আবার বসন্ত পর্ব ৪

আবার বসন্ত পর্ব ৪
ঝিলিক মল্লিক

ফ্ল্যাটের একটা নেমপ্লেট আছে। ক্ষণস্থায়ী নেমপ্লেট। সেখানে ঝুকে চোখ ছোট ছোট করে ফ্ল্যাটের নামটা পরলো তাজরীন।
“আসমা নূরকানন”– ·
নামটা ভীষণ সুন্দর। মনোরম, স্নিগ্ধ আর অনেকটা শান্তি শান্তি ভাবের। তাজরীন পরপর তিনবার ঠোঁট নাড়িয়ে বিরবির করে নামটা উচ্চারণ করলো। ততক্ষণে কলিংবেল বাজার মিনিট খানেকের মধ্যে আয়েশা খানম এসে সদর দরজা খুলেছেন। সামনে তিতানকে গোমড়ামুখে বুকে দুই হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেন বেশ। আজ এতো দ্রুত ফিরলো যে! তাজরীন পাশ থেকে সরে এসে সামনে দাঁড়ালো। মিষ্টি করে হাসলো আয়েশা খানমকে দেখে। এখানে এসে ইতস্তত বোধ করছে ও। তিতানের জন্য বাধ্য হয়ে আসা। আয়েশা খানম বুঝলেন। মেয়েটার জড়তা কাটাতে ওকে ভেতরে আসতে অনুরোধ জানালেন। পাশে সরে দাঁড়াতেই তাজরীন ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করলো। তিতান গিয়েই সোফার ওপর ঝাঁপ দিয়ে বসে পরলো। তারপর অনিয়ন্ত্রিত কান্না শুরু করলো। আয়েশা খানম হতভম্ব হলেন। প্রথমে বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা। তাজরীনের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাতেই ও বললো, “আন্টি, লাড্ডু আমার সাথে কমিউনিটি সেন্টারে যেতে চাচ্ছে। জিদ ধরেছে, ওকে নিয়ে যেতেই হবে।”

“কমিউনিটি সেন্টারে?”
“হ্যাঁ। তহুরাকে চেনো না? রুবায়েতের কলিগ? ওর বিয়ের অনুষ্ঠানে।”
“হ্যাঁ চিনি তো। আমার ছেলের কলিগ। আমার সাথে আলাপও হয়েছে বহুবার। তিতানকে খুব ভালো জানে। আমাদেরকেও তো ওর বিয়েতে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমরা শুধুমাত্র বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে-ই যাবো।”
“আমাকে আজ আর আগামীকালও যেতে হবে। এখন কী করবো আন্টি? লাড্ডু তো জেদ ধরে বসে আছে।”
আয়েশা খানম চিন্তায় পরলেন। একবার তিতানকে দেখে নিলেন। অনবরত কান্নাকাটি করেই চলেছে। থামার নাম নেই। এদিকে তার আজ অনেক কাজ। সবগুলো ঘর পরিষ্কার করতে হবে। সপ্তাহে একদিন এ-কাজে ব্যস্ততায় কেটে যায়। এই দিনগুলোতে তিতানকে টিভির রিমোট নাহয় সেলফোন ধরিয়ে বসিয়ে দেন। নিজে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন। কিন্তু আজ নাতিটা অশান্ত হয়ে আছে। কাজটাও হয়ে উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। আবার না করেও উপায় নেই। পরবর্তীতে নাহলে অনেক কাজ জমা পরে যাবে। অনেক ভাবনাচিন্তা করে আয়েশা খানম তাজরীনকে বললেন,
“ও যখন কান্নাকাটি করছে, তখন নিয়ে যেতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তুমি আপত্তি করবে না– · এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু ওর বাবা জানতে পারলে তো ওর বাসার বাইরে বেরোনোও বন্ধ করে দেবে। আমি চাচ্ছি না, বাচ্চাটা এই বয়সেই বন্দীদশায় ভুগুক। ওর এখন পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর বয়স, নতুনত্ব দেখে কৌতূহলী হওয়ার বয়স ; সেখানে. . .”
“চিন্তা কোরো না মা। রুবায়েত তো আসবে সন্ধ্যার আগে না-হয় পরে। তুমি বরং ওকে বিকালের মধ্যে দিয়ে যেও।”
“আচ্ছা আন্টি। তাহলে আমি লাড্ডুকে নিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই দিয়ে যাবো। এতোক্ষণ এ-নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এবার কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। নির্দ্বিধায় নিয়ে যেতে পারবো ওকে।”
আয়েশা খানম দ্রুত তিতানকে নতুন পোশাক পরিয়ে, চুল আঁচড়ে জেল লাগিয়ে তৈরি করিয়ে দিলেন। তাজরীন ওকে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে আসলো। জীমের কাছে তিতানকে বসিয়ে দিয়ে গোসল সেরে তৈরি হতে গেল।

রুবায়েত কনফারেন্স রুমে ছিল। মাত্র সেখান থেকে বের হতেই ফোনে কল আসলো ওর। কলারের নাম্বারটা একবার দেখে তারপর কল রিসিভ করলো রুবায়েত।
“আসসালামু আলাইকুম আব্বু।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম বাজান। কেমন আছো তুমি?”
রুবায়েতের সালামের জবাবে ফোনের ওপাশ থেকে মুরব্বি মতোন মানুষটা জবাব দিয়ে প্রশ্ন করলেন। রুবায়েত হালকা হেসে জবাব দিলো,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমরা সবাই কেমন আছো? মামনি কেমন আছে? শরীর সুস্থ তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই ভালো আছি বাপ। তোমার মামনি তো প্রতিদিন-ই তোমার কথা মনে করে। তোমাকে দেখতে চাইছে কতদিন ধরে। কিন্তু তোমার তো ছুটি হচ্ছে না। ছুটি পেলে না-হয় রাজশাহীতে আসতে বলতাম। লাড্ডুটাকেও দেখি না কতোদিন হয়ে গেলে।”

রুবায়েত ইতস্তত বোধ করে। মাঝে সে রাজশাহীতে গিয়েছিল — একথা আর বললো না। বললে আব্বু আর মামনি কষ্ট পাবে। তবে রুবায়েতকে যে ঘোরাঘুরি করতে নয়, বরং মিশনের প্রয়োজন রাজশাহীতে যেতে হয়েছিল— একথা তাদেরকে বললেও তারা বুঝতে চাইবে না, বরং অভিমান করবে। ফোনের ওপাশ থেকে জাহিদ গাজী বললেন,
“বৌ মরলে বুঝি বৌয়ের বাপের বাড়ির মানুষজন পর হয়ে যায় বাজান?”
“না– না আব্বু! ব্যাপারটা এমন নয়। তোমরা আমার কাছে কখনোই পর ছিলে না। শুধুমাত্র সময়ের ব্যবধানে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে আমার। দায়িত্বের বোঝা ভারী হচ্ছে। এই বোঝা বইতে গিয়ে আমি অনেকটা নিজের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। চাইলেও ফেরা সম্ভব হচ্ছে না। আমার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব আব্বু। সেগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে আমাকে। তোমাদের নাতিকে মানুষ করতে হবে, অনেক বড় করতে হবে। আসমার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। আমি যে হুট করে একদিন এতোটা বড় হয়ে যাব, এতো বেশি দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে— এটা তো আগে বুঝতে পারিনি। তোমাদের মেয়েটা থাকলে কিছুটা হলেও মুশকিল আসান হতো। ও তো আমাদের একা ফেলে চলে গেল!”

রুবায়েত কথাগুলো স্বাভাবিকভাবে বললেও একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পেলেন জাহিদ গাজী। বুক ভার হয়ে আসলো তার। হাহাকার জেগে উঠলো বুকের ভেতর। কিন্তু সহমর্মিতা দেখালেন না তিনি। রুবায়েত সহমর্মিতা নিতে পারে না। বরং, ভালো পরামর্শ দিলে সেগুলো গ্রহণ করার চেষ্টা করে। একারণে তিনি বললেন,
“তুমি তো আবার বিয়ে করলে পারতে। তোমার আম্মা সেদিন এক মেয়ের কথা বলছিল। তোমার ব্যাপারে নাকি কথা বলেছে সেই মেয়ের পরিবারের সাথে। মেয়েটাও তোমাকে পছন্দ করে। তোমার ছেলেকেও সহজেই মেনে নেবে। শুনলাম, তুমি নাকি রাজি হওনি?”
“আ–ব্বু. . .আমরা মানুষের বাইরে থেকে দেখে বা মানুষের কাছ থেকে শুনে যা ধারণা করি, সবসময় যে সেটা সঠিক হয়— এমনটা নয়। ওই মেয়ের সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে আমার। নিজেই যেচেপড়ে কথা বলতে এসেছে। কথাবার্তায় বিশেষ সুবিধার মনে হলো না। যতবার কথা বলেছে, শুধুমাত্র ওর আর আমার ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনার কথা। সেই পরিকল্পনা প্রকল্পে কোথাও আমার লাড্ডু নেই। ছিটেফোঁটাও না। অমন মেয়েকে বিয়ে করে কি বাবা হয়ে আমার ছেলের পুরোটা জীবন বরবাদ করবো নিজ হাতে? কখনোই পারবো না আব্বু। এমনকি আমি দ্বিতীয়বার আর বিয়েও করতে চাইছি না। মাফ করো আমাকে।”

“আমার আসমাটা যাওয়ার পর থেকে যন্ত্রমানব হয়ে গেছো তুমি। তোমার সাথে কথা বললে মনে হয়, মানুষর সাথে না, মেশিনের সাথে কথা বলছি। এরকম হইয়ো না বাজান। তোমার আম্মা, তিতান, আমরা সবাই কষ্ট পাবো। আমাদের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হইয়ো না।”
জাহিদ গাজীর কন্ঠে আকুতি। বুড়ো মানুষটা বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। আগের মতো তেজ আর নেই। এমনিতেও নরম স্বভাবের মানুষ তিনি। সন্তান বলতে ছিল বড় মেয়েটা আর বর্তমানে ছোট বছর পনেরোর একটা ছেলে আছে। মেয়ে জামাইকে সবসময় ছেলের নজরে দেখেছেন তিনি। বছর তিনেক আগে মেয়ের মৃত্যুর পর প্রথম দুই বছরে বেশ ভালো যোগাযোগ ছিল তাদের। কিন্তু গত একবছরে যোগাযোগটা কমে এসেছে। এর কারণ, রুবায়েতের ব্যস্ততা। সন্তানের ভবিষ্যৎ গোছানোয় ভীষণ ব্যস্ত রুবায়েত। ছেলের নামে ডিপোজিট করে রাখছে। তাছাড়াও ঢাকা শহরে জমি ক্রয়ের প্রয়াস চলছে। যদিও এতো জলদি কোয়ার্টার ছেড়ে অন্য কোথাও শিফট করার আগ্রহ রুবায়েতের নেই। তবে সন্তানের ভবিষ্যত বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন সে। জাহিদ গাজী এসব কথা জানেন। আগের মতো আর দেখা-সাক্ষাৎ নাহলেও মাসের মধ্যে গুনলে দেখা যাবে পঞ্চাশ-ষাটবার ফোনে কথা হয় তাদের। তবে সামনাসামনি দেখতে না পাওয়ার আফসোস যে মেটে না। তার স্ত্রী সেলিমা নাতিকে দেখার জন্য আহাজারি করেন প্রায়-ই। জাহিদ গাজী বললেন,

“তোমাকে যখন আমরা চিনি, তখন তোমার অল্প বয়স। চিকনা গড়নের তালগাছের মতো লম্বা একটা ছোকরা। এরপর কেটে গেল সাতটা বছর। তখন তুমি দায়িত্ব নিতে নারাজ ছিলে। এখন তোমার কাঁধে অজস্র দায়িত্ব। এখন তুমি শক্ত-সামর্থ্য একজন পুরুষ। এই রুবায়েতকেই একসময় দেখতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের মেয়েটা নেই এখন।”
রুবায়েত কথা ঘোরাতে চাইলো। জানে, এসব কথা উঠলে আব্বুর বুকে ব্যাথা বাড়ে, অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। রুবায়েত তাড়া দিয়ে বললো,
“আব্বু, আমার একটু দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে আজ। তোমাকে কথা দিচ্ছি, এরমধ্যে আমি চেষ্টা করবো ছুটি নেওয়ার। এমনিতেও আমার সপ্তাহখানেকের লিভ ব্যালেন্স বাকি আছে। আমি সময় করে তোমাকে জানিয়ে দেবো। এখন ফোন রাখছি। মামনির, ইশরাফের আর নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ।”

রুবায়েত ফোন কেটে করিডোরে দাঁড়ালো। সামনের মাঠে প্যারেড হচ্ছে। অন্য দিনগুলোতে রুবায়েত এখানে অফিসার ক্যাডেটদের প্যারেড পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। আজ দায়িত্বটা অন্য কারো কাঁধে দেওয়া হয়েছে। তাই রুবায়েত আগেই বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। কাজের চাপে ছেলেকে সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না সবসময়। আজ যেহেতু সময় এবং সুযোগ পেয়েছে, তাই কাজে লাগানো উচিত বলে মনে হলো। রুবায়েত ভবন থেকে নেমে গেইটের দিকে হাঁটা ধরলো। এখান থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই ঘুরে গিয়ে পেছনের রাস্তায় আর্মি আবাসিক কোয়ার্টার। পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়।

রুবায়েত অনবরত কলিংবেল বাজিয়েই চলেছে। আজ দরজা খুলতে এতো দেরি করছে কেন কে জানে! রুবায়েতের আর তর সইছে না। তার ছেলে এতো দ্রুত তাকে বাড়ি ফিরতে দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। খুশিতে সোফার ওপর দাঁড়িয়ে লাফালাফি করবে। তারপর রুবায়েতকে টেনে ধরে নিয়ে বসিয়ে হলা জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে গালে। আদর করে চুল টেনে দেবে। তার মিষ্টি কন্ঠে আধো আধো গলায় কথা বলবে। তারপর বাপ-বেটা মিলে ক্রিকেট ম্যাচ দেখবে। আজ সম্ভবত বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ আছে। রুবায়েত নিজ হাতে আজ তার ছেলের পছন্দের পাস্তা রান্না করবে। দু’জনে একসাথে বসে খাবে আর ম্যাচ উপভোগ করবে।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান রুবায়েত চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে নিলো সবটা। অতঃপর – · ততক্ষণে এসে দরজা খুললেন আয়েশা খানম। রুবায়েতকে দেখেই চমকে উঠলেন তিনি। দরজার সামনে রুবায়েতকে দেখে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালঘড়িতে সময় দেখলেন। সবে তিনটা বাজে। এতো দ্রুত ফিরবে তা ভাবতেও পারেননি তিনি। চমক এবং ভয়টা বেশিই ছিল। এবার একটা তুলকালাম নিশ্চয়ই হবে। রুবায়েতের মুখে সামান্য হাসি ছিল। মায়ের অমন আতঙ্কিত মুখ দেখে হাসিটা মিলিয়ে গেল। কিছু কি হয়েছে!

রুবায়েত পাশ কাটিয়ে দ্রুত ঘরের ভেতর প্রবেশ করে উঁকিঝুুুঁকি দিতে দিতে আম্মা’কে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলো,
“লাড্ডু কোথায় আম্মা? ওকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
প্রশ্ন করেই জবাবের অপেক্ষা না করে রুবায়েত সোফায় বসে পায়ের মোজা খুলতে খুলতে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো,
“লাড্ডু? লাড্ডু? কোথায় তুমি? বাইরে আসো বাপ। পাপা এসেছে। দেখে যাও।”
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। রুবায়েতের এবার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হলো। ভ্রু কুঁচকে সামনে আতঙ্কিত হয়ে দাঁড়ানো মায়ের মুখের দিকে তাকালো। স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসা করলো,

“লাড্ডু কোথায় আম্মা?”
“লাড্ডু. . .– লাড্ডু তো তাজরীনের সাথে।”
“ও আচ্ছা! তাজরীনের সাথে? ওদের ফ্ল্যাটে?”
দাঁতে দাঁত পিষে যথেষ্ট শান্ত থাকার চেষ্টা করলো রুবায়েত। আয়েশা খানম অপরাধীর ন্যায় মুখে ছোট্ট করে জবাব দিলেন,
“না। কমিউনিটি সেন্টারে।”
“মানে?!”
“তাজরীনের সাথে কমিউনিটি সেন্টারে গেছে। তহুরার বিয়ের অনুষ্ঠানে।”
রুবায়েত কিছুক্ষণ একটানা স্থির চাহনিতে তাকিয়ে থাকলো তার আম্মা’র দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বিরবির করলো,
“কমিউনিটি সেন্টারে না! ওকে!”
রুবায়েত উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। আয়েশা খানম প্রথমে বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা। সেখানেই সোফায় বসে পরলেন। মিনিট পাঁচেক পরে যখন রুবায়েত সামরিক পোশাক পরিবর্তন করে সিভিল পোশাকে ঘর থেকে বের হয়ে এসে কোনোকিছু না বলেই সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল, তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন তিনি৷ রুবায়েত রাগের মাথায় ফোনটাও ফেলে রেখে গেছে টি-টেবিলের ওপর।

তিতান স্টেজে তাজরীনের কোলে বসে সামনের নাচ-গান দেখছিল। তহুরার কাজিনরা নাচ-গান করছে। তিতান এই গান-বাজনা উপভোগ করছে বেশ। কতক্ষণ পরপর খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠছে। তাজরীন তহুরার পাশে বসে আছে। তিতানের খুশি দেখে ওর-ও খুব আনন্দ হচ্ছে। তাজরীনের মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল। তখনই হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে উঠলো। স্ক্রিনে দেখলো, ফোন নাম্বারটা অচেনা। তিতানকে তহুরার পাশে বসিয়ে দিয়ে উঠে গেল তাজরীন। স্টেজের পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই অপর পাশ থেকে যেন ঘূর্ণিঝড় উঠলো। একটা ছেলে কন্ঠ একটানা বলতেই লাগলো, “স্যরি তাজরীন। আমাকে মাফ করে দাও। এমন ভুল আর কখনো করবো না। সত্যি বলছি। আর কখনো তোমাকে কথা শোনাবো না। তোমার অতীত নিয়ে কথা তুলবো না। তোমার আগের বিয়ে ভেঙে গেছে, তোমার কখনো বাচ্চা হবে না— বলে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি – এসব কথাও কখনো বলবো না। আর জীবনেও না। কান ধরছি, বিশ্বাস করো। তুমি আমাকে ফিরিয়ে নাও প্লিজ। তোমাকে জীবনেও কষ্ট দেবো না।”

ছেলে কন্ঠটা তাজরীনের পরিচিত। এশরাক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল করেছে ওকে। কতবড় সাহস! তাজরীন সব জায়গা থেকে এশরাককে ব্লক করেছে। যে ছেলে বিয়ের আগেই ওকে খোঁটা দেয়, তাকে অনন্ত বিয়ে করে পস্তানো উচিত নয়। একটি ভুল, সারাজীবনের কান্না। তাজরীন কাঁদতে চায় না। বরাবরই সুখী মানুষ তো সে। বরং তাকে যারা কাঁদাতে চাইবে, তাদেরকে কাঁদিয়ে ছাড়ার ক্ষমতা সে রাখে। অবলা নয়, অনাদরেও বড় হয়নি। তবে কেন মানুষের দয়া নেবে?
তাজরীন শক্ত গলায় বললো,

“এশরাক, তোমার স্বভাবটাই এমন। এর আগেও কয়েকবার তুমি আমার সাথে এরকম আচরণ করেছো। আমার অতীত আর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কষ্ট দিয়ে কথা বলেছো। আমি যখন কঠিন হয়েছি, তখন তুমি আবার সুযোগসন্ধানী হয়েছো, ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করেছো। কিন্তু তুমি ভালো মনের মানুষ নও এশরাক। ভালো মনের মানুষেরা কখনো কাউকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কথা বলে না। সেখানে তো আমি তোমার জীবনসঙ্গিনী হতে চলেছিলাম! তাহলে নিজেই ভাবো, বাকিটা জীবন তুমি আমাকে কতোটা দুর্দশাতেই না রাখতে! আসলে তোমাদের মতো মানুষেরা কখনো ভালো হয় না। শুধুমাত্র ভালো সাজার নাটক করে।”
“আমি সত্যি বলছি তাজরীন। তোমাকে আমি ভালোবাসি।”
“আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না। আর না তো তুমি আমাকে ভালোবাসো। ভালোবাসার মানুষকে কেউ কখনো তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতায় আঘাত করে কথা বলতে পারে না। আমাদের পারিবারিকভাবেই বিয়ে ঠিক হয়েছিল। এবং পারিবারিকভাবেই বিয়েটা ভাঙার ব্যবস্থা করেছি আমি। তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ফোন রাখো।”
“তাহলে তোমাকে বিয়েটা করবে কে?”

“এইতো তোমার আসল রূপ! এটাই দেখতে চেয়েছিলাম আমি। শোনো, কেউ না বিয়ে করুক আমাকে। করলেও সম্মানের সহিত, কোনোরকম দয়া না দেখিয়ে আমার সব সমস্যা জেনে যদি করতে পারে, তবে করুক। নচেৎ সারাজীবন কুমারী থাকবো। মাদার তেরেসা হবো। তবু তোমার মতো কুলাঙ্গারের বাচ্চাকে বিয়ে করবো না। ফোন রাখ অথর্ব!”

আবার বসন্ত পর্ব ৩

তাজরীনের মেজাজটাই বিগড়ে গেছে। জোরে চাপ দিয়ে কল কাটলো ও। স্টেজের পেছন থেকে ঘুরে সামনে যাওয়ার জন্য নেমে দাঁড়াতেই কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো তাজরীন। অবশ্য চমকে ওঠার-ই কথা। এরকম পরিস্থিতিতে সবাই চমকে উঠবে। যাকে দেখার আশা করেনি, সেই ব্যক্তির উপস্থিতি এখানে। তাজরীন আশ্চর্য হওয়ার চাইতেও বেশি ভয় পেল। রুবায়েতের মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। রাগ না শান্ত ভাব, ওই মুখ দেখলে তা বোঝাও যাচ্ছে না। খেয়াল করলে দেখা যায়, নিচের ঠোঁট দ্বারা ওপরের ঠোঁট চেপে ধরে সম্ভবত মেজাজ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে, হাত মুষ্টিবদ্ধ। যেকোনো মুহূর্তে যে কাউকে ঘুষি মে’রে বসতে পারে। কিন্তু তাজরীনকে যে মারবে না– · এতটুকু নিশ্চিত ও। রুবায়েত দূরত্ব বজায় রেখেই শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
“আমার ছেলে কোথায়?”
এই শান্ত কন্ঠস্বরও তাজরীনের হৃদয়ে ঝড় তুললো। ওর কপালে যা থাকে, থাকুক। না জানি, লাড্ডুর কপালে কি আছে!

আবার বসন্ত পর্ব ৫