আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ৩৭
নূরজাহান আক্তার আলো
পৃথিবীতে সবচেয়ে জঘন্যতম অভ্যাসের নাম ‘মায়া।’ জঘন্যতম বলার কারণ বিচ্ছেদ যন্ত্রণা। বুক পাঁজরের অদৃশ্য জ্বলন। শূন্য শূন্য ভাব। মায়া রুপী এক তরফা ভালোবাসার যন্ত্রণা দ্বিগুন। কাউকে বলা যায়; আর না ভোলা যায়; কিংবা সহ্য করা যায়। একা একা তড়পানোই যেন ভবিতব্য! যন্ত্রণাময়ী নিয়তি!
মনে মনে উক্ত কথাটি আওড়াতে আওড়াতে রিমি প্রস্থান করেছিল। আর তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রুপক হাসল। এই হাসির মানে অস্পষ্ট।
সে হয়তো হাসির কারণ মুখ ফোটে বলতে পারবে না। বলতে পারবে না সে মায়াতে আঁটকে গেছে। প্রতিদিন কথা বলতে বলতে রিমি তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর সেই অভ্যাসটাই পরিণত হয়েছে মায়া রুপে। মায়া রুপটা কখনো ভালোবাসা হয়ে ধরা দেবে? নাকি ভালোবাসার আরেক রুপ মায়া? না এসব নিয়ে ভাবলে তার চলবে না। কিছু কিছু জিনিসকে দূর রাখায় মঙ্গল। এসব ভেবে রুমের দরজা আঁটকে ফ্রেশ না হয়ে শুয়ে পড়ল। ক্লান্তি জেঁকে ধরেছে সর্বাঙ্গে অথচ চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মনে অশান্তি। চোখের সামনে ভাসছে কারো অভিমানী মুখ। অভিমানে পূর্ণ করা কারো মায়াবী চোখ। সে এক বুক অশান্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের দিকে। ভাবতে লাগল তার মনের একান্ত কিছু কথা। যে কথাগুলো সে সর্বদা লুকিয়ে রাখতে প্রস্তুত। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। কারণ মন তার কথা শোনে না। বারণ শুনে না? বাঁধা মানে না? কেন শুনে না তাও জানে না। তবে মনের উপর প্রচন্ড বিরক্ত সে।
মনটা কেন নিষিদ্ধ কারো মায়াতে আঁটকাবে? পৃথিবীতে মেয়ে ছিল না? নাকি কার মন কানা? শেষে কী না, প্রেম নিয়ে উপদেশ মূলত কিছু লেকচার দিতে গিয়ে সেই কী না হোঁচট খেলো তার প্রতি। ছিঃ! ছিঃ! রিদওয়ান জানলে কী হবে? তাকে নিশ্চয়ই জুতো পেটা করবে। এজন্যই কারো ব্রেকআপ হলে আগ বাড়িয়ে জ্ঞান দিতে যেতে নেই। সে ভেবেছিল মেয়েটার সদ্য প্রেমিক হারালো একটু সময় দিক, কথা বলুক, মিশুক, এতে যদি ছোট মেয়েটার মন ভালো হয়। হাসে। মেয়েটাকে হাসাতে গিয়ে এখন সে প্রেম নামক ফাঁসিতে ঝুলছে। না পারছে মরতে আর না পারছে সত্যটা মেনে নিতে। তাছাড়া রিমি ছোটো মানুষ। সে কিভাবে দূর্বল হলো তার প্রতি?
