আত্মার আগলে পর্ব ৩৩
সানজিদা আক্তার মুন্নী
এশার মুখে এমন বাজে গালি শুনে মেহরাজ থতমত খেয়ে যায়। মানে, মেয়ে মানুষ এত গালাগালি কীভাবে করে! কীভাবে এমন কথা মুখ দিয়ে বের হয়!
মেহরাজ এশার থুতনি আলতো করে চেপে ধরে বলে,
—“এশার, বাচ্চা, এত গালাগালি করিস না, নয়তো দাঁত ফেলে দেব।”
এশা উল্টো দাঁত চেপে বলে,
—“বিছানা থেকে নেমে যা, নয়তো উষ্টা মেরে মাটিতে ফেলে দেব!”
মেহরাজ আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে যায়, গিয়ে সোফায় শোয়ে পড়ে। এশার গালাগালি শুনে তার ঘুম চলে আসছে।
মেহরুব গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে এক মনঃক্ষুণ্ণ অবস্থা নিয়ে ছাঁদের দিকে এগিয়ে । ঘুম আসছিল না, মনও অস্থির। ছাঁদে ওঠার পর তার চোখে পড়ে নূরি, আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা, যেন তার সব ভাবনা শূন্যে উড়ে যাচ্ছে।
মেহরুব অবচেতনভাবে হেঁটে এসে হালকা ঘাবড়েই গেছে নূরি কে দেখে, তবে ঠিক যেন কিছু একটা অনুভব করে নূরির সামনে দাঁড়িয়ে রাগ তো অনুভব হলো না, বরং এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে মুখে।
এমন সময় সে নূরির দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে—
— “কি রে, এত রাতে ছাঁদে কি করছিস?”
নূরি একপলক তাকিয়ে বলল—
— “ঘুম আসছিল না, তাই…”
মেহরুবের চোখ নূরির হাতে গেল। তার সাদা হাতে লাল লাল দাগ, যেন কিছু হয়েছে। মেহরুব ঘাবড়ে গিয়ে বলল—
— “হাতে কী দাগ এগুলো?”
নূরি এক মুহূর্তে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “ও… এটা এশা আপুকে মেহেদী দিতে গিয়ে লেগে গেছে।”
মেহরুব কিছুটা হালকা হয়ে বলল—
— “আহ, তোরও তো মেহেদী দেওয়া উচিত ছিল! বাড়ির সব পিচ্চি তো এশার সাথে মেখেছে।”
নূরি মলিন হেসে বলল—
— “এশা আপু মেহেদী পড়েছে নিজের মাহরামের জন্য, আর পিচ্চিরা পড়েছে শখের জন্য। আমার তো কিছুই নেই, তাহলে আমি কেনো পড়ব?”
মেহরুবের মুখ মলিন হয়ে গেলো কথাগুলো যেন মেহরুবের অন্তরে তীক্ষ্ণ সুচের মতো বিঁধে গেল। তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত অস্থিরতা নিয়ে বলল—
— “মেহেদী কি শুধু মাহরামের জন্য পড়তে হবে? শখের জন্য পড়া যায় না?”
নূরি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল—
— “শখের জন্য মেহেদী পড়া, আর হারাম পুরুষদের সামনে চলাফেরা করা, এটা ঠিক আমার মনে হয় না।”
মেহরুব এক পলকও বিরতি না দিয়ে অবাক হয়ে বলে—
— “তুই হারাম পুরুষ পেলি কোথায়? তোর গায়রে মাহরাম তো শুধু ভাইজান আছে, আর ভাইজানের সামনে তো তুই যাস না!”
নূরি এক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে এরপর মুখ ফিরিয়ে বলে—
— “ভাইজানের সামনে যাই না, কিন্তু আপনি আপনার সামনে তো যাই!”
মেহরুব কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে—
— “তাহলে তুই আমায় কোনভাবে তোর জন্য হারাম বলছিস?”
নূরি মলিন হাসি দিয়ে বলে—
— “আর বলব কেন? আপনি তো আমার জন্য হারাম চাচাতো ভাই হন। আপনি আমার কাছে হারাম তো হবেই!”
মেহরুবের শরীর রাগে টান দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে সে যেন নিজের পুরোটা হারাতে চলেছে।
নূর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় “! বেশ বুঝতে পারে তাড মেহরুব ভাই ক্ষেপে গেছে তার এই কথায়”!
নূরি চলে যাচ্ছিল, তবে মেহরুব তাকে থামিয়ে দেয়।
সে এক টানে নূরির বাহু ধরে দাঁত চেপে বলে—
— “তোর সাহস হয় কী রে, আমায় হারাম বলার? তোর এত বড় কলিজা হয় কী রে?”
নূরি বেশ ঘাবড়ে গেল, কিন্তু তবুও মেহরুবের দিকে তাকিয়ে বলল—
— “দেখুন, মেহরুব ভাই, সত্যটা আমি জানি, আর আপনিও জানেন। তাই এত রাগ করার কিছু নেই।”
মেহরুব দাঁত চেপে বলল—
— “সত্যটা কী?”
