আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৮
তানহা ইসলাম বৈশাখী
প্রকৃতি রঙ-বেরঙের সাজে সুসজ্জিত। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে আর রৌদ্রের তাপে চারপাশ ঝলসে গেলেও, গাছের ডালে ডালে ফুটে থাকা বাহারি ফুলগুলো যেন এক ছটাক শান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির বুকে। কৃষ্ণচূড়ার আগুন-লাল রঙ, জারুলের বেগুনি থেকে নীলচে লাবণ্য মিশ্রিত সৌন্দর্য, আর অমলতাসের ঝুলন্ত হলুদিয়া ফুল। সব মিলিয়ে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মুগ্ধতা আর রঙের উচ্ছ্বাস। তাইতো এত গরম হওয়া সত্তেও বিয়ে বাড়ির মহল কেমন ফুরফুরে। হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছে চৌধুরী বাড়ি। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। বিয়ের অনুষ্ঠান।
বাড়ির মেজো ছেলে আয়ান অন্ত চৌধুরীর বিয়ে। পাঁচ বছরের অপেক্ষার পর অবশেষে তার অন্তঃপ্রিয়া হতে চলেছে তার অর্ধাঙ্গিনী। আর মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা।
বর্তমানে অন্তকে স্টেজে বসিয়ে রেখে প্রার্থরা বসে আছে বাইরে। ছেলেমেয়ে গুলো কাজ করতে করতে কাহিল। এখন একটু বসেছে একটু পর আবার দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। আটটা চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে আটজন বসে আছে।
সবার মাঝ থেকে হৃদয় হঠাৎ গরমে হাসফাস করে উঠল,
“উফফ! বাল এত্ত গরম কেন? এখন তো রোদও নাই তবুও এত গরম!”
মোহ তেতে উঠল হৃদয়ের কথায়,
“মুখের ভাষা ঠিক করে কথা বলো হৃদয়। তোমার জন্য আমার ছেলেটা বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় গালাগালি করো কেন? ছেলেটাও হচ্ছে তোমারই মতো।”
বউয়ের রাগি মুখ দেখে একটু আমতা আমতা করলো সে। বিড়বিড় করে বলল,
“আমার ছেলে তো আমার মতোই হবে, তাইনা?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শুধু বিড়বিড়ই করলো। গলা উঁচু করে বউয়ের উপর আর কিছু বলতে পারল না। তখন কোথা থেকে ছুটে এলো গোলুমোলু দেখতে তিন বছরের এক বাচ্চা মেয়ে। দৌড়াদৌড়ি করে ঘেমে গেছে একেবারে। টসটসে গালদুটো লাল হয়ে আছে। মেয়েটা হৃদয়ের কাছে এসে কেঁদে কেঁদে বলল,
“চাচু চাচু, লিদ (হৃদ) বাইয়া আমাকে তুমু (চুমু) দিয়েথে।”
হৃদয় মেয়েটার আধো আধো স্বরে বলা বাক্য বুঝলো না। সে ওর টুসটুসে গাল টেনে বলল,
“কি হয়েছে স্নিগ্ধা মামনি? লিদ ভাইয়া কি করেছে?
“অরন্যা আহমেদ স্নিগ্ধা” অর্নব-স্নেহার মেয়ে। বয়স তিনের কোঠায়। পিচ্চি মেয়েটা হাত নাচিয়ে নাচিয়ে বলল,
“লিদ বাইয়া আথে না? বাইয়া আমাকে,,, তুমু দিয়েথে।”
হৃদয় তবুও বুঝল না। পাশে বসা প্রার্থ ওকে টেনে কাছে আনল। স্নিগ্ধার এলোমেলো ছোট চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল,
“হৃদ ভাইয়া তোমাকে চুমু দিয়েছে মামনি?”
