আত্মার আগলে পর্ব ৩১

আত্মার আগলে পর্ব ৩১
সানজিদা আক্তার মুন্নী

বদ্ধ পরিবেশে একটা ভ্যাপসা গন্ধ ভাসছে। যেন বাতাসও থমকে আছে, নিঃশ্বাস নেওয়া ভারী লাগছে। ঠান্ডা লোহার চেয়ারে দড়ি দিয়ে বাঁধা পড়ে বসে আছে এশা। হাত-পা নড়াতে পারছে না, শরীর জুড়ে ব্যথা। মাথাটা ভারী লাগছে, যেন কয়েক ঘণ্টা অচেতন ছিল।
চোখ মেলে ধীরে ধীরে সামনে তাকাতেই সে দেখতে পায় এক চেনা মুখ।
মেহরাজ!
প্রথমে বুঝতে পারেনি। কয়েকবার চোখের পলক ফেলে, তারপর ঠিকই চিনে ফেলে।
পাশেই একজন কাজি দাঁড়িয়ে, আরেকপাশে মেহরুব!

শুক্রবার দিন মাদ্রাসায় আলেমরা একটা বৈঠক ডেকেছেন কিছু তাফসির করতে। এশাকেও যেতে হয়। মেহনূরের যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে তো আর পারবে না যেতে। তাই এশা একাই এসেছে মাদ্রাসায়। কিন্তু মাদ্রাসায় আর পৌঁছাতে পারে না। কয়েকজন নারী এসে তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয় ও মুখে কাপড় বেঁধে দেয়।
আর এখন তার জ্ঞান ফিরে! জ্ঞান ফিরে চোখ খুলে সামনে স্পষ্ট দেখতে পায় মেহরাজকে। প্রথমে তো চিনতে পারছিল না, বার কয়েক তাকিয়ে ঠিকই আন্দাজ করে নেয়—এটা মেহরাজ।
এশা গোঙিয়ে উঠে অস্পষ্ট গলায় বলে—
— কী হয়েছে রে বাবা? আমায় তোমরা এখানে এত খাতির-যত্ন করে বসিয়ে রেখেছ কেন?
মেহরাজ এশার গলা শুনে এশার পানে তাকিয়ে বলে—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— তোমায় বিয়ে করব বলে।
এমন কথা শুনে এশার হুশ উড়ে যায়! থমকে গিয়ে এক পলক মেহরাজের পানে তাকায়, ফের মেহরুবের পানে তাকায় আর বলে—
— বাবা মেহরুব, তোমার ভাই এসব কী বলছে? আমায় বিয়ে করবে মানে?
মেহরাজ এক চিলতে হেসে বলে—
— আমার বোনকে যেমন তোমার ভাই কলঙ্কিত করেছে, তোমাকেও আমি আজ থেকে পদে পদে কলঙ্কিত করব, এশা তালুকদার!
এশা মেহরাজের কথা শুনে ভয় পায় না, উল্টো তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে—

—! স্বপ্ন দেখতে থাক বাবা, মেহরাজ! তুই ভুলে যাস না, এহসান তালুকদারের বোন আমি!
মেহরাজ কোনো কথা বলে না, চুপচাপ নিজের পিস্তল বের করে এশার কপালে ঠেকিয়ে বলে—
— মা, এশা বউ হবে একটু পর তুমি আমার, তাই বাবা টা সাথে লাগিও না।
এশা পিস্তল দেখে বেশ ঘাবড়ে যায়। যদি চালিয়ে দেয় মেহরাজ?
মেহরাজ এশাকে দেখতে পারছে না, দেখবে কী করে? সম্পূর্ণ সহি পর্দা করা! তবে বুঝতে পারছে, এশা ঘাবড়ে গেছে। মেহরাজ এটা বুঝতে পেরে কাজি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে—
— শুরু করুন।

