আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৬
নূরজাহান আক্তার আলো
মুভি যখন প্রায় অর্ধেক শেষ তখন রিদওয়ান রুমে প্রবেশ করল। তাদের দেখে এক ভ্রুঁ উঁচু করে তাকিয়ে রইল। কুহু তার অনুপস্থিততে তার রুমে হামলা চালাতে পছন্দ করে সেটা তার ভালো করেই জানা আছে। রিমিও একই জাতের। এদিকে রিমি কিংবা কুহু তাকে দেখেও এমন ভাব করল যেন দেখেই নি। চেনেই না। সে তাদের পাত্তা না পেয়ে নিজেই মুখ খুলল,
-‘এই যে আপনারা আমার রুমে কেন, জানতে পারি?’
রিমি একবার কুহুর দিকে তাকিয়ে তারপর চকলেটে কামড় বসিয়ে ভাব দেখিয়ে জবাব দিলো,
-‘মুভি দেখছি।’
-‘তাতো দেখতেই পাচ্ছি।’
-‘তাহলে জিজ্ঞাসা করছো কেন?’
-‘বাসায় টিভি থাকতে আমার লেপটপের উপর হামলা করতে লজ্জা করল না আপনাদের?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-না, করলো না তো।’
-‘কেন করল না?’
-‘কারণ আমাদের লজ্জারও লজ্জা নেই? হে হে।’
-‘ওহ আচ্ছা, আচ্ছা, তার মানে আপনারা বেহায়া?’
-‘ভাইয়া! ভালো হচ্ছে না কিন্তু।’
-‘কি ভালো হচ্ছে না?’
-‘ঝগড়া কোরো না তো এখন যাও, পরে এসো।’
-‘আমার রুমে এসে আমাকে কি না বলছে.…….!’
এদের ভাইবোনের কথা শুনে এবার কুহু মুখ বাঁকিয়ে ঠান্ডা সুরে জবাব দিলো।
-‘না মানে হয়েছি কি ভাইয়া, আমরা আমাদের লজ্জা ডিপ ফ্রিজে ঠান্ডা করতে দিয়েছি। যা গরম পড়েছে! আপনি চিন্তা করবেন না একদমই লজ্জা ঠান্ডা হলেই আমার টুপ করে খেয়ে নিবো।’
একথা শুনে রিদওয়ান কিয়ৎকাল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এরপর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এদের এখন রুম থেকে বের করা যাবে না, সে নিশ্চয়ই। তাকে যেতে দেখে কুহু আর রিমি খিলখিল করে হেসে উঠল। রিদওয়ান যেতে যেতে তাদের হাসির শব্দ শুনল। রুপকের কথায় ঠিক, ‘বাড়ির মেয়েরা হাসলে বাড়িও হাসে। চারদিকে সুখ ছড়িয়ে পড়ে।’
প্রায় আধা ঘন্টা পর দু’জন পুরো মুভিটা শেষ করে তবেই উঠল। দুপুরের খাবার খেলো। একটু ঘুমালো। লং জার্নি করে সেদিন আর কেউই বের হলো না। তবে বিকেলের দিকে নেইবার হুডের রাস্তা অবধি হেঁটে এলো।
সন্ধ্যার দিকে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা হলো। এখন অবধি কুহুর ঠিকঠাক আছে দেখে সবাই যেন মনে মনে স্বস্ত্বির শ্বাস নিচ্ছে। তারপরের দিনটাও
ভালোই ভালোই কাটল। রিদওয়ান রুপক আর কুহুকে নিয়ে বের হলো।
খুব সুন্দর একটা কফিশপে কফি খেলো। এ দেশের সুন্দর সুন্দর জায়গা ঘুরে দেখাল। তারপর বাসায় ফিরে আম্মুকে ছবিগুলো পাঠাল। কতক্ষণ গল্প করল। হাসাহাসি করল। এরপরের দিন রিদওয়ানের বাসায় একজন গেস্ট এলো। নাম ডেইজি। কি যে মজার একজন মানুষ। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করে দেয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে উনি প্রায় ঊনিশটা দেশের ভাষায় কথা বলতে পারে। কুহু তো শুনেই অবাক। যদি বাংলা ভাষা স্পষ্ট নয় তবে বোঝার মতো। তাকে প্রথম দেখেই ডেইজি যে কথাটি বলেছে সেটা হলো,
– ‘ বলো তো, গরু কেন ঘাস খায়?’
-‘ক্ষুধা লাগে তাই।’
-‘উহুম, আরো একটা কারণ আছে। ভাবো তো। এরপর বলো।’
-‘ওর পছন্দ তাই।’
-‘উহুম হলো না।’
-‘তবে?’
-‘কারণ সে গরু তাই, হে হে হে।’
কুহু কিছুক্ষণ ড্যাব ড্যাব কর তাকিয়ে রইল তারপর সেও হেসে ফেলল। তাকে হাসতে দেখে ডেইজে বলল,
-‘পরিস্থিতি যেমনই হোক। সবকিছু সহজভাবে নিবা। এরপর সমাধান না পেলে তারপর কঠিন পথে হাঁটবা। আমরা হচ্ছি মনভোলার জাত। আর ভুলে যাওয়া মানুষের ধর্ম।’
-‘ভুলে যাওয়া মানুষের ধর্ম? কিভাবে?’
-‘যেমন আমিই বউয়ের গুঁতো খেয়ে রান্না করতে গেলাম। তার ফেভারিট পছন্দের ডিশ রান্না করলাম কিন্তু সল্ট দিতেই ভুলে গেলাম।’
এই কথা শুনে এবার পাশে বসে থাকা রিদওয়ান ফট করে বসে বসল।
-‘তা আপনি শিং ওয়ালা বউ কোথা থেকে জুটালেন? যে সে আপনাকে গুঁতো দেয়?’
একথা শুনে পুরো রুমের মধ্যে হাসির রোল পড়ল। ডেইজিও খুব হাসতে হাসতে জানাল, সব বউদের এক অদৃশ্য শিং থাকে। সেই শিং দিয়ে তারা গুঁতো দেয়। এজন্য নিরীহ স্বামীরা বউদের এত ভয় পায়। তা কুহুপাখি এবার কথা বলো তো শুনি।’
-‘আমার কি কথা বলব?’
-‘তুমি কি করতে পছন্দ করো। কি খেতে পছন্দ করো। দেশ নিয়ে কিছু বলো,শুনি।’
ডেইজির কথা শুনে কুহু এবার রুপকের দিকে তাকাল। ভাইয়ের ইশারা পেয়ে ডেইজির সঙ্গে গল্প করল অনেকক্ষণ। ডেইজি এক কথা বারবার করে সুধাল। শুনল। কুহুকে কথা দিয়ে খেলিয়ে নিলো। এমন এমন কথা বলল সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এভাবে কুহুর চিকিৎসার প্রথম ধাপ শুরু হলো। এরপর দেড় ঘন্টার মতো সময় কাটিয়ে সে চলে গেল। আর যাওয়ার আগে রিদওয়ানকে একটা পজেটিভ সাইন’ও দিয়ে গেল।
তা বুঝে রিদওয়ান মনে শুকরিয়া জ্ঞাপন করল। এদিকে রিমি আর কুহু
ডেইজির বলা কিছু কথাগুলো নিয়ে হাসছে। মানুষটা ভীষণ মজার কথা বলে। হাসায়। কুহুর খুব ভালো লেগেছে উনার সঙ্গে কথা বলে। আগামী সপ্তাহেও ডেইজি রিদওয়ানের বাসায় এলো। একইভাবে কথার মাধ্যমে
কুহুকে ব্যস্ত রাখল। কুহুকে এটা ওটা আনতে বলল। কুহু এনেও দিলো। কখনো কি আনতে বলল রান্নাঘরে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল। বললে সেটা আনতে আনতে বলল,
-‘কি ভুলো মন আমার। সব ভুলে যাই।’
-‘বলো কি! মানুষ তো বুড়ো হয়ে গেলে ভুলে যায়।’
-‘আমি তো বুড়ি না হতেই ভুলে যাচ্ছি।’
-‘ কারণ তুমি প্রচুর ভাবো।’
-‘যে কোনো জিনিস নিয়ে খুব ভালো।’
-‘আপনি কিভাবে জানলেন?’
