আত্মার আগলে পর্ব ৩৫

আত্মার আগলে পর্ব ৩৫
সানজিদা আক্তার মুন্নী

সালটা ২০০৭-এর শেষের দিক। মেহরাজ আর তুমি তখন তালুকদার বাড়ির অংশ। আমি তখন হয়তো দশ কিংবা এগারো বছরের একটা বাচ্চা।
তুমি তো জানো, আমরা ভাইবোন আব্বার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। আব্বার প্রথম স্ত্রী, এনিমা বেগম—মানে, আমার বড় খালা—কম বয়সেই ক্যান্সারে মারা যান, রেখে যান তিন সন্তান: বড় ভাই মারুফ, ছোট ভাই নিরব, আর সবার বড় বোন আলিফা।
বড় আম্মা মারা যাওয়ার পর আব্বা তার প্রথম স্ত্রীর ছোট বোনকে বিয়ে করেন, মানে আমার আম্মাকে। আর মেঝো বোনকে তোমার দাদাই বিয়ে করেন আব্বার বিয়ের এক বছর পর।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহনূরের দিকে তাকায়। মেহনূর তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন আরও কিছু জানার অপেক্ষায়।
এহসান আবারও চাপা শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে—

— অতঃপর, ২০০৭ সালের শেষের দিকে শুরু হয় এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়, মৃত্যুর তাণ্ডব। পাশের গ্রামের জসিম জমিদার তখন বেশ ক্ষমতাবান ছিল, তার দুই ভাইসহ পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের সঙ্গে আমাদের জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ চলছিল। জায়গাটা আমাদের, অথচ তারা নিজেদের দাবি করত। আব্বা আর চাচা বছরের পর বছর লড়ে গেছেন, কিন্তু কেউ এক আঙুলও ছাড় দেয়নি।
কিন্তু হঠাৎই আপনজনের মধ্যেই ফাটল ধরে। চাচা আলাদা হয়ে যেতে চান, আব্বা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি, কিন্তু শেষমেশ ভাগ দিতে হয়। জমির অর্ধেক দিয়ে দেন চাচাকে, তবে তালুকদারদের যে সাত-আটটি বড় মঞ্জিল ছিল, তা তিনি রেখে দেন।
এরপর থেকেই পরিস্থিতি আরও ঘোলা হতে থাকে। চাচা ক্ষিপ্ত হয়ে যান। চেয়েছিলেন শুধু জমি নয়, গুপ্ত সম্পত্তিগুলোও। কিন্তু আব্বা রাজি হননি। প্রতিশোধস্পৃহায় চাচা সেই জমিটি জসিমদের দিয়ে দেন, যা নিয়ে তারা এতদিন লড়ছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এবার তারা আমাদের পুরোপুরি ধ্বংস করতে উঠে-পড়ে লাগে। আব্বা চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ান, জসিমও। তখন হুমকির পর হুমকি আসতে থাকে। আব্বাকে, বড় ভাইদের, সবাইকে জানে মারার ভয় দেখানো হয়, যাতে পদ ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আব্বা অটল ছিলেন, ভাইজানরাও।
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে
ঈদের দিন পর আম্মা, আমার বড় ভাই এনাম, এমরান, এশা—সবাই নানাবাড়িতে যান!
বাড়িতে রই আমি, বড় আপা, আব্বা, বড় ভাইজান, ছোট ভাইজান, বড় ভাবি, আর দশ বছরের ভাতিজি আলিসা ও ভাতিজা আরিফ! ছোট ভাইজান তখনও বিয়ে করেননি!
ঈদের চার দিন পরেই ভোটের দিন! ঈদের তিন দিনের দিন, রোজ শনিবার—সেদিন ছিল এক অভিশপ্ত দিন আমাদের পরিবারের, যেদিন সব… সব শেষ হয়ে গিয়েছিল!
ঈদের সময় হওয়ায় আমাদের যত লোকজন ছিল, তাদের ছুটি দেওয়া হয়। আব্বা বোকামি করে সবাইকে ছুটি দিয়ে দেন—শুধু হাসিব আর জয়নালনের আব্বা ছাড়া। ওরা তো আমাদের গ্রামেই ছিল, তাই আর তাদের যেতে হয় না। আর বাকি যে পালোয়ানরা ছিল, সবাই তখন বাড়িতে।

