আত্মার আগলে পর্ব ৪৯+৫০
সানজিদা আক্তার মুন্নী
একটা মাস কেটে গেছে…
নূরি এখন বেশ সুস্থ। আলহামদুলিল্লাহ, টুনা-টুনির ছোট্ট সংসারে শান্তির রোদ ঝরে পড়ে।
মেহরাজ আর এশা মণিও নিজেদের জগতে সুখে ডুবে থাকে—নিঃশব্দে, নিঃসীমে।
শুধু একটা সম্পর্ক…
এহসান আর মেহনূরের হৃদয়ের ফাঁকে জমে থাকে অভিমান।
তাদের দু’জনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বোঝা পাপ, যার ভার এহসান নিজেই স্বীকার করে নিয়েছে।
— “বাঁচলে নিজের পাপ, নিজের পবিত্রতা—দুইটাই নিয়ে বাঁচব,”
এটাই তার এক কথা।
মেহনূর প্রতিদিন বিনয়ে ভেঙে পড়ে… কখনো পায়ে ধরে, কখনো হাতে হাত রেখে বলে,
— “ফিরে এসো… দয়া করে এগুলো ছেড়ে দাও।”
কিন্তু এহসান চুপ থাকে। তার চোখের পেছনে জমে থাকে একরাশ অন্ধকার।
এদিকে মেহনূরের শরীরও ভালো যাচ্ছে না। খেতে ইচ্ছে করে না, মনের ভিতর কেমন যেন করে।
সবকিছুর গন্ধে বমি ভাব হয়, আজকাল চা পর্যন্ত খেতে পারে না।
দুই দিন ধরে অবস্থা ভয়াবহ।আজ সকালে চায়ের কাপ হাতে নিয়েই মুহূর্তে বমি করে ফেলে—সামনেই ছিলেন এনিসা বেগম আর আয়শা বেগম।
তাঁরা দুজনেই চমকে ওঠেন।দ্রুত মেহনূরের কপালে পানি দেন, ওকে শান্ত করে বসার ঘরে নিয়ে আসেন।
মেহনূর তখন চোখ বুঁজে বসে, শরীর যেন ভেঙে পড়ছে—মাথা ঘোরে, বুক ধড়ফড় করে।
এক গ্লাস লেবুর শরবত এনে দেওয়া হয়।এক ঢোঁক খেয়ে গ্লাসটা এনিসা বেগমের হাতে দিয়ে মেহনূর সোফায় হেলে পড়ে। গলায় কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “আম্মা… আমার ভেতরটা কেমন করছে… কুলাচ্ছে না… মনে হচ্ছে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে।এ কয়দিন ধরে এমন হচ্ছে, কিন্তু আজ তো… আজ তো খুব বাজে করছে!”
এনিসা বেগম ওর পাশে বসেন, হাত ধরে ধীরে বলেন,
— “মা… এটা স্বাভাবিক। আমার মনে হয়… তুমি মা হতে চলেছো।”
শব্দগুলো যেন মেহনূরের ভেতর একটা বোমা ফাটায়।
মা… হতে… চলেছে?
ঠোঁট কাঁপতে থাকে… চোখে অশ্রুর কুয়াশা… গলা শুকিয়ে আসে।
সত্যিই… সবকিছুর মানে এবার মিলছে। এই কষ্ট, এই অস্থিরতা—সবটাই তো…
নিজের পেটে হাত রেখে মেহনূর মাথা তোলে।আলতো হেসে তাকায় এনিসা বেগম, আয়শা বেগম আর আমেনা বেগমের দিকে।
— “এটা… সত্যি? সত্যিই তো?”
আয়শা বেগম ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন,
— “পাগলি, সত্যি না হলে এমন হবে কেনো? তবে একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেই।”
আমেনা বেগম বলেন,
— “আমি ডাক্তার আপাকে ফোন করি… দাঁড়াও।”
কিছু সময় পর
ডাক্তার এসে মেহনূরকে চেক করেন।ঘর নিঃশব্দ… সবার দৃষ্টি ওর দিকে।
ডাক্তার একসময় হালকা হাসি নিয়ে বলেন,
— “মেহনূর… তুমি মা হতে যাচ্ছো।”
ঘর জুড়ে আনন্দের শীতল ঢেউ।কিন্তু মেহনূর বসে থাকে চুপচাপ।একটাই অনুভূতি বারবার ধাক্কা দিচ্ছে হৃদয়ে—
“আমি মা… আমি মা হতে যাচ্ছি…”
আশেপাশে হাসির ঝিলিক, কোলাহল। কিন্তু ওর ভেতরে চলছে এক গভীর নিঃশব্দ লড়াই।
ঠিক তখনই…
বাড়ির সদর দরজা খোলা যায়।ম্লান চোখ, ক্লান্ত শরীর আর গম্ভীর মুখ নিয়ে এহসান ঢোকে ঘরে।
রাতভর সে বাইরে ছিল—শেয়ার মার্কেটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত।
নিজের স্বার্থে অনেক কিছু করছে সে… এমনকি আয়ানকে সরিয়ে দিয়ে এখন নাটক করছে আরিফের সাথে।
আর এই এদিকে মানুষ লছ খেয়ে শেয়ার বেচে দিচ্ছে, সে তখন তা কিনে নিচ্ছে সস্তায়।
কিন্তু আজ ফিরে এসে ঘরের এমন দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায়।
ডাক্তার?
মেহনূর?
সবাই এমন করে তাকিয়ে আছে কেনো?
দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে, মেহনূরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে,
— “কি হয়েছে আম্মা? ওর এমন করছে কেনো? ডাক্তার কেনো?”
