আবার বসন্ত পর্ব ২

আবার বসন্ত পর্ব ২
ঝিলিক মল্লিক

“আম্মা, লাড্ডু কার কথা বলছে?”
আয়েশা খানম সবে ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ভেতরে প্রবেশ করছিলেন। তখনই কথাটা শোনামাত্র থমকে দাঁড়ালেন। তিতান তখন সোফার ওপর বসে রুবায়েতের সেলফোনটা নিয়ে খেলা করছিল। ওর মনোযোগ ছিল ফোনের দিকে। আয়েশা খানম একপলক তিতানকে দেখে তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলেন রুবায়েতকে,
“কার কথা বলছে?”
“কোন আন্টি ওর. .”
“ওহহ, ও তো তাজরীনের কথা বলছে।”
“তাজরীন?”

রুবায়েত প্রশ্ন ছুড়ে কপট ভ্রু কুঁচকে সরু চোখে তাকালো মায়ের দিকে। আয়েশা খানম জবাব দিলেন,
“হ্যাঁ। তোমার কলিগ রুস্তম আছে না? ওর ছোটবোন। আজ-ই এসেছে এখানে। দেখা হলো বিল্ডিংয়ের বাইরে। বেশ ভালো মেয়ে। মিশুকে স্বভাবের। অনেকক্ষণ গল্পসল্পও করলাম। আমি তো বলে এসেছি, মাঝেমধ্যে আমাদের এখানে আসতে৷ তিতান ওকে বেশ পছন্দ করেছে বলে মনে হচ্ছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়েশা খানম হাসিমুখে এগিয়ে গেলেন তিতানের দিকে। ওর গাল টেনে ডাইনিং-এর দিকে আসতে বলে সেদিকে চলে গেলেন। রুবায়েত হাতঘড়িতে সময় দেখলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে ওর। এতোক্ষণ মায়ের জন্য-ই অপেক্ষা করছিল। এবার বেরোতে হবে। পকেটে হাত রেখে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তিতানের দিকে তাকালো রুবায়েত। তিতান তখন ফোনের লক খুলে নিজে নিজেই প্লে-স্টোরে ঢুকে ভয়েসে ‘গেইম’ বলে সার্চ করে ইনস্টল করা শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তা দেখে রুবায়েতের মেজাজ বিগড়ে গেল। ছেলেটা বাড়ন্ত আর অতি অল্প বয়সেই খুব চালু হয়ে যাচ্ছে। রুবায়েতের ফোন প্রায়শই ওর কাছে থাকায় ফোনের প্যাটার্ন – পাসওয়ার্ড জেনে বসে আছে। আশ্চর্য তো সেদিন হয়েছিল রুবায়েত, যেদিন ছেলেকে সে তার ফোনের লক খুলতে দেখেছিল৷ ফোন ব্যবহারে ছেলেটা তার আগে থেকেই পটু। এখন আরো চালু হচ্ছে। সব হয়েছে রুবায়েতের অনুপস্থিতির ফলাফল। বাইরে থাকাকালীন সময়ে তার মা নাতির সব বায়না-আবদার পূরণ করেন। ফোনে গেইম খেলা আর কার্টুন দেখার জন্য কান্নাকাটি করে আবদার করলে তিনি কঠিন হতে পারেন না আদরের নাতির জন্য। এভাবেই তিতানের ফোনের প্রতি আসক্তি। কিন্তু রুবায়েত তো ছেলের এহেন কাজকর্ম মেনে নেবে না।

হঠাৎই তিতানের হাত থেকে ফোনটা কেঁড়ে নিলো রুবায়েত। সঙ্গে সঙ্গে যেন পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটলো। তিতান চিৎকার-চেঁচামেচি করে এলাকা কাঁপিয়ে কান্না শুরু করলো। একে মরাকান্না বললেও ভুল হবে না। দূর থেকে যে-কেউ শুনলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে, বুক ধড়ফড় করবে। রুবায়েতের মেজাজ তরতর করে বাড়ছে। ছেলের অধঃপতন সহ্য হচ্ছে না তার। চেঁচিয়ে দিলো এক ভয়াবহ ধমক। সঙ্গে সঙ্গে বসার ঘর পুরোপুরি ঠান্ডা। তিতান স্থির হয়ে কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখ করে দেখতে লাগলো তার রাগান্বিত বাবাকে। তখনই তার তাজ বাবুর বলা রাক্ষসের কথা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, রেগে গেলে তার বাবাকে তাজ বাবুর বর্ণনানুসারে সেই রাক্ষসের মতো-ই লাগে। আজ তিতান তা খেয়াল করে দেখলো। এজন্য সে চুপ করে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। রুবায়েতের রাগে কপালের শিরা নীল হয়ে ফুলে আছে। নাক খাঁড়া করে তিতানের দিকে শাহাদাত আঙুল উঁচিয়ে বেশ গম্ভীর এবং রাগী স্বরে রুবায়েত বললো,

