আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ৩৯
নূরজাহান আক্তার আলো
চারিদিকে আনন্দ সমাগম। হইহই রব। চেনা অচেনা বহু মানুষদের ভিড়ে রিদওয়ানদের ড্রয়িংরুম গিজগিজ করছে। সেখানে অনুষ্ঠানের গেষ্টদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন নিলুফা ইয়াসমিন। তিনি নিজেও কিছু কিছু মানুষকে চিনে না আবার অনেককে চিনেন না। কখনো দেখেও নি। তাও
হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছেন।পাশে দাঁড়ানো আতিকুল রহমান উৎফুল্লের সঙ্গে উনাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এতদিন পর উনাদের একসঙ্গে দেখে একটা চাপা গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেকে আড় চোখে দেখে যাচ্ছেন আভিজাত্যপূর্ণ পোশাকে আবৃত করা নিলুফা ইয়াসমিনের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে। এ বয়সেও তিনি যথেষ্ট স্মার্ট।উনার বাচনভঙ্গি
, হাঁটা চলা, হাসি, সব কিছু পাফেক্ট লেভেলের। যেটা সহজে সবার নজর কাড়ছে। আতিকুল রহমান হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন রিদওয়ান, কুহু, রিমি, তিনজনের একজনও এখানে নেই। তারা এখনো নিচে’ই নামে নি।
উনি নিলুফা ইয়াসমিনকে ইশারায় সাইডে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘আচ্ছা ছেলে মেয়েরা কই? নামছে না কেন তারা? সবাই তাদের কথা জিজ্ঞাসা করছে। কোনো সমস্যা হলো নাকি, এত দেরি হওয়ার তো কথা না?’
-‘ উপরে গিয়ে দেখছি আমি।’
-‘কুহুর বাবা মাও তো এখনো এলো না।’
-‘দুপুরে ওভাবে চলে গেল কেন সেটাই তো বুঝলাম না। কুহু নিশ্চয়ই কিছু বলেছে।’
-‘বারণ করো নি?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘করেছিলাম। শোনে নি।’
-‘আচ্ছা তুমি গিয়ে দেখো রিমির হলো নাকি? রাত বাড়ছে। ‘
-‘হুম।’
-‘আর শোনো?’
-‘হুম।’
-‘রিদওয়ান আমার কল ধরছে না রেগে আছে বোধহয়। তাকে বলো রাগ টাগ পরে দেখাতে। এখন যেন নিচে নামে। আমি বাবা। আমার মেয়ের জন্য যেটা মঙ্গলজনক আমি সেটাই করব।’
-‘রিদওয়ানের যুক্তিটাও কিন্তু মন্দ নয়। রিমি তার বোন। সেও নিশ্চয়ই বোনের খারাপ চাইবে না, তাই না?’
-‘তাই বলে, এভাবে?’
-‘সমস্যা কি তাতে?’
