আত্মার আগলে পর্ব ৩৯ (২)
সানজিদা আক্তার মুন্নী
— না ভাইজান, আমি পাপিষ্ঠ পুরুষের জন্য কাঁদছি না…
মেহনূর থেমে যায়। গলার মধ্যে যেন শব্দগুলো আটকে গেছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তবুও সে শক্ত করে মেহরুবের হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে—
— আমার ভয় করছে… নিজের অস্তিত্ব হারানোর ভয়। ঐ পাপিষ্ঠ পুরুষই তো আমার অস্তিত্ব!
এটুকু বলে মেহনূর ঢোক গিলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
নূরি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । হঠাৎই মেহনূর নূরিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠে—
— আমার পাপিষ্ঠ পুরুষের যদি কিছু হয়, আমি বাঁচব না! আমি চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাব! আমার অস্তিত্ব মুছে যাবে… সে-ই আমার সব! আমার প্রাণ! আমার আত্মা!
মেহরুব মেহনূরকে এভাবে কাঁদতে দেখে শুধু এটুকুই বলেছিল—
— তুই ঐ পাপিষ্ঠ পুরুষের জন্য এমন অবস্থা করিস?
ব্যস! এই কথাটা যেন মেহনূরের বুক চিরে বেরিয়ে এলো!
এহসানকে হাসিব ও তার লোকজন হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশও এসে উপস্থিত হয়েছে।
এহসান এখনও জীবিত, কিন্তু অবস্থা সংকটাপন্ন। তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
এহসানের এমন অবস্থা শুনে মেহনূর ও তার পরিবারের সবাই কীভাবে যে হাসপাতালে পৌঁছালেন, তারা নিজেরাও জানে না।
হাসপাতালে এসে এহসানের রক্তাক্ত শরীরের এক ঝলক দেখা মাত্রই মেহনূরের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠেছে। কলিজাটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে! দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলেও পারছে না।
শহরজুড়ে এখন একটাই খবর— তালুকদার বাড়ির ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে!
ছোট তালুকদার বাড়িতেও খবর পৌঁছেছে।
এশা ভাইজানের এমন অবস্থার কথা শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। মেহরুব তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। কারণ, মেহরাজ এখন হাসপাতালেই আছে। যেই হাসপাতালে সে কাজ করে, সেখানেই এহসানকে ভর্তি করা হয়েছে। হয়তো তিনিই এহসানের চিকিৎসা করছেন।
মেহরুব একা এশাকে নিয়ে যেতে পারছিল না, তাই নূরিকেও সঙ্গে এনেছে এশাকে সামলানোর জন্য।
হাসপাতালে এসে মেহরুব নিজের বোনের অবস্থা দেখে হতভম্ব! পাগলের মতো আচরণ করছে মেহনূর! হয়তো এটাই পাপিষ্ঠ পুরুষদের ভালোবাসা…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেহনূরের কলিজা ফাটানো কান্না শুনে মেহরুব তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—
— দেখ কলিজা, এভাবে কাঁদিস না। তোর হাসি বেড়ে যাবে। তুই এভাবে কাঁদলে আমারও কষ্ট হয়…
মেহনূর মেহরুবের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে—
— আমার কী হবে? উনার কিছু হলে আমি কী নিয়ে বাঁচব? আমি শুধু উনার বুকেই থাকতে চাই… কেন এমন হলো?
মেহরুব হাত বাড়িয়ে মেহনূরের মাথা নিজের কাঁধে রাখে—
— চিন্তা করিস না, তোর পাপিষ্ঠ পুরুষ একদম ভালো থাকবে!
মেহনূর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এক কান্না চাপা গলায় বলে–
— ভেবেছিলাম এক সুন্দর সূচনার শুরু করব কিন্তু তার আগেই আমায় বিষাদে ছুঁইয়ে দিল!
মেহরুব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় শুধু!!
ক্যাবিনের বাইরে বসে আছেন এনিসা বেগম, এশা, এনাম, এমরান, আমেনা বেগম।
মনিরুল সাহেব এক কোণে চুপচাপ বসে আছেন।
এহসানের অপারেশন চলছে। সময় লাগবে, কারণ তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। মেহরাজ নিজেও সেখানে আছে, বড় বড় ডাক্তারদের সঙ্গে।
নির্বাচন থামেনি। ভোট গণনা চলছে। সেখানে এহসানের লোকজন, জয়নাল আর হাসিব উপস্থিত আছে। হাসিব হয়তো যাবে না, কিন্তু তার ভাইজান আজ মৃত্যুর মুখে, তাই কি আর না গিয়ে পারে?