কাজি সাহেব বলেন—
— জ্বি, শুরু করব। দেনমোহর কত দেব?
মেহরাজ মেহরুবের দিকে তাকিয়ে বলে—
— যতই হোক, ও তো আমার সাথেই থাকতে হবে এ জীবন! তাই কত দেওয়া যায়, দেনমোহর বল তো?
মেহরুব একটু ভেবে বলে—
— বিশ দিয়ে দাও।
মেহরাজ এক পলক এশার পানে তাকিয়ে কাজিকে বলে—
— বিশ লক্ষই দিয়ে দিন।
কাজি মাথা নাড়িয়ে লিখতে শুরু করেন!
এশা আমতা-আমতা করে বলে—
— মেহরাজ, ভুল করছো! এর জন্য তোমায় মৃত্যুর চেয়েও বড় শাস্তি পেতে হবে! ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দাও আমায়।
মেহরাজ বলে উঠে—

— আমার মরণের ভয় নেই! তোমার ভাই যে নরপশু, ঐটা আমি জানি! তাও শেষ চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?
এশা মেহরাজকে বলে—
— যত যাই করো, মেহনূর শুধু আমার ভাইজানের! আমায় ফেরে ফেললেও তুমি মেহনূরকে পাবে না, আর ফেরত, ভাতিজা!
মেহরাজের খুব রাগ হয় এশার এমন কথায়! পিস্তলের ট্রিগারে শক্ত করে আঙুল রেখে বলে—
— আমি কোনো দিক দিয়ে তোমার ভাতিজা হই? এই দেশেরই না আমি! আর আমার বোনকেও আমি নিজের কাছে নিয়ে নেব! আর তোমাকেও নিজের অর্ধাঙ্গিনী করে আমার করে রাখব!
এশা এবার কেঁদে উঠে আর বলে—
— দেখো, আমি সাদামাটা চলি। দয়া করে আমার জীবনটা এই নোংরা খেলায় শেষ করো না!
মেহরাজ তিক্ত হেসে বলে—

— আমার বোনও সাদামাটা ছিল, কিন্তু তাও তোমার ভাই আমার বোনকে নিজের নোংরামিতে ফাঁসিয়েছে!
এশা কিছুটা চিৎকার করে বলে—
— আমার ভাইজান মেহনূরকে ভালোবাসে, তাই বিয়ে করেছে! কিন্তু তুমি কেন এমন করছ? শুধু প্রতিশোধ নিতে? ছিঃ!
মেহরাজ বলে—
— সমস্যা কী? তোমার ভাই আমার বোনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, আর তোমাকে বিয়ের পর ভালোবাসব! হবে তো!
এশা এত বিকৃত কথা শুনে চিৎকার করে বলে—
— আমি তোকে বিয়ে করব না! মরে গেলেও করব না!
কাজি মেহরাজকে একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বলেন—
— সই করুন উভয় জনে।
মেহরাজ পেপারটা হাতে নিয়ে একটুও দেরি না করে বিসমিল্লাহ বলে সই করে দেয়। অতঃপর এশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—

— নাও, চুপচাপ সই করে নাও।
এশা মেহরাজের কথায় তাচ্ছিল্য করে বলে—
— স্বপ্ন দেখ বাবা তুই! এটা স্বপ্নেই সম্ভব!
এই “বাবা” ডাক শুনে মেহরাজের ভীষণ রাগ হয়! এক লাফে চেয়ার থেকে উঠে, উক্ত চেয়ারেই জোরে লাথি মেরে এশার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে—
— এশার বাচ্চা, যদি আর একটা শব্দ ব্যয় করিস তো তোর জানাজা পড়ব এখানে! চুপচাপ সই করে নে আর আমার বেগম হয়ে যা!
মেহরাজের এমন রাগ দেখে এশা ভয় না পেয়ে উল্টো তাচ্ছিল্য করে বলে—
— যা ইচ্ছে করে নে বাবা, আমি এটা করব না!
মেহরাজ নিজের পিস্তল বের করে বসে থাকা কাজির মাথায় ধরে দাঁত চেপে বলে—
— যদি সই না করিস, তো এটাও যাবে! সাথে তুইও!
এশার ভয় লাগে! কারণ পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নেই, কী থেকে কী করে ফেলে না জানি! নিজের জন্য ভয় লাগছে না, এশার কাজির জন্য ভয় লাগছে!
এশা কাঁপা গলায় বলে—
— দাও।