নূরি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সে হতভম্ব হয়ে মেহরুবের দিকে তাকায়, কেন সে এমন করছে। অবশেষে মেহরুবের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সে কাঁপতে কাঁপতে বলল—
— “সত্য এটাই যে, আপনি আমার মাহরাম, আপনার অধীনে আমি। তবে শুধু নামে মাত্র।”
মেহরুব কাঠ গলায় বলল—
— “নামে হই আর কাজে, আমিই তোর মাহরাম। আমি তোর জন্য হালাল, আর যদি কোনোদিন আমায় হারাম বলবি, তো দেখে নিস তোর কী অবস্থা করি!”
নূরির মনটা ভারী হয়ে গেল। এতদিন তার সাথে কোনো সঠিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি, আর আজ মেহরুব তাকে এমনভাবে অধিকার দেখাচ্ছে। সারা জীবনের ঝক্কি, যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছে, আর আজ তাকে হালাল বলা হচ্ছে। নূরির চোখে এক কালো মেঘে ঢেকে গেল সব কিছু।
নূরি মলিন গলায় বলল—
— “আপনি অহেতুক অধিকার কেন দেখাচ্ছেন আমার উপর? সত্যি কারে তো, আমাদের কোনো সম্পর্কই নেই!”
মেহরুব একটুও সঁজিয়ে না বলল—
— “কেন নেই? আমাদের সম্পর্ক তো আছে…”
নূরি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল—
— “কি সম্পর্ক?”
মেহরুব কিছু সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল—
— “একটা পবিএ সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক, কিন্তু আমি সেই সম্পর্ককে মূল দেই না।”
নূরি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে—
— “যে সম্পর্কের মূল দেন না, তার ভিত্তিতে আপনি আমার উপর অধিকার দেখাচ্ছেন? আপনি কি জানেন, মেহরুব ভাই, আপনি কী করছেন?”
মেহরুব তার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল—
— “আমি সম্পর্কের মূল দিই আর না দিই, তবে এটা জানি, তুই শুধু আমার অধীনে, আর তোর উপর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে আমার। আর আমার উপরও তোর অধিকার রয়েছে।”
নূরি চমকে উঠল। এতক্ষণ তার মধ্যে কোনো অনুভূতি ছিল না, কিন্তু মেহরুবের এই কথাগুলো তাকে একেবারে স্তব্ধ করে দেয় তাকে।
নূরি মৃদু গলায় বলল—
— “মেহরুব ভাই, কী হয়েছে আপনার? এমন আজব কথা বলছেন কেন?”
মেহরুব হতাশ গলায় বলল—
— “জানি না কী হচ্ছে… কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে… সবসময় তোকে দেখতে ইচ্ছে হয়, তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়, জানি না কেন এমন হচ্ছে… কাজে গেলে.. কাজেও মন বসে না, বাড়িতে চলে আসতে মন চায়, এক পলক তোকে দেখলেই সব ঠিক হয়ে যায়… জানি না, আমি ঘুমাতে গেলেও ঘুম আসে না… ভেতরটা খচখচ করে।”
নূরি কিছু সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেহরুবের কথাগুলো তার শোনার মতো ছিল না, কিন্তু কিছু না বলারও ছিল না।
🌸☘️ ফজরের পর🌸☘️
ফজরের নামাজ শেষে মেহরাজ ঘরে প্রবেশ করে। চারপাশে একরকম নীরবতা। তখনই ওর ফোনটা বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আসে এক পরিচিত কণ্ঠ—
— “আমার বোন কোথায়?”
মেহরাজ বুঝে যায় কার কণ্ঠ। একবার পাশ ফিরে তাকায় জায়নামাজে বসে থাকা এশার দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে—
— “ঘুমাচ্ছে।”
অথচ এশা তখনো জায়নামাজে বসে। মেহরাজের এই কথায় ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। ঠোঁট দুটো অল্প কাঁপে যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু নিজেকে সামলায়। তারপর উঠে এগিয়ে আসে
ওপাশ থেকে এহসানের দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে—
— “কেমন আছে ও?”
মেহরাজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দেয়,
— “ভালো। নাও কথা বলো।”
এই বলে সে এশার দিকে ফোন এগিয়ে দেয়। ক্ষিপ্ত দৃষ্টির এশা এবার নিজেকে শান্ত করে ফোন হাতে নেয়।
— “আসসালামু আলাইকুম ভাইজান।”
— “ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস?”
— “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
— “তোর সাথে কেউ বাজে ব্যবহার করছে না তো?”
— “না ভাইজান, সব ঠিক আছে।”
এ কথার মাঝেই হঠাৎ মেহরাজ পেছন থেকে এশার কোমর জড়িয়ে ধরে। এশার চোখ বড় হয়ে যায়। ভাইয়ের সাথে কথা বলছে, কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। তার গলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে, অথচ মেহরাজ ইচ্ছে মতো ওর ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়াতে থাকে।
এশা দাঁতে দাঁত চেপে ভাইয়ের সাথে কথা চালিয়ে যায়। একসময় কোনো রকমে ফোন রেখে দেয়। পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে—
— “ইবলিশের ইবলিশ! আজ তোর একদিন, তো আমার একদিন!”
