আত্মার আগলে পর্ব ৩৬+৩৭
সানজিদা আক্তার মুন্নী
কেটে গেছে আরও তিনটি দিন। এখন নির্বাচনের আর মাত্র সাতদিন বাকি! চারদিকেই ব্যস্ততার হাওয়া। এহসানের প্রতিটা দিন কাটছে দৌড়ঝাঁপ আর মিটিং-মিছিলের মধ্য দিয়ে। এক মুহূর্তও যেন বিশ্রামের সুযোগ নেই তার।
কিন্তু ব্যস্ততার মাঝেও এহসানের মনের এক কোণে সবসময় কেউ একজন থাকে—মেহনূর।
সেই সেদিন হঠাৎ করেই মেহনূরের জ্বর উঠেছিল খুব। একেবারে অবস্থা খারাপ। এহসানের বুক কেঁপে উঠেছিল তখন। বাইরের সব কাজ, দৌড়ঝাঁপ সামলেও নিজের নারীকে সামলাতে এতটুকু খামতি রাখেনি সে। নিজের হাতে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, পা ছুঁয়ে দেখেছে জ্বর কমলো কিনা, রাতের পর রাত পাশে বসে থেকেছে।
আল্লাহর রহমতে এখন মেহনূর অনেকটাই সুস্থ। শরীরটা ক্লান্ত হলেও মুখে সেই চিরচেনা শান্ত হাসি ফিরে এসেছে।
এহসান নিজের ব্যস্ততার ভিড়ে থেকেও ঠিক সময় করে ঘরে ফেরে, মেহনূরের পাশে বসে।
মেহনূরও বোঝে, তার এহসান যেন আরও ক্লান্ত, আরও ব্যস্ত। তাই নিজেই এবার বেশি যত্ন নেয় এহসানের—একটু বেশি যত্নে জোর করে বিশ্রাম নিতে বলে।
ব্যস্ত শহর সিলেট। জিন্দাবাজার পয়েন্টে আজ মানুষের ঢল নেমেছে—চারপাশে ভিড়, সবার কাঁধে কাঁধ লেগে যাচ্ছে, কারও না কারও সাথে ধাক্কা খাচ্ছে সবাই।
এই বিশৃঙ্খল ভিড়ের মাঝে ধীরপায়ে হাঁটছে এক যত্নশীল পুরুষ, তার নারীকে বুকের মাঝে আগলে। নূরি অনুভব করছে চারপাশের ভিড়, খেয়াল করছে কিভাবে মানুষ একে অপরের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে ব্যস্ততার স্রোতে। কিন্তু তার শরীরে কেবল একজনেরই স্পর্শ লেগে আছে—তার আপন পুরুষ, তার মেহরুব ভাই।
মেহরুব শক্ত করে নিজের বাহু দিয়ে আগলে রেখেছে নূরিকে, যেন কেউ তার শরীর ছুঁতে না পারে। প্রতি মুহূর্তে সে সতর্ক, এক সেকেন্ডের জন্যও হাত ছেড়ে দিচ্ছে না। যেন এই ব্যস্ত শহরের কোলাহলের মধ্যেও নূরি থাকে কেবল তারই আশ্রয়ে।
নূরির কিছু কেনাকাটা প্রয়োজন, তাই মেহরুব ওকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সে ভিড়ের কথা ভুলেই গেছে। তার একমাত্র লক্ষ্য—নূরির নিরাপত্তা, তার স্বস্তি, আর এই শহরের ব্যস্ততার মাঝেও তাকে নিজের কাছে রাখা।
মেহরুব একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
— আমি আছি, চিন্তা করিস না।
নূরি মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকায়। সে জানে, যত ভিড়ই হোক, যত ব্যস্ততাই থাকুক—তার আপন পুরুষের বাহুতে সে সবসময় নিরাপদ…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজ সকালেই নূরি তার আব্বার কাছে এসে বলেছিল—
— আব্বা, আমার কিছু কাপড় কেনার দরকার। আপনার সময় হলে আমাকে এনে দেবেন? আমি লিস্ট দিয়ে দিচ্ছি।
নূরির কথা শুনে তৌফিক তালুকদার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই পাশে বসে থাকা মাজহারুল সাহেব মেহরুবকে ডাক দিলেন। নিজের বাবার ডাকে দেরি হতে পারে, কিন্তু মেহরুবের আসতে দেরি হয় না।
সামনে এসে দাঁড়াতেই গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দিলেন মাজহারুল সাহেব—
— মেহরুব, এখন থেকে নূরির সব দায়িত্ব তোমার। আমরা আমাদের মেয়ে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম, আগলে রাখার জন্য। কিন্তু তুমি তাকে তার মর্যাদা দাওনি, তাই বলে তার দায়িত্বও নেবে না?
মেহরুব এক পলক নূরির দিকে তাকায়, তারপর বলে—
— কি হয়েছে, আব্বা? একটু খুলে বলুন।
নূরি কিছু না বলেই দ্রুত সরে যায়, তবে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শোনে।
মাজহারুল সাহেব কঠোর স্বরে বলেন—
— তোমার স্ত্রী তার বাবার কাছে এসে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস চাইছে। অথচ তুমি তার স্বামী হয়েও কিছু করছো না! এটা কি তোমার দায়িত্ববোধ?
তৌফিক তালুকদার বিষয়টি সামলানোর চেষ্টা করেন—
— ভাইজান, বাদ দিন না। হয়তো সময় লাগবে।
কিন্তু এবার আরও কঠোর হয়ে ওঠেন মাজহারুল সাহেব—
— তুই চুপ থাক! তোর জন্যই আমার ছেলে এত সাহস পেয়েছে। যখন বলেছিল, ‘নূরিকে স্ত্রী হিসেবে মানি না,’ তখনই বলেছিলাম, ওকে ওর খালাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিই। অন্তত ভালো থাকবে। কিন্তু তুই বললি, সব ঠিক হয়ে যাবে। কই ঠিক হলো? আর কিছুদিন দেখি, তারপর আমি নিজ হাতে আমার মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দেব।
এই কথা শুনে মেহরুবের ভিতরটা কেঁপে ওঠে।
নূরির অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে!
মুহূর্তেই ঠোঁট মুখ শুকিয়ে আসে, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না।
— অন্য বিয়ে কেন? মানুষের তো বিয়ে একবারই হয়!
মাজহারুল সাহেব এবার কঠোর গলায় বলেন—
— তাহলে কি করব? তুমি আমার মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মানবে না, আর সে সারাজীবন তোমার আশায় বসে থাকবে?
মেহরুব অস্ফুট স্বরে বলে—
— আ… আচ্ছা, আমি নিজের দায়িত্ব পালন করব।
বলে সেখান থেকে চলে যায়, যেন আর কিছু শুনতে না হয়।
তৌফিক তালুকদার এবার বলেন—
— এত রাগ না করলেও পারতেন।
মাজহারুল সাহেব ধীর গলায় বলেন—
— কি করব? দুই বছর হলো বিয়ে হয়েছে, অথচ দু’দিনও সংসার করেনি। এবার শুক্রবার আমি নিজের হাতে আবার বিয়ে দেব, এবার ঠিকই মেনে নেবে।
— কিভাবে বুঝলেন, মেনে নেবে?
