আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬ (২)

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬ (২)
তানহা ইসলাম বৈশাখী

“ক্রনিক সাবডুউরাল হেমাটোমা”
ক্রনিক সাবডুরাল হেমাটোমা (Chronic Subdural Hematoma, cSDH) হলো মস্তিষ্কের ওপর জমে থাকা রক্তের এক ধরনের সঞ্চয়, যা ধীরে ধীরে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে গঠিত হয়। এটি সাধারণত মস্তিষ্ক ও মেনিনজেসের মধ্যে থাকা সাবডুরাল স্পেসে রক্ত জমার ফলে সৃষ্টি হয়।
এই রোগ সাধারনত মাথায় আঘাতের ফলে হয়ে থাকে। মাথায় আঘাত পেলে সেখানে ধীরে ধীরে রক্ত জমাট বাধতে থাকে। এবং এই জমাট বাঁধা রক্ত মস্তিস্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। চাপ সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে মস্তিস্ক বিকল করে ফেলে। এ ধরনের রোগের উপসর্গ সরূপ রোগীর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। এর লক্ষনসরূপ তীব্র মাথা ব্যাথা হয়, বমি হয়, ছোট ছোট বিষয় ভুলে যায় ও আচরন গত পরিবর্তন ঘটে।

এ রোগ ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে হবে। অপারেশন করে মস্তিষ্ক হতে জমাট বাঁধা রক্ত বের করতে হবে। নয়তো রোগী ব্যাক্তি কোমায় চলে যেতে পারে অথবা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
এইটুকু পড়ে অস্থিরতায় তরতরিয়ে উঠলো মন। এমন কঠিন রোগটাই কেন আল্লাহ প্রার্থর সুখ ফুলের মাঝে দিলো। এটা প্রার্থর কেন হলো না। আন্তত এত ভয়, দুশ্চিন্তা অস্থিরতা থেকে মুক্তি তো পেতে পারতো। যার মাঝে ধৈর্য্য বলতে কোন জিনিস নেই তাকে এ কেমন ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেললেন রব?
“ইয়া করীম, সাহায্য করুন। ধৈর্য্য দান করুন। আমার ফুলকে সুস্থতা দান করুন।”
মনে মনে আল্লাহ তায়া’লার কাছে ধৈর্য চাইছে, প্রেয়সীর প্রান ভিক্ষা চাইছে প্রার্থ। মহান রাব্বুল আলামিন-ই একমাত্র পারেন তার ফুলকে তার কাছে সুস্থ সবল ফিরিয়ে দিতে।
ল্যাপটপের স্ক্রীন থেকে চোখ সরিয়ে মাথাটা কাউচে হেলিয়ে দিলো প্রার্থ। সকাল সকাল বসেছে সে রোগের চোদ্দগুষ্টি চিনে নিতে। এ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত না জানলে এটাকে ট্যাকেল দেওয়া মুসকিল। যে কোন মূল্যেই তার ফুলকে তার চাই। চাই মানে চাই-ই। বাই হুক অর বাই ক্রুক। পুষ্প সারাজীবন প্রার্থর বুকেই থাকবে। আল্লাহ না চাইলে কেউ তার থেকে ফুলকে কেড়ে নিতে পারবে না। মহান রব সহায় হোন তাদের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-আপনার কফি।
প্রার্থ চোখ বন্ধ করে হেলে ছিলো কাউচে। হঠাৎ পুষ্পর শব্দ শুনে তড়িৎ গতিতে উঠে বসে। ঝটপট হাতে বন্ধ করে দেয় সামনে জ্বলজ্বল করা ল্যাপটপ। একটু নড়েচড়ে স্বাভাবিক হয়ে বসে।
পুষ্পর হাতে কফির মগ। সেটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে ফের বলতে নেয়,
“-আপনার কফি…!
মাঝপথেই আটকে যায় সে। চোখ যায় সামনের টেবিলের উপরের কফির মগটার উপর। সে কি! ওখানে কফি এলো কোথা থেকে? পুষ্প তো মাত্র নিয়ে এলো কফিটা।
পুষ্প সন্দিহান গলায় বললো।