কিন্তু মেহরাজ থামার পাত্র নয়। নিজের দুষ্টু হাসি ঠোঁটে রেখে এগোতেই এশা রাগে ফেটে পড়ে। এক মুহূর্তে ওর ফোনটা দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারে। ফোনটা গিয়ে ধাক্কা খায় দেয়ালে, পড়ে যায়।
মেহরাজ এবার ফোন হাতে নিয়ে দেখে, ভাগ্য ভালো— ফোন বেঁচে গেছে, তবে আধমরা। সে রেগে গিয়ে এশার দিকে এগিয়ে এসে বলে—
— “কি করেছো দেখো! ফোন পুরো শেষ করে দিলে।”
এশা দাঁত চেপে বলে—
— “এই ফোনেই তো তুই আমার ছবি তুলেছিলি। তাই ভেঙে দিলাম। তুই এমন করলি কেন, যখন আমি কথা বলছিলাম?”
মেহরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে—
— “ঐ ছবির জন্য যদি ফোন ভাঙো, মনে রেখো, এখন থেকে দিনে সাতবার করে ঐ ছবি আমি দেখব।”
এশা চোখ বড় করে তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে বলে—
— “ফোন তো নাই, কী দিয়ে দেখবি মাথা দিয়ে ?”
মেহরাজ এবার মুচকি হেসে টেবিল থেকে ল্যাপটপ এনে বিছানায় রাখে। এশার হাত ধরে বসায়। ল্যাপটপটা অন করে ছবি দেখিয়ে বলে—
— “বউ তুমি কি আমায় বলদ ভেবেছো? এই ছবি আমি আগলে রেখেছি। তুমি সরাসরি দেখতে দিবে না, তো কী হয়েছে? স্ক্রিনে দেখে নেব।”
এশা হুড়মুড় করে ল্যাপটপ হাতে নিতে চাইলেও মেহরাজ ওর হাত চেপে ধরে। তারপর কপালে কয়েকবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ধীর কণ্ঠে বলে—
— “বউ মানুষ তুমি। তোমার এই ছ্যাৎ ছ্যাৎ করা মানায় না। তোমার মানায় শুধু ভালোবাসা দেওয়া আর নেওয়ায়।”
বলতে বলতেই নিজের ঠোঁট রেখে দেয় এশার গালের একপাশ জুড়ে।
এশার ইচ্ছে করে কয়েকটা গালি দিতে। কিন্তু ঠোঁট থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। মেহরাজের এই স্পর্শে যেন অবস হয়ে গেছে সমস্ত শরীর।
ফজর নামাজ শেষে বাগানে হাঁটছে মেহনূর আর আস্তে আস্তে তেলাওয়াত করছে, আপন মনে।
এহসান ঘুমিয়ে আছে। নামাজ পড়ে সাধারণত ঘুমায় না সে, কিন্তু আজ বেশ ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। তাই গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়।
মেহনূর কে একবার বলেছিল, তার বুকে ঘুমাতে। কিন্তু মেহনূরের তো এত প্রেম হজম হয় না। সে তো ছ্যাৎ করে উঠে বলেছিল,
— “নিজের রহমতের বাতাস পাবেন না, সঙ্গে আমায়ও পেতে না দেওয়ার ধান্দা করছেন!”
এহসান এতে আর কিছু বলে না, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেই বেগম ছাড়া ঘুমিয়ে পড়ে।
মেহনূর অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ঘরে প্রবেশ করে। গিয়ে দেখে, এহসান বেদম ঘুমিয়ে তলিয়ে আছে।
মেহনূর ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়, তারপর চোখে তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে।
কত সুন্দর মনে হয় এই ঘুমন্ত মুখের এহসানকে! অথচ বাস্তবতা ভিন্ন, এই পুরুষ হাঁটতে, বসতে, উঠতে মানুষ খুন করে। আর এই পুরুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় কতই না নিষ্পাপ লাগে! মন চায় কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকতে।
কিন্তু আবার ভেতর থেকে প্রশ্ন আসে,
“মেহনূর, তুমি না তো ঘৃণা করো? তবে যাকে ঘৃণা করো, তার পানে কি করে এত মায়ার দৃষ্টিপাত করো? তোমার লজ্জা হয় না? এই খুনির মায়ায় জড়িয়ে যেতে না হয়!”