“শোনো লাড্ডু; একটা কথা বলে দিচ্ছি, এতো ফোন দেখা তোমার জন্য ভালো নয়। ভেরি ব্যাড। এরপর থেকে যেন তোমাকে আমার, তোমার দিদার আর বাড়তি ফোনটা টাচ করতে না দেখি। বোঝা গেল?”
তিতান মুখে জবাব না দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বাধ্যগতভাবে দুই পাশে ঘনঘন কয়েকবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই রুবায়েত বেরিয়ে গেল গটগট পায়ে হেঁটে। ও যেতেই তিতান সোফার দুই পাশে তার গোলগাল হাত আর পা জোড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে, নাকের পাটা ফুলিয়ে অভিমানে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো। ছোট্ট হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কান্নার জন্য নাকে এসে জমা হওয়া সর্দি মুছতে মুছতে বললো,
“পাপা আমালে ইত্তুও বালুপাছে না। পাপা এত্তা তাক্কশ!”

তহুরা এসেছে রুস্তমদের ফ্ল্যাটে, তাজরীনের সাথে দেখা করতে। চট্টগ্রামের ট্যুরে তাজরীনের সাথে বেশ একটা ভালো সম্পর্ক হয়েছিল তহুরার। ধীরে ধীরে সেটা প্রসারিত হয়েছে। ওর তেমন কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই। তাই বিয়েতে সকল অনুষ্ঠানে নিজের জন্য বিশেষ অতিথি বলতে সে তাজরীনকেই প্রথম কাতারে রেখেছে।
ডলি বেগম ট্রে-তে করে চায়ের কাপ এনে রাখলেন সোফার সামনের টি-টেবিলের ওপর। তাজরীন আর তহুরা একই সোফায় মুখোমুখি বসে ছিল। তখন জীম এলো শোবার ঘর থেকে। গত দু’টো দিন যাবত ভীষণ অসুস্থ সে। শোবার ঘরেই বিশ্রাম নিচ্ছে বেশিরভাগ সময়। বসার ঘরে প্রবেশ করে তহুরাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হলো তাজরীন। এগিয়ে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলো,
“কেমন আছো? কখন আসলে?”
“এইতো ভালো আছি। মাত্র কিছুক্ষণ হলো, আসলাম৷ তুমি কেমন আছো?”
“আল্লাহ রেখেছেন ভালো।”
তহুরার প্রশ্নের জবাব দিয়ে জীম থেমে আবার তাজরীনের দিকে তাকালো। কিঞ্চিৎ উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তাজ, তোমার ভাই এখনো আসেনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে?”
“না তো বৌমণি।”

তাজরীনের জবাব শুনে আরো বেশি চিন্তায় পরলো জীম। এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা৷ আজ এতো দেরি করছে কেন কে জানে! এখনই কল করা দরকার। জীম ধীর গতিতে হেঁটে আবারও ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ও যাওয়ার পরে তহুরা তাজরীনকে প্রশ্ন করলো,
“জীম কী অসুস্থ?”
তাজরীন জবাবে বললো, “হ্যাঁ।”
“প্রেগন্যান্সির জন্য-ই এমন হচ্ছে হয়তো। তার নিজের প্রতি একটু যত্ন নেওয়া দরকার।”
তহুরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো। তাজরীনের চোখে-মুখেও চিন্তার ছাপ দেখা গেল। ও বললো,
“আমরা তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি বৌমণির যত্নআত্তিতে। কোনোদিক থেকে খামতি রাখতে দিচ্ছি না। তবু কোথায় গিয়ে যেন একটা কমতি থেকে যায়। সেটা যে কি, তা বুঝতে পারছি না। দেখি আজ ভাইয়া ফিরলে আমি কথা বলে দেখবো। তুমি যেন কী বলছিলে?
তহুরা এবার মূল আলোচনায় আসে। গলা ঝেড়ে কেশে বলতে শুরু করলো,

“আমাদের বিয়ের নিবন্ধন আর নিকাহনামা প্রস্তুত হবে ক্যান্টনমেন্ট ব্রাঞ্চে। এরপর বিয়ের বাদবাকি আয়োজন হবে অফিসার্স কমিউনিটি সেন্টারে। বলতে গেলে আনুষ্ঠানিকতাগুলো সেখানেই হবে। কমিউনিটি সেন্টার তিনদিনের জন্য নেওয়া হচ্ছে। তোমাকে কিন্তু থাকতে হবে সেখানে। বিয়ের কার্ড রুস্তম স্যারের কাছে দিয়েছি আগেই। আজ সোমবার। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত সকল আয়োজন।”
তহুরা যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়। ক’টা দিন তার ভীষণ ব্যস্ততা৷ বসারও সময় নেই। জটিল সমীকরণ থেকেই সময় বের করে সে তাজরীনকে জানাতে এসেছে। তাজরীন ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলো,
“বিয়েতে সেই তুমি তাহলে রাজি হয়েই গেলে?”
তহুরা না হেসে পারে না। মুচকি হেসে জবাব দেয়,

“রাজি না হয়ে উপায় ছিল বলো? ওই বাঁদরটা পিছুই ছাড়ছিলো না। রীতিমতো বখাটেদের মতো ইভটিজিং করা শুরু করে দিয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টে ঠিকমতো ওর জন্য ডিউটিও করতে পারতাম না৷ রাতের ঘুম হারাম করে ছেড়েছিল। শেষমেশ বলেছিল, আমি যদি বিয়েতে রাজি না হই; তাহলে ও বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। আমি বললাম, ‘বুড়িগঙ্গার ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানিতে ডুব দিলে তুমি মরবে না। বরং বেঁচে ফিরলে কিম্ভূতকিমাকার দেখাবে। তখন তো কোনো মেয়ে ফিরেও তাকাবে না৷ তোমার কোনো মেয়ের সাথে ফ্লার্টিং কিংবা টাইমপাস করাও হয়ে উঠবে না।’ একথার পর সে আর বুড়িগঙ্গায় গেল না ঠিকই, তবে আমার হাত-পায়ে ধরে মাফ চাইতে এলো। জীবনেও আর কোনো মেয়ের দিকে ফিরে তাকাবে না। তাকালে সে পুরুষের জাতের মধ্যে পড়ে না। কোনো মেয়ের নামও উচ্চারণ করবে না। আরো কত কথায় কনভিন্স করার চেষ্টা। আমি জানতাম আফিমের মনে আমার জন্য স্বচ্ছ একটা অনুভূতি আছে, যা এতোদিন সে ঢাকা দিয়ে রেখেছিল নিজের স্বভাবের নিচে; কিন্তু সেই অনুভূতি যে এতোটা প্রকট, সেটা ধারণা করতে পারিনি। বাঁদরটা শেষমেশ আমার মতো মুক্তোর মালাকে গলায় ঝোলানোর মতো সৌভাগ্য অর্জন করেই ফেললো!”

তাজরীন সামান্য হাসলো৷ দারুণ তো! এরকম পরিণয়ের কাহিনী যুগ যুগ ধরে অমলিন থাকুক। তহুরা যেতে গিয়েও কী মনে করে যেন তাজরীনকে জিজ্ঞাসা করলো,
“তোমার খবর তো বললে না। এশরাককে বিয়ে করছো কবে?”
“এশরাক? ওই পাঠার বাচ্চাকে? ছাগলটাকে আমি বিয়ে করছি না। বিয়ে ক্যান্সেল। আমি হলাম তাজ। তাজ রানি। ওর মতো ছাগলকে বিয়ে করে কী ছাগল রানি হবো? সুতরাং, নো বিয়ে-শাদি। অনলি বিয়ে খাওয়া। লেগ রোস্ট কিন্তু তোমার বিয়েতে। হ্যাঁ?”
তহুরার প্রচন্ড হাসি পেল তাজরীনের কথায়। মেয়েটা যেকোনো পরিস্থিতিতে সদা উৎফুল্ল থাকতে পারে। নাহলে নিজের বিয়ে ভেঙে দেওয়া ঘটনা কেউ এভাবে বলতে পারে?

সকাল সকাল তাজরীন হাত-মুখ ধুয়েই বেরিয়েছে বিল্ডিংয়ের বাইরে। হাঁটছিল দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরে। তখনই দেখলো, তিতান দাঁড়িয়ে আছে দূরে কুঁজো হয়ে। ওর হাত পেটে। কিছুটা নিচের দিকে ঝুঁকে আছে। মুখটা ভালোভাবে খেয়াল করলেই বোঝা যায়। তাজরীন এগিয়ে গেল ওদিকে। তিতানকে ডাক দিলো৷ তিতান মুখ তুলে তাজরীনকে দেখে খুব খুশি হলো৷ তাজরীন জিজ্ঞাসা করলো,
“লাড্ডু সোনা, এখানে যে? একা কী করছো?”
“জুগিং কততে আচচিলাম পাপার ছাথে। পাপা উদিকে চলি গিচে। এখুন দিদা আচে ইকানে।”

তিতানের কথা শেষ হতেই আয়েশা খানমকে দেখা গেল। দূর থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে আসছেন তিনি৷ তাজরীন দেখলো তাকে। রুবায়েতের এহেন কাজে তার রাগ লাগছে বেশ। এতোটুকু একটা দুই আঙুলের বাচ্চাকে কিনা নিজের মতো সাতসকালবেলা ব্যাঙের নাচ নাচাতে বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে জমিদারের বংশধরটা! কি আশ্চর্য! দুনিয়ার মানুষজন কত নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। নিজে সারাক্ষণ জলপাই রঙের খাকি পোশাকটা পড়ে থাকে বলে কী ছেলের সাথে এমন বর্বরের মতো ব্যবহার করার আইন পাশ করে গেছে নাকি! তিতানকে দেখা গেল মন খারাপ করে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে আছে। তাজরীন নিচু হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“মন খারাপ কেন রে লাড্ডু সোনা?”
লাড্ডু ঠোঁট উল্টে অভিমানী স্বরে বললো,
“পাপা ছুদু বুকা দিই আমালে। ছক্কাল ছক্কাল ঘুউম তেখে টেনে নিয়ে আচিতে। পুতিদিন ইমুন করে। ইত্তুও আনুনদো কোততে দেয় না।”
“লাড্ডু সোনাকে আনন্দ করতে দেয় না স্বৈরাচারী রাক্ষসটা? ওকে!”
তাজরীন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাস টেনে সিদ্ধান্তটা নিলো। আয়েশা খানম তিতানের বল খুঁজছিলেন আশেপাশে। তাজরীন এগিয়ে গিয়ে তাকে বললো,
“ও আন্টি, লাড্ডুকে আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাচ্ছি। আমার সাথে সময় কাটাবে কিছুক্ষণ। পরে আমি গিয়ে দিয়ে আসবো। তোমার কোনো অসুবিধা আছে?”
আয়েশা খানম কোনোরকম আপত্তি না করেই কেন জানি তাজরীনের সাথে তিতানকে যেতে দিলেন। তাজরীন তিতানকে পিঠে তুলে নিয়ে বিল্ডিংয়ের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো,
“চল লাড্ডু, আজ তোকে আনন্দ মেলায় ভ্রমণ করাবো৷ জিন্দেগীতে তুই যা যা করতে পারিসনি আজ তাই তাই করবি। আজ তেরা স্বাধীনতা দিবস রে লাড্ডু। লেট’স সেলিব্রেট। দেখি কোন জমিদারের বাচ্চা আটকায়!”

“আম্মা লাড্ডু কোথায়? ওর নাস্তা করতে হবে তো।”
রুবায়েতের আজ দেরি হওয়ায় আগেই জগিং করে ফিরে সকালের নাস্তা করে নিজের ঘরে গিয়ে ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে তৈরি হয়ে বাইরে এসে ছেলের খোঁজ করতে লাগলো মা’কে একা দেখে। আয়েশা খানম সোফার কুশনে কভার ভরতে ভরতে লা-পরোয়া জবাবে বললেন,
“ও তো রুস্তমদের ফ্ল্যাটে।”
“ রুস্তমদের ফ্ল্যাটে মানে! কে নিয়ে গেছে ওকে ওখানে? তুমি যেতে দিলেও বা কী করে? নূন্যতম কাণ্ডজ্ঞান নেই!”
আয়েশা খানম পারলে কানে তালা দেন। ছেলের এই চিৎকার-চেঁচামেচি আর রাগকে ভয় পান তিনি৷ আগে তার ছেলেটা এমন ছিল না। আসমা মারা যাওয়ার পর থেকে এমন খিটখিটে মেজাজি হয়ে গেছে। একটুতেই চিল্লাপাল্লা করে। রাগ সবসময় নাকের ডগায় থাকে। মেজাজ তো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়। আয়েশা খানম আস্তে করে জবাব দিলেন,
“তাজরীন নিয়ে গেছে তিতানকে।”
“তাজরীন না? দেখছি!”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে মেজাজ তুঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল রুবায়েত। আয়েশা খানম বুকে ফুঁ দিয়ে ইস্তেগফার পড়তে লাগলেন।

তাজরীনের ঘরটা পুরো এলোমেলো। ওয়ারড্রবে কোনো জামাকাপড় নেই। সব জামাকাপড় ফ্লোরে, পালঙ্কের ওপর আর টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। বিছানার ঠিক মাঝখানে যেন একটা জামাকাপড়ের পাহাড় তৈরি হয়েছে। সেই পাহাড়ের ওপর বসে চকলেট কামড়ে কামড়ে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে লাড্ডু৷ ওর চারপাশে কতগুলো চকলেট জমা হয়ে আছে। তাজরীন একটা কৌটা নিয়ে এলো। লাড্ডুর হাতে দিয়ে বললো,
“এতে মাখন আছে। খা লাড্ডু সোনা। জিন্দেগী জি লে আপনি মার্জি মে। খায়েঙ্গে, দায়েঙ্গে, ঘুরেঙ্গে, ফিরেঙ্গে অর মাস্তি কারেঙ্গি। এ হুয়্যি না বাত?”
লাড্ডু উল্লাসিত। এমন স্বাধীনতা যে সে পাবে ভাবতে পারেনি। তাই উচ্ছ্বাসটাও বেশি। চোখের সামনে তার কাঙ্ক্ষিত সবকিছু! তাজরীন ভ্রু নাচিয়ে বললো,

“চল লাড্ডু মাস্তি করি।”
লাড্ডু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কিমুন?”
“উঠে আয় দেখাচ্ছি।”
লাড্ডু আস্তে-ধীরে গুটি গুটি পায়ে নেমে এলো পোশাকের পাহাড় থেকে। তাজরীন এগিয়ে গিয়ে সাউন্ড বক্সে গান চালু করলো।
“থাকলে মাল্লু বাড়বে ভেলু,
টপে যাবি উঠে,
ছুটছে সবাই জিতবে বলে
চলনা পাগলু ছুটে,
লে চান্স দে, লে চান্স দে
লে চান্স চান্স চান্স!
লে পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স ডান্স
লে পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স. . !”
তাজরীন আর তিতান উরাধুরা ঘর কাঁপিয়ে নাচ শুরু করেছে। এ ঘরের বাইরের মানুষেরা জানে, তারা মূলত এসব করতেই ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে রেখেছে। বাড়িতে মানুষ বলতে তাজরীনের মা আর বৌমণি৷ তারা কিছু বলছে না। সুতরাং ওরা স্বাধীন। তিতান তাজরীনের কোলে উঠে মাখন খেতে খেতে নাচছিল হাত-পা নাড়িয়ে। তাজরীনও দ্বিকবিদিক ভুলে এলোপাতাড়ি নাচ দিচ্ছিল। হঠাৎ তিতানের আতঙ্কিত কন্ঠস্বর,

“তাজ বাবুউ, পাপা!”
তাজরীন শুনলো তিতানের কথা। কিন্তু ও এখন তিতানকে নাচাতে মগ্ন। তিতানকে কোল থেকে নামিয়ে দুই হাত নিজের দুই হাত দ্বারা টেনে ধরে গানের তালে তালে গোলগোল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
“আরে বেটা বাপ যায়ে আন্ধেরা
আব টাইম হ্যায় তেরা।
যারা নাচলে না রে বাবা!”
“লাড্ডু!”

এক চিৎকারে রুম পুরো ঠান্ডা। এই সাউন্ড বক্সটাও এমন গাদ্দারের গাদ্দার! ভুল সময়ে-এ এসে চুপ হয়ে গেল। ভাবখানা এমন যেন মানুষের মতো সে-ও ধমকে ভয়ে চুপ হয়ে গেছে। তিতান ইতিমধ্যে তাজরীনের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে উঁকি দিচ্ছে অল্পস্বল্প। ভয়ে জমে গেছে বেচারা। তাজরীন হতভম্ব। ভয়ডরও লাগছে বেশ। সামনে জাঁদরেলটা দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। পারলে এখানেই দাফনকাজ করে দেয় ওর। রুবায়েত ওপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে নাকের পাটা ফুলিয়ে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখছে সবকিছু। ঘর, কাপড়ের স্তুপ, সাউন্ডবক্স . . শেষমেশ ওর চোখ গেল তাজরীনের পেছনে লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টায় রত তিতানের দিকে। তিতানের নাক-মুখ ভর্তি চকলেট আর মাখন মেখে একাকার। রুবায়েত ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে তিতানকে উদ্দেশ্য করে ধমকে তাঁরস্বরে বললো,
“একি! কি খাচ্ছো তুমি? তোমার হাতে ঐটা কী?”
“মাক্কন পাপা। ইতা মাক্কন।”

বাবার রাগী স্বরে তিতান ভয় পেয়ে চটপট জবাব দেয়। সঙ্গে সঙ্গে রুবায়েত চেঁচিয়ে ওঠে বলে,
“কিসব হচ্ছে এখানে! তোমাকে না কতবার বলেছি এসব ছাইপাঁশ খাবে না! আনহেলথি ফুড। এসব খাওয়া বারণ তোমার। নিষেধ করেছি না আমি? তাহলে কোন সাহসে খাচ্ছো?”
শেষের বাক্যে আবার ধমকে উঠলো রুবায়েত। এগিয়ে যেতে লাগলো তিতানের দিকে। তাজরীন এবার ওকে আড়াল করে সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে সামান্য সৌজন্যতামূলক হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আরেহহ আরেহহ কি করছেন! বকছেন কেন ওকে? এসব খাওয়া কী গুনাহ নাকি। খাচ্ছে তো ভালোই। এই খাবার ওর পছন্দের। আপনি দয়া করে ওর খাওয়ায় ব্যাগড়া দিয়ে গুনাহ কামাই করবেন না স্বৈরাচার জমিদার।”
রুবায়েত এক পা এগোতে গিয়েও থেমে যায়। তাজের চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত পিষে কটমট করে বলে,
“কী শেখাচ্ছো আমার ছেলেকে?”

“স্বাধীনতা। স্বাধীনতার চর্চা করা শেখাচ্ছি।”
তিতান এবার উৎসাহ পেয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
“মিত্তি আন্টির কাচে তাকলে আমি ছাদিন থাকি পাপা। মিত্তি আন্টি মিত্তির মোতো কুব মুজা।”
রুবায়েত এবার জোরপূর্বক তিতানের চেপে ধরে ওকে টানতে টানতে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো,
“চলো এখান থেকে। এমন বিচ্ছিরি ফাজলামি নেওয়া যাচ্ছে না আর। এই বেয়াদবের সঙ্গ পেয়ে কোনোভাবেই তোমাকে বেয়াদবি করতে দেবো না আমি।”
তাজরীন পেছন থেকে চেঁচিয়ে লাড্ডুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ওয়ে লাড্ডু, শোনরে!”
লাড্ডু পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিলো,
“বুলো তাজ বাবুউ।”
“মাত্র কী বললাম মনে আছে তো?”
লাড্ডু যেতে যেতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জবাব দিলো,
“হুইই মুনে আতে।
বাপ যায়ি আনদিরা,
আব তাইম মিরা।”

আবার বসন্ত পর্ব ১

রুবায়েত কথাটার গাঢ় অর্থ বুঝলো। তাজরীনের মুখে শুনে পিত্তি অবধি জ্বলছিল। এখন নিজের ছেলের মুখে এমন বেয়াদবিপূর্ণ কথা শুনে শরীরের প্রতিটা শিরা হতে শুরু করে মাথা অবধি দপদপিয়ে জ্বলতে লাগলো ওর। লাড্ডুর কন্ঠে একই কথার সুর— “বাপ যায়ি আনদিরা, আর তাইম মিরা। বাপ যায়ি আনদিরা, আব তাইম মিরা।”
রুবায়েত ঠিক করলো, আজ-ই এক প্যাকেট তুলা আর একটা কসটেপ কিনে নিয়ে আসবে। হয় নিজের কানে তুলো গুঁজবে, না-হয় ছেলের মুখে কসটেপ মারবে। নচেত এ ছেলে থামার নয়। বেয়াদবটা যা কুমন্ত্রণা শিখিয়েছে! লাড্ডু তখনও ননস্টপ বলে চলেছে,
“বাপ যায়ি আনদিরা,
আব তাইম মিরা. . .”

আবার বসন্ত পর্ব ৩