আত্মার আগলে পর্ব ৪১ (২)
সানজিদা আক্তার মুন্নী
মেহনূর এসেছে আপন বাড়ি…
না, আপন বাড়ি বলছি কেনো?
এটা তো তার আপন বাড়ি নয়! সে এসেছে নিজের বাপের বাড়ি!
আজ মেহরুব আর নূরি ফুলের বিয়ে।
বড় তালুকদার আর ছোট তালুকদারদের মাঝে যখন এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়ে গেছে, তখন মুস্তফা সাহেব দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে কার্পণ্য করেননি।
তিনি নিজেই গিয়েছিলেন ওদের বাড়িতে দাওয়াত দিতে।
ভালো করেই জানতেন—ওরা কেউ আসবে না!
তবুও তিনি গিয়েছিলেন, কারণ কিছু দায়িত্ব রক্তের সম্পর্কের মতো—নিশ্চিত জানলেও যে এর কোনো প্রতিদান নেই, তবু তা পালন করতেই হয়!
এহসান সকালে পার্টি অফিসে যাওয়ার আগে মেহনূরকে নামিয়ে দিয়ে গেছে তার বাপের বাড়িতে।
কিন্তু যাওয়ার আগে কড়া গলায় বলে গেছে,
— “রাতে এসে নিয়ে যাব, চুপচাপ চলে আসবে আমার সাথে!”
মেহনূর কিছু বলেনি, বরং উল্টো তার গলা জড়িয়ে ধরেছিল!
এহসান অবাক হয়েছিল এতে।
তার নারী তো এমন করে না!
হঠাৎ এমন কেনো করল?
মেহনূর ধীরে ধীরে তার বাহু থেকে সরে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “আচ্ছা… আর শুনুন, বুকের সেলায়ে পানি লাগলে পানি তুলে নিবেন! যদি যোহরের পর বাড়ি এসে গোসল করেন তো… এখন তো আমি থাকব না! তাই নিজেও নায়ক হয়ে ভেবলাশ পেয়ে যাবেন সব!”
এহসান মুচকি হেসে বলেছিল,
— “আর ফজরের পর ফরজ গোসলই করব! তুমি চিন্তা করো না!”
মেহনূর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদায় নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
এহসান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার চলে যাওয়ার দিকে।
মেহনূর গাড়ি থেকে নামতেই এহসানের কপালের রগ দপদপ করে উঠে!
এতক্ষণ আপন নারীর সামনে নিজেকে সংযত রেখেছিল, কিন্তু তার ভেতর জমে থাকা রাগ এখন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উপচে পড়ছে!
রাগের কারণও আছে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এহসান ঠান্ডা হাতে ফোনটা বের করল, একটা নাম্বারে কল দিল!
দুই-তিনবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরল।
এহসানের চোখ লাল হয়ে উঠল, দাঁত চেপে বলল,
— “কি রে, কাফিরের বাচ্চা! দিতাম নাকি তোরে উওম মধ্যম কয়েকটা!”
ওপাশ থেকে এক অশ্রাব্য গালি ভেসে এলো!
— “তুই কোন কুত্তার বাচ্চা রে, আমায় এমন হুমকি দিচ্ছিস?”
এহসান এবার দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে উঠল,
— “আমি তোর এহসান বাপ! চিনতে পারছিস আমায়?”
সেই ব্যক্তি হঠাৎ চুপ করে গেল।
কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করার পর কাঁপা গলায় বলল,
— “আপনি… স্যার, আপনি?”
এহসান এবার চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিল, তারপর নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,
— “শুনলাম, তুই নাকি আমার কনস্ট্রাকশন সাইডে গিয়ে মাস্তানি করেছিস?”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এল না।
এহসান এবার মাটির দিকে তাকিয়ে একদলা থুতু ফেলল, তারপর স্বর আরও নীচু করল,
— “এত সাহস হয় কী করে তোর? ধরে এক টানে ছিঁড়ে দেব নাকি তোকে?”