তুমি বিবেক দিয়ে ভাবো, আবেগ দিয়ে নয়! ভালোবাসলেই মানুষ মানুষ হয় না।
মেহনূরের ভেতরটা উতালপাতাল হয়ে উঠে। এসব ভাবতে ভাবতে, আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে, তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে যায়।
রান্নাঘরে এসে রুটি বানানোর প্রস্তুতি নেয়।
মেহনূর নাস্তা তৈরি করে ঘরে আসে। এসে দেখে, এহসান এখনও ঘুমিয়ে। মেহনূর চুপচাপ কাপড় নিয়ে গোসল করতে বাথরুমে প্রবেশ করে।
এহসানের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে চারদিকে তাকায়, কিন্তু না, কোথাও তার বেগম সাহেব নেই! কিন্তু সে চিন্তিত হয় না। বাথরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ আসছে, দেখে বুঝে যায়, হয়তো গোসল করছে।
এহসান কিছু সময় বিছানায় বসে থাকে, আর শুধু মেহনূরের কথা ভেবে, আপন মনে ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে নির্বোধভাবে।
মেহনূর গোসল সেরে বেরিয়ে আসে। পড়নে তার নীল রঙের থ্রি পিস। মেহনূর বেরিয়ে আসতেই, এহসান ওর পানে তাকায়। সবসময়ই এর মতই, নিজের নারীর নজরকাড়া সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উঠে এহসান।
মেহনূর এহসানকে দেখে কিছু বলে না। নিজের হাতে থাকা কাপড় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে নেয় উদ্দেশ্য কাপড় মেলা।
তখনি, এহসান বিছানা থেকে উঠে, নিজের লুঙ্গির বাজ ঠিক করতে করতে, মেহনূরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
— “কি রে কবুতরের বাচ্চা? রাতে তো আমি গোসল করার মতো কিছু করিনি তোর সাথে। তুই যে এখন এত সকালে গোসল করলি!”
মেহনূর কটমট করে তাকায় এহসানের পানে আর বলে,
— “শুরু হয়ে গেছে খারাপি। এত খারাপ কেনো আপনি?”
এ বলেই, মেহনূর এহসানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এহসান তাকে যেতে দেয়, নাকি মেহনূরের যাওয়ার তাক্কত আছে কি আর?
মেহনূর কাপড় মেলে দেয় উঠানো রশিতে। মেহনূর কাপড় মেলে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই দেখে, এহসান মিসওয়াক করতে করতে বেরিয়ে আসছে।
এহসান মিসওয়াক মুখে নিয়েই, মেহনূরকে বলে,
— “যা, নাস্তা নিয়ে পুকুর ঘাটে আয়। আমি ওখানেই আছি।”
মেহনূর চুপচাপ ঘরে চলে যায়। এ পুরুষের কত কি মনে ধরে, আল্লাহই জানেন।
মেহনূর এক গ্লাস দুধ, সাত আটটা খেজুর, একটা সেদ্ধ ডিম আর রুটি, সাথে গরুর মাংস, এগুলো একটা প্লেটে তুলে নেয়। দুধ আর খেজুর, এহসানের সবসময়ই লাগবে, যে লাগবেই। একদিনও, মেহনূর দেখেনি যে, দুধ আর খেজুর ছাড়া এহসান সকালের নাস্তা সেরেছে!
এহসানের প্রিয় নাকি এই খাবারগুলো!
মেহনূর ধীর পায়ে খাবারের ট্রে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পুকুর পাড়ের কাছে গিয়ে দেখে, এহসান বসে আছে। পুকুরের সিঁড়ি, গাছের ছায়ায়, পুকুর পাড়ে দুদিকে গাছ রয়েছে, যার জন্য বেশ আরামদায়ক বাতাস আর ছায়াও রয়েছে।
মেহনূর এহসানের পাশে খাবারের ট্রে রেখে দেয়, আর বলে,
— “খেয়ে নিন, নাকি মুখে তুলে দিব?”
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
— “জানিস, যখন খাইয়ে দিতে হবে, তখন জিজ্ঞেস করে কেন করছিস?”
মেহনূর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, এহসানের পাশে বসে বলে,
— “আমি রুটি মুখে তুলে দিচ্ছি, আপনি দুধ আর খেজুরটা খেয়ে নিন।”
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে, নিরলস হেসে বলে,
— “তুই কিছু খেয়েছিস?”
মেহনূর, এহসানের হাতে দুধের গ্লাসটি ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— “হুম, চা খেয়েছি।”
এহসান দুধের গ্লাসটি হাতে নিয়ে, মেহনূরের দিকে এগিয়ে বলে,
— “নে, একটু খেয়ে নে।”
মেহনূর ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বলে,
— “আরে না, এটু হয়ে যাবে তো!”
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— “তোর এটু খাবার, আমার জন্য রহমতময়।”
মেহনূর কিছু বলে না, চুপচাপ বিসমিল্লাহ বলে, এক চুমুক খেয়ে নেয়।
এহসান, মেহনূরের অর্ধ খাওয়া দুধটুকু ধীরে ধীরে বিসমিল্লাহ বলে, তিন চুমুকে খেয়ে নেয়।
অতঃপর, কয়েকটি খেজুর মুখে তুলে দেয়। মেহনূরও তার মুখে দুটো খায়।
মেহনূর, এহসানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, আর এহসান নীরবে বসে তা খাচ্ছে। মেহনূর বেশ বুঝতে পারে, এহসান এর মন কোনো কারণে খারাপ, তবে তাও কিছু বলে না।
এহসান হঠাৎ বলে উঠে,
— “খাবার খেয়ে, তৈরি হয়ে নিস, বাড়ি ফিরব!”
মেহনূর বেশ অবাক হয় এটা শুনে, বেশ মন খারাপও হয় তার। কেননা, এ কদিনে মন বসে গেছে, এই ছোট্ট বাড়িতে, তার এই ছোট্ট পুকুর ঘাটে, ছোট্ট ঘরে।
মেহনূরের মন ক্ষুন্ন হয়ে যেতে দেখে, এহসান প্রশ্ন করে,
— “কি হলো? এমন করছিস কেনো?”