মেহরাজ মেহরুবকে ইশারা করতেই মেহরুব মাটিতে পড়ে থাকা বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারটা এশার হাতে তুলে দেয়, সাথে একটা কলম।
এশা সই করতে নেয়, কিন্তু ওর হাত কাঁপতে থাকে! ভয়াবহ কাঁপতে থাকে! এশা কোনো রকমে কলম বসাতে পারছে না কাগজে!
মেহরাজ এশার এত সময় নিতে দেখে ধমক দিয়ে বলে—
— কী হলো? এত দেরি হচ্ছে কেন?
এশা মেহরাজের ধমকে কেঁপে উঠে, বোকার মতো মেহরাজের দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে—
— এক কাজ করো, বিয়েটা যেহেতু তুমি নিজের প্রতিশোধের জন্য করছ, তাই আমার সইটা তুমি করে নাও! আমার হাত অবশ হয়ে গেছে, সই হচ্ছে না!
এশার এমন কথা শুনে মেহরাজ-মেহরুব দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে! মানে সে নিজেই নিজেকে বিয়ে করবে!
মেহরাজ এশাকে এবার ধমক দিয়ে বলে—

— সাইন করবি না? কাজিকে উড়িয়ে দেব!
মেহরাজের কথায় কিছু বলে না,
এশা চুপচাপ কাগজে সই করে দিল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু সে নিজের সইটা শেষ করেই মাথা নিচু করে রাখল। মুহূর্তেই কাগজটা মেহরাজের হাতে চলে যায়। মেহরাজ সেই কাগজ সামনে ধরে, এক তৃপ্ত হাসি হাসল, যেন সে কোনো জয়ের মুকুট পরেছে।
কাজি সাহেব তখন তার ধীমান আওয়াজে বলেন, — কবুল বলো, মা।
এশা সোজা দাঁড়িয়ে যায় এবং কাজি সাহেবকে এক রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— এসব, কবুল বলার প্রয়োজন নেই! ওর কাজ ছিল আমায় বিয়ে করা, সে তো করে নিয়েছে। প্রতিশোধ পূর্ণ করে নিয়েছে।
এশার কথা শোনে কাজি সাহেব কিছু বলার আগেই মেহরুবের দিকে তাকায় এবং রেগে গিয়ে বলে এশা,
— এবার আমায় বাড়ি যেতে দেও, তোমার ভাই তো বিয়ে করে নিয়েছে, সব শেষ তো হলো।
মেহরাজের চোখের আগুন যেন আরো জ্বলে ওঠে। তার মনের অন্ধকার আগুন বেমালুম জ্বলে ওঠে। সে ধমক দিয়ে বলে

