আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৯
তানহা ইসলাম বৈশাখী
এ্যালিগেন্ট রাইডারস স্টুডিওতে বসে আছে পাঁচ বন্ধু। চারপাশে মিউজিক ইন্সটুমেন্টস এর ছড়াছড়ি। মাত্রই একটু রিহার্সাল করে এসে তাদের বরাদ্দকৃত সোফায় এসে বসলো সকলে। সামনের টেবিলটাতে ঠান্ডা ঠান্ডা ক্লেমন ক্যান রাখা। চারজনে একে একে নিজেদের ক্যান বুঝে নিলো। গরমের মাঝে ঠান্ডা ঠান্ডা পানীয় দিয়ে গলাটা ভেজাবে এবার। কিন্তু একটা ক্যান ওভাবেই টেবিলে পড়ে রইলো। প্রার্থর তেমন কোন আগ্রহ নেই সেটা উঠিয়ে খাওয়ার। আগ্রহ নেই কোন কিছুতেই। তার মন পড়ে থাকে নানান অযাচিত ভাবনাদের কাছে। এইযে এখনো কেমন করে বসে আছে। দুই হাটুতে কুনুই ঠেকিয়ে আঙ্গুন নিয়ে রেখেছে ঠোঁটের কাছে। চোখ আটকে আছে দূরের দেওয়ালে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন ভাবনায় সে বুদ হয়ে আছে।
বন্ধুর এমন মনমরা অনাগ্রহ ভাব দেখে চার বন্ধু বিচলিত হলো। ওরা কয়েকদিন ধরেই খেয়াল করছে প্রার্থর কোনকিছুতেই তেমন মন নেই। স্টুডিওতে ডাকলে আসতে চায় না। আড্ডা দেওয়ার জন্য বাইরে ডাকলেও নাকচ করে দেয়। কদিন পর কনসার্ট আছে একটা তাতেও তেমন আগ্রহ নেই। কেমন ঢিলেমি ভাব সবেতে।
হৃদয় ক্যানের মুখে চুমুক বসিয়ে খুবই বিজ্ঞ স্বরে বলে উঠলো,
“-কিরে মামাহ! তোর কি হইছে বল তো। এমন বেডি মানুষের মতো চাপায় হাত দিয়া কি আকাশ-পাতাল ভাবোস?
“-তোর নানির হাঙ্গা দিবার কথা ভাবতেছে।
রকির টিটকারি মূলক কথায় চোখমুখ কুচকে ফেললো হৃদয়। পাশেই বসা ছিলো রকি। ওকে পা দিয়ে লাথি দিয়ে বলল,
“-যাহ শালা! সবসময় নানিরে টানোস কেন? বেশি বললে তোর সাথে দিয়া দিমু। আমার নানি তোর ইতালিয়ান ফার্মের মুরগির থিকা বেশি সুন্দর।
রকি হৃদয়ের মাথায় চাপড় মেরে বলে,
“-চোপ শালা! তোর নানিরে তোর নানার লগেই হাঙ্গা দে। আমার ‘ইনারা’ ওসব বাঙালী লুতুপুতু মার্কা মেয়েদের থেকে ভালো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“-আগে ওরে বিডি তে আন এরপর দেখা যাবে। বিয়ে করে ইতালি চলে গেলে তোর পাছায় আগুন ধরাবো আমি।
দুই বন্ধুর এমন ঝগড়াঝাঁটিতেও প্রার্থর কোন হেলদোল দেখা গেলো না। অর্নব ব্যাপারটা সিরিয়াস নিলো। ওদের দুটোকে চুপ করিয়ে বলল,
“-থাম তোরা দুজন। এগুলো নিয়ে পরে ভাবিস। এই প্রার্থ, তোর কি হইছে? কোনো ব্যাপারে টেনসড?
প্রার্থ কিছুক্ষণ চুপ রইলো। বাকি চারজন বেশ উৎসুক নজরে তাকিয়ে আছে তার জবাবের আশায়। একটু পরেই নিশ্বাস ঝেড়ে সোজা হয়ে উঠে বসে প্রার্থ। এরপরই বলে উঠে এক অপ্রত্যাশিত বাক্য,
“-আমি গান ছেড়ে দিবো।
এমন একটা অভাবনীয় কথা শুনে চমকে উঠে চারজন। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু। এটা কি তারা সত্যি শুনলো? এত শখের কাজ ছেড়ে দিবে? মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি? কার্তিক শান্ত মাথার ছেলে। সে কাজ করে কুল এন্ড কাম স্টাইলে। তাই সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলেও কার্তিক ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন ছুড়লো,
“-কিছু হয়েছে প্রার্থ? হঠাৎ এ কথা কেন? যেখানে গান তোর প্রিয় শখ সেখানে ছেড়ে দেওয়ার কথা তো আসার কথা নয়। কি হয়েছে ঝেড়ে বল।
প্রার্থ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
“-মন টানছে না।
অর্নব সন্ধিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“-মন টানছে না? তোর? কিন্তু কেন? তুই নিজেও জানিস এখানে আসতে আমাদের কতটা জার্নি কতকিছু সাফার করতে হয়েছে। এক দিনে এপর্যন্ত আসি নি। এখন যখন মানুষ আমাদের চায় তখন আমরা কেন ছাড়বো এটা?
প্রার্থ একই টোনে বলল,
“-আমি বলেছি আমি ছাড়বো। তোদের ছাড়তে বলিনি।
হৃদয় নিজের মতো করে নিজের ভাষায় বলল,
“-হ বাল! তুমি গান ছাড়বা আর আমরা তোমারে ছাড়া আ-ই করে করে গান করবো। তোর এইটা মনে হয়, আমরা তোরে ছাড়া কনসার্ট করমু?
অর্নব এগিয়ে আসে। প্রার্থর কাঁধে হাত রেখে বলে,
“-কি হইছে দোস্ত? আমাদের বল। কোন সিরিয়াস ইস্যু? কোন ঝামেলায় পড়ছিস? রাজিব কিছু করছে? কিন্তু ও তো জেলে। কি হইছে বল না ভাই।
প্রার্থ মলিন স্বরে বলে উঠলো,
“-পুষ্প অসুস্থ।
কথা শুনে চারজনেরই কপালে ভাজ পড়লো দ্বিগুন। অসুস্থ মানে?কেমন অসুস্থ? কোন ধরনের রোগ হয়েছে? অর্নব ফের শুধালো,
“-লিটল প্রিন্সেস অসুস্থ? ও তো প্রেগন্যান্ট। এসময় আবার কি হয়েছে?
প্রার্থ সংক্ষেপে বললো সবকিছু। রোগ সম্পর্কে, রিস্ক সম্পর্কে, ডাক্তারের পরামর্শ সব কিছুই বললো তাদের। এরকম কথা শুনে চারজনই বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলো। এতদিন হয়ে গেলো ব্যাপারটার অথচ প্রার্থ কাউকে জানালো না? এতদিন জানালেও তো ওরা একটু ভরসা দিতে পারতো তাকে। এখন যে ভেঙে পরছে সে। এখন কি করবে ওরা?
চারজনই তৎপর হলো বন্ধুকে ভরসার কাঁধ এগিয়ে দিতে। অর্নব বলল,
“-এভাবে ভেঙে পড়ছিস কেন? তুই ভেঙে পড়লে তোর ফুলকে কে দেখবে? রোগ হয়েছে। রোগের চিকিৎসাও আছে। ডাক্তার তো বলেছে সার্জারি করে জমাট বাঁধা রক্ত বের করলেই প্রিন্সেস সুস্থ। তাহলে এত চিন্তা করছিস কেন? গানই বা ছারছিস কেন? এভাবে সব ছেড়েছুড়ে বসে থাকলে চলবে?
প্রার্থ সোফায় মাথা এলিয়ে দেয়। চোখ দুটো বুঁজে রেখে বলে,
“-জানি না আমি। আমার মন চাচ্ছে সব ছেড়ে দেই। গান বাজনার প্রতি আগ্রহ আমার আর নেই। ইচ্ছে করছে সারাদিন রবের দরবারে মাথা ঠুকে থাকি। সারাদিন প্রার্থনা করি। যে প্রার্থনায় আমার ফুল থাকবে আমার বাচ্চা থাকবে। ওদের আমি হারাতে পারবো না। আমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে প্রতিটি স্পন্দনে মিশে গেছে ও। ওকে ছাড়া এক সেকেন্ড চিন্তা করাও আমার জন্য মৃত্যু সমান। প্রতিটা মুহুর্তে মরন যন্ত্রনার টের পাচ্ছি আমি।
ওদের বুঝতে বাকি নেই যে বন্ধু কোন পরিস্থিতিতে আছে বর্তমানে। সবাই এগিয়ে এলো। প্রার্থর কাছাকাছি বসে বিভিন্ন কথা বলে তাকে সাহস দিলো। মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করলো। যাতে হার না মানে।
প্রার্থ প্রসন্ন হাসে বন্ধুদের চিন্তিত বদন দেখে। তালে তালে তো মনের সব গোপন কথা বলে দিলো বন্ধুদের। আর নয়। ওদের চিন্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। প্রসঙ্গ বদলানো যাক। প্রার্থ নিজে মোকাবেলা করতে পারবে সবকিছু। শুধু শুধু কেন বন্ধুদের টানবে।
এমন সময় টেবিলের উপর থাকা যান্ত্রিক ফোনটা ভো ভো শব্দে বেজে উঠলো। সাথে জ্বলে উঠলো ফোনের স্ক্রীন। সেখানে উপরেই জ্বলজ্বল করছে ‘স্নেহময়ী’ নামটা। সকলের চক্ষু এখন সেখানেই তাক হয়ে আছে। প্রার্থ ভালো একটা সুযোগ পেলো প্রসঙ্গ বদলানোর। অর্নবকে শুধিয়ে বলল,
“-তোর স্নেহময়ী ফোন করেছে। কথা বল আগে। ভাবি তোকে ছাড়া থাকতে পারছে না বোধহয়।
হৃদয়ও টিপ্পনী কেটে বলল,
“-কিরে, বিয়ে নাকি তুই সেচ্ছায় করিসনি? আমরা জোর করেছি বলে করেছিস। তবে এটা কি? দুদিনেই বউ স্নেহা থেকে স্নেহময়ী হয়ে গেলো? শালা, তুই তো হেব্বি চালু মাল। আমার থেকেও দশগুন বেশি চালু। আমি এখনো মোহ’র নাম্বার ‘জান’ দিয়ে সেভ করে রাখছি আমার তো ওখানে ‘মোহময়ী’ দেওয়া উচিত ছিলো।
অর্নব পড়লো ফ্যাসাদে। দুদিন আগেই স্নেহার নাম্বারটা সেভ করেছে ফোনে। মাথায় তখন শুধু স্নেহময়ী নামটাই ঘুরছিলো তাই ওটাই দিয়েছে। কে জানতো বন্ধুদের কাছে এভাবে কেস খাবে।
ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেলো। অর্নব হৃদয়কে ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বলে আবার ডায়াল করতে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। তখনই আবার বেজে উঠলো যন্ত্রটা। এবার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে কানে দিলো ফোনটা। তখন ওপাশ থেকে ভেসে এলো স্নেহার রিনরিনে মিষ্টি গলার স্বর,
“-হ্যালো অ..অর্নব!
এই মেয়েটার মুখে অর্নব নামটা শুনতে কেমন কেমন লাগে। অর্নব ওর এত বড় তবুও অকপটে অর্নব বলে দেয় মেয়েটা। হয়তো তীব্র কোন অধিকারবোধ থেকেই বলে। অর্নব সাড়া দিয়ে বলল,
“-হ্যাঁ বলো শুনছি।
“-আপনি কোথায়?
“-স্টুডিও তে। কেন কিছু লাগবে তোমার? যাওয়ার সময় নিয়ে যাবো?
স্নেহা চুপ রইলো। ইতস্ততায় কিছু বলতে পারছে না। অর্নব ধৈর্য ধরে রইলো কথা শোনার জন্য। একটু পর স্নেহা ইতস্ততা খানিকটা কাটিয়ে বলল,
“-আপনি এখনই বাড়িতে আসতে পারবেন?
“-এখন? কেন? কি হয়েছে?
“-আসলে বাড়িতে কেউ নেই। আব্বু আম্মু দাওয়াতে গেছেন। আমার ভয় করছে।
অর্নবের কপালে ভাজ পরলো গোটা কতক। সন্দেহ নিয়ে শুধালো,
“-আব্বু আম্মুর তো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। তুমি যাওনি?
স্নেহা অপরাধীর ন্যায় মিনমিন করে বলে,
“-আসলে শরীরটা ভালো লাগছিলো না। এজন্য যাইনি। ভাবলাম বাড়িতেই একটু রেস্ট নেই। কিন্তু এখন অনেক ভয় করছে। আপনাদের বাড়িটা অনেক বড়। আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে। আপনি কি একটু আসবেন?
অর্নব পরলো বিপাকে। এদিকে বন্ধু ওদিকে বউ। বন্ধুর এই অবস্থায় তাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। ওদিকে আবার পেয়েছে একটা বউ, কথায় কথায় ভয় পায়, বাচ্চাদের মতো মিয়িয়ে থাকে সবসময়। কে জানে একলা রুমে বসে বসে ভয়ে কাঁদছে কিনা।
অর্নব ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবলো। আরেকবার সিওর হতে বলল,
“-এখনই যেতে হবে? সন্ধ্যায় গেলে হবে না? বেশি ভয় করছে?
স্নেহার এখন কান্না চলে আসছে। কোনমতে নিজেকে সংযত রেখে বলল,
“-হুম। বাড়ির পেছন দিক থেকে কেমন আওয়াজ আসছে। আমার একা এত বড় বাড়িতে থাকার অভ্যেস নেই এজন্য বেশি ভয় হচ্ছে। আপনি ফ্রী হলে আসিয়েন আমি অপেক্ষা করবো।
অর্নব একবার প্রার্থর দিকে তাকালো। প্রার্থ চোখের ইশারায় বোঝালো ‘যা, এখন ওর তোকে প্রয়োজন’।
অর্নব ইশারা বুঝে স্নেহাকে বলল,
“-ঠিকাছে আমি আসছি। তুমি ভয় পেও না। দরজা লক করে ঘরে বসে থাকো। ফোনে কিছু দেখতে থাকো। এমনিতেও বাড়িতে কেউ ঢুকবে না। থাকো আমি পৌছাচ্ছি কিছুক্ষণের মধ্যে।
কথাটুকু বলে এপাশ থেকে ফোন কেটে দেয় সে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“- আমাকে যেতে হচ্ছে। ও ভয় পাচ্ছে একা বাড়িতে। প্রার্থ, তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আমার পরিচিত ডাক্তারের সাথেও আলাপ করে তোকে জানাবো। ইন শা আল্লাহ প্রিন্সেসের কিছু হবে না।
প্রার্থ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। অর্নব চলে যায়। দরজার সামনে যেতেই পেছন থেকে ডেকে উঠে প্রার্থ। ডাক শুনে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে পেছনে তাকালে প্রার্থ বলে উঠে,
“-বাড়িতে কেউ নেই। বউ একা একা ভয় পাচ্ছে। আজ একবার হানিমুন হওয়া চাই দোস্ত।
অর্নব সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“-শালা খ্রাপ।
টিভির পর্দায় চ্যানেল ‘সনি ম্যাক্স’। ইন্ডিয়ান একটা মুভি দেখছে প্রিয়া। রণবীর সিং, দীপিকা পাড়ুকোন আর প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত সিনেমা ‘বাজিরাও মাসতানি’ দেখছে। সাথে প্রান্তও আছে। আজকের মতো দুজনেই গেড়ে বসেছে টিভির সামনে। পুষ্পর ভালো লাগছে না বলে তাকে শুয়িয়ে দিয়ে এসেছে প্রিয়া।আর অন্ত তো নিজের রুমে পড়ালেখায় ব্যাস্ত। দুজনেই আপাতত টিভির সামনে।
এদিকে প্রিয়া ছবি দেখছে আর এক নাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে। কান্না মাসতানির জন্য আসছে না কান্না আসছে কাশীবাইয়ের জন্য। কাশীর কত বিশ্বাস ছিলো বাজিরাও এর উপর যে তার স্বামী কখনো তাকে ছাড়া অন্য নারীতে আসক্ত হবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমান করে পেশওয়া বাজিরাও মাসতানির প্রেমে পড়ে। প্রথম স্ত্রীকে ভালোবাসার পরেও মানুষ কি করে পর নারীতে আসক্ত হতে পারে? প্রিয়া নিজেকে কাশীর জায়গায় দাঁড় করায়। নিজে নিজে অনুভব করছে ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছে কাশী। কাশীর জায়গায় যদি সত্যিই ও থাকে কোনদিন। যেমন এমন হলো যে অন্ত হলো বাজিরাও প্রিয়া হলো কাশী আর কোন এক শাঁকচুন্নি হলো মাসতানি। তার মানে কি হলো? অন্ত ওকে বিয়ে করলেও অন্য নারীর পেছনে ছুটবে?
কথাটা ভেবেই হেঁচকি তুলে ফেলছে। প্রান্ত বেশ বিরক্ত হচ্ছে। নাক মুখ কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করে বলল,
“-আপু তুমি থামবে? এটা দেখে এত কাঁদার কি আছে? তোমার জন্য ছবির ফিল নিতে পারছি না।
প্রিয়া ফুঁসে ওঠে,
“-তুই চুপ কর। তুই কি বুঝবি মেয়েদের কষ্ট। তুইও বাজিরাওয়ের মতো দুই বিয়ে করতে চাস এজন্য ফিল নিতে চাচ্ছিস। সব ছেলে এক।
বলেই নাক টানলো। তখনই পাশে এসে বসে অন্ত। হতাশ ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে রুমাল এগিয়ে দেয়। অন্ত রুমালগুলো রাখেই বোধহয় প্রিয়ার জন্য। ওর নিজের কাজে আসে না একটাও প্রিয়ার কাজেই লেগে যায়। প্রিয়া অন্তর দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকায়। ওকে দেখেই সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে ভাসছে। প্রিয়া দরজার সামনে দাড়িয়ে। দরজার বাইরে দুজন নব দম্পতি। তারই বর অন্ত আরেকটা শাঁকচুন্নি বিয়ে করে এনেছে। দিনের বেলায়ও এমন স্বপ্ন দেখে আত্মা কেঁপে উঠে। সব ক্ষোভ যায় অন্তর উপর। রাগে মুখ বাকিয়ে বলে,
“-লাগবে না তোমার রুমাল। যাও এখান থেকে।
অন্তর অসহায় স্বর,
“-আমি আবার কি করলাম?
প্রিয়া চোখ মুছে বলে,
“-তুমিই নষ্টের মূল। কারন তুমি ছেলে।
অন্ত অবাক না হয়ে পারে না। এটা কেমন ধরনের কথা? মেয়েদের কমন সেন্স কোথায় থাকে? আদোও কি থাকে? নাকি এরই শুধু কমন সেন্স নেই। কিসব লজিকলেস কথা বলে সবসময়। সে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“-আশ্চর্য! এখন কি আমাকে মেয়ে হতে বলছিস?
“-তাই হওয়া উচিত। মেয়ে হলে বুঝতে মেয়েদের কত কষ্ট।
প্রিয়ার চোখে এখনো জল পরছে। অন্ত আর ফাও পেচালে গেলো না। নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে প্রিয়ার মুখটা হাতে তুললো। অন্যহাতের রুমাল দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে ভেজা চোখ মুছিয়ে দিলো। আশকারা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“-কি হয়েছে বল আমাকে? এত কাঁদছিস কেন? ছবিতে এমন কি আছে যার জন্য এত কাঁদতে হবে?
অন্তর আদর মাখা স্বরে গলে যায় প্রিয়া। ঠোঁট উল্টে ভাঙা গলায় বলে
“-তুমিও আমাকে বিয়ে করে এভাবে ভুলে যাবে তাইনা? তারপর আরেকটা বিয়ে…
অন্ত রেগে যায়। মাঝপথেই আটকে দেয় প্রিয়াকে। খানিক ধমকের স্বরে বলে,
“-আশ্চর্য! এসব আজাইরা কথা তোর মাথায় আসে কি করে? সবাইকে এক ভাবতে হবে কেন? আমাকে এমন মনে হয় তোর? তুই আজ পর্যন্ত কখনো দেখেছিস তোকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়েছি?
“-এক মিনিট। তোমরা এগুলো কি করছো? ভাইয়া তুমি আপুকে কি বললে? আপু কি বললো? তোমরা বিয়ে করবে? তোমাদের মাঝে কি চলে?
গেলো! সব গেলো। ওদের সামনে যে প্রান্ত নামের ইচঁরেপাকা একটা ছেলে বসে আছে এটা তো ওরা ভুলেই গেছে। এর সামনে ওদের গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেলো? এবার এই কটাকে কি করে সামাল দিবে?
অন্ত শুকনো ঢোক গিলে। প্রিয়ার থেকে দূরত্ব রেখে বসে। গলা ঝেড়ে ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
“-কি -কি চলছে? কিছুই চলছে না। বাদরামি বাদ দিয়ে পড়তে যা। যাহ।
প্রান্ত দু হাত বুকের কাছে ভাজ করে বলে,
“-আমাকে এতটাও বোকা ভেবো না ভাইয়া। আমি জানি তোমরা প্রেম করছো? একই বাড়িতে থেকে দুজন প্রেম করছো। ছিঃ!
প্রিয়া খপ করে প্রান্তর মুখ চেপে ধরে। ভয়ে ফিসফিস করে বলে,
“-আস্তে বল ভাই আমার। কেউ শুনলে কেস খাবো। আমরা প্রেম করবো কেন? আসলে অন্ধর মাঝে হঠাৎ ফিউচার হাসবেন্ড দেখতে পেলাম তাই দুঃখ প্রকাশ করলাম। আর ও-ও একটু শান্তনা দিলো আমাকে। এর বেশি না।
প্রান্ত মুখ থেকে হাত ছাড়িয়ে বলে,
“-আমাকে বোকা বানানো এত সহজ না। আমি জানি তোমরা প্রেম করো। লুকিয়ে কোন লাভ নেই। আমি সবাইকে বলে দিবো
অন্তর মনে সাহস এলো। নির্ভয়ে বলল,
“-যা বল। সবাইকে ডেকে ডেকে বলে আয়।
এরপর আবার প্রিয়ার কাছাকাছি এলো। এক হাতে ওর কাঁধ জরিয়ে বলল,
“-ও শুধু আমার প্রেমিকা নয় আমার ফিউচার ওয়াইফ। তোর ভাবি। সম্মান দিয়ে কথা বলবি। আর সবাইকে যখন বলবি তখন ওকে ভাবি সম্মোধন করে বলবি। যা এবার বলে আয়।
প্রিয়া অদৃশ্য হাতে কপাল চাপড়ায়। এখন এত হিরোগিরী করতে বলেছে কে ওকে? সবাই জেনে গেলে দেখা যাবে এমন নায়ক নায়ক ভাব কতক্ষণ থাকে।
এদিকে প্রান্ত উৎসুক হয়ে কিছু বলবে তার আগেই সদর দরজায় বেল পরলো। অন্ত উঠে দরজা খুলতে যায়। পেছন থেকে প্রান্ত নেতা স্বরে বলে উঠে,
“-কেউ আসলো বলে আজ বেঁচে গেলে নয়তো সবাইকে বলে দিতাম আজ।
অন্ত জানে প্রান্ত কাউকে কিছু বলবে না। এ ক্ষেত্রে বান্দা এক নাম্বার।
সে গিয়ে দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকলো প্রার্থ। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো পুষ্প নেই। প্রিয়াকে প্রশ্ন করবে তার আগেই খেয়াল হলো প্রিয়ার আধভেজা ফোলাফোলা চোখ। কপাল গুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“-কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?
প্রিয়াকে প্রশ্নটা করেই তাকায় অন্তর দিকে। যেন অন্তই কিছু একটা করেছে। অন্ত ইঙ্গিতটা বুঝেই জোরে জোরে মাথা নাড়ায়। হরবার করে বলে,
“-আমি কিছু করিনি ভাই। ও মুভি দেখে কাঁদছিলো। আমি তো আদর করে দিচ্ছিলাম।
নিজের কথায় নিজেই তব্দা খেলো অন্ত। মনে মনে জ্বিভ কেটে ভুল সংশোধন করে বলল,
“-না মানে আদর নয় আরকি বুঝাচ্ছিলাম যে ছবি দেখে কাঁদতে নেই। এগুলো সব অভিনয়। হে হে।
কথা শেষ করে জোরপূর্বক একটা হাসি দিলো। যেন হাতেনাতে ধরা খেয়েও বাঁচার জন্য মিথ্যে বলার চেষ্টা।
প্রিয়া তো ভয়ে মাথা নুয়িয়ে রেখেছে। প্রান্তটা যদি মুখ ফুটে কিছু বলে ফেলে তাহলে তার আর রক্ষে নেই। প্রার্থ ভাই যে দুটোকে কি করবে তার কোন হিসাব নেই।
অথচ প্রার্থ কিছুই বললো না। প্রিয়াকে শুধু জিজ্ঞেস করলো,
“-তোর বোন কোথায়?
“-বুবু ঘরে শুয়ে আছে। বললো ভালো লাগছে না তাই আর ডিস্টার্ব করিনি। এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে বোধহয়।
উত্তর শুনে আর অপেক্ষায় রইলো না। হনহন পায়ে চলে গেলো উপরে।
অন্ত হাফ ছেড়ে আবার বসে প্রিয়ার পাশে। প্রিয়া খোঁচা দিয়ে বলে,
“-ওভাবে কেন বললে? ভাই যদি কিছু বুঝে যায় তাহলে আমাদের মেরে তক্তা বানাবে।
অন্ত চশমা ঠেলে সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
“-মারবে কেন? আমরা কি খারাপ কিছু করেছি নাকি? ভালোবাসায় আবার ভয় কিসের? দুদিন পর আমিই জানাবো সবাইকে।
প্রান্ত বলল,
“-তুমি জানানোর আগে আমি জানিয়ে দেবো সবাইকে। এরপর মার খাওয়াবো তোমাদের।
অন্ত কনফিডেন্সের সাথে বলে,
“-তো যা না। এখনই বলে আয়। এমনিতেও প্রার্থ ভাই সব জানে।
প্রিয়া অবাক চোখে তাকায়। বড় বড় চোখ করে আশ্চর্য সমেত বলে,
“-কি বলো? প্রার্থ ভাই জানে? তুমি বলে দিয়োছো সব? ভাই কিছু বলেনি? মেরেছে তোমাকে?
“-মারবে কেন? ভাই তোর জানার আগে থেকেই জানে। জানিনা কিভাবে কিভাবে যেন বুঝে গেছে সব। শুধু তুই বুঝিসনি আমাকে।
প্রিয়া অবাক হয়ে আরো কিছু বলবে তার আগে শুনতে পেলো উপর থেকে ভেসে আসা প্রার্থর চিৎকার। ওরা উপরের দিকে তাকাতে দেখে প্রার্থ পুষ্পকে কোলে করে নিয়ে আসছে। প্রার্থ উপর থেকেই জোরে জোরে বলে,
“-অন্ত দরজা খোল। গাড়ি স্টার্ট কর জলদি।
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৩৮
পুষ্প প্রার্থর কোলের উপর কাতরাচ্ছে ব্যাথায়। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। অন্ত, প্রিয়া কিছু বুঝলো না কি হয়েছে। শুধু বুঝলো পুষ্পর কিছু হয়েছে। প্রার্থর সাথে সাথে ওরার ছুটলো বাইরের পথে। ওদের উচ্চশব্দে ঘর হতে বেরিয়ে এসেছেন পূর্ণিমা বেগমও। ওরকম হরবার করে ওদের সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে দেখে তিনিও গেলেন পিছু পিছু।