হাসপাতালের বাইরে মিডিয়া আর সাংবাদিকদের ভিড়। কমিশনার নিজে এসে পুলিশ মোতায়েন করেছেন, যাতে মিডিয়া তালুকদার বাড়ির নারীদের ক্যামেরার সামনে না আনে। কারণ, তিনি জানেন, এহসান এটা পছন্দ করবে না।
মেহনূরের ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বারবার কানে বাজছে এহসানের সেই কথা—
— “তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসি! ভীষণ!”
আচ্ছা, আর কেউ কি এই কথা বলবে?
আর কেউ কি তাকে “বেয়াদব নারী” বলে ডাকবে না?
তার পাপিষ্ঠ পুরুষের বুকে কি সে আর মাথা রাখতে পারবে না?
এই ভাবনায় তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। গলা দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে—
— আপনাকে আমি পেয়েও চাইনি… আর যখন চাইলাম, তখনই আপনিই নেই!
ঠিক তখনই ক্যাবিনের দরজা খুলে ডাক্তাররা বেরিয়ে আসেন।
এনাম, এমরান, মেহরুব উঠে দাঁড়ায়।
মনিরুল সাহেব এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন—
— আমার ছেলের কী অবস্থা?
সবচেয়ে সিনিয়র ডাক্তার গম্ভীর গলায় বলেন—
— বলতে পারছি না। অপারেশনের পর পালস অনেক স্লো হয়ে গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে হয়েছে। এবার আল্লাহ ভরসা…
তিনি চলে যাওয়ার আগে বলেন—
— কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবেন না!
এই কথা শুনে সবার বুক ধক করে ওঠে।
মেহনূরের যেন দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম!
মেহরাজ দ্রুত মেহনূরের দিকে আসে।
মেহনূর পাগলের মতো ছুটে গিয়ে মেহরাজের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে—
— ভাইজান, উনার কী হয়েছে? ঠিক আছেন তো? বলো না ভাইজান!
মেহরাজ বোঝে, তার বোন এহসানকে ভালোবেসে ফেলেছে।
সে মেহনূরকে জড়িয়ে ধরে বলে—
— কিছু হবে না, আল্লাহ আছেন! তিনি সহায় হবেন, তিনি রহিম, তিনি রহমান!
মেহনূর মেহরাজের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে—
— আমার দুনিয়া শেষ! আমি শেষ! উনার কিছু হলে আমি চিরতরে মিলিয়ে যাব…
মেহরুব মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে মেহরাজকে বলে—
— ভাইজান, ও শুধু শুধু কাঁদছে! সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই না? আমি কতবার বলেছি, কিন্তু ও শুনতেই চায় না!
মেহনূর মেহরাজের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করে—
— আমি উনার জন্য কাঁদছি না… আমি ভয় পাচ্ছি… নিজের অস্তিত্ব হারানোর ভয়!
মেহরাজ তাকে বেঞ্চে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—
— কাঁদিস না! তুই কাঁদলে আমার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যায়!
মেহরুব নিঃশব্দে মেহনূরের পাশে এসে বসে, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মেহরাজকে চোখের ইশারায় এশার দিকে যেতে বলে— ওর অবস্থাও কাহিল।
মেহরাজ সামনে তাকায়। বেঞ্চে বসে আছে তার শ্যামবতী, মাথা হেলান দিয়ে, চোখে হাত দিয়ে। হয়তো কাঁদছে, হয়তো কান্না চেপে রেখেছে। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে তার যন্ত্রণার সবটুকু।
মেহরাজ ধীরে ধীরে মেহনূরের হাত ছেড়ে উঠে এশার দিকে এগিয়ে যায়।
নূরি মেহনূরের হাত শক্ত করে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
— “তুমি না এহসান তালুকদারের স্ত্রী! তাহলে এভাবে ভেঙে পড়বে কেন? কেঁদে না! সাহস রাখো!”
মেহনূর চোখের পানি মুছে নিয়ে নূরির কথায় ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। নূরি তাকে নিয়ে যায় নামাজের জায়গায়।
মেহনূর ওজু করে সালাতুল হাজত পড়তে দাঁড়ায়।
মেহনূর চোখ বন্ধ করে সিজদায় পড়ে যায়। বুকের গভীর থেকে কান্না বেরিয়ে আসে, অশ্রুতে ভিজে যায় জায়নামাজ।
তার কণ্ঠ কাঁপছে, কিন্তু হৃদয় আকাশ ফাটানো আকুতি নিয়ে প্রার্থনা করে—
“হে দয়াময় আল্লাহ! আপনার অফুরন্ত করুণার দ্বারা আমি প্রার্থনা করছি— আমার পুরুষকে হেফাজত করুন, তাকে শেফা দিন, তাকে সুস্থ করে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আপনি তো পরম দয়ালু, অনন্ত মেহেরবান, আপনি তো সম্মানিতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ!”