“-কফিটা কি আপনি বানিয়ে এনেছেন? কষ্ট করতে গেলেন কেন? আমাকে বলতেন আমি করে দিতাম।
প্রার্থর ভেতরে চিনচিনে ব্যাথা হয়। গলা শুকিয়ে আসে। প্রথম কফিটা তো পুষ্পই এনে দিয়েছে ওকে। তারমানে কি সেকথা সে ভুলে গেছে? আল্লাহ! এর থেকে বড় শাস্তি বোধহয় আর মানুষের জন্য হতে পারেনা। একসময় যদি প্রার্থকেই ভুলে যায়, তখন কি করবে সে? মরে যাবে? নাকি প্রেমতৃষ্ণা নিয়ে বেঁচে থাকবে?
নাহ! আর ভাবতে পারে না প্রার্থ। এসব ভাবলেই ভেতর থেকে আউলিয়ে আসে। এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না। তাকে শক্তভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে সব।
“-কথা বলছেন না যে! কি হয়েছে?”

পুষ্পর কথায় ধ্যান ছুটে গেলো প্রার্থর। গলা খাঁকারি দিয়ে ভালো করে বসলো কাউচে। হাত বাড়িয়ে পুষ্পকে কাছে ডাকলো। পুষ্প কফিটা টেবিলে রেখে একটু কাছে এগিয়ে আসে। প্রার্থ তার খসখসে হাতের মুঠোয় পুষ্পর সুকোমল হাতটা চেপে ধরে আরো কাছে নিয়ে আসে। টেনে বসায় তার হাঁটুর উপর। দু’হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে।
“-কফিটা তুই এনেছিলি।
পুষ্প অবাক হয়ে বলে,
“-আমি এনেছি? কখন? আমি তো মাত্রই আপনাকে কফিটা দিতে এলাম।
প্রার্থ কাষ্ঠ হাসে। সে হাসিতে প্রান নেই। সে প্রসঙ্গ বদলাতে চায়। বলে,
“-বাদ দে। তুই আনা আর আমি আনা একই কথা। এখানে একটু বসে থাক। ভালো লাগছে।
“-এখন বসে থাকতে পারবো না তো। নিচে কাজ আছে।
প্রার্থ কঠিন চোখে তাকায়। গম্ভীর স্বরে বলে।
“-কিসের কাজ? আজ এখন এই মুহুর্ত থেকে তোর সব কাজ বন্ধ। একটা কাজে হাত লাগাবি বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।

পুষ্প এক ভ্রু উঁচু করে বলে,
“-আচ্ছা? হুমকি দিচ্ছেন? এরকম হুমকিতে কিন্তু আমি ভয় পাই না। ভয় পেলে আপনিই পাবেন। এখন চলেন বাবার বাড়ি রেখে আসেন অনেকদিন হয় আব্বু আম্মুকে দেখি না।
নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলো প্রার্থ। তার বোঝা উচিত ছিলো পুষ্প বাবার বাড়ি গেলে ছটফট করবে সে নিজে। শাস্তিটা পুষ্পর জন্য হবে না শাস্তিটা হবে তার নিজের জন্য। সে নিজের ভুল শুধরে নিলো ঝটপট। গলার শ্লেষ কাটিয়ে বললো,
“- আমি তেমনটা বলিনি। বেশি কথা শিখেছিস। বাবার বাড়ি যাওয়ার আগে পা কেটে রেখে দিবো।
পুষ্প ভাব নিয়ে বললো,
“-আবারও সেই ফাঁকা হুমকি। নিন পা আপনার সামনেই আছে। কেটে রেখে দিন।
আচ্ছা মুশকিলে পরলো তো। যা বলছে তারই হিতে বিপরীত হচ্ছে। প্রার্থ হতাশ শ্বাস ফেললো। পুষ্পকে যে দুটো কড়া কথা শুনাবে তা-ও করতে মন চায় না। গম্ভীরস্বরে শুধু বললো,
“-পাকনামি না করে চুপচাপ বসে থাক।
কথাটুকু বলে পুষ্পকে আরো ভালোভাবে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে পরে রইলো। পুষ্পও আর পাকনামি করলো না। চুপচাপ বসে রইলো প্রার্থর কোলে।