ওপাশ থেকে এবার কেবল শ্বাসের শব্দ শোনা গেল।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেই ব্যক্তি অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
— “আমি জানতাম না ঐটা আপনার জায়গা! এর পর থেকে এমন হবে না, স্যার!”
এহসান এবার এক নিঃশ্বাসে বলল,
— “এরপর থেকে এমন হলে আর নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাবি না! বলে দিলাম!”
“টাশ!”
ফোনটা কেটে দিল এক ঝটকায়!
এখনও তার শরীর রাগে জ্বলছিল।
মেহনূর মেহেদির কৌটা খুলে এক হাতে নূরির হাত ধরে, অন্য হাতে মেহেদি পরিয়ে দিচ্ছে। এশাও পাশে বসে নূরির অন্য হাতে মেহেদি দিচ্ছে।
এশা একদম হেসে বলে
— “বাহ রে বইন! তুই তো দেখি মীরজাফরের থেকেও ভয়ংকর!”
মেহনূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “আমি আবার কী মীরজাফরি করলাম?”
এশা মেহেদি দিতে দিতে বলল,
— “আমার ভাইজানকে মেনে নিয়ে আমার ভাতিজা ভাতিজির মা হয়ে যাচ্ছিস, আর একবারও একটু ইঙ্গিত দিলি না!”
মেহনূর মুচকি হেসে বলল,
— “না দেইনি, ভেবেছি একেবারে তোর ভাতিজা অথবা ভাতিজিকে দুনিয়াতে এনে তোকে শুনাব!”
এশা মুচকি হেসে বলল,
— “তুমি দেখি ময়না, তলে তলে এত কিছু ভেবে রেখেছো!”
মেহনূর এশার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তা ম্যাডাম তেরেসা, আপনি কবে আমার ভাইকে বাপ বানাবেন, তা একটু বলুন?”
এশা মেহেদি দিতে দিতে বলে
— “তোমার ভাই বাপ হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে!”
নূরি তাদের কথা শুনে মুখ লাল করে বলল,
— “একটু তো মুখে লাগাম দাও! লজ্জা তো করো!”
মেহনূর এক হাতে মেহেদি রেখে নূরির গাল টেনে বলল,
— “লজ্জাবতী লতাপাতা রে! এত লজ্জা পাইও না! আজ তোর বিয়ে, আর বিয়ের পর এত লজ্জা থাকতে হয় না!”
এশা চমকে গিয়ে বলল,
— “কি রে! তুই এই ‘লজ্জাবতী লতাপাতা’ কথাটা কোথা থেকে শিখলি?”
মেহনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “আপনার ভাইজানের থেকে!”
এশা আর নূরি হেসে উঠল। নূরি মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আপ্পি, আমার গাল তো ছাড়ো! তুমি আর তোমার ভাই, আমার গাল খালি কেন টানো…!”
নূরি সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করে নিল, কথায় কথায় কী থেকে কী বলে ফেলল!
এশা মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “দেখ, এই মেয়ে আমাদের লজ্জা শিখাচ্ছে, আর সে আমার ভাতিজার সাথে ঠিকই তলে তলে পিরিত করে যাচ্ছে!”
এশার কথা শুনে মেহনূর হা করে বলল,
— “মা রে! অন্তত আর ‘ভাতিজা’ বলিস না, তুই এখন আমার ভাইয়ের বউ!”
নূরি মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “আগে তুমি তো ঠিক হও! মা কাকে ডাকছো?”
ঠিক তখনই বাইরে থেকে মেহরাজের গলা ভেসে আসে ,
— “মেহনূর! এশাকে বল, এদিকে আসতে!”
এশা ডাক শুনে মেহনূরকে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “বল, আমি এখানে নেই!”
মেহনূর ভ্রু উঁচু করে বলে,
— “মিথ্যে বলব কেন?”
এশা চোখ রাঙিয়ে বলে
— “উষ্টা খেতে যদি না চাস, তো বল, আমি এখানে নেই!”
মেহনূর চোখ ছোট করে তাকিয়ে গলা বাড়িয়ে বলে উঠে,
— “ভাইজান, এশা এখানে আছে, কিন্তু আমায় না বলতে বলছে!”