মেহনূর হাত তুলে চোখের পানি মুছে নেয়। এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তার ঠোঁটে, যেন আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যাওয়া এক ফেলে আসা স্বপ্নের চিহ্ন।
— “হে আল্লাহ! আমার দুনিয়া, আমার ভালোবাসা, আমার আত্মার একাংশকে ফিরিয়ে দিন… আমি ছাড়া সে অসম্পূর্ণ, আর সে ছাড়া আমি নিঃস্ব!”
এশার সামনে যেতেই মেহরাজ এনিসা বেগম উঠে যেতে নেন। মেহরাজ তাড়াতাড়ি বলে,
— “না না, সমস্যা নেই। আপনি বসুন।”
এনিসা বেগম থমকে দাঁড়ান।
মেহরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাঁটু গেড়ে বসে এশার হাত নিজের মুঠোয় নেয়। তার গলা নরম হয়, অথচ দৃঢ়,
— “তুমি না আমার সাহসী এশা তালুকদার? তাহলে এভাবে ভেঙে পড়ছো কেন? আমার বোনটা অবুঝ, তাই এমন পাগলামি করছে, কিন্তু তুমি তো বুঝতে পারো। বোকামি করো না, কেঁদো না বেগম। আল্লাহ আছেন, তিনি সব ঠিক করে দেবেন। আশা রাখো!”
এশা নড়েচড়ে বসে, দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— “আমি সহ্য করতে পারছি না, ভাইজানের এমন অবস্থা… আর মেহনূরের সেই আর্তনাদ!”
এনিসা বেগম নির্বাক হয়ে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনি ভেবেছিলেন, তার মেয়ে হয়তো সুখে নেই, কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন। তার মেহরাজ যেমন মেহনূরকে আগলে ধরছে, তেমনি এশাকেও!
তিনি হাত বাড়িয়ে মেহরাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন,
— “আমার মেয়েকে এভাবেই আগলে রেখো সারাজীবন!”
এনিসা বেগম উঠে যান। মেহরাজ তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর এশার পাশে বসে।
এশা ধীরে ধীরে মাথা মেহরাজের কাঁধে রেখে ফিসফিস করে,
— “সাহসী মেয়েরা কাঁদে না, তাই না?”
মেহরাজ নরম হেসে বলে,
— “হুম, বোকা মেয়ে!”
ঠিক তখনই মেহরুব এসে মেহরাজের সামনে খাবারের প্যাকেট বাড়িয়ে দেয়,
— “ভাইজান, হয়তো আপনার বেগম এখনো কিছু খাননি। দেখে নেবেন। এটা বলা আমার দায়িত্বের বাইরে, কিন্তু কর্তব্য মনে হলো জানিয়ে দেওয়া।”
মেহরাজ ম্লান হেসে খাবার আর পানির বোতল হাতে নেয়। তারপর জানতে চায়,
— “আমার মেহনূর খেয়েছে তো? আর নূরি?”
মেহরুব ছোট্ট করে মাথা নাড়ে,
— “অনেক কষ্টে কয়েক লোকমা খাইয়েছি।”
এই বলে সে চলে যায়।
মেহরাজ হাত ধুয়ে ফিরে আসে। এশার পাশে বসে আলতোভাবে তার নিকাব খুলে দেয়।
আজ এশা গাল দেয় না। কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে।
মেহরাজ রুমাল ভিজিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দেয়। তারপর খাবার এগিয়ে দেয়,
— “খেয়ে নাও, জান… এভাবে কেঁদো না।”
নিজের কথায় নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়। সবসময় একা থাকলে ‘জান’ ডাকলেও চলে, কিন্তু আজ…
এশা তাকিয়ে থাকে মেহরাজের দিকে। এত যত্ন, এত ভালোবাসা… এটা কি উপেক্ষা করা যায়?
ধীরে ধীরে খাবার মুখে তোলে।
তার পরিবারের সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এত ভালো থাকবে তাদের এশা— তারা কখনো কল্পনাও করেনি!
