আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৭

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৭
তানহা ইসলাম বৈশাখী

রাতের এরকম উৎসবমুখোর একটা জায়গা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একেকজনের হাতে ধারালো অস্র, লাঠি । যে যাকে পারছে মারছে। কয়েকজনের মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। হাত পায়ে লেগে সেখান থেকেও রক্ত বের হচ্ছে। এক ধরনের যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী হয়ে গেছে।
পুষ্পর মাথায় প্রথমে আঘাত লেগে রক্ত বের হলেও অতটা ক্ষতি হয়নি। মাথায় হাত দিয়ে রক্ত আটকে এদিক ওদিক পথ খুজছে অথচ কোন জায়গা দিয়েই বের হতে পারছে না। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসে একজন বারি মারলো পুষ্পর মাথায়। এবার আর টিকে থাকা যাচ্ছে না। ব্যাথায় ককিয়ে উঠেছে মেয়েটা। ফর্সা দবদবে মুখটা ব্যাথায় লাল হয়ে উঠেছে। রক্ত দিয়েও মাখো মাখো হয়ে আছে। ভাড়ি আঘাতে এবার চোখটা বুজে আসছে। ঝাপসা লাগছে চারিপাশ।

মারামারি, গন্ডগোল হওয়ায় স্টেজে পারফর্ম করা যুবকরাও থেমে গেছে। সিকিউরিটি গার্ডরা সবাই মানুষের হট্টগোল, হাতাহাতি থামাতে ব্যাস্ত । প্রার্থ কেবলি নিজের গিটারটা নামাতে গেলো ওইখানে কি হচ্ছে নিজে গিয়ে দেখবে বলে। ব্যাপারটা এখানেই ক্লিনআপ করা দরকার৷ তবে গিটারটা গলা থেকে সরাতে পারলো না তার আগেই দেখলো পাশ থেকে অর্নব ‘লিটেল প্রিন্সেস’ বলে ডেকে দৌড়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। অর্নবের এমন দৌড় দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো সামনে। অর্নবকে অনুসরণ করে তাকাতেই চোখে এলো রক্তাক্ত পুষ্পর মুখ। কপালের পাশ ঘেষে থুতনি অব্দি চলে এসেছে র*ক্তের স্রোত। চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে। ওকে ওইভাবে দেখে প্রার্থ গিটারটা ফেলেই দৌড় দিলো।

অর্নব স্টেজ থেকে লাফিয়ে নেমে গিয়ে পুষ্পর কাছে গেলো। ততক্ষনে পুষ্প হাটু গেড়ে বসো পড়েছে। মাথা ঝাকিয়ে সামনে তাকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সব ঝাপসা। কষ্ট করে হলেও চোখটা খুললো। ঝাপসা চোখেই আবছা দেখা গেলো প্রার্থট মুখ৷ প্রার্থকে আকুল হয়ে দৌড়ে আসতে দেখে ঠোঁট প্রসারিত হলো। মুখে অস্পষ্ট স্বরে আওরালো
“-প্রার্থ!
অর্নব পুষ্পর সাথে বসে পড়েছে। দুহাতে বাহু ধরে রেখেছে মাটিতে শুয়ে পড়া থেকে বাচাতে। পুষ্প প্রার্থ বলেই অর্নবের হাতেই ঢলে পড়লো। পুষ্পর মুখে প্রার্থ নাম শুনে আপনাআপনি হাতটা ঢিলে হয়ে গেলো। সামনে তাকালে দেখলো প্রার্থ দৌড়ে এসে পড়েছে তাদের সামনে।
প্রার্থ এসেই পুষ্পকে নিজের একহাতের উপর রাখলো। অন্যহাতে মুখে কয়েকটা চাপড় মেরে ডাকলো তাকে।
“-পুষ্প! পুষ্প, পুষ্প উঠ।
অর্নব পুষ্পকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো৷ তাড়া দিয়ে বললো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“-পুষ্পকে কোলে তোল প্রার্থ। চল এখান থেকে। ও সেন্সলেস হয়ে গেছে। কোলে তোল জলদি।
ততক্ষনে হৃদয়রাও এখানে এসে দাড়িয়েছে। তারা সকলে এখানে দেখে সিকিউরিটি গার্ডরা তাদের ঘেরাও করে রেখেছে। মানুষজনকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রার্থ আর দেরি না করে পুষ্পকে কোলে তুলে নিলো। সামনের রাস্তা পরিষ্কার করে দিলো অর্নবরা। প্রার্থ ওকে কোলে নিয়ে চলে গেলো কমনরুমের দিকে। সেখানে গিয়ে সোফার উপর শুয়িয়ে দিলো পুষ্পকে।
প্রিয়া, অন্ত’রা এদিকটায়ই ছিলো। প্রার্থকে এভাবে কোলো করে পুষ্পকে আনতে দেখে তারাও পিছু পিছু এসে পৌছায় এখানে।
প্রার্থ তাকে সোফায় সুয়িয়ে দিয়েই সরে আসলো। প্রিয়া গিয়ে পুষ্পর কাছে বসে কান্নারত অবস্থায় বোনকে ডাকলো বার কয়েক