সেদিন সকাল থেকেই আমাদের বাড়ির আশেপাশে কেউ না কেউ ঘুরাঘুরি করতে থাকে। এ জিনিস আমি লক্ষ্য করলেও সেসময় ছিলাম ছোট মানুষ—ওত বেশি পাত্তা দিইনি!
আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন রাতের কথা! আমি যখন মসজিদ থেকে আসছিলাম, তখনই দেখতে পেয়েছি—সকালে যে লোক দু’-একজন করে ঘুরাঘুরি করছিল, এখন তারা সবাই একসাথেই ঘুরাঘুরি করছে!
আমি বোকা—এসব ওত মাথায় ঢুকাই না! বাড়ি এসে ভেবেছিলাম, আব্বা নয়তো ভাইজানকে বলব। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। বড় আপা তার হাতে সন্দেশ বানিয়েছেন—সেটাই তৃপ্তিসহিত খেতে বসে যাই, সাথে ভুলেই যাই এ কথা বলতে!
রাতের খাবার খেতে বসলাম। আমরা সবাই একসাথে খেলামও! খেয়ে উঠে উঠোনে বের হই আমি, আব্বা, আর ছোট ভাইজান!
ঠিক তখনই দেখতে পাই—আমাদের গেটের বাইরে অনেক লোক! অনেক!
আব্বা বেশ অবাক হয়ে যান—

—এসব কী হচ্ছে এখানে?!
আব্বা সামনে এগোতেই আমাদের গেট ভেঙে একটা ট্রাক প্রবেশ করে!
আমি ভয়ে ছিটকে দূরে সরে যাই! ট্রাক থেকে নেমে আসে জসিম আর তার দুই ভাই, সাথে তাদের পালোয়ানরা!
জসিম এসেই আব্বার সামনে দাঁড়িয়ে বলে—
—কথা শুনলি না তো? এখন বহুত পস্তাবি!
ছোট ভাইজান বাঘের মতো জসিমের দিকে তেড়ে এসে বলে—
—তোর সাহস কী রে হ…
ভাইজান এতটুকুই বলতে পারে—তার বুক বরাবর সাত-আটটা গুলি একসাথে করে দেওয়া হয়!
আমি সেদিন শুধু তাকিয়ে ছিলাম… শুধু তাকিয়ে…
এই… এই কিছু মুহূর্ত আগেও আমার ভাইজান আমার সাথে মজা করছিল… আর এই—আমার ভাইজান গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল…!
আমি আর আব্বা তখন থমকে দাঁড়িয়ে আছি… কিছু বলতে যাব, তখনই ওরা আমাদের হাত-পা বেঁধে জমিনে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দেয়!
ঘরে গিয়ে টেনে বের করে আনে—

আমার বড় ভাইজান, তার ছোট ছেলে, আমার বড় আপা, আমার ভাবি, আমার ভাতিজিকে…
একে একে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে!
জানিস? সেদিন আমার খুব কষ্ট হয়েছিল! দম বন্ধ হয়ে আসছিল! কেন জানিস?
আমার বোনকে… ভাবিকে… হারাম পুরুষ দেখে নিয়েছিল!
তারা আমার চোখের সামনে আমার বড় ভাইজানটাকে কুপিয়ে ফেলে! একেবারে মেরে ফেলে!
কিন্তু কেন জানি… আমার কান্না আসছিল না!
আমি পাথর হয়ে গিয়েছিলাম… আমি শুধু দেখছিলাম… শুধু…!
ওরা আমার ভাইজানের শরীরটা টুকরো টুকরো করে… তাতে থেকে রক্ত বের করে… আমায় আর আব্বাকে গোসল করায়…!
জানিস? তোর বাপ-চাচা কিন্তু গেটের বাইরে ছিল! তারা সেখানেই ছিল!
তারা কীভাবে পারল এমনটা করতে?!
একেকজন একেকবার উঁকি মেরে দেখে যায়… এসে একটু পর পর…
কিন্তু… কিন্তু কিছু করে না!
অথচ এরাই ছিল আমাদের আপন!
আমার ভাতিজা—কলিজা অব্দি ছিঁড়ে আনে ওরা!
এতেও আমার কষ্ট নয়! হয়ে গেছে তো, হয়ে গেছে!
কিন্তু… কিন্তু…