মেহনূর, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,
— “মায়া জড়িয়ে গেছে, বেশ কয়দিন থেকেছি তো, তাই কেমন যেন খারাপ লাগছে!”
এহসান মলিন হেসে বলে,
— “বারে মাত্র কয়দিনে এ ঘরের মায়ায় জড়িয়ে গেলি? অথচ এই আমার আর মায়ায় জড়ালি না!”
এহসানের এমন কথা, মেহনূরের বুকে গিয়ে তীরের মতো বিঁধে। মেহনূর অসহায় গলায় বলে,
— “এভাবে বলছেন কেনো? আমার কষ্ট হয় তো!”
এহসান মৃদু হেসে বলে,
— “কেনো? কষ্ট হয় কেনো?”
— “আপনি আমার ওপর রেগে এই কথা বললেন!”
এহসান হেসে বলে,
— “তুমি আমার প্রাণপ্রিয় নারী, তোমার উপর রাগ অভিমান আমার মানায় না। তোমার উপর শুধু আমার ভালোবাসাটাই মানায়!”
মেহনূর শান্ত গলায় বলে,
— “তাহলে কেনো এমন আঘাত দিয়ে কথা বললেন?”
এহসান মেহনূরের গালে হাত রেখে বলে,
— “আঘাত পেয়েছো আমার কথায়?”
মেহনূর মাথা নাড়িয়ে বলে,
— “হুম!”
এহসান মেহনূরের দিকে, নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে, মেহনূরের কপালে বার কয়েক ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। মেহনূর চোখ বুঁজে নেয় আবেশে।
এহসান মেহনূরের কোল থেকে প্লেটটা সরিয়ে, অন্য দিকে রেখে, মেহনূরের গালে নিজের হাত আলতো করে রেখে বলে,
— “একটা প্রশ্ন করি?”
মেহনূর উত্তর দেয় না, নিরলস চোখে তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে। এহসান বুঝে যায়, মেহনূর প্রশ্ন করতে বলছে।
এহসান মেহনূরকে বলে,
— “ঘৃণা করো আমায়, আগের মতো?”
মেহনূর, এহসানের এমন প্রশ্নে, শুধু তাকিয়ে থাকে তার পানে। কিছু মুহূর্ত চুপ থাকার পর, অস্থির গলায় বলে,
— “হয়তো না, কারণ আপনার প্রতি আমার ঘৃণা আসে না। আপনায় ঘৃণা করতে চাই, কিন্তু পারি না। আপনার প্রতি প্রতিটি ঘৃণা, নিমিষেই ঘৃণা মায়ায় পরিণত হয়ে যায়। কেন জানি কি হয়ে গেছে আমার, আমি পারি না আপনায় ঘৃণা করতে!”
এহসান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, নিজের নারীর কথা শুনছে। মেহনূর, কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে, ফের বলে,
— “জানেন, আপনার বুকে যখন মাথা রাখি, তখন আপনার প্রতি আমার সব ঘৃণা মায়া পরিণত হয়ে উঠে এক ক্ষিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। মনে হয় সব ভুলে যাই। আপনার পাপ, আপনার নিকৃষ্টতা, এখন কেনো জানি তুচ্ছ মনে হয়। সব কিছু গুলিয়ে যায় আমার! আমি নিজের মনের অবস্থা নিজে বুঝে উঠতে পারছি না, কেনো হচ্ছে এগুলো আমার সাথে? আমি তো এসব চাই না!”
মেহনূর এক নাগাড়ে নিজের মনে চেপে থাকা সব কথা বলে দেয় এহসানকে।
এহসান স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার নারীর, তার প্রতি অনুভূতি প্রকাশে, ভালোবাসুক বা না বাসুক, ঘৃণা তো করে না!
এহসান মেহনূরকে আগলে ধরে, নিজের বুকে, আর মেহনূরকে বলতে থাকে,
— “এটাই হয়তো ভালোবাসার শুরু, এটাই হয়তো আমায় তুমি তোমার নিজের আত্মার আগলে জড়িয়ে নেওয়ার শুরু!”
মেহনূর, এহসানের বুকে নাক ঘেঁষে, এহসানের শরীরের ঘ্রাণ নিতে থাকে, তারপর ফিসফিসিয়ে বলে,
— “ছাড়ুন, নয়তো আমার হাতে তরকারি লেগে আছে, আপনার গেঞ্জিতে লেগে যাবে!”
এহসান মেহনূরকে ছাড়ে না, শক্ত করে মেহনূরকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “কিছু সময় থাকো না, এই পাপিষ্ঠ বুকে কি এমন ক্ষতি হবে!”
মেহনূর চুপ হয়ে, ঘাপটি মেরে বসে থাকে, আপন পাপিষ্ঠ পুরুষের আপন পাপিষ্ঠ বুকে।
মেহরাজ কালো শার্ট আর প্যান্টের ওপর সাদা অ্যাপ্রন পরে তৈরি। ওর সাজগোজ একেবারে পারফেক্ট, যেন সিনেমার কোনো নায়ক!