— দেখলি না, যখন বললাম নূরির অন্য বিয়ে দেব, তখন কেমন মুখ শুকিয়ে গেল? নূরিকে স্ত্রী মানবে না, আবার অন্য কারোও হতে দেবে না—এটা তো হয় না! হয় নিজের বেগম নিজে রাখতে হবে, নয়তো আমরা ভালো দেখে ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেব।
নূরির আতঙ্ক
এসব শুনে নূরির ভেতরটা ধড়ফড়িয়ে ওঠে। বুকের ভেতর এক অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ভাবে—
তার মেহরুব ভাই তাকে বউ হিসেবে কখনোই মানবে না। যদি সত্যিই অন্য কারো অধীনে চলে যেতে হয়? না! সে তো মরে গেলেও এটা মেনে নিতে পারবে না!
সারাদিন কেটে যায় এক গভীর আতঙ্ক আর হতাশার মাঝে। যদি মেহরুব স্বীকার না করে, তবে সে তো শেষ… বাঁচতে পারবে না অন্য কারো হয়ে।
নূরি ভেবেছিল, মেহরুব তাকে কাপড় কিনে দেবে না। হয়তো আবারও আব্বাকে বলতে হবে।
কিন্তু সে ভুল প্রমাণিত হলো।
বিকেল তিনটার দিকে⚡⚡
মেহরুবের ঘরে গিয়ে নূরি ওর কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখছিল। তখনই মেহরুব হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করে! কিন্তু ভেতরে ঢুকেই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
সে দেখে, তার নূরি ফুল যত্নে কাপড় গুছিয়ে রাখছে, একদম আপন করে।
মেহরুব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একদিনও স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়নি, অথচ এই মেয়েটি দিনের পর দিন তার জন্যই সবকিছু করেছে।
আজ সারাদিন সে শুধু এই মেয়েটির কথাই ভেবেছে, যে নাকি তার থাকবে না!
কিন্তু সে তো এটা কখনোই হতে দেবে না। এই মেয়েকে সে সারাজীবন চাই… বাঁচতে হলে এই নারীকে চাই!
নূরি আপন মনে ওয়ারড্রবে কাপড় রাখছিল আর বিরবির করছিল—
— এই মেহরুব ভাই কোনো কাজের না! নিজে না পারলে আমায় তো বলতে পারত! কাপড় ধোয়ার কী অবস্থা! সাত দিনেও শুকোয় না! সবকিছুতে হেয়ালি! সবকিছুতে অবহেলা! একটা মানুষ এত অগোছালো হয় কিভাবে!
মেহরুব নীরবে হাসে। তার নূরি ফুল এখনো তাকে নিয়েই আছে, তার জন্যই ভাবে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলে—
— তুই আছিস তো, এই অগোছালো আমায় গোছানোর জন্য।
নূরি চমকে উঠে!
চোখ তুলে দেখে তার শ্যাম পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে সামনে—
নূরি মায়া ভরা দূষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহরুব এর পানে
মেহরুবের পরনে সবসময়ই পাঞ্জাবি থাকে, তবে যখন কোম্পানিতে যায়, তখন শার্ট-প্যান্ট পরে।
নূরি মেহরুবের দিকে তাকিয়ে মন ভরে দেখে, যেন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার শ্যাম পুরুষ—তার আপনজন, তার একমাত্র আশ্রয়। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও তার মন চাচ্ছে আরও একবার আপন পুরুষটিকে ভালো করে দেখে নিতে।
সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কোমরে ইন করা, চুলগুলো একটু এলোমেলো, ক্লান্ত মুখ… তবু কী ভয়ংকর সুন্দর!
পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হয় নাকি! নূরির চোখ কিছুতেই সরতে চায় না তার শ্যাম পুরুষের দিক থেকে।
এত ভয়ংকর সুন্দর পুরুষ হয় নাকি!
নূরি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, যেন চোখ ফেরাতে পারছে না।
মেহরুব বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে—
— কিরে? আমার মতো কালো মানুষের দিকে এভাবে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছিস কেন?
নূরি মুচকি হেসে বলে—
— **আপনি কালো নন, মেহরুব ভাই। আপনি শ্যাম পুরুষ… আপনি আমার শ্যাম পুরুষ আপনি সুন্দরের চেয়েও ভয়ংকর সুন্দর!
বলেই নিজেই লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়!
মেহরুব এবার সত্যিই হেসে ফেলে। বুঝতে পারে, তার নূরি তাকে কতখানি ভালোবাসে।
আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বলে—
— আর লজ্জা পেতে হবে না। যা, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।
নূরি ভ্রু কুঁচকে তাকায়—
— কেন, মেহরুব ভাই?
মেহরুব মুচকি হেসে বলে—
— তোর যা কেনাকাটা করার আছে, আজ করবি। তোকে নিয়ে টাউনে যাব।
নূরি মেহরুবের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে—
— প্রয়োজন নেই। বড় আব্বা এমনিই বলেছেন, তাই আপনি অযথা কষ্ট করবেন না।
মেহরুব এবার ধমক দিয়ে বলে—
— আমি আমার ইচ্ছেতে তোকে নিয়ে যাচ্ছি, তোর বড় আব্বার কথায় নয়। তাই চুপচাপ তৈরি হয়ে নে।
নূরি জানে, এই পুরুষ যা বলে, তা-ই করে। তাই তর্ক করে কোনো লাভ নেই…
—বর্তমান 🌸🌸
মেহরুব নূরিকে নিয়ে একটা জুতোর শোরুমে প্রবেশ করে।
মেহরুব নূরিকে বলে,
— তোর কোন কোন জুতো পছন্দ, বেছে নে।
নূরি মেহরুবের হাতে থাকা নিজের হাতের দিকে এক পলক তাকায়। মেহরুব তার হাতটা খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে! নূরি মেহরুবের দিকে তাকিয়ে একদম নিচু সুরে বলে,
— হাতটা ছেড়ে দিলে ভালো হয়, আমি সামনে যেতে পারি।
নূরির কথায় মেহরুব ওর দিকে তাকায়, কিন্তু হাত ছাড়ে না, বরং হাত ধরেই ওকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তখন দোকানের একজন কর্মী এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,
— স্যার, আপনাদের কী লাগবে বলুন, আমি সাহায্য করছি।
মেহরুব বলেন,
— এই শোরুমের যত ভালো ভালো জুতো আছে, এক এক করে আমাদের দেখান।
এ বলে মেহরুব নূরিকে নিয়ে দোকানে রাখা সোফায় বসে যায়।
নূরি দেখতে পায় দোকানের কর্মী একে একে অনেকগুলো জুতো সামনে রাখছেন।
নূরি এটা দেখে মেহরুবের বাহু হালকা টেনে ধরে। মেহরুব বুঝতে পারে, নূরি কিছু বলবে। তাই নিজের মাথা নূরির দিকে এগিয়ে নিয়ে বলেন,
— হুম, বলো।
নূরি বলে,
— আমার একটাই জুতো চাই, এতগুলো নয়। শুধু একটা সু কিনে দিন, এত কিছু দিয়ে কী করব আমি?