তার যাই বলুক, রিমির আবেগ দায়ী এসবের মূলে সঙ্গে সমান দায়ী সে নিজেও। তারা কখা বলা শুরু না করলে জল এত গড়াতো না। আর না অশান্তি নিয়ে দিনরাত পার করতে হতো। মনে মনে এসব ভেবে সে তার ফোন থেকে নিজেও রিমিকে ব্লক দিয়ে রাখল। যাতে রিমি ব্লক আনব্লক করলে তাকে মেসেজ দিতে না পারে। ফোন নাম্বার রাখল ব্ল্যাকলিস্টে।
পাগলের সঙ্গে পাগলামি করলে চলবে না। সে মানুষ। তারও মন আছে। অনুভূতি আছে। সেই সঙ্গে এটাও স্মরণে রাখতে হবে বন্ধুর কথা। অসুস্থ বোনের কথা। বোনের জন্য সব করতে পারবে। সদ্য গড়ানো অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করতেও পারবে। এতদিন পর বোন সুখের মুখ দেখেছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। এত সব বাঁধা পেরিয়ে রিদওয়ানের হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।তারা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতেও শুরু করেছে। এই মুহূর্তে তার আর রিমির কথা সবাই জানলে তাদের সম্পর্কে আঘাত আসতে পারে? যেটাভাই/বন্ধু হয়ে সে কখনো চায় না। কষ্ট হবে হোক, তবুও এমন কিছু করবে না যেখানে বোনের দিকে আঙুল ওঠে?
এসব নানান কথা ভেবে রুপক শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ওয়াশরুমে চলে গেল। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েও গেল। ঠান্ডা পানি মাথা বেয়ে শরীর ভিজাতে লাগল। আর সে তার নেত্রজোড়া বন্ধ করে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে সেকেন্ড গেল, মিনিট গেল, এরপর এক ঘন্টার পার হলো। শরীরও ঠান্ডা হয়ে এলো। অথচ বুকের জ্বালাপোড়া একচুলও কমল না।
একচুলও না!
ওদিকে রিদওয়ান রুপককে ক’বার কল দিয়েও রেসপন্স পেলো না। সে নিজেও গিয়ে নক করল তবুও সাড়া পেল না। তাই কাজের ছেলেটাকে বলল চলে যেতে। রুপক বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। লং জার্ণি করে ক্লান্ত ছিল শোয়া মাত্রই ঘুম। জেগে থাকলে এতক্ষণ সাড়া দিতো নিশ্চয়ই।
রিদওয়ানের কথা শুনে ছেলেটা চলে গেল। আর রিদওয়ান গেল তাদের রুমে। কুহু সদ্য ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে ট্রে এর সামনে বসে মিষ্টি খাচ্ছে। তার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। এখন ছটপট কিছু না খেলে হাত-পা কাঁপতে শুরু করবে। কড়া পাওয়ারের মেডিসিন খায় এজন্য’ই হয়তো।
তখন রিদওয়ান এসে রুমের দরজা আঁটকে কুহুর চুলের তোয়ালে খুলে চুলগুলো মুছে দিলো। কুহু কিছুই বলল না। কি বা বলবে যার কাজ সেই করছে। এমনটা যে রিদওয়ান এই কাজটা প্রথমবার করছে। বিয়ের পর থেকেই করে। এবং স্বেচ্ছায় করে। কুহু খেতে খেতে রিদওয়ানরের মুখেও এটা ওটা তুলে দিলো। রিদওয়ান খেলো। খেতে খেতেই কুহুর ভেজা চুল ড্রায়ার দিয়ে শুকানোর ব্যবস্থা করল। এরপর তারা শুয়ে পড়ল। হঠাৎ কুহু রিদওয়ানের মুখপানে তাকিয়ে বলল,
-‘স্থায়ীভাবে দেশে তো চলে এলাম, তাই না? এখন থেকে তো এখানেই থাকব। বলছিলাম যে, আপনি আবার কলেজে জয়েন্ট করুক।’
-‘তারপর?’
-‘তারপর আবার কি?’
-‘ সেটাই তো তুমি বলবা। ‘
-‘অনেকের মতে ,আপনি টিচার হিসাবে পারফেক্ট। আপনি যখন চলে গেলেন সবাই আপনাকে খুব মিস করেছিল। তারা চাচ্ছিল আপনি ফিরে আসুন।’
-‘অনেকের মতে? তা আপনার মতে আমি কি পারফেক্ট টিচার ছিলাম?’
