আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪১

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪১
ইশিকা ইসলাম ইশা

চারদিকে তখন আলো ফুটতে শুরু করেছে।তীব্রর গাড়ি এসে দাড়ালো এয়ারপোর্টের সামনে। তীব্রর গাড়ি এসে থামতেই পরপর এয়ারপোর্টে ঢুকল আরো দুটি গাড়ি।লাবিব,তীর দুইজনে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিল তীব্রর পিছু পিছু।দুইজনেই তীব্র কে কিছু বলার সাহস করছে না।তীব্রর হাতের রক্তের ফোটা এখনো টপটপিয়ে পড়ছে ফ্লোর এ।সেদিকে তার বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই।
মির্জা বাড়ির প্রাঙ্গণে রাতেই ছিল ঝকঝকে চকচকে আলো।রাত কেই তীব্র চৌধুরী দিনের মতো আলোকিত করলেও সকালের আলো ফুটতেই মিজা বাড়ি ধ্বংস স্তুপ এ পরিনত হয়েছে।কালো মেঘে ঢেকে আছে আজ মির্জা বাড়ির চারদিক।

নাজমা চৌধুরীর কোলে গুটিশুটি মেরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে রিদিতা।পড়নে রাতের সেই লেহেঙ্গা। অতিরিক্ত কাঁদার ফলে চোখের কাজল লেপ্টে আছে, কাঁদার ফলে চোখে লালচেভাব ফুটে উঠেছে,মুখের অবস্থা করুণ।রিদি চোখ বন্ধ করে তখনকার ঘটনা মনে পড়ল,
তীরের যাওয়ার পর রিদি আশেপাশে তীব্র কে না দেখে চকলেট খাওয়াই মনোযোগী হলো। খাবারের পর মিষ্টি খেতে ভালোই লাগছে রিদির। তাছাড়া চকলেট টাও দারুন খেতে! বাংলাদেশের না দেখেই বোঝা যাচ্ছে।রিদি চেটে পুটে চকলেট খাওয়ার মাঝেই সামনে এসে দাঁড়ালেন আমেনা বেগম।রাগী আর ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
শয়তান মেয়ে একটা তুই!নিজের মাকে খেয়ে এখন বাপকেও খেতে চাইছিস তাই না!!
আমেনা বেগমের এমন কটু কথাই রিদি তোয়াক্কা করল না।সে এসব শুনতে শুনতে অভ্যস্ত। কিছু না করলেও আমেনা বেগম বাবা ,মা কে খেয়ে ফেলার উদাহরণ দেয় এতে নতুন কিছু না।তাই বিশেষ নজর না দিয়ে চকলেট খাওয়াই মনোযোগী হলো। কিন্তু আমেনা বেগম থেমে নেই।সে রেগে রিদির হাতের বড়ো চকলেট টা কেড়ে ফেলে দিয়ে বলল,
বেয়াদব মেয়ে!তোর মতো মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। বেঁচে আছিস কেন তুই মরে যা।
রিদি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সমস্যা কি আপনার আম্মা?
আমেনা বেগম খেপে বললেন,
এই এই খবরদার আমাকে আম্মা ডাকবি না।আজ তোর জন্য আমার স্বামী জীবন হারাতে বসেছে।শোন রিদি তোর বাপের যদি কিছু হয় আমি তোকে বলছি তুই কিন্তু সুখে থাকবি না!
রিদি এবার বিরক্ত প্রকাশ করে বলল,
কি বলেছেন?বুঝিয়ে বলুন।
আমেনা বেগম এবার চট করেই কেঁদে উঠলো ফ্যাচফ্যাচ করে,
তোর বাপরে ছাইরা দিবার ক রিদিতা!!
রিদি হতভম্ব হয়ে গেল আমেনা বেগমের কান্না দেখে।আমেনা কাঁদতে কাঁদতে আবারো বলল,
তোর বাপরে ম্যাইরা ফেলবে রিদিতা। তীব্র চৌধুরী তোর বাপরে পুলিশে ধরাইয়া দিছে।ওহানে ওরে অনেক মারতাছে রে রিদিতা।

রিদি আমেনা বেগমের কথা বিশ্বাস করল না।আমেনা বেগম যে নাটক করতে এক্সপার্ট তাই বিরক্ত হয়ে বলল,
আব্বারে মারতাছে কেন?কি করছে?
তীব্র চৌধুরীর সাথে তোর বাপ তোর বিয়া দিত না তাই তীব্র চৌধুরী বড় মন্ত্রী দিয়া হেরে জেলে ঢুকাইয়া দিছে।
রিদি এবার যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলল,
ওনার আমাকে বিয়ে করতে আমার নাম মাত্র বাপের প্রয়োজন নেই। সেটা জেনেও কেন তিনি এ কাজ করবেন?
আমেনা বেগম অবাক হয়ে বলল,
তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না!!
রিদি সোজাসাপ্টা জবাব,

না।ওনার এতো ভালবাসার পরেও যদি আমি আপনাকে বিশ্বাস করি তবে দোষটা তো আমারই তাই না।
রিদির কথায় আমেনা বেগম ফোন বের করে একটা ভিডিও প্লে করে মুখের সামনে ধরতেই রিদি থ হয়ে গেল,
রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে রুপেস মির্জা।পুরো পিঠ আর শরীর জুড়ে মারের দাগ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।মুখ থেকে আওয়াজ বের হচ্ছে না শুধু গোঙানির শব্দ।
এসব রিদির মাথা ঘুরে উঠল।থপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।চোখ বেড়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল।তীব্রর নিকৃষ্টতম উদাহরণ সে দেখেছে কিন্তু নিজের বাবার সাথে এমন আচরণ রিদি মেনে নিতে পারছে না। হাজার হলেও জন্মদাতা পিতা তার। সামান্য কারনে তীব্র এতো নিকৃষ্ট ব্যবহার করবে এটা হয়তো আশা করেনি রিদি।

এদিকে জরুরি একটা ভিডিও কল শেষ করে এসে রিদি কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তীব্র রিদির কাছে এসে ওর পাশ ঘেসে বসল।এদিকে সব গ্রামের মানুষেরা ছিল ওরা এখন নেই তাই লোকজন কম এদিকে।নাজমা চৌধুরী আর বাড়ির সবাই এটা ওটা কাজে ব্যস্ত আছে আপাতত!
বৌ……
ওই বৌ……. চলুন অনেক তো হয়েছে।এবার শ্বশুর বাড়ি ফিরে চলুন।তবে বলে দিই শ্বশুর বাড়ি কিন্তু আপনার একটা না।আমি দেশের……..
হাত ধরে টেনে উঠাতে চাইলে রিদি উঠল না। তীব্র রিদির এমন নির্লিপ্ততা দেখে ভু কুঁচকে তাকাল রিদির দিকে। ততক্ষণে নাজমা চৌধুরী আর রিদিকে বিদায় দিতে বাড়ির সবাই বেরিয়ে এসেছে ভেতর থেকে।
তীব্র রিদির দিকে এগিয়ে রিদির পায়ের কাছে বসে
আদুরে গলায় বলল,

কি হয়েছে জান? শরীর খারাপ করছে?
…………………
কি হয়েছে বলবেন তো??
………………
তীব্র এবার রেগে বলল,
কি সমস্যা তোর?আবার কি নাটক শুরু করেছিস।সেই সন্ধ্যা থেকে অনেক নাটক হয়েছে!এবার চল!ফিরতে হবে। আমার জরুরি…….
রিদি এতক্ষণ পর মুখ খুলল,
আপনি নির্দয় ,পাষাণ ………বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো।
তীব্রর তোয়াক্কা বিহীন সহজ সিকারক্তি
হ্যাঁ !!আমি নির্দয়, পাষাণ।তুই ছাড়া আর কারো জন্য আমার সামান্যতম কোন অনুভুতি কাজ করে না।তো!!! এসব বলে এখন কি মোলোড্রামা করবি!!
রিদি তীব্রর কথায় কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
আব্বুকে ছেড়ে দিন তীব্র……

সবাই তখন আশ্চর্য হয়ে রিদির কান্না দেখছে।আর কি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছে!
তীব্র রিদির দিকে চেয়ে খানিক সময় চুপ থেকে বলল,
“ইউ মিন তোর বায়োলজিক্যাল ফাদার !রাইট…..
রিদি আশ্চর্য হয়ে তাকালো তীব্রর দিকে। তীব্র খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,
দেখ বৌ!এখন বাপ, শ্বশুর চেনার সময় আমার নাই! আমার তোকে লাগবে!তুই হলেই আমার চলবে।আর তোকে যে আমার থেকে দূরে করার চেষ্টা করবে তাকে আমি দুনিয়াতেই রাখব না।সে হোক তোর বাপ!! আই ডোন্ট কেয়ার!
রিদি তীব্রর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
বাবাকে ছেড়ে দিন তীব্র!আমি আপনার সাথে যাব বাবাকে ছেড়ে দিলে আমি আপনার সাথে যাব!
তীব্র ভু কুঁচকে বলল,
যদি না ছাড়ি তবে যাবি না……..