“-বুবু! বুবু কি হয়েছে তোমার? প্রার্থ ভাই, বুবুর মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। কিছু করো।
সবাই পুষ্পকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। কার্তিক কোথা থেকে এক বোতল পানি এনে উপর থেকে ছিটিয়ে দিলো পুষ্পর মুখে। তাতেও কাজ হলো না। জ্ঞান ফিরলো না।
হৃদয় ডাক্তারের সাথে কথা বলে এসে বললো।
“-ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি। আসতে একটু সময় লাগবে।
প্রিয়া ভায়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো।
“-কিন্তু বুবুর তো জ্ঞান ফিরছে না। আমার ভয় করছে। কিছু করোনা প্রার্থ ভাই। প্লিজ বুবুকে বাচাও।
উপস্থিত সবাই পুষ্পকে নিয়ে বিচলিত হলেও তেমন কোন রেশ দেখা গেলোনা প্রার্থর মাঝে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে পুষ্পর রক্তমাখা মুখে তাকিয়ে আছে নির্বিশেষ। প্রিয়াকে ওমন কাঁদতে দেখে ধমকে উঠলো প্রার্থ।
“-চুপ কর। ম*রে যায়নি তোর বোন। এত কেন কাদছিস? এত সহজে ম*রবে না ও। প্রথমে আমাকে জালিয়ে মা*রবে এরপরেই না ম*রবে।

এতক্ষনের ভায়ার্ত, অসহায় চাহনী নিমিষেই বদলে গেলো প্রিয়ার। সেখানে ভর করলো বিষ্ময় ও একরাশ বিষন্নতা। হৃদয় ধমকে উঠলো প্রার্থকে।
“-এটা কোন ধরনের কথা প্রার্থ? ও তোর বউ একটু তো কেয়ার কর। মেয়েটা সেন্সলেস হয়ে পরে আছে। মাথা ফেটে গেছে। তোর কি একটুও খারাপ লাগছে না?
অন্তও বললো।
“-তুমি সবসময় পুষ্প আপুকে নিয়ে এত খারাপ কেন ভাবো ভাই? আপুর জ্ঞান নেই তবুও এগুলোই বলছো তুমি?
প্রান্ত পুষ্পর শিয়রে দাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
“-প্রার্থ ভাই তুমি সত্যিই খুব বাজে। ফুল আপুকে শুধু কষ্টই দাও। তুমি জানো ফুল আপু তোমাকে কতটা ভালোবাসে? তুমি কেন এত কাঁদাও আমার আপুকে?

প্রার্থ সবার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে অন্তকে স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলো।
“-অন্ত! প্রিয়ু আর প্রান্তকে বাড়িতে নিয়ে যা।
অন্তর কিছু বলার আগে প্রিয়া শক্ত গলায় বললো
“-কোথাও যাবো না আমি বুবুকে ছেড়ে। হৃদয় ভাই ডাক্তারকে আরেকবার ফোন করুন না। দেখুন না কোথায় আছে?
প্রার্থ এগিয়ে এলো। বললো গম্ভীর স্বরে।
“-তোদের যেতে বলেছি যাবি। ব্যাস!
প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে কথাটুকু বলে পুষ্পকে কোলে তোলার জন্য নিচু হলো হাত বাড়িয়ে। প্রিয়া হুট করে বলে ফেললো।

“-ছোবেনা তুমি। আমার বুবুকে একদম ছোবেনা। তোমার কোন অধিকার নেই আমার বুবুকে ছোয়ার।
প্রার্থ পুষ্পকে না তুলে পিঠ সোজা করে দাঁড়ালো। সরু চোখে তাকিয়ে বললো।
“-তুই আটকাবি আমাকে ওকে ছোয়া থেকে? দুইবোন সবসময় অধিকারের কথা বলবিনা একদম। আমি অধিকার দেখালে টিকতে পারবে তোর বোন? সর সামনে থেকে।
প্রিয়াকে তোয়াক্কা না করেই পুষ্পকে কোলে তুলে নিলো। কপাল থেকে রক্ত পড়া এখনো বন্ধ হয়নি। প্রার্থ এক পলক পুষ্পর দিকে তাকিয়ে অন্তকে বললো।
“-প্রিয়ুকে বাসায় নিয়ে যা। কার্তিক আমার সাথে আয়।
প্রিয়া নাকচ করে বললো।
“-আমি বাসায় যাবো না এখন। তুমি বুবুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
“-মা*রতে নিয়ে যাচ্ছি তোর বুবুকে।
প্রিয়া ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলো।

“-কি বলছো? ছাড়ো বুবুকে? তুমি পাগল হয়ে গেছো ভাইয়া ছাড়ো বুবুকে।
প্রিয়া এগিয়ে গিয়ে প্রার্থকে থামাতে ন্যায়। অন্ত এসে আটকে দেয় তাকে। হাত ধরে টেনে বলে।
“- কিচ্ছু হবে না আপুর। তুই থাক এখানে। আপুকে হসপিটালে নিবে ভাই।
প্রিয়া থামলো অন্তর কথায়। পরপর হন্যে হয়ে বললো
“-তাহলে আমিও যাবো। আমাকেও নিয়ে চলো।
ততক্ষণে প্রার্থ বেড়িয়ে গেছে রুম থেকে। পুষ্পকে কোলে করে নিয়ে নিজের গাড়ির পেছনের সিটে শুয়িয়ে দিলো। প্রিয়া হুট করে দৌড়ে এসে গাড়ির ভেতরে বসে বোনের মাথা নিজের কোলে তুলে নিলো।
” – তাড়াতাড়ি চলো ভাই। বুবুর কিছু হয়ে যাবে। প্লিজ তাড়াতাড়ি চলো। এখনো জ্ঞান ফিরছে না কেন?
প্রার্থ আর কিছু বললো না। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। পাশে বসেছে কার্তিকও। অর্নব হমদয়রা এখানেই থেকে গেলো। এখানের ব্যাপারটা সর্ট আউট হওয়ার আগ পর্যনৃত তাদের এখানেই থাকতে হচ্ছে।

ঝগড়া লাগার মূল কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে অর্নবরা মনে করছে তাদের বিপক্ষ দল রক রাইডার্সদের কাজ এটা। তাদের কনসার্টের বারোটা বাজানোর জন্য লোক দিয়ে এরকম একটা কান্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ এসে গেছে। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকে আহত হয়েছে তাদেরকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। এই স্পটটা এখন অনেকটাই খালি হয়ে গেছে। মানুষজনের ভীর কমে এসেছে। কনসার্টও আজকের মতো শেষ হয়ে গেছে।
ঘড়ির কাটা রাত এখন প্রায় একটার ঘরে। অর্নবরা এখানের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে রওনা হয়েছে প্রার্থদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। হাসপিটালেই যেতে চেয়েছিলো কিন্তু পরে খবর এলো পুষ্পকে বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। তাকে দেখতেই যাওয়া হচ্ছে সেথায়।

প্রার্থর রুমে বসে আছে সকলে। পূর্নিমা বেগম থেকে শুরু করে অহনা বেগম, আশরাফ চৌধূরী, এমনকি পুষ্পর মা বাবাও উপস্থিত। তারা পুষ্পর এমন কথা শুনে ছুটে এসেছে এই মাঝ রাতে। পুষ্পর মা পূর্ণতা বেগম ক্ষনে ক্ষনে কাঁদছে। মেয়ের মাথায়, পায়ে ব্যান্ডেজ দেখে বুকটা পুড়ে যাচ্ছে। কত চঞ্চল মেয়েটা তার কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে। পুষ্পর বাবা প্রত্যয় আহসান মেয়ের মাথার কাছে বসে আছে। পুষ্প এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হসপিটালে জ্ঞান ফিরতেই বাড়িতে আসার জন্য পাগলামো করছিলো। প্রার্থ অবশ্য আজ রাতেই বাড়িতে আনতো না তাকে কিন্তু বোকামি করে বসেছে প্রিয়া। বাড়িতে ফোন করে সকলকে জানিয়ে দিয়েছে। তখন পূর্নিমা বেগম কেঁদে কেটে ছেলেকে বলেছে হয়তো তাকে হসপিটালে নিয়ে যাও নয়তো পুষ্পকে বাড়িতে আনো। সে দেখবে তার মেয়েকে। প্রার্থ বাধ্য হয়েই বাড়িতে নিয়ে আসলো। তবে বাড়িতে আসার আগে ডাক্তার কড়া ডোজের ওষুধ দিয়েছে যার কারনে এখন বেহুসের মতো ঘুমোচ্ছে। নাহয় ব্যাথায় হয়তো ঘুমাতেই পাড়তোনা মেয়েটা।
কপালের কাছে লেগেছে, মাথার পেছনে বাড়ি লেগেছে, হাতেও মোটা লাঠির বারির দাগ বসে গেছে, পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা মানুষের যাতায় প্রায় থেতলে গেছে। ডাক্তার বারবার প্রোপার রেস্টে থাকতে বলেছে। কয়েকদিন বেড রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।

অর্নবরা প্রার্থদের বাড়িতে পৌছালো রাত একটার একটু পরে। প্রার্থ তখন ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। পুরু গোলাপি ঠোঁটটা সিগারেটের আগুনে পুড়ে কালচে হয়ে গেছে। বড় বড় চুলগুলো বাতাসের দমকায় উড়ছে। সিগারেটটাও বাতাসের কারনে তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যাচ্ছে।
ছাদের রেলিংয়ে দাড়িয়ে দেখলো অর্নবরা গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে আসছে। কিন্তু প্রার্থর কোন হেলদোল দেখা গেলো না। সেখানে দাঁড়িয়েই আপন মনে সিগারেট টানছে। নিচে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলোনা হয়তো।
হৃদয়রা বাড়ির ভেতরে এসে দেখলো সবাই পুষ্পকে ঘিরে আছে। টুকটাক কথা বলছে কিকরে দূর্ঘটনাটা হলো? পুষ্পর কি করে লাগলো? এইসবই আরকি। অর্নবরা সেখানে কার্তিকসহ সবাইকে পেলেও প্রার্থকে দেখতে পেলো না। তবুও একটু বসে সবার সাথে ক্ষানিকক্ষন করা বললো তারা। অর্নব আস্তে করে উঠে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। মিউজিক রুমে প্রার্থকে খুজে না পেয়ে সোজা চলে গেলো ছাদের দিকে।
ছাদে এসে দেখলো একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে সে। নিচে আরেকটা খাওয়া সিগারেট যেটায় আগুন এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। নিভে যায়নি পুরোপুরি। প্রার্থর পিঠ ছিলো অর্নবের দিকে ঘোরা। অর্নব প্রার্থর সোজাসুজি পেছনে দাঁড়িয়ে বললো।

“-তুই এখানে কেন?
হঠাৎ শব্দে একটু নড়লোনা অব্দি সে। যেভাবে ছিলো সেভাবেই রইলো। যেন তার আগে থেকেই জানা ছিলো অর্নব এখানে আসবে। প্রার্থ এবার পিছনে ঘুরে গেলো। হাওয়ায় ধোয়া ছেড়ে বললো।
“-তো আমার কোথায় থাকার কথা?
“-এটা কি আমাকে বলতে হবে?
“-চাইলে বলতে পারিস।
অর্নব বিরক্তিতে মুখে ‘চ্ব’ সুচক শব্দ বের করে বললো
“-এমন কেন করিস বা*ল? তুই জানিস না তোর কোথায় থাকা উচিত?
“-তোকে তো বললাম তুই বল আমার কোথায় থাকা উচিত।
“-তোর এখন পুষ্পর কাছে থাকা উচিত।
প্রার্থ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। গাল ভরতি ধোয়া বের করলো। হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সেই সাদা ধোয়া। রেলিংয়ের সাথে পিঠ এলিয়ে দিলো। চুলগুলো ঠেলে আকাশের পানে চেয়ে বললো।
“-ওর কাছে সবাই আছে।

“-কিন্তু ওর তো সবচেয়ে বেশি তোকে প্রয়োজন।
প্রার্থ ঘাড় সোজা করে তাকালো ওর দিকে। ভ্রু কুচকে বললো।
“-কেন? আমি ডাক্তার?
অর্নবের বিরক্তি বাড়লো। চোখমুখ কুচকে বললো
“-ধুর বা*ল। এত ত্যাড়া কেন ভাই তুই?
প্রার্থর নির্লিপ্ত জবাব।
“-আমি ত্যাড়া তাই আমি ত্যাড়া।
“-ভাই মাফ কর। আমি জীবনেও কথায় পারবোনা তোর সাথে। এখন নিচে চল।
“- কেন?
” আন্টি ডাকছে তোকে।

প্রার্থ আর কথা বাড়ালো না। অর্নবকে রেখেই নিচের দিকে গেলো। অর্নব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ জানালো শত শত। নিজের মনে নানান কথা ভেবে ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ভারী শ্বাস ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিজেও চলে গেলো নিচের দিকে।
প্রার্থ রুমে এসেই মাকে শুধালো।
“-ডেকেছিলে মা?
পূর্নিমা বেগম বললেন।
“-না ডাকিনি। কিন্তু তুই কোথায় গিয়েছিস? একটু বোস না ওর কাছে। তোর ছোটমা তোকে খুজছিলো।
প্রার্থ পূর্নতা বেগমের কাছে গিয়ে দাড়ালো। ভদ্রমহিলা কাঁদছেন। প্রার্থ শান্তনা বানী দিয়ে বললো।
“-কাঁদছো কেন ছোটমা? কিছু হয়নি ওর। ঠিক হয়ে যাবে দুইদিনেই।
পূর্নতা কান্নামাখা স্বরে বললেন।
“-ভালো লাগছে না রে প্রার্থ। আমার এত চঞ্চল মেয়েটাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না। তোদের বিয়ের পর থেকে আমার সাথে ভালো করে কথাও বলেনা মেয়েটা। জানিনা কেন এত অভিমান আমার উপর।
পূর্নতার কথায় প্রার্থ তাকালো পুষ্পর দিকে। কিছুক্ষন ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে বললো।
“-কেন কথা বলে না?
পুর্নিমা বেগম ছেলেকে বলে উঠলো।

“-ওসব কথা থাক না এখন। পূর্ন তুই প্রত্যয়কে নিয়ে একটু বিশ্রাম কর। সারাদিন কাজের জন্য দৌড়াদৌড়ি করিস এখন নিশ্চয়ই ক্লান্ত। একটু ফ্রেশ হয়ে নে। আমি দেখছি ওকে।
অহনা তুইও যা। কাল তো অফিসেও যাবি। একটু বিশ্রাম কর তোরা সবাই।
প্রার্থ মাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
“-তুমিও যাও। এখানে তোমাকে থাকতে হবে না। প্রিয়ু দেখে নিবে ওকে।
কথার মাঝে ফোঁড়ন কাটলো অর্নব আর হৃদয়।
“-প্রিয়া কেন থাকবে। তুই থাকলেই তো হবে।
“-তাইতো। প্রিয়াও ক্লান্ত। মেয়েটাকে দেখেছিস কেমন ঝিমিয়ে গেছে। তুই থাক পুষ্পর কাছে। এমনিতেও ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। উঠবে না আর রাতে। তুইই থাক এখানে। সবাই একটু বিশ্রাম করুক।
প্রার্থ প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করলো।
“-প্রিয়ু তুই থাকতে পারবি এখানে?
হৃদয় প্রিয়াকে চোখ দিয়ে বার বার ইশারা করছে যেন সে বলে যে পারবেনা থাকতে। প্রিয়া বুঝে ফেললো তার ইশারা। মাথা ঝাকিয়ে বললো।
“-আমি মনেহয় পারবোনা ভাই। অনেক ক্লান্ত লাগছে।
পূর্নতা বেগম বললেন।

“-তোরা সবাই ঘুমা গিয়ে আমি থাকছি ওর পাশে। তোরা তো সবাই ক্লান্ত।
“-প্রয়োজন নেই। আমিই থাকছি। তোমরা যাও।
প্রার্থর কথায় আরো কিছু বলবে তার আগে হৃদয় তাড়া দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বের করে দিলো ঘর থেকে। সবাই একে একে বেড়িয়ে গেছে বাকি বন্ধুরাও বেড়িয়ে গেলো। রকি যাওয়ার আগে বলে গেলো।
“- তুই আবার ঘুমিয়ে যাস না। একটু খেয়াল রাখিস নিজের বউয়ের।

প্রার্থ কিছু বললো না। দরজা আটকে দিয়ে পুষ্পর সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত মুখটার দিকে। ফর্সা নাক, মুখ এখনো লাল হয়ে আছে। ফোলা ফোলা গালগুলো বেশি ফোলা দেখাচ্ছে না এখন। যেন দুদিনেই শুকিয়ে গেছে অনেকটা। প্রার্থ আজকাল শুধু পুষ্পকে দেখেই যায় ভেতর থেকে কথা আসতে চায় না। মন তো চায় সবসময় অপমানের উপরে রাখতে। কিন্তু সহজে ভেতর থেকে সেসব কথা বের হতে চায় না।
কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সে ঝুকে পড়লো পুষ্পর উপর। বন্ধ চোখের দিকে চেয়ে বললো।
“-কবে মুক্তি দিবি আমায়? কেন এসেছিস আমার জীবনে? আমি তো তোকে চাইনা আমার লাইফে। তাহলে সব জেনেও কেন এলি? মারতে নাকি মরতে? জীবনে এসে যখন পড়েছিস তাহলে কষ্ট তো তোকে পেতেই হবে। একটাসময় এই প্রার্থ চৌধুরীর দেওয়া কষ্টগুলো সহ্য করতে পারবি না। তখন ছেড়ে যেতেই হবে। ততদিন নাহয় কষ্ট পেতে থাক।

কথাগুলো বলেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বালিশ নিয়ে সোফায় গিয়ে শুতে হবে এখন। আচানক কেমন গোঙানির মতো শব্দ হলো। প্রার্থ পেছন ঘুরে দেখে পুষ্পর ঠোট নড়ছে। কিছু বলছে হয়তো। প্রার্থ বালিশটাকে রেখে পুষ্পর কাছে গেলো। তবুও ভালোভাবে বুঝতে পারলো না সে কি বলছে। আস্তে ধীরে নিচু হয়ে পুষ্পর মুখের কাছে কান নিলো। অস্পষ্ট আওয়াজ এলো কানে। পুষ্প গোঙানোর মতো করে বলছে।
“-প্রার্থ ভাই! প্রার্থ!
নিজের নাম শুনে মাথা সোজা করলো প্রার্থ। বুকের কোথাও লাগলোও হয়তো। মাথা সোজা করায় মুখোমুখি হলো দুজন। দুজনের মুখের সাথে মোটে দুই ইঞ্চির মতো দূরত্ব। পুষ্পর গরম শ্বাস এসে লাগছে মুখে। এত সামনে থেকে পুষ্পর মুখটা একটু অন্যরকমই লাগলো। প্রার্থ চেয়ে রইলো সেই মুখে।
পুষ্প আবার অস্পষ্টে বলে উঠলো।