শহরের আকাশে আজ উল্লাসের ঢেউ। ভোট গণনা শেষ—এহসান তালুকদার বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন! এক লক্ষ চল্লিশ হাজার ভোট পেয়ে তিনি আগামী মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
কিন্তু আশ্চর্য, শহরে এমন বিজয়ের দিনেও আনন্দের চেয়ে উদ্বেগ বেশি।
রাকিব আশি হাজার ভোট পেলেও, এখন তার দিন শেষ। পুলিশ সব প্রমাণ ঘেঁটে দেখেছে—কীভাবে, কোন চক্রান্তে, কত পরিকল্পনায় সে এহসানকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার প্রতিটি অপকর্ম আজ উন্মোচিত। তাই পুলিশ তাকে এবং তার পুরো দলকে গ্রেপ্তার করেছে।
কিন্তু জনগণ কি আজ স্বস্তি পেয়েছে?
শহরজুড়ে উল্লাস চলছে। স্লোগান উঠছে—
“আমাদের নেতা জয়ী! আমাদের নেতা আমাদের মেয়র!”
কিন্তু আজ যদি তাদের নেতা থাকতেন… আজ যদি তাদের এহসান ভাইজান নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে, নিজেই হাসিমুখে জনতার সামনে আসতে পারতেন…
জনতা জানে, তাদের নেতা আজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। তাই তারা উল্লাস করছে, কিন্তু কান্নাও লুকিয়ে রাখছে।
ভাইজান, আপনি জিতেছেন!
মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাসিব আর জয়নাল। তারা জানে, তাদের ভাইজান জিতেছেন।
কিন্তু কিসের জয়?
চোখ ভিজে আসছে তাদের, শ্বাস ভারী হয়ে আসছে।
জয়নাল ফুঁপিয়ে কাঁদছে, দু’হাত মুখে চেপে ধরে কেবল একটাই কথা বলছে—
— “ভাইজান! আমরা জিতেছি! অবশেষে আমরা এই লড়াইয়ে জয়ী! কিন্তু আপনি আজ মৃত্যুর কাছে…!”
তার পাশে হাসিবও দাঁড়িয়ে, চোখ লাল হয়ে গেছে। সে কাঁপা গলায় বলে,
— “এ কেমন বিজয়, ভাইজান? আপনি ছাড়া এই বিজয়ের মূল্য কী?”
তাদের কান্না মিছিলে থাকা হাজারও মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যায়। তারা সবাই একসাথে কাঁদছে, একসাথে প্রার্থনা করছে—এহসান ভাইজান ফিরে আসুন, সুস্থ হয়ে তাদের সামনে দাঁড়ান!
শুধু এনাম চুপ
সবাই কাঁদছে, উল্লাস করছে, হাহাকার করছে।
কিন্তু একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এনাম।
তার চোখেও অশ্রু, কিন্তু সে শব্দ করছে না। তার মুখে একটাই দৃঢ়তা—তার এহসান কি ফিরে আসবে! সে চোখ খুলবে! সে এই মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলবে—”ভাইসব, আমরা জিতেছি!”
শহর আজ আলোয় ঝলমল করছে, কিন্তু হৃদয়ে একটাই শূন্যতা—
“এহসান কই?”
নিঃশব্দ ঘরটায় শুধু মনিটরের টিপটিপ শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কৃত্রিম আলোয় সাদা বিছানায় নিথর হয়ে শুয়ে আছে এক পাপিষ্ঠ পুরুষ— তার আপন পুরুষ।
মেহনূর বসে আছে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে এহসানের নিথর দেহের পানে। অক্সিজেন মাস্ক ঢাকা মুখ, নিথর দেহ, হাসপাতালের শাদা চাদরে মোড়া শরীরটায় কোনো সাড়া নেই। শুধু বুকে ওঠানামা করছে মেশিনের সাহায্যে।
রাত চারটা বাজতে চলল।
ডাক্তার অনুমতি দিয়েছেন, সবাই দেখে গেছেন, কিন্তু এখনও জ্ঞান ফেরেনি তার এহসানের।
সবাই বাইরে অপেক্ষা করছে। শুধু মেহনূর বসে আছে এহসানের পাশে। সে যাবে না, কিছুতেই যাবে না।
“আমি তাকে ফেলে কোথায় যাব? মরে গেলেও যাব না!”
মেহনূর ধীরে ধীরে নিজের মুখের নিকাব খুলে ফেলে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই মুখের দিকে, যে মুখ যে ভালোবাসার গোধূলি ছড়িয়েছে তার জীবনে। আজ সেই মুখ নিথর, নিশ্চল।
কলিজাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে!
ভালোবাসার অনুভূতি বুঝি এমন হয়? প্রিয় মানুষের কষ্টে নিজের এত কষ্ট হয়? কিভাবে হয়? ভালোবাসা এত ভয়ংকর হয় বুঝি?