-‘আরে বোকা মানুষ যত ভাবে তত পূর্বের কথা ভুলে যায়। ভাবনা যখন মস্তিষ্কে চাপ দেয় তখন মানুষ কথা ভুলে যায়,স্মৃতি ভুলে যায়, মস্তিষ্ক যত পারো ঠান্ডা রাখবে। কম ভাববে দেখবে মন মেজাজ ভালো থাকবে। সবকিছু ভালো লাগবে। খুশি লাগবে।’
-‘ভাবব না বললে কি আর হয়? ভাবনারা তো ভাবা থামায় না।’
-‘বলো কি! আমি একটা মেডিসিন সাজেস্ট করি তোমাকে?.খেলে দেখবে ভাবনা টাবনা লেগ গুটিয়ে পালাবে।’
-‘না, না, আমার মেডিসিন টেডিসিন খেতে ভালো লাগে না। আমি খাব না ওসব।’
-‘ওকে, ওকে, খেও না। তুমিও দেখি আমার মতো মেডিসিন খেতে চাও না। আমরা ভালো লাগে না খেতে। কিন্তু খায়। নিজের ভালো জন্য খেতে হয়।’
রাত্রি তখন সাড়ে দশটা। সবার ডিনার পর্ব শেষ। এরপর একচোট গল্পও হয়েছে। হয়েছে হাসাহাসি। নিলুফা ইয়াসমিন আর আতিকুল রহমান খুব টায়ার্ড। শপ আর অফিসে সময় দিতে হয়েছে। বাড়তি কাজও করেছে। এজন্য উনারা তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেল। আর রিমি আর কুহু টিভিতে সিরিয়াস দেখতে বসল। তা দেখে রিদওয়ান বকাবকি করলেও কেউ গা করল। টিভির দিকেই তাকিয়ে রইল। দুই ঘাড়ত্যাড়ার সঙ্গে না পেরে সে রুপককে বলে হাঁটতে বের হলো।৷ রুপক বাইরে যাওয়ার আগে বোনকে বারবার বলে গেল রিমির সঙ্গে থাকতে। সে চেনে না কিছু তাই একাএকা যেন বের না হয়।
কুহুও ভদ্র বালিকার মতো সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। তা দেখে রুপক নিশ্চিন্ত মনে বের হলো। তাদের যেতে দেখে রিমি আর কুহু ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে খেতে খেতে টিভি দেখতে লাগল।
সিরিয়াল শেষ হলো রিমির ফোনে তার ফ্রেন্ডসদের কলও এলো। তখন কুহু রিমিকে বলল তাকে ধরে রুমে দিয়ে আসতে। কুহু টিভি বন্ধ করে তাই করল। রিমিকে ধরে ধরে তার রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানার হেডবোর্ডে
হেলান দিয়ে বসাল। আঘাতপ্রাপ্ত পায়ের নিয়ে বালিশ দিয়ে দিলো। রিমি তাতে ভীষণ খুশি হলো। সে কল রিসিভ করে তার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে লাগল।
একপর্যায়ে কুহুর সঙ্গে রিমি তার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিলো। কুহু ভদ্র সূচক হাই হ্যালো করে কোনোমতে এড়িয়ে গেল। কারণ সে ইংলিশ বলতে পারে না। বোঝেও না। সে বরাবরই ইংলিশে কাঁচা। এ কথা তার বাসার সবাই জানলেও এরা তো আর জানে না। তাছাড়া এরা এত দ্রুতই ইংলিশ বলছে যেন মুখস্থ পড়া। রিমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পরিস্থিতি সামলে নিলো। সে নিজে লেগে গেল আড্ডা দিতে। আর কুহু চেয়ার টেনে বসল। কতক্ষণ বসে রিমিদের আড্ডা দিতে দেখে সে উঠে তার বরাদ্দকৃত রুমটাতে চলে এলো। এখন আর ভালো লাগছে না কিছু।
একা একা লাগছে। দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। বাবা কই! আম্মু কই! আম্মু আজ সারাদিন একবারও তাকে বকে নি। খেতে ডাকে নি। এজন্যই কি ভালো লাগছে না? ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব? তার চেনা রুমটাই বা কই? রুমের চেনা গন্ধটাই বা কোথায় হারালো? কেন সব হারিয়ে যাচ্ছে, দূরে সরে যাচ্ছে? সে রুমে ঢুকে মেঝের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো আশপাশ তাকাল। রুমের দেওয়াল গুলো সব ছোটো হয়ে যাচ্ছে কেন?
রুমের সবজিনিসপত্রগুলো চড়কির মত করে ঘুরছে কেন? মাথার ছাদ যেন নড়ছে। এতকিছু আর সে চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে বিরবির করছে। তার একবার স্মরণ হচ্ছে না রুমের লাইট আছে। সেটা জ্বালিয়ে দিতে। সে জড়বস্তুে মতো দাঁড়িয়ে থেকে বিরবির করেই যাচ্ছে, ‘ওহ আম্মু আমাকে বাঁচাও। এরা আমাকে মেরে ফেলবে। এরা আমাকে বাঁচতে দেবে না। আম্মু! আম্মু! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। আমি তোমার কাছে যাব,মা! ওহ মা! আমাকে বাঁচাও, মা।’
এসব বলতে বলতে তার পুরো শরীর কাঁপতে লাগল। সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুমে থেকে। টলাতে শরীর নিয়ে সিঁড়িতে পা দেওয়ামাত্রই ভর সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। এরপর একটা একটা করে সিঁড়ি পার হতে লাগল তার অসুস্থ শরীর। রিদওয়ান তখন ডায়নিং টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়েছে কেবল। রুপক লনে দাঁড়িয়ে ইসমত আরা বেগমের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। ইসমত আরা বেগম ফোন করে কাঁদছে। বাসাতে নাকি থাকতে পারছেন না। খালি উনার কানে কুহুর ডাক ভেসে আসছে। উনার মনে হচ্ছে মেয়েটা বার বার ডাকছে। রুপক বোঝাচ্ছে কুহু ঠিক আছে। উনাদের মা ছেলেকে কথা বলতে দেখে সে ভেতরে এসেছে। গলা ভেজানো দরকার। আর তখনই কিছু পড়ার শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
দেখে কুহু সিঁড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছে। লাস্ট সিঁড়ি পার করে মেঝেতে এসে পড়েছে কুহুর রক্তাক্ত দেহ। এই দৃশ্য দেখে রিদওয়ান কিছুক্ষণের জন্য হতবাক। সে ঠোঁটের কাছে গ্লাস ধরা অবস্থায় অনড় হয়ে তাকিয়ে রইল। যখন ঘটনা বুঝল তখন গ্লাস রেখে দৌড়ে গেল কুহুর কাছে। কুহুর রক্তাক্ত শরীর বুকে জড়িয়ে গাল থাবা দিয়ে ডাকল। কুহু সেন্সলেস। তার সাড়াশব্দ নেই। রিদওয়ান নিজেও দিশেহারা। সে কুহুর মাথা বুকে চেপে ধরে চিৎকার তার বাবা মাকে ডাকল। তখন তার পেছনে দাঁড়িয়ে কেউ করুণ কন্ঠে বলে উঠল, ‘বেঁচে আছে?’
রিদওয়ান বিষ্মিত দৃষ্টি নিয়ে পেছনে তাকাল। রুপক হাতে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিডিও করে ইসমত আরা বেগম। আর কথাটা ইসমত আরা বলেছে। ছেলের চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে নিলুফা ইয়াসমিন ও আতিকুল রহমান। উনারা রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে ভয়ে শিউরে উঠলেন। একপ্রকার দৌড়ে এসে ছেলেকে তাড়া দিলেন হসপিটালে যাওয়ার জন্য। এতক্ষণ যেন রিদওয়ানের হুঁশ এলো। সে কুহুকে কোলে তুলে ছুটল গাড়ির দিকে। আতিকুল রহমানও গাড়ির চাবি নিয়ে ছুটলেন ছেলের পিছু পিছু। রুপক এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শরীর যেন অসাড়।
তার হাতের ফোন গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। কল কেটে গেছে। নিলুফা ইয়াসমিন রুপককে ধাক্কা দিয়ে হসপিটালে যাওয়ার তাড়া দিলেন। কিন্তু রুপক উঠে দাঁড়াবে কি। তার শরীরও থরথর করে কাঁপছে। উনি দৌড়ে গিয়ে পানি এনে রুপকের মুখে ধরলেন। সামান্য একটু পানি খেয়েও সে উঠে দাঁড়াতে পারল না। এরপরও সে বাইরে গেল। রিদওয়ানের গাড়িটা ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। সে অসহায় দৃষ্টিতে নিলুফা ইয়াসমিনের দিকে তাকাল। সেও চেনা না কিছু। কোথায় যাবে। কোথায় খুঁজবে বোনকে।
সে এবার কান্নাভেজা চোখে নিলুফা ইয়াসমিনের দিকে তাকাল। উনিও ততক্ষণে আরেকটা গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। রিমিকেও বলে এসেছেন কুহুর কথা। বলার আগে মেয়েকে একটা থাপ্পড়ও বসিয়েছেন।
মেয়েটার দিকে নজর রাখতে বলছিল রিদওয়ান। অথচ এই মেয়ে তার ফ্রেন্ডদের নিয়ে মজে আছে। এখন কি বলবে রুপককে? কি বলে মুখ দেখাবে? মায়ের থাপ্পড় আর কথাগুলো শুনে একথা শুনে রিমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না সে। হয়তো কিছু বলতো কিন্তু শোনার সময় নেই দেখে উনি চলে এসেছেন।
এরপর উনি রিদওয়ানকে কল করে জেনে নিলেন কোন হসপিটালে যাচ্ছে তারা। রিদওয়ার বেস্ট একটা হসপিটালের নাম বলল। সেটা শুনে উনি রুপককে নিয়ে বেরিয়ে এলো। দশ মিনিটে উনারাও হসপিটালে পৌঁছে গেল। ততক্ষণে কুহুতে ওটিতে নিয়ে ইমার্জেন্সি ট্রিটমেন্ট শুরু করা হয়েছে। রক্ত লাগবে। উনারা তারা সবাই দাঁড়িয়ে আছে ওটির সামনে। রুপকের মুখের অবস্থা দেখে রিদওয়ান বুক কেঁপে উঠল। চোখ ভিজে গেল। কারণ রুপককে দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধ হেরে যাওয়ার সৈনিক। সে রুপককে কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা রুপক মাথা তুলে তাকাল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না।
ঠোঁট দু’টো কেঁপে উঠে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার সব চেষ্টা বুঝি বিফলেই গেল। আচ্ছা বোনটা বাঁচবে তো? দরকার নেই চিকিৎসার চলে যাবে তারা? বোন টা বেঁচে থাকুক। পাগল টাগল মাথা নষ্ট হোক তবুও বেঁচে থাকুক। রিদওয়ান রুপককের কষ্ট বুঝেও কিছু বলতে পারল না শুধু অশ্রুজমা চোখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তাছাড়া ডেইজি তাকে জানিয়েছে কুহুর সমস্যাটা ৫০% কমার সম্ভবনা আছে।
কিন্তু তাকে রেগুলার মেডিসিন খেতে হবে।সবচেয়ে বড় ভুল চিৎকার করতে করতে রুপকরা থেমে গিয়েছিল। যেটা একদম ঠিক হয় নি। রোগ যেহেতু জটিল সমাধাও জটিল হবে এটাই তোস্বাভাবিক। তবে দীর্ঘদিন মেডিসিন নিলে কুহু ঠিক থাকবে, সুস্থ থাকবে। এসব বলায় তারাও আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল। হঠাৎ এই অঘটনটা ঘটে গেল। কথা হচ্ছে, পড়ল কিভাবে? নিচে আসতে চাচ্ছিল নাকি অন্যকিছু? তাদের বের হওয়া বেশিক্ষণ হয়েছে তাও না। এরমধ্যেই এই অঘটন।
কথা আছে,’ রাখে আল্লাহ মারে কে!’ কুহুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মাথায় বেশ কয়েকটা স্ট্রিচ পড়েছে।হাতে, কাঁধে, কোমরে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে।
এখনো হসপিটালে আছে সে। তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আছে। মাথা আর কাঁধের ব্যথায় নড়া যাচ্ছে না। সে আশেপাশে কাউকে দেখল না। রুপকও নেই। একটুপরেই রিদওয়ান প্রবেশ করল। রুপক বাইরে আছে। এতক্ষণ কেবিনে সেই ছিল। বোনের হাত ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল।
তাকে কোনোমতে শান্ত করিয়ে চোখ, মুখে, পানি দিয়ে বাইরে বসিয়ে এলো। রিদওয়ান দেখল কুহু তার দিকে তাকিয়ে আছে। জ্ঞান ফিরেছে। তা দেখে রিদওয়ান সামনে বসে কিছু বলার আগেই কুহু বলল,
-‘যদি মারা যেতাম?’
-‘তোমার ভাই খুব কষ্ট পেতো।’
-‘আর কেউ পেতো না।’
-‘কি জানি, পেতো কি?’
-‘আমার এখানে ভালো লাগছে না। আমি বাংলাদেশে যাব। এই শহরে মায়া নেই। টান নেই। শান্তি নেই।’
-‘সব আছে। শুধু ধৈর্য্য ধরে খুঁজে নিতে হবে।’
-‘এত ধৈর্য্য আমার নেই।’
-‘হাল ছাড়লে কোনো কাজেই সফল হওয়া যায় না।’
-‘ দরকার নেই সফলতা।’
– সফলতা ছাড়া বাঁচতে পারবে?’
-‘খুব পারতাম।’
-‘ পারলেও। তুমি মারা গেলে, আমি কষ্ট পেতাম।’
-‘আসলেই কি তাই?’
-‘তাই তো।’
-‘আপনারা সবাই আমাকে মিথ্যা বলেন। মিথ্যা স্বাত্বণা দেন। আমি বুঝি।
আপনারা ভাবেন আমি অসুস্থ। এজন্য ডেইজি নামের লোকটাকে ডেকে এনেছেন। উনি একজন ডাক্তার। আমি ধরে ফেলেছি আপনাদের চাল।’
-‘এসব কথা কে বলেছে তোমাকে?’
-‘উনার পকেট থেকে একটা কার্ড পড়ে গিয়েছিল। আমি তুলে দেওয়ার সময় দেখে ফেলেছি। তবে আপনাদের অভিনয় কিন্তু দারুণ। অভিনব।
আপনারা ইচ্ছে করে আমাকে অসুস্থ বানাতে চাচ্ছেন।’
-‘তুমি ভুল বুঝছো? তোমাকে অসুস্থ বানিয়ে আমাদের কি লাভ বলো?’
-‘লাভ ক্ষতির হিসাব তো আমি জানি না। সেটা আপনারা ভালো জানেন।
তবে আপনাদের চালাকির মাশুল আপনাদের দিতে হবে, হবেই হবে।’
আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ২৫
-‘তুমি আমার কথাটা আগে শোনো..!’
-‘ভাইয়াকে বলুন, আমাকে দেশে রেখে আসতে। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি এখানে থেকে না নিয়ে গেলে আমি সত্যিই মারা যাব।’