স্নিগ্ধা উপর নিচ মাথা নাড়ালো ঘনঘন। অর্নব এ কথা শুনে বড় বড় চোখ করে বলল,
“দেখছিস? বাবার মতো ছেলে হয়েছে। এই হৃদয়, তোর ছেলেকে এতটুকু বয়সে পাকিয়ে দিয়েছিস। আমার মেয়ের থেকে দূরে রাখ ওকে। কত বড় সাহস আমার মেয়েকে চুমু খায়। সেদিনও আমার সামনেই আমার মেয়েকে চুমু খেয়েছে তোর ছেলে।”
হৃদয় উল্টো মেজাজ দেখিয়ে বলল,
“একশো বার খাবে। তোর মেয়েকে আমার ছেলের বউ বানাবো। চুমু খেলে সমস্যা কি?”
অর্নব পা দিয়ে ওর চেয়ার লাথি মেরে বলল,
“একদম নজর দিবিনা আমার মেয়ের দিকে। তোর ছেলের সাথে আমি মেয়ে দিবো না। ”
এবার তেতে উঠল স্নেহা,
“থামবেন আপনি? বাচ্চার সামনে কি সব বলছেন। ও কি শিখবে বলুন তো।”
অর্নব চুপ হয়ে গেলো কিন্তু চোখে চোখে আরেকচোট যুদ্ধ চলল হৃদয়ের সাথে।
তখন পুষ্প স্নিগ্ধাকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নিলো। ফোলা গালটাতে চুমু দিয়ে বলল,
“হৃদ ভাইয়া স্নিগ্ধাকে আদর করে চুমু খেয়েছে। এইযে তোমার আন্তি যেমন তোমার গালে চুমু খেলো তেমন। তাহলে কাঁদছো কেন মামনি? ভাইয়া তো আদর দিয়েছে। ”
স্নিগ্ধা ছোট ছোট করে তোতলানো স্বরে বলল,
“পাপা বলেথে লিদ বাইয়া তুমু খেলে আমাল কাথে বিচাল দিবে। কালন বিশি তুমু খেলে লোগ (রোগ) হয়।
কথাটুকু শুনে সবাই অর্নবের দিকে সরু চোখে তাকালো। এতটুকু মেয়েকে এসব বলার কি প্রয়োজন! এতগুলো চোখ দেখে বেচারা অর্নব মিইয়ে যায়। পুষ্প স্নিগ্ধাকে আদর করে বলে,
” না মা। পাপা ভুল বলেছে। বড়রা আদর করে চুমু খেলে কিছু হয় না। তবুও আমি হৃদ ভাইয়াকে বকে দিবো। ঠিক আছে? ”
“আতথা (আচ্ছা)। ”
কথা শেষ হতেই ওদের সামনে এলো স্নিগ্ধার থেকে একটু বড় আরেকটা মেয়ে। চিকন চাকন দেখতে অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েটা। সেও ঘেমে নেয়ে একাকার৷ মুখ পুরো লাল হয়ে আছে। বয়স চার হবে। সে এসে সুস্মিতার পাশে দাঁড়াল। মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আম্মু। লিদ আমাকে খেলতে দেয় না।”
হৃদয় অবাক হয়ে বলে,
“শশী মা, হৃদ কি তোমাকেও চুমু দিয়েছে?”
কার্তিকের মেয়ে ‘শর্মিলা সাহা শশী’ মাথা ঝাকিয়ে গালে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,
“হ্যাঁ চাচ্চু। এই এখানে চুমু দিয়েছে। তালপল আমাকে খেলতেও দেয় না।”
এবার কার্তিকও অর্নবের মতো খ্যাপে গেলো,
“আজ আসুক হৃদ। কত বড় সাহস, বড় বোনকেও চুমু খায়। এই মোহ তুমি কিন্তু ছেলেকে একদম হৃদয়ের মতো হতে দিও না। বাপ ছিলো প্লে-বয়। ছেলেটাও সেই পথেই হাটছে। ওকে আজ শায়েস্তা করেই ছারবো।”
বলতে বলতেই হৃদ এসে হাজির হলো ওদের সামনে। সবে চার বছর বয়সে পা রেখতে চলেছে কিন্তু লাফালাফি এবং ফ্লার্টিং স্কিল তার দশ বছরের বাচ্চার থেকেও বেশি। বাবার থেকে দশধাপ এগিয়ে সে। মাথা ভর্তি খাড়া খাড়া চুলগুলোই প্রমান করে তার বদমায়েশির লেভেল। দেখতে একদম বাবার মতো। মনেহয় হৃদয়ের কার্নব কপি এনে বসিয়ে দিয়েছে হৃদের মুখে। হৃদের পুরো নাম ‘মাহিন আহমেদ হৃদ’। হৃদ এসেই পুষ্পর কোলে বসে থাকা স্নিগ্ধাকে টানছে খেলার জন্য।
“নিগ্ধা আয় খেলব।”
হৃদয় ওকে টেনে নিজের সামনে দাঁড় করাল।
“তুই এদিকে আয় বাপ। তোর নামে নালিশ এসেছে। মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করিস তুই? ওরা তোর বোন হয় না? ওদের সাথে….
” কি হচ্ছে টা কি হৃদয়? ও বাচ্চা ফ্লার্ট করার কি বুঝে? বলো যাতে এমন ব্যাড বিহেভ না করে। তুমি শাসন করতে গিয়ে এমন এমন ওয়ার্ড ইউজ করো তাতে ওরা আরো বাজে কাজ সম্পর্কে শিখবে। ভালো ভাবে বলো। হৃদ মাম্মামের কাছে এসো। কাম।”
হৃদয় জ্বিভ কেটে বলল,
“সরি জান। এই মুখটাও না! অটোমেটিক চলতেই থাকে। ইদানীং মুখে ভালো কিছু আসে না কেন কে জানে৷ ”
মোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছেলেটা কোনদিন ভালো হবে না। পাঁচ বছর ধরে সংসার করছে দুজন। হৃদয়ের এই উদ্ভট আচরণের জন্য কম বকা খায়নি সে মোহর থেকে। তবুও শুধরায়না। তবে একটা কথা ঠিক, মোহকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। মোহ প্রচন্ড মেজাজি মেয়ে। মেজাজ খুয়িয়ে গেলে তার তাল থাকে না। মুখে যা আসে তাই বলে। হৃদয় তা সিরিয়াসলি নেয় না। বউ রেগে গেলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। বউয়ের রাগ ঠান্ডা হলেই তার কাছে আসে।
হৃদ তখন মোহর কাছে গেলে মোহ বলল,
“তুমি কি বোনেদের গালে চুমু খেয়েছো? ”
হৃদ মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। বলল,
“আমি চুমু খাই নি তো মাম্মা। ”
“মিথ্যে কেন বলো হৃদ? ওরা বলল তুমি ওদের জোর করে চুমু খেয়েছো? ওইযে দেখো স্নিগ্ধা কেমন কাঁদছে। তুমি বোনকে কাঁদিয়েছো কেন বাবা? শশী আপুকেও খেলতে দিচ্ছো না। দিস ইজ ব্যাড ম্যানার্স।”
“আমি কিচু কুরিনি মাম্মা সুত্যি বলছি।”
মোহ চোখ পাকাল। আদর করে বললে ছেলেটা কিচ্ছু স্বীকার করবে না তাই শক্ত গলায় বলতে হবে। তবে মোহর কিছু বলার আগেই প্রার্থ থামিয়ে দিলো।
“কিছু বলো না মোহ। আমার কাছে দাও ওকে। হৃদ চাচ্চুর কাছে আসো তো।”
হৃদ সুযোগ পেয়েই মায়ের থেকে ছুটে গেলো প্রার্থর কাছে৷ কোলে উঠে বসল চাচ্চুর। প্রার্থ আদর করে বলল,
“তুমি আপুদের ভালোবাসো না?”
“বাসি তো।”
“তাহলে ওদের কাঁদাও কেন?”
“আমি তো ইকটু চুমু খেয়েছি।”
পুষ্প ফোঁড়ন কেটে বলল,
“এ্যাই নটি বয়! তুমি না চুমু খাওনি?”
হৃদ হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,
“ইকটু খেয়েছি আন্তি বিশি না।”
“তাহলে মাম্মামকে মিথ্যে কেন বললে?”
হৃদ আবারও একইভাবে বলল,
“ইকটু বলেছি তো বিশি না। ইকটু মিতথে বললে কিচ্চু হয় না।”
“কে বলল কিছু হয় না? তুমি জানো? একটা মিথ্যে দিয়ে কত মিথ্যে তৈরী হয়। আর মিথ্যেবাদিকে আল্লাহ কখনো ভালোবাসে না জানো না? কারো কাছে মিথ্যে বলবেনা বাবা, ঠিকাছে? মিথ্যে বললে আল্লাহ পাপ দেয়।
” আর বলব না।”
“দ্যাট’স মাই বয়। আপুদেরও আর বিরক্ত করবে না, ঠিকাছে?”
“টিকাচে।”
ভদ্র ছেলের মতো শুনলো কথা। হৃদ এদিকে খাটি সোনা। বাবা মায়ের কথা একটাও শুনবে না কিন্তু চাচ্চু আর আন্টিদের কথা সে ফেলেনা। একেবারে শিরোধার্য রূপে গ্রহন করে।
তখন হঠাৎ কর্কশ শব্দে প্রার্থর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা সামনে ধরতে দেখলে ভিডিও কল এসেছে। ইতালি থেকে কল করেছে রকি। গত একবছর যাবত সে ইতালিতে থাকছে ইনারার সঙ্গে। আজ বন্ধুর ভাইয়ের বিয়েতেও সে উপস্থিত থাকতে পারছে না। এদিকের খবরাখবর নিতেই কল করা।
প্রার্থ ফোনটা তুলল। সকলের মাঝে তুলে ধরলো। স্ক্রীনের উপর ভেসে উঠলো রকির হাস্যজ্জল চেহারা। তার পাশেই গা ঘেঁষে বসে আছে অতিরিক্ত ফর্সা সুন্দরী এক নারী। এই বুঝি সেই ইতালিয়ান ইনারা। ওদের বিয়ে হয়েছে দুবছর আগে। ইনারা বাংলাদেশে এসেছিলো তখন। এবার রকি গেছে ইতালি।
ফোনে বন্ধুর সাথে কথা বলার মাঝেই চঞ্চল হৃদ চাচ্চুর থেকে ছুটে গেলো। স্নিগ্ধা আর শশীকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। ও তো আর বসে থাকার মতো ছেলে না। নিজেও বসবে না কাউকে বসতেও দিবে না দুষ্টুটা।
রাত বাজে তখন প্রায় ১২ টা। অন্ত-প্রিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে সন্ধ্যার পরপরই। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে তিনবার কবুল বলে প্রিয়া আজ পুরোপুরি অন্তর নামে দাখিল হয়ে গেছে৷ পাঁচটা বছরের অপেক্ষায় ফল তাদের আজকের এই বিয়ে।
সারাদিন সারাক্ষণ আনন্দ ফুর্তি হৈ-হুল্লোড়ে কাটিয়ে অন্ত সবে বাসর ঘরে ঢুকল। প্রিয়াকে সেই কখন বসিয়ে রেখেছে ঘরে কিন্ত অন্তর খবর নেই।
মাত্র সবকিছু থেকে একটু ফুরসত পেয়ে বাসর ঘরে পা রাখল।ঘরে ঢুকেই প্রথমে দরজা লাগিয়ে দিলো সে। ঘুরে তাকাল নববধূবেশে বসা তার অন্তঃপ্রিয়ার দিকে। প্রিয়া লাল লেহেঙ্গা পরে খাটের মাঝ বরাবর বসে আছে। মাথায় তার এক হাত ঘোমটা টানা।
অন্ত এগিয়ে এলো ধীর কদমে।
হুট করে প্রিয়া নিজের মাথার ঘোমটাটা টেনে খুলে ফেলল। চোখ মুখে তার উপচে পরা খুশি। অদূরে দাঁড়ানো অন্তর দিকে দুহাত বাড়িয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল,
“অন্তওওও! আমাকে জরিয়ে ধরো। জলদিইই।”
ওর এমন কান্ড দেখে অন্ত হাসবে না কাঁদবে বুঝে পায় না। নতুন বউ, কই একটু লজ্জা টজ্জা নিয়ে বসে থাকবে আর অন্ত এসে সেই লজ্জা ভাঙাবে। তা না করে বউ নির্লজ্জের মতো জামাইকে কাছে ডাকছে।
অন্ত হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলো প্রিয়ার দিকে। ওর বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ফাক গলে গিয়ে জরিয়ে ধরল ওকে। খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরল। প্রিয়াও খুশিতে শক্ত করে চেপে ধরল অন্তকে। অন্ত ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকল,
“বউ?”
প্রিয়া অন্তর ঘাড়ে মুখ গুজে রেখে মিহি স্বরে প্রতুত্তর করল,
“হুম।”
অন্ত আবার ডাকে, “বউ!”
“শুনছি তো বলো না।”
“বলছি তো। বউ। তুই আমার বউ। এর বেশি আর কি বলব? বউয়ের থেকো মিষ্টি শব্দ এই দুনিয়ায় নেই। ভালোবাসি বউ।”
অন্তর কথা শুনে প্রিয়াতো খুশিতে গদগদ হয়। মুখ উঠিয়ে তাকায় অন্তর চোখে। দুহাতে কাঁধ জড়িয়ে রাখে। অন্ত দুহাত নিয়ে রাখে প্রিয়ার মেদহীন কোমড়ে।
দুজনের খুশি যেন বাঁধ মানছে না। এত খুশি যে ওরা কই রাখবে! দুজনের চোখের কোনই ভিজে উঠেছে প্রায়। হঠৎ এমন আবেগপ্রবণ মুহূর্তে প্রিয়া দুষ্টুমি করে বসলো। সে বেডের উপর হাটু ভাজ করে রেখে দাঁড়ানোর মতো ছিলো। অন্ত ছিলো মেঝেতে সটান হয়ে দাড়িয়ে। দুজনের মুখ একদম মুখোমুখি। প্রিয়া নিজের তকতকে কোমল ঠোঁট জোড়া উচু করলো। চুমু দেওয়ার মতো মুখে শব্দ করলো দুবার। ঠোঁট উঁচু রেখেই বলল,
“চুমু দাও। ”
এমন আবদারে অন্ত শব্দ করে হেসে ফেলে। দুষ্টু স্বরে বলে,
“সত্যিই দিবো? বুঝিস কিন্তু। একবার চুমু দিলে আজকের জন্য আর ছাড়ছি না।”
“বাদ দাও ছাড়াছাড়ি। আমি বলেছি নাকি ছাড়তে? নষ্ট প্রেমিক পুরুষ তুমি। প্রমিকাকে রেখে চার বছর দূরে থেকেছো। পাঁচ বছরের প্রেমে একটা গভীর চুমু খেতে পারলে না। কিসের প্রেমিক তুমি, শুনি?
” চরম অসভ্য প্রেমিক পুরুষ আমি? এক্সাম্পল চাই? তো দেরি কিসের? লেট’স স্টার্ট।”
প্রিয়া ঠোঁট জোড়া উঁচু করে রেখেছে। অন্ত এগিয়ে গেলো সেই রক্তলাল অধর পানে। প্রিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলে আগেই। কিন্তু সময় চলে যায় ঠোঁটে আর কিছুর স্পর্শ আসে না। প্রিয়া অধৈর্য হয়ে চোখ খোলে। দেখে অন্ত চশমার ভেতর থাকা চোখ দুটো কুঁচকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়া সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,
“কি হলো?”
“আমি কি লিপস্টিক খাবো?”
“মানে?”
“মানে এই মেকআপ আগে তোল। লাল টকটকে লিপস্টিক দিয়ে তো ঠোঁট রাঙিয়ে রেখেছিস। আমি কি এত সাজতে বলেছি? তুই তো আমার কাছে এমনিতেই পরী।
প্রিয়া প্রশংসা শুনে খুশিতে গদগদ কিন্তু অন্তকে বুঝতে দিলো না। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
” তাই বলে বিয়ের দিনও সাজব না?”
অন্ত হেসে ওর ফোলানো ঠোঁট টাতে ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল। “বোস, আসছি। ”
অন্ত গিয়ে ক্লিনজার আর ন্যাপকিন নিয়ে এলো। প্রথমে যত্নসহকারে বউয়ের গায়ের সমস্ত ভারী গয়না খুলে ফেলল এরপর মুখের মেকআপও তুলে দিলো। ন্যাচারালি প্রিয়াকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ঘোর লেগে যাচ্ছে অন্তর। বিশেষ করে কৃত্রিম রংহীন গোলাপী ওই ওষ্ঠ জোড়া একটু বেশিই টানছে তাকে। অন্ত নেশালো চোখে মেপে মেপে দেখে নেয় তার অর্ধাঙ্গিনীকে। এই মেয়েকে নিজের অর্ধাঙ্গী রুপে পাওয়াটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে সে কোন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু না এটা বাস্তব। অন্তর অন্তঃপ্রিয়া সারা জীবনের জন্য অন্তর নামে লেখা হয়ে গেছে।
অন্তর চাহনীতে এবার প্রিয়া নেতিয়ে পরে। এবার আর ছাড় দেয় না অন্ত। ওর গোলাপি অধর জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নেয় মুহুর্তেই।
আর কোন চাওয়া নেই। আর কোন পাওয়া নেই। এ জনমের জন্য অন্তর চাওয়া পাওয়া এটুকুই ছিলো। সে পেয়েছে। প্রিয়াকে সে নিজের করে পেয়েছে। এরপর তার চাওয়া পাওয়া কতটুকুই বা বাকি থাকে? একটুও না।
পুষ্পর বিছানায় দুটো ছোট ছোট বিড়ালের বাচ্চা শুয়ে আছে। পুষ্প রুমে এসে ওদের দেখে হতাশ শ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়ল, বিড়াল ছানা দুটোকে ডেকে বলল,
“চিনি, মিনি এদিকে এসো। এটা কি তোমাদের ঘুমনোর জায়গা? আমার সাহেব বাবু আসলে যে বকা খেতে হবে, জানো না? কাম আন্ডাবাচ্চা। আমার কাছে এসো।
সাদা এবং সাদা কালোর সংমিশ্রণের দুটো বিড়াল অলস ভঙ্গিতে উঠে এলো। পুষ্প দু হাতে ছোট বাচ্চা দুটোকে হাতে তুলে নেয়। আদর দিয়ে বলে,
” আন্ডাবাচ্চা, আমি বলেছি না উনি বাসায় থাকলে বিছানায় উঠা এলাও নয়। এসে তোমাদের দেখলেই বলবে, ‘পুষ্প, সরা তোর আন্ডাবাচ্চাদের। জীবন জ্বালিয়ে দিলো আমার। লোম লেগে গেছে বিছানায়। এবার আমি ঘুমাবো কোথায়? আজ সারারাত তোর উপর শুয়ে থাকবো। এটা তোর আন্ডাবাচ্চাদের পাপের শাস্তি।”
প্রার্থর মতো করে অভিনয় করে কথাগুলো বলে বলে হাটছে পুষ্প। প্রার্থ এখনও বিড়াল পছন্দ করে না। শুধু পুষ্পর প্রিয় বাচ্চা বলে বাড়িতে থাকতে দেয়। কিন্তু রুমে বিড়ালের অস্তিত্বটাও তার পছন্দ না। সেবার কত বুঝিয়ে শুনিয়ে এলাচির জন্য একটা মেয়ে বিড়াল আনলো। নাম রাখল লিলি। এলাচির সাথে ভালোই জমে তার। পুষ্প ওদের বিয়েও দিলো। একটা রেজিট্রি টাইপ কার্ডে বিড়াল দুটোর পায়ের ছাপ দিলো। সেই থেকে এলাচি আর লিলি সংসার করছে। গতবছর তাদের দুটো ফুটফুটে বিড়ালছানা হয়েছে। পুষ্প ছানাদুটোর নাম রেখেছে চিনি, মিনি।
এ নিয়েও প্রার্থর দেনামনা। সে কিছুতেই এতগুলো বিড়াল রাখবে না বাড়িতে। কিন্তু ও শুধু মুখের কথাই। বউয়ের উপরে সে কিছু করতে পারবে নাকি?
পুষ্প এলাচির জন্য একটা ক্যাটহাউস বানিয়েছে। পাশেই চিনি, মিনির জন্য আরেকটা ক্যাট হাউস। ও ক্যাট হাউসের সামনে এসে দেখে ভেতরে এলাচি আর লিলি একে অপরের দিকে ফিরে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। অথচ তাদের আন্ডাবাচ্চাগুলো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুষ্প চিনি মিনিকে তাদের হাউসে রেখে আবার রুমে ফিরে এলো। এসে দেখল প্রার্থ রুমের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। পুষ্প এগিয়ে এলো। প্রার্থর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আপনি এখানে কেন? বিছানায় যান। ক্লান্ত হয়ে গেছেন। ঘুমান। বাচ্চারা ঘুমিয়েছে?”
প্রার্থ উঠল না। উল্টো পুষ্পকে টেনে নিজের কোলে বসাল। বলল,
“বাচ্চারা তিনজনই ঘুমিয়ে গেছে। এবার তোকে নিয়ে আমি ঘুমাবো।”
“তাহলে বিছানায় চলেন। এখানে বসে বসে ঘুমাবেন?”
“এখানে থাকি একটু। ভালো লাগছে।”
পুষ্প আর বারন করল না। বসে রইল প্রার্থর কোলে। প্রার্থ মুখ গুজে পরে রয় পুষ্পর কাঁধে। বেশ অনেকটা সময় কাটে। পুষ্প হঠাৎ কি মনে করে বলে উঠে,
“আপনার বাচ্চা অনেক পছন্দ, তাইনা?”
প্রার্থর শান্ত স্বর,
“তুই জানিস না?”
“জানি তো পছন্দ। তবে আমাদের যে কোন বাচ্চা নেই।”
“ওরাই আমার বাচ্চা।”
“ওরা তো আমারও বাচ্চা। কিন্তু আছে না, আপনার নিজের বাচ্চা। আপনার আর আমার।”
“নেই তো? কি করার আছে আর? যা আছে তাতেই সন্তোষ্ট।”
“তবুও। একটু আফসোস হয় না?”
“না হয় না। তুই আছিস না? তুই আমার থাকলে দুনিয়ার কোন কিছুতে আমার আফসোস থাকবে না।”
পুষ্প আর কিছু বলল না। চুপ রইল অনেকক্ষণ। প্রার্থ এবার উঠতে চায় বিছানায় যাওয়ার জন্য। পুষ্প উঠতে দেয় না। ভাবে আজই সব বলবে। আর লুকানো সম্ভব না। যে সুখবরটা সে প্রার্থর জন্মদিনের দিন দিতে চেয়েছিলো সেটা আজই বলে দিবে। এই আনন্দ একা একা ভোগ করার মজা নেই। সে প্রার্থকে বসিয়ে রেখেই বলে,
“এখন না।পরে। আপনাকে জরুরী একটা কথা বলব।”
প্রার্থ কপাল কুঁচকে শুধাল,
“কি কথা? ”
“আগে বলুন, আপনার বাবা চাই নাকি মা চাই?”
“মানে?”
“আরে একটা চুজ করুন না? বাবা চাই নাকি মা চাই?”
প্রার্থ না বুঝেই বলল,
“দুটোই চাই।”
পুষ্প তখন বিড়বিড় করে বলে,
“তাহলে আমাদের দুটো বাচ্চা হবে। ”
প্রার্থ বুঝল না। পুষ্পর চোখের কোন ততক্ষণে ভিজে উঠেছে। ও প্রার্থর হাতটা টেনে নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখল। কম্পিত স্বরে বলল,
“এখানে আপনার একটা বাবা নয়তো একটা মা আছে। আপনার কোনটা চাই বলুন তো।”
প্রার্থর চোখমুখে বিস্ময়। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে পুষ্পর চোখে। পাঁচ বছরের সংসার জীবন তাদের। পুষ্পর অসুস্থতার পর সে আর মা হওয়ার সুযোগ পায়নি। ডাক্তারও দেখিয়েছে তবুও লাভ হয়নি। শেষমেশ আশা ছেড়ে দিয়েছে তারা। আশা ছাড়ার পর হঠাৎ সুখবরটুকু শুনে সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে শুধু তাকিয়েই আছে। হাসফাস করে উঠেছে বুকের ভেতর। বড় বড় শ্বাস ফেলে প্রার্থ শুধাল,
“এ..এটা সত্যি?”