মেহরুব উত্তরে বলে,
— কেন? পড়বি না?
নূরি বলে,
— আরে আমি তো এই জুতো পরে বাইরে যাই না। আমি তো সু পরে মাদ্রাসায় যাই, একটা ভালো সু হলেই হবে। এত কিছু প্রয়োজন নেই।
মেহরুব নূরির কথা শুনে দোকানের কর্মীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
— একটা কাজ করুন, যত সু কালেকশন আছে, সব দেখান এখন।
কর্মী মাথা নাড়িয়ে বলেন,
— আচ্ছা।
দোকানের কর্মী একে একে অনেক দামি সু ও জুতো তাদের সামনে রাখেন।
মেহরুব নূরিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— দেখো, কোনটা পছন্দ হয়। যেগুলো পছন্দ হবে, পায়ে পরে দেখে নাও।
নূরি আলতো পায়ে উঠে গিয়ে একখানা সাদাসিধা, কোনো ডিজাইন ছাড়া কালো সু হাতে তুলে নেয়। সোফায় বসে মেহরুবের দিকে তাকিয়ে একদম নিচু গলায়, যেন মেহরুব ছাড়া আর কেউ শুনতে না পায়, ফিসফিসিয়ে বলে,
— মেহরুব ভাই, এটাই নিয়ে নেই। আর লাগবে না।
মেহরুব নূরির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। এই মেয়েটা এত অল্পতেই কেন সন্তুষ্ট হয়? একটা কেন, অন্তত দুটো তো কিনতে পারত! শেষে তার নিজের জোরেই কিনে দিতে হবে।
মেহরুব বলে,
— আচ্ছা, এটা পায়ে পরে দেখো।
নূরি মাথা নাড়িয়ে নিজের পায়ের জুতো খুলতে থাকে। বসে থেকে ঝুঁকে জুতো খুলছে নূরি। মেহরুব এটা দেখে উঠে দাঁড়ায় এবং নূরির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।
নূরি তো অবাকের শেষ সীমানায়! কী করছেন মেহরুব ভাই!
মেহরুব নূরির পা আলতো হাতে ধরে নেয়। নূরি কেঁপে ওঠে এমন আচমকা আচরণ দেখে। কিছু বলতেও পারছে না। জোরে বললেই দোকানে থাকা অন্য মানুষ শুনে ফেলবে, আর সে চায় না কোনো হারাম পুরুষ তার গলার আওয়াজ শুনুক।
মেহরুব আলতো হাতে নূরির পায়ের থেকে জুতো খুলে, নূরির পছন্দ করা জুতোটি পায়ে পরিয়ে দেয়।
জুতো পড়ানো হলে মেহরুব বোঝে, এটা নূরির পায়ে একদম ফিট হয়েছে। সে নূরির দিকে তাকিয়ে বলে,
— হয়েছে তো?
নূরি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেহরুব ভাইয়ের এই আচরণ দেখছিল, তারপর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।মুখ দিয়ে কিছু বলে না এখানে হারাম পুরুষ আছেন সে চায় না হারাম কেউ তার গলার আওয়াজ অব্দি শুনুক
মেহরুব বলে,
— নিয়ে নেই।
নূরি আবার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
মেহরুব নূরির সম্মতি পেয়ে, ওর পা থেকে সেই জুতোটি খুলে আগের জুতোটি পরিয়ে দেয়।
নূরির বেশ লজ্জা লাগছে। এমনিতেই দোকানের ভেতর থাকা মানুষরা তাকিয়ে আছে, কারণ সে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো পর্দায় ঢাকা। আর তার ওপর মেহরুব তাকে এভাবে জুতো পরিয়ে দিচ্ছে! এসব সবাই দেখছে বেশ লজ্জায় পড়ে যায় সে
মেহরুব উঠে গিয়ে নিজে পছন্দ করে বারো-পনেরো জোড়া ভিন্ন ডিজাইনের সু এবং সাত-আটটা অন্য ডিজাইনের জুতো দেখিয়ে দেয় দোকানের কর্মীকে। তারপর বলে,
— ঐ কালো জুতোর মাপের সবগুলোই মাপ মিলিয়ে প্যাক করে দিন।
এতগুলো জুতো দেখে নূরির তো হুশ উড়ে যায়। কী হয়েছে, এই পুরুষ তো পাগল হয়ে গেছে নাকি! এত জুতো তো সে নিজের এক জীবনেও পরেনি!
নূরি উঠে গিয়ে মেহরুবের বাহু টেনে ফিসফিসিয়ে বলে,
— এত জুতো দিয়ে কী করবেন? একই মাপের, আমার এতগুলো চাই না। আমি একটাতেই সন্তুষ্ট।
মেহরুব কোনো ভাবান্তর না হয়ে বলেন,
— তোর প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমার আছে। আমি কিনছি। আর একটা কথাও বলবি না।
নূরি চুপ হয়ে যায়।
মেহরুব দোকানের ম্যানেজারকে বলেন,
— হোম ডেলিভারি হয়?
তিনি উত্তর দেন,
— জি, হয়।
মেহরুব বলেন,
— আচ্ছা, তাহলে এই জিনিসগুলো পৌঁছে দিন।
এ বলে মেহরুব ঠিকানা আর বিল দিয়ে নূরিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
—
সন্ধ্যার হু হু বাতাসে সিলেট শহর এক অদ্ভুত মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে।ক্বীন ব্রিজের উপর দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছে মেহরুব আর নূরি। নূরির নরম হাতখানা মেহরুবের মুঠোয় বন্দি, নূরি চারপাশের সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে—তার প্রাণের শহর, তার ভালোবাসার সিলেট!
এই শহর এমনিতেই ভয়ংকর সুন্দর, আর রাতের সিলেট!—সে তো অন্য এক রূপকথা। তার মধ্যেই এমন স্নিগ্ধ বাতাস, শরীর ছুঁয়ে যাওয়া এক শীতল প্রশান্তি, আর পাশে মেহরুব! এই মুহূর্তটা যেন এক পূর্ণতা, এক স্বপ্নপূরণ। কতদিন চেয়েছিল এমন এক সন্ধ্যায়, প্রিয় পুরুষের হাত ধরে আপন শহরের পথে হাঁটতে! আজ সেই স্বপ্ন সত্যি হলো।
বারবার মেহরুবের দিকে তাকিয়ে দেখছে নূরি, যেন এই বাস্তবতাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে। আর মেহরুব? সে আজ এক কান্ডই করে ফেলেছে!