-‘আমার অভিজ্ঞতা খুবই বাজে তাই আমার মত জানানো যাবে না।’
-‘ তবুও বলুন শুনি।’
-‘সত্যি বলব?’
-‘বলুন।’
-‘রাগ করা যাবে না কিন্তু? ‘
-‘ওকে।’
-‘আমার মতে টিচার হিসাবে আপনি খুব, খুব খারাপ। এটিটিউডওয়ালা।
ভাবওয়ালা। শুধু শুধু মারতেন। ধমকাতেন। দাঁড় করিয়ে রাখতেন। আমার মতে আপনি একজন ছিঃ! মার্কা টিচার।’
-‘আমি এটিটিউডওয়ালা? ভাব ওয়ালা? ছিঃ, মার্কা?’
-‘এভাবে তাকাচ্ছেন কেন, আশ্চর্য তো! এজন্যই তো সত্যি বলতে চাই নি।’
-‘কত বড় সাহস আমাকে বলে আমি নাকি ‘ভাব ওয়ালা।’
-‘বেশ করেছি। শুনতে চাইলেন কেন? আর পরিচয় হওয়ার ঘটনা ভুলে গেছেন? নাকি তার পরের কাহিনিগুলো ভুলে গেছেন, কোনটা?’
-‘তোমার মনে আছে সেসব কথা?’
-‘আছে তো।’
-‘সত্যি মনে আছে?’
-‘আছে তো। আপনাকে প্রথমে ভুল ঠিকানা দেখিয়েছিলাম। সত্যি বলতে দুষ্টামি করে কাজটা করেছিলাম। খুব আনন্দ’ও পেয়েছিলাম। তারপর কলেজে গিয়ে দেখি আপনি আমার ক্লাস টিচার। এরপর থেকেই মরার
উপর ফাঁড়ার ঘা শুরু হয়েছিল। কোনোমতে কলেজ থেকে ফিরে বাসায় এসে দেখি আপনি আমার বাসাতেই সাহেবী স্টাইলে বসে আছেন। পরে শুনলাম আপনি ভাইয়ার বন্ধু। একের পর একেকটা বাঁশ খেলাম। গাল থাবড়ে তওবা করলাম এমন দুষ্টুমি আর করব না। ভাইয়াকে যদি বলে দেন এই নিয়েও খুব চিন্তায় থাকতাম। এখানেই থামে নি ব্যাপারটা পরে শুনলাম আপনি নাকি আমাদের বাসায় থাকবেন এবং আপনার কাছে আমাকে পড়তে হবে। তখন আমার অবস্থা হয়েছিল ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। তখন আমার এক একটা দিন ছিল বিপদের। কত ভয়ে ভয়েই যে থাকতাম।
-‘এত ভয়ের কারণ কি?’
-‘শুধু শুধু মারলে, ধমকালে, ভয় লাগবে না? দুই হাতে মেরে কি অবস্থা করেছিলেন, মনে নেই? পাষাণ লোক একটা।’
-‘ বেশ করেছি। ওইরকম কিছু আমার নজরে এলে আবার মার খাবে। মারের উপর মার। কোনো কথা হবে না আগে মার তারপর কথা।’
-‘ যারা যারা পড়া পারে নি তাদের এতজোরে মেরেছিলেন না। আমাকে শুধু ওই রকম পাষাণের মতো মেরেছিলেন।’
-‘কেন মেরেছিলাম আন্দাজও করতে পারো নি তাই না?’
-‘কেন আবার, পড়া পারি নি তাই মেরেছিলেন?’
-‘না। মেরেছিলাম ভি-বেল্ট সরার কারণে। একবার নয় বেশ কয়েকবার সেইম।কাজ। আর বলতেও পারছিলাম না কিছু। তাই ওভাবে মেরে রাগ মিটিয়েছিলাম। বড় হয়েছেন। বুঝে হবে অনেক কিছু তাই না?’
আজকে আসল ঘটনা জেনে কুহু ড্যাব ড্যাব করে রিদওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে রিদওয়ান তার নাক টেনে দিয়ে হাসল। কুহু তখন ভ্রুঁকুটি করে বলল,
-‘আপনি আসলেই লুচু মার্কা। আমি আপনার স্টুডেন্ট ছিলাম। আপনার চোখ কেন আমার ওইদিকে, হ্যাুঁ! লজ্জা লাগে না স্টুডেন্টের দিকে ওভাবে তাকাতে?’
-‘স্টুডেন্ট যদি দেখানোর মতো করে রাখে তাহলে আমার কি দোষ? ‘
-‘আমি কি ইচ্ছে করেছি?’
-‘আমিও কি ইচ্ছে করে দেখেছি? স্বাভাবিকভাবে তাকাতে দিকে নজরে এসেছে।’
-‘এই লোক সরুন। সরুন বলছি। আপনার মতো লুচু মার্কা বর লাগবে না আমার।’
একথা শুনে রিদওয়ান সরলো না বরং আরো শক্ত করে জাপটে ধরল।
জোরপূর্বক আদর আকঁলো কুহুর দুই গালে, কপালে, থুতনির ভাঁজে।
কুহু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে একটা সময় থেমেও গেল।
তারপর শান্ত হয়ে রিদওয়ানের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে নিলো। এবং ঘুমিয়ে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। রিদওয়ান হাসল ওর কান্ড দেখে।
তবে তার খুব জানতে ইচ্ছে করল কুহুর কী এখন মনে আছে ওই ঘটনার কথা। যে ঘটনার প্রেক্ষিতে সে রেগে গিয়ে কুহুদের বাসা ত্যাগ করেছিল।
যোগাযোগ বন্ধ করেছিল। মনে মনে আবার ভাবল পুরনো কথা উঠিয়ে মুড নষ্ট করা ঠিক হবে না। পুরনো কথা বাদ। তাছাড়া কুহু ভুলে গিয়েও থাকে তাহলে তাকে খুঁচিয়ে মনে করানো বোকামি হবে। বলা বাহুল্য, যা বাস্তব, যা ঘটেছে, মেডিসিনের মাধ্যমে কুহু ধীরে ধীরে সেসব কথা মনে করতে পারবে। তার মনেও পড়বে। আর যেগুলো ছিল কল্পনা সেগুলোই তার ব্রেণ থেকে আবছা হয়ে মুছে যাবে। এরপর এসব চিন্তার বাদ দিয়ে রিদওয়ানও নিশ্চিন্তে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
সেদিন রাতটা কেউ কেউ জেগে চোখের পানি ফেললো কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পার করল। আগামীকাল রিমির জন্মদিন। অনুষ্ঠানের ঝামেলায় যেন যাওয়া নাহয় রিমি আগে তা বলে দিয়েছে। তবুও পারিবারিকভাবে
ছোটো খাটো একটা অনুষ্ঠানে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আতিকুর রহমান।
এতে সায় জানিয়েছে নিলুফা ইয়াসমিনও। পরেরদিন সকালবেলা। নতুন একটি ভোর। নতুন একটি সকাল। দীর্ঘ লং জার্ণিন লেকজেট কাটে নি কুহু, রিদওয়ানের। তাছাড়া দেরি করে ঘুমানোর কারণে তারা বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠল। ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে এগারোটা।
আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ৩৬
ঘুম থেকে উঠে কুহু জানল রুপক সকাল সকাল বাসায় চলে গেছে। তার নাকি খুব জরুরি কাজ পড়ে গেছে। একথা শুনে কুহু কিছু বলল না রিদওয়ানের সঙ্গে সকালের নাস্তা করতে বসল। আতিকুল রহমান বাসায় নেই, রিমি রুমে আছে, নিলুফা ইয়াসমিন রান্নাঘরে কিসব লাগবে না লাগবে তারই লিস্ট করছেন। তখন কলিংবেশ বেজে উঠল। কুহু এঁটো হাতে উঠতে গেলে নিলুফা ইয়াসমিন বাঁধ সাধলেন। কুহুকে খেতে বলে উনিই গেলেন দরজা খুলতে।