পুষ্প ভেজা চোখেই হেসে দিলো। প্রার্থর গালে হাত রেখে বলল,
“আপনার মনেহয় আমি এই বিষয় নিয়ে মজা করবো?”
প্রার্থ ঘনঘন মাথা নাড়ে দুপাশে। ছেলেটার চোখও ভিজে উঠেছে। প্রথমবার বাবা হয়েও বাবা না হওয়ার কষ্ট সে কখনো ভুলবেনা। পুষ্পকে বুঝতে না দিলেও সে মনে মনে চাইতো তাদের একটা বাচ্চা হোক। প্রার্থকে বাবা ডাকার একটা মানুষ হোক। অবশেষে! অবশেষে আল্লাহ তার ইচ্ছেটা পূরন করেছে।
সে আর একভাবে বসে রইলো না। পুষ্পর গালে নাকে মুখে সহস্রাধিক চুমু খেল। পুষ্পকে সোফায় বসিয়ে নিজে হাটু গেড়ে বসে পরল নিচে। পুষ্পর পেটে হাত রেখে দৃষ্টি পুষ্পতে তাক করে বলল,
“আমি আবার বাবা হবো ফুল?”
“হুম। আমরা আবার বাবা-মা হবো।”
প্রার্থর পুষ্পর পেটেও চুমু খায় অনেকগুলো। পুষ্পকে জরিয়ে ধরে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতরেই ওকে নিয়ে গোল গোল ঘুরতে থাকে। এই খুশি আর ধরে রাখে কে?
একচোট লাফিয়ে বেড়িয়ে থামে সে। পুষ্পকে দাঁড় করায় নিজের মুখেমুখি। দুহাত পুষ্পর গালে রেখে মোহনীয় স্বরে জানায়,
“এত খুশি কেন দিস আমাকে? এই খুশি আমি কোথায় রাখবো বল? আমার খুশিতে পাগল হতে ইচ্ছে করছে।”
পুষ্প ভেজা চোখে কম্পিত স্বরে হাসতে হাসতে বলে,
“এই সাবধান! একদম পা/গল হওয়া যাবে না। আমার বাচ্চা পৃথিবীতে এসে তার বাবাকে পাগল দেখলে কি ভাববে বলুন তো।
” পা/গলকে দেখলে তো পা/গলই ভাববে।”
পুষ্প খিলখিল করে হসলো। তার বরটা আসলেই পা/গল।
প্রার্থ হুট করে পুষ্পর ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো। কিছুক্ষণ বাদে ছেড়ে এসে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“আজ তোর কি চাই বল। আমাকে আবার বাবা হওয়ার সুযোগ দেওয়ায় আজ তোর জন্য সবকিছু করবো আমি। বল কি চাই।”
পুষ্প দুহাতে প্রার্থর গাল চেপে ধরে বলে,
আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৪৭
“আমার আপনাকে চাই। আমার আমাদের সন্তানকে চাই। আমার পরিপূর্ণ একটা সংসার চাই।”
প্রার্থ কিছু বলল না। পুষ্পর কপালে ছোট চুমু দিয়ে তাকে জরিয়ে রাখলো নিজের সাথে। মিশিয়ে রাখলো বুকের সাথে। পুষ্পও গুটিশুটি মেরে পরে রইল সেই বুকে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শান্তি, সর্বোচ্চ সুখ মহান আল্লাহ তার ঝুলিতে এনে ঢেলে দিয়েছেন। এতটুকু দুঃখের বদলে এতক্ষাণি সুখ লেখা থাকলে ওই দুঃখটুকু কোন ব্যপার না। প্রার্থ পুষ্পর এখন সুখী জীবন। জীবনের পুরোটা পথ তাদের এভাবেই সুখে শান্তিতে কাটুক।