বোরখা কিনতে গিয়ে একটা পছন্দ করেছিল নূরি, আর মেহরুব?—গুনে গুনে পনেরোটি বোরখা নিয়ে নিয়েছে! কলিজাটা ধক করে উঠেছে নূরির, এত টাকা খরচ! তার জন্য! শুধু কি তাই? সাথে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার ছাব্বিশটি সুতির থ্রি-পিস, সাত-আটটি গর্জিয়াস থ্রি-পিস, বিশখানা ওড়না, সাত-আটটি নামাজের হিজাব, হাত-পা মোজা, বড় বড় নিকাব, এমনকি চোখ ঢাকার জন্য কালো পর্দা পর্যন্ত!
নূরি তো হাতে-পায়ে ধরে বারণ করেছিল, কিন্তু মেহরুব ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে! সবগুলো জিনিস হোম ডেলিভারি করিয়েছে সে, যেন হাতে কিছু না থাকে—শুধু থাকে নূরির হাত, আর কিছুটা সময় তার সাথে কাটানোর সুযোগ।
মেহরুব মুচকি হেসে বলে,
— এভাবে বারবার কি দেখছিস?
নূরি আলতো গলায় ফিসফিস করে,
— আপনাকে।
ভ্রু কুঁচকে মেহরুব,
— আমি এত সুন্দর?
নূরি হাসে,
— জানি না, তবে আমার চোখে আপনি সবচেয়ে সুন্দর। আমার চোখ, আমার অন্তর সুন্দর পুরুষ বলতে শুধু আপনাকেই চেনে।
মেহরুব চুপ করে যায়, এই মেয়েটা এত গুছিয়ে কথা বলে যে তার অন্তর শীতল হয়ে আসে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,
— পছন্দ করিস আমায়?
নূরি থমকে যায়, কী বলবে! কিছু না বলায় মেহরুব আবার বলে,
— কি রে, চুপ করে আছিস কেন?
অবশেষে সত্যিটাই স্বীকার করে নেয় নূরি,
— হ্যাঁ, পছন্দ করি। খুব পছন্দ করি। আমার পছন্দের সমাবেশে আপনিই প্রধান, আর আপনিই শ্রেষ্ঠ!
মেহরুবের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে যায়।
— তুইও ধীরে ধীরে আমার পছন্দের সমাবেশে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠছিস।
নূরি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, কিন্তু সাথে সাথে মেহরুব চাপা গলায় বলে,
— হুঁশ! এখানে এভাবে হাসিস না। তোর হাসির শব্দের সাক্ষী শুধু আমি হতে চাই, অন্য কেউ নয়।
নূরি মাথা নাড়িয়ে মেহরুবের বাহু আঁকড়ে ধরে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
— জানেন মেহরুব ভাই?
— কি?
— আপনি এই সন্ধ্যার মেঘমুক্ত আকাশের মতোই ভয়ংকর সুন্দর!
মেহরুব মুচকি হেসে বলে,
— নূরি ফুল, আমার মতো তুচ্ছ পুরুষকে এত উঁচুতে নিস না।
নূরি মেহরুবের চোখে চোখ রেখে বলে,
— আপনি আমার চোখে তুচ্ছ পুরুষ নন। বরং আপনি আমার চোখে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ!
মেহরুব থমকে যায়, কিছুক্ষণ পর বলে,
— তোকে বিয়ে করলাম, অথচ তোকে তোর প্রকৃত মর্যাদা দিতে পারলাম না। আর তুই এখনো আমাকে এত আপন ভাবিস?
নূরি হাসে,
— “আমি আপনায় ভালোবাসলে আপনারও, যে আমায় ভালোবাসতেই হবে তা তো নয়”!
— “আমি আপনায় আপন ভাবি আপনায় ভালোবাসি বলে, এবার আপনি আমায় ভালোবাসবেন কি না, মর্যাদা দিবেন কি না, সেটা আপনার ইচ্ছে”! তবে আমি তো বাসি আমি তো মর্যাদা দেই আর এটাই যথেষ্ট আমার জন্য ‘!
মেহরুব নির্বাক! এই মেয়েটা তাকে প্রতিনিয়ত অবাক করে দিচ্ছে!
কথা বলতে বলতে তারা সিলেট বন্দরের কাছাকাছি চলে আসে। হঠাৎ মেহরুব নূরির বাহু শক্ত করে ধরে নিজের বুকে টেনে নেয়—কেউ যেন তাকে স্পর্শ না করতে পারে, তার ব্যক্তিগত নারীকে!
নূরি একরাশ সুখ নিয়ে মেহরুবের বুকে মুখ গুঁজে দেয়। আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে উষ্ণ, সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে উজ্জ্বল একটি দিন!
মেহরাজের ঘুম আজকাল প্রশান্তি খুঁজে পায় এক জায়গাতেই—এশার বুকের ওমে। এ ক’দিনে যেন এটাই তার নিত্য অভ্যাস হয়ে গেছে। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিতে না দিতেই ঘুম এসে যায়, অথচ সেই ঘুমের মূল্যটা বেশ চড়া! এশার ধমক, খোঁচা, মাঝে মাঝে লাতিও জোটে ভাগ্যে, তবু মেহরাজের একটাই কথা—
— “বউ যখন এনেছি, তখন আর বালিশে নয়, বউয়ের বুকেই ঘুমাবো বাকি জীবন! এতে বউ উষ্টা মারুক, লাতি দিক, গালি দিক— আমি কিছুতেই বউয়ের আঁচল ছাড়ব না!”
আজ আসরের নামাজের আগে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে মেহরাজ। সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার হিসেবে নিযুক্ত আছে বর্তমান , দেশ ছেড়ে থাকাটা আর ভালো লাগছিল না তার। কানাডার হাসপাতাল থেকে রিজাইন দেওয়ার আপিলও করে ফেলেছে। এবার সে দেশেই থাকবে, এশার কাছেই থাকবে, এটাই তার প্রতিজ্ঞা!
আজকের দিনটা ছিলো কঠিন। টানা তিন ঘণ্টার অপারেশনের ধকল শেষে ক্লান্ত দেহটা যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বাড়ি ফিরেই গোসল সেরে আসরের নামাজ পড়লো, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে একদম সোজা ঘরে ঢুকে পড়ে।
ঘরে ঢুকতেই দেখে এশা জায়নামাজে বসে আছে। চোখ বন্ধ, যেন গভীর কোনো ভাবনায় নিমগ্ন। মেহরাজ জানে, নামাজের পরপরই এশা একটু সময় চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু আজকের ক্লান্তিটা এতোটাই প্রবল যে, সে কোনো কিছু না ভেবেই এগিয়ে গেলো।
কোনো কিছু না বলে, একটুও অনুমতি না নিয়ে জায়নামাজ থেকে এশাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ফেলে এনে বসিয়ে দিলো মেহরাজ !
আচমকা এমন ঘটনায় এশা ক্ষেপে গিয়ে উঠে বলে।
— “সমস্যা কী? সারাদিন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম না নিয়ে আমায় খোঁচাচ্ছ কেন?”