এ বলেই এহসান থেমে যায়! বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে আসতে চায়!
মেহনূর নিজের মধ্যে নেই… একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে… অঝোরে কাঁদছে সে!
এই নির্মম পরিস্থিতির কথা শুনে… কতই না অসহায় ছিল সেদিন তার ছোট্ট পাপিষ্ঠ পুরুষটা!
এহসান এবার কেঁদে উঠে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে—
—কিন্তু ওরা… ওরা আমার ফুলের মতো দুই বোন… আমার বড় আপা… আমার ভাবিকে… আমার ছোট্ট ভাতিজিকে… টেনে সামনে নিয়ে আসে!
তাদের কাপড় টেনে খুলে ফেলে!
তারা চিৎকার করে! আকুতি করে!
কিন্তু কিছু সম্ভব হয় না!
আমার আব্বা চিৎকার করে বলেন—

—আল্লাহর দোহাই লাগে! প্রয়োজন সব নিয়ে নাও! আমার মেয়ে, নাতনিকে ছেড়ে দাও!
আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠি!
কিন্তু… হয় না! কিছু হয় না! কিচ্ছু না…!
আমি চোখ বন্ধ করে নেই…
সামনেই… আমার বোনদের ইজ্জত হানির সেই চিৎকার আর দৃশ্য!
আমার ভাতিজিটা অব্দি ছাড় পায় না!
তার বয়স তো মাত্র আট ছিল… তার কী দোষ ছিল…?
তাকে একজন পালোয়ান ধর্ষণ করে মেরে ফেলে…!
আমার ভাবি আর বড় আপাকে ততক্ষণ ধর্ষণ করা হয়, যতক্ষণ তারা মারা না যায়…
কিন্তু একটা ব্যাপার ভালো হয়—আমার ভাবি আর আপা বেশি সময় বাঁচে না! তারা তাড়াতাড়ি মারা যায়…!
জানিস, মেহনূর?
আজও না… আমার কানে আমার বোনদের সেই আত্মচিৎকার ভেসে ওঠে…!
তোর বাপ-চাচা চাইলেই বাঁচাতে পারত!

চাইলেই পারত!
কিন্তু… তা করেনি!
.তারা আমায় মারেনি!
কেন মারেনি, জানিস?একসাথে আমার ভাইজানদের এসে আবারও মারবে বলে!
তারা চলে যায়!
এ গ্রামের মানুষ সব জানত…অথচ কেউ কিছু বলেনি!
ভয়ে… শুধু ভয়ে…!তাই আমি বড় হওয়ার পর থেকে তাদের ভয় রাখি!
ক্ষমতার দাপটে ভয় রাখি!
কারণ তাদের এই ভয় আমাদের শেষ করে দিয়েছে!
তবে হাসিবের আব্বা ঠিকই আসেন! তবে… ওরা তাকেও মেরে ফেলে!
জয়নালের আব্বাকেও!সাথে সব… সব শেষ হয়ে যায়…!

এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে—
—জানিস? আপন মানুষের মরার খাটিয়া তোলা খুব কষ্টদায়ক হয় রে! খুব!
আর আমরা… তিন ভাই আর আমার আব্বা… একসাথে পাঁচ-পাঁচটা খাটিয়া কাঁধে তুলেছিলাম!
পাঁচ-পাঁচটা… তাও একদিনে…!
এহসান আর কিছু বলতে পারে না!
মেহনূর অঝোরে কাঁদছে… ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে… পারছে না…
ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে!নিজের বাপ-চাচার এমন মীরজাফরি কথা শুনে…
তারা চাইলেই পারত…
সব ঠিক করতে…কিন্তু… কিছু করেনি…!
রাতের নীরবতায় শুধু নিঃশব্দ কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মেহনূর মাথা নিচু করেই কাঁদছে, চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ে তার হাতের ওপরে। ওর দেহ অবশ হয়ে এসেছে, হৃদয়ের গহীন থেকে একরাশ বেদনা যেন নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে।
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