, — সব শেষ হয়নি! তোমায় বিয়ে করে নিয়ে চার বাচ্চার মা যতদিন না বানাচ্ছি, ততদিন কিছুই শেষ হবে না।
এশা শুনে থমকে যায়। সে এক মুহূর্তের জন্য কিছু বলার সাহস পায় না। তার চোখ বড় হয়ে যায়, যেন তাকে আরও কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বুঝতে হচ্ছে। মেহরাজের কথা শুনে তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে যায়, সে ভাবতেই পারেনি যে, মেহরাজ এমন কিছু বলবে।
“এটা কি বলছে সে?” সে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে। “কি এক অদ্ভুত শর্ত দিয়ে যাচ্ছে? আমি তো ভেবেছিলাম শুধু বিয়ে করেই ছেড়ে দেবে, কিন্তু এটা কি হচ্ছে!”
এশার চোখে চরম শঙ্কা আর হতাশার ছায়া ঝলকাতে থাকে। তার কপালে কুন্ডলী পাকানো শোকের রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এশাকে অনেক ভয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে নিয়েছে মেহরাজ! বর্তমানে ওকে নিয়ে একটা রিসোর্টে উঠেছে, কিন্তু এশার জ্ঞান নেই—অজ্ঞান করেই নিয়ে এসেছে!
রিসোর্টের রুমে এসে এশাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গোসল করতে যায় মেহরাজ।
গোসল সেরে এসে যখন কক্ষে প্রবেশ করে, তখনই ওর চোখ পড়ে ঘুমন্ত এশার দিকে! রিসোর্টের একজন মেয়ে কর্মীকে বলেছিল যেন এশার বোরকা খুলে দেয়।
এশার পরনে হালকা নীল রঙের একটা থ্রি-পিস। বিছানায় শুয়ে আছে ও, নিস্তব্ধ আর কোমল। নিঃশ্বাসের ওঠানামায় বুকের কাপড় সামান্য কাঁপছে।
মেহরাজ ধীর পায়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে এশার দিকে।
ওর ভেতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করছে! এ মেয়েটাকে ভয় দেখিয়েছে, কাঁদিয়েছে, জোর করে নিজের অধিকার নিয়েছে—তবুও কেন এত শান্ত, এত কোমল লাগছে ওকে?
একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয় মেহরাজ। তারপর ধপ করে পাশে বসে পড়ে।
এবার স্পষ্ট দেখতে পায় ও—উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের তার বেগম, গালে টোল পড়ার মতো একটা কাটা দাগ! দেখে মনে হচ্ছে, ঘুমের মধ্যেই মুচকি হাসছে! যেন কোনো স্বপ্ন দেখছে, কিংবা হয়তো কেবল ওর মনের মায়ায় এমনটা মনে হচ্ছে!
মেহরাজ এশাকে দেখে নিজের অজান্তেই ফিসফিস করে বলে,

— এত মায়াবতী একজন তোর কপালে থাকবে, সেটা কল্পনার বাইরে, মেহরাজ! দেখ, কতটা ভয়ংকর সুন্দর তোর বেগম! তুই সবদিক দিয়েই জিতে গেছিস! বোনকেও পেয়ে যাবি, সাথে এত সুন্দরী বউ তো ফ্রি!
নিজেই নিজেকে এসব বলে আপন মনে হাসে মেহরাজ! কিন্তু হাসিটা বেশি স্থায়ী হয় না। বুকের কোথাও যেন একটা খচখচে কাঁটা বিঁধে যায়।
এশাকে দেখে একবার মনে হয়—ওকে আঘাত দেওয়া ঠিক হচ্ছে না! আরেকবার মনে হয়, ওর হাতেই তো নিজের জীবন সঁপে দিয়েছে!
অতঃপর কী একটা মনে করে ঠোঁট কামড়ে হেসে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে এশার পাশে বসে।
এশার পাশে বসে কিছু মুহূর্ত ওর দিকে এক দুষ্টু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর মলিন গলায় বলে,
— মাফ করো… আমি চাই না কখনোই কোনো নারীকে অসম্মান করতে। কিন্তু এটা করতেই হবে।
সেই মুহূর্তে এশার হাত মৃদু কেঁপে ওঠে। মেহরাজের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে! এশা কি জেগে গেল?
ও কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে! না, এশা এখনো গভীর ঘুমে।

কিন্তু মেহরাজের হাত কাঁপতে শুরু করেছে! মনে হচ্ছে, কোনো অজানা এক ভয় ওকে জড়িয়ে ধরেছে!
এশাকে আঘাত দিতে গিয়ে কেন যেন নিজেই আঘাত পাচ্ছে মেহরাজ!
মেহরাজ কাঁপা হাতে এশার শরীর থেকে আলতো করে কামিজ সরিয়ে নেয়! অতঃপর কিছু ছবি তুলে নেয়! ছবি তোলা শেষ হতেই সাথে সাথে এশার জামা ঠিক করে দেয়! নিজের উপর ঘৃণা লাগছে মেহরাজের, এসব করতে, কিন্তু এটাই একমাত্র পথ এহসানকে থামানোর, নয়তো এহসান আর ওকে এ দুনিয়ায় থাকতে দেবে না!
মেহরাজ নিজের ফোন পাশে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এশার দিকে এবং ওকে ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ওর দিকে ঝুঁকতে থাকে!
ঠিক তখনই এশার জ্ঞান ফিরে! চোখ খুলে মেহরাজকে নিজের এত কাছে দেখে এশা কিছু মুহূর্ত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, তারপর কিছু বুঝে উঠতে না পেরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় মেহরাজের গালে আর চিৎকার করে বলে,

— আমার অনুমতি ছাড়া আমায় দেখার অধিকার কে দিল?!
নরম হাতের হঠাৎ গরম থাপ্পড় খেয়ে মেহরাজ এশার থেকে ছিটকে সরে যায় আর নিজের গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— ভালো করে বললে পারতে না?
এশা এসবে পাত্তা না দিয়ে যখন নিজের গায়ে ওড়না দেখতে পায় না, তখন বিশ্রীভাবে রেগে বলে,
— এই কাপুরুষের কাপুরুষ! আমার ওড়না কই? আমার বোরকা কেন খুলেছিস?
এশার এমন গালাগালি শুনে মেহরাজ বেশ চটে যায়। মেয়ে মানুষ হয়ে এত গালাগালি কেন করবে? সে তো ছেলে মানুষ হয়েও এত গালাগালি করে না!
মেহরাজ রেগে গিয়ে এশার হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে আর বলে,
— আর একটা গালি দিলেই তোমার সাথে আমার হয়ে যাবে একটা! আর তোমার বোরকা কেন? সব খোলার অধিকার পেয়ে গেছি আমি, বুঝেছো?
এশা রেগে দাঁত চেপে বলে,

— বালের অধিকার পেয়েছো তুমি! জোর করে বিয়ে করেছিস! আমি এই বিয়ে মানি না! তুই আমায় কেন দেখলি? বল! আমার মাহরাম ছাড়া আমায় কেউ দেখেনি জীবনে! তাহলে এত বড় দায় আমার গায়ে কেন দিলি?!
মেহরাজ রেগে ফুঁসে বলে,
— তোমার মাহরামদের বড় মাহরাম আমিই! তাই এত দায় একে দেওয়ার কিছু নেই! আর একটা গালি দিলে মুখ ভেঙে দেব, অসভ্য মেয়ে!
এশা মেহরাজের চোখে চোখ রেখে বলে,
— তুই কি আমার মুখ ভেঙে দিবি? তোর অস্তিত্বই মুছে দেবে আমার ভাইজান! শুধু জানুক তো একবার! তুই কাপুরুষ! এত বড় কাপুরুষি করেছিস!
মেহরাজ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে এশার ওপর ঝুঁকে বিছানা থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে সেই ছবিগুলো এশার সামনে ধরে!
এশার হাত-পা কাঁপতে থাকে! যদিও ছবিগুলো অতটাও খারাপ না—তার বোরকা নেই, হালকা পেট দেখা যাচ্ছে, ওড়না নেই বুকে! এশার কাছে এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না! এশা নিজের মুখ চেপে ধরে নিজের এমন অবস্থা দেখে!
মেহরাজ তাচ্ছিল্য করে বলে,

— মেয়ে, তোমার ভাইজান আসলে যদি যেতে চাও, তো এ ছবি গুলো আমার সাথে সাথে আমার বিদেশি যত ফ্রেন্ড আছে তারাও দেখবে! আর মনে রেখো, সাথে সারা দেশও!
এশা নিজের মুখ চেপে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে শুধু হতভম্ব হয়ে একবার মেহরাজের দিকে তাকায়, তো একবার নিজের ছবির দিকে। এশা আর ঠিক থাকতে পারে না, ডুকরে কেঁদে বলে,
— কী করে পারলে এমন কিছু ভাবতে?! আমার মতো তোমারও তো একটা বোন আছে! তুমি কি একবারও ভাবোনি, সে যদি এমন কিছুর শিকার হতো, তার কেমন লাগতো?!
মেহরাজের খুব খারাপ লাগে এশার এ অবস্থা দেখে! সে সত্যি এমন কিছু চায়নি, কিন্তু এশাকে নিজের করে নেওয়া, সাথে মেহনূরকে ফিরিয়ে নিতে এটা প্রয়োজন! মেহরাজ এশাকে শান্ত গলায় বলে,
— তোমার ভাইজানের কাছে থেকে আমার বোন হয়তো এর চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে!
এশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,