মেহরাজ নির্লিপ্তভাবে মাথা থেকে টুপিটা খুলে পাশে রাখলো, তারপর লুঙ্গিটা গুছিয়ে বিছানায় আরেকটু ভালোভাবে উঠে বসে বলে।
— “তোমার বুকে মাথা রাখলেই আমার বিশ্রাম হয়ে যাবে।”
এই বলে বিন্দুমাত্র দেরি না করে এশার মাথা বালিশে ফেলে দিলো, তারপর নিজে গিয়ে ওর বুকের কাছে মুখ গুঁজে দিলো।
চোখ বুজতেই যেন ক্লান্তির সমস্ত ভার মুছে যেতে লাগলো। যেন সারাটা দিন সে শুধুই এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিল! দু’হাত বাড়িয়ে এশার কোমরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, যেন আর কখনো ছেড়ে যাবে না।
এশা মেহরাজের কাঁধে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে বলে—
—”আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধর! এমনভাবে ধর, যাতে আমার সারা শরীরের হাড়-গুঁড়ো ভেঙে আমি ওপরে চলে যাই!”
মেহরাজ ওর বুকে মুখ বুঁজেই ফিসফিস করে বলে—
—”না গো বউ, এটা কী করে হয়? তুমি ওপরে চলে গেলে তোমার সাথে যে আমার না হওয়া চার-চারটে বাচ্চাও চলে যাবে!”
মেহরাজের কথা শুনে এশা দাঁত চেপে বলে—
—”তোর এই অসভ্য জবানে শুধু জুতোর বারি পড়ুক, আর কিছু না!”
মেহরাজ আগের মতোই ফিসফিস করে হেসে বলে—
—”সে তো তুমি আমায় দিনে একশো বারি জুতো দিয়ে মারো! মুখ দিয়ে তা আর বলতে?”
এশা নিজের হাতের আঙুল মেহরাজের চুলের ফাঁকে ডুবিয়ে দিয়ে বলে—
—”যদি ঘুমোতে হয়, তো চুপচাপ ঘুমা! নয়তো উঠে যা!”
মেহরাজ এশার নরম হাতের ছোঁয়া নিজের চুলে পেতেই সাথে সাথে চোখ বুঁজে নেয়। একটা কথাও বলে না, আর চুপচাপ ঘুমিয়ে যায়!
এখন,
মাগরিবের সময় হতে চলল, কিন্তু মেহরাজের উঠার নামগন্ধ নেই! এশা মেহরাজকে বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে বলে
—”মেহরাজ, ওঠো! এটা ঘুমের সময় নয়, এখন নামাজের সময়!”
মেহরাজের ঘুম হালকা ভেঙে যায়। মেহরাজ মুখ তুলে এশার দিকে তাকিয়ে বলে—
—”আজান হয়ে গেছে?”
এশা উত্তর দেয়—
—”হয়নি, একটু পরেই হয়ে যাবে!”
মেহরাজ এশার উত্তর শুনে ছোট্ট করে “ওহ” বলে। যেই না আবারও শুতে যাবে, তখনই চোখ পড়ে এশার মুখশ্রীর দিকে। মেহরাজ আর চোখ ফিরাতে পারে না নিজের বউয়ের দিক থেকে!
এশার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এশার কপালে ও গলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয় আলতো হাতে। তারপর এশার মুখের সামনে নিজের মুখ নিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
এশা মেহরাজের এমন শান্ত আচরণে একদম স্থির হয়ে যায়। এক দৃষ্টিতে সেও তাকিয়ে থাকে মেহরাজের দিকে।
মেহরাজ আলতো হেসে বলে—
—”আমার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী, আমার প্রিয় শ্যামবতী, তোমায় আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি! ভীষণ! তুমি আমার শ্যামবতী!”
এশা মেহরাজের কথা শুনে এক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
মেহরাজ এশার গালে আলতোভাবে নিজের হাত ছুঁইয়ে বলে—
—”জানো, যবে থেকে তোমার জন্য কবুল বলেছি, তবে থেকে তোমার প্রতি এক অন্তহীন ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে! জানো, শ্যামবতী, তোমায় প্রথম দেখেই আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে গেছি! পাগল! এখন তো তুমি ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না!”
একটু থেমে যায় মেহরাজ। এশা আগের মতোই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাজ আবারও বলে—
—”আমার সবটা জুড়ে আজ তোমার বিচরণ! তোমায় ছাড়া আমি নিজের কাছে নিজেই অসহায়! তুমি প্রাণনেশা হয়ে গেছো,!”
এশা এগুলো শুনে কিছু মুহূর্ত চুপ থাকে। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলে—
—”তাড়াতাড়ি উঠো! এই অবেলায় দরজা বন্ধ করে আমরা ঘরে বসে আছি, বাড়ির সবাই কী ভাববে?”
মেহরাজ এশার গলায় মুখ গুঁজে দিতে দিতে বলে—
—”কি আর ভাববে! হয়তো ভাববে, তোমায় নিয়ে অন্য জগতে পারি দিয়েছি!”
এশা রেগে গিয়ে বলে—
—”ইবলিশ! আস্ত একটা ইবলিশ! তুই সবসময় শুধু এই ইবলিশগিরি নিয়ে থাকিস!”
মেহরাজ শব্দ করে হেসে ওঠে, শুধু! আর কিছু বলে না।
এশা এবার বিরক্ত হয়ে বলে—
—”নিজের এত বড় দামড়া শরীর নিয়ে এসেই ঘুমিয়ে যাও! আমার এই ছোট্ট শরীরের উপর একটুও কি বিবেক নেই, যে আমার কষ্ট হয় কি না?”
মেহরাজ ফিসফিসিয়ে বলে—
—”জান, এসব টুকটাক কষ্ট মেনে নিতে হয়!”
এশার নামাজ পড়ে বাচ্চাদের নিয়ে তিনতলায় নামাজের কক্ষে বসে আছে মেহনূর। উদ্দেশ্য—এখন তাদের কোরআন মসক দেওয়া আর সবক নেওয়া।
মেহনূর বাচ্চাদের উদ্দেশে বলে:
— কার কোন আয়াত পড়তে বা বুঝতে সমস্যা হয়, আমায় বলো।
এলিজা হাত তুলে বলে:
— ছোট আম্মা, আমি কোরআনের সাকতাহ ঠিকমতো আদায় করতে পারি না, বুঝতেও পারি না।
মেহনূর হেসে বলে:
— ওহ, আচ্ছা! তাহলে মন দিয়ে শোনো।
বাচ্চারা মনোযোগ দিয়ে তাকায়।
মেহনূর বুঝিয়ে বলতে শুরু করে:
— সাকতাহ বলতে সেই ছোট্ট বিরতিকে বোঝানো হয়, যেখানে কোরআন তিলাওয়াতের সময় শ্বাস না নিয়ে সামান্য থামতে হয়, কিন্তু পূর্ণ বিরতি বা ওয়াকফ হয় না।
— বুঝতে পারলে?
