ে হেঁটে বেড়ায়, যেন এ মাটির প্রতি তার কোনো টান নেই।
মেহনূর এসব দেখতে দেখতে বলে

— এ কোথায় নিয়ে এসেছেন আপনি আমায়
এহসান শান্ত গলায় বলে,
— “আমি তোমায় আমাদের গুপ্ত রাজ্যে নিয়ে এসেছি, যেখানে কেবল তুমি আর আমি থাকব। এখানে নেই বাইরের কোনো কোলাহল, নেই কোনো তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব।”
মেহনূর থমকে যায়। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দেয়, কিন্তু কোনোটা উচ্চারণ করার আগেই এহসান বিছানার ওপর থেকে একখানা রেশমি শাড়ি নিয়ে তার সামনে ধরে।
— “এটা পড়ে নাও।”
সে ঘরের একপাশে থাকা দরজার দিকে ইশারা করে বলে,
— “এটা বাথরুম। ভেতরে যাও,কাপড় বদলে এসো।”
মেহনূর আর কিছু না বলে শাড়িটা হাতে নেয় এবং দরজার ওপারে চলে যায়।
বাথরুমটাও অদ্ভুত সুন্দর। দু’ভাগে বিভক্ত—একদিকে গোসল ও ওযুর ব্যবস্থা, অন্যদিকে টয়লেট। দেয়ালে লাগানো ছোট্ট আয়নায় নিজের ক্লান্ত মুখ দেখে মেহনূর। মনে মনে ভাবে, ‘এহসান কেন এমন করছেন? কেন উনি আমাকে এখানে নিয়ে এলো?’

মেহনূর মনে করেছিল, এহসান হয়তো রাতটা পার করার জন্য এখানে এসেছে, তাই নিজ মনে ধীরে ধীরে শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে নিতে থাকে।
শাড়ি ঠিকভাবে পরে ধীর পায়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে সে।
এদিকে, এহসান নিজের ভেজা কাপড় পাল্টে একখানা লুঙ্গি আর সাদা টিশার্ট পরে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এত রাগের মাঝেও তার বারবারই মেহনূরকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে—স্নিগ্ধ, কোমল সেই মুখশ্রী দেখে প্রহর গুনতে ইচ্ছে করছে! অথচ সেই নারী, যে এতক্ষণ আগে বাথরুমে ঢুকেছিল, এখনও বের হওয়ার নাম নেই! মনে ছটফট করছে—একবার, অন্তত একবার নিজের কবুতরের বাচ্চাটাকে প্রাণভরে দেখে নিতে চায় সে!
রাসেলের আস্তানায় আসার আগেই সব কিছু পরিষ্কার করে ঠিকঠাক গুছিয়ে রেখেছে সে, যেন এখন থেকে মেহনূরকে এখানেই রাখতে পারে। নির্বাচন আসন্ন, রাত-দিন বাইরে থাকতে হবে তাকে। এ সুযোগে যেন মেহনূর তার থেকে আলাদা না হয়ে যায়! আজ যা করেছে, তার জন্য কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত!
কিন্তু কী শাস্তি দেবে? এহসান জানে, এই বেয়াদব নারী তার সমস্ত অস্তিত্ব, তার রক্তের প্রতিটি বিন্দুর সঙ্গে মিশে গেছে। তাকে কষ্ট দিলে কি নিজেও শান্তিতে থাকা যায়? তাই সবদিক ভেবেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে—মেহনূরকে কিছুদিন এখানেই রাখবে।

মেহনূর বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে, টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে।
এহসান স্তব্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
কালো শাড়িতে মেহনূরের ফর্সা শরীর যেন চাঁদের আলোয় চকচক করছে! কিন্তু এহসানের চোখ বারবার সেখানে আটকে যায় না—আটকে যায় তার মুখশ্রীর ওপর! ভেজা চুল, পানি ছুঁয়ে যাওয়া ঠোঁট, চোখের কোল বেয়ে নামা জলবিন্দু—সব মিলিয়ে এহসানের মাথা ঘুরে যায়! জমে থাকা রাগ মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!
মেহনূর তার দৃষ্টি অনুভব করে। বুঝতে পারে, পুরুষটি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ফিসফিসিয়ে বলে,