মেহনূরের গলায় ফিসফিসে স্বর, চোখে জমে থাকা অশ্রু নিয়ে।
এ বলে তাড়াতাড়ি মেহনূরের পাশে এসে বসে এহসান।
তারপর খুব নরম হাতে মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।কিন্তু মেহনূর সেই আগের মতোই বসে থাকে।
নীরব।
নিথর।কোনো কথা বলবে না সে।
এই পুরুষটার ওপর সে রাগ করে আছে কাল থেকে।
না… আসলে কালের পর কাল ধরে।
এহসান বাড়ি আসেনি গতরাতেও, তার আগের রাতেও না।
সে ভেবেছিল—আরও কিছু হবে, আরও অনেক কিছু হবে, কিন্তু হয়নি।
চিন্তায়, অপেক্ষায় সে প্রায় প্রাণ হারিয়ে ফেলছিল…
তবু সে মুখ খোলেনি, পণ করেছে—আর কোনো কথা নয়।
এমন সময় এনিসা বেগম হালকা রাগের সুরে বলে উঠেন,
— “কেন, কি করবে তা জেনে? তোমার এতে কি?
পরের মেয়ে কে এনেছো, খবর রাখ! ওর শরীর কেমন যাচ্ছে, ভালো আছে কি না?”
এহসান চমকে উঠে, কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে,
— “কি বলছ আম্মা! ও তো ঠিকই আছে… কি হয়েছে?”
এইবার আয়শা বেগম বলেন একটু গম্ভীর কণ্ঠে,
— “কই ঠিক আছে? কদিন ধরে কিছু খেতে পারছে না,
এখন তো বমিও করছে… অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
মেহনূর তখনও চুপচাপ বসে থাকে।সে জানে, এই খবরটা শুনলে এহসান পাগল হয়ে যাবে—খুশিতে।সারাদিন ‘বাচ্চা বাচ্চা’ করে ঘোরে লোকটা।আর আজ… আল্লাহর রহমতে, সেই বাচ্চা…সে এলো বলে।
ডাক্তারনি তখন হেসে উঠেন।
এনিসা বেগম এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন এহসানের দিকে।
তার মাথায় স্নেহভরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
— “বাপ রে, তুই বাপ হতে যাচ্ছিস…
তোর বেগমের কোলে নতুন বংশধরের আবির্ভাব হবে!”
এই কথা শুনে এহসানের ভিতরে যেন ধক করে কেঁপে ওঠে কিছু।
সে বাবা হতে যাচ্ছে?
সে… বাবা?
তার নারী…
তার মেহনূর…সে তো তার সন্তানের মা হতে যাচ্ছে!
একপলক মেহনূরের দিকে তাকায় এহসান।তারপর ধীরে চোখ ফেরায় মায়ের দিকে।
উচ্ছ্বাসে তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক উজ্জ্বল হাসি,
— “কীহ্ আম্মা! কি বলছো তুমি?”
এনিসা বেগম হেসে বলেন,
— “হ্যাঁ আব্বা, সত্যি।”
এহসান সোফায় গা এলিয়ে দেয়।
চোখ বুজে শান্তির নিশ্বাস নেয়।গলার আওয়াজে হাসির আবেশ মিশিয়ে তৃপ্তি ভরে উচ্চারণ করে—
ٱلْـحَمْدُ لِلَّٰهِ… سُبْحَانَ ٱللَّٰهِ…
…….
ٱلْـحَمْدُ لِلَّٰهِ ٱلَّذِي بِنِعْمَتِهِ تَتِمُّ ٱلصَّالِحَاتُ
“সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর, যাঁর নিয়ামতের দ্বারা সৎ কাজ পূর্ণতা লাভ করে।”
তারপর এহসান ধীরে ধীরে কণ্ঠে এক ধরনের কান্না মেশানো আবেগ নিয়ে ফিসফিস করে—
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
“হে আমার রব! আমাকে সৎ সন্তান দান করুন।”
— সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০০
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
“হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের আমাদের চোখের শীতলতা করুন এবং আমাদের মুত্তাকীদের জন্য আদর্শ বানান।”
— সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ৭৪
মেহনূর কিছুটা লজ্জায় পড়ে যায় এহসানের এমন পড়া শুনে।
চুপচাপ আলগোছে উঠে নিজের ঘরে চলে যায়।
এহসান এখনও স্বর্গীয় শান্তির আবেশে…সে যে বাবা হতে চলেছে!
এ অনুভূতি যেন তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ এনিসা বেগম ডাক দেন,
— “বাপ, যা ঘরে যা… আর কতক্ষণ বসে থাকবি?”
এহসান চোখ খুলে পাশে তাকায়।
কিন্তু কই…?মেহনূর তো এখানে নেই!
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে।
এনিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “দোয়া করবেন আম্মা… যেন আমি একজন মুত্তাকী সন্তানের জনক হতে পারি।আর আমার স্ত্রী যেন আপনার মত একজন আদর্শ মা হয়ে উঠতে পারে।”
এনিসা বেগম হেসে বলেন,
— “আমার প্রতিটি মোনাজাতে তোদের জন্যই দোয়া থাকে বাবা… তোরা আর তোদের সন্তানের জন্য।”
এহসান হেসে বলে,
— “আব্বা-ভাইজানেরা কোথায়?”
আয়শা বেগম উত্তর দেন,
— “তারা মজলিসে।”
এহসান উনাদের উদ্দেশ্যে বলে,
— “ওহহ… দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”
আমেনা হেসে বলেন,
— “দোয়া আছে ভাই।”
ঘরে ফিরে আসে এহসান।
দেখে মেহনূর বিছানায় বসে আছে, একদৃষ্টিতে বেলকনির দিকে তাকিয়ে।
এহসান আলতো পায়ে তার দিকে এগিয়ে যায়।মেহনূর এহসানকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ায়।
উদ্দেশ্য একটাই—সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
রাগে-অভিমানে জ্বলে আছে সে।
এহসান ততক্ষণে তার হাত ধরে নেয়।মেহনূর থেমে যায়।
সেই হাতে তাকিয়ে কঠোর গলায় বলে,
— “ছাড়ুন বলছি… আমায় ছুঁবেন না!”
এ বলে হাতটা ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়।এহসান মুচকি হেসে, এক টানে তাকে টেনে নেয় নিজের বুকের সাথে।
মেহনূর ছটফট করে।
চায় এহসান থেকে ছুটে যেতে।কিন্তু এহসানের হাত তার কোমরে শক্ত করে বাঁধা।
আর মেহনূর স্তব্ধ হয়ে যায়…
হাজারোবার সে এই স্পর্শে অধিকারী হয়েছে।
দিনে, রাতে… কিন্তু প্রতিবারই নতুন করে শিহরিত হয়।
মনে হয়—এই স্পর্শ নতুন, এই ভালোবাসা নতুন।
এহসান চোখে ভালোবাসা নিয়ে বলে,
— “এত রাগ করছো কেনো? কাল তো পা পর্যন্ত ধরেছিলাম…”
মেহনূর রেগে গিয়ে বলে,
— “তো…?
মাফ চেয়ে কী করলেন? সেই তো একই কাজ করলেন!
জুতা মেরে গুরু দান!”
এহসান হেসে তার থুতনি আলতো ছুঁয়ে বলে,
— “এত রাগ করো না, প্রিয়তমা…তুমি যদি এভাবে রেগে যাও, তাহলে আমার বাচ্চা টাও তোমার মতো রাগচটা হয়ে যাবো।”
মেহনূর আবার এহসানের হাত সরিয়ে দেয়,
— “ছাড়ুন আমায়… আমি কথা বলব না আপনার সাথে।”
এহসান ধীরে বলে,
— “জান… মাফ করে দাও।আর কখনো… কখনো দেরি করে বাড়ি ফিরব না।”
মেহনূর কড়া চোখে তাকিয়ে বলে,
— “মনে থাকে যেন… আর যদি দশটার আগে বাড়ি না আসেন,তাহলে ঘরে জায়গা হবে না। বলে দিলাম।”
এহসান হেসে ফেলে।আজ তার খুশির দিন।
আজ সে পূর্ণতার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল।
এহসান মেহনূরের কপালে চুমু এঁকে দেয়।
তার গাল দুটো দু’হাতে ধরে, ভালোবাসা মাখা গলায় বলে,
— “ধন্যবাদ…আমায় এত বড় নিয়ামতের অধিকারী বানানোর জন্য।ধন্যবাদ, প্রিয়তমা…আমার মতো পাপিষ্ঠ পুরুষের অস্তিত্ব বহন করার জন্য…”
এ বলে মেহনূরের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
তারপর আবার মুখ তোলে,
— “ধন্যবাদ, প্রিয় নারী।আমার পাপ মেনে আমায় ভালোবাসার জন্য।তুমি শ্রেষ্ঠ… আমার চোখে তুমিই শ্রেষ্ঠ।”
মেহনূর এবার তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
— “ধন্যবাদ আপনাকে…আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের জননী বানানোর জন্য আমায়।ধন্যবাদ, প্রিয় পাপিষ্ঠ… ধন্যবাদ।”
এহসান এবার হাত রেখে দেয় মেহনূরের পেটে।আলতো করে বুলিয়ে দেয়—
অনুভব করতে চায় নিজের রক্ত, নিজের অস্তিত্বকে…
যে এই পবিত্র গর্ভে বেড়ে উঠছে।
সে ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।
মেহনূরের কোমর জড়িয়ে ধরে তার পেটে মুখ গুঁজে দেয়।
— “এই গর্ভে এখন আমার আরেক পবিত্র অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে…”
তার গলা ভারী হয়ে আসে,
কণ্ঠ কেঁপে যায়,
— “ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে…আমি সত্যিই একজন সন্তানের জনক হতে যাচ্ছি।আমি… বাবা হতে যাচ্ছি!”
— “কলিজা অব্দি প্রশান্তিতে ভরে গেছে।”
মেহনূর এবার তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— “আমি মা হতে চলেছি…আমি এহসান তালুকদারের সন্তানের জননী হতে চলেছি।আপনাকে কিভাবে বোঝাবো…এই অনুভূতি কতটা ভয়ংকর সুন্দর…কতটা সুখের…”!
এহসান মেহনূরের পেটে সাথেই জড়িয়ে থাকে—
আর সেই অবস্থাতেই বসে থাকে…
কোনো কথা নেই…
শুধু নিঃশব্দে হৃদয়ের ভাষায় বলে যায় ভালোবাসা।
—
এশা আর মেহরাজ এসেছে আজ বড় তালুকদার বাড়িতে। সুখবর শুনেই এশার যেন মন টেনেছে এখানে। এতদিনে একবারও বলেনি আসার কথা, আজ হঠাৎ সব দ্বিধা পেরিয়ে মেহরাজকে নিয়েই চলে এসেছে। মেহরাজ প্রথমে বাড়ির ভিতর আসতে চায়নি, কিন্তু এশা তো আর মেহনূর নয় যে এহসান যা করবে সব মেনে নেবে—জেদে কান ধরে ভিতরে টেনে এনেছে ওকে! আজ মেহরাজ বলেই দিয়েছে—থাকবেও।
মেহরাজের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি, একধরনের সংকোচ… ভেতরে একটা চাপা ভয়—ওরা কি ওকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নেবে? কিছু বলবে না তো?
কিন্তু আসার পরপরই সেই ভয় যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সবাই যেন জামাই আদরে আপন করে নিয়েছে ওকে। নিজের ছোট বোনটাকেও দেখল—শুনে বুক ভরে উঠল… ছোট্ট পরীটা মা হতে যাচ্ছে!
তবে একটা জিনিস ওর মনে কাঁটার মতো বিঁধে গেল—এহসান হেসে, মজা করে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু বারবার ‘ভাতিজা’ আর ‘বাবা’ ডাক শুনে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছে সে। কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারছে না।
এদিকে এশা দাঁড়িয়ে আছে নিজের ঘরের বেলকনিতে। অনেকদিন পর এ ঘরে ফেরা… এই বেলকনি তার ভীষণ প্রিয়। রাতের আকাশটা যেন আগের মতোই আছে, কিন্তু এশার ভেতরে কত বদল!
পাশের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর—আরও দু’জন বান্ধবী একসাথে, মেয়েলি গল্পে রাতও যেন ছোট হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই মেহরাজ এশাকে রাগানোর উদ্দেশ্যে মুচকি হেসে বেলকনির দিকে এগিয়ে এসে বলে,
— “বউ চলো আমরাও একটা ক্রিকেট টিম তৈরি করার কাজে নেমে পড়ি!”
কথাটা বলেই পাশ ফিরে বেলকনিতে দাঁড়ানো মেহনূরকে দেখে থমকে যায়। মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়, মাটির নিচে মিশে যেতে মন চায়—ছোট বোনের সামনে কি না বলে ফেলেছে!
আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,
— “আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাযি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যূম, ওয়া আতূবু ইলাইহি! মাবুদ, আমি এ কী পাপ করে ফেললাম নিজের ঠাটা পড়া জবান দিয়ে !”
মেহনূর লজ্জায় দৌড়ে ঘরের ভেতর পালায়। ওর ভাই, পুরুষ মানুষ… আর সবাই এমন হবেই হয়তো।
এশা চোখ রাঙিয়ে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “যাও, বানাও আরও ক্রিকেট টিম! লজ্জা নেই, ছিঃ! বোনের সামনে!”
মেহরাজ একটু ভাব নিয়ে বলে,
— “লজ্জা….. লজ্জার কি! আমি জানতাম নাকি ও এখানে! আর ও নিশ্চয়ই বুঝে গেছে এটা একটা ভুল ছিল!”
এশা দাঁত চেপে বলে,
— “তোমায় তো কেউ কিছু বলবে না, বলবে তো আমায়! খোঁচা দেবে আমায়! তোমার বোন যে কী ফাজিল তুমি জানো না!”
মেহরাজ মুচকি হেসে বলে,
— “তুমি কি কম যাও? তুমিও তো ওর ননদ! আর ওরা তো আমাদের দিকেই এক ধাপ এগিয়ে! তাই খোঁচালে তো—তুমিও খোঁচাবে!”
এশা বিরক্ত হয়ে দূরে যেতে যেতে বলে,
— “দেখি তো সরো! এই এসেই যাচ্ছো আমার সাথে অসভ্যতা করতে!”
মেহরাজ পিছন থেকে এশাকে জড়িয়ে ধরে কাতুকুতু দিতে দিতে বলে,
— “বউয়ের সাথে অসভ্যতা করব না তো কার সাথে করব শুনি?”
এশা কুঁকড়ে কুঁকড়ে হেসে বলে,
— “ইয়া আল্লাহ! মাবুদ ইতা কিতা তে!”
হাসতে হাসতেই বলে,
— “ছাড়ো মেহরাজ! এটা আমার বাড়ি, পাশের ঘরেই ভাইজান! ছাড়ো!”
মেহরাজ কাতুকুতু থামিয়ে এশার ঘাড়ে মুখ গুঁজে ফিসফিসিয়ে বলে,
— “এশা মনি… আমি কবে বাবা হব?”
এশা মুচকি হেসে বলে,
— “যেদিন আল্লাহর হুকুম হবে…”
মেহরাজ ঠোঁট ডুবিয়ে বলে,
— “তার জন্য তো উসিলা দরকার! কিন্তু আমি কাছে গেলেই তুমি কান্না করে পালিয়ে যাও! বাবা হব কীভাবে?”
এশা কনুই দিয়ে বুকে আঘাত করে বলে,
— “হু! এত মিথ্যা কথা কেন বলো? প্রতিদিনই তো আমাতে বেসামাল হও!”
মেহরাজ এক ঝটকায় এশাকে কোলে তুলে নেয়। হালকা গম্ভীর স্বরে বলে,
— “চল, আজও হয়ে যাই!”
এশা তাড়াতাড়ি বলে,
— “না না! এটা মেহমান বাড়ি! এখানে এসব করা যায় না, স্বামী!”
মেহরাজ হেসে বলে,
— “উমম… বিবি জান! স্বামীর ভালোবাসা যেখানে ইচ্ছা সেখানে গ্রহণ করা যায়—মেহমান বাড়ি হোক আর যমের বাড়ি!”
এশা ওর গলায় হাত জড়িয়ে ধরে।
মেহরাজ যখন তাকে বিছানায় রাখতে রাখতে বলে,
— “আজ কন্ট্রোলে কেদো… এটা তোমার বাপের বাড়ি, সম্মান গেলে তোমার যাবে, আমার না!”
এদিকে মেহনূর ঠোঁট টিপে হাসছে। এহসান ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,
— “কি রে কবুতরের বাচ্চা! এত খিলখিল করছিস কেন? আমি তো কিছু করিনি!”
মেহনূর চোখ পাকিয়ে বলে,
— “হু! আমি আমার ইচ্ছেতে হাসছি—তাতে আপনার কি?”
এহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ল্যাপটপে চোখ রাখে,
— “আমার তো তুই নিজেই… আর বলছিস আমার তাতে কি!”
মেহনূর নিজের ভিতরে এক মিষ্টি কম্পন অনুভব করে—এহসান তাকে ‘তুই’ বলেছে। যেন সম্পর্কটা আরও আপন, আরও কাছের!
এহসান বলে,
— “চলে আসো… ঘুমাতে হবে তো!”
মেহনূরের চোখে মেঘ জমে, মুড একটু বিষণ্ণ হয়… তবু হাসি টেনে বলে,
— “হুম…”
বাতি নিভিয়ে ধীরে ধীরে বিছানায় আসে। ওযু আগেই করা… তাই আর কিছু লাগবে না।
এহসান এখনও ল্যাপটপে কাজ করছে। মেহনূর বিছানায় উঠতেই এহসান বা হাত বাড়িয়ে দেয়,
— “ঘুমিয়ে যাও… এসো মাথা রাখো আমার বুকে।”
মেহনূর ধীরে এগিয়ে আসে… নিজের আশ্রয় খুঁজে নেয় তার প্রিয় পুরুষের বুকে।
এহসান ওকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,
— “বউ… তুমি আমায় মেনে নিয়েছ তো?”
এই প্রশ্নে মেহনূরের হৃদয়ে যেন কাঁটা বিঁধে যায়… এহসান কি জানে না সে কত ভালোবাসে?
অভিমানে বলে,
— “না, মেনে নিইনি তো! এমনি এমনি আপনার বাচ্চার মা হয়ে গেছি!”
এহসান হেসে বলে,
— “দোয়া করি জমজ বাচ্চার বাপ যেন আল্লাহ বানিয়ে দেন আমায়!”
মেহনূর বলে,
— “হু! দোয়া থামান! বড় বাচ্চা তো আপনি ঘরে এলে শান্তি দেন না… আর দুইটা চাইছেন!”
এহসান তার পিঠে এহসানের আঙুলের নরম ছোঁয়ায়—বৃদ্ধা আঙুলে চিরচেনা আলতো আদর।
এহসান বলে,
— আমি তো একসাথে তিনটা বাচ্চার সপ্ন দেখি। বিশ্বাস কর, যদি জমজ বাচ্চা হয়, তাহলে আমি আর তোমায় অতিরিক্ত জ্বালাবো না…
ভেতর থেকে উঠে আসে একরাশ প্রশান্তি। মেহনূর তার বুকে কিল মেরে বলে,
— চুপ থাকুন খারাপ পুরুষ, শুনতে পাননি খবর? একদিনও হলো না, আর এমন করছেন!
মৃদু হেসে এহসান আবারও ল্যাপটপে চোখ রাখে, ক্লিকের শব্দের ফাঁকে হঠাৎ বলে ওঠে,
— মেয়ে হলে কি রাখব বল তো নাম?
মেহনূর একটু উঠে, কাঁধে চুল ছড়িয়ে বলে,
— আমি কি জানি না! এসব মেয়ের বাপ রাখবেন, আমি নাই এসবে।
হালকা হেসে, থেমে থেকে এহসান বলে,
— হুমমম, মেয়ে যদি হয়, তাহলে রাখব “জাহরা ছিদ্দিক এহনূর।”
মেহনূর চুপ করে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পর বলে,
— হুম, সুন্দর হবে…
আবারও শব্দ ফুঁড়ে আসে এহসানের কণ্ঠ—
— আর ছেলে হলে? ছেলের মা রাখবে বলুন, সাহেবা, কী রাখবেন নাম?
মেহনূর একটু সময় নিয়ে ভাবে, চোখ বুজে নেয় যেন অনুভব করে নামের ছন্দ, তারপর বলে,
— মুরসালিন ছিদ্দিক এহজাজ, কেমন হবে?
এহসান ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়, গলায় গম্ভীর অথচ নরম মুগ্ধতা,
— আপনার যা মর্জি, বেশ সুন্দর হয়েছে। এহসানের ছেলে হবে এহজাজ আর মেয়ে হলে এহনূর—কত সুন্দর তাই না কবুতরের বাচ্চা?
মেহনূর হেসে ওঠে, কণ্ঠে লাজুক রঙ,
— হুম, আমি আপনার এক জোড়া কবুতরের জননী হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ…
এহসান হেসে উঠে! সেই হাসির আলোয় ঘর আরও আলোকিত হয়ে যায় যেন। মেহনূর মুখ তুলে এহসানের হাসি দেখতে থাকে, মুগ্ধতায় চোখের পাতা কাঁপে। আজ আর লজ্জা পায় না—পুরুষটা তার, একান্তই তার। আজ সে সেই সৌন্দর্যকে ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার রাখে।
মাথা তুলে মেহনূর ধীরে আলতো এগিয়ে আসে, এহসানের গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। এহসান চোখ বন্ধ করে ফেলে। মেহনূরের এক হাতে ওর গাল ধরা, অন্য হাতে মুখে মুখে আঁকা হয় ভালোবাসার চিহ্ন। কপাল, গাল, চোখের পাতা, নাক—প্রতিটা প্রান্তর ছুঁয়ে যায় তার ঠোঁট।
কিছু সময়ের জন্য এহসানের ঠোঁটও আঁকড়ে ধরে ও। মেহনূর আবার তাকায়—সেই চোখে, যেটা তার প্রতি গভীরভাবে আবদ্ধ।
এহসানের চুলে আঙুল বুলিয়ে মেহনূর বলে,
— আপনি আমার ভীষণ… আক্ষেপের…”! প্রিয় পুরুষ… ভীষণ চাই আমি আপনায়, ভীষণ…
এহসানের ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে যায়। ভেতরে আল্লাহর দরবারে গুমগুম শুকরিয়ার ধ্বনি—এই ভালোবাসার দেখা পেতে পেরেছি, এটা কি কম কিছু?
মেহনূর ধীরে ধীরে এহসানের কলার চেপে ধরে, নিজের পুরোটা ভর দিয়ে ওর বুকেই মাথা রাখে।
এহসান মেহনূরের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
— মা হওয়া খুব কষ্টের, তাই না? এই যে আমার সুস্থ সুবল তুমি, এখন এত দুর্বল হয়ে যাচ্ছো…
মেহনূর বলে,
— হুম, অনেক দুর্বল লাগে… হাঁটতে হলে শরীর ভার লাগে।
এহসান মাথা নাড়ায়, কণ্ঠে গভীর আশ্বাস,
— চিন্তা করো না, আল্লাহ সব সহজ করবেন। আর কাল তো ডাক্তারের কাছে যাবই।
মেহনূর শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।
একটু পর, এহসান আবার বলে ওঠে,
— মনে আছে তো, কোন মাসে কোন সূরা পড়তে হয়? কী কী আমল করতে হয় এ অবস্থায়?
মেহনূর মুচকি হেসে বলে
— আপনি বলুন শুনি তো
—এহসান মেহনূরের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে,
— শোনো বেগম, মা হওয়া কেবল শারীরিক না, এটা একরকম আমানত। আমাদের গর্ভে আল্লাহ একটা প্রাণ দিয়েছেন। এই সময়গুলোতে কিছু বিশেষ সূরা পড়া খুবই উপকারী।
মেহনূর চুপচাপ শুনছিল, চোখে নরম মায়ার আলো। তার নিঃশ্বাসেও যেন মিশে গেছে এক অদ্ভুত শান্তি।
এহসান একটু থেমে আবার বলল,
— জানো, প্রথম মাসে সূরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি আর বাকারা’র শুরুতে পাঁচ আয়াত—এসব বেশি বেশি পড়তে হয়। এতে শিশু ঈমানদার হয়, অন্তর নরম হয়। আমি চাই আমাদের অস্তিত্ব তেমন হৃদয় এর অধিকারী হোক।
মেহনূর নিচু স্বরে বলল,
— আমি নিয়ম করে পড়ব ইনশাআল্লাহ… আপনি বলুন আরও।
এহসান মৃদু হাসে, যেন হৃদয়ের গভীর থেকে কথা আসছে।
— দ্বিতীয় মাসে সূরা ইউসুফ। আমি চাই না শুধু রূপবান হোক, চাই সে ইউসুফ (আঃ)-এর মতো পরহেযগার হোক, দুনিয়ার সব রূপকে অস্বীকার করে যেন আল্লাহর পথে অটল থাকে।
মেহনূরের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে যায়, চোখে মুগ্ধতা।
তারপর এহসান বলে,
— তৃতীয় মাসে সূরা মারইয়াম। মারইয়াম (আঃ)-এর মতো পবিত্রতা, লজ্জাশীলতা আর গভীর আল্লাহভীতি চাই। যেন সে চাহনি দিয়ে নয়, চরিত্র দিয়ে আলো ছড়ায়।
এহসানের কণ্ঠ নিচু হয়ে যায়, যেন দোয়ার মতো করে বলে,
— যদি মেয়ে হয়, চাই সে হোক মারইয়ামের মতো। আর যদি ছেলে হয়, তার দৃষ্টিতে থাকুক নম্রতা, আর অন্তরে থাকুক ভদ্রতা।
মেহনূরের চোখ চিকচিক করে ওঠে, আবেগে গলা ধরে আসে।
— চতুর্থ মাসে সূরা লোকমান, যেন আমাদের সন্তান জ্ঞানী হয়, যেন সে বাবা-মাকে সম্মান করতে জানে, দুনিয়ার মাঝে হোক সে আল্লাহর একজন প্রকৃত বান্দা।
— পঞ্চম মাসে সূরা ইয়াসিন। এতে অন্তর আলোকিত হয়, বুদ্ধি খোলে, হৃদয় হয় কোমল। আমি চাই সে শুধু জানুক না, বুঝুকও।
— ষষ্ঠ মাসে সূরা ফুরকান, যেন হক আর বাতিলের মাঝে পার্থক্য করতে শেখে, নিজের নৈতিকতা নিজেই ঠিক করতে পারে।
মেহনূর ধীরে ধীরে বলে,
— আমরা কি একসাথে পড়তে পারি? রাতগুলোয়? একসাথে বসে? আপনার কণ্ঠ শুনতে শুনতে?
এহসান ওর কপালে একটানা চুমু দিয়ে বলে,
— অবশ্যই পারব। একসাথে পড়ব, একসাথে দোয়া করব। আমি থাকব তোমার পাশে, প্রতিটি রাত, প্রতিটি মুহূর্তে।
তারপর আবার বলল,
— সপ্তম মাসে সূরা মুজাম্মিল। যেন রাতের ইবাদতে ওর মন বসে। গভীর রাতে সিজদায় পড়ে কান্না করতে পারে এমন মন চাই।
— অষ্টম মাসে সূরা ইনশিরাহ, সূরা ওয়াকিয়া, সূরা আদ-দুহা। এগুলো মনে প্রশান্তি আনে, উদ্বেগ কমায়। মা হিসেবে তোমার মনে থাকুক শান্তি, সন্তানের অন্তর ভরে উঠুক পরিপূর্ণতায়।
— আর নবম মাসে…
এহসান থেমে যায়। ওর কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। মেহনূর ওর চোখের দিকে চায়। ওর চোখে কুয়াশা।
— সূরা কাহফ, সূরা ক্বদর, সূরা ইখলাস, ফালাক, নাস।
শয়তান থেকে হেফাজতের জন্য, অশুভ থেকে বাঁচার জন্য, সন্তান যেন আলোয় জন্মায়, দোয়ার মাঝে ভেসে বেড়ায়।
মেহনূর একদম চুপ। মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে শুধু কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা।
এহসান ওর হাত ধরে বলে,
— সবটাই সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। তুমি দরূদ পড়ো বেশি করে, ইস্তিগফার করো, আর দুয়া ইউনুস—”লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্জালিমিন”—এটা যেন তোমার অন্তরের কথা হয়ে যায়।
মেহনূর ফিসফিসিয়ে বলে,
— আপনি পাশে থাকলে সব পারব, এহসান।
এহসান ওর কপাল ছুঁয়ে বলে,
— আমি শুধু পাশে থাকব না…
মৃত্যু পর্যন্ত তোমার জন্য দোয়া করব।
তোমার জন্য, আমাদের সন্তানের জন্য।
একটা দীর্ঘ নীরবতা নেমে আসে। তারপর…
এহসান ধীরে ওর বুকের কাছে মেহনূরকে টেনে নেয়।
রাতটা যেন দু’জনের নিঃশব্দ দোয়ায় ডুবে যায়।আল্লাহ যেন শুনে নেয় সমস্ত চাওয়া…একটা জীবনের শুরুর আগেই, দুটো হৃদয়ের প্রার্থনা।
রাত গভীর হয়ে এসেছে। ঘরের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে বিছানার এক কোণায়। বাতাসে মিশে আছে একরাশ প্রশান্তি।
এহসান মেহনূরের হাতটা নিজের দুই হাতে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— জানো মেহনূর, এই সন্তান শুধু আমাদের না, এই সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে!
ও যেন দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়, যেন তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে থাকে আল্লাহর ভয়, মানুষের প্রতি দয়া।
মেহনূর নিচু গলায় বলে,
— আপনি যা যা বলছেন, আমি সব লিখে রাখব। যেন কোনোদিন ভুলে না যাই। যেন প্রতিদিন আমি সেটা হৃদয়ে ধারণ করি।
এহসান আবেগে চোখ বন্ধ করে একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল,
— আমি চাই, আমাদের সন্তান এমন হোক যে তার নাম শুনলে মানুষ বলুক, “এ তো কারো দোয়ার ফসল!”
তার চোখে থাকুক হিদায়াতের আলো, তার মুখে থাকুক সত্য, আর তার চরণ যেন চলে ন্যায়ের পথে।
মেহনূর এবার একটু হাসে, কাঁধে মাথা রেখে বলে,
— ও জন্ম নিলে প্রথমবার কোলে নেব, আর কুরআনের প্রথম আয়াতটি ওর কানে পড়ে দেব। “ইকরা বিস্মি রাব্বিকাল্লাযি খালাক”।
এহসান একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়,
— আমার বউ তো আমায় ছাড়িয়ে যাবে দোয়ার দিক দিয়ে!
মেহনূর চোখ টিপে বলে,
— আপনি শিখিয়েছেন সব। আপনি যদি না বলতেন এসব, আমি হয়তো এগুলো ওত গুরুত্ব দিতাম না…
এহসান চোখ সরিয়ে আবার চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি চাই, সন্তান যেন নামাজে শান্তি খোঁজে, কুরআনে সান্ত্বনা পায়, আর দুনিয়ার মধ্যে থেকেও আখিরাতের কথা ভুলে না যায়।
তারপর ধীরে ধীরে মেহনূরের কানে মুখ নিয়ে বলে,
— তুমি রোজ একবার করে ওকে সালাম দিও, যেখানেই থাকুক সে তোমার গর্ভে, যেন ছোটবেলা থেকেই বুঝে যায়—মা’র দোয়া, মা’র কণ্ঠ, মা’র আদর পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।
মেহনূরের চোখ দিয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু।
সে বলে,
— আমি এই সন্তানের জন্য সব করব। আল্লাহ যেন আমাকে হায়া ও ধৈর্যের মায়ায় গড়ে তোলেন।
এহসান বলে,
— আল্লাহর কাছে চাইব যেন আমাদের সন্তান জান্নাতের পথে চলার অভ্যেস নিয়ে জন্ম নেয়। আর যদি কোনোদিন কখনো সে পথ হারায়… আল্লাহ যেন তোমার কান্না দিয়ে, আর আমার সিজদা দিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনেন।
মেহনূর ধীরে মাথা নাড়ে।
কথা বলে না, শুধু এহসানকে জড়িয়ে ধরে।
চুপচাপ।
তাদের নিঃশব্দতা ভাঙে শুধু ঘড়ির টিকটিক, আর জানালার বাইরে মিলিয়ে যাওয়া রাতের বাতাস।
এই রাত যেন সাক্ষী হয়ে থাকে…
একটি জীবনের সূচনা,
একটি দোয়ার যাত্রা,
আর দুইটি হৃদয়ের নিঃশব্দ ভালোবাসা।
নিশুতি রাত। ঘরের ভেতর হালকা নিঃশব্দ। জানালার বাইরে চাঁদের আলো পড়েছে বিছানার প্রান্তে, যেন সেই আলোয় লুকিয়ে আছে এক চিলতে সান্ত্বনা।
নূরি হাঁটছে ঘরে বাঁকানো হয়ে, মুখটা পাথরের মতো শক্ত, দাঁত চেপে রেখেছে সে। চোখ বুঁজে রেখেছে, কিন্তু ব্যথা তাকে নিস্তরঙ্গ করে তুলছে। প্রথম দিনের পিরিয়ড, পেটের নীচে টানটান যন্ত্রণা, কোমরে যেন শেকল বেঁধে কেউ টেনে ধরছে।
সে উঠতে পারছে না, বসতে পারছে না—ঘুমও আসছে না। লজ্জায় বুকের ভিতরটা জমাট বাঁধা। মেহরুব পাশে বসে কখনো ওর দিকে তাকিয়ে, কখনো আবার নিজের ল্যাপটপে চোখ রাখছে।
— “নূরি… কী হয়েছে তোর?”
বারবার প্রশ্ন করছে মেহরুব, কিন্তু নূরি কিছু বলছে না। মাথা নিচু, চোখ বন্ধ। সে জানে, বলতেই হবে, কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না। কীভাবে বলবে? নিজের স্বামী হয়েও তাকে বলতে এত দ্বিধা কেন জানে না। এত লজ্জা কোথা থেকে আসে, নিজেই বুঝে না সে।
নিজের কাছে রাখা প্রয়োজনীয় ন্যাপকিনগুলোও ফুরিয়ে গেছে। সবসময় ছোট চাচীর হাত দিয়ে এসব এনে রাখে—কিন্তু এখন? এই রাতে ছোট চাচীর কাছে যাওয়া কীভাবে সম্ভব? কী বলবে উনাকে? তার নিজের মুখ দিয়ে তো কিছু বলা হয় না।
এদিকে মেহরুব ধীরে ধীরে বুঝে ফেলছে কিছু একটা ঠিক নেই।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
— “পিরিয়ড হয়েছে তোর, তাই না?”
নূরির কান গরম হয়ে ওঠে, মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। মাথা নিচু, এক বিন্দু চোখ তুলে তাকায় না সে।
মেহরুব দাঁত চেপে ধমক দিয়ে বলে,
— “তোর লজ্জায় তোকে চুবিয়ে মারব, শয়তান মেয়ে! এতক্ষণ ধরে ব্যথায় কুঁকড়ে আছিস, অথচ একটা কথাও বলছিস না আমাকে! আমি তোর স্বামী—আমার সামনেও তো লজ্জা?”
সে উঠে দাঁড়ায়, পেছনে হাঁটা দেয় কিছুটা। এরপর ফিরে তাকায়, চোখ জ্বলছে মিশ্র অভিমান আর উদ্বেগে।
— “এই তোর সাথে সংসার করব আমি? আমি তোর মাহরাম, অথচ আমার সামনে লজ্জায় মরতে বসিস! এটা তো আমার জানা উচিত—তুই কষ্টে থাকবি, আর আমি নির্বিকার থাকব সেটা তুই কীভাবে ভাবলি?”
নূরি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। শব্দ করে না, শুধু চোখের কোণায় এক ফোঁটা জল ঝুলে থাকে।
মেহরুব তার সামনে এসে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করে,
— “প্রয়োজনীয় কিছু লাগবে? গরম পানির ছ্যাঁকা নেবি? পেটে, কোমরে ব্যথা করছে?”
নূরি অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।
— “আ… আপনি এগুলোও জানেন?”
মেহরুব নিজের কপালে থাপ্পড় মেরে বলে,
— “দূর! এই অবুঝ মেয়েটা আমার হয় কেন? এগুলো জানা কি অস্বাভাবিক? এগুলো খারাপ কিছু নাকি?”
নূরি নিচু গলায় বলে,
— “হুম… খারাপ না।”
— “ন্যাপকিন আছে?”
এই প্রশ্নে যেন মাটিতে গুঁড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে নূরির। একদিকে ব্যথা, অন্যদিকে লজ্জা। সে হেসে ফেলে অসহায়ভাবে, তারপর মাথা ঘুরিয়ে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— “না… নেই… কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না… সকালে পেয়ে যাব…”
মেহরুব এবার সত্যিই রেগে যায়।
— “কখন হয়েছিল?”
নূরি নিঃশব্দে বলে,
— “ইশার নামাজের পর…”
মেহরুব এবার ঠোঁট চেপে ধরে ধমকে ওঠে,
— “বালের লজ্জা পাও তুমি বাল পাও! কতক্ষণ ধরে কষ্ট পাচ্ছিস! একবার বললে হতো না?”
সে সঙ্গে সঙ্গে মানিব্যাগটা তুলে নেয়, লুঙ্গিটা ঠিক করে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
— “খবরদার ঘর থেকে বের হবি না। আমি ফার্মেসী থেকে আসছি।”
নূরি কিছু বলতে চায়, পারে না। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। হাতে ছোট একটা প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে মেহরুব। তার মুখে কড়া ভাব নেই, আছে মমতা মেশানো তাগিদ।
সে প্যাকেটটা নূরির দিকে এগিয়ে দেয়।
— “যা… চেঞ্জ করে আয়।”
নূরি কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেটটা নেয়। চোখে ভেসে ওঠে অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞতার আলো। সে তাকায় মেহরুবের দিকে—নিঃশব্দে, অথচ ভেতর থেকে গভীরভাবে ভালোবেসে।
বাথরুমে চলে যায় সে…
…
এদিকে মেহরুব নিচে নেমে আসে। দ্বিতীয়বারের মতো জীবনে রান্নাঘরে পা রাখে—তাও গভীর রাতে। গ্যাস চালায়, চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে বারবার তাকায় কেটলির দিকে। গরম পানিটা যত্ন করে গরম করে। হাত ছুঁয়ে দেখে, যেন পারফেক্ট তাপমাত্রা হয়।
তার চোখে ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই—
…ঘরের ভেতর আলো ক্ষীণ। দেয়ালে দেয়ালে ছায়া নেমে এসেছে। নূরি চুপচাপ বিছানায় বসে আছে, মুখে একটুও শব্দ নেই। চোখে ক্লান্তির ছাপ, অথচ তার চেয়েও বেশি স্পষ্ট সেই চাপা লজ্জা—যেটা সে বারবার ঢাকতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
মেহরুব ধীর পায়ে এসে তার পাশে বসে। খুব কোমল কণ্ঠে বলে,
— “শুয়ে যা…”
নূরি মাথা নাড়িয়ে বলে,
— “আচ্ছা…”
ধীরে ধীরে শরীরটা টেনে বালিশে মাথা রাখে সে। মেহরুব তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে, নূরির কামিজটা আলতো করে সরিয়ে নেয় পেটের ওপর থেকে।
তারপর গরম পানি ভরা পাত্র থেকে একটা পরিষ্কার নরম রুমাল ভিজিয়ে নেয়। হালকা চেপে বাড়তি পানি ঝরিয়ে, সেই রুমালটা নিয়ে খুব যত্ন করে ছোঁয়ায় নূরির পেটে।
রুমালের উষ্ণতায় একটু আরাম মিশে যায় নূরির চেহারায়। চোখ বন্ধ করে ফেলে সে, দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শান্তি নেমে আসে মুখে।
মেহরুব তখন নিচু গলায় বলে ওঠে—কণ্ঠে ধরা পড়ে গভীর দায়িত্ব আর মায়া,
— “আমি তোর স্বামী, নূরি। আমার সামনে এসব নিয়ে লজ্জা পাবি না তো। এই সময় তোর যত্ন নেওয়া আমার দায়িত্ব। তুই কষ্টে থাকলে, সেটা আমারও কষ্ট। এই কষ্ট লুকানোর কিছু নেই, এটা কোনো লজ্জার বিষয় না। একজন দায়িত্বশীল স্বামী হিসেবে তোর পাশে থাকাটা আমার দায়িত্ব, আমার ভালোবাসা…”
তার কণ্ঠের উষ্ণতায়, হাতের ছোঁয়ার কোমলতায়—নূরির গাল বেয়ে যেন একটা তৃপ্তির ঢেউ বয়ে যায়।
মেহরুব শব্দ না করে , হাতের রুমাল আরও একটু আগে গরম পানিতে ডুবিয়ে এনেছে। সেই তোয়ালে এবার আলতো করে নূরির পেটের নিচে চেপে ধরে। ব্যথার তীব্রতায় নূরির চোখ দুটো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে আসে, কিন্তু সে কিছু বলে না। শুধু নিঃশব্দে সহ্য করে যায়।
মেহরুব তার মুখটা কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— “আর কষ্ট পাচ্ছিস?”
নূরি শুধু মাথা নাড়ে, চোখদুটো ভিজে আসে অজান্তেই।
— “এই ব্যথাটা যদি আমি নিতে পারতাম… তোকে এইভাবে দেখতে আমার সহ্য হয় না।”
তার কণ্ঠের নিচে এক অচেনা কাঁপুনি। পেছনে রাখা মগটা এগিয়ে দেয় সে,
— “এইটা খা। আদা আর দারচিনি দিয়ে বানিয়েছি। গরম আছে এখনো। খেলে একটু আরাম পাবি।”
নূরি ধীরে ধীরে উঠে বসে, হাত বাড়িয়ে মগটা নেয়। ঠোঁটে কাপ ছুঁইয়ে এক চুমুক নেয়। এরপর বিছানায় হেলান দিয়ে চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। মেহরুব তখন তার পেছনে বসে, দুই হাত দিয়ে পিঠটা আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করতে থাকে।
আত্মার আগলে পর্ব ৪৮
— “এইভাবে ভালো লাগছে?”
— “হুঁ…”
একটা ছোট শব্দ, কিন্তু তাতে অনেক প্রশান্তি মিশে আছে।