বাচ্চারা একসাথে বলে:
— জ্বি ছোট আম্মা।
মেহনূর এবার নিজের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে:
— কোরআনে মোট চারটি সাকতাহ রয়েছে, আমাদের মাজহাব মতে। সেগুলো হলো:
১. সূরা কাহাফ-এর ১ নং আয়াতে
২. সূরা কিয়ামাহ-এর ২৭ নং আয়াতে
৩. সূরা ইয়াসিন-এর ৫২ নং আয়াতে
৪. সূরা আল-মুতাফফিফীন-এর ১৪ নং আয়াতে
— আমি তোমাদের সূরা কাহাফের সাকতাহ আদায় করা শিখাবো, যাতে বাকি তিনটি আয়াতেও ঠিকভাবে করতে পারো। সূরা কাহাফের সাকতাহ দুইভাবে আদায় করা যায়—এক, তানবীন দিয়ে; দুই, মদ দিয়ে। আমি দুটোই দেখিয়ে দেবো।
মেহনূর কোরআন খুলে তিলাওয়াত শুরু করে:
“الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَىٰ عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا”
এই পর্যন্ত পড়ে সামান্য শ্বাস বন্ধ রেখে থামে। অতঃপর কয়েক মুহূর্ত পর আবার পড়ে:
“قَيِّمًا لِّيُنذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِّن لَّدُنْهُ وَيُبَشِّرَ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا”
বাচ্চারাও একসাথে পড়ে। মেহনূর এবার উভয় নিয়মে সাকতাহ আদায় করে বুঝিয়ে দেয়। একে একে বাচ্চারাও করে দেখায়, এবং সবাই ঠিকভাবে শিখে নেয়।
মেহনূর বলে:
— হয়েছে, এবার মনে রেখো, এই সূরার সাকতাহ তানবীন ও মদ দু’ভাবেই আদায় করা যায়। আমি উভয়ভাবে মসক দিলাম, তোমরা মনোযোগ দিয়ে শিখে নাও।
এরপর ইনাম বলে:
— ছোট আম্মা, সূরা আন-নূরের ৩৫ নম্বর আয়াতটা একবার পড়াতেন?
মেহনূর হাসি দিয়ে বলে:
— আচ্ছা, ধরো আমি পড়ে যাচ্ছি।
সবাই কোরআন খুলে আয়াতটি দেখে। মেহনূর ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করে শোনায়।
পাঠ শেষে বাচ্চারা বলে:
— ছোট আম্মা, আপনি আমাদের একটি সুন্দর বয়ান শোনান। মাদ্রাসায় তো আপনার বয়ান আমরা শুনি, খুব বুঝি।
মেহনূর মুচকি হেসে বলে:
— আচ্ছা, আজ নফস নিয়ে বলি। নফস বলতে কী বুঝো?
বাচ্চারা বলে:
— নিজের ভেতর থাকা ভালো-খারাপ আত্মাকে বুঝি।
মেহনূর বলে:
— একদম ঠিক। নফস হলো মানুষের আত্মা বা মন। এটা তার আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, অনুভূতি, প্রবৃত্তির সাথে জড়িত। ইসলামে নফসের তিনটি স্তর বলা হয়েছে:
এক নাম্বারে নফস-এ-আম্মারা যা প্রবৃত্তি বা কামনা করার আত্মা এটি হলো সেই নফস যা খারাপ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, যেমন ক্ষুধা, লালসা, রাগ ইত্যাদি।
দুনম্বারে নফস-এ-লাওয়ামা যা আত্ম-অভিযোগকারী আত্মা এটি হলো সেই নফস যা ভুল বা পাপ করার পর নিজের উপর অনুশোচনা করে।
তিন নম্বরে।নফস-এ-মুতমাইন্না যা শান্ত ও তৃপ্ত আত্মা এটি হলো সেই নফস যা পরিপূর্ণ শান্তি ও তৃপ্তির অনুভূতি অনুভব করে, আল্লাহর সাথে সঠিক সম্পর্ক গঠন করলে এই স্তরে পৌঁছানো যায়।
— আমরা চাইলে আমাদের নফসকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারি। কিন্তু আমরা অনেক সময় উল্টো নিজেরাই নফসের গোলাম হয়ে যাই। আমাদের রবকে পেতে হলে, নফসের দাসত্ব ছেড়ে দিতে হবে।
ইমরান তখন জিজ্ঞেস করে:
— কিন্তু সেটা কিভাবে, ছোট আম্মা?
মেহনূর বলে:
— ধরো, নামাজের সময় হয়েছে। তোমার মন বলছে, নামাজ পড়ে নেই। আবার একই মন বলছে, আজ থাক, পরে পড়বো। এবার তুমি যদি তোমার প্রবৃত্তিকে জয় করে বলো, “না, আমি এখনই নামাজ পড়বো”, তখন বুঝবে—তুমি নফসের দাস নও, বরং নফস তোমার অধীনে।
বাচ্চারা আগ্রহভরে মাথা নাড়ায়। মেহনূর শেষ কথা বলে:
— নফসকে নিজের আয়ত্তে আনতে হলে কোরআন, নামাজ, ভালো কাজের দিকে মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই শান্তি পাবে।
এহসান আজ তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরে এসেছে। ঘরে এসে মেহনূরকে না পেয়ে তড়িঘড়ি নিচে নেমে যায়। জানতে পারে, তার বেগম সাহেবা ব্যস্ত আছেন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। তাই আর ডেকে ওঠেনি। ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম না নিয়েই গোসল করে মেহনূরের কাছে যাওয়ার জন্য বের হয়ে পড়ে।
দোতলার দরজায় এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে মেহনূরের কোমল, দৃঢ় কণ্ঠ শোনা যায়—নফসের ব্যাখ্যা দিচ্ছে বাচ্চাদের। এহসান দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে মুগ্ধতা, মুখে এক প্রশান্তির হাসি। মেহনূরের কথা থামা অবধি তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
মেহনূর বয়ান শেষ করলে হালকা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তাকায় এহসানের দিকে।সে বুঝতে পেরেছিল তার পুরুষ এখানেই আছেন দাঁড়িয়ে যে তার অস্তিত্বের অনুভব করতে পারে
এহসান এগিয়ে এসে বাচ্চাদের পাশে বসে বলে:
— তা শুনি, ক্বারীয়া মেহনূর, কী শিখাচ্ছেন আজ?
এরিশা মুচকি হেসে বলে:
— ছোট আব্বা, আপনি জানেন! আমাদের ক্বারীয়া ছোট আম্মা খুব ভালো বয়ান দেন। একদম বুঝিয়ে দেন আমাদের মতো করে!