এশা বিছানায় বসে মেহরাজ কে দেখে প্রথমে নিজেও কিছুটা অবাক হয় কিন্তু ওতো আর মেহরাজ কে সুন্দর বলবে না তাই ওর দিকে তাকিয়ে টিটকারি দিয়ে বলে,
— “হাসপাতালে যাচ্ছ নাকি নায়কগিরি করতে? এত নায়ক সেজে গেলে নার্স আর ইয়াং ডাক্তারনিরা তো তোমার সাথে বাড়ি চলে আসবে
মেহরাজ একটু হাসল, তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “তুমি কি আমার ওপর ফিদা হয়ে গেছ? তোমার কথাবার্তা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে!”
এশা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বলল,
— “নিজের মুখ আয়নায় দেখেছিস? একদম বানরের মতো! তোর ওপর ফিদা? আমার ঠ্যাংও হবে না!”
মেহরাজ হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল,
— “আমার জীবনে এত অসভ্য মেয়ে দেখিনি! আল্লাহ, তুমি মাফ করো!”
তারপর ব্যাগটা হাতে নিয়ে এশার সামনে এসে বলল,
— “এখন যাচ্ছি, তবে চিন্তা করো না, ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরে এসে তোমার অসভ্যতার ডবল ডোজ দেব!”
এ কথা বলে মেহরাজ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এশা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, যেন কিছু ভাবছে। তারপর দ্রুত বেলকনিতে গিয়ে দেখল, মেহরাজ বাড়ির গেট পেরিয়ে চলে গেছে।
এশা আর দেরি করল না। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নূরির খোঁজে। ভাগ্য ভালো, দরজা খুলতেই নূরি সামনে পড়ে গেল।
— “নূরি, তুই একটা সাহায্য করবি?”
নূরি অবাক হয়ে বলল,
— “কেমন সাহায্য?”
এশা ওর হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। দরজা লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “তোর ভাইজান আমার কিছু বাজে ছবি তুলে রেখেছে ওর ল্যাপটপে। ওগুলো ডিলিট করতে হবে। তুই আমায় সাহায্য কর!”
নূরি হতভম্ব হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বলল,
— “গায়রত বলেও তো কিছু আছে! এসব কী বলছ তুমি?”
এশা হালকা হাসল, তারপর ওর বাহুতে একটা হালকা থাপ্পড় মেরে বলল,
— “আরে দূর বেডি! তুই আমার ভাতিজি হস। তোর সাথে নিজের সমস্যার কথা বললে গায়রত নষ্ট হবে না!”
নূরি কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— “ঠিক আছে, কিন্তু এখানে আমি কী করব?”
এশা উজ্জ্বল চোখে বলল,
— “তুই শুধু আমায় একটা ফোন এনে দে। ফোনের টিউটোরিয়াল দেখে ফাইলগুলো ডিলিট করব!”
নূরি একটু চিন্তা করল, তারপর মাথা নাড়ো।
এশার ঠোঁটে ধীরে ধীরে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠে…
—মেহরুব ভাইয়ের ফোন নিয়ে আসি, উনি বললেই দিয়ে দিবেন, বলল নূরি।
এশা নূরির কথা শুনে, সিরিয়াস সময়েও মুচকি হেসে টিটকারি দিয়ে বলে,
— ও ভাতিজি, কী ব্যাপার? আমার ভাতিজাকে দেখছি বেশ ভালো চেনো তুমি।
নূরি লজ্জায় মুখ ফুলিয়ে বলে,
— তুমি এসব বললে, আমি এনে দিব না কিন্তু। আর আমাদের মধ্যে তেমন কিছু নেই, কিন্তু।
এশা মুচকি হেসে বলে,
— হয়েছে মা, থামো। তুমি যে দুই বছর আগেই আমার ভাতিজার বউ হয়ে বসে আছো, ঐটা আমি জানি, আর আমার ভাতিজা যে তুমি বলতে পাগল, ঐটাও বুঝতে পারি!
নূরি এশার কথায় লজ্জায় মরে যাচ্ছে, হাসিও পাচ্ছে। মেহরুব ভাই নাকি সে বলতে পাগল! তবে আর কিছু না বলে, কক্ষে থেকে বেরিয়ে যায়, উদ্দেশ্য মেহরুবকে খোঁজা।
মেহরুবকে নিচে খুঁজে পায় না, তাই দাদি এনিফা বেগমকে জিজ্ঞেস করে,
— দাদিজান, মেহরুব ভাইকে দেখেছো?
এনিফা বেগম নূরিকে মেহরুব ভাই বলে ডাকায় একটু চটে গিয়ে বলেন,
— এ হারামজাদি, কতদিন বলেছি, ও তোর জামাই হয় ভাই, না ভাই ডাকবি না।
নূরি বিরক্তি নিয়ে বলে,
— দাদিজান, তুমিও না, এখন আমি উনাকে মেহরুব ভাই না ডেকে মেহরুব জামাই ডাকব নাকি?
এনিফা বেগম চোখ রোল করে বলেন,
— মানুষ, কত কী ডাকে! নিজের জামাইকে, জান, এগো, ওগো আর কত ইংলিশে কী কী ডাকে!