— আমার ভাইজান মেহনূরকে হয়তো এখনো ভালো মতো ছোঁয়নি! আর এত বড় অপবাদ দিচ্ছো!
মেহরাজ রেগে ফেটে পড়ে বলে,
— তুমি কি তাদের কক্ষে প্রবেশ করে তা দেখেছো যে এত সাফাই গাইছো?!
এশা কান্না করতে করতে দু’পাশে মাথা নাড়াতে নাড়াতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে,
— মেহনূরের কাপড় বদলানোর প্রয়োজন হলে ভাইজান সবসময় আমায় নিয়ে যেত! আমিই বদলে দিতাম! এসব কিছুই ভাইজান তোমার বোনের সাথে করেনি! সে তো যত্নের চেয়েও যত্ন রেখেছে!
মেহরাজ চমকে গিয়ে বলে,
— তাহলে আমার বোন তোমার ভাইয়ের বাচ্চার মা হলো কীভাবে?!
এশা চোখের জল মুছে মাথা নাড়িয়ে বলে,
— এসব মিথ্যা! এসব কিছু হয়নি! মেহনূর আমায় সব বলে! সব মিথ্যা!

এ বলে এশা নিজের কপাল চাপড়ে কেঁদে উঠে। অন্যের বোনকে তার ভাইজান জোর করে বিয়ে করেছিল, আর আজ একই ঘটনা তার সঙ্গে আরও নির্মমভাবে ঘটল! তার শ্লীলতাহানি অবধি হয়ে গেল!
এশাকে এমন অবস্থায় কাঁদতে দেখে মেহরাজ ওকে বুঝিয়ে বলতে নেয়—
— দে… দে… দেখো, তুমি যতটা খারাপ…
আর কিছু বলতে পারে না মেহরাজ। সাথে সাথে তার গালে আরেকটি থাপ্পড় পড়ে যায়—এশার নরম হাতের!
এশা দাঁত চেপে চিৎকার করে বলে—
— ভাইজানরা তোদের এমনি এমনি কাপুরুষ বলে না! তোদের আমলেই তোদের কাপুরুষ বলে! কাপুরুষের দল! লজ্জা করে না এমন নিচ কাজ করতে? এর চেয়ে তুই আমায় মেরে ফেল, এটা ভালো হবে! তাও আমার ইজ্জত নিয়ে খেলিস না!

মেহরাজ এবার রেগে গিয়ে এশার দুই বাহু শক্ত করে ধরে বলে—
— তোমায় মারব না! তোমায় সারাজীবন রেখে দেব! আর গোটা জীবন তোমার ইজ্জতের অধিকার হয়ে বাঁচব!
এশার রাগে-ঘৃণায় গা জ্বলে উঠছে! সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চিৎকার করে বলে—
— আমায় ছুঁবি না! বলে দিলাম, ছাড়! বলছি, ছাড়!
মেহরাজ দাঁত চেপে এশার বাহু আরও শক্ত করে ধরে, এক টানে নিজের মুখের সামনে নিয়ে এসে এশার চোখে চোখ রেখে বলে—
— তোমায় শুধু ছুঁবই না! তোমার সঙ্গে কিছু আলাদা মুহূর্তও কাটাবো, আজ এই রাতেই, এশা তালুকদার!
এশার শরীর রাগে কাঁপতে থাকে! ঠোঁট, চোখ, মুখ—সবকিছু রাগে ঝলসে যেতে থাকে!
এশা কাঁপতে কাঁপতে বলে—