এহসান হাসে, মেয়ের গালে আলতো টোকা দিয়ে বলে:
— হুম, বুঝেছো আম্মা, তোমার ছোট আম্মা কার বেগম, সেটাও মনে রেখো। তোমার ছোট আব্বার বেগম।
এলিজা সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে:
— হয়েছে ছোট আব্বা! এসব বলতে হবে না। আমাদের ছোট আম্মা আপনার বেগম হওয়ার আগে আমাদের ক্বারীয়া হয়েছেন!
এহসান এবার হেসে এলিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়:
— ওরে আমার মা রে! তোমরা এত পাকনামি কোথা থেকে শিখো?
মেহনূর পাশে বসে শুধু হাসছে, চোখে মায়া মাখানো দৃষ্টিতে সবার কথোপকথন শুনছে।
হঠাৎ ইমরান বলে ওঠে:
— ছোট আব্বা, আমার একটা বিচার আছে!
এহসান হেসে বলে:
— বলো বাবা, তোমার কী বিচার? তুমি তো এক আদম, যা বিচার করতে করতে দিন কাত হয়ে যায়! এখন তোমার কী বিচার শুনবো আচ্ছা বলো কি বিচার?
ইমরান ইনামের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করে:
— ছোট আব্বা, গত সপ্তাহে দাদাজান আমায় বিশটি হাদিস মুখস্থ করতে বলেছিলেন। আমি আঠারোটা পারলাম, দুটো পারিনি। তাই ইনাম আমায় সারাদিন খুঁচায়, মজা করে।
মেহনূর নরম কণ্ঠে বলে:
— এটা ঠিক না বাবা। মজা করতে হবে এমনভাবে, যাতে কারও মনে কষ্ট না লাগে। ইনাম, মনে রাখবে, ভাইয়ের সঙ্গে মজা করা মানে তাকে ছোট করা নয়।
ইনাম মুখ নিচু করে বলে:
— আচ্ছা ছোট আম্মা, আমি আর করব না। তবে ভাইজানও যেন আমায় নিয়ে বেশি মজা না করে!
মেহনূর এবার ইমরানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে:
— তুমি বড় ভাই হয়ে এমন করলে ছোট ভাই তো শিখবেই, তাই না?
সবাই মিলে হাসাহাসি করতে করতে গল্প জমে ওঠে। এমন হাজারো হাসি-গল্প শেষে এহসান আর মেহনূর ঘরে ফিরে আসে।
ঘরে এসে মেহনূর একটু লাজুকভাবে বলে:
— মাফ করবেন। আপনি আসার পর আপনার সামনে থাকতে পারিনি। বাচ্চাদের পড়াতে ব্যস্ত ছিলাম। আর ধারণাই ছিল না আপনি এত তাড়াতাড়ি ফিরবেন।
এহসান কিছু না বলে কয়েক মুহূর্ত মেহনূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ এগিয়ে এসে এক ঝটকায় মেহনূরের কোমর জড়িয়ে ধরে বলে:
— উমম… মাফ নেই। এইবার অন্য কিছু চাই।
মেহনূর লাজুক চোখে তাকায়:
—
মেহনূর এহসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— কি?
এহসান নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে মেহনূরের দিকে আলতো সুরে বলে,
— একবার তোমার ঠোঁট ডুবিয়ে দাও আমার গালে।
মেহনূর বেশ লজ্জায় পড়ে গিয়ে বলে,
— আপনি সবসময় শুধু এসবের ধান্দায় থাকেন!
এহসান বলে,
— তোমার মতো সুন্দরী বউ থাকলে এসবের ধান্দাই মাথায় আটবে, আর কিছু না! এবার চুপচাপ আমার পাওনাটা মিটিয়ে দাও।
মেহনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের পায়ের পাতার সামনের দিকে ভর দিয়ে হালকা উঁকি দিয়ে এহসানের ঠোঁট ছোঁয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এহসান ইচ্ছে করে বুক টানিয়ে দাঁড়ায়। এতে মেহনূর আর পারে না। তাই এবার বেশ রাগ হয় মেহনূরের। ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত চেপে বলে,
— নাটক করার শখ হয়েছে তো নাটক করুন! আমি আর এসব পারব না!
এই বলেই মেহনূর যেতে নেয়। কিন্তু এহসান কি ওকে যেতে দেবে? এহসান ওর কোমর জড়িয়ে ধরে হালকা উপরে তুলে নেয় শূন্যে। এতে মেহনূর আতঙ্কিত হয়ে এহসানের দুই কাঁধে হাত রেখে বলে,
— কি করছেন! ছাড়ুন! পড়ে যাব তো!
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— চিন্তা করো না, এই হাত তোমায় কোনোদিন পড়ে যাওয়ার জন্য আকঁড়ে ধরবে না।
মেহনূর মুচকি হেসে বলে,
— ছাড়ুন তো!
এহসান বলে,
— আমার পাওনা তো মিটিয়ে দাও, বউ!
এ বলেই নিজেই মাথা উঁচু করে মেহনূরের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়!
ধীরে ধীরে মেহনূরকে নিচে নামায়! মেহনূর একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ তার জনাব তাকে ছাড়ছেন, ততক্ষণ সে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে!
এহসান ধীর পায়ে মেহনূরের দিকে এগিয়ে এসে থেমে দাঁড়াল। নরম আলোয় তাঁর মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি খেলা করছে। একটু পর, মেহনূরকে আলতো করে ছেড়ে দিয়ে, বিছানার উপর রাখা ছোট্ট একটি থলি তুলে নেয়। মোখবল কাপড়ে মোড়ানো নীল রঙের থলিটি হাতে নিয়ে মেহনূরের দিকে বাড়িয়ে বলে—
— নিন, বেগম সাহেবা, আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য একটি ছোট্ট উপহার।
মেহনূর বিস্মিত চোখে থলিটি হাতে নিয়ে। নরম কাপড়ের গায়ে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল—
— কী এতে?
এহসান মৃদু হেসে বলল—
— খুলে দেখো।
মেহনূর মুচকি হেসে বিছানায় গিয়ে বসলে। পরম কৌতূহলে থলির মুখ খুলতেই তার চোখ বিস্ময়ে জ্বলে উঠে ওর। ভিতরে চারটি অর্ধশুকনো জয়তুনের ডাল, কয়েকটি আজওয়া খেজুর, একটুখানি বোতলে জমজমের পানি, একটি স্নিগ্ধ সুবাস ছড়ানো মারিয়াম ফুল, আর একটি অপূর্ব সুন্দর তসবিহ!