একথা বলে পা বাড়াতেই সব লাইট বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার।
কথাবার্তা গুঞ্জন বেড়ে গেল। নিলুফা ইয়াসমিনও থমকে দাঁড়িয়ে গেল। লোডশেডিং কিংবা কোনো সমস্যা হলো নাকি দেখার জন্য আতিকুলও রাজুকে ডাকতে উদ্যত হয়েছেন। তখন হঠাৎ একটা নীল আলো জ্বলে উঠল সিঁড়ির কাছে। আলোটা এঁকে বেঁকে এদিক ওদিকে যাচ্ছে। তখন কেউ একজন সেখানে এসে দাঁড়াল। আবছা তবে মেয়েলি অবয়। মুখটা নিচু থাকায় কেউ দেখতে পারল না। তবে তার পরণে বিশাল ঘেরওয়ালা পার্টি গাউন। লম্বা খোলা চুলগুলো কার্ল স্টাইলে বাঁধা।মাথায় ক্রাউন। সে ধীরে ধীরে নামতে নামতে উজ্জ্বল আলোয় তার মুখ স্পষ্ট হলো। অচেনা মেয়েটিকে কেউ চিনে না অথচ সবার মুগ্ধ দৃষ্টি তার দিকেই। অনেকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল পুতুল মুখের মেয়েটির দিকে। তখন বার্থডে টোন বেজে উঠল। সে যে বার্থডে গার্ল স্পষ্টও হলো। সবাই করোতালি দিলো।
মুখোরিত হলো চারিপাশ। মায়ের ইশারায় রিমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। চারিদিকে আলোয় আলোয় ভরে গেল। ভীষণণ সুন্দর দেখাচ্ছে
তাকে। স্বল্প সাজে যেন জীবন্ত পুতুল একটা। আতিকুল রহমান মুখভর্তি হেসে এগিয়ে গেলেন। মেয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বেশ গর্ব করে সবাইকে জানালেন এটাই উনার একমাত্র মেয়ে; রিমি। রিমিকে বেশির ভাগ মানুষ দেখে নি চিনে না। তাই সবার দৃষ্টি এখন তার দিকেই। এত এত মানুষের দৃষ্টি তার দিকে থাকার পরেও রিমির মধ্যে নার্ভাসনেস কাজ করছে না।
আনইজি ফিল করছে না। হাত-পা ঘামা তো দূর তার কোনো ফিলিংসই কাজ করছে না। তবে তার চোখ দুটো বড়ই চঞ্চল। কাউকে খুঁজছে সে।
কাঙ্ক্ষিত সেই মানুষটি তার আশে পাশে নেই দেখে সে দীর্ঘশ্বাস চেপে স্মার্টলি হেঁটে এসে বাবা মায়ের পাশে দাঁড়াল। মুখে আঁটল মিষ্টি হাসি।
নিলুফা ইয়াসমিন মেয়ের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’একবার পরখ করে নিলেন। সব ঠিক আছে দেখে পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন সিঁড়ির দিকে। আর দুজন কই? তারা আসছে না কেন? রুমে তৈরি হতে গিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে বসে আছে নাকি কে জানে! ছেলেটাও আজকাল
ছোটোদের মতো ঝগড়া করে কুহুর সঙ্গে। মেয়েটার পেছনে কোনো না কারণে লেগেই থাকে। এদিকে রিমির সঙ্গে কথা বলতে অনেকে এগিয়ে এসেছে। কিছু না কিছু জিজ্ঞাসা করছে। রিমি সুন্দর করে জবাব দিচ্ছে।
উনি মনে মনে বিরক্ত হয়ে সময়ও দেখে নিলেন। রাত বাজে এগারোটা।
আর দেরি করা ঠিক হবে না ভেবে উনি রিদওয়ানকে ডাকতে যাওয়ার আগে আরেকবার সিঁড়ির দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে উনার চোখ মুখে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল। রিদওয়ান আর কুহু একসাথে নামছে। কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে দু’টোকে। রিদওয়ানের পরণে ব্ল্যাক শুট আর কুহুর পরণে ব্ল্যাক শাড়ি। কুহুর শাড়িটা খুব বেশি জমকালো না। বলা বাহুল্য, পার্টির জন্য একেবারে পারফেক্ট। চুলটাও বেঁধেছে চমৎকারভাবে। স্বল্প সাজ। তাদেরকে নামতে দেখে এবার সবার দৃষ্টি রিমির থেকে সরে গিয়ে বিঁধল সিঁড়ির দিকে। তাতে গুঞ্জন বেড়ে গেল। তারাও ধীরে ধীরে নেমে বাবা মায়ের পাশে পাশে দাঁড়াল।
পাঁচজনের সুখী পরিবার। আতিকুর রহমান এবারও সবার সঙ্গে,পরিচয় করিয়ে দিলেন পুত্র এবং পুত্রবধূর সঙ্গে। পরিচয় পর্ব সেরে শেষ হলো কেক কাটার আয়োজন করা হচ্ছে। রিদওয়ান আশেপাশে কিছু বন্ধুদের দেখে পা বাড়ালো সেইদিকে। সর্তক দৃষ্টিতে খেয়াল করল সবাই থাকলেও এখানে রুপক নেই। রুপক আসে নি। সারাদিন তার কল রিসিভ করে নি। রাগে তার হাত নিশপিশ করতে লাগল। কড়া কিছু বলার জন্য ফোন বের করার আগেই সেখানে রুপক হাজির হলো। রিদওয়ান তাকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকাতেই রুপক গালভর্তি হেসে বলল,
-‘ জ্যামে পড়েছিলাম ভাই তাই একটু দেরি হলো। কুহু কই? সব ঠিকঠাক তো?’