রিদি তীব্রর কথায় হঠাৎ থম মেরে গেল।তার ছোট মাথায় এতোকিছু ঢুকছে না।আপাতত সামনে রুপেসের রক্তাক্ত অবস্থাই চোখের সামনে ভাসছে।এদিকে তীব্রর ঢেকে রাখা রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে রিদির নিশ্চুপতা দেখে।রাগে চোয়াল শক্ত করে হাত মুঠি করল।রাগে দাঁতে দাঁত চেপে রিদির হাত ধরে টেনে বলল,
আমাকে বিশ্বাস কর বৌ!আমার রাগ খুব খারাপ!আমি তোর উপর টচার করতে চাই না।তোকে আঘাত করলে শতগুণ আঘাত আমার কাছেই ফিরে আসে।তাই আপাতত আমাকে ভালো রাখতে তোকে ভালো থাকা লাগবে ।আর এই মুহূর্তে আমার তোকেই লাগবে।তাই কান্নাকাটি না করে চল আমার সাথে……
তীব্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই রিদি বলল,
আমি আব্বু কে এই অবস্থায় ফেলে যেতে পারি না তীব্র…

রিদির পুরো কথা শেষ না হতেই তীব্রর তান্ডব শুরু হয়।গায়ের কোট টা খুলে ছুড়ে মারে কোথাও।হাতের কাছে থাকা সরু একটা রড দিয়ে সজোরে আঘাত করে টেবিলে।টেবিলে থাকা কাঁচের প্লেট বারি খায় হাতে যার ফলে গলগলিয়ে রক্ত বের হতে থাকে হাত থেকে। তীব্র হাতের কাছে থাকা সবকিছু চুরমার করতেই আছে। তীব্রর এমন ভয়ঙ্কর রুপ দেখে সবাই স্তম্ভিত।তবে নাজমা চৌধুরী,তীর,মির এরা শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কারন তারা বহুবার এমন দৃশ্যপট দেখেছে।এদিকে রিদি এসব দেখে ভয়ে আরো কেঁদে উঠলো।নাজমা চৌধুরী রিদিকে জরিয়ে ধরে একপাশে এনে দাঁড়িয়েছে।রিদিকে কিছু জিজ্ঞেস করার অবস্থায় ও নেই।তীব্রর তান্ডব এর জন্য।এরপর আজানের ধ্বনি কানে আসতেই তীব্র থেমে যাই।পুরো ১৫ টা মিনিট ধরে চলেছে তান্ডব।
বর্তমান,

নাজমা চৌধুরী বসে আছে রিদির পাশে।তিনি রিদির মাথায় হাত বুলিয়ে হতাশ হয়ে তাকালো লতিফা বেগমের দিকে। লতিফা বেগম নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।তাদের এখন কি করা উচিত?এটা আপাতত তাদের জানা নেই।এই পরিস্থিতিতে তারা দিশেহারা হয়ে আছে।তীব্রর জেদ আর রাগের আগে কোন কিছুই করার থাকে না।এই তো কিছুক্ষণ আগেই তীর কল করে বলল তীব্র এখান থেকে সোজা এয়ার পোর্ট গিয়ে তার প্রাইভেট বিমানে করে পৌছে গেছে তার বাসভবন কানাডার টরেন্টো শহরে।
টরন্টো কানাডার সবচেয়ে জনবহুল শহর।তাই শহর থেকে কিছুটা দূরে গ্রামের মতো পরিবেশে তীব্রর বিশাল বাসভবন।আর এই বিশাল বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তীর।অসহায়ের মতো একবার বিশাল বাড়িটা দেখে আফসোসের সুরে বলল,

আল্লাহ!দুনিয়াতে কি বন্ধুর অভাব পড়েছিল?বেছে বেছে এই গুনধর বন্ধুই আমার কপালে ফেলেছেন? দেখছেন সালা আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিল না।এখন আমি এই মধ্যে দুপুরে না খেয়ে কোথায় কোথায় ঘুরব?
সেই বিয়ের খাওয়ার পর আর কিছুই আমার পেটে পড়েনি এখনো!

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪০

তীরের এতো আহাজারি শুনে লাবিব একবার দোতলা থেকে নিচে তাকাল তীরের দিকে।তো একবার তীব্রর বন্ধ ঘরের দিকে তাকালো।আপাতত বসের মনোভাব বুঝা সম্ভব হচ্ছে না।তাই আপাতত কিছু না বুঝে নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরে ঢুকে গেল।তীরের চিন্তা তার হচ্ছে না।কারন তীর ফ্লার্টিং মাস্টার নিশ্চিত আশেপাশে থেকে নিজের জন্য কোন না কোন জোগার করেই ছাড়বে।হলোও তাই!!লাবিব ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে তীর লনে বসে একজন কানাডিয়ান মেয়ের সাথে ফ্ল্যাট করছে।এই দৃশ্য দেখে লাবিব নিজেকেই বাহাবা দিল।তার ভাবনা কখনো ভুল হয় না।

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪২