আপনাতেই আমি পর্ব ৫৩
ইশিকা ইসলাম ইশা
ফুটফুটে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করছে রিদি। বাচ্চাটা খিলখিল করে হাসছে।তার হাসির শব্দ যেন চারদিকে সুর তুলে ছন্দ তৈরি করছে।রিদি মুগ্ধ নয়নে সেই হাসি মুখ দেখছে। বাচ্চাটা হাসি দেখতে দেখতেই রিদি আশেপাশে খেয়াল করল,
আশেপাশে সবকিছু সাদা। যেন সাদা মেঘের ভেলা। মেঘ যেন ঘিরে আছে তাদের।তবে সবটাই কেমন ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। অবস্থান রত জায়গা ছাড়া আশেপাশে তাকিয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছে না রিদি।জায়গাটাও পরিচিত জায়গা মনে হচ্ছে না । তাই ফেরার উদ্দেশ্য বাচ্চাটাকে কোলে নিতে চাইলে বাচ্চাটা দৌড়ে চলে যায় সেই মেঘাচ্ছন্ন ধোঁয়াশাই। খিলখিল সেই হাসির শব্দ মিলিয়ে যায় বাতাসে ।রিদি দৌড়ে খুঁজতে শুরু করে বাচ্চা টাকে। কিন্তু খুজে পায় না।শুধু কানে এসে বাজছে তার খিলখিল হাসির শব্দ।রিদি চিৎকার করে বলে …
মা কষ্ট পাচ্ছে সোনা!!ফিরে আয়!!!!!
ধরপর করে উঠে বসে নীর রিদির চিৎকারে।
কি হয়েছে আপু!!!আপু!!
আমার বাচ্চা হারিয়ে যাচ্ছে ঐ কুয়াশায় ওকে বাঁচাতে হবে!!!
বাচ্চা!!!আপু!!!!আপু!!!তুমি ঠিক আছো???কথাটা রিদিকে ঝাঁকিয়ে বললো নীর
রিদি আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো সে স্বপ্ন দেখছিল।পাশে নীরের একটার পর এক প্রশ্ন কানে এলেও কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু নীর কে উদ্বিগ্ন হতে দেখে আস্তে করে বলল।
আমি ঠিক আছে নীল!! স্বপ্ন দেখেছিলাম!!
খারাপ স্বপ্ন??
হারানোর স্বপ্ন!!
নীর একটু থেমে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কে হারিয়েছে??আর মা কষ্ট পাচ্ছে কাকে বলছিলে!!আর বাচ্চা!!কার বাচ্চা??
রিদি কিছু বলল না।নীর আবারো কিছু বলবে ঠিক তখনি চারদিক থেকে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি।রিদি উঠে দাঁড়ালো।বাইরে তখনো সূর্যোদয় হয়নি। রিদি নামাজ পড়ার জন্য ওজু করে এলো।নীল চুপচাপ রিদিকে দেখে সেও ওজু করে এসে নামাজে দাঁড়ালো।
নামাজ শেষ করে রিদি বেলকনিতে দাঁড়ালে নীল ও পিছু পিছু এলো। মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,
আপু চা খাবে!!
না!!!
নীর বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
সরি!!!
রিদি নীলের দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে,
কেন??
আমি তোমাকে ওসব কিছু জিজ্ঞেস না করলে হয়তো তুমি অসুস্থ হতে না!!!
রিদি তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
আমি তো সুস্থ ই ছিলাম না নীল।আমি বরাবরই অসুস্থ। তুই যা গিয়ে একটু ঘুমা।
তুমি??
আমি এখানে বসবো।
তাহলে আমিও বসব!তুমি শুলে আমিও শুবো।
অহেতুক জেদ কেন করছিস!!
নীল রিদির দিকে তাকিয়ে দেখল রিদিকে।মনে মনে ভাবল অনেক কিছু ,”আচ্ছা আপুর জীবনে কি ঘটেছে?তখন ডক্টর ওনার ভাইয়ের সাথে কার ব্যাপারে কথা বলছিলো?এই তীব্র কে??কথাটা আড়ালে থেকে শুনলেও এর মানে বের করতে পারে নি নীল।রায়ান কেন বলল যে এটা সম্ভব না!!!আর বাচ্চা!কার বাচ্চা??
নীল কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিদি বলল,
ভয় পাস না আমার কিছু হবে না।
নীল ভাবনা থেকে বেরিয়ে রিদির কথা শুনলেও নাছোড়বান্দার মতো বসেই রইল।রিদি নীল কে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে গিয়ে বিছনায় শুয়ে থাকল।নীল ও এসে শুয়ে পড়লো। বেচারি রাত জেগে টায়ার্ড তাই ঘুমিয়ে পড়ল মুহূর্তেই। কিন্তু রিদির চোখে ঘুম নেই।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু কত নির্ঘুম রাতের সাক্ষী।স্বপ্নে দেখা সেই খিলখিল হাসি এখনো তার কানে বাজছে।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করল তীব্র। অপারেশন রুম থেকে কেবিনে এসেই চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল। বড্ড বেশি ক্লান্ত সে।পরপর দুটি অপারেশন ছিল আজ।দুটোই সাকসেসফুল। সাকসেসফুল কথাটা শুনে পেসেন্টের পরিবারের সদস্যরা কেঁদে কেটে একাকার। তীব্রকে ঘিরে তাদের কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নেই যদিও এটা নতুন কিছু না। তবে মধ্যে বয়সী একটা মহিলা তীব্রর মাথায় হাত রেখে বলল,
আল্লাহ তোমাকে সবসময় সুখে শান্তিতে রাখুক বাবা দোয়া করি।
তীব্র হাসলো মহিলাটির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
আমার সুখ শান্তি দুটোই আমার থেকে দূরে আছে।
মহিলাটি হয়তো কিছু বলবে। কিন্তু তীব্র কোন সুযোগ না দিয়েই গটগট করে হেটে চলে গেল। মহিলাটি তীব্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
আল্লাহ তোমার সুখ শান্তি দুটোই ফিরিয়ে দিক বাবা।ভালো থেকো।তীব্র কথাগুলো হয়তো শুনতে পায়নি।পাবে কিভাবে সে তো তীব্র।কাজ শেষ মানে সেখানে আর দুই সেকেন্ড ও না।
তীব্র চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসার কয়েক মিনিট পরেই রুমে ঢুকে লাবিব। ক্লান্ত তীব্র কে দেখে কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে থাকল।বস আজকাল অনেক প্রেসারে থাকে।রাতেও তার ঘুম নেই।শকুনের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার কাজ চলতেই থাকে।এতো প্রেসার নিতে নিতে মানুষটার না কিছু হয়ে যায়।এতো কষ্ট তাকে করতে হচ্ছে শুধু মায়ায় জড়ানো নিজস্ব সম্পদের জন্য।না হলে তীব্র চৌধুরীকে নাচানো অসম্ভব।লাবিবের ভাবনার মাঝেই তীব্র চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলে বাইরে যেতে পারিস!!
তীব্র চোখ বন্ধ করেও বুঝে গেছে লাবিব কিছু বলতে চাই। লাবিব হতবাক হল না।সে এসবে এখন অভ্যস্ত। তীব্র চোখ খুলে লাবিব কে দেখল। ক্লান্ত চোখে বিরক্তকর কন্ঠে বলল,
কি হল কিছু বলবি!!!(শক্ত কন্ঠে)
ভাই আসলে ম্যাম আপনার খোঁজ করছিলো?গত কয়েকদিন ধরে বাসায় যান নি।ফোনেও আপনাকে পাচ্ছে না।আপ….
লাবিবের কথা শেষ না হতেই তীব্র বলে,
তোর ম্যাম কে ভাবি হিসেবে পছন্দ হয়নি নাকি??
তীব্রর এমন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকাল লাবিব।তবে ভাবি কথাটাই রিদির কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তার।রিদি তার ছোট হলেও রিদিকে ভাবি ডাকত লাবিব।ভালো লাগত ছোট মেয়েটাকে ভাবি ভাবি ডাকতে।আর রিদিও কি সুন্দর তাকে ভাইয়া ডাকত!রিদি তাকে বলেছিল,
আমি আপনার বয়সে ছোট।আমাকে নাম ধরে ডাকবেন!ম্যাম বলা যাবে না। কিন্তু বসের বৌ কে নাম ধরে ডাকা সোভা পায় না তাই ভাবি বলেই ডাকত।
উনি ম্যাম হলেও ভাবি না স্যার!!
লাবিবের কথায় হাসল তীব্র!!তীব্রর হাসির দিকে তাকিয়ে নিজেও একটু হাসল লাবিব। দুইজনের হাসিতেই বেদনাময় রহস্য??
হসপিটালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়াই অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি।রিদি সেই সকাল থেকে রোগীদের দেখে চলছে।
রিদি তুমি সেই সকাল থেকে রোগী দেখছো এখন একটু রেস্ট কর।(রিদি কলিগ ডঃ জায়ান হক)
রিদি মাস্কের আড়ালে সল্প সুরে বলল,
এই কেবিনে রোগী…………
রিদি কিছু বলার আগেই কেউ চিৎকার করে উঠল,
ডঃ রিদিইইইইইই
পেসেন্ট সহ সবাই হচকচিয়ে তাকাল চিৎকার করে ডাকা ব্যাক্তির দিকে। রিদি আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল তার কাছে,
লিলি!!এভাবে চিৎকার করে ডাকার কি হয়েছে?? ডাকাত পড়েছে!!!
লিলি কিছু বলার আগেই ডঃ জায়ান হক এসে বলে,
এটা হসপিটাল নাকি মাছের বাজার??
লিলি মাথা নিচু করে বলে,
সরি স্যার!আসলে একটা বাচ্চার ভীষণ জ্বর। কিন্তু বাচ্চাটা কান্না করছে।
ডঃ জায়ান কটমট করে বলল,
জ্বর হলে তো আপনিও কাঁদেন।ও তো বাচ্চা! কাদবেই এতে এতো চেচানোর কি আছে?
আসলে!!!
আসলে আসলে না করে গিয়ে নিজের কাজ করেন।
কিন্তু স্যার। বাচ্চাটা সেই ১ঘন্টা যাবৎ কেঁদেই চলেছে।কেদে কেদে একদম চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে।কেউ শান্ত করতে পারছে না।যেই কোলে নিচ্ছে তাকেই মারছে!!
মারছে!!লাইক সিরিয়াসলি!!ও বাচ্চা!!
লিলি অসহায় চোখে তাকাল রিদির দিকে,
ডঃ জায়ান তার কথা বিশ্বাস করছে না।
রিদি লিলির এলোমেলো চুল আর মুখে নখের আঁচড় দেখে কিছুটা আন্দাজ করে বলল,
ডঃ জায়ান আপনি বাকি রোগীদের একটু দেখুন আমি বাচ্চাটাকে দেখছি।
ডঃ জায়ান কিছু বলার আগেই রিদি চলে গেল। ডঃ জায়ান বিরক্ত মুখে রোগীদের দেখতে চলে গেল। সঙ্গী হিসেবে বেশ পছন্দ তার মেয়েটাকে।
করিডর থেকেই শোনা যাচ্ছে বাচ্চার কান্নার শব্দ।রিদি দ্রুত রুমে ঢুকে।ঢুকেই অবাক । ডঃ মিতুর কোলে ৫-৬মাসের একটা বাচ্চা কাঁদছে।সুতি একটা বেগুনি ফ্রগ পড়নে গোলগাল সুন্দর একটা বাচ্চা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।রিদি বাচ্চাটার অবস্থা দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠল অনেকক্ষণ কাঁদার কারনে মুখ লাল হয়ে আছে যেকোন সময় মনে হচ্ছে গাল ফেটে রক্ত বেরবে।কাঁদছে তো কাঁদছে ছোট ছোট হাতে ঘামচে ধরছে চুল,নাক,মুখ। ডঃ মিতু হিমশিম খাচ্ছে সামলাতে।ডঃ মিতুর চুলের অবস্থা দেখে যে কেউ তাকে পাগল ভাববে।কারন চুল পাখির বাসার মত হয়ে গেছে।
রিদি কে দেখে ডঃ মিতু কোনমতে মেয়েটাকে রিদির কোলে দিয়ে দেয়।রিদি চমকে উঠে। বাচ্চাটার শরীর অনেক গরম। দ্রুত বাচ্চাটাকে সোজা করে বুকে চেপে ধরে। কিছুক্ষন ছটফট করে রিদির বুকে শান্ত হয়। হয়তো রিদি গুনগুন করে গান শোনানো তার পছন্দ হয়েছে,
“ঘুম আসে যায়….
চোখের পাতায়…
আমার সোনা ঘুমাবো…..”
বাচ্চাটা শান্ত হতেই সবাই প্রান ফিরে পায় যেন। ডঃ মিতু তো বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে।এমন বাচ্চা আজ পর্যন্ত দেখেনি।এতো জ্বরের কিভাবে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। কাঁদছে তো কাঁদছে আবার হাত ও চলছে।ভাবা যায়!!কি সাংঘাতিক ব্যাপার!এর মা বাবা কে??জানার তীব্র ইচ্ছা জাগল তার মনে।
এদিকে নিভু নিভু চোখে রিদির দিকে তাকিয়ে আছে বাচ্চাটা।রিদি মুচকি হেসে কপালে চুমু দিল। একধ্যানে কেমন তাকিয়ে আছে তার দিকে।রিদির ভেতরটা হু হু করে উঠল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে।না চাইতেই পানি গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে।মাতৃত্ব হৃদয় জুড়ে গেল।রিদি বুকের মাঝে জরিয়ে ধরায় বুঝতে পারল বাচ্চাটা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । অতিরিক্ত কাঁদার ফলে মাঝে মাঝে কেপেও উঠছে।ইসসস না জানে কখন থেকে কাঁদছে!!
রিদি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মায়াবী মুখের দিকে।এরপর বেডে শুইয়ে দিতেই কেঁদে উঠলো।রিদি ঝটপট আবারো কোলে তুলে নিতেই ডঃ মিতু বলল
ডঃ মিতু:এমা এই দেখি তোমার কোল থেকে নামলে কাঁদছে!!অথচ এতোক্ষণ আমাদের কোলে থাকবে না বলে কাঁদছিল। কিন্তু বাচ্চাটার তো অনেক জ্বর।আমি ওকে ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি।
রিদি সম্মতি দিয়ে বলল,
বাচ্চার বাবা মা কোথায়??
মিতু রাগী গলায় বলল,
বাচ্চার কেয়ার টেকার নিয়ে এসেছে ।বাবা মা নাকি নাই বাসায়।এসব ভাবা যায়!! সন্তানের প্রতি কোন দায়িত্ব নেই। শুধু টাকা ইনকাম করতে পারলেই হলো।এখনকার সব মডার্ন বাবা মা।ফালতু সব!রিদি মিতুর কথায় ছোট একটা শ্বাস ফেলে বুকের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটার দিকে তাকালো। সুন্দর, শান্ত বাচ্চা একটা মেয়ে।রিদি বাচ্চাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসল হা হয়ে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা।ইসসস কি সাংঘাতিক কিউট!!
আপনাতেই আমি পর্ব ৫২
বাচ্চার নাম কি??মিতু মহিলাটিকে জিঙ্গেস করতেই সে আমতা আমতা করে বলল,
নাম!! মানে নাম!!কি যেন কইছিলো!!
বাচ্চার নাম জানেন না!!!(অবাক হয়ে)
পরি!!পরির মতো দেখতে তাই স্যার ওর নাম রাখছে পরি।দেহেন না। কত্তো সুন্দর!!পরির লাহান।
ডক্টর মিতু চাইল বাচ্চাটার দিকে রিদির কোলে কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে অথচ শোয়াতে গেলে কেঁদে উঠছে।মিতুর কাছে মনে হচ্ছে যেন সে মায়ের বুকে ঘুমাচ্ছে।মিতু আবারো চাইল বাচ্চাটার দিকে হলদেটে ফর্সা বাবুটা।মনে হচ্ছে কাঁচা হলুদ মেখেছে।এমন রং খুব কম মানুষেরই হয়। সাথে অত্যাধিক মায়াবী।মনে হয় খুব আদরে পালিত রাজকন্যা সে।রাজার রাজ্যের আদুরে রাজকন্যা।