মেহনূর গভীর মুগ্ধতায় উপহারগুলো হাতে নিয়ে একের পর এক খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। জয়তুনের ডাল ছুঁয়ে তার মন ভরে উঠে— মিসওয়াক করার জন্য এমন কিছু সে বহুদিন ধরে চেয়েছিল। ছোট্ট বোতলটায় জমজমের পানি দেখে তার হৃদয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তি নেমে আসে
— এগুলো কোথায় পেলেন? — মুগ্ধ স্বরে জানতে চাইল সে।
এহসান পাশে এসে বসতে বসতে বলল—
— আমার এক পরিচিত লোক আর তার স্ত্রী উমরাহ করতে গিয়েছিল। তাদের হাত দিয়েই তোমার জন্য এনেছি।
মেহনূর গভীর আবেগে তাকায়, কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা আপ্লুত। তারপর এক কোমল হাসি খেলে গেল তার ঠোঁটে।
— খুব খুশি হয়েছি… খুব।
এহসান চুপচাপ তাকিয়ে রইল মেহনূরের উজ্জ্বল মুখশ্রী পানে। এই মুখের হাসির জন্য সে যে কোনো কিছু করতে পারে… যে কোনো কিছু।
এদিকে—
রাহেলা খাতুন, মানে নূরির মা, আজ লজ্জায় মরতে মরতে গিয়ে বেঁচেছেন!
আসলে বাড়ি আসার পর মেহরুব গোসল করে নূরির ঘরে এসেছিল। এসে দেখতে পায়, নূরি ঠাসবুনিয়ে একশোটা কথা বলে বলে সব কাপড়-চোপড় গুছিয়ে রাখছে। নূরি এটাই বলছিল,
— এক নবাবের সাথে গিয়েছিলাম মার্কেট করতে! নবাব আমায় নবাবজাদি বানিয়ে দিয়েছেন, এখন কাপড়-চোপড় দিয়ে…
মেহরুব মুচকি হেসে এসে বলে,
— আমার চোখে কিন্তু তুই নবাবজাদিই!
নূরি আবারও আপন মনে কথা বলতে গিয়ে শরম পেয়ে যায়! তাও মেহরুবকে বলে,
— আপনার কিছু প্রয়োজন?
মেহরুব চোখ-মুখ কুঁচকে বলে,
— ঐ যদি আমার মাথাটা টিপে দিতি!
নূরি মুচকি হেসে বিছানায় বসে যায় আর বলে,
— আচ্ছা, আপনি এখানে বসুন, আমি দিচ্ছি।
মেহরুব বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। কিছু মুহূর্ত নূরির দিকে তাকিয়ে, নূরির কোলে মাথা রেখে বলে,
— এবার একটু শান্তি পাব!
নূরি কিছুটা ঘাবড়ে যায় মেহরুবের হঠাৎ এমন আচরণে! কিন্তু তাও নিজের নরম হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মেহরুবের চুলে।
মেহরুবের একসময় চোখ লেগে আসে সারাদিনের ক্লান্তির জন্য। নূরিও বিছানায় মাথা হেলিয়ে, মেহরুবের মাথা নিজের কোলে রেখেই ঘুমিয়ে তলিয়ে যায়।
কিছু সময় পর রাহেলা খাতুন মেয়ের খোঁজ করতে ঘরে প্রবেশ করেন!
এসেই এই দৃশ্য দেখে থমকে যান উনি! কিন্তু পরক্ষণেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যান ঘর থেকে, সাথে দরজাটা ভালো করে দিয়ে যান।
আজ তিনি খুশি! তার মেয়ে তার মর্যাদা পাচ্ছে, এতে তিনি খুব বেশি খুশি!
মেহরাজ বসে ল্যাপটপে কি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে, আর এশা ঘর গোছাচ্ছে। বলছে,
— এদিকে লুঙ্গি, ওদিকে তোয়ালে, ঐদিকে গেঞ্জি, সেদিকে কাগজ! এমনভাবে সব অগোছালো করে রাখেন, মনে হয় কোনো দেশের মন্ত্রী উনি!
মেহরাজ ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে এশার পানে তাকিয়ে বলে,
— কোনো দেশের মন্ত্রী কি না জানি না, কিন্তু তোমার রাজ্যের রাজা আমি!
এশা কটমট করে ওর পানে তাকিয়ে বলে,
— আর এমন অগোছালো করে রেখো খালি, দেখবে, তখন রাজা হওয়ার স্বাদ বের করবো! খালি উষ্টা দিয়ে!
মেহরাজ হেসে বলে,
— তোমার পায়ের উষ্টা খেতেও আমি রাজি গো, আমার শ্যামবতী!
এশা মেহরাজকে বলে,
— যাও, চুপচাপ গিয়ে খাবার খেয়ে আসো! আমি আসছি, এগুলো গুছিয়ে।
মেহরাজ বলে,
— না, আজ খাবার খাবো না।
এশা ভ্রু কুঁচকে বলে,
— তো কি খাবে?
মেহরাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
— তোমায়!
এমন কথা শুনে এশা দাঁত চেপে বলে,
— তোকে আমি এমনি ইবলিশ বলি! তোর অভ্যাসে আমি তোকে ইবলিশ ডাকি!
মেহরাজ ল্যাপটপ রেখে উঠতে উঠতে বলে,
— জান, এমন বলো না!
এশা ধমক দিয়ে বলে,
— চুপ! একদম ওসব বাল বলে আমায় ডাকবি না! তোর জান তোরে ভিতরে, আমি তোর জান হই কিভাবে?
মেহরাজ হেসে গিয়ে এশাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— আমার ভেতরে তো তুমি আছো! তাই তুমিই আমার জান!
এ বলেই এশার ঘাড়ে নাক-মুখ ডুবিয়ে দেয়!
এশা কিছু সময় চুপ থেকে বলে,
— মেহরাজ, এখন এসব করার সময় নয়! সবাই খাওয়ার জন্য নিচে চলে এসেছে, চলো যেতে হবে!
মেহরাজ এশাকে ছেড়ে দিয়ে যেতে যেতে বলে,
— মনে রেখো! এখন এসবের সময় নয় বলেছো! তার মানে খাওয়া-দাওয়া শেষে এসবের সময়! আর তখন তোমায় ধরলে আর ছাড়ব না! তাই গালাগালি করলে তোমার খবর আছে!
এশা কিছু বলে না, চুপচাপ নিরবে আলতো হেসে উঠে শুধু।
মেহনূরের বুকে মুখ বুঁজে শুয়ে আছে এহসান!
মেহনূর ওকে সরাতে সরাতে বলে,
— আজ যদি আমার জ্বর উঠে, তো দেখবেন! সেদিন তিন দিন অব্দি জ্বরে মরেছি!
এহসান মেহনূরের থেকে না সরে ফিসফিসিয়ে বলে,
— বেগম, তোমার ছোট্ট শরীরখানা এত দুর্বল! তো আমি কি করব বলো তো?
মেহনূর বলে,
— এখন সব দোষ আমার! আপনি যে বেশি বেশি করেন!
এহসান শব্দ করে হেসে উঠে বলে,
আত্মার আগলে পর্ব ৩৫ (২)
— আমি যদি বেশি বেশি করতাম, তো তোমায় খুঁজেই পাওয়া যেত না, বেগম! শুকরিয়া আদায় করো, আমি নিজেকে যথেষ্ট সামলাতে পারি!
এ বলে এহসান মেহনূরের গলা-বুকে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়!
মেহনূর খিলখিলিয়ে হেসে উঠে! তার হাসির শব্দ গোটা ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে!