আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১৪

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১৪
তানহা ইসলাম বৈশাখী

রাত বাজে প্রায় নয়টা। অর্নবরা একটু আগেই বেড়িয়ে গেলো প্রার্থদের বাসা থেকে। পুষ্প তাদের খাবারের ব্যাবস্থা করতে চেয়েছিলো কিন্তু কেউই তাকে কিছু করতে দেয়নি। ওরা না খেয়েই চলে গেছে। শুধু চা টুকুই খেয়েছিলো।
পুষ্প এখন প্রার্থর জন্য খাবার তৈরী করছে। সে নাকি এখন কিছুই খাবে না তাই পুষ্প আজ রাতেও স্যুপ করে নিচ্ছে। জোর করো ঠুসে ঠুসে খাইয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে। আর খাওয়ানোর জন্য কাজে লাগাবে পূর্নিমা বেগমকে। মায়ের সামনে না খেয়ে যাবে কই?
স্যুপ বানিয়ে উপরে চলে আসলো পুষ্প। সাথে তার পিছে পিছে এলাচিও এসেছে।
প্রার্থ খাটে বসা ছিলো। এলাচিকে দেখেই নাক সিকোয় তুলে বললো।
“-এটাকে কেন আমার রুমে এনেছিস? সরা এখান থেকে।
পুষ্প নিচে তাকিয়ে দেখলো এলাচি তার পায়ের সাথে ঘেষে আছে। স্যুপের বাটিটা টেবিলের উপর রেখে এলাচিকে কোলে তুলে নিলো। বললো।

“-ওকে নিয়ে আপনার কেন এত সমস্যা? আপনার এলার্জি আছে বিড়ালে? নেই তো। তারপরও কেন দেখতে পারেন না ?
“-ওকে দেখলেই আমার এলার্জি হয়। তুই রুমের বাইরে দিয়ে আয় ওটাকে এক্ষুনি। লোম দিয়ে পুরো রুম মাখিয়ে ফেলবে।
“-আমি যেখানে থাকবে এলাচিও সেখানে থাকবে। আপনার প্রবলেমে আমাদের কিছু যায় আসে না। ওর লোম নরম নয় শক্ত। কোথাও মাখাবে না।
“-তুই সরাবি?
পুষ্পও তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে বললো।
“-না
পূর্নিমা বেগম থামিয়ে দিলেন ওদের। বললেন।
“-প্রার্থ। ছোট্ট বিড়ালটাকে নিয়ে সবসময় এমন করিস কেন? ওকে ওর মতো থাকতে দে। এখন কি ওর জন্য তোরা স্বামী স্ত্রী মিলে ঝগড়া করবি নাকি?
পুষ্প সুযোগ লুফে নিয়ে বললো।
“-তোমার ছেলেকে বোঝাও বড়আম্মু। আমার এলাচি নিয়ে কথা বললে আমি ছেড়ে দিবো না।
প্রার্থ চোখ উল্টিয়ে বললো।
“-তোকে ধরে রাখতে বলেছে কে?
পূর্নিমা বেগম আবার বললেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-কি শুরু করলি? এই পুষ্প ওকে আগে খাইয়ে দে তো। ওষুধও দিতে হবে তো।
“-মা। আমি ছোট বাচ্চা নই। আমি নিজে খেতে পারবো।
“-তা তো পারবিই কিন্তু বউয়ের হাতে খাবার খেলে ভালোবাসা বাড়ে।
প্রৌঢ়ার এমন কথায় দুজনেই অস্বস্তিতে পরে গেলো। এক সঙ্গে দুজনের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। পুষ্প মনে মনে বললো। “খাইয়ে দিলে যদি ভালোবাসা হতো তাহলে তাকে খাইয়ে খাইয়েই মারতো। ভালোবাসাই নেই আবার বাড়বে কি করে?” এদিকে প্রার্থর কথাটা শুনে কেমন কেমন লাগলো। যেটা তার চাই না সেটাই কেন বারবার জীবনের সাথে আটকে যেতে চায়। কারো ভালোবাসা চায় না সে। তবুও ভালোবাসা নামক জিনিস তার পিছু ছাড়ছে না।
পুষ্প দাড়িয়ে আছে বলে পূর্নিমা বেগম আবার তাগাদা দিলেন খাওয়ানোর জন্য। পুষ্প এলাচিকে নিচে নামিয়ে স্যুপের বাটিতে হাত দিতে যায় ওমনেই প্রার্থ বলে উঠে।

“-আগে নিজে পরিষ্কার হয়ে আয়। তোর গায়ে তোর বিড়ালের লোম লেগে আছে।
পুষ্প রেগেমেগে চলে গেলো ওয়াসরুমে। হাত ধুয়ে আবার আসলো। প্রার্থ ভ্রু কুচকে বললো।
“-শাড়ী বদলে এলি না কেন? শাড়ীতেও লেগে আছে।
পুষ্প কোন বাক্য ব্যায় না করে স্যুপের বাটিটা উঠিয়ে নিলো। প্রার্থর মুখের সামনে ধরে বললো।
“-এত ঢং আমি করতে পারবো না। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। আপনাকে খাইয়ে বড় আম্মুকেও ওষুধ দিতে হবে। আপনার গায়ে আবার জ্বর আসছে। তাড়াতাড়ি হা করুন।
প্রার্থ বাধ্যের ন্যায় হা করলো। পুষ্পর পুরোটা খাইয়ে দেওয়া পর্যন্ত পূর্নিমা বেগম সেখানে বসে রইলেন। দুজনকে এভাবে দেখলে আর অন্তর জুরিয়ে যায়। সে যে ছেলে মেয়ে দুজনকে এক করে কোন ভুল করেনি তাতেই তার গর্ববোধ হয়। ওদেরকে একসাথে সুখী দেখতে পারলেই তার সুখ। প্রার্থটাকে নিয়েও তার কোন চিন্তা থাকবে না। এই বৃষ্টির জ্বর নিয়ে কত চিন্তায় থাকতো। কে দেখবে তার ছেলেটাকে? ওরকম জ্বরে ভালোমতো সেবাযত্ন না করলে সহজে ঠিক হয় না ছেলেটা৷ কিন্তু এখন পুষ্প আছে। সে থাকতে আর কোন চিন্তা করার দরকারই নেই তার। পুষ্পর কাছে প্রার্থকে দিয়ে এখন চিন্তামুক্ত সে। তার মতে প্রার্থও একইভাবে পুষ্পর সেবা যত্ন করে এবং ভালোবাসে। এজীবন এখন এখানে ইতি টানলেও সমস্যা নেই। জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে গেছে তার। কোন কিছু না পাওয়ার আফসোস নেই আর।

প্রার্থর শরীরে আবার জ্বর এসে গেছে। দুদিন ধরে একই অবস্থায় আছে। একবার বাড়ে আবার একটু কমে আবার বেড়ে যায়। ডাক্তার এনেও কাজ হলোনা। ওষুধ খাইয়েও কিছু হচ্ছে না। যা তা-ই হয়ে আছে। রাতের দিকে যেন জ্বরটা আরো বেড়ে যায়। মাত্র কিছুক্ষণ আগে পুষ্প ওষুধ খাইয়ে রেখে গেছে ওকে। তার মাঝে আশরাফ এবং অহনা বেগম এসেছিলেন একবার প্রার্থর সাথে দেখা করতে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই অফিস থেকে একসাথে ফিরেছে। এসেই প্রার্থকে দেখে গেছে। তখনও গায়ের তাপমাত্রা আনুমানিক কম ছিলো। এখন নিচে সবকিছু গুছিয়ে, খাবার খাইয়ে এলো সবাইকে। শুধু অন্ত বাদে। সেই যে সন্ধ্যার সময় দোর বন্ধ করেছে এখনো খুলেনি। খাবার খেতে ডাকলে বলেছে খিদে পায় নি। ভালো লাগছে না বলে আর বের হয়নি। পুষ্পও আর বেশি ঘাটতে যায়নি তাকে।
সবকিছু ঠিকঠাক করে রুমে এসে দেখে আবার প্রার্থর গা কাপিয়ে জ্বর উঠে গেছে৷ কম্বল গায়েই কাপছে ছেলেটা। চোখ বুজে আছে। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে।পুষ্প কাবার্ড থেকে আরো একটা কম্বল এনে উপর দিয়ে দিয়ে দিলো। কপালে হাত দিয়ে চেক করলো। তাপমাত্রা অনেকটাই বেশি মনেহচ্ছে। প্রার্থর চুলগুলোকে পুষ্পর কোমল হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে তার ঘুমন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বললো।

“- আজ আর কাছে আসবো না প্রার্থ ভাই। কাছে আসলে দূরে যেতে বেশি কষ্ট হবে। আপনি আমাকে আরো দূরে ঠেলে দিন যাতে আপনাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট না হয়। মৃত্যুর যন্ত্রনা থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রনা বেশি কষ্টদায়ক। হোক সেটা একপাক্ষিক ভালোবাসা আর একপাক্ষিক বিচ্ছেদ। কষ্ট তো যে ভালোবাসে তাকে পেতেই হয়।
চোখে টলটল করা অশ্রু কয়েকটা পলক ঝাপটে শুষে নিলো। কথায় কথায় চোখটা বেহায়া হয়ে যায়৷ সবকিছুতেই পানি ছেড়ে দেয়। জীবনে চলতে গেলে এত অশ্রু বিসর্জন দিলে চলে? কিছু কিছু সময় অশ্রুকণাও বাচিয়ে রাখতে হয়।
পুষ্প গিয়ে একটা বোলে করে পানি আর জলপট্টির জন্য কাপড় নিয়ে এলো। পানিটাকে বেডসাইড টেবিলে রেখে পুষ্প বেডের উপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো। পানিতে কাপড় চুবিয়ে সেটা ভিজিয়ে উঠিয়ে প্রার্থর কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো। যদিই তাপমাত্রা একটু কমে।
এরই মাঝে প্রার্থ বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো। পুষ্প বুঝলো না তার কথা৷ আরেকটু এগিয় গিয়ে বললো

“-কিছু লাগবে আপনার? কি বলছেন?
প্রার্থর ঠোঁট দুটো নড়ছে। কথা স্পষ্ট নয়। জ্বর এলে যে প্রার্থ আবোল তাবোল বলে সেটা ভলো করেই জানে পুষ্প। সে আরো একটু এগিয়ে গেলো। কান পেতে শুনলো কি বলছে। প্রার্থ তখন অস্পষ্ট আওড়ালো।
“-অর্নব।
পুষ্পর মেরুদন্ড সোজা হয়ে গেলো। হঠাৎ অর্নবের নাম কেন নিচ্ছে? অর্নব ভাইয়ের কথা কি তাহলে সত্যিই। সত্যিই সে অর্নব ভাইয়ের প্রতি জেলাস? অর্নব ভাই যাওয়ার আগে বারবার পুষ্পকে বলে গেছে প্রার্থর মাঝে কোন পরিবর্তন খেয়াল করলে জানাবে। বা আমাকে নিয়েও যদি কিছু বলে তাহলেও জানাবে।
আবার যতক্ষণ অর্নবরা এখানে ছিলো ততক্ষণ অর্নব পুষ্পর সাথে সাথে থেকেছে। কোন না কোন বাহানায় সবার সামনে তাকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেছে। এগুলো যে কারো চোখ এড়ায়নি তা নয় সবাই দেখেছে। কিন্তু সবাই নেগেটিভলি নেয়নি তবে অর্নব চায় প্রার্থ যেন বিষয়গুলো নেগেটিভ নেয়। তবেই না সব বুঝবে।
প্রার্থর মুখে অর্নবের নাম শুনে আবার ডাকলো তাকে।

“-প্রার্থ ভাই কি বলছিলেন আবার একটু বলুন।
প্রার্থ চোখদুটো হালকা খুলে তাকালো সামনে। সামনে পুষ্পর মুখটা দেখতে পেলো। বললো রূগ্ন গলায়।
“-আর কাউকে ভালোবাসতে চাই না। চলে যা।
পুষ্পর বক্ষঃস্থল থমকে গেলো। মাথায় বাড়ি খেলো কথাটা। আর কাউকে ভালোবাসতে চায় না। তার মানে সমৃদ্ধি আপু এখনো মেটার করে তার লাইফে। কিন্তু আজ যখন অর্নবকে জিজ্ঞেস করলো সমৃদ্ধির ব্যাপারো তখন তো সে গ্যারান্টি দিয়ে বললো সে সমৃদ্ধির কোন অস্তিত্ব নেই প্রার্থর জীবনে।
পুষ্প দুটো শুকনো ঢোক গিলে কাপা স্বরে বললো।
“-সমৃদ্ধিকে ভালোবাসেন?
প্রার্ধ আধো খোলা চোখে পুষ্পর দিকে চেয়েই বললো।
“-ওর নাম নিবিনা। ও প্রতারক, ধোকাবাজ। ভালেবেসে শুধু প্রতারণা পেয়েছি আর কাউকে জীবনে ভালোবাসবো না।

“-একজনের কাছ থেকে প্রতারণা পেয়েছেন বলে কি সবাই প্রতারণা করবে এমন কোন কথা আছে? কেউ কেউ তো ভালোবেসে আগলে রাখতেও জানে। একবার ভালোবেসে ধোকা পেয়েছেন দ্বিতীয়বার ভালোবেসেই দেখুন।
ফার্স্ট লাভ ইজ ইম্পর্টেন্ট। বিকজ ফার্স্ট লাভ চেঞ্জ ইউর নেচার। বাট সেকেন্ড লাভ! সেকেন্ড লাভ উইল চেঞ্জ ইউর হোল লাইফ।
দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েই দেখু্ন। জীবন বদলানোর দায়িত্বটা নাহয় আমিই নিলাম।
প্রার্থ আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পুষ্পর দিকে৷ এরপর আবার চোখদুটো বুজে ফেললো। পুষ্প তপ্ত শ্বাস ফেলে মাথায় জলপট্টি দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
মরুর বুকে গাছ লাগানোর চেষ্টা করছে সে। মরুর ওই তপ্ত খরখরে বালুর উপর কি গাছ লাগানো সম্ভব?পানি ছাড়া কি গাছ আদৌ বাচবে?

তবুও পুষ্পর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। কে বলতে পারে যদিই কোন মিরাকল হয়ে যায়।
হঠাৎ প্রার্থ বেডে থাকা পুষ্পর হাত চেপে ধরলো। পুষ্প ধ্যানের সুতো ছিড়ে বেড়িয়ে এলো। প্রার্থর শক্ত হাতের মুঠোয় ধরে থাকা হাতটার দিকে তাকিয়ে হেয়ালি হেসে বললো।
“-আপনি কিন্তু এভাবেই মায়া বাড়াচ্ছেন। শেষে ছেড়ে যেতে না পারলে আমার কোন দোষ নেই বলে দিলাম। একে তো কখনো বুঝবেন না আমাকে তার উপর এমন ছোট ছোট কান্ড করে মনটাকে মোম বানিয়ে ফেলছেন। একটু তাপ পেলেই গলে যাই। কবে যেন গলে গলে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাই। আপনি এগুলো আমার সাথে একদম ঠিক করছেন না।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১৩

শেষের দিকে এসে কন্ঠটা বুজে এলো। এতক্ষন ধরে আটকে রাখা চোখের জলও বাধ মানলো না। নরম গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোটা অশ্রু।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ১৫