মেহনূর ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দেয়, সাদা চাদরটা সরিয়ে নেয় এহসানের শরীর থেকে।
চাদরের নিচে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া বুক… সেই বুক, যেখানে রাতের পর রাত সে আশ্রয় খুঁজেছে, সেখানে আজ গুলি!
চোখের সামনে এহসানের ক্ষতবিক্ষত বুক দেখে মেহনূরের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
এই বুক তো শুধু তার! তাহলে কিভাবে এই বুক গুলির আঘাতে বিদীর্ণ হলো?
এই বুক তো তার মাথার বালিশ! তাহলে কীভাবে এই বুক এতটা ক্ষতবিক্ষত হলো?
তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখ ভিজে আসে। অথচ, আজ এহসান নেই সেই চোখের পানি মুছিয়ে দেওয়ার জন্য!বুকে আঁকড়ে নেওয়ার জন্য!
মেহনূর ধীরে ধীরে এহসানের নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে,
— “উঠুন… দেখুন আমি কাঁদছি। আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিন না… আমাকে বুকে জড়িয়ে নিন না… একবার… শুধু একবার!”
কথাগুলো একা একাই বাতাসে মিলিয়ে যায়।
তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু সে পারবে না… কারণ মেহরাজের পা ধরে এখানে থাকার অনুমতি নিয়েছে। মেহরাজ তাকে এখানে একা রেখে যেতে চায়নি, কারণ ভালো করেই জানে, সে একা থাকলে কান্নাকাটি করবে, নিজেকে সামলাতে পারবে না।
কিন্তু মেহনূর কসম করেছে!
সে কাঁদবে না! শুধু তার পুরুষের পাশে থাকবে…!
মেহনূর চোখ বন্ধ করে শ্বাস চেপে ধরে। চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এহসানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
তার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় সেই ব্যান্ডেজ করা বুকে।
এহসানের বুক ভিজে যাচ্ছে তার আপন নারীর চোখের পানিতে… অথচ সে জানেই না! সে আজ নিস্তব্ধ
মেহনূর শক্ত হয়ে উপরের দিকে তাকায়, ভেজা চোখে , হাত তুলে কান্না চেপে বলে,
— “ইয়া রব! আমার মাহরামকে ফিরিয়ে দিন! আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন! আপনি তো দয়াময়… আপনি আমায় দয়া করুন!”
তার ঠোঁট কাঁপে, দৃষ্টি অসহায় হয়ে ফিরে আসে এহসানের মুখের দিকে।
সে ধীরে ধীরে মাথায় হাত রাখে, কপালে আঙুল ছোঁয়ায়।
তারপর আহত কণ্ঠে ফিসফিস করে,
— “ও আমার পাপিষ্ঠ পুরুষ এমন করছেন কেনো উঠুন না.. একটা বার আমায় কবুতরের বাচ্চা বলে ডাকুন না! বলুন না বেয়াদব নারী! বলুন না ভালোবাসি তোকে আমি!
.. বলুন না আমি শুনতে চাইতো আপনার কথা,,, বলুন না কয়েকটি অসভ্য কথা! … বিশ্বাস করুন আমি আর আপনার সাথে রাগারাগি করব না…! সত্যি বলছি আর রেগে যাব না…! নিরবে আপনার সব কথা সব ভালোবাসা নিয়ে নিব তাও তো উঠুন”….
কিন্তু তার পাপিষ্ঠ পুরুষ আজ চুপ।
আজ কোনো উত্তর নেই।
অন্য সময় হলে সে এই কথা বললেই হয়তো ভালোবাসায় ভেসে যেতো। আজ শুধু নিস্তব্ধতা…!
মেহনূর অসহায়ভাবে ফিসফিস করে কেঁদে ওঠে, মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে,
— “আপনি না বলেছিলেন, আমাকে বুকে না নিলে আপনার ঘুম আসে না? আর আজ সেই আপনিই আমাকে বুকে না নিয়েই এত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন?”
সে ফুঁপিয়ে ওঠে, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়।
আত্মার আগলে পর্ব ৩৯
ধীরে ধীরে বসে পড়ে বিছানার পাশে।
দুই হাত বিছানায় রেখে মাথা এলিয়ে দেয়।
তারপর চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়।
আর তাউয তাসমিয়া পড়ে শুরু করে প্রিয় পুরুষের জন্য প্রিয় সূরাগুলোর তেলাওয়াত…
কিন্তু প্রতিটি আয়াতের মাঝে যেন একেকটি কান্না মিশে যায়…!