বেলা বাজে বারোটা। মাথার উপর সূর্য নেই। সকাল থেকে সেখানে মেঘেরা অবাধে ঘোরাফেরা করছে। বৃষ্টি হবে হবে ভাব তবে হচ্ছে না। কখন যেন হুট করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পরবে।
অর্নব স্নেহাকে নিয়ে শপিংয়ে এসেছে। বিয়ের পর তো কেটে গেলে দু-তিনদিন। অর্নবের মা তাই জোর করে ছেলে, ছেলে বউকে পাঠিয়ে দিলো কেনাকাটা করতে।
কিন্তু এখানে এসে অর্নব চরম বিরক্ত। বিরক্ত তার স্ত্রী নামক মেয়েটার উপর। মেয়েরা নাকি শপিংয়ের পাগল। ফ্রীতে শপিং করলে পারলে দোকানের সব লুটে নিবে তারা। কিন্তু এখানে তো সব বিপরীত যাচ্ছে। সেই সকালের দিকে এসেছে মলে অথচ মেয়েটা কিছু কিনতেই চাইছে না। মোটে কয়েকটা ড্রেস কিনেছে তাও অর্নবের জোরাজুরিতে। অর্নব নিজেই পছন্দ করে দিয়েছে। তার নাকি কোন পছন্দ নেই। অর্নব যা দিবে তাই নিবে।
এবার তারা যাচ্ছে জুতার সেকশনে। অর্নব দ্রুত পায়ে হাটছে। তার পাশে পাশে পা মিলিয়ে এক প্রকার দৌঁড়ে দৌঁড়ে হাটছে স্নেহা। অর্নবের পায়ের সাথে পা মেলাতে বেগ পেতে হচ্ছে। সেদিকে অর্নবের খেয়াল নেই। হাতে তিনটে শপিং ব্যাগ নিয়ে চোখে সানগ্লাস পড়ে হেঁটে যাচ্ছে সে।