—এই পুরুষের কি বিরক্তি আসে না এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে?
এহসান ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে আসে তার দিকে, মৃদু হেসে বলে,
—তুমি বিরক্তির কথা বলো? তোমার দিকে তাকিয়ে যদি গোটা জীবন পার করে দিতাম , তবুও হয়তো আমি এহসান তোমায় মনভরে দেখার তৃষ্ণা মেটাতে পারতাম না!
মেহনূর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
—আমার মধ্যে আপনি এমন কী খুঁজ পেলেন?
এহসান আরও এক কদম এগিয়ে এসে মেহনূরের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গভীর কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
—তোর মধ্যে আমি আমার অস্তিত্বের খোঁজ পেয়েছি। তাই তো তোকে নিজের অজান্তেই আপন আত্মার আগলে জড়িয়ে নিয়েছি!

মেহনূর স্তব্ধ হয়ে যায়। কিছু একটা বলবে বলে মুখ খুলতেই এহসান এক ঝটকায় তাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে! তারপর কোনো অনুমতি ছাড়াই গভীরভাবে ডুবিয়ে দেয় তার ঠোঁট মেহনূরের নরম ঠোঁটে! মেহনূর এত কিছুর মধ্যে নিজের পাপিষ্ঠ পুরুষের শরীরে ঘ্রাণ ঠিকিই নিচ্ছে মন ভরে অনুভব করছে
মেহনূর হতভম্ব! কিছু বলতে পারছে না!
এহসান পাগলের মতো আঁকড়ে ধরে আছে তাকে! দাঁড়ির খসখসে স্পর্শ তার নরম ত্বকে সুচের মতো বিঁধছে!
মেহনূর এহসানের বুক আর কাঁধে ধাক্কা দেয়, নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়! কিন্তু এহসান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, আরও গভীর করে ডুবিয়ে দেয় নিজের ঠোঁট নিজের আপন নারীর ঠোঁটে!
ধীরে ধীরে মেহনূর বুঝে যায়, এহসান তাকে ছাড়বে না। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
এহসান নিজেকে কিছুটা সংযত করে, ধীর গতিতে মেহনূরকে ছেড়ে দেয়।

অন্যদিন হলে মেহনূর চিৎকার করত, কেঁদে ফেলত। কিন্তু আজ কিছুই বলে না। উল্টো এহসানের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে। কীভাবে এত সুন্দর, এত নিষ্পাপ হতে পারে এই পুরুষের চোখ! অথচ এই চোখের অধীকারী মানুষ টা কতটা ভয়ংকর আর নিকৃষ্ট “! মেহনূরের চোখের সামনে রাসেলের বিবৎস মৃত্যু ভেসে উঠে “!
সহসা ভয় ঘিরে ধরে তাকে! চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় সে!
এহসান চমকে যায়। হালকা ঝাঁকিয়ে বলে,
—কি হয়েছে? এমন করছ কেন?
মেহনূর চোখ বন্ধ রেখেই ফিসফিসিয়ে বলে,
—আপনার জন্য হচ্ছে!
এহসান তার থুতনি আলতো ধরে,
—আমি আবার কী করলাম?
মেহনূর চোখ খুলে ফিসফিসিয়ে বলে,

—এই যে ভয়ংকরভাবে খুন করলেন, এখন সেটা আমার চোখের সামনে ভাসছে! ভয় করছে… ভীষণ ভয়!
এহসান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
—সত্যি তোর ভয় করছে? সত্যি?
মেহনূর ভ্রু কুঁচকে বলে,
—হ্যাঁ, করছে! কিন্তু হাসছেন কেন আপনি?
এহসান হেসে বলে
— নাহ এমনি আর এখানে কিছুদিন থাকলে সব ভয় উড়ে যাবে
মেহনূর চমকে উঠে এহসানের কথায়
— কি বলেছেন আমি এখানে কেন থাকব
মেহনূরের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে এহসান ফিসফিস করে বলে
— “এটা তোমার জন্য এক ভয়ংকর শাস্তি, প্রতারণার শাস্তি! যতদিন আমি না চাইব, ততদিন তুমি এখানেই থাকবে, আমার বন্দিনী হয়ে!”
মেহনূর হতভম্ব হয়ে গেল। এহসান কি সত্যি বলছে? নাকি এটা নিছক এক নিষ্ঠুর রসিকতা? কাঁপা গলায় বলল,

— “মিথ্যে বলেছেন! এমন হতে পারে না!”
এহসান হেসে তার কোমর আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিল, যেন তাকে আরও নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে। গভীর চোখে চেয়ে বলল,
— “আমি মিথ্যা বলছি—এটাই সত্য!”
মেহনূর বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠে বলে,
— “ফাইজলামি করছেন? আমি এখানে কীভাবে থাকব?”
এহসান ধীরস্থির ভঙ্গিতে তার ঠোঁটে শাহাদাত আঙুল রাখল।
— “হুস! এত গলা উঁচু করিস না। বিশ্বাসঘাতকদের জন্য মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত, কিন্তু আমি সেটা করিনি! আমি শুধু তোকে বন্দী করেছি!”
মেহনূর তার হাত সরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করল,
— “আমি এখানে থাকতে পারব না! প্রয়োজনে আমাকে মেরে ফেলুন, তবুও এখানে রেখে যাবেন না!”
এহসান এবার কঠিন স্বরে বলল,
— “হাত ধরে ওয়াদা করেছিলি, তারপর প্রতারণা করলি! এখন এত বড় বড় কথা বলছিস? একটুও লজ্জা করে না?”
এবার মেহনূর রুষ্ট স্বরে উত্তর দিল,
— “আপনি জোর করে বিয়ে করেছেন আমাকে! লজ্জা তো আপনার করা উচিত! আর পালিয়ে যাওয়াটা যদি ভুল হয়, তবে আপনার অন্যায় কিসের?”

এহসান এবার গভীর দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকাল।
— “পালিয়ে গেলে ততটা রাগ করতাম না। কিন্তু তুই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস! আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছিস! ওয়াদা করে তা রাখিসনি!”
মেহনূর এবার ভয় পেয়ে গেল। তার মানে এহসান সত্যিই তাকে এখানে আটকে রাখবে? সে দ্রুত এহসানের হাত চেপে ধরে বলে,
— “না, দয়া, এমন করবেন না! আমি বাঁচতে পারব না!”
এহসান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— “আমিও তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না, এ কথা বলেছিলাম। ভীষণ ভালোবাসি, সেটাও বলেছিলাম। কিন্তু তুই আমাকে ছেড়ে যেতে চেয়েছিলি! তাই এটাই তোর শাস্তি!”
মেহনূর হতাশ হয়ে এহসানের হাত ছেড়ে দিল।
— “আমি মরে যাব! যদি আমাকে এখানে রেখে যান, আমি নিজে থেকেই মরে যাব!”
কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই টাশ করে
এহসানের শক্ত হাতে একটা চড় এসে পড়ল তার গালে! মুহূর্তেই চারপাশের সবকিছু যেন দুলে উঠল!মেহনূরের কান দিয়ে গরম বাতাস বেরতে লাগল
এহসান দাঁত চেপে বলে
— “খারাপের বাচ্চা! এরপর যদি এমন কথা বলিস, তোকে মরে যেতে হবে না, আমি নিজেই তোকে শেষ করে দেব!”

বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে কাঁদছে মেহনূর। সে জানে, এহসান সত্যি বলছে। এবার সত্যিই সে এখানে বন্দী হয়ে গেছে!
এহসান বাইরে গেছে খাবার আনতে। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে আসে, দেখে মেহনূর এখনও কাঁদছে। বিরক্ত গলায় বলে,
— “কাঁদতে থাক! যত খুশি কাঁদ! তোর কান্নায় আমি গলব না! তুই এখানেই থাকবি, বেয়াদব নারী!”
এ বলে সে ঘরের একপাশের দরজা খুলে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। সেখান থেকে খাবার এনে একটা প্লেটে সাজিয়ে নেয়।
এরপর সোজা এসে বসে মেহনূরের সামনে।
মেহনূর মাথা নিচু করে বসে ছিল। এহসানের শরীরের চিরচেনা সুগন্ধ তার নাকে এল, সে ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল।
এহসান গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী করবে? এই কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহনূর কেঁদে নিজের চেহারার কি হাল করেছে! চোখ লাল, নাক ফুলে গেছে, মনে হচ্ছে গালে একটু স্পর্শ করলেই রক্ত পড়বে।
এহসান ধমকের সুরে বলল,
— “আর কাঁদলে একদম মেরে ফেলব! কী হাল করেছিস নিজের? পাগলি লাগছিস! কান্না বন্ধ কর!”
মেহনূর দাঁত চেপে বলল,
— “আমার ইচ্ছে! আমি কাঁদব! আপনি কে, এত কথা বলার?”
এহসান খাবার হাতে নিতে নিতে শান্তভাবে বলল,
— “আমি তোর বাচ্চার বাপ। তাই এত কথা বলছি!”