-‘আঙ্কেল আন্টি কই?’
-‘ওই যে আসছে।’
-‘সারাদিন ফোন ধরিস নি কেন?’
-‘ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। একঘুমে দিন পার করেছি।’
-‘ওহ।’
-‘ আচ্ছা দাঁড়া বার্থডে গার্লের সঙ্গে একটু কথা বলে গিফ্ট দিয়ে আসি।’
-‘না।’
-‘কি না?’
-‘রিমির সঙ্গে কথা বলবি না?’
-‘ কেন?’
-‘আমি বারণ করছি তাই।’
-‘বারণ করবি কেন? বারণই যদি করবি তাহলে এখানে আসতে বলার মানে কি?’
-‘সব ‘মানের’ মানে জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই।’
-‘কি হয়েছে বলবি তো নাকি? রেগে আছিস কেন?’
-‘নিজেকে একটু বেশিই চালাক ভাবিস, তাই না?’
-‘মানে?’
-‘মানেটা তো আমার থেকে তুই ভালো জানিস।’
-‘আরে ভাই কি হয়েছে? কি করেছি আমি?’
-‘তুই নিজে নাহয় ভাব।’
হঠাৎ রিদওয়ানের এমন আচরণে রুপক অবাকই হলো। তার চোখ মুখে একপ্রকার বিষ্ময় খেলে গেল। হঠাৎ একথা কেন? রিদওয়ান তো এভাবে কথা বলে না। সে আড়চোখে একবার দেখে নিলো প্রিয় বন্ধুকে। অজানা একটা ভয় কাজ করছে তার মনে। রিমি কি কিছু বলেছে রিদওয়ানকে?
কি বলেছে? কতটুকু বলেছে? সে এ ব্যাপারে কথা বাড়াতে চাইল না তাই কুহুকে দেখে ডেকে উঠল। কুহু ভাইকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। বোনের কাজে রুপক হতবাক।সে একবার রিদওয়ানের দিকে তো একবার কুহুুর যাওয়ার দিকে তাকাল। তখন গেস্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কেক কাটার পর্বও শুরু হলো। রিমি বাবা_মায়ের হাত ধরে বিশাল বড় কেক কেটে সবাইকে খাওয়াল। বাদ গেল না রিদওয়ানের বাম পাশে দাঁড়ানো রুপকও। বেচারা অভদ্রতার খাতিরে কেকটুকু মুখে নিয়ে আর গিলতে পারছি না। বুকের ভেতর যন্ত্রণাদায়ক একটা কাটা খচখচ করে
তাকে রক্তাক্ত করছিল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ওদিকে কেক কাটার পর্ব শেষ করতেই রিদওয়ান এবার এগিয়ে গেল। মাইক্রোফোন হাতে নিলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে। সে বোনকে নিয়ে কিছু কথা বলে বলল,
-‘প্রতিবার তোমার জন্মদিনে তোমার জন্য দু’টো করে গিফট রেডি রাখি আমি। এবারও আছে। গতবারের জন্মদিনে তোমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘বার্থডে গিফ্ট হিসেবে আমার থেকে কি চাও? র্নিদ্বিধায় সেটা বলতে পারো।’ তুমি আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে মন খারাপের সুরে বলেছিল, ‘ একটা পরিবার। এক টুকরো সুখ। সময় অসময়ে আবদার পূরণ করা কিছুু মানুষ।’ আমি বুঝেছিলাম তোমার চাওয়াকে। তাই কিছু দিন সময় চেয়েছিলাম। আজ তোমার সেই চাওয়া পূরণ করেছি।
একটু দেরি হলেও অপরিপূর্ণ রাখি নি। বছর ঘুরে আজও তোমার জন্ম দিন।
একইভাবে আজও জিজ্ঞাসা করছি, ‘বলো কি চাও? যেটাই চাইবে ভাই হিসেবে এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।’
রিদওয়ানের কথা শুনে রিমি ছলছল করে তাকিয়ে আছে। বাবাকে সে ছোটো থেকেই কাছে পায় নি। কিন্তু আবদার পূরণের মানুষটা ছিল তার ভাইয়াই। যখন যেটা চেয়েছে এনে দিয়েছে। এতদিন যা চেয়েছিল আজ
সেসব চাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। সে বড় হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। তাই এখন আর পুতুল, ফোন, হাজিবাজি প্রতি আগ্রহ নেই। সে ভাইয়ার দিকে
একবার তাকাল। মুখভর্তি হাসল। এরপর ছলছল চোখ নিয়েই হাসিমুখে বলল,
-‘আমি এখন বড় হয়েছি ভাইয়া। এখন আর পুতুল, সাইকেল, কিংবা রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার আবদার করব না। সুযোগ দিচ্ছো ভেবে দাও কারণ এবার আমি ছোটো মোটো কিছু চাইব না। এখন বড় হয়েছি তাই আবদারও বড় সড় কিছুই হবে।’
-‘হোক।’
-‘তাহলে আমাকে একটা বিশ্বস্ত হাত খুঁজে দাও। বাবা কিংবা তোমার পরে যে আমাকে ভালো রাখবে। যার কাছে আমি নিরাপদে থাকব।’
উপস্থিতি সকলে বিষ্মিত। এমন দৃশ্য তারা কেউ কখনো দেখে নি।কোনো ভাই এভাবে কোনো বোনের চাওয়া পূরণ করে? বোনও এভাবে ভাইকে তার মনের কথা জানাতে পারে, আশ্চর্য! তাও এমন অদ্ভুত চাওয়া। তবে বোনের আবদার শুনে রিদওয়ান মুচকি হাসল। হাসতে হাসতেই সরাসরি তাকাল অদূরে দাঁড়ানো রুপকের দিকে। রুপক হতভম্ব। মজার ব্যাপার হলো রিদওয়ানের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবার দৃষ্টি এখন রুপকের দিকে।
সেকেন্ডের মধ্যেই স্পষ্ট হলো অনেককিছুই। রিদওয়ান রুুপককে ডাকল।
রুপক দ্রুত হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে ধীরে পায়ে এগিয়ে গেল বন্ধুর দিকে।
রিদওয়ান এবার রুপককে বলল,
আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব ৩৮
-‘আমার বোন চেয়েছে বিশ্বস্ত হাত। বিশ্বস্ত হাত খুুঁজতে গিয়ে তোকে ছাড়া আর কাউকেই আমার নজরে পড়ল না। আমার বোনের বিশ্বস্ত কেউ হবি? সরাসরিই বলছি, আমি তোকে আমার বোনের দায়িত্ব দিতে রাজি। নিবি আমার বোনের দায়িত্ব?’
-‘হুম।’
এবার ইসমত আরা এগিয়ে এলেন। ছেলের হাতে একটি রিং ধরিয়ে দিয়ে ইশারা করলেন রিমিকে পরিয়ে দিতে।