হঠাৎ একজন লোকের সাথে সামান্য ধাক্কা লাগলো স্নেহার। লোকটা না দেখার ভান করে চলে যায়। কিন্তু দাঁড়িয়ে যায় স্নেহা। বাঁ-হাত দিয়ে ডানহাতের বাহু ঘসতে থাকে। ধাক্কা সামান্য হলেও ব্যাথা পেয়েছে হাতে।
অর্নব বুঝলো সাথে স্নেহা নেই। সে তড়িৎ পেছনে ঘুরে তাকায়। দেখে স্নেহা হাত ডলছে। পেছনে লোকটাকে যেতে দেখে বুঝলো ধাক্কা লেগেছে।
অর্নব এগিয়ে এসে বললো।
“-কি হয়েছে? ধাক্কা লেগেছে? বেশি ব্যাথা পেয়েছো? আ’ম স্যরি।
স্নেহা বিস্ময় নিয়ে শুধায়,
“-আপনি কেন স্যরি বলছেন?
“-আমার তোমাকে সাথে নিয়ে হাটা উচিত ছিলো। এবার এসো। সামনে আরো ভীর। আমার সাথে সাথে চলো।
অর্নব আর স্নেহার আসার অপেক্ষা করলো না। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে হাত ধরলো। স্নেহার নরম তুলতুলে আঙ্গুলের ফাক গলে অর্নবের খসখসে হাত খুব সহজেই জায়গা করে নিলো। যত্নসহকারে ধরে এগিয়ে গেলো সামনে।
স্নেহা মাথা উঁচু করে বিমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সুদর্শন ছেলেটার দিকে। তাদের মাঝে স্বামী স্ত্রীর মতো খুব স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক না থাকলেও মোটামোটি একটা পর্যায়ে আছে। আর অর্নব যা কেয়ারিং হাসবেন্ড তাতে করে স্বাভাবিক সুন্দর একটা সম্পর্কে অবতরণ করতে খুব একটা সময় লাগবে না। একটু ধৈর্য্য ধরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছে প্রার্থ। আজ সারাদিন বাড়িতেই ছিলো সে। সকাল থেকে আকাশটা গুমোট বেঁধে আছে বলে পূর্নিমা বেগম আর ছেলেকে বাহিরে বের হতে দেননি। ছেলের জ্বর নিয়ে প্রচুর চিন্তা বৃদ্ধার। প্রার্থও তার এই আদেশগুলো যথাযথ পালন করার চেষ্টা করে। আজ অবশ্য আরও একটা কারনে সে বাড়িতে আছে। সারাদিন বাড়িতে থাকলে পুষ্পর যত্ন নিতে পারবে ঠিকমতো। দেখে দেখে রাখতে পারবে। ডাক্তার বলেছে তাকে সাবধানে রাখতে। স্ট্রেস যেন না নেয় সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে বলেছে। নয়তো বাচ্চা এবং পুষ্প দুজনেরই ক্ষতি। প্রার্থ চেষ্টা করছে যেন পুষ্পকে সবসময় হাসিখুশি রাখা যায়।

দুপুরের খাবার খেয়ে পুষ্পকে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রার্থ এখন মাকে রুমে দিয়ে নিজেও চলে যাচ্ছে রুমে।
রুমের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো প্রার্থ। পুষ্প জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দুহাত গ্রিলের ফাক গলিয়ে বাইরে দিয়ে রেখেছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে কিছুক্ষন আগে। সেইনবৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে হাত বাড়িয়ে। মনের আনন্দে ঠোট প্রসারিত করে হাসছে। ইশশ!বৃষ্টির ফোটাগুলো হাতে নিতে কি আনন্দ টাই না হচ্ছে।
পুষ্পর সুন্দর আনন্দমুখর আদলটি অদূরে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ দেখে গেলো প্রার্থ। অতঃপর নিশ্বব্দে এগিয়ে গেলো সামনে। ঠিক পুষ্পর পিঠের কাছে এসে দাঁড়ালো। পেছন থেকে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে শুধালো,

“-ভিজবি?
হঠাৎ শব্দে চমকে তাকায় পেছনে। প্রার্থকে দেখেই গালে হাসি টানে পুষ্প। জিজ্ঞেস করে,
“-আপনি? কখন এলেন।
“-এখন। ভিজবি বৃষ্টিতে?
পুষ্প সহাস্যে মাথা দোলায় উপড় নিচ। অর্থাৎ সে ভিজতে চায়। পরপর আবার দু’পাশে মাথা নেড়ে না বোঝায়।
প্রার্থ তার কনফিউশান হওয়া দেখে হাসি চেপে রেখে বলে,
“-কেন?
পুষ্প মিয়িয়ে গিয়ে বলে,
“-আপনি বকবেন।
“-বকবো না চল।

কথাটা বলেই পুষ্পর হাত ধরে হেঁটে যায়। পুষ্প জিজ্ঞেস করে ” কোথায় যাচ্ছে? কি করবে? কেন যাচ্ছে? ” কিন্তু প্রার্থর একটারও উত্তর দেয় না। চুপচাপ হেঁটে চলে। সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় সে। হুট করে পুষ্পকে কোলে তুলে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠে যায়।
পুষ্প ভাবে প্রার্থ বোধহয় তাকে একা নামিয়ে দিবে ছাদে ভেজার জন্য কিন্তু তাকে ভুল প্রমান করে প্রার্থ নিজেরও দাঁড়িয়ে পরে বৃষ্টির মাঝে। পুষ্প বিস্মিত হয়ে বড় বড় চোখ করে বলে,
“-একি! কি করছেন? আপনি কেন ভিজছেন? নামান আমাকে আমি একা ভিজতে পারবো। আপনি প্লিজ ভিজবেন না আপনার জ্বর হবে।
প্রার্থ পুষ্পকে নিচে নামিয়ে বলে।
“-কিছু হবে না। হলে তুই আছিস না? তুই সেবা করবি।

এতক্ষণ দুজনের শরীর ভিজে জুবুথুবু। এই নিয়ে দুবার প্রার্থকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখছে পুষ্প। ছেলেরা বৃষ্টিতে ভিজলে কি একটু বেশিই সুন্দর লাগে? নাকি তার ব্যাক্তিগত পুরুষটাই একটু বেশি সুন্দর?
প্রার্থর সৌন্দর্যও পুষ্পকে আটকাতে পারলো না। সে প্রার্থকে ঠেলে দিয়ে বললো।
“-আপনি প্লিজ চলুন এখান থেকে। আমাদের কাউকে ভিজতে হবে না। সারাদিন বাড়িতে থেকে তাহলে কি লাভ হলো? এভাবে ভিজলে ১০৪° জ্বরে ভুগবেন আপনি। আজকেই গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসবে দেখবেন। আপনি জানেন জ্বর হলে আপনার কি অবস্থা হয়? প্লিজ চলুন প্রার্থ ভাই। আপনাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে আমার ভালো লাগে না।
পুষ্প কথা বলে যাচ্ছে প্রার্থকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার সেদিকে খেয়াল নেই। তার চোখ আটকে আছে ওই কোমলমতি ঠোঁট জোড়ার দিকে। যেটা অনবরত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে সে। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মুছে যাওয়া গোলাপ রাঙা ওষ্ঠ জোড়া বড্ড আকৃষ্ট করছে তাঁকে। সে ধীরে এগিয়ে যায় সেদিকে। হঠাৎ তার এগিয়ে আসা দেখেই থেমে যায় পুষ্প। প্রার্থ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তাদের মাঝের সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে পুষ্পর সুকোমল ওষ্ঠপুটে নিজের মসৃণ অধর ডুবিয়ে দেয়।

বৃষ্টির পানির সাথে ধুয়ে মুছে দিতে চায় ভেতরের সমস্ত দুঃখ, ক্লেশ এবং ক্লান্তি। সেখানে খুঁজে পেতে চায় একটু শান্তি। মন চাইছে, সময়টা এখানেই থেমে যাক। দুঃখগুলো এখানেই বিনাশ হোক। সুখগুলো এসে ধরা দিক তাদের হাতের মুঠোয়। হারানোর ভয় নামক ভিতী থেকে মুক্ত হোক সে।
কিন্তু এসবের কিছুই হয় না। খানিকক্ষণ বাদে প্রার্থ সরে আসে। কপাল ঠেকায় পুষ্পর কপালে। তার ছোট সুন্দর মুখটা নিজের দুহাতের আজলায় পুরে প্রার্থ বলে,
“-আমার কিছু হবে না ফুল। তুই ঠিক থাকলেই আমি ঠিক। তোর সুখে আমার জান কুরবান।
পুষ্প কপাল উঠিয়ে তাকায় প্রার্থর চোখে। সে চোখে তাকিয়ে থেকেই বলে।
“-জান তো চাই না। আমার তো আপনাকে চাই।
প্রার্থ তার মসৃণ কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“-তাহলে এই আমিটাই আমার ফুলের নামে কুরবান।

বিকেল তিনটা। প্রিয়ার কলেজ ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু এখনো বাসায় যেতে পারছে না সে। কলেজের গেট মাড়িয়ে গেটের সামনে আসতেই শুরু হলো তুমুল বর্ষণ। প্রিয়া দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে একটা টং দোকানের সামনে। এখনো বৃষ্টি কমার নাম নেই। এদিকে রিক্সাও পাচ্ছে না একটাও। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হওয়ার উপক্রম। ঠিক তখনই পায়ের সামনে এসে একটা রিক্সা থামলো। প্রিয়া ভরকে যায় এতে। সামনে তাকাতে দেখে অন্ত হুট তোলা রিক্সার ভেতরে বসে। বৃষ্টিতে অর্ধেক শরীর ভিজে গেছে। ভার্সিটি থেকে ফিরছিলো বোধহয়।
সে মাথাটা একটু বের করে প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বললো।
“-প্রিয়া! উঠে আয়।
প্রিয়া উঠে না। দুপাশের জামা খামচে ধরে দুহাতে। প্রিয়ার এত সাহস নেই যে একই রিক্সায় অন্তর পাশাপাশি গায়ের সাথে গা মিলিয়ে বসে যাবে। এমনিতেই নতুন সব অনুভুতির জোয়ারে ডুবে মরছে সে। আরেকটু ডুবতে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু।
প্রিয়া যাবে না বলো পন করলো। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো।

“-তুমি যাও আমার যেতে দেরি হবে। কাজ আছে।
অন্ত সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়,
” কি কাজ?”
প্রিয়া বানিয়ে বানিয়ে বলে,
“-ওই একটা বন্ধু আসবে। ওর থেকে কিছু জরুরি নোটস নিতে হবে। তুমি যাও।
বন্ধুর কথা শুনেই মেজাজ গরম হলো সারাক্ষণ ঠান্ডা থাকা ছেলেটারও। একে বলে জেলাসি। প্রেয়সীকে অন্যের সাথে দেখলে জ্বলন হলে হুটহাট এমন মেজাজ গরম হয়-ই।
সে রিক্সা থেকে নেমে গেলো। রিক্সাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলো। অর্ধভেজা শরীর বৃষ্টির ছাটে এবার পুরোপুরি ভিজে গেলো। মাথার চুলগুলো লেপ্টে রইলো কপালে। সেখান থেকে বৃষ্টির পানির মতোই টুপটুপ করে পানি পরছে। দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। প্রিয়া হা করে তাকিয়ে আছে অন্তর দিকে। ও কি বললো আর ও কি করলো সেটা ভেবেই কুল পাচ্ছে না সে।

অন্ত এসে প্রিয়ার ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“-তোর ফ্রেন্ডকে জলদি আসতে বল। একসাথে বাসায় ফিরবো।
প্রিয়ার মেজাজ চটলো। দাঁত খিঁচে বললো,
“-তুমি পাগল? গাড়ি ছেড়ে দিলে কেন? এখন কোন রিক্সা পাবে তুমি? আমি বলেছি আমাকে সাথে নিয়ে চলো? আমি কি একা বাড়িতে যেতে পারবো না?
“-আমি কখন বললাম একা যেতে পারবি না? আমি বলেছি আমি তোর সাথে যাবো। রিক্সা নেই তো কি হয়েছে? হেঁটে যাবো।
প্রিয়া রাগে দুঃখে টং দোকানের ছায়াতল ছেড়ে দিলো। ভরা বৃষ্টির মাঝেই হাঁটা দিলো সামনে। অন্ত ঠোট কামড়ে হেসে এগিয়ে যায় সেদিকে। পেছন থেকে ডেকে শুধায়,
“-কিরে তোর বন্ধু আসবে না তোকে নোটস দিতে?
প্রিয়া চেঁচিয়ে উঠে,

“-না আসবে না। মিথ্যে বলেছি আমি। এবার যাও আমি একা একাই যাবো।
প্রিয়া ভিজে জুবুথুবু। সেই ভিজতে ভিজতেই এগিয়ে গেলো। অন্ত দ্রুত তার কাছে গিয়ে ভেজা হাতের আঙ্গুলে হাত গুজে দিলো। আদেশ দিয়ে বললো।
“-চুপচাপ চল। রাস্তায় বখাটেদের অভাব নেই। ভেজা শরীরে রাস্তায় বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।
অন্তর কন্ঠ টা একটু অন্যরকম শোনালো। একদম গম্ভীর টাইপ। প্রিয়া আর কিছু বলার সাহস পায় না। সত্যিই শরীর ভেজা তারউপর কলেজ ড্রেসটাও সাদা। রাস্তায় বখাটেদের লোভাতুর দৃষ্টির শিকার হবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। প্রিয়ার নিজেরই নিজের উপর রাগ হচ্ছে। এত ঢং করতে বলেছিলো কে? তখন রিক্সায় গেলে কি হতো? সেই তো অন্তর সাথেই যেতে হচ্ছে তা-ও হাতে হাত রেখে।
প্রিয়া হাতটা মুচড়ে অন্তর হাত থেকে ছুটে বললো।

“-এমনি হাটো। হাত ধরতে হবে না।
অন্ত থেমে যায়। রাগ দেখিয়ে বলে।
“-ওহ স্যরি! আমার হাত তো কালো। আপনার সুন্দর কোমল হাত ধরলে তো অন্যায় হয়ে যাবে। সুন্দর হাতের সাথে অসুন্দর হাত মানায় না, তাই না?
কি আশ্চর্য! প্রিয়া কখন কালো ফর্সার তফাত দেখালো এখানে? আর এই ছেলেটা নিজেকে কালো বলছে কেন? সে কি কালো নাকি? শ্যামবর্নের সুদর্শন মানুষকে যে কালো কুৎসিত বলে আখ্যায়িত করবে তার মতো বোকা এই পৃথিবীতে নেই। কৃষ্ণবর্নের পুরুষদের মাঝে যে সৌন্দর্য থাকে তা ফরসা পুরুষদের মাঝে কখনো পাওয়া যায় না। প্রিয়া আগে নাহয় ওকে কালো বলতো কিন্তু এখন তো ও বুঝে অন্ত কালো নয় বরং একটু বেশিই সুন্দর। হয়তো মনের ভাষা পরিবর্তনের পাশাপাশি চোখের ভাষাও বদলেছে। নয়তো অজান্তে ভালোবেসে ফেলা ছেলেটাকে এত সুদর্শন লাগবে কেন?
প্রিয়া বুঝলো অন্তর অভিমান। সে হাতটা বাড়িয়ে দিলো অন্তর দিকে। মুখ বাকিয়ে বললো।

“-নাও ধরো হাত। আমি তোমাকে তেমন ভাবে কিছু বলিনি। শুধু শুধু ভুল বুঝছো।
অন্ত নাকচ করে দিলো,
“-ধন্যবাদ কিন্তু এই হাত আর ধরছি না।
প্রিয়ার রাগ হয়। ব্যাটা তোকে ধরতে দিয়েছি এই বেশি তুই আবার ফিরিয়ে দিস। যাহ এবার আর ধরতেই দেবো না।
মনে মনে এসব বলে হাতটা নামিয়ে নেয়। আর কিছু না বলেই হাটতে থাকে। অন্ত পেছন থেকে দৌড়ে এসে আবার সেই আঙ্গুলের ফাকে আঙ্গুল গলিয়ে দিলো। প্রিয়া সরু চোখে তাকায় অন্তর দিকে। অন্ত চোখে চোখ রেখে বলে,
“-তোর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরবো না। আমি নিজে থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে নেবো আমার জিনিস। এবার আর কথা নয় চুপচাপ হাট।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৬

প্রিয়া আর কিছু বললো না। এমন কান্ডে একটু হাসিও পেলো। তবে নিজেকে সংযত রেখে এগিয়ে চললো সামনে। শুনশান সড়কে অনুভুতির বর্ষনে দুজন গা ভাসিয়ে এগিয়ে চললো বাড়ির পথে।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৭