“-পানি, পানি।
প্রার্থ স্পষ্ট শুনলো পানির কথা। হুট করে উঠে পড়লো পুষ্পর উপর থেকে। শুকনো ঢোক গিলে পানি খুজতে লাগলো। টেবিলের উপর পানি দেখে সেটা নিয়ে গ্লাসে ঢেলে পুষ্পর সামনে আসলো। কিন্তু পুষ্পর চোখ খোলা নেই। বেহুসের মতো ঠোট নাড়াচ্ছে শুধু। প্রার্থ কি করবে বুঝতে পারছে না। ডাকবে কি পানি খেতে? পুষ্পই তো চাইলো। হয়তো পিপাসা পেয়েছে। নিজের মনেই দেনামনা করে সিদ্ধান্ত নিলো ডাকবে। মাথা নিচু করে আস্তে করে ডাকলো।
“-পুষ্প। পুষ্প উঠ। পুষ্প।
পুষ্পর সাড়া নেই। প্রার্থ এবার তার গালে হাত রেখে আলতো চাপড় দিলো গালে। গাল হাত দিতেই টের পেলো পুষ্পর মুখ গরম হয়ে আছে। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই গরম। গাল থেকে সরিয়ে আনা হাতটা আবারো গালে রাখলো। ভালোভাবে ধরতেই বুঝতে পাড়লো জ্বর এসেছে। তাপমাত্রা অনেকটাই বেশি শরীরের। পুষ্প এখনো পানি পানিই করছে।
প্রার্থ আবারো মুখে হাত দিয়ে ডাকলো।

“-ফু….
মুখে আসা কথাটাকে আটকে নিলো। এই নামে সে এখন ডাকে না। তবুও হুটহাট মুখ থেকে বেড়িয়ে আসতে চায়। মুখে আশা কথাটুকু গিলে ফের ডাকলো।
“-পুষ্প উঠ। পানি দেবো?
পুষ্প হালকা করে চোখটা খুললো। চোখের সামনে কিছুই পরিষ্কার নয়। আস্তে আস্তে একটু করে খুলতে আবছা অবয়ব দেখতে পেলো শুধু। ওইটুকু দেখেই মনে হলো এটা প্রার্থ।
ব্যাথায় জর্জরিত মুখ নিয়েই একটু হাসলো। উচ্চারন করলো।
“-প্রার্থ!
প্রার্থ পুষ্পর ঘারের নিচে হাত দিয়ে শোয়া থেকে উঠালো। মুখের সামনে পানির গ্লাস নিয়ে বললো।
“-পানি খা।
পুষ্প হয়তো খুব কষ্টে এক ঢোক পানি গিললো। এরপর আবার শুয়িয়ে দিলো। প্রার্থ ওর গায়ে কাথা টেনে চলে আসতে চাইলো। পুষ্প তার রুগ্ন হাতটা দিয়েই ধরলো প্রার্থর হাত। পুষ্পর হাতটা এতো গরম। তার হাতের গরম ভাব প্রার্থর হাতেও লাগছে। পুষ্প হাত ধরায় প্রার্থ পেছনে ঘুরে শক্ত কন্ঠে বললো।
“-কি চাই?
পুষ্প আধো আধো চোখে তাকিয়ে আধে স্পষ্টে বললো।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৬

“-আপনি কেন ছেড়ে যান আমায়? কেন আমার জন্য একটুও মায়া হয় না আপনার? কেন এত অবহেলা? না চেয়েও পেয়ে গেছেন বলে? তাই বলে এতটা অবহেলা? আমাকে কি মানুষ মনে হয় না? আমার ভালোবাসা কি ভালোবাসা মনে হয় না? বলুন না।
এতটুকু কথা বলতে অনেকটা সময় লেগে গেলো তার।ঠোঁট দুটো তীর তীর করে কাপছে। বারবার আটকে আটকে বলছিলো কথাগুলো। চোখের দুপাশ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো কান অব্দি। আরো চেয়ে থাকা দুস্কর হয়ে পরলো। আধো খোলো চোখদুটো বুজে গেলো আপনাআপনি।

আমরণ প্রেমতৃষ্ণা পর্ব ৮