আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২২
নূরজাহান আক্তার আলো
সন্ধ্যা সাতটা।
হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি। ঝড়ো বাতাস নেই। তবে অঝর বৃষ্টি। বাসায় ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজেপুরে রুপক তেলেভাজা খাবার এনেছে। গরম গরম বেগুনি, পেঁয়াজু, রোল, কুহুর ভীষণ পছন্দ। আনার সঙ্গে সঙ্গে সে খেতে শুরু করেছে। খেতে খেতে ফোনে নাটক দেখছে। ভীষণ হাসির নাটকটা।
হাসতে হাসতে একা একা গড়াগড়ি খাচ্ছে সে। তার হাসিতে ড্রয়িংরুমের প্রতিটি কোণে যেন ঝলমল করছে। হাসছে। গাইছে। সাজছে। রঙিন রুপ ধারণ করেছে আশপাশ। রুপক তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সেই হাসি প্রাণ ভরে দেখছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, বাসার মেয়ে, বউরা, হাসলে বাসাও হাসে। সুখসমৃদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। এখন যেমন তার বোনটা হাসছে দেখে তার পৃথিবীও ঝলমল করছে। সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে বোনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে এসে রান্নাঘরে উঁকি মেরে মাকে খুঁজল। মাকে না পেয়ে গেল বাবা মায়ের রুমে। সে বাইরে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলো। আম্মু! আম্মু! ডেকে জানাল নিজের উপস্থিতি। এর
আগে কারোই অনুমতি নিতো না সে। যার তার রুমেই ঢুকে পড়তো। নক করে ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো ধৈর্য্য ছিল না কখনোই। কিন্তু ক্লাস ফাইভে থাকাকালীন তার মা তাকে বেত দিয়ে ইচ্ছে মতোন পিটিয়েছিল।
অপরাধ ছিল, তার সদ্য বিবাহিত চাচ্চুর রুমে অনুমতি না নিয়ে সে ঢুকে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে চাচ্চু আর চাচি ছিলেন রোমান্সে ব্যস্ত। এরপর যা যাওয়ার তাই হলো। তাদের রোমান্স করতে দেখে বাসার সবাইকে বলে দিয়েছিল। হাসাহাসিও হয়েছিল। এতে ভীষণ লজ্জাও পেয়েছিল চাচ্চু।আর চাচি রাগে লজ্জায় বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল, বাসায় প্রাইভেসি নেই, গোঁয়ো ভূত, আদব কায়দা জানে না, এসব নানান কথাবার্তা বলে।
কোনোভাবেই সেদিন চাচিমাকে কেউ আঁটকাতে পারে নি। সে নিজেও সরি বলেছিল। তবুও চাচি চলে গিয়েছিলেন। চাচিমা চলে যাওয়ার পর ইসমত আরা তাকে জিলাপি দেওয়ার নাম করে রুমে ঢুকিয়ে মনের রাগ না কমা অবধি ইচ্ছেমতো পিটিয়েছিল। সেই মার খেয়ে আজও ভোলেনি কারো রুমে প্রবেশের আগে নক করা ভদ্রতা। সভ্যতা। আর ভদ্রতা জ্ঞান টুকু সবার মধ্যে থাকা উচিত।ছেলের উপস্থিতি বুঝে ইসমত আরা জলদি শাড়ির আঁচল ঠিক করে অনুমতি দিলে রুপক তখন রুমে প্রবেশ করল।
বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে মুদু হাসল। বিছানার উপর বসল। বাবা ইজি চেয়ারে বসে পেপার পড়ছিল। আর তার মা বড় আলমারি খুলে কিসব ঘাটাঘাটি করছিলেন। গুছাচ্ছিলেন। সে বাবা মাকে বসতে বলে আসল কথা দিয়ে কথা শুরু করল,
-‘কুহুর জন্য আরেকটা নতুন ডাক্তার ঠিক করেছি। ভাবছি উনাকে দিয়ে দেখাব।’
ইসমত আরা বেগম ছেলের পাশে বসলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘কোন ডাক্তার?’
-‘ডাঃ ডেইজি।’
-‘কোন হসপিটালে বসে?’
-‘আসলে রিদওয়ান জানে। সেই ঠিক করেছে। কথাও বলেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কুহুকে ওখানে যেতে হবে।’
-‘কোথায় যেতে হবে?’
-‘সুইজারল্যান্ড!’
-‘পাগল হলি? তোর বোনকে তুই চিনিস না? সে দূরে কোথাও যায়? গিয়ে থাকতে পারে?’
-‘এটাই তো সমস্যা। কিন্তু কুহুর সমস্যাগুলো দিন দিন বাড়ছে দেখছোই তো। এবার সিরিয়াসলি ট্রিটমেন্ট না করলেই নয়। আর আমিও সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছি না আম্মু।’
-‘কিসের সুযোগ?’
-‘বাইরের দেশে গিয়ে কুহুর চিকিৎসা করানোর সুযোগ। আর রিদওয়ান যাকে তাকে ঠিক করবে না। এটাও আমি জানি। সে এই পরিস্থিতি দেখে বুঝে নিজ দায়িত্বে ডেইজিকে দিয়ে চিকিৎসা করানোর কথাজানিয়েছে।
যেভাবেই হোক কুহুকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে।’
-‘রিদওয়ানের বাবা মায়ের দেশে ফেরার কথা। তারা নাকি তাড়াতাড়িই দেশে সেটেল্ড হবে। তাহলে তোরা গিয়ে কোথায় থাকবি? কি করবি? কি বলছিস, না বলছিস কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি।’
-‘ আন্টি এতদিন দেশে বাইরে ছিল। উনি নিজে জব করতো। শপ আছে উনার। রিমিরও পড়াশোনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যত। রিদওয়ানের অফিস সবই তো ওখানে। এসব ছেড়ে হুট করে আসার কথা বললেই কি আসা যায়? আর রিদওয়ান যতটুকু জানাল, সে নাকি তার বাবাকেই ওখানে থাকার কথা জানিয়েছে। কারণ এমন আরাম আয়াশের জীবন এ দেশে হবে না।
আঙ্কেল এখনো কিছু জানায় নি যদিও। তবে রিদওয়ান আমাকে বলল, আমরা গেলে নাকি কোনো সমস্যা হবে না। সে সব হ্যান্ডেল করে নেবে।’
এতক্ষণ মা ও ছেলের কথোপকথন শুনে এবার রুপকের বাবা নড়ে চড়ে বসলেন। চিন্তিত সুরে জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘ কিন্তু কুহু কি যেতে রাজি হবে?’
-‘ রাজি করতে হবে বাবা। আর ভুলেও বলা যাবে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাব। তাহলে সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে।’
-‘তাহলে কিভাবে কি করবে?’
-‘বেড়ানোর লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাব । আজকে যেমন রিদওয়ান তাকে সুন্দর কিছু জায়গা দেখাল। ঘুরতে যাওয়ার কথা বলল। এভাবেই প্ল্যান এগোতে হবে। নয়তো হবে না।’
-‘কবে যেতে চাচ্ছো?’
-‘তোমাদের পারমিশন পেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাব।’
-‘যাব বললেই তো যাওয়া হয় না। ভিসা লাগবে। কুহুকে রাজি করাতে হবে।’
-‘ভিসার চিন্তা করছি না কারণ আমার ফ্রেন্ড দোয়েলের বাবা এসবেরই কাজ করে। টাকা খসালে ভিসা ম্যানেজ হয়ে যাবে। এখন বলো তোমরা কি বলছো?’
-‘তুমি কি বোনকে একা সামলাতে পারবে? এটাই তো চিন্তার কারণ।’
-‘এতদিন তো সামলে এসেছি। তাছাড়া রিদওয়ান তো আছে। চিন্তা কোরো না।’
-‘তোমার মাকে নিয়ে যাও।’
-‘আম্মুকে নিয়ে গেলে তোমার দেখভাল কে করবে? আমি আম্মুর ভিসা করতে দেবো। যদি খুব প্রয়োজন হয় টিকিট কেটে চলে যেতে পারবে। প্রথম আমরা দু’জন যাই। অবস্থা বুঝি।’
-‘ঠিক আছে।’
এরপর আরো কিছু ব্যাপারে আলোচনা সেরে রুপক ড্রয়িংরুমে এলো।
কুহু এখানে নেই। সে বোনের উপর উঁকি মেরে দেখে কুহুর চোখে কাজল পরছে। একচোখে পরা হয়ে গেছে। আরেক চোখে পরতে গিয়ে তার হাত থেমে গেল। কিছু ভাবল। তারপর আরেকচোখেও কাজল পরল। রুপক এবার বোনকে ডাকতে ডাকতে রুমে প্রবেশ করল। তারপর ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে উৎফুল্ল সুরে বলল,
-‘কত্তদিন পর বেড়াতে যাচ্ছি। কি যে আনন্দ হচ্ছে। ‘
-‘কোথায় বেড়াতে যাচ্ছ ভাইয়া?’
-‘বলব না।’
-‘কেন?’
-‘যদি তুইও যেতে চাস।’
-‘যেতে চাইলে নিয়ে যাবে।’
-‘জি না। ওখানে তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। অনেক দূর।’
-‘কতদূর শুনি?’
-‘সুইজারল্যান্ড।’
-‘সুইজারল্যান্ড? ওখানে কি করতে যাবে? ‘
-‘আরে পাগলি ওটাই তো বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশের একটি। ঘুরে বেড়ানোর দারুণ জায়গা।’
-‘কি কি আছে ওখানে?’
-‘দেখবি?’
-‘এখানে বসে কিভাবে দেখব?’
-‘আরে বোকা ফোন আছে কি করতে? সার্চ দিয়ে দেখব।’
-‘ওহ তাই তো।’
একথা বলে কুহুও ভাইয়ের পাশে ধপ করে শুয়ে পড়ল। রুপক গুগলে সার্চ দিয়ে কিছু দৃশ্য দেখাল। কুহু বিষ্ময় নিয়ে দেখল। এভাবে কিছু স্থান দেখে কুহু বলল,
-‘ভাইয়া!’
-‘আমি যেতে চাই, প্লিজ!’
-‘না।’
-‘কেন? আমার খরচের টাকা বাবা দিবে।’
-‘তাও নিয়ে যাব না।’
-‘কেন?’
-‘তোর মুডের ঠিক নেই। এখন বলছিস যাবি। একটুপর বলবি, যাব না। তখন এত টাকা দিয়ে ভিসা টিসা করিয়ে হুদাই টাকাগুলে জলে যাবে। এরচেয়ে তুই বাসায় থাক আমি বরং ঘুরে আসি।’
-‘না, না, আমি কথা চেঞ্জ করব না সত্যি। আমাকে নিয়ে চল ভাইয়া। বড় বড় পাহাড়, লেকের নীল পানি ছুঁয়ে দেখতে চাই আমি। আমি যাব।’
-‘তোর মুড সুয়িং হলেই পাল্টি খাবি আমি জানি। তুই এমন কিছু কর যাতে প্রমাণ পাই আর পাল্টি খাবি না তাহলে নিয়ে যাব।’
কুহু কিছুক্ষন ভাবল। তারপর একটা সাদা পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লিখল, ‘আমি সুইজারল্যান্ড বেড়াতে যেতে চাই। যেতে চাই! যেতে চাই! পরে পাল্টি খাব না। ভিসার টাকাও জলে ফেলতে দেবো না। যদি পাল্টি খাই অথবা আমার কারণে ভিসার টাকা জলে যায় তাহলে আমি…! ‘
একটু লিখে রুপকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘আমি কার বউ হলে খুশি হবে তুমি?’
-‘গরিলার বউ।’
-‘গরিলা কেন? রিকশাওয়ালার বউ হই?’
-‘না। আমার টাকা জলে গেলে তোকে গরিলার সঙ্গে বিয়ে দেবো। আর গরিলাকে শিখিয়ে দেবো যেন তোকে প্রতি বেলায় নিয়ম করে পাঁচটা করে থাপ্পড় দেয়।’
কুহুর করুণ চোখে তাকাল। চোখ বন্ধ করে ভেবে নিলো গরিলার মুখ। কালো কুচকুচে একটা গরিলা। মোটা ঠোঁট। বিশ্রী দাঁত। কুহু চোখ খুলে
কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই করল। কিন্তু রুপকের একই কথা। তাই সে বাধ্য হয়ে
লেখা সম্পূর্ণ করল,
-”আমি সুইজারল্যান্ড বেড়াতে যেতে চাই। যেতে চাই! যেতে চাই! পরে পাল্টি খাব না। ভিসার টাকাও জলে ফেলতে দেবো না। যদি পাল্টি খাই অথবা আমার কারণে ভিসার টাকা জলে যায় তাহলে আমি গরিলার বউ।’
এইটুকু লিখেই নিচে সাইন করে দিলো। রুপক সেটা নিয়ে আঠা দিয়ে কুহুর ড্রেসিংটেবিলের আয়নার লাগিয়ে দিলো। এবার যতবারই চোখে পড়বে ততবারই লেখাটা নিয়ে ভাববে। মেয়ে মানুষ আয়না দেখে বেশি।
আর কুহুর আয়না দেখার সময় লেখাটা বার বার চোখে পড়লে ভোলার চান্স কম। তারপর বোনের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সে রুমে এলো। তার, কুহুর এবং মায়ের ভিসার জন্য যাবতীয় কাগজপত্রও রেডি করল।
কাল সকালে যাবে ভিসার ঝামেলা মেটাতে। তখন হঠাৎ ফোন এলো।সে
ফোনের দিকে তাকিয়ে রিদওয়ানের নাম দেখে হাসল। কিন্তু কল রিসিভ করতেই কুহুর চিৎকার শুনতে পেল। সে ফোন হাতে নিয়ে বের হলো রুম থেকে। গিয়ে দেখে কুহু মেঝেতে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে কলা খেয়ে খোসাটা ছুঁড়েছে খেয়ালই নেই তার। এখন বেখেয়ালে কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে গেছে। রুপক বোনকে তুলে সোফায় বসাল। ব্যথা পেয়েছে নাকি জিজ্ঞাসা করল। ইসমত আরাও ছুটে এসেছে চিৎকার শুনে। উনিই কুহুকে বকতে বকতে এ্যান্টিসেপটিক ক্রিমও লাগিয়ে দিলো বাম হাত ও ডান পায়ের গোড়ালিতে। পুরো ঘটনা বুঝে এতক্ষণে রিদওয়ান মুখ খুলল,
-‘বোনকে ঠিকঠাক মতো হাঁটা শিখাস নি? শুকনো জায়গায় পড়ে কিভাবে?’
রুপক রিদওয়ানের কথা শুনে পাশের সোফায় বসল। ফোনটা মুখের সামনে ধরে হাসতে হাসতে বলল,
-‘ওকে রেললাইনের ধাঁরে কুঁড়িয়ে পেয়েছিলাম তো তাই যত্ন করে হাঁটা, কথা বলা, শেখানো হয় নি। বিয়ে দিয়ে তাড়িয়েই তো দেবো শুধু শুধু কষ্ট করার কি দরকার?’
-‘ তাও ঠিক। এজন্যই কুহুকে পড়া ধরলে তোতলায়।’
-‘তোতলায়? সিরিয়াসলি?’
-‘হুম। ওকেই নাহয় জিজ্ঞাসা কর। ‘
-‘ওর তোতলানো কমাতে নদীর পেটমোটা পটকা মাছ খাইছিলাম। এখন দেখি আরেকবার খাওয়াতে হবে।’
-‘খাইয়ে দিস। মেয়ে মানুষ। বিয়ে টিয়ে দিতে হবে।’
ওদের কথা শুনে কুহু রাগে গজগজ করতে করতে উঠে চলে গেল। এই লোকটাকে সহ্য হয় না তার। বিরক্তিকর লোক। বাসাতে থাকতেও খোঁচা মারত। জ্বালাত। এখন দূরে থেকে শান্তি দিচ্ছে না। কুহুকে যেতে দেখে
রুপক কথার প্রসঙ্গ চেষ্টা করল। তারপর বলল,
-‘ভাই মুখে যাইই বলি আমার খুব টেনশন হচ্ছে। ডাক্তার দেখানোর কথা শুনলে কুহু হাঙামা শুরু করবে। আমি বোনকে ভয় পাই না। ভয় পাই ওর জেদকে। ‘
আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২১
-‘আমিও কোনো দায়িত্ব নিলে সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে না সারা অবধি শান্ত থাকতে পারি না। টেনশন করে লাভ নেই। নিজেকে শক্ত কর। কুহুর জন্য যতটুকু করার দরকার। আমরা সবটুকু করব।’