নূরির হাসি উঠে, দাদিজানের কথা শুনে। নূরি মুখে হাত রেখে হাসতে হাসতে বলে,
— দাদীজান, তুমিও এসব ডাকো নাকি দাদাজানকে?
এনিফা বেগম হেসে বলেন,
— হ্যাঁ, ডাকি তো! আয়, তোরে শিখিয়ে দেই, আমার ছোট নাতিকে কী বলে ডাকবি।
নূরি হাসতে হাসতে বলে,
— হইছে, আর শিখানো লাগবে না! এমনিতেই তোমার নাতির সাথে কথা বলতে আমার হাত-পা কাপে, আর এসব বলে ডাকলে আমায় তোমার নাতি আর জিন্দা রাখবেন না!
ঠিক তখনই বাড়ির ভেতর মেহরুব প্রবেশ করে, নূরি ও এনিফার কথা শুনে, বলে,
— কে কাকে জিন্দা রাখবে না, শুনি?
এশা ও নূরি চমকে ওঠে, নূরি মনে মনে ভাবে, এ পুরুষ কিছু না, শুনে নি তো, হয়তো!
এনিফা বেগম বললেন,
— এই তো তুই এসে গেছিস নূরি, তোরে খুঁজ করছিল, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। তোরে দিয়ে ওর কী কাজ, ও আমায় বলে তোর লগে নাকি ওর বহুত কাজ, আমারে তা বলা যাইত না।
নূরি একবার মেহরুবের দিকে তাকায়, তারপর একবার দাদিজানের দিকে, দুই হাত দিয়ে না না করতে করতে বলে,
— না, মেহরুব ভাই , আমি এটা বলিনি, সত্যি এটা বলিনি।
এনিফা বেগম হাসেন, মেহরুব বুঝে যায়, দাদিজান মজা করছেন।
মেহরুব নূরির দিকে তাকিয়ে বলেন,
— আমায় এক কাপ চা দিবি বানিয়ে?
নূরি মাথা নাড়িয়ে বলে,
— আচ, আচ্ছা, এখন একটু কাজ আছে।
মেহরুব বলে,
— আচ্ছা।
এ বলে, সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে, নূরি এক দৌড়ে মেহরুবের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
— মেহরুব ভাই, একটা কথা ছিল।
মেহরুব থেমে গিয়ে নূরির দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলেন,
— কী?
নূরি হাজার দ্বিধায় বলে,
— ঐ, ঐ আপ, আপনার ফোনটা একবার দিবেন, একটা জরুরি কাজ ছিল।
মেহরুব পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলেন,
— তো এটা বলতে এত থুতলাতে হয়?
এ বলে ফোনের লক খুলে, নূরির দিকে নিজের ফোন এগিয়ে দেন। মেহরুব। নূরি ফোন হাতে নিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, মেহরুব নিজের ঘরে চলে যায়।
নূরি এশার ঘরে ফোন নিয়ে আসে। এশা ফোন নিয়ে বলে,
— মা রে, তুই আমায় যে সাহায্য করলি, দোয়া করি তোর আর মেহরুব জমজ সন্তান হোক!
এশার এমন দোয়া শুনে, নূরি বলে,
— সংসারি হলো না, সন্তান হবে কোথা থেকে?
এশা হাসতে হাসতে বলে,
— আমি আছি না, সংসার জোড়া লাগিয়ে দেব, আর আল্লাহ তো আছেনই!
নূরি মলিন হাসিতে বলে,
— আগে নিজে সংসারটা তো করো।
নূরির কথায়, এশা আর কিছু বলে না, তাড়াতাড়ি মেহরুবের ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে বিছানায়।
— আচ্ছা, লক জানো কী?
এশা বলে,
— হ্যাঁ, জানি, সকালে দেখে নিয়েছি।
নূরি এশার সামনে বসে বলে,
— আচ্ছা, ভাইজান যদি জানতে পারে পরে, তো রাগ করবে।
এশা, নূরির দিকে মেহরুবের ফোন এগিয়ে দিয়ে বলে,
— সার্চ কর তো, এসব ফাইল নষ্ট কিভাবে করে, যেগুলো টাইম দিয়ে সেট করা থাকে।
নূরি ফোন নিয়ে খুঁজতে থাকে, এশা ফাইল খুঁজতে থাকে।
অনেকক্ষণ হয়ে যায়, আধঘণ্টা পার হয়ে, কিন্তু কেউ কিছু পায় না। তখনই ঘরের দরজায় কেউ কড়া নাড়ে।
নূরি ও এশা কেঁপে ওঠে। এশা নূরিকে ফিসফিসিয়ে বলে,
— মনে হয়, তোর ভাইজান ইবলিশ এসে গেছে। শোন, আমি ল্যাপটপ রেখে দিচ্ছি, তুই ফোন লুকিয়ে নে, আর বলবি, আমরা গল্প করছিলাম।
নূরি বলে,
— আচ্ছা।
এশা দরজা খুলে দেয়, এবং তার ধারণা সঠিক, মেহরাজ এসেছে। মেহরাজ ঘরে প্রবেশ করতে দেয়, এশা কোনো কথা বলে না। মেহরাজ নূরিকে দেখে, আর এশাকে ঠোঁট শুকিয়ে যেতে দেখে, ভুরু কুঁচকে বলেন,
— কী রে, তোরা কী আকাম করছিলি এখানে, নূরি?
নূরি কিছু বলতে যাবে, তখনি এশা নিজেকে সামলে বলে,
— আমরা যাই করি, তোমায় বলব কেনো?
মেহরাজ এশার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়, তারপর নূরিকে বলে,
— নূরি, মেহরুব বলেছে তোকে এটা বলতে, যে তোকে কতক্ষণ আগে চায়ের কথা বলেছিল, আর তুই কতক্ষণ পরে চা দিবি?
এ কথা শুনে নূরি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাইজান, দিচ্ছি।
এ বলে, এশার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি আসি, কেমন?
এশার মেজাজ চটে যায়, লক্ষ্য পৌঁছাতে পারল না!
এশা কটমট করে মেহরাজের দিকে তাকায়, তারপর ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু মেহরাজ তার জন্য তা সম্ভব হয় না, মেহরাজ তাকে আটকে নেয়, নিজের হাত বাড়িয়ে।
এশা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
— ছাড়বি তুই আমায়, না, উষ্টা খাবি?
মেহরাজ এশার কোমর জড়িয়ে ধরে, ওর কাছে নিয়ে বলল,
— এত চেষ্টা করলে, কিন্তু সফল হলে না।
এশা চমকে গিয়ে বলে,
— কিসের চেষ্টা?
মেহরাজ হেসে বলে,
— জানো, তুমি যতবার ফাইলে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছো, ততবারই আমার ফোনে নোটিফিকেশন গেছে।
এশা বেশ ঘাবড়ে যায়, তাও জোর গলায় বলে,
— সমস্যা নেই, এই ল্যাপটপটি ভেঙে দেব যদি না কাটিস ঐ ছবি গুলো।
এশার এত বড় বড় কথা শুনে, মেহরাজ তার ঠোঁটে হাত রেখে বলে,
— এ মুখ দিয়ে এত তিতা কথা কিভাবে বের করো? ক্লান্ত হও না!
এশা মেহরাজের হাত ঝারি মেরে সরিয়ে বলে,
— হাতও কথা বলে নাকি, যে কথায় কথায় হাত নাচে!
মেহরাজ মুচকি হেসে, এশার থুতনি আলতো চেপে বলেন,
— হাত, পা, ঠোঁট—সবই কথা বলে।
এ বলেই, মেহরাজ এশার অধর আঁকড়ে ধরে, নিজের অধর দ্বারা!
এশা কি কম যায়? না, কি সে সুযোগ বুঝে, মেহরাজের কাটা ঠোঁটে নিজের দাঁত বসিয়ে দেয়! মেহরাজ ব্যথায় কিছুক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখে, তারপর ছেড়ে দেয়, আর নিজের ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে বলে,
— নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ, এত ভয়ংকর বউ, শএুও না হোক মাবুদ!
এশা মেহরাজের ঠোঁটের রক্ত নিজ হাতে মুছে দিতে দিতে বলে,
— আমায় বিয়ে করেছিস না, তোর বিয়ের শখ, এবার মিটবে!
রাতের সিলেট শহর তখন নিস্তব্ধ। আকাশে একফালি ম্লান চাঁদ, দূরে দু-একটা বিমানের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঠিক রাত তিনটার দিকে সিলেট এয়ারপোর্টের বাইরে কালো রঙের একটা স্যুটকেস হাতে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। তার চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা, ঠোঁটের কোণে রহস্যময়ী এক হাসি।
চারপাশে যতই নীরব হোক, মনে তার ঝড়।
একটা কালো SUV এসে থামে ঠিক তার সামনে। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়ায়। ব্যাগটা গাড়িতে রেখে নিজেও উঠে পড়ে লোকটি। গাড়িটা ধীরে ধীরে এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে ছুটে চলে গ্রামের দিকে।
গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দিয়ে, ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে মেখে লোকটা চোখ মুছে তাকায় অন্ধকার গ্রাম বাংলার দিকে। ঠোঁটের কোণ আরও একটু বাঁকায়, গলা নরম কিন্তু কঠিন স্বরে ফিসফিস করে বলে ওঠে—
আত্মার আগলে পর্ব ৩২
— “অনেক হয়েছে লুকোচুরির খেলা। এবার শুরু হবে সামনাসামনি লড়াই। তালুকদাররা, আমি আসছি।”
গাড়ির গতির সাথে সাথে তার কণ্ঠও কঠিন হয়ে ওঠে।
— “অতি শিগগিরই হবে মুখোমুখি লড়াই। হয়তো তোরা মরবি… নয়তো আমরা। কিন্তু শেষবারের মতো এই খেলার পর আর কোনো পালানোর রাস্তা থাকবে না।”
রহস্যময় হাসিটা ঠোঁটের কোণে রেখে সে চোখ বন্ধ করে, যেন মানসপটে আগত যুদ্ধের ছবি আঁকছে। অন্ধকার রাত, সিলেটের বাতাস, আর সামনে অপেক্ষমান এক উত্তাল অধ্যায়ের পূর্বঘোষণা যেন তার কথায় ভেসে বেড়ায়।
