আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৭৩
ইশিকা ইসলাম ইশা
খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল ছেলেটাকে?হাত আর মাথায় ব্যান্ডেজও করা দেখলাম।বার বার বললাম ভেতরে আসতে।এলো না!!
লতিফা বেগম ছেলের বৌয়ের কথায় চিন্তিত মুখে বলল,
সে কি??কি হয়েছে??তুমি জিগাও নি??
জিঙ্গসা করেছি আম্মা। কিন্ত কিছু বলেনি। শুধু হাতে রিদির ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছে আর ঠিক মতো খাওয়াতে বলেছে!
আল্লাহ আমার নাতি নাতনির কিসের পরিক্ষা নিচ্ছে। আল্লাহ এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো মওলা।গত ১ মাস ছেলেটা গাড়িতেই ঘুমাচ্ছে।রিদির সব কিছুর যত্ন করছে।অথচ নিজের খেয়াল রাখছে না।
আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছে আম্মা!ছেলেটার চোখমুখ একদম শুকনা ছিল।ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে কি না আল্লায় মালুম।তার উপর আঘাত ও পেয়েছে।
আমরা বললে ও কখনো আসবে না।এদিকে রিদি ও জেদ ধরে বসে আছে। তীব্র কে আশেপাশে সহ্য করতে পারছে না।কি করব??হোন বৌ!আমি গিয়া একটু দেইখা আসি তীব্ররে।রিদি মনে হয় ঘুমাচ্ছে।ও জানতে পারবো না।
ঠিক আছে আম্মা!!
লতিফা বেগম সোফা ছেড়ে উঠে যেতেই রিদি আড়ালে থেকে সরে এলো।নিজের রুমে এসে জানালা খুলে একটু ফাঁক দিয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকালো।সেখানে দাঁড়িয়ে আছে চকচকে কালো মার্সিডিজ গাড়ি।রিদি চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক দেখল।না তীব্র নাই। ইতিমধ্যে নাজমা চৌধুরীকে দেখা গেল গাড়ির কাছে।কাচ নামিয়ে কিছুক্ষণ কি কথা বলল বোঝা গেল না তবে তিনি মলিন মুখে আবারো বাড়ির দিকে আসতে দেখে।রিদি চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল।সে জানে তীব্রর রাগ, জেদ কতোটা।সে যে কোনমতেই আসবে না।রিদি ভরা পেট নিয়েই আবারো দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো।লতিফা বেগম তখন সবেই বাড়িতে ঢুকুছে। লতিফা বেগমকে দেখে রিদির চাচি বললো,
কি হলো আম্মা!!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্বরে পুড়ছে তবুও এলো না।তীর ওষুধ পানি নিয়ে বসে আছে তবুও খাওয়াতে পারেনি।
আম্মা একবার রিদিরে বলবেন??
ও শুনবেই না।এই মেয়ে ও স্বামীর লাহান জেদি হয়ছে।
রাত প্রায় ৮ টার কাছাকাছি।এখনো তীব্রর গাড়ি রাস্তায় দাঁড় করানো।রিদি আর থামতে না পেরে ফোনটা নিয়ে কল করল তীব্র কে। কিন্তু তীব্রর ফোন বন্ধ।রিদি এবার ঝটপট তীরের নাম্বারে কল করল।ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই রিদি বলল,
ভাইয়া! ওনার জ্বর নেমেছে!
না!আমি রাইমা কে কল করে…….
ভাইয়া প্লিজ কষ্ট করে ওনাকে বাসায় নিয়ে আসুন!
ঠিক আছে!
কিছুক্ষণ পর তীব্রকে তীর নিয়ে আসে।জ্বরে কাহিল হয়ে মাতালের মতোই হাঁটছে।তীর রুমে এনে বেডে শুইয়ে দিতেই তীব্র বলল,
তোকে বললাম না আমি গাড়িতেই থাকব!! এখানে…..
চুপচাপ থাকেন। শরীরের অবস্থা ভালো না অথচ চৌধুরী পনা যাচ্ছে না।আমরা জানি আপনি তীব্র চৌধুরী। তীব্র চৌধুরীর তো অসুখ বিসুখ হয় না।মোস্ট স্ট্রং পারসন ইন দা ওয়ার্ল্ড!!
রিদির ত্যাছড়া কথায় তীব্র অবাক হয়ে তাকালো রিদির দিকে। কিন্তু রিদি এসব তাকানো ইগনোর করে তীরের উদ্দেশ্য বলল,
ভাইয়া ওনার মেডিসিন পাঠিয়ে দিন।আর চাচিকে একটু সুপ করে দিতে বলবেন!
তীর খুশি হয়ে বলল,
ঠিক আছে।খুব চিন্তায় ছিলাম সারাদিন কিছু খাইনি।
তীর বের হতেই রিদি কোমরে হাত দিয়ে তীব্রর দিকে এগিয়ে এলো।গায়ে হাত দিতেই চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিল।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।
মাথা ফাটালেন কি করে?কাকে মারতে গিয়ে মার খেয়ে এসেছেন??
তীব্র উওর করল না। থেমে একটু পর বলল,
একটু জড়িয়ে ধরতে দিবেন!!
রিদি কিছু বলার আগেই রুমে ঢুকে তীর।হাতে ওষুধ আর সুপের বাটি।সেটা রিদির দিকে এগিয়ে দিতেই রিদি বলল,
ভাইয়া একটু খাইয়ে দিন।আ………..
আমি খাব না।
রিদির কথা শেষ না হতেই তীব্রর উওর শুনে রিদি ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
হ্যাঁ তা খাবেন কেন?আপনারা সবাই তো পারেন শুধু আমাকে কষ্ট দিতে।পেটের গুলো জ্বালিয়ে মারছে সাথে তাদের গুরু ও যুক্ত হয়েছে।
তীব্র মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়তেই রিদি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো,
এই উঠুন!!খেয়ে নিন! খবরদার এখন নাটক করবেন না।
রিদি চেয়ার টেনে তীব্রর কাছে বসল।চামচে করে সুপ তীব্রর মুখের সামনে ধরতেই তীব্র উঠে খেয়ে নিল।রিদি পুরোটা খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিল। তীব্র ও বাধ্য বাচ্চার মতো খেয়ে নিল।তীর সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করেও কিছু খাওয়াতে পারেনি আর রিদির কাছে বাধ্য বাচ্চার মতো খেল।তীর মুচকি হেসে বলল,
রাত অনেক হয়েছে এখন ঘুমিয়ে পড়ো তোমরা। আমি আসছি। দরকার হলে কল করো।
রিদি ও খাবার খেয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে শুয়ে পড়ল।আজ রুমের মধ্যে পরিচিত ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। সবচেয়ে পছন্দের সুগন্ধি যাকে বলা যায়।রিদি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে তীব্রর দিকে তাকালো। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে রিদিও চোখ বন্ধ করলো। ভারী শরীরটা নাড়াতেও ভীষণ কষ্ট হয়।ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে।রিদি ঘুমে বুঝতে পেরে তীব্র চট করে উঠে বসল।একহাতের দূরত্ব ঘুচিয়ে গা ঘেঁষে রিদির গলায় মুখ গুঁজে দিল। উষ্ণ ছোঁয়ায় রিদি কেঁপে উঠলেও অভ্যাস থাকার কারনে ঘুমের মাঝেই তীব্রর পিঠে এক হাত বুলিয়ে অন্যহাত মাথায় বুলিয়ে দিতেই তীব্র মৃদু হাসল।গলার ভাঁজে অনেকক্ষণ মুখ গুঁজে থেকে এবার ফোলা ফোলা পেটের দিকে নেমে এলো।মেক্সির কাপড় তুলে সেখানে উষ্ণ হাত বুলাতেই তীব্রর হাসি চওড়া হলো।মুখটা পেটের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,
পাপা লাভস ইউ বেবিস!!পাপা অলসো মিস এ লট!!আর কয়েকটা দিন এরপর আপনারা মাম্মার পেট থেকে পাপার কোলে চলে আসবেন। ততোদিন পর্যন্ত মাম্মা কে কষ্ট দিবেন না পাপাই।আপনারা পৃথিবীতে আসলে পাপাই আপনাদের এতো এতো চকলেট কিনে দিবে ততদিন মাম্মার পেটে দুষ্টুমি কম করবেন।ইজ দিস ডিল ডান পাপাই!!!সাথে সাথে পেটে কিক করতেই তীব্র হাসল। টপাটপ পেটে কয়েকটা চুমু দিয়ে বলল,
আস্তে আস্তে!মাম্মা জেগে যাবে! আপনার মাম্মা আপনার পাপাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।আপনার মাম্মা কেন বুঝে না আমি যা করেছি আপনাদের বাঁচাতে করেছি। আপনার মাম্মামের ক্ষতি করলে আপনার পাপা পাগল হয়ে যায়। কিন্তু আপনার মাম্মা বুঝেই না।এমন হাজারো কথার ঝুলি নিয়ে আলোচনা জমেছে অনাগত সন্তানদের সাথে। বেশ কিছুক্ষণ নিজের সন্তানদের আদর করে রিদির ফোলা পেটটা ঢেকে আবারো রিদির গলায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল।আজ কতোদিন পর একটা শান্তিপূর্ণ ঘুম হবে।যদিও তীব্র এই ঘুম নিয়ে কম্প্রোমাইজ করত না।জোর করে হলেও রিদিকে চেপেই ঘুমাতো কিন্তু বাচ্চাদের কথা আর রিদির কথা ভেবে রিদিকে তার মতো থাকতে দিয়েছে।নয়তো তীব্র চৌধুরীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় এমন কিছু সে বরদাস্ত করে না।
দেখতে দেখতে দুদিন পার হয়েছে।এই দুদিন তীব্র রিদির রুমেই ঘুমিয়েছে।রাত পেরিয়ে তখন ভোর। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৫ টা বাজে।ফোলা ফোলা পায়ে আরাম অনুভব হতেই রিদি চোখ মেলে তাকাল। তীব্র কে পায়ের কাছে বসে মালিশ করতে দেখে রিদি ঘুম জড়ানো কন্ঠে মৃদু হেসে বলল,
একটু আপনার বুকে নিবেন??
তীব্র অবাক হলেও বুকে নিতে দেরি হয়নি ।ছো মেরে রিদিকে বুকে জড়িয়ে নিয়েই পুরো মুখে অজস্র চুমু বসিয়ে দিল।রিদি মিষ্টি হেসে তীব্রর বুকে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল। তীব্র রিদিকে বুকে পেয়ে যেন সব পেয়ে গেল। শান্তি কি জিনিস তীব্র সেটা কখনো না বুঝলেও এই একটা মায়াবী কন্যা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে শান্তি কি!হাজারো রাগ গলে যায় এই মায়াবী মুখখানা দেখলে, ভয়ানক হিংস্রতাও ফুরিয়ে যায় শুধু একটুখানি ছুঁয়ে দিলে,সকল চিন্তা দূর হয়ে যায় এই দেহটাকে একটু জড়িয়ে ধরলে,পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ নিজেকে মনে হয় যখন মায়াবী এই কন্যা তার বুকে এভাবে লেপ্টে থাকে। তীব্র চৌধুরীকে ভালো রাখতে পারে পুরো পৃথিবীতে শুধু এই একজনই।
তীব্র আবারো পরপর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল পুরো মুখে।রিদি ঘুমের মধ্যে খানিকটা চোখ মুখ কুচকাতেই তীব্র মৃদু হাসল।
রাত তখন ৪:৫০ বাজে। অপারেশন রুমের দরজায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তীব্র।রিদির লিভার পেইন উঠায় তাৎক্ষণিক হসপিটালে নিয়ে এসেছে।এম্বুলেন্সে রিদির ব্যাথায় চিৎকার করে কাঁদতে দেখে তীব্র স্তব্ধ হয়ে রিদিকে বুকে জড়িয়ে বসে ছিল।বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল।আজানা ভয়ে শরীর আসার হয়ে আসছিল।বেবি হওয়ার সময় এতো কষ্ট হয় এটা জানলে সে কখনো বেবি নিতে দিত না।রিদি জড়িত সামান্য ব্যাপারেও তীব্র ভীষণ ভীতু ,অধিক সেনসিটিভ।তাইতো রিদিকে ওমন ব্যাথায় ছটফট করতে দেখেও সে কিছুই করতে পারল না এটা তাকে কষ্ট দিচ্ছে।এতো বড় মাফিয়া,এতো বড় একজন হাট স্পেশালিস্ট,টপ বিজনেসম্যান,এতো এতো ক্ষমতাশালী ব্যাক্তি হয়েও সে নিরবে রিদিকে কষ্ট পেতে দেখল।সে কেন পারল না সব কষ্ট,ব্যাথা দূর করতে।
তীব্র……..
তীরের ডাকে তীব্র মাথা তুলে তাকালো।চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে দেখে তীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তীব্রর ঐ টলটলে লাল চোখজোড়া দেখল। তীব্র কে এমন টলটলে চোখে দেখেছিল বাবা মায়ের মৃত্যুর দিন।এরপর আর তীব্রকে কাঁদতে কখনো দেখেনি তীর।তীর মলিন হেসে তীব্রর কাধে হাত রেখে বলল,
কিছু হবে না ভাই!রিদি আর বাচ্চারা সহি সালামত তোর বুকে ফিরে আসবে।
ইনশাআল্লাহ……..
কারো কথায় তীব্র মুখ তুলে তীরের পাশে তাকাল। পরিচিত ব্যাক্তিটিকে দেখে মলিন হেসে বলল,
আমি কিছুই করতে পারছি না।ওর খুব কষ্ট হচ্ছে!
ব্যাক্তিটি তীব্রর মাথায় হাত রেখে বলল,
একজন মা যখন সন্তানের মুখ দেখবে তখন কষ্টকে আর কষ্ট মনে করবে না তীবু!তবে রিদি বেরিয়ে আপনাকে এই অবস্থায় দেখলে বেশি কষ্ট পাবে ! বুঝলেন চৌধুরী সাহেব।
ও শুধু ঠিকঠাক বেরিয়ে আসুক আমি আর কিছুই চাই না।
ঠিক তখনি দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রাইমা।হাতে সদ্য জন্মানো একটা সাদা ফুটফুটে বাচ্চা।রাইমা কে দেখেই তীব্র আগের ফমে চেঁচিয়ে উঠে,
১ ঘন্টা ধরে কি বাল করছিলি আমার বৌ কোই বের কর!
তীব্রর চেঁচিয়ে উঠার শব্দে সদ্য জন্মানো বাচ্চা চমকে উঠে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না শুরু করলো। তীব্র কান্নার শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।তোয়ালে মোড়ানো বাচ্চার দিকে তাকাতেই রাইমা বলল,
রিদি একদম ঠিক আছে ভাই।তবে???
রাইমার তবে কথাটা শুনেই তীব্রর ভু কুঁচকে গেল,
তবে কি???
তোর দুইজন জমজ ছেলে সন্তানের মধ্যে একজন একদম সুস্থ হলেও অন্যজন কিছুটা দূর্বল।রিদির কাছে দেওয়ার মতো অবস্থায় ও নেই।তোকেই এখন ওকে নিতে হবে।
নিতে হবে মানে!!!
মানে ওকে অভজবেশনে রাখা হবে।আইসিইউতে!!ওর এখন মা অথবা বাবার উষ্ণ স্পর্শ দরকার।কথাটা শেষ করতেই নাস অন্য একটা বাচ্চা নিয়ে রুম থেকে বের হল।এই বাচ্চাটা একদম শান্ত আর নিথর হয়ে আছে। তীব্র দুইটা সদ্য জন্মানো বাচ্চাগুলোর দিকে গোলগোল চেখে তাকালো।একদম ছোটো এইটুকু মাথা আর একটু খানি মুখ। তীব্র হাত বাড়িয়ে দুইজনকেই কোলে তুলে নিল। দুইজনের কপালে চুমু দিয়ে তাঁদের কানে আজান দিল।
বাবার উন্মুক্ত বুকের সাথে লেপ্টে থাকা প্রানটার দিকে অনিমেষে তাকিয়ে আছে তীব্র। ঘন্টাখানেক ধরে ছেলেকে বুকে নিতে বসে সে।ছেলেটা তার একদম নিরব আর শান্ত হয়ে ধীরে নিশ্বাস ফেলছে।সদ্য জন্মানো বাচ্চার নাকে ক্যানোলা পড়ানো দেখে তীব্র মলিন মুখে বলল,
চিন্তা করবেন না পাপাই।আপনি না পাপার স্ট্রং বয় ।একদম ঠিক হয়ে যাবেন ভাইয়ার মতো।পাপা আছি তো কিছু হতে দেব না আপনাদের। প্রমেস!!!
বাবার কথায় বাচ্চাটা খানিকটা নড়ে চড়ে উঠে উঠে। তীব্র আদুরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
কষ্ট হচ্ছে পাপাই!!
ছেলের রিএকশন বোঝার আগেই রুমে ঢুকে একজন ডক্টর।বাবুকে টোকা মেরে চেক করতেই তীব্র কটমট দৃষ্টিতে তাকালো ডক্টরের দিকে। ডক্টর মাইফুল ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
স্যার আমি শুধু চেক করছি!!
তীব্র কঠিন মুখে বলল,
ওর হার্টবিট স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। শুধু শ্বাস ধীরে নিচ্ছে।
জি স্যার।আসলে ও একটু দূবল।তাই!!মায়ের বুকের দুধ এখন ওর শক্তি হলেও রিদিতা সেই অবস্থায় নেই।তাই বাবার বুকের উষ্ণতা খুব দরকার ওর।
তীব্র ছেলের অসহায়ত্বে মলিন মুখে বলল,
ওর কোন সমস্যা নেই তো ডক্টর!
ডক্টর তীব্রর পিতৃ আবেগ দেখে মুচকি হেসে বলল,
না স্যার!
ঠিক তখনি অপর বেবিকে নিয়ে রুমে ঢুকে রাইমা।ছেলেটা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে।রাইমা চিন্তিত মুখে বলল,
রিদির এখনো ঙ্গান ফিরেনি।আর ও কেঁদেই চলছে। তীব্র ছেলের কান্না দেখে অন্য হাতে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাবার উষ্ণ স্পর্শে কান্না থামে বাচ্চাটার।দুইজনকে বুকের উপর নিয়ে তীব্র মৃদু হাসল।বাবার উষ্ণতা পেয়ে দুইজনেই চুপ করে আছে এখন তা দেখে রাইমা বলল,
অদ্ভুত এই মায়ার টান।কি সুন্দর দুইজনে চুপটি করে বাবার বুকে লেপ্টে আছে।
রিদির ঙ্গান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে।তার জমজ ছেলে হয়েছে শুনে রিদি অধির আগ্রহে দরজায় তাকিয়ে আছে।কখন তার ছেলেরা আসবে। হঠাৎ দরজা খুলে কাউকে প্রবেশ করতে দেখে রিদি বিষ্ময়কর দৃষ্টি মেলে তাকাল,
দাদি!!
নাজমা চৌধুরী এগিয়ে এসে বসলেন রিদির পাশে।রিদি নাজমা চৌধুরীকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সত্যি না কল্পনা সেটা ভাবতেই নাজমা চৌধুরী জড়িয়ে ধরল রিদিকে।রিদির মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।নাজমা চৌধুরী রিদির মাথায় হাত বুলিয়ে রিদির মুখখানা দেখে বলল,
সেদিন তীব্র যাকে মেরেছিল সে আমি না রিদু।তোর সাতের অনুষ্ঠানের দিন আমি রেডি হয়ে বের হতেই কেউ আমার মুখের সামনে কিছু ধরাই আমি বেহুঁশ হয়ে যাই। শত্রু পক্ষের সেই মেয়েটা আমার বেশভুষায় মুখে আমার আকৃতির সিলিকন মাস্ক লাগিয়ে তোকে মারার উদ্দেশ্য যায়।জানি না কিভাবে তীব্র বুঝে যায় ব্যাপারটা আর সে তোকে মারার আগেই তীব্র তাকে মেরে দেয়। তুই যেন এসব দেখে ঘাবরে না যাস তাই তোকে কোনোকিছুই জানতে দেওয়া হয় নি। সেদিন রাতে অনেক গোগাগোলি,আর মারামারি হয়।তোর সামনেই হয়।অথচ তীব্র তোকে এভাবে প্রটেক্ট করেছে যে তুই বুঝেতেই পারিস নি।
রিদির চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। কাঁপা গলায় বলল,
তুমি কোথায় ছিলে এতো দিন??
আমার গ্রামের বাড়িতে।পরের দিন খুব ভোরেই তীব্র আমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়।আমি শুনলাম তুই আমার জন্য তীব্রর থেকে দূরত্ব তৈরি করেছিস!আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস।যে কেউ তোর জায়গায় হলে এমনটাই করত।
রিদি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো,
এতো অনিশ্চিত জীবন যাপন কেন করছেন উনি।যদি এসবে ওনার কিছু হয়ে যায় দাদি!!আমরা কি নিয়ে বাঁচব। আমার ছেড়ে যাওয়া সামান্য কথায় যদি ওনি এমন করে তবে আমরা!দাদি আমরা কিভাবে বাঁচব ওনাকে ছাড়া।
আমার খুব ভয় করে দাদি। আমার তো কিছুই নেই ঐ একটা মানুষ ছাড়া।তীব্রর মাঝে আমি সব পেয়েছি দাদি আমি কোনমতেই তীব্র কে হারাতে পারব না।
নাজমা চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলল।রিদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
কাদিস না। আল্লাহর কাছে দোয়া কর সব ঠিক হয়ে যাবে।
একটা ছেলেকে বুকে নিয়ে সোফায় বসে আছে তীব্র।রুমের ভেতর পিনপতন নীরবতা।অপর জন মায়ের কাছে খাবার খেতে ব্যস্ত। খাবার পর পিঠে হালকা চাপড় দিতে হয় তীব্র আপাতত সেই কাজটাই করছে।তবে মুখখানা গম্ভীর।রিদির সাথে দরকার ব্যাতিত কথা বলেনি এই কয়দিন।রিদি ব্যাপার টা লক্ষ্য করলে নিজেও কিছু বলেনি।মান অভিমানের পাল্লা বাড়াতে দুইজনে নিশ্চুপ হয়ে আছে।রিদি মুখে না বললেও তীব্রর শক্ত অভিমান তাকে পুড়াচ্ছে।আজ রিদিকে হসপিটালে থেকে ছুটি দিয়েছে।এটা মূলত কথার কথা কারন তীব্র রিদির কন্ডিশন আর বাচ্চাদের কন্ডিশন বিবেচনা করে তাদের নিয়ে বাড়ি ফিরছে।যতোই তীব্র চৌধুরী এই হসপিটালের মালিক হোক আর যতোই সেটা তার নিজস্ব কেবিন হোক তবুও হসপিটাল তো হসপিটাল।
তীব্র বেড থেকে ধীরে রিদিকে কোলে তুলে নিল।নাজমা চৌধুরী আর রাইফার কোলে তাঁদের দুই রাজপুত্র টুকুর টুকুর দেখছে। তীব্র লিফট থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে এসে রিদিকে গাড়িতে বসিয়ে দিল।নাজমা চৌধুরী কোল থেকে একজনকে নিয়ে রিদির কোলে দিয়ে অপর জনকে রাইফার কোলে থেকে নিয়ে গাড়িতে বসল।বাবা মায়ের কোলে থাকা দুই রাজপুত্র টুক টুক করে বাবা মা কে দেখছে।
চৌধুরী বাড়িতে উৎসব মুখর পরিবেশ। পুরো বাড়ি ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছে রুপ,তীর,মীর,মিহি,লাবিব সহ সকলে।রুপ দুই রাজপুত্র কে দেখেই খুশিতে আটখানা হয়ে কোলে তুলে নিয়েছে।সবার মাঝে খুশির ঝলক। এদিকে তীব্র রিদিকে কোলে তুলে সোজা রুমে নিয়ে এসেছে।ছেলেদের সাথে ব্যাতিত সবার সাথেই সেই গম্ভীর,গোমড়া মুখ করে আছে।কথা তো এমনিতেও বলে না এখন যেন দুনিয়াতে দুই পুত্র ছাড়া কেউ নেই ভাবখানা এমন।
তীব্র রিদিকে ফ্রেশ করিয়ে নিচে গিয়ে খাবার এনে খাইয়ে দিচ্ছে।রিদি বারবার কথা বলার চেষ্টা করলেও তীব্র ইগনোর করছে। তাই বলে রিদির যত্নে কমতি নেই।রিদির সব কাজ নিজ হাতেই করছে শুধু কথা বলা ব্যাতিত।
রিদি এখন মোটামুটি সুস্থ। হাঁটাচলায় সমস্যা নাই।আজ প্রায় ১ মাসের মতো পার হয়েছে।রিদি হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তীব্রর সাথে বলতে।কাজ ব্যাতিত তীব্র তাকে এড়িয়েই চলেছে।রিদির কান্নাকাটি করলেও কোন লাভ হচ্ছে না।
আজ রিদি দুই ছেলেকে নিয়ে সকালেই লতিফা বেগমের কাছে এসেছে।লতিফা বেগমের শরীর হঠাৎ খারাপ হওয়ার রিদি দুই পুত্র নিয়ে হাজির হয়েছে।সাথে অবশ্য নাজমা চৌধুরী এসেছে।সকাল থেকে তীব্র কে কল করলেও পাওয়া যাচ্ছিল না তাই বাধ্য হয়েই নাজমা চৌধুরীর সাথে এসেছে।
এই রিদু!!দুটাই দেখছি বাবার কপি!!
চাচির কথায় রিদি মুচকি হেসে বলল,
হ্যাঁ!!আমি ওদের মা এটা অনেকে মানতে চায় না।
কেন মানতে চাইবে না!
দুটাই বাপের মতো ধলা হয়েছে।ঐ চোখ ছাড়া কিছুই আমার সাথে মিলে না।স্বভাব ও বাপের পেয়েছে।একটু উনিশ বিশ হলেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে ফেলে।এক মাসের এইটুকু বাচ্চা দুটো আমাকে সারাদিন নাচিয়ে ছাড়ে।শুনেছি মানুষ ছেলেমেয়ে নিয়ে পড়াশোনা করে!আর আমি!!হাহ!! এদের দুইজনের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার সময় শেষ।
যাই বল ছেলেদুটো তোর মাশাআল্লাহ!!একদম রাজপুত্রের যতো।থু থু আমারি নজর না লাগুক।
রিদি বিরক্ত হয়ে বলল,
হ্যাঁ শুধু দেখতেই রাজপুত্র।নয়তো দুষ্টুর সর্দার ওরা। সারাক্ষণ মায়ের কোলে থেকেও এদের মন ভরে না।যেই অন্যকেউ একটু কোলে নিবে ওমনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠবে।যদি পরিচিত মানুষ হয় ১৫-২০ মিনিটের অধিক থাকে না।খুব জ্বালাতন করে।
কি দাদুভাই খুব জ্বালাতন করো আম্মুকে!!
রিদির চাচি দুইজনের সাথে টুকটাক কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল।
এই সময়ে আবার কে এলো??
আমি দেখছি চাচি!!
না।তুই বাবুদের নিয়ে ঘরে যা।কে না কে এসেছে!!আমি আগে দেখে আসি। তোর চাচা পইপই করে বলেছে তোরা আছিস তাই যেন হুটহাট দরজা না খুলি।
রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুইজনকে কোলে নিয়ে রুমে আসে।দুইজনের চোখ ই ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে।রিদি দুই পুত্র কে ঘুম দিয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসল।দুইটাই একদম ডিসিপ্লিন বাচ্চা।টাইমে খাবে টাইমে ঘুমাবে।
রিদি দূর আকাশে তাকিয়ে আছে। বাইরে নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত দেখালেও ভেতরে পুড়ে ছারখার হচ্ছে।তীব্রর দূরত্ব তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। কতোদিন মানুষটা তাকে বৌ বলে ডাকে না।তাকে কাছে টেনে নেয় না। উষ্ণ স্পর্শে ভরিয়ে তোলে না।আগলে নেই না।কোন অবদার করে না।দরকার ব্যাতিত তার সাথে কথা পর্যন্ত বলে না।রিদি কান্না করলেও মানুষটা একটু আদুরে হাত বুলিয়ে দেয় না।থামাই না।
তীব্রর এই অসম্ভব পরিবর্তন রিদিকে শেষ করে দিলেও সে অভাগী এটা সে জানে।শত অবহেলা মুখ বুজে হাসিমুখে সহ্য করার অভ্যাস তো তার পুরানো।তাইতো তীব্রর এই অবহেলা সহ্য করছে।যে মানুষটা তাকে বুকে না জড়িয়ে ঘুমাতো না সে এখন ছেলেদের বুকে নিয়ে তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমাই।রিদি কান্না করলেও মানুষটা ফিরে দেখে না।একটু আদুরে কথা বলে না।রিদির ভীষণ কষ্ট হয়।আবার ভাবে এটা তো তার নিয়তি সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়না।