— দেখো, তুমি শুনেই কাঁদছো, অথচ আমি এসবের স্বয়ং সাক্ষী! আচ্ছা, এরপরও কি তুমি আমায় ঘৃণা করবে? নিজের বাপ-চাচার পক্ষ নেবে? কোনটা?
মেহনূর চোখ মুছে এহসানের দিকে তাকায়, গভীর দৃষ্টিতে। তারপর ধীর, স্থির কণ্ঠে বলে,
— ঘৃণা? আমি আপনাকে এখন করি না সেটাই আগেই বলে দিয়েছি। আর পক্ষ নেওয়ার কথা যদি বলেন, তাহলে কোনো পশুও তাদের পক্ষে কথা বলবে না! তবে… আমি আপনার মতো তাদের ঘৃণা করতে পারব না। যতই হোক, তারাই তো আমার আপনজন…
এহসানের মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে যায়। মলিন কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
— আর আমি? আমি কে তোমার?
মেহনূর একটুও দ্বিধা না করে বলে,
— আপনি আমার পাপিষ্ঠ পুরুষ… আমার প্রাণপ্রিয় পুরুষ!
এহসান থমকে যায়। এমন উত্তর সে কল্পনাও করেনি! কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
— আবেগের তাড়নায় বলছো না তো?
মেহনূর এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
— আপনি আমার আবেগ নন, আপনি আমার বাস্তব। আপনিই আমার সব। এই কয়দিনে আমি তা ঠিকই উপলব্ধি করেছি।

এহসান এবার আরও গভীরভাবে তাকায় মেহনূরের চোখে।
— ভালোবাসো আমায়?
মেহনূর এক মুহূর্ত এহসানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নরম কণ্ঠে বলে,
— হয়তো না… আবার হয়তো হ্যাঁ… আমি এটা জানি না। তবে আমি জানি, আমি শুধু আপনার সঙ্গেই থাকতে চাই…
এহসান বুঝে যায়, তার আপন নারী তাকেই চাইলো।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলে,
— একটা কথা রাখবি?
মেহনূর নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলে,
— বলুন, রাখব।
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
— আমায় একবার জড়িয়ে ধরবি?
মেহনূর কিছু না বলে চুপচাপ দু’কদম এগিয়ে আসে। এহসানের চোখের পানে একবার তাকায়, তারপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে শক্ত করে এহসানকে জড়িয়ে ধরে!
এহসানের বুকের গভীরে মুখ লুকিয়ে ফেলে, যেন সারা জীবনের জন্য লুকিয়ে থাকতে চায় ওখানে!
তারপর ধীরে ফিসফিস করে বলে,

— এই পাপিষ্ঠ বুকটাই আমার জন্য সর্বোত্তম ঠাঁই… এই বুকেই আমি সারাজীবন থাকতে চাই…
এহসান মেহনূরের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়, গভীর ভালোবাসায় বলে,
— চিন্তা করো না, পাপিষ্ঠ বুকসহ এই পাপিষ্ঠ আমিও তোমার… শুধু তোমার… শুধুই তোমার…
মেহনূর আরও শক্ত করে এহসানকে আঁকড়ে ধরে। ও ভেবেছিল, আজ জিজ্ঞেস করবে কেনো এহসান তাকে এত ভালোবাসে। কিন্তু সে প্রশ্ন আর করা হলো না…
এহসান এবার মেহনূরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— আমার বোকা ফুল, তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসি! ভীষণ! তুমি আমার ভোরের কুয়াশায় ফোটা এক স্নিগ্ধ ফুল… যার ছোঁয়ায় আমি বেকুল হয়ে উঠি!
এ বলে সে মেহনূরকে আলতো করে কোলে তুলে নেয়, উদ্দেশ্য—ঘরে ফেরা!
ঘরে এসে মেহনূরকে বিছানায় শুইয়ে দেয় এহসান। তারপর বাতি নিভিয়ে নিজেও ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে, মেহনূরের বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে নেয়।

মেহনূর আলতো হাতে এহসানের মাথায় বিলি কাটতে থাকে, যেন আশ্বাস দিচ্ছে—তুমি একা নও, আমি আছি… আমি আছি তোমার পাশে…
এহসান প্রশান্তির নেশায় চোখ বুজে নেয়।
এই প্রথম, দীর্ঘদিন পর—সে নিজেকে একটু নিরাপদ মনে হয়… একটু ভালো লাগে… যেন সব অন্ধকারের পরেও আলো আছে… এক নিঃশ্বাস ভালোবাসার আলো…!

