আপনাতেই আমি পর্ব ৬৫
ইশিকা ইসলাম ইশা
চারদিকে সকালের আমেজ শুরু হয়েছে। গ্রামে মানুষ খুব ভোরে উঠেই তাদের কর্মে যায়।সবাই একে একে তাদের কাজে লাগছে।রিদি বারান্দা থেকে দূরে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই দেখে এসেছে রোজ তীব্রর বুকে সেদিনের মতোই সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে।তীব্র ও মনে হচ্ছে খুব শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।যেন অনেক দিন নির্ঘুম রাত পার করেছে। রোজ আর তীব্রর ব্যাপার তার কাছে জটিল একটা অংক মনে হচ্ছে।যা সমাধান করতে গেলে মাথা ঘোরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তা।মনে মনে প্রশ্ন জাগছে” রোজ কে?কি তার পরিচয়? কিন্তু উওর জানা নেই কোনটারই।
আপু !!
নীরের কথায় পেছনে তাকায় রিদি।নীরের বাবা মা ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগছে।তার জন্যই এসব হচ্ছে। যদিও জানে তীব্র কিছু করবে না কিন্তু সাময়িক কষ্ট পাবে তো।
আম সরি নীল!!
“সরি কেন বলছ আপু!
“আমার জন্য তোর বাবা মা……
“এতে তোমার কোন দোষ নেই!তবে আমি জানতে চাই তোমার অতীত।
রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবারো দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
অবহেলা কি জানিস নীল!!আমি ছোট থেকেই অবহেলায় বড়ো হয়েছি। শুধু আমার গায়ের রং কালো তাই!আমরা দুই বোন এক ভাই!আমি, ভাইয়া আর রুপালি আপু।এরপর রিদি বলতে শুরু করল তার অতীত।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদিকে তীব্রর ঘুম ভাঙ্গে অবোল তাবোল কথায়।প্রথমে বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে চোখ খুলে বুঝল।মেয়ে তার বুকের উপর শুয়ে তাকে দেখছে আর কি কি সব বলছে।হাত দিয়ে ধরতে চাইছে তীব্রর মুখ। কিন্তু পারছে না।তীব্র রোজ কে দেখে বিস্তর হাসল।দুহাতে মেয়েকে বুকে বসিয়ে বলল জানের পাখি!!আমার প্রিন্সেস!!আমার মায়ের ঘুম হয়ে গেল!
“রোজ বাবার চুল মুঠোয় নিয়ে খেলতে লাগল।
তীব্র রোজের পেটে কাতুকুতু দিতেই রোজ খিলখিল করে হেসে উঠল।
দুইজনের দুষ্টুমির মাঝেই তীব্র ঘড়িতে সময় দেখল।তখন বাজে ৮টা ২ মিনিট।রিদি রুমে ঢুকে রোজ, তীব্র কে জেগে থাকতে দেখে বলে,
আমার মামনি উঠে গেছে??আসো!!রোজ রিদি কে দেখে হাত পা ছুড়তে থাকে। যেন বাবা মা কে একসাথে দেখে সে ভীষণ খুশি।মেয়েকে খুশি দেখে রিদির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।রোজ কে কোলে নিয়ে তীব্রর দিকে তাকালো।তীব্র মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে মা মেয়ের দিকে। রিদি তীব্র কে দেখে বলল,
খাবার তৈরি চলে আসুন!!
তীব্র মিষ্টি হেসে সম্মতি দেয়।এরপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে আসতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।আলু ভর্তা আর ভাত!!!!
রিদি মনে মনে বলে,
হু!! থাকবেন না! থাকেন!!এসব ই খেতে হবে!!এটা আপনার চৌধুরী বাড়ি না!!
তীব্র অসহায় চোখে তাকাল রিদির দিকে,
এসব কি খাবার!!!
রিদি বিরক্ত হয়ে বলল,
কি খাবার আবার!!ভাত ভর্তা!!চোখে দেখেন না!
তীব্র অসহায় মুখে বলে,
আমি এটা খাব!!!
রিদি একই ভঙ্গিতে বলে,
তো!খেলে খান না খেলে চলে যান!!
নীর ভু কুঁচকে দুইজনকে দেখছে।তীব্র একটু ভাতের সাথে একটু ভতা দিয়ে মুখে দিতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।সকালে এসব খাবার খায় না তীব্র।হেলদি ব্রেকফাস্ট করে।যাতে থাকে ঐ ঘাসপাতা সবজি,ডিম,ওটস,দুধ। তাছাড়া তীব্র ঝাল খেতে পারে না।আর নীর ভর্তায় ঝাল বেশি দিয়ে করেছে।তাই চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে।রিদি জানলেও কিছু বলে নি।
তীব্র কোনমতে ভাতটুকু গিলে গটগট করে পানি খেল!!নীর দুইজন কে দেখে বলে,
আব কিডন্যাপার ভাইয়া!!কোন সমস্যা!!আপু বলল আপনি নাকি ঝাল পছন্দ করেন!!
তীব্র শীতল চোখে রিদির তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
অনেক!!!
তাহলে খান!!
হ্যাঁ খাচ্ছি!!
তীব্র রিদির দিকে তাকিয়ে ঝাল ভতা দিয়ে ভাত মুখে পুরে নেয়।রিদি হতবাক হয়ে তাকালো তীব্রর দিকে।পরপর ঝাল ভর্তা খেয়ে তীব্রর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। তবুও খেয়েই যাচ্ছে।রিদি তীব্রর মুখ দেখে ঝট করে উঠে এসে বললপ,
হয়েছে!!আর খেতে হবে না!!
তীব্র জেদ ধরে বলে,
আমি খাব!!
রিদির রাগ হয়,
তীব্র জেদ করবেন না! ছাড়ুন!!
তীব্র তবুও জেদ করে খেতেই রিদি তীব্রর হাত ধরে বলে,
হয়েছে আর খাবেন না! মানা করছি না আমি!!তীব্র ঝালে মাথা নিচু করে আছে। ইচ্ছে করছে সব উল্টা পাল্টা করে দিতে।ভেতরে জ্বলছে তার।লাল হয়ে আসা মুখটা একটু তুলে রিদিকে বলল,
“জান!!আপনি খুশি তো!!আমি শাস্তি পাচ্ছি!!
রিদির চোখ টলমল করে উঠল। তবুও নিজেকে শক্ত করে বলল,
“কেন একা ছেড়ে দিচ্ছেন না আমাকে!
কথাটা বলে ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি এনে গ্লাসে করে তীব্রর মুখের সামনে ধরে। কিন্তু তীব্র মুখ সরিয়ে রুমে চলে যায়।রিদি তীব্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে!রাগে গজগজ করতে করতে তীব্রর পিছু পিছু যায়।এই লোক অত্যাধিক ত্যারা।রিদি রুমে এসে দেখে তীব্র সটান হয়ে শুয়ে আছে। গলায় হাতে লাল লাল কি যেন হচ্ছে।রিদি অবাক হয়ে বলে,
এসব কি হচ্ছে?? আপনার গায়ে?মানা করলেও আপনি কেন শুনেন না তীব্র।আমাকে কষ্ট দিয়ে কি মজা পান!!এতো ভালো লাগে আমাকে কষ্ট দিতে!!
দেখি উঠুন।সাওয়ার নিতে হবে!! আসুন!!
তীব্র থেমে থেমে বলল,
আপনি একটু ছুঁয়ে দিন সব ঠিক হয়ে যাবে!!
রিদির হুট করেই মেজাজ গরম হলো।রেগে বলল,
উঠুন বলছি!! অসভ্য লোক!! উঠুন!!
রিদির জোড়া জোড়ি তে তীব্র উঠে দাঁড়াল।রিদি তীব্রর রগে রগে পরিচিত তাই সময় নষ্ট না করে হাত টেনে নিয়ে সাওয়ার এর নিচে দাড় করিয়ে দিল। শার্টের বোতাম খুলে শার্ট টাও খুলে ফেলতেই নজরে আসল পেটানো শরীর।রিদির আপাতত সেদিকে খেয়াল নেই।সে ব্যস্ত শরীরের দাগ গুলো দেখতে।পিঠের দিকে যেতেই নজরে আসে কালচে হয়ে যাওয়া দাগের দিকে।যেন জোরে কিছুর আঘাত করলে যেমন হয়।
রিদি অন্য সময় হলে লজ্জায় লাল নীল হয়ে যেত। কিন্তু এখন আপাতত চিন্তা অন্যকিছু।কালচে দাগের উপর কাঁপা কাঁপা আঙ্গুল ছোঁয়াতেই চোখ বন্ধ করে নিল তীব্র।রিদি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কালচে দাগের দিকে।কেউ তীব্র কে আঘাত করবে তা সম্ভব না।তীব্র মারামারি করলেও এমন ভাবেই জবাব দেয় যাতে শরীরে এমন ক্ষত তো হবে না। তাছাড়া কথায় কথায় সুট করে দেওয়া লোক নিজেকে এভাবে মার খাওয়াবে!!রিদির ভাবনা বাদ দিয়ে ট্যাপ ছেড়ে বালতিতে পানি ভরে মগে করে তীব্রর গায়ে ঢালতে লাগল। কিন্তু এতো লম্বা হওয়ার কারনে হাত পৌঁছাচ্ছে না গলার দিকে।ঝনায় পানি পড়লেও বলিষ্ঠ দেহী পুরুষের শরীরে পৌঁছাচ্ছে না।এটা তো সাধারণ বাড়ি।এটা তো চৌধুরী বাড়ি না যে সব তীব্রর হিসেবে চলে।রিদি টুল এগিয়ে বলল,
বসুন!!
তীব্র ভদ্র বাচ্চাদের মতো বসে পড়লে রিদি পানির মগে করে পানি ঢালতে থাকলো।তবে ঐ দাগ!রিদি আমতা আমতা করে বলল,
পিঠে কি হয়েছে??
তীব্রর ফটাফট জবাব,
জানি না!!
রিদি রেগে বলে,
বললে আমি আপনাকে মেরে ফেলব না!!
তীব্র বাঁকা হেসে মনে মনে বলল,
আপনার কষ্টের ভাগ জান!! তবে মুখে কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বলল,
হয়তো কোন মেয়ের আচরের দাগ!!!
রিদির রাগ হলেও কিছু বলল না।তবে মনেমনে বলল,
আমার চোখ আছে!! অসভ্য লোক!!
তীব্র রিদির বিরবির করাই মুচকি হাসল।তীব্রর শরীরে পানি দিতে গিয়ে নিজেও ভিজে গেছে।ভেজা জামা শরীরে লেপ্টে শরীর বোঝা যাচ্ছে।সেদিকে কোন ধ্যান নেই রিদির সে চিন্তিত মুখে পানি নিয়ে পুরো শরীর ধুয়ে দিচ্ছে। তীব্র রিদির চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ইচ্ছে করলে রিদির ঠোঁটের উপর হামলা করে ঝাল মিটিয়ে নিতে পারত।কয়েকবার করতে চেয়েও করেনি।এতো ঝাল ঐ নরম ঠোঁটে সহ্য হবে না।আজ আর রিদির প্রতি তীব্রর উত্তেজনা কাজ করছে না।এই যে ভেজা শরীরে তার সামনে কিন্তু তীব্রর চোখ গিয়ে আটকাচ্ছে না।সে তো আটকে আছে সীগ্ধময়ীর স্নিগ্ধতায়!মায়াবী মুখটা তার জন্য চিন্তিত! আহা কি সুখ!! এইটুকু! সুখের কিছু না হলেও তীব্রর কাছে সুখের ভান্ডার!!
কিছুক্ষণ পর লালচে দাগ কমে আসতেই রিদি বলল,
চেন্জ করে আসুন!!আমি বাইরে যাচ্ছি!! বলে কয়েক কদম যেতেই তীব্র বলে,
আপনার সামনে চেঞ্জ করতে আমার সমস্যা নাই জান! আপনিই তো!!
রিদি কটমট করে বলল,
অসভ্য!!বলে বের হতেই তীব্র চেঁচিয়ে বলল,
শুধু আপনার অসভ্য পুরুষ আমি জান!!
রিদি থামল না।তবে রাগী মুখটা মূহূর্তে বদলে চোখ ছলছল করে উঠলো।বিরবির করে বলল,
কেন পোড়াচ্ছেন তীব্র!!
রিদি আর দাড়ায় না অন্য রুমে চলে আসে।নিজেকে সামলে চেন্জ করে নেই।রিদির জামাও কিছুটা ভিজে গেছে!!
তীব্র সাওয়ার নিয়ে বের হতেই নীর দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
কিডন্যাপার ভাইয়া আসব??
তীব্র নীর কে দেখে বলে,
কাম!!!
নীর হাতের গ্লাস আর প্লেট টেবিলে রেখে বলল,
আপু আপনার জন্য এই ওষুধ আর নাস্তা পাঠিয়েছে!!
রাখো!!
নীর যেতে গিয়েও আবার বলে,
আব ভাইয়া আপনি ঝাল খেতে পারেন না তাই না??
তীব্র মুচকি হাসল!!
না!!
তাহলে,
আপু হয়তো রাগ করেই বলেছে আপনি ঝাল খান।
জানি আমি?!!
নীর অবাক হয়ে বলল,
তবুও খেলেন?!!
“না খেলে বৌয়ের সেবা আর পেতাম কিভাবে??
নীর তীব্রর কথায় অবাক হলেও মুচকি হাসলো!মনে মনে দোয়া করল সব যেন ঠিক হয়ে যায় তাদের মাঝে।
রোজ কে ঘুম পাড়িয়ে নিজের ঘরে আসে রিদি।আজ হসপিটালে যাওয়া হয়নি।তীব্রর শরীরে এখন লাল দাগ কিছুটা কমে এসেছে। ওষুধের কারনে হয়তো ঘুমাচ্ছে।তা দেখতেই নিজের রুমে আসে রিদি।কারন তীব্র তার রুমেই ঘুমিয়ে আছে।
এদিকে কারেন্ট চলে গেছে প্রায় ৫ মিনিট হয়েছে। রিদি রুমে এসে তীব্রর ঘামাত অবস্থা দেখে চমকে উঠে।ভিজে গেছে পুরো শার্ট। শুধু মাত্র ৫ মিনিট কারেন্ট নেই তাতেই।রিদি বেডের অন্য পাশে রোজ কে শুইয়ে দিয়ে চার্জার ফ্যান এনে তীব্রর দিকে দিল।ওরনা দিয়ে ঘাম মুছে হাতপাখা এনে বাতাস করতে লাগল!ফ্যান চললেও তা তীব্রর শরীরে তেমন কাজে আসছে না।তাই হাতপাখা নিয়ে তীব্রর পাশে বসল।রোজ আর তীব্র কে বাতাস করতে করতে কখন নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে।
আপনাতেই আমি পর্ব ৬৪
তখন বাজে ১১ টা ২০।নীর বাসায় এসেই ফ্রেশ হতে যায়।পুরো বাড়ি শান্ত দেখে রিদির রুমে ঢুকেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল নীরের।কলেজে আজ ক্লাস ছিল না তাই আগেই চলে এসেছে।এসে যে এতো সুন্দর একটি দৃশ্য দেখবে তা ভাবে নি।রিদির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে তীব্র।রিদি খাটে হেলান দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে।আর তীব্রর বুকের উপর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে পুচকি রোজ।তিনজন যেন একে অপরের সংস্পর্শে নিশ্চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে।নীর রুমের পদা গুলে একটু টেনে দিল যাতে বাইরের রোদ না আসে!!ফ্যানের পাওয়ার একটু বাড়িয়ে চুপচাপ বের হয়ে গেল।রিদিকে এতো শান্তিমত ঘুমাতে দেখে নি নীর।হোক সময়টা প্রায় দুপুর তাতে কি!!!এমন শাস্তির মানুষগুলো থাকলে গাছতলাতেও ঘুম আসে।নীর সব ভেবে রান্নাঘরে চলে গেল।আজ সে রান্না করবে!!