মেহনূর এহসানের এমন কথায় কিছু বলে না এই বাচ্চার মা আর বাপের কথা শুনতে শুনতে সে হাঁপিয়ে গেছে সে বিস্ময়ে চোখ বড় করে বলল,
— “আমি পালিয়ে যাব! এখান থেকে পালিয়ে যাব!”
এহসান হেসে বলল,
— “গেট পেরোতে পারলেই তবে!”
মেহনূর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
— কেন পারব না?
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— কারণ চারদিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। একবার পালাতে গেলেই শেষ!
মেহনূর ধাক্কা খায়। সত্যিই কি ওর কোনো উপায় নেই?
এহসান তখন ওকে কথায় কথায় ভুলিয়ে খাবার মুখে তুলে দিচ্ছিল। কখন যে খাওয়া শেষ হলো, মেহনূর বুঝতেই পারেনি। এরপর নিজেও খেয়ে নিয়ে প্লেটগুলো গুছিয়ে রান্নাঘরে রেখে এলো।
কিন্তু ফিরে এসে দেখে, মেহনূর আগের মতোই বসে আছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অন্য কারও বেলায় হলে সে বিরক্ত হতো। রাগও হতো হয়তো। কিন্তু নিজের নারীর ওপর কিসের রাগ, কিসের বিরক্তি? যে নারীই তার বেঁচে থাকার কারণ, তার ওপর কি রাগ করা যায়?
আলমারি খুলে একটা চিরুনি বের করে সে মেহনূরের দিকে এগিয়ে যায়। বিছানায় উঠে একদম কাছে বসে পড়ে।
মেহনূর সেই আগের মতোই বসে আছে, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

এহসান ওর চুল হাতে নিয়ে দেখে, কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। ভেজা চুলের ভেতর গিঁট পড়ে আছে।
— পাগলির মতো চুলগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে রাখিস কেন? সব ঝরে যাবে অকালে, বুড়ি হয়ে যাবি আমার বাচ্চার মা হওয়ার আগেই!
মেহনূর তেতে উঠে।
— আপনি হাত দেবেন না আমার চুলে! নয়তো—
এহসান মৃদু হেসে ওর গাল থেকে আলতো করে চুল সরিয়ে নিজের থুতনি রেখে দেয় ওর কাঁধে।
— নয়তো কী?
মেহনূর শিহরিত হয়ে ওঠে। এহসানের খসখসে দাড়ির স্পর্শে মনে হয়, ওর গাল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।
ও হাত দিয়ে এহসানের মুখ সরানোর চেষ্টা করে।
— নয়তো মেরে ফেলব! সরুন! আমাকে এখানে রেখে যাবেন তো, কাছে আসছেন কেন? সরুন বলছি!
এহসান কোনো উত্তর দেয় না। শুধু মুখ ডুবিয়ে দেয় ওর কাঁধে।
মেহনূর হতভম্ব হয়ে যায়। নিজের হাত দিয়ে নিজের চামড়ায় নখ বসিয়ে দেয়, যাতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কিছু বলে না ফেলে। যদি গালিও দিয়ে ফেলে, তাহলে হয়তো…

আত্মার আগলে পর্ব ২৫+২৬

এহসান মুখ তুলে নেয় ওর কাঁধ থেকে। চিরুনি পাশে রেখে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত কেটে যায়।
তারপর হঠাৎই, একটানে মেহনূরকে নিজের বুকের বাঁ পাশে টেনে নেয়।
মেহনূর ধরা পড়ে যাওয়া পাখির মতো চুপ হয়ে থাকে।
এহসানের বুকে মুখ গুঁজে।
একটি ক্ষুদ্র, কবুতরের বাচ্চার মতো।

আত্মার আগলে পর্ব ২৮+২৯