— এসবের সাহসও করিস না! নয়তো অকালে, অপ্রস্তুতভাবে প্রাণ দিবি!
মেহরাজ এসবে পাত্তা দেয় না! উল্টো নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় এশার কাঁপতে থাকা ঠোঁটে! আর তার স্বাদ নিতে থাকে! জীবনের প্রথম কোনো মেয়েকে এভাবে আঁকড়ে ধরল মেহরাজ! আর সে মেয়েটাই তার স্ত্রী!
এশা নিজেকে ছাড়াতে না পেরে খাবলে ধরে মেহরাজের দুই কাঁধ, নিজের দুই হাত দিয়ে! কিন্তু মেহরাজ তাতে দমে না! বরং আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এশার অধরখানা!
এশার চোখ দিয়ে স্রোতের মতো পানি ঝরছে! আর নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছে!
— কেন এ বংশে জন্ম নিলাম? যদি এ বংশে জন্ম না নিতাম, তাহলে এমন কিছুর শিকার হতাম না!
এশার থেকে নিজেকে সামলে সরে আসে মেহরাজ! তারপর হেসে, ঠোঁটে একচিলতে হাসি টেনে এশার ঠোঁটে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—

— এই অধরখানা এখন থেকে আমার দখলে নিলাম! যখন ইচ্ছে, তখন আমার আওতায় থাকবে তোমার এই অধর! মনে রেখো, মেয়ে!
এশা আর কিছু বলে না। পাথরের মতো চুপচাপ বসে থাকে! কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে, তারপর আগের মতোই বালিশে মাথা রাখে! নিজেকে পুতুল মনে হচ্ছে! প্রাণহীন পুতুল!
এশাকে এভাবে নিস্তেজ হয়ে যেতে দেখে মেহরাজ উঠে গিয়ে ওর মাথার পাশে বসে! তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে—
— মনে রেখো, মেয়ে! তোমার ভাইজান হয়তো কিছু সময়ের মধ্যে চলে আসতে পারে আমাদের খোঁজ নিতে! তবে তুমি যদি কোনো চালাকি করো, তাহলে তোমার ছবিগুলো কিন্তু রয়েছে আমার কাছে!
এশা শুধু শুনে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না! চুপ করে থাকে!
মেহরাজ নিজের দুই হাত এশার বাহুতে রাখে! অতঃপর হালকা ঝুঁকে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে এশার ডান গালে নিজের গাল বসিয়ে দেয়!
এশা কেঁপে ওঠে! এমন ভয়ংকর, বাজে পরিস্থিতিতে পড়ে ভয়ে নিজের এক হাতে বিছানার চাদর আর অন্য হাতে নিজের হাঁটু খামচে ধরে!
মেহরাজ নিজের গাল এশার গালে বারবার স্পর্শ করিয়ে বলে—

— মনে রেখো, তুমি এখন থেকে আমার স্ত্রী! তাই ভুলেও ভাইজানের সাথে যেতে নিও না! নয়তো…
এশা এবার মুখ খুলে বলে—
— নয়তো কী? আমায় নিজের বিদেশি বন্ধুদের কাছে বিক্রি করে দেবে?
মেহরাজের ভেতর ধক করে ওঠে! সে ভালো করেই বুঝতে পারে, এশা তাকে ঠিক কতটা ঘৃণ্যভাবে নিচু চোখে দেখছে!
মেহরাজ এশার গালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে বলে—
— নাহ! তবে বিক্রির যে কাজটি ভেবেছো, সেই কাজটি আমি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ করব!
এশা তীব্র ঘৃণায় কেঁপে ওঠে! তারপর কঠিন গলায় বলে—
— ভোগ করা শেষে তালাক দেবে আমায়?
মেহরাজ এশার এমন উক্তি শুনে হেসে, একইভাবে এশার গালে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করিয়ে বলে—
— তুমি স্ত্রী হও আমার! আর স্ত্রী ভোগের পাত্রী নয়! ভালোবাসার পাত্রী হয়! তাই ইহকালে তোমাকে তালাক দেওয়া অসম্ভব!