মনে মনে অনেক কিছুই ভাবে রিদি তবে কোনো কূল খুঁজে পাইনা।এই যে আজকেও কতো কিছু ভাবছে অথচ কোন কূল খুঁজে পাচ্ছে না। তীব্র তার কল ও রিসিভ করে না আজকাল।এতো দূরত্ব রিদির আর সহ্য হচ্ছে না।সে তীব্রর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই তীব্র বলে,
আপনি কি চান না আমি বাসায় ফিরি! আমার ভালো লাগে না এই ব্যাপারে কথা বলতে।দয়া করে একটু একা ছেড়ে দিন আমাকে।
তীব্রর ঠান্ডা হুমকিতে আর তির্যক পূর্ন কথায় রিদির কথা গলায় ই আটকে থাকে।গলা দিয়ে বের হয় নি সেই মূহূর্তে। তবুও নিজেই নিজেকে বুঝায় সব ঠিক হয়ে যাবে,সব ঠিক হয়ে যাবে।
কখনো কখনো মনে হয় তীব্র বদলে গেছে।হয়তো এখন আর তাকে ভালো লাগছে না।হয়তো তার চাহিদা এই পর্যন্তই ছিল। আবার তীব্রর পাগলামি ভালোবাসা মনে করে রিদি নিজেকে বোঝায় তীব্র তাকে ভালোবাসে শুধুই তাকে ভালোবাসে।এতো ভালোবাসা মিথ্যা নয়। হয়তো সময়টা খারাপ কিন্তু সব ঠিক হয়ে যাবে। তীব্র তো তার ম্যাজিকম্যান নিশ্চয় জাদুর কাঠি দিয়ে সব ঠিক করে দেবে।
রিদি পাশে অবহেলিত ফোনটা হাতে তুলে কল করলো তীব্রর নাম্বারে।এবার রিং হচ্ছে। কয়েকবার রিং হয়ে কলটা রিসিভ ও হয়েছে।তবে ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
জি কে বলছেন??
রিদি অবাক হলো না।এটা তীব্রর নতুন জয়েন হওয়া পিএ।সে জানে এই ব্যাপারে।যদিও এসবে তার কোন সমস্যা ছিল না কখনো।আর না এখনো আছে।তীব্রর প্রতি তার পুরো বিশ্বাস আছে।
ওনি!মানে তীব্র চৌধুরী কি আছে??
মেয়েটা মিষ্টি কন্ঠে বলল,
সরি স্যার তো অফিস থেকে চলে গেছে সেই বিকেলে।ফোনটা ভুলে রেখেই গেছিল অফিসে আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরছি পথে ফোনটা স্যারের বাড়িতে দিয়ে দিব।তবে আপনি কে???
সেভ করা নাই বুঝি!!
জি না।আসলে স্যার দুপুরের দিকেই নতুন ফোনটা কিনেছে।তাই নাম্বার সেভ করা নাই।
আচ্ছা।আপনি বাসায় ফোনটা পৌছে দিন আমি পরে ফোন করব।
রিদি কল কেটে আবারো দূর আকাশে তাকালো।অদূরে কোথা থেকে ভেসে আসছে হিন্দি গানের লাইন।ছোকরা ছেলেরা হয়তো মনসি মিয়ার দোকানে সন্ধার চায়ের আড্ডায় গানটা শুনছে সাথে নিজেরাও গাইছে,
আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৭২
Sayaraa tu to badla nahi ha….
Mosum jara sa rutha hua ha….
রিদি আনমনেই বিরবির করল আপনি বদলে যাননি তীব্র !!সময়টাই হয়তো খারাপ যাচ্ছে !!