মেহরাজ হেসে বলল,
— “ওকে বল, চুপচাপ চলে আসতে! আমি ঘরে প্রবেশ করে যদি নিয়ে আসি, তবে অবস্থা খারাপ হবে কিন্তু!”
এশা মেহনূরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে,
— “আসছি!”
এ বলে উঠে যেতে যেতে বলে,
— “ইবলিশনি! তোর ইবলিশি আমি ছাড়াব! দাড়া, আগে আমি তোর ভাই ইবলিশকে দেখে আসি!”
এ বলে এশা বেরিয়ে যায়! মেহনূর আর নূরি মুচকি হাসে।
নূরি মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে
— “আচ্ছা আপ্পি, তুমি সুখে আছো তো?”
মেহনূর তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলে
— “হ্যাঁ, আমি খুব সুখে আছি রে! আমার পাপিষ্ঠ পুরুষ আমার সাথে আছে বলে!”
নূরি মেহনূরের চোখে ভালোবাসার দীপ্তি দেখে বলে,
— “এত কিছু করার পরও তুমি তাকে এত ভালোবাসো?”
মেহনূর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— “ভালোবাসা পাপ, কলঙ্ক মানে না রে! ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যায়, তাই ভালোবাসি!”
নূরি মুচকি হেসে বলে,
— “আমি দোয়া করি, তোমাদের ভালোবাসা চিরন্তন হোক!”
মেহনূর হেসে বলে,
— “আমিও দোয়া করি, নূরি ফুল! তুই আমার ভাইয়ের সাথে সুন্দর জীবন শুরু কর!”
— “ইনশাআল্লাহ, হবে সুন্দর কিছুর সূচনা!”
মেহরাজ এশাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। এশা রাগি চোখে তাকিয়ে বলল,
— “তোমার আমায় না খুঁচালে পেটের ভাত হজম হয় না, তাই না?”
মেহরাজ নিজের হাতের প্যাকেট থেকে কিছু একটা বের করতে করতে বলল,
— “তোমায় না খুঁচালে পেটের ভাত তো দূরের কথা, ঘুম অব্দি হয় না!”
এ বলে প্যাকেট থেকে একটি সাদা-লাল পারের সুতির শাড়ি বের করে এশার সামনে ধরল, সঙ্গে ফুলের গাজরা।
এশা এগুলো দেখে বলল,
— “এগুলো কার জন্য?”
মেহরাজ শাড়িখানা এশার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
— “তোমার জন্য! এগুলো পরবে আজ রাতে! আজ থেকে শুরু হবে আমাদের নতুন দিন!”
এশা শাড়ি দেখতে দেখতে বলল,
— “আমি তো শাড়ি পরতে ওত ভালো করে পারি না!”
মেহরাজ হেসে বলল,
— “যেভাবে পারো, পড়ো! আমার জন্য যেমন ইচ্ছে তেমন করে পড়ো!”
এশা মুচকি হেসে বলল,
— “আচ্ছা!”
মেহরাজ এশার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
— “খুশি তো, প্রিয়?”
এশা মেহরাজের বুকে আলতো মাথা রেখে বলল,
— “হুম, খুব!”
—
নূরিকে লাল একখানা শাড়ি পরানো হয়েছে। শাড়ির পাড়ে সোনালি সূচিকর্ম, আগুনের শিখার ওপর মৃদু রোদের ঝলকানি। সেই শাড়ির নরম আঁচল তার কোমল শরীর ছুঁয়ে আছে। সাজসজ্জা খুব বেশি নয়, তবু প্রতিটি ছোঁয়াতেই রাজকীয়তা।
চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে ন্যুড রঙের লিপস্টিক, আর গালে একটুখানি ব্লাশ—যেন এক প্রাচীন রাজকুমারীর রূপ ফিরে এসেছে বর্তমানের আলোয়। চুলগুলো খোঁপা করে সামনের দিকে আনা হয়েছে, যাতে তার মায়াবী মুখাবয়ব আরও ফুটে ওঠে। হাতে সোনালি চুড়ি, কানে দুল,—সব মিলিয়ে এক মোহময়ী সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি।
নূরিকে সাজিয়ে এশা ও মেহনূর তাকে নিচে নিয়ে আসে। মেহনূরের গায়ে শুধু একটি সাদা সাধারণ কামিজ। কোনো অলংকার নেই, কোনো ঝলমলে পোশাকও নয়। পরবে কার জন্য? যার জন্য সাজবে, সেই তো নেই! তাহলে সাজবার মানেই বা কী?
এশাও পরেছে এক সাধারণ কামিজ, মাথায় সবসময়ের মতোই ঘোমটা। তবে সে জানে, মেহরাজের দেওয়া শাড়িটা সে পরে নেবে রাতেই। চায়, মেহরাজই তাকে সেই প্রথম দেখুক, একান্ত তার জন্যই।
ঘরের মাঝখানে টানা হয়েছে সাদা পর্দা। এক পাশে বসে আছে মেহরুব, অন্য পাশে নূরি। মেহরুবের পাশে তার বাবা, চাচা, বড় ভাইয়েরা। আর নূরির পাশে তার মা, চাচি, এশা, মেহনূর, আর ছোট ছোট চাচাতো ভাই-বোনেরা।
তাদের বিয়ে পারিবারিক ভাবেই হয়! আলাদা কোনো আত্মীয় থাকেন না এতে!
কাজি সাহেব এসে বসলেন মেহরুবের পাশে। এক ঝলক তাকিয়ে দেখলেন সাদা পর্দার ওপারে বসা মেয়েটিকে। মেয়েটি যে আজ থেকে এক নতুন পরিচয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটাই যেন তার নিঃশব্দ উপস্থিতিতে বলে দিচ্ছে।
তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
— **“নিকাহ বা বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন। এই সম্পর্ক মহান আল্লাহর বিধান অনুযায়ী স্থাপিত হয়। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক আমরা আজ নূরি ও মেহরুবের বিবাহ সম্পন্ন করতে যাচ্ছি।”**
সবাই নিঃশব্দ। শুধু মৃদু বাতাসের আওয়াজ, আর কারও কারও চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এরপর কাজি সাহেব নূরির দিকে তাকিয়ে বললেন,
— **“মা, তুমি কি রাজি? মেহরুবকে তোমার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে চাও?”**
ঘর নিস্তব্ধ। নূরির বুকের ধুকপুকানি যেন সমস্ত কক্ষে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ থমকে থেকে সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল—
— **“জ্বি, আমি মেনে নিলাম, মন থেকে।”**
নূরির কণ্ঠের সেই মৃদু উচ্চারণে ঘরের নিস্তব্ধতা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেল। সকলেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে পর্দার দুই প্রান্তের দিকে।
কাজি সাহেব এবার মেহরুবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— **“বাবা, তুমি কি নূরিকে তোমার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছ?”**
মেহরুবের চোখে দৃঢ়তা। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করেই সে শান্ত অথচ শক্ত স্বরে বলল,
— **“আমি আমার অন্তর থেকে তাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিলাম।”**
এক পবিত্র বন্ধনের সূচনা হলো। দুই আত্মা এক হয়ে গেল এক চিরস্থায়ী সম্পর্কের বাঁধনে।
কাজি সাহেব ঘোষণা করলেন,
— **“এখন থেকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী। আল্লাহ তোমাদের দাম্পত্য জীবনে বরকত দান করুন।”**
এরপর মোহরানার পরিমাণ ঘোষণা করা হলো, উভয়ের সম্মতি নিশ্চিত করা হলো। সাক্ষীদের সামনে বিবাহের বৈধতা প্রমাণিত হলো।
[আমি বিয়ে কিভাবে পড়ানো হয় তা দেখেনি কখনো তাই হয়তো ভালোভাবে বুঝিয়ে লিখতে পারলাম না]
শেষে কাজি সাহেব দাম্পত্য জীবনের গুরুত্ব ও দায়িত্ব সম্পর্কে ইসলামী খুতবা পাঠ করলেন এবং নবদম্পতির জন্য দোয়া করলেন।
ঘরের চারপাশে এক অন্যরকম আলোড়ন।
সকলের মুখে প্রশান্তির হাসি।
নূরি আর মেহরুব—যদিও তারা এখনো দুই পাশে বসে, কিন্তু আজ থেকে তাদের পথ একসঙ্গে চলার।
কাজি চলে গেলে একে একে সবাই উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু মেহরুবের পক্ষে উঠতে পারা সম্ভব নয়, কারণ তার মন এখনো বসে আছে এক জায়গায়—তার নূরি ফুলের কাছে।
শরীরের প্রতিটি রক্তকণা রক্তিম উত্তেজনায় ধুকপুক করছে। বুকের গভীরে এক অজানা শিহরণ খেলে যাচ্ছে। কতদিন ধরে এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেছে সে? আজ তার নূরি ফুল কেমন লাগছে? কেমন দেখাচ্ছে তাকে বউ বেশে?
নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে ফেলে—
— “পর্দাটা সরালে ভালো হয়।”
মেহরাজ সঙ্গে সঙ্গে বাঁকা হাসি দিয়ে বলে
— “ভাই, এত সহজে আমার বোনকে দেখতে পাবি না! একটু তো অপেক্ষা কর!”
মেহনূরও তাল মিলিয়ে বলে
— “অবশ্যই! আমাদের বোনকে দেখতে হলে টাকা দিতে হবে!”
মেহরুব বিস্ময়ের ভান করে বলে,
— “ভাইজান, তুমি আমার কাছ থেকে টাকা নেবে?”
মেহরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে
— “ছিঃ ছিঃ! আমি তোর বড় ভাই হয়ে তোর থেকে টাকা নেব? মেহনূর নেবে, পরে না হয় ওর থেকে নিজের ভাগটা মেরে দেব! কী করব বল, টাকার লোভ সামলাতে পারি না!”
নূরি পর্দার আড়াল থেকে শুনছিল সবকিছু। নিজের হাসি চাপতে গিয়েও পারল না। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল, যা মেহরুব দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পারল!
সে দ্রুত পকেট থেকে এক বান্ডিল টাকা বের করে মেহনূরের হাতে দিয়ে বলে,
— “এবার তো দেখতে দে!”
মেহনূর টাকা হাতে নিয়ে গুনতে গুনতে বলে,
— “কম হয়ে গেল না?”
মেহরাজ দ্রুত মেহরুব এর কাধ ছেড়ে উঠে বলে,
— “এদিকে দে! তুই গুনতে পারিস না, আমি গুনি।”
মেহনূর হাসতে হাসতে বলে,
— “থাক, গুনতে হবে না! পরে দেখা যাবে, টাকা গোনার আগেই তো সব তোমার পকেটে চলে গেছে!”
তারপর সে অর্ধেক টাকা রেখে বাকি অর্ধেক পর্দার ওপাশে দিয়ে দিল এশার হাতে।
— “নে, তোর জামাইর টাকা! তুই নিয়ে নে!”
মেহরাজ কপট অভিমানে বলে,
— “দেখ! মেহনূর কী করছে! আমার ভাগ আমার বউকে দিয়ে দিচ্ছে!”
মেহরুব শুধু হাসল।
মেহনূর দ্রুত সবাইকে ভাগ দিয়ে সরিয়ে দিল, যেন এখানে আর কেউ না থাকে—শুধু দুজন।
এশা মেহরাজের দিকে এগিয়ে এসে ওর হাত টেনে বলে,
— “চলো, ঘরে চলো! এখানে তোমার আর থাকার দরকার নেই!”
মেহরাজ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
— “তুমি যদি চাও অন্য কিছু , আমি চলে আসব!”
এশা চটপট করে তার বাহুতে একটা চিমটি কাটল।
— “আহ্! তোমার হাতে কেমন ব্যথা লাগে!”
— “আরও লাগবে! চলো!”
মেহরাজ আর কিছু বলার সুযোগ পেল না, কারণ এশা তাকে একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল।
মেহনূরও হেসে সরে গেল।
এখন চারপাশ নিস্তব্ধ।
শুধু দুজন…
নূরি আর মেহরুব।
শুধু এক ফোঁটা আবেগ…শুধু এক ঝলক অপেক্ষার উত্তাপ…
মেহরুব ধীরে ধীরে বলল,
— “নূরি ফুল, তোকে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর লাগছে! আচ্ছা, কতখানি সুন্দর? আমি নিজেকে সামলাতে পারব তো?”
নূরি মুচকি হাসে শুধু ।
মেহরুবের বুক কাঁপছে। হাতের তালু ঘামে ভিজে উঠছে।
আলতো হাতে সে পর্দাটা সরিয়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে ধাক্কা দিল এক বিস্ময়—
তার নূরি ফুল!
সামনের আলোয় বসে আছে তার জন্য সাজা তার বিবিজান!
শরীরে জমকালো রঙিন পোশাক, মাথায় ঘোমটা, আর সেই চোখ… সেই লাজুক চোখ!
নূরির মাথা নিচু।
শুধু একঝলক দেখা যাচ্ছে তার কাজল আঁকা চোখের পাতা।
মেহরুব শ্বাস নিতে ভুলে গেল। বুকের মধ্যে ধকধক শব্দ হচ্ছে।
সে ফিসফিস করে বলল,
— “হুমায়রা, মুখটা তোলো।”
হুমায়রা কোনো নাম নয়, এক বিশেষ উপাধি—যে নারীর গাল লজ্জায় বা খুশিতে আনার ফলের মতো লাল হয়ে ওঠে, তাকেই বলা হয় ‘হুমায়রা’।
নূরি ধীরে ধীরে মুখ তোলে।
তার চোখে লজ্জা, তার ঠোঁটে মৃদু হাসি।
মেহরুব শ্বাস আটকে গেল!
অল্প মেকআপে সে যেন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি! মনে হচ্ছে, জান্নাতের কোনো রহমত তার সামনে বসে আছে।
তার চুলের খোঁপা থেকে টুপটাপ গড়িয়ে পড়ছে বেলি ফুলের গন্ধ, যা মেহরুবকে ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে।
তার গাল হালকা লাল, ঠিক যেন আনার ফল!
মেহরুব বুকের উপর হাত রেখে অপলক তাকিয়ে থাকল।
— “ভাবতেই অবাক লাগে—আজ থেকে এই লজ্জা রাঙা মুখটা আমি প্রতিদিন দেখতে পাব, প্রতি মুহূর্তে!”
নূরি মুচকি হেসে মাথা নিচু করে নিল।
তার লজ্জা আরো গাঢ় হলো।
তার চোখে এক ফোঁটা পানি—শুধু খুশির!
মেহরুব ধীরে ধীরে হাত বাড়াল।তার আঙুল ছুঁয়ে গেল নূরির কপাল।
নূরি একবার কেঁপে উঠে।
মেহরুব নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল…
আজ তার পৃথিবীর সব আলো এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে—তার নূরি ফুলের দু’চোখে!
আকাশ ভরে আছে চাঁদের ম্লান আলোয়, হালকা বাতাস বইছে নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে।
মেহনূর চলে যাচ্ছে। এসেছিল অতিথির মতো, বিদায়ও নিচ্ছে অতিথির মতো।
এহসান বাড়ির বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায়। মেহরুবের ফোনে বার্তা পাঠিয়েছে—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, মেহনূর যেন চলে আসে।
মেহনূর ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। বিদায় নেয়ার সময় একে একে সবাইকে জড়িয়ে ধরে। বাবা, দুই ভাই, এশা—সবার উষ্ণ আলিঙ্গনে যেন তার হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। কান্না আটকে রাখতে পারে না, চোখের কোনে জমে থাকা জল একে একে গড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু আফসোস, একটা রাতও এহসান তাকে এখানে থাকতে দেবে না।
দাদাজান, দাদীজানের কাছ থেকেও বিদায় নিয়ে দরজার চৌকাঠ মাড়ায়।
তার এক হাত মজহারুল সাহেবের মুঠোয়, অন্য হাত মেহরুবের। সামনে-পিছনে তার বড় ভাইজান আর চাচা। সবাই যেন তাকে একসাথে বিদায় জানাচ্ছে, এক সুরক্ষার বলয়ে রেখে এগিয়ে দিচ্ছে।
এহসান গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে। অন্ধকারের মাঝে তার চোখজোড়া উজ্জ্বল, যেন অপেক্ষায় আছে তার নিজের আকাশের চাঁদের জন্য। মেহনূরকে আসতে দেখেই তার ক্লান্ত মুখে এক রহস্যময় হাসি খেলে যায়। কোথা থেকে যেন এক আকাশ খুশি আর প্রশান্তি ভর করে তার ভেতর।
মজহারুল সাহেব মেয়েকে এহসানের সামনে এনে দাঁড় করান। গলা ভারী হয়ে আসে, তবু নিজেকে সামলে নেন।
— হয়তো তোর কাছে আমার মেয়েটা ভালো আছে। তোর কাছে একটাই অনুরোধ, আমার ফুলকে যত্নে রাখিস।
একটু থেমে মেহনূরের চোখে চোখ রেখে বলেন,
— ওর মা মারা যাওয়ার পর ওকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছি। অথচ আজ ও আমার কাছে নেই!
কণ্ঠের ভারী আবেগ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। গভীর দৃষ্টিতে এহসানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
— যদি তোর কোনোদিন মনে হয় আমার মেয়ে তোর যোগ্য নয়, বা তুই ওকে আর রাখতে পারবি না, তাহলে আমার ফুলকে আমার হাতে ফিরিয়ে দিস। কিন্তু কখনো অযত্ন করিস না!
মেহনূরের বুক ফেটে যাচ্ছে বাবার কথা শুনে। বাবারা কি এমনই হয়? নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেন সন্তানের জন্য? আর যদি সে হয় মেয়ে, তাহলে তো কথাই নেই! মেয়েরা একটু বেশিই আদরের হয়। তাই তো সে তার বাবার কাছে ফুলের মতো, আর তার বাবা তাকে রেখেছেনও সেভাবে—একটা ফুটন্ত, সুরক্ষিত গোলাপের মতো।
মজহারুল সাহেব মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে এহসানের দিকে তাকিয়ে বলেন,
— খুব যত্নে বড় করেছি তো, তাই মাঝে মাঝে ভয় হয়। আমার যত্নে রাখা আমার মা, আমার প্রাণ, কোথাও অযত্নে আছে কি না!
মেহনূর নিঃশব্দে হাত ছাড়িয়ে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বুক ভরে নিতে চায় বাবার স্নেহের উষ্ণতা। মজহারুল সাহেব গভীর আদরে মেয়ের
মেহনূর নিম্ন গলায় কান্না চেপে বলে,
— চিন্তা করবেন না, আমায় যত্নেই রেখেছেন তিনি।
মেহনূর কিছু মুহূর্ত পর তাকে ছেড়ে মেহরুবকে জড়িয়ে ধরে আর ফিসফিসিয়ে বলে,
— আমার নূরি ফুলকে ভালো রেখো।
তারপর মেহরাজের বুকে মাথা রেখে বলে,
— আমার এশাকে কষ্ট দিও না, আমার এশার যত্ন নিও।
সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে এহসানের পাশে এসে দাঁড়ায়। এহসান এতক্ষণ নীরবে সব দেখছিল এবং শুনছিল।
এহসান গাড়ির দরজা খুলে মেহনূরকে গাড়িতে বসিয়ে, গাড়ির দরজা লাগাতে লাগাতে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
আত্মার আগলে পর্ব ৪১
— এই নারী আমার প্রাণ, আর নিজের প্রাণকে অযত্নে রাখে না।
এ বলেই সালাম দিয়ে অন্য দিকে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে উঠে যায়।
এটা যেন এক অমলিন রাতের গল্প, যেখানে বিদায়ের দুঃখ, ভালোবাসার মিষ্টি অনুভূতি এবং আত্মবিশ্বাস এক সঙ্গে মিশে যায়, আর তাদের সম্পর্কের শক্তি যেন আরো দৃঢ় হয়।