এশা আর কোনো কথা বলে না! চুপ হয়ে যায়! যেন পুরো ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে! প্রাণ নেই কোথাও!
মেহরাজ এশাকে ছেড়ে দেয় না! বিছানায় এশার পাশে শুয়ে পড়ে! শুধু পাশে শোয় না—এশাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে! পিছন থেকে ওর ঘাড়ে মুখ বুজে ফিসফিসিয়ে বলে—
— একদম নড়ো না! জীবনের প্রথম আমি নারীর সংস্পর্শে এসেছি! তাই আমায় তোমাতে হারিয়ে যেতে দাও!
এশা এবার চিৎকার করে উঠে! মেহরাজের হাত খাবলে ধরে বলে—
— আমায় ছাড়! কাপুরুষের কাপুরুষ! ছাড় বলছি! নয়তো থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে দেব!
মেহরাজ এশার এমন গালি শুনে তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে! ওর ঘাড়ে নাক-মুখ বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—
— চুপচাপ শোয়ে থাকো, মেয়ে! নয়তো আমি আমার পুরুষত্ব দেখিয়ে দেব!
এশা ছটফট করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ে!

— ছাড় আমায়! ঘৃণা করছে! তোর হারাম স্পর্শ আমায় ছুঁয়েছে! ছাড় বলছি!
মেহরাজ এবার আর না পেরে এশাকে এক টানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়! এশার চোখের পানি নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দেয়! অতঃপর কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে!
হঠাৎই এশার বুকে মাথা গুঁজে দেয় মেহরাজ
এশা মেহরাজকে নিজের থেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করে! কিন্তু মেহরাজ তাকে আরও শক্ত করে ধরে রাখে!
এশা চিৎকার করে মেহরাজকে নিজের থেকে সরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু তা সম্ভব হয় না!
মেহরাজ আরও শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে—
— বউ, এমন করো না! তোমার বুকেই তো আমার শেষ ঠাঁই…

অন্যদিকে…
মেহনূর রান্নাঘরে ব্যস্ত। এহসান ঘুমিয়ে আছে। তার জ্বর কিছুটা কমেছে, তবে এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি, তাই আজ কাজে যায়নি।
মেহনূর আস্তে আস্তে কক্ষে প্রবেশ করে। এহসানের প্রশান্ত মুখ দেখে বোঝা যায়, সে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।
নিঃশব্দে বিছানার কাছে এগিয়ে যায় মেহনূর। বালিশের পাশ থেকে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে এহসানের ফোনটি তুলে নেয়। ভেতরে এক অজানা ভয় কাজ করছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও হাত কাঁপতে কাঁপতে ফোনের লক খুলে ফেলে!
এহসান এত গভীর ঘুমে আছে যে কিছুই টের পায় না!
ফোন হাতে নিয়ে মেহনূর রান্নাঘরে ফিরে আসে। বুক ধুকধুক করছে! দেরি না করে দ্রুত মেহরুবকে ফোন দেয়!
সে ভেবেছিল, হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবে, কিন্তু মেহরুব যা বলল, তা শুনে যেন দম বন্ধ হয়ে এলো! বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা নেমে এলো!
মেহরুব স্পষ্ট বলে দেয়—
— এশাকে বড় ভাইজান বিয়ে করেছে!
এই এক বাক্যে যেন পায়ের নিচের মাটি সরে গেল!

আত্মার আগলে পর্ব ৩০

মেহনূর কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না! কতটা ভয়ংকর মৃত্যু দেবে এহসান মেহরাজকে? এহসান… যদি জানতে পারে, তাহলে কী করবে? আল্লাহই জানেন!
আর বেচারী এশার সাথেই বা কী ঘটল?
জোর করে বিয়ে করা মানে কতটা যন্ত্রণা, কতটা নিঃস্ব হয়ে যায় একজন মানুষ, কতটা ঘৃণা জমে যায় অন্তরের গহীনে—মেহনূর খুব ভালো করেই জানে!
কিন্তু এখন বড় প্রশ্ন—
এহসান কি বাঁচিয়ে রাখবে মেহরাজকে, যদি সত্যিটা জানতে পারে?
মেহনূরের সারা শরীর কাঁপতে থাকে! পায়ের নিচের জমিন যেন ধসে গেছে! চারপাশের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে…

আত্মার আগলে পর্ব ৩২