ফজরের পর নূরি ছাদে চা নিয়ে এসেছে মেহরুবের জন্য! মেহরুব ছাদে রাখা সোফায় বসে! অজিফা হাতে নিয়ে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করতে ব্যস্ত।
নূরি আড়চোখে একবার মেহরুবের দিকে তাকিয়ে, মেহরুবের সামনে এগিয়ে গিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলে রাখে।
মেহরুবেরও সে সময় তেলাওয়াত শেষ! অজিফা খানায় ভাঁজ দিয়ে, মেহরুব চোখ তুলে তাকায় নূরির পানে! একখানা সাদা হিজাব পড়নে নূরির—এই হিজাব তিন বছর আগে সে দাদাজানের সাথে উমরাহ করতে গিয়েছিল, তখনই এনেছিল। এনে একটা মেহনূরকে আর আরেকটা নূরিকে দিয়েছিল!
নূরিকে নামাজের হিজাব পরা অবস্থায় বাচ্চা বাচ্চা লাগে—সুন্দরময় মুখখানা গোল হয়ে প্রদর্শন হয়, এত মায়া লাগে দেখতে! মেহরুব নূরির দিকে তাকিয়ে বলে—
—আড়চোখে যে তাকাচ্ছিস, চোখ তো বাঁকা হয়ে যাবে।
নূরি মেহরুবের এমন কথায় অবাক হয়ে বলে—
—মেহরুব ভাই, চোখ আবার বাঁকা হয় কেমন করে? আপনি এত আজব কথা কিভাবে বলেন?
মেহরুব মুচকি হেসে নূরিকে প্রশ্ন করে—

—ওযু আছে?
নূরি উত্তর দেয়—
—আছে।
মেহরুব অজিফা খানাটা নূরির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—
—তুই সূরা আর-রহমান তেলাওয়াত কর, আমি চা খেতে খেতে শুনি।
নূরি এখন কি করবে? অজিফা এগিয়ে দিয়েছে, তাই আর কিছু না বলে অজিফা হাতে নিয়ে সোফায় বসে যায় আর মেহরুবের দিকে তাকিয়ে বলে—
—অজিফা রেখে এমনি করি?
মেহরুব চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলে—
—যেভাবে ইচ্ছে কর, আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।
নূরি গলা পরিষ্কার করে, হালকা কাশি দিয়ে, অতঃপর তাউয-তাসমিয়া পড়ে শুরু করে—প্রিয় পুরুষের জন্য প্রাণপ্রিয় সূরা…
✨✨
এশা হাতে চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকে, কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। ঘর নিস্তব্ধ।
সে একটু চমকে ওঠে, তবে পরক্ষণেই বুঝতে পারে—মেহরাজ বোধহয় বাথরুমে। পানি পড়ার শব্দ কানে আসে।
কিছু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর দরজার খটখট আওয়াজ হয়।
মেহরাজ বেরিয়ে আসে, ভেজা শরীরে, কোমরে শুধু একটি সাদা টাওয়াল জড়ানো।
এশার দৃষ্টি আটকে যায় মেহরাজের ফর্সা, সুঠাম শরীরে। নিখুঁত মসৃণ বুক, জলের ফোঁটায় চিকচিক করছে।
সে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে,
— কি রে বেহায়া! লজ্জা করে না এভাবে একজন মেয়ে মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে?
মেহরাজ মুচকি হেসে এক পা এগিয়ে আসে।
— লজ্জা পাব কেনো তোমার সামনে ? তোমার সাথে যেখানে পাঁচ-ছয়টা বাচ্চা নিয়ে সংসার করার সপ্ন দেখি!
এশা অস্বস্তিতে কেঁপে ওঠে,
— বাজে কথা বলবি না!

মেহরাজ হাসে। এশার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে আলতোভাবে টেবিলে রাখে, তারপর যখন এশা চলে যেতে চায়, তখনই তার পথ রোধ করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে।
এশার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। মেহরাজের ভেজা শরীরের গন্ধ, উষ্ণতা… সব মিলিয়ে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
এশা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে মেহরাজের বুকের পেশীতে দাঁত বসিয়ে দেয়।
— আহহ!
মেহরাজ এবার একটু ঝাঁকুনি খায়, এশাকে ছেড়ে দেয়,
— এই পাগলি!
সে বিরক্ত হয়ে এক হাতে এশার গাল চেপে ধরে, অন্য হাতে তার দাঁতে আলতো ছোঁয়া দিয়ে বলে,
— এশার বাচ্চা আর যদি কামড়াস, তো দাঁত খুলে নেব!
এশা মেহরাজের হাত সরিয়ে দিয়ে রেগে যায়,
— আমি কি ইচ্ছে করে কামড়াই? তুই নির্লজ্জের মতো জড়িয়ে ধরিস কেনো?
মেহরাজ ধমক দেয়,

— বউ আমার তুমি! আর বউকে তো জড়িয়ে ধরতে হয়, সাথে আরও অনেক কিছু করতেও হয়!
এশা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকে তারপর দাঁত চেপে বলে
— তোর যদি কত কিছু করার শখ তাকে না ,তাইলে বিয়ে আরেকটা কর গিয়ে তার সাথে যা ইচ্ছে কর যা”!
মেহরাজ মুচকি হেসে বলে,
— সেটাতো করব যা ইচ্ছে তা তবে তোমার সাথে করব গো বউ অন্য কারো সাথে নয়”!
এশার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়,
— কুত্তা! তোর জবান এত খারাপ কেন?
মেহরাজ এবার থতমত খেয়ে যায়। সে সারাদিন গালাগালি করে, আর এখন এশাই তার জবান খারাপ বলছে!
সে এশার গাল টিপে ধরে বলে,
—এশার বাচ্চা এত গালাগালি করিস না এখন ঠোঁট ফাটিয়ে দিব”!
এশা মেহরাজের হাত সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
— এশার বাচ্চা কি? সম্মান দিয়ে কথা বল”!
মেহরাজ হেসে চোখ কুঁচকে বলে,

— ওরে আমার সম্মানবতি রে তা শুনো কি কারণে আপনায় আমি সম্মান করব ম্যাডাম”!
এশা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— আমি তোর বউ! আর বউকে সম্মান দিতে হয়
মেহরাজ ঠোঁট কামড়ে হাসে,
— তাই নাকি? তাহলে স্বামীকে সম্মান দিতে হয়, এটা কি জানো না
এশা চুপ হয়ে যায়।
তার নিজের মুখেই স্বীকার করে ফেলেছে যে সে মেহরাজের বউ!
এই মুহূর্তে মেহরাজ আরও এক ধাপ এগিয়ে আসে।
তার চোখে বিদ্রূপাত্মক হাসি, মুখ ক্রমশ নেমে আসছে এশার দিকে, ঠোঁট ছুঁতে…
এশা চোখ বড় করে দেখে, তারপর কোনো কিছু না ভেবেই দুই হাতে মেহরাজের কোমরে জড়ানো টাওয়াল চেপে ধরে বলে,

আত্মার আগলে পর্ব ৩৪

— আর একবার যদি নিজের মুখ এগোনোর চেষ্টা করিস, তো এই টাওয়াল আর কোমরে থাকবে না, বলে দিলাম!
মেহরাজ থমকে যায়, তারপর একবার নিজের কোমরের দিকে তাকায়, এরপর ঠোঁট কেটে হেসে বলে,
— খুলে ফেললে ফেলো, লজ্জা তো তুই পাবি, আমি না!
এ কথা বলেই সে ঠোঁট বসিয়ে দেয় এশার ঠোঁটে, গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে!
এশা হালকা চিৎকার করে, মেহরাজের পেটে খামচে দেয়, কিন্তু কোনো লাভ হয় না!
এবার সে সুযোগ বুঝে মেহরাজের ঠোঁট কামড়ে ধরে ছাড়ানোর জন্য, কিন্তু তাও সম্ভব হয় না।
আজ মেহরাজ ওকে ধরেছে, ধরার মতো, ছাড়ার নাম নেই…!

আত্মার আগলে